সাইক্লিস্ট

সাইক্লিস্ট

ময়ূখের বেশ পছন্দ হয়ে গেল বাড়িটা৷ চারপাশটা ছায়াময়৷ শালগাছে ঘেরা৷ বাড়ির সামনে থেকে একটা রাস্তা শালবনের গা ঘেঁষে এগিয়ে হারিয়ে গেছে একটা বাঁকের আড়ালে৷ বাঁকের ওপাশে মনে হয় একটা নদী আছে, দূর থেকে চিকচিক করছে জায়গাটা৷ নিঝুম দুপুরে শালের বন থেকে ভেসে আসছে পাতা খসার অস্পষ্ট সরসর শব্দ, কখনো বা নাম-না-জানা পাখির ডাক৷ এর মধ্যেই একলা দাঁড়িয়ে আছে ঢালু ছাদঅলা ছিমছাম ছোট্ট বাড়িটা৷

ভাড়া সংক্রান্ত প্রাথমিক কথাবার্তা মিটে যাবার পর বাড়ির বৃদ্ধা মালকিন ময়ূখকে তার থাকার জন্য যে ঘরটা দেওয়া হচ্ছে সেখানে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘আমি কোনোদিন ঘর ভাড়া দিইনি৷ আসলে আমার স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থ৷ বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, কথাবার্তাও বলতে পারেন না৷ আমাদের সঞ্চয় শেষ হয়ে এসেছে৷ তাঁর ওষুধপত্রের জন্য টাকার প্রয়োজন৷ সেজন্যই ভাড়া দিতে হচ্ছে৷ উনি ওপাশের একটা ঘরে থাকেন৷’

বৃদ্ধার সঙ্গে ঘরে ঢুকল ময়ূখ৷ সুন্দরভাবে সাজানো ঘরটা৷ খাট, আলমারি, লেখার জন্য টেবিল, সবকিছুই আছে৷ বেশ বড়ো একটা জানলাও আছে রাস্তার দিকে৷ আর সেই জানলার পাশে দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে তেলরঙে আঁকা একটা বড়ো ছবি৷ সে ছবিটা ভালো করে দেখার পর বেশ অবাক হয়ে গেল ময়ূখ৷ আরে জানলা দিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তা সব কিছুই তো দেখা যাচ্ছে ছবিটাতে৷ যেন এই জানলার সামনে বসেই কেউ এঁকেছিলেন ছবিটা৷ ওই তো কম্পাউন্ডের বাইরে গেটের বাঁপাশে অন্যদের থেকে কিছুটা তফাতে একলা দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট শালগাছটা! ওই তো আরও কিছুটা এগিয়ে পথের ডানপাশে উঁচু ঢিবি মতো জায়গাটা! লাল কাঁকর বিছানো রাস্তা, ওই তো বাঁকটা! ছবির চাঁদের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! শালবনের মাথার ওপর সোনার থালার মতো চাঁদ উঠেছে৷ সে আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে শালের বাগান, আর তার মধ্যে নিয়ে এগিয়ে চলা রাস্তাটা৷ শুধু একটা জিনিস বাড়তি আছে ছবিটাতে৷ দূরে বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছে একজন সাইক্লিস্ট৷ তার ছবিটা এত ছোটো যে তার মুখ বোঝা যাচ্ছে না, তাছাড়া মাথায় একটা টুপিও সম্ভবত আছে৷ তবে তার দাঁড়াবার ভঙ্গি দেখে মনে হয় চন্দ্রালোকিত রাস্তা ধরে সে যেন এ বাড়ির দিকেই আসছে!

ময়ূখ অবাক হয়ে বৃদ্ধাকে জিগ্যেস করল, ‘ছবিটা কার আঁকা?’

বৃদ্ধা মৃদু হেসে বললেন, ‘আমার স্বামীর৷ অনেক পুরোনো ছবি৷ আসলে পঞ্চাশ বছর আগে উনি আর্ট কলেজের যখন ছাত্র ছিলেন তখন উনি আর তাঁর এক বন্ধু এখানে এসেছিলেন ছবি আঁকার জন্য৷ এ জায়গা দুজনেরই ভালো লেগে গেল৷ কাজ জুটিয়ে এখানেই থেকে গেলেন তাঁরা৷ সাইকেল নিয়ে দুই বন্ধু মিলে ঘুরে বেড়াতেন এই রাস্তায়, শালের জঙ্গলে…৷’ একথা বলার পর ভদ্রমহিলা প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, ‘আপনার ঘর পছন্দ হয়েছে তো?’

ময়ূখের ঘর পছন্দ না হবার মতো ব্যাপার নেই৷ তাছাড়া সে তো মাত্র তিনরাত কাটাবে এ ঘরে৷ এখানে একটা সরকারি অফিসে অডিট অর্থাৎ হিসাব পরীক্ষার জন্য সে এসেছে৷ সারাদিন তার সেখানেই কাটবে৷ শুধু রাতটুকু শোবার জন্যই তার এ ঘরের ব্যবস্থা৷ রান্নারও কোনো পাট নেই তার৷ যেখানে সে কাজ করবে সেখানেই খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে৷ এ ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুমও আছে৷ আর কী চাই? সে জবাব দিল, ‘না, আমার কোনো অসুবিধা হবে না৷’

বৃদ্ধা এরপর মামুলি কিছু কথাবার্তা বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন৷ অফিসের যে লোকটা তাকে এ বাড়িতে এনেছিল সে এতক্ষণ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়েছিল৷ সঙ্গের সামান্য কিছু জিনিসপত্র ঘরে রেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই লোকের সঙ্গে ময়ূখ রওনা হয়ে গেল তার কাজের জায়গাতে৷

রাত আটটা নাগাদ বাড়িটাতে ফিরল ময়ূখ৷ বাড়ির চারপাশে কাঠের তৈরি নিচু বেড়া দেওয়া আছে৷ তার দরজা খোলার শব্দ শুনেই মনে হয় একবার বাড়ির কোনো একটা ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালন ভদ্রমহিলা, তারপর ময়ূখকে দেখে আবার ভিতরে ঢুকে গেলেন৷ অফিসেই খাওয়া সেরে এসেছে ময়ূখ৷ সারাদিন নানা ধকল গেছে তার৷ ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতি নিবিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে৷

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার জন্যই হয়তো মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার৷ সামনে খোলা জানলা দিয়ে বাইরে চাঁদের আলোতে শালবন, রাস্তা সব, কিছু দেখা যাচ্ছে৷ ময়ূখের খাটের মাথার ওপর জাফরিবিহীন বেশ বড়ো গোলাকার ঘুলঘুলিটা দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো এসে পড়েছে ছবিটার ওপর৷ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে ছবিটা৷ সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ময়ূখের একটা অদ্ভুত ব্যাপার হঠাৎ মনে হল৷ ছবির সেই সাইক্লিস্টের চাকা দুটো যেন ধীর গতিতে ঘুরছে! তাছাড়া সে যেন তার আগের জায়গাতে নেই৷ সেই বাঁকের মুখ থেকে অনেকটা এগিয়ে সে এসে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশে সেই ঢিবি মতো জায়গাটার কাছে৷ আকারেও যেন একটু বড়ো হয়েছে সেই সাইকেল আরোহী৷ দূর থেকে কাছে এলে যেমন হয়৷ এ ব্যাপারটা কি ময়ূখের দৃষ্টিবিভ্রম? নাকি আলো-ছায়ার খেলা? ব্যাপারটা ঠিক ধরতে না পেরে সেই ছবির দিকে তাকিয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল ময়ূখ৷ শেষ রাতের দিকে আবারও একবার ঘুম ভেঙে গেল তার৷ একটা অস্পষ্ট গোঁগোঁ শব্দ যেন কোথা থেকে ভেসে আসছে৷ শব্দটা অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে গেল৷ তার কিছুক্ষণের মধ্যেই শালবনের মাথার আকাশ লাল হতে শুরু করল৷ ধীরে ধীরে শোনা যেতে লাগল পাখির কলকাকলি৷

দুই

সকালবেলা ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোবার আগে ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনে হাসল ময়ূখ৷ গত রাতের ব্যাপারটা মনে পড়ে গেল তার৷ না, ছবিতে কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ সেই ছোট্ট সাইক্লিস্ট বাঁকের মুখে একই জায়গাতে আছে৷ আর তার চাকাও ঘুরছে না৷ ছবির সাইক্লিস্টের কি সাইকেল চালানো সম্ভব?

দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই ময়ূখ দেখল বৃদ্ধা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন৷ ময়ূখের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী, ঘুম হল রাতে? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

ময়ূখ হেসে বলল, ‘অসুবিধা হয়নি৷ তবে ভোর রাতে কীরকম একটা শব্দ শুনলাম৷ মনে হল মানুষের গলা…৷’

বৃদ্ধা একটু বিষণ্ণ ভাবে বললেন, ‘ওটা ওঁর গলা৷ আসলে পূর্ণিমা-অমাবস্যা এলে ওঁর অসুস্থতা একটু বাড়ে৷ উনি তো কথা বলতে পারেন না৷ পক্ষাঘাতগ্রস্ত৷ মুখ দিয়ে ওরকম শব্দ করেন৷ আগামীকাল আবার পূর্ণিমা৷ ওঁর কষ্ট বাড়ছে৷’

তাঁর কথা শুনে ময়ূখ সৌজন্যর খাতিরে বলল, ‘ওঁকে একবার দেখা যাবে?’

ভদ্রমহিলা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন একটু ইতস্তত করেই বললেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে৷’

ময়ূখকে নিয়ে ভদ্রমহিলা একটা ঘরে ঢুকলেন প্রথমে, তারপর সে ঘর পেরিয়ে ঢুকলেন অন্য একটা ঘরে৷ একটা বাতি জ্বলছে ঘরে৷ ঘরটাতে কোনো জানলা নেই৷ ঘরের মাঝখানে একটু উঁচু সেকেলে পালঙ্কে শুয়ে আছেন একজন বৃদ্ধ৷ মাথায় সাদা শনের মতো চুল, চোখের পাতা বোজা৷ সম্ভবত ঘুমাচ্ছেন তিনি৷ খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁরা দু-জন৷ বৃদ্ধা পরম মমতায় শুয়ে থাকা মানুষটার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘আপনি যে ঘরটায় আছেন, সেখানেই উনি থাকতেন৷’

ময়ূখ বলল, ‘ও ঘরটা তো বেশ ভালো৷ বড়ো জানলা দিয়ে আলো-বাতাস খেলে৷ ওনাকে এ ঘরে আনলেন কেন?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বৃদ্ধা জবাব দিলেন, ‘ওই জানলাটা নিয়েই তো সমস্যা৷ শীত-বর্ষা কিছুতেই ওই জানলা বন্ধ করতে দিতে চাইতেন না উনি৷ গতবার শীতে জানলা খোলা রেখে শরীরটা আরও খারাপ হয়ে গেল৷ আর তারপর থেকেই বাধ্য হয়ে ওনাকে এ ঘরে এনে রাখতে হয়েছে৷’

মিনিটখানেক সে ঘরে থাকল ময়ূখ৷ তারপর সে ঘর, সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে রওনা হল তা কাজের জায়গাতে৷

সারাদিনটা কাজের চাপে কী ভাবে কেটে গেল তা বুঝতে পারল না ময়ূখ৷ অফিসের একটা গাড়ি যখন বাড়িটার সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল তখন বেশ রাত৷ প্রায় দশটা বাজে৷ চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা৷ শালবনের দিক থেকে ভেসে আসছে পাতার ফিসফিসানি আর ঝিঁঝির কলতান৷ বাড়িতে পা দিতেই সেই গোঁ গোঁ শব্দটা শুনতে পেল ময়ূখ৷ বেশ জোরেই হচ্ছে শব্দটা৷ এমনকী ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করার পরও কানে আসতে লাগল সে শব্দ৷ সম্ভবত সেই ভদ্রলোকের অসুস্থতা আরও বেড়েছে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই বিছানায় শুয়ে পড়ল ময়ূখ৷ বৃদ্ধর আর্তনাদ থেমে গেল একসময়৷ ঘুম নেমে এল তার চোখে৷

মাঝরাতে সম্ভবত আবারও কারও আর্তনাদে ঘুম ভেঙে গেল ময়ূখের৷ ঘুম ভাঙার পর অবশ্য আর কোনো শব্দ শুনতে পেল না সে৷ খাটের সামনে তার পায়ের দিকে খোলা জানালা৷ আগামীকাল পূর্ণিমা৷ আকাশে প্রায় পূর্ণচাঁদ৷ সেই আলোতে আরও স্পষ্ট আজ বাইরেটা৷ শালের বন, তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়া পথ, পথের পাশে সেই উঁচু মতো জায়গা বা ঢিবিটা, রাস্তা শেষে বাঁকটা, সবকিছুই আজ আরও স্পষ্ট৷ আর এরপরই আধো ঘুম চোখে তাকাল দেওয়ালের গায়ের ছবিটার দিকে৷ ছবিটাও যেন আরও বেশি স্পষ্ট৷ ছবির চাঁদের আলো যেন আজ ছড়িয়ে পড়েছে ফ্রেমের আনাচে-কানাচে৷ আর সেই ছবির দিকে তাকিয়ে আজ আরও বেশি অবাক হয়ে গেল ময়ূখ৷ সেই সাইকেল আরোহী তার নিজের জায়গাতে নেই৷ দূরের সেই বাঁক থেকে আরও অনেকটা এগিয়ে এমন কী রাস্তার মাঝপথে সেই ঢিবিটাকেও পিছনে ফেলে অনেকটা পথ অতিক্রম করে এসে দাঁড়িয়েছে সে৷ তাকে কালকের থেকেও বড়ো দেখাচ্ছে৷ তার অবয়ব, সাইকেলের গড়ন, সবকিছুই আজ অনেক বেশি স্পষ্ট৷ লোকটার ছিপছিপে চেহারা, পরনে সম্ভবত একটা ব্রিচেস, পায়ে শু, মাথায় একটা টুপি৷ টুপির আড়ালে তার মুখ বোঝা না গেলেও সম্ভবত সে তাকিয়ে আছে এ বাড়িটার দিকেই৷ ময়ূখের আরও মনে হল, তার সাইকেলের চাকা দুটো যেন খুব ধীর গতিতে ঘুরছে! চাঁদের আলোতে কাঁকর বিছানো রাস্তা ধরে খুব ধীরগতিতে এ বাড়ির দিকে এগোচ্ছে৷

ব্যাপারটা দেখতে পেয়েই বিস্ময়ে ঘুম ভাবটা কেটে গেল ময়ূখের৷ সে আর আগের দিনের মতো শুয়ে থাকতে পারল না৷ বেডসুইচ থেকে আলো জ্বালিয়ে খাট থেকে নেমে সে গিয়ে দাঁড়াল ছবিটার একদম কাছে৷ কী আশ্চর্য ছবির সবকিছু তো ঠিকই আছে৷ সেই সাইক্লিস্ট তো রাস্তার দূর প্রান্তে বাঁকের মুখেই দাঁড়িয়ে! সাইক্লিস্টের একটা ছোট্ট অস্পষ্ট অবয়ব৷ তাহলে এতক্ষণ কী দেখল ময়ূখ? নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আলোছায়ার খেলা৷ নিজের মনে হাসল সে৷ তবুও ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল সে৷ ছবিটা অনেক পুরোনো৷ জায়গায় জায়গায় ক্যানভাসটা পোকায় কেটেছে, অনেকটা অংশ বিশেষত রাস্তার শেষে যে জায়গাতে সাইক্লিস্ট দাঁড়িয়ে আছে সে জায়গায় কাপড়টা বেশ ঝুরঝুরে হয়ে গেছে৷ আঙুল দিয়ে টোকা দিলেই হয়তো জায়গাটা খসে পড়বে৷ কিছুক্ষণ ছবিটা দেখার পর বাতি নিভিয়ে ময়ূখ বিছানায় শুয়ে পড়ল৷

তিন

সকালবেলা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকের গোঙানির শব্দেই ময়ূখের ঘুম ভাঙল৷ বেশ জোরে জোরে আর্তনাদ করছেন ভদ্রলোক৷ ময়ূখ ঘর থেকে বেরিয়েই দেখতে পেল বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে৷ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি৷ তাঁর চোখেমুখে স্পষ্ট ক্লান্তি আর বিষণ্ণতার ছাপ৷ ভোরের নতুন আলোও ধুয়ে দিতে পারছে না তাঁর ক্লান্তিকে৷ ময়ূখ তাঁর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘ওনার অসুস্থতা কি আরও বেড়েছে?’

ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, কাল থেকে আরও বেড়েছে৷’

‘ডাক্তার ডেকেছিলেন?’

বৃদ্ধা এবার অসহায় ভাবে বললেন, ‘ডাক্তার ডেকে তেমন কোনো লাভ হবে না৷ তারা আগেই দেখে বলে গেছেন, নতুন কোনো ওষুধ দেবার ব্যাপার নেই৷ আজ রাতটা যদি কোনোভাবে…৷’ কথা শেষ না করে তিনি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকে গেলেন৷ সকালবেলা ময়ূখ যতক্ষণ বাড়িটাতে থাকল ততক্ষণই তার কানে আসতে লাগল সেই ভদ্রলাকের গোঙানির শব্দ৷ প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন ভদ্রলোক৷

অফিসে গিয়ে শেষদিনের যাবতীয় কাজ মিটিয়ে এদিন বাড়িটাতে পৌঁছতে রাত নটা বাজল ময়ূখের৷ আজ পূর্ণিমা৷ চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত বাড়ির পাশের শালের বন, তাঁর মাঝখান দিয়ে এঁকে-বেঁকে দূরে বাঁকের দিকে হারিয়ে যাওয়া রাস্তাটা৷ কিন্তু চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা ঢালু ছাদ আর বারান্দাঅলা বাড়িটা আজ কেমন যেন নিঝুম বলে মনে হল ময়ূখের৷ কোথাও কোনো শব্দ নেই৷ সেই বৃদ্ধর আর্তনাদও আর শোনা যাচ্ছে না৷ ময়ূখ একবার ভাবল ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা করে বৃদ্ধ কেমন আছেন সে ব্যাপারে খোঁজ নেয়৷ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল কাল রাত জাগার পর আজ হয়তো তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ বৃদ্ধাকে এখন আর বিরক্ত করা ঠিক হবে না৷ কাল সকালে চলে যাবার সময় একবার তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতেই হবে৷ তখন কথা হবে৷ এই ভেবে সে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল৷

পরদিন ভোরবেলা এ বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় ফিরবে ময়ূখ৷ একটা গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে৷ সকালে সে গাড়ি তাকে নিতে আসবে৷ সামান্য গোছগাছ সেরে নিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল ময়ূখ৷ চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত বাইরের পৃথিবী৷ মুগ্ধভাবে ময়ূখ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল শালের বন, রাস্তার দিকে৷ তারপর বিছানায় যাবার আগে ইচ্ছা করেই আজ জানলার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল৷ ময়ূখের মনে হল খোলা জানলা দিয়ে চাঁদের আলো তার মুখে এসে পড়ে বলেই তার ঘুম ভেঙে যায়৷ পাল্লা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে৷

কিন্তু এদিন রাতেও আগের দু-দিনের মতোই ঘুম ভেঙে গেল তার৷ প্রথমে তার চোখ পড়ল খাটের পাশে টেবিলে রাখা টাইমপিসের ওপর৷ ঘড়িটার রেডিয়ামের কাঁটা জানান দিচ্ছে রাত প্রায় তিনটে বাজে৷ সোজা হয়ে শুল ময়ূখ৷ আর এরপরই অন্যদিনের মতো চোখ গেল তার সামনাসামনি দেওয়ালের গায়ে ঝুলতে থাকা ছবিটার ওপর৷ ঘুলঘুলি দিয়ে আজও চাঁদের আলো এসে পড়েছে ছবির ওপর৷ তাছাড়া ছবির চাঁদটা যেন আজ উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে ক্যানভাসে৷ সেই আলোতে ময়ূখ স্পষ্ট দেখল সেই সাইক্লিস্ট নিজের জায়গাতে নেই৷ রাস্তার দূরবর্তী বাঁকে, রাস্তার মাঝমাঝি দূরত্বে পথের পাশের সেই ঢিবি অতিক্রম করে সে বাড়িটার অনেক কাছে, গতরাতের চেয়েও অনেক কাছে চলে এসেছে! চাঁদের আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার পায়ের সঞ্চালন, চাকা ঘূর্ণন! তবে সবকিছুই বেশ ধীর গতিতে৷ এক সুতো এক সুতো করে ছবির রাস্তাটা অতিক্রম করছে লোকটা! না, এরকম দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে না৷ ময়ূখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, ধীরে ধীরে লোকটা রাস্তা অতিক্রম করে ছবির ফ্রেমের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে৷ বিছানায় শুয়ে ময়ূখ দেখতে লাগল সেই অবিশ্বাস্য দৃশ্য৷ হ্যাঁ, চাকাটা ঘুরছে! প্যাডেল করছে লোকটা! হ্যাঁ, ক্রমশ বড়ো হচ্ছে তার অবয়ব!

সাইক্লিস্ট একসময় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল বাড়ির একদম কাছে একলা দাঁড়ানো সেই বিরাট শালগাছটার নীচে৷ চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাকে৷ মাথায় টুপি, পরনে ব্রিচেস, পায়ে শু্য৷ এমনকী সাইকেলের ঘণ্টি, চাকার স্পোকগুলোও দেখা যাচ্ছে৷ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে কয়েকবার যেন মাথাও নাড়ল লোকটা৷ আর এরপরই যেন জানলার বাইরে থেকে অস্পষ্ট একটা শব্দ বেশ কয়েকবার কানে এসে লাগল ময়ূখের৷ সাইকেলের ঘণ্টির মৃদু টিং টিং শব্দ! হ্যাঁ, সে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে ঘণ্টির শব্দ!

ব্যাপারটা কী ঘটছে আজ তাকে বুঝতেই হবে৷ বিছানা ছেড়ে উঠে ময়ূখ এগিয়ে গেল জানলার দিকে৷ পাল্লাটা একটু ফাঁক করে তাকাল বাইরের দিকে৷ চমকে উঠল ময়ূখ৷ চাঁদের আলোতে সেই শালগাছের নীচে সত্যিই এসে দাঁড়িয়েছে একজন সাইক্লিস্ট! মাথায় টুপি, পরনে ব্রিচেস, পায়ে শু্য৷ সে তাকিয়ে আছে বাড়িটার দিকে৷ হুবহু দেওয়ালের ছবিটার মতো! সাইকেলের ঘণ্টিটা মাঝে মাঝে আস্তে আস্তে বাজাচ্ছে সে৷ টিং-টিং-টিং-টিং… কিছুক্ষণের মধ্যেই আরও এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল ময়ূখ৷ তাদের বাড়ি থেকে একটা মানুষ ধীর পায়ে বেরিয়ে এগিয়ে গেল সাইক্লিস্টের দিকে৷ কে ও? তবে কি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ছাড়াও এ বাড়িতে অন্য কেউ থাকেন! ময়ূখের দিকে পিছন ফিরে হাঁটছে বলে তার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ময়ূখ৷ দ্বিতীয় লোকটা কাছে যেতেই তাকে দেখে সম্ভবত সম্ভাষণসূচক মাথা নাড়ল সাইক্লিস্ট৷ তারপর সে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নিল৷ দ্বিতীয় লোকটা নিঃশব্দে চেপে বসল তার সাইকেলের পিছনের কেরিয়ারে৷ শালবনের মাঝখান দিয়ে চন্দ্রালোকিত পথ ধরে যেখান থেকে সে এসেছে সেদিকে লোকটাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করল সাইক্লিস্ট৷ বিস্মিত, হতভম্ব ময়ূখ চেয়ে রইল সেই অদ্ভুত দৃশ্যর দিকে৷ একসময় লোকটাকে নিয়ে দূরে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল সেই সাইক্লিস্ট৷

চার

ঘরের বাইরে বারান্দায় কাদের কথাবার্তার শব্দে যেন ময়ূখের ঘুম ভাঙল৷ ময়ূখের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গত রাতের স্মৃতি৷ তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে৷ শালবনের মাথার ওপর সূর্য উঠে গেছে তখন৷ বারান্দায় বেশ কয়েকজন লোক৷ এক ভদ্রলোকের গলায় স্টেথিসকোপ ঝুলছে, সম্ভবত তিনি ডাক্তার হবেন৷ সেই বৃদ্ধাও আছেন তাঁদের সঙ্গে৷ লোকজনের টুকরো টুকরো সংলাপ শুনে ময়ূখ অনুমান করল সেই অসুস্থ বৃদ্ধ আর নেই৷ ময়ূখ এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বৃদ্ধার সামনে৷ তাকে দেখে বিষণ্ণ হেসে বৃদ্ধা বললেন, ‘এ বাড়ির মানুষটা আর নেই৷ ভালোই হল, অনেকদিন ধরে কষ্ট পাচ্ছিলেন৷ আসলে কি জানেন? যৌবনে তিনি তাঁর যে বন্ধুর সঙ্গে এ জায়গাতে পা রেখেছিলেন, যার সঙ্গে সাইকেল চেপে ঘুরে বেড়াতেন এই শালের বনে, বছরখানেক আগে তার মৃত্যু হয়৷ শেষ বয়সে বন্ধুবিচ্ছেদ আর সইতে পারেননি তিনি৷ তারপর থেকেই ওঁর শরীরটা ভেঙে পড়ল৷ একদিন পূর্ণিমার রাতে উনি নাকি দেখেছিলেন ওই যে ওই শালগাছের নীচে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে নাকি ডাকছেন তাঁর বন্ধু৷ এরপরই আমি ওনাকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যাই৷ কিন্তু পূর্ণিমা এলেই তারপর থেকে কেমন যেন করতেন উনি৷ কাল তো পূর্ণিমা ছিল…৷’ ঠিকমতো কথা শেষ করতে পারলেন না ভদ্রমহিলা৷

ময়ূখ শুধু তাঁকে জিগ্যেস করল, ‘কখন ঘটল ব্যাপারটা?’

‘ডাক্তারবাবু তো বললেন রাত তিনটে নাগাদ হবে৷’ কান্নাভেজা গলায় জবাব দিলেন বৃদ্ধা৷

ময়ূখ ঘরে ফিরে এসে ছবিটার সামনে দাঁড়াল৷ প্রায় সবকিছু ঠিকই আছে ছবিটাতে৷ চন্দ্রালোকিত শালের বন, সেই রাস্তা, রাস্তার পাশেই ঢিবি, পথের শেষের বাঁকটা৷ শুধু নেই সেই সাইক্লিস্ট! পোকায় কাটা ক্যানভাসের সেই ছোট্ট অংশটা কোথায় যেন খসে পড়েছে৷ চাঁদের আলোতে শালবনের মধ্যে দিয়ে সঙ্গীকে নিয়ে দূরে ওই পথের বাঁকে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই সাইক্লিস্ট৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *