সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ
ইউসুফের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো কালেক্ট করেই কৌশিককে কল করে লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, তোমার ওই সাইকিয়াট্রিস্ট বন্ধুর কাছে নিয়ে চলো এখন৷ ওই যে অরুণাংশু পালের কাছে৷’
কৌশিক বলল, ‘জিতা, তুমি ছোটোবেলায় রাস্তায় বেরিয়ে আঙ্কলের কাছে কটনক্যান্ডি খাবার বায়না করতে তা-ই না? আঙ্কল যদি বলতেন, দাঁতে পোকা হবে তাহলে নতুন ফ্রক পরে মাটিতে বসে পড়তে তা-ই না?’
লগ্নজিতা বলল, ‘এটা কোথা থেকে সংগ্রহ করা তথ্য?’
কৌশিক বলল, ‘এটা আমার হবু শ্বশুরমশাই বলেছেন৷ ওকে আসতে আসতে বলছিলাম, এসব বায়না সামলাব বলেই তো আমার জন্ম হয়েছে এ ধরিত্রীতে৷ আপনার তো বয়েস হচ্ছে, বায়নাকুটে মেয়েটার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে দিয়ে আপনি একটু নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘কৌশিক, তোমার মনে সব সময় বিয়ের লাড্ডু ফোটে তা-ই না? বাকি কোথায় কার কী ফাটল ফুটল সেসব তো দেখো না৷’
কৌশিক বলল, ‘তোমার মতো আমার পশ্চাতে অল টাইম ছারপোকা কামড়ায় না যে জিতা৷ আর মাথার পোকাগুলোও অস্থির নয়৷ শুধু মনটাই সচল থাকে৷ তাই যা লাড্ডু সব ওখানেই ফোটে৷ ‘এনিওয়ে, অরুণাংশুর কাছে তোমার মাথার পোকাগুলোর ওষুধ চেয়ে নিলে মন্দ হবে না৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘বাবা-মা তো তোমার প্রশংসা করেই যাচ্ছিল তাই আমার বেরোতে দেরি হয়ে গেল৷ এনিওয়ে চলো ‘না নিয়ে৷’
কৌশিক বলল, ‘কেন বলবে? আরে, তোমরা তো ওই ড্রাগ এজেন্টগুলোকে ধরেই ফেলেছ৷ তাহলে আবার কার সঙ্গে কার সম্পর্ক ছিল পাস্ট টেন্সে, সেসব জেনে কী হবে, বলবে?
লগ্নজিতা আদুরে গলায় বলল, ‘নিয়ে যাবে না তা-ই তো?’
কৌশিক বলল, ‘তুমি পুলিশের চাকরি ছেড়ে সিনেমা জয়েন করো, জিতা৷ তোমার কিন্তু হবে বুঝলে৷ এই গলার আপস অ্যান্ড ডাউন— এ তো অভিনেতারাও পারে না গো৷ যখনই দেখলে, ধমকেধামকে কাজ হচ্ছে না তখনই গলায় আমূলের মাখন ঢেলে দিলে, বলো? নাহ, আন্টি একদম ঠিক বলছিলেন৷ জিতা, তোমার কথা যদি দশটা মানে, তোমায় দিয়ে অন্তত একশোটা মানিয়ে নেবেই৷ আমার চাকরিটা মনে হচ্ছে, চলে যাবে জিতা, তোমার এই জেলে থাকা আসামির পাস্ট টেন্স জানতে গিয়ে৷ ঘণ্টাখানেক সময় দাও, রাউন্ডে যেতে হবে৷ দুজন পেশেন্টের একটু ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন৷ রাউন্ড সেরে যাচ্ছি৷ তুমি রেডি থাকো৷’
লগ্নজিতা বলল, কৌশিক তোমায় আরও বেশি করে ভালোবাসতে মন হয় মাঝে মাঝে৷’
কৌশিক বলল, কেউ বারণ করেছে বলে তো আমার জানা নেই৷ এনিওয়ে, আর ঘি, মাখনের অপব্যবহার করার দরকার নেই৷ আমি এখন রাখলাম৷
লগ্নজিতা টোটাল ফাইলটা গুছিয়ে নিল৷ অরুণাংশু আর কৌশিক খুব ভালো বন্ধু৷ একই মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছে৷ ইন ফ্যাক্ট, দুজন দুজনের পেশেন্টদের কেস হিস্ট্রি নিয়েও আলোচনা করে৷ অরুণাংশু একটু ইন্ট্রোভার্ট মানুষ৷ সেই কারণেই লগ্নজিতা একা একা যেতে চাইছে না৷ হয়তো বন্ধুর উডবির সঙ্গে বেশি কথাই বলল না৷ চা-কফি খাইয়ে বিদায় করে দিল৷
কৌশিক এসেই বলল, ‘চলো চলো৷ অরুণাংশুর আবার চেম্বার আছে বিকেল পাঁচটা থেকে৷ আমি যাচ্ছি শুনে বলল, কী মরতে আসছিস? তোর প্রেমিকা ছেড়ে পালিয়েছে নাকি? ব্রেকআপের দুঃখ ভুলতে এলে আসার দরকার নেই, ওষুধ বলে দিচ্ছি, লিখে নে৷ তারপর যখন বললাম, তুমি যাবে কেসের বিষয়ে ক-টা ইনফরমেশন নিতে তখন ব্যাটা বলে, ওহ তা-ই বল৷ আমার সামনে এত লেকচার তো, তোমার সামনে দেখবে, প্রশ্নের বাইরে একটাও উত্তর দেবে না৷ ও নিজেও একটা অদ্ভুত ক্যারেকটার৷’
লগ্নজিতা বলল, অদ্ভুত ক্যারেকটার বলেই এত বড়ো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হতে পেরেছে৷ মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করে তার সমস্যার সমাধান করা এতটা সহজ নয়৷’
কৌশিক বলল, ‘তা ঠিক৷’
অরুণাংশুর সামনে সমস্ত প্রেসক্রিপশন আর ওষুধের ছবি সাজিয়ে দিয়ে লগ্নজিতা বলল, বলুন অরুণাংশুদা এই পেশেন্টের কী কী সমস্যা হয়৷
অরুণাংশু সব দেখে বলল, ‘রোগ একটা নয় অনেকগুলো মানসিক সমস্যার শিকার রোগী৷ ADHD- Attention-deficit/hyperactivity disorder- সঙ্গে আবার Money obsession disorder-আছে৷ দেখুন, ইনি একটা কাজে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারবেন না৷ অসম্ভব অস্থির হয় এই পেশেন্ট৷ কিন্তু প্রচুর বুদ্ধিমান হয়৷ এঁর দেখছি, আরও একটা ভয়ংকর রোগ আছে৷ ইনি টাকার প্রতি মোহগ্রস্ত৷ এই মোহ এমন লেভেলে যায় যে প্রিয়জনকে খুন করে দিতে দুবার ভাববে না৷ না এমন নয় যে তার জীবনে প্রচুর টাকার প্রয়োজন আছে৷ টাকা ইনকাম করাটাই একটা নেশা৷ ঠিক মাদকদ্রব্যের নেশার মতো৷ যারা ড্রাগ নেয়, তারা যেমন ড্রাগ ডিলারকে ছাড়া আর কিছু চেনে না, বাকি সব তুচ্ছ তাদের কাছে৷ এদেরও তাই প্রচুর টাকা ইনকাম করার নেশা৷ আবারও বলছি, ভালো লাইফস্টাইল, প্রচুর খরচ করবে— এসব না-ও হতে পারে, শুধু ইনকামটাই এর নেশা৷’
লগ্নজিতা বলল, ‘আমি যতটুকু খবর পেলাম, তাতে অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট কিন্তু৷ অরুণাংশু বলল, ‘হ্যাঁ, সে হতেই পারে৷ হয়তো প্রচুর পড়াশোনা করে এ পেশেন্ট ডাক্তার হল৷ পরের দিন চেম্বার ছেড়ে মুদির দোকান খুলতেও পারে৷ মানে কোনো কিছুতেই খুশি হতে পারে না৷ অত্যন্ত ফাস্ট চলে এদের মস্তিষ্ক৷ ওষুধ তো ঠিকই চলছে৷ কিন্তু কাজ কতটা হচ্ছে, সেটাই দেখার৷ কারণ শুধু ওষুধ বা কাউন্সেলিংয়ে কাজ হবে না৷ নিজেকেও শান্ত রাখতে হবে পেশেন্টকে৷ সেটা ইনি করেন কি না আমার জানা নেই৷ ইনি যে ডক্টরের আন্ডারে ট্রিটমেন্ট করছেন, সেই ডক্টরের সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচিতি আছে৷ দেখি, কথা বলা যায় কি না৷’
ফোনটা স্পিকারে করে অরুণাংশু বলল, ‘হ্যালো রূপমস্যার, আমার এক পরিচিত একটা কেস হিস্ট্রি নিয়ে একটু কথা বলতে চাইছেন আপনার সঙ্গে, আপনারই পেশেন্ট৷
ডি.সি.পি. লগ্নজিতা ভট্টাচার্য আছেন আমার সামনেই৷ একটু কথা বলুন স্যার৷ রূপমবাবু বললেন, ‘বলুন ম্যাডাম, লগ্নজিতা রোগীর ডিটেলস বলার পরে উনি বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, ওর একটা রোগ প্রশমিত করা গেছে অল্প হলেও৷ সেটা হচ্ছে, অস্থির মানসিকতাটা একটু হলেও ঠান্ডা হয়েছে৷ কিন্তু অপরাধ প্রবণতাটা কমানো যায়নি কিছুতেই৷ টাকা রোজগারের জন্য ও সবকিছু করতে পারে৷ অপরাধবোধ তৈরি হলেও সেটা সাময়িক৷ কাউন্সেলিং করলে মাসখানেক ভালো থাকে, কিন্তু আবারও একই নেশায় মেতে ওঠে৷ সব চেয়ে প্রিয় হল ছদ্মবেশ৷ মিথ্যেটাকে সত্যির মতো করে প্রেজেন্ট করে৷ মুখোশের আড়ালে থাকতেই পছন্দ করে৷ আমি জানি ম্যাডাম, ‘এ পেশেন্ট হয়তো কোনো অপরাধে জড়াবে৷ কিন্তু ডক্টর হিসাবে আমি নিরুপায়৷’
লগ্নজিতা অরুণাংশুকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এল৷ কৌশিক বলল, ‘এবারে বুঝলাম, তুমি কেন হঠাৎ এই সত্যজিৎ ব্যানার্জির কেস হিস্ট্রি নিয়ে পড়লে৷’
লগ্নজিতা বলল, রাতে বাড়িতে এসো, তোমার হবু শাশুড়ি ডিনারে নিমন্ত্রণ করেছে তোমায়৷ আপাতত আমায় যেতে হবে৷ একটা বড়ো কাজ পড়ে আছে৷’
কৌশিক বলল, ‘খুব সাবধান জিতা৷ টেক কেয়ার৷’