সাঁঝ-সকালের মা – মহাশ্বেতা দেবী

সাঁঝ-সকালের মা

বৈশাখের তাতে মাঠের ছাতি ফাটে, সাধন কান্দোরীর মা জটি ঠাকুরনী মরে গেল।

মরে যাবার আগে জটি ঠাকুরনীর পেট গলা ফুলে ঢাক হয়েছিল। বাঁশের দোলা বেঁধে সাধন কান্দোরীর মা—কে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিল।

‘মোকে আঁসপাতালে দিস না সাধন। আঁসপাতালে ডোমে লাড়ীভুড়ি টেনে ছিঁড়া করবে বাপ।’

‘ডাক্তারে বলে আঁসপাতালে লিয়া করতে।’

‘অ বাপ, মোর সাধন বাপ, ডোম দিঞে লাড়ী ছিঁড়া করাস না বাপ!’

‘লাড়ী ক্যাও ছিঁড়ে না মা।’

‘ছিঁড়ে বাপ! তু কি জানবি বল? দুধের ছেলা তুই। ডোমে লাড়ী ছিঁড়ে, আঁত ছিঁড়ে। ডাক্তারে বুতলে আঁত রেখে দেয় বাপ।’

‘কেন গো মা?’

‘তু কি জানবি বাপ? দুধের ছেলা তুই। এ মনিষ্য শরীর ই কলিকালে পুড়াবার লয়, গোর—গাড়ার নয়, জানলু?’

‘হেই মা! ই কি কথা?’

‘হক কথা বাপ! কিন্তু আত্মীয় বন্ধু মনিষ মরলে সামাজ দেয়, চিলুতে উঠায়, লা কি বল?’

‘হক কথা।’

‘উ ডাক্তার—বদ্যি—ডোম—ধাই সভে শুগুন পানা চিয়ে দেখে।’

‘মা।’

চিয়ে চিয়ে দেখে। তা বাদে য্যাতক্ষণ বেওয়ারিশের মড়া পায় তখন উ—রা ভাগীদার হয় বাপ। ডোমে লাড়ী আঁত ডাক্তারকে দেয়। ধাই কাপড়—জামা ল্যায়। ডোম মড়াটি পচা করিয়ে হাড় বিচে পয়সা ল্যায়।’

‘ধ্যুর, তা আমি হতে দিই?’

‘দিস না বাপ। আমি তোর সাঁঝ—সকালের মা। মোকে তু আঁসপাতালে মারা করাস না।’

‘চুবো যা মা’।

সাধন কান্দোরী ধমক দিয়ে উঠেছিল। জটি ঠাকুরনী ওকে পেটে ধরেছিল এক দিন। ওরা বড় প্রাচীন জাতি, জরা—ব্যাধের বংশধর। ওদের সম্প্রদায়ের নাম পাখ—মারা সম্প্রদায়। সেই বংশের মেয়ে জটেশ্বরী সাধনকে পেটে দশ মাস ধরে প্রসব করেছিল।

কেমন করে গর্ভধারিণী মা সাঁঝ—সকালের মা হয়ে গেল সে এক আশ্চর্য বৃত্তান্ত। সাধনের দেড় বছর বয়স থেকে জটেশ্বরীর ওপর দেবতার ভর। সেই থেকে জটি দিনেমানে জটি ঠাকুরনী। সূর্য ওঠা থেকে সূর্য ডোবা অবধি ঠাকুরানীকে কেউ মা বউ—বোন ভাবতে নিষেধ। ডাকতে নিষেধ।

সাধনকে জটি নিষেধ করেছিল।

‘মা বোলে ডাকো না বাপ, বাপো আমার।’

‘কখুনো লয়?’

‘লা বাপো, খুব বিয়েনবেলা, সূয্যি না উঠতে মা বোলে ডেকে লবি। সূয্যি ডুবতে মা বলে ডাকবি।’

‘শুধু সাঁঝে আর সকালে, তাই লয় গো মা?’

‘হ্যাঁ বাপো!’

সাঁঝে আর সকালে তু মা। আর দিনেমানে তু ঠাকুরনী?’

‘হ্যাঁ বাপো। আমি তোর সাঁঝ—সকালের মা।’

এই সাঁঝ—সকালের মা জটেশ্বরী কেমন করে যাদবপুরে লাইনের পারে এল, কেমন করে ওর ছেলেকে রিকশা করে দিল—সে অনেক কথা।

মা ছাড়া সাধন কান্দোরী কিছু জানে না। সাধন নির্বোধ, তিরিশ বছর বয়সেও ওর বুদ্ধিসুদ্ধি অপরিণত। মোষের মতো শরীরে ওর পাকস্থলী ছাড়া আর কিছু নেই। ফুসফুস রক্তজবার পাপড়ির মতো হৃদযন্ত্র, সাপের মতো পিচ্ছিল নাড়ি, ভোরের দোপাটির মতো কুসুমকোমল জীবকোষ, কিছু নেই ওর শরীরে। শুধু একটা পাকস্থলী আছে।

আর আছে খিদে। শুধু খেতে দেবার লোভ দেখিয়ে ওকে দিয়ে ওর মনিবের যুবতী বউ কাঠ চ্যালা করায়, টিউবকলের জল টানায়। মন মন কয়লা ভাঙিয়ে নেয়।

মনিবের যুবতী ঘোমটা—টানা সুন্দরী বউ।

‘মনিবানীর দিকে চেয়ো না সাধন।’

‘লা মা।’

‘য্যাখন চাইবি, মাত্তিভাবে দেখবি, জানু বাপ।’

‘হ্যাঁ মা।’

মা যা বলে সাধন তাতেই হ্যাঁ বলে। মা ওর জগৎ—সংসার, মা ওর চাঁদ—সূর্য। সেই মা যখন জ্বরে, আমাশয়, পিত্তরসে, কফে ভুগে ভুগে ফুলে গেল, তখন সাধন মনিবকে বলল, ”টাকা দেন মশায়, মোকে টাকা দেন।’

‘কেন সাধন?’

‘মোর মা মরে যায় মশায়।’

‘কি হয়েছে, অসুখ?’

‘হ্যাঁ মশায়। মা দিনেমানে ছেঁয়া দেখতে লেগেছে, লুন খেয়ে বলে বাতাসা খেলাম। আজ দুপুরে মশায় মা বলে মোকে ‘মা’ বলে ডাক সাধন।’

‘বললে!’

‘হ্যাঁ মশায়। ডাক্তার আনা করব আপনি টাকা দেন।’

সাধন কান্দোরীর মনিব ওকে দশটি টাকা হাতে দিয়ে বলল, ‘মা—কে চিকিচ্ছে করা সাধন। শত হলেও গর্ভধারিণী।’

‘আমার মা মনিষ্য লয় গো মশায়। মা ঠাকুরনী।’

‘তুই ডাক্তার ডাক।’

অনাদি ডাক্তার যাকে চিকিৎসা করে সে—ই মরে যায় বলে কলোনীর লোকেরা ওকে মেরে তাড়িয়েছিল। অনাদি ডাক্তার এখন রেলপারে খালধারে দোকান খুলেছে। বর্তমানে তার প্রচুর পসার। ইদানীং বহু খুনজখমের লাশকে ও মোটা টাকার বিনিময়ে ‘ডায়েড অফ হার্ট ফেলিওর’ লিখে শ্মশানে পাচার করে। শ্মশানের লোকদেরও আজকাল টাকা দিয়ে কেনা যায় এই যা সুবিধে।

অনাদি ডাক্তারের যে বাড়বাড়ন্ত হবে তা জটি ঠাকুরনী বলেছিল। হয়তো সেই জন্যে, হয়তো বহু ভ্রূণহত্যা, গর্ভপাত, মিথ্যা সার্টিফিকেটের পাপের ভয়ে, ব্রাহ্মণ অনাদি ডাক্তার জটি ঠাকুরনীর পা ধরে তেল—নারকেল—চাল—লবণ দিয়ে প্রণাম করে।

অনাদি ডাক্তার তাই তাড়াতাড়ি জটি ঠাকুরনীকে দেখতে গেল। ভয়ানক দুর্গন্ধ জটির ঘরে। তক্তপোশে টকটকে লাল রংয়ের ময়লা চেলি পরে জেটি ঠাকুরনী রূপকথার রাক্ষসীর মতো চিৎ হয়ে পড়ে ছিল। পেট ফুলে উঁচু, হাত পা চিতিয়ে ফেলে রাখা। জটি ঠাকুরনীর চোখে শুধু আশ্চর্য, অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি ছিল। পিচুটিভরা রক্তাভ চোখের দৃষ্টি এত সুন্দর হতে পারে তা অনাদি ডাক্তার জানত না।

অনাদি ডাক্তারের টেবিলে মাঝে মাঝে যে—সব যুবতী মেয়েরা অসহায় বেদনায় শুয়ে থাকে, তাদের চোখের চেয়েও জটি ঠাকুরনীর চোখ সুন্দর। আসন্ন মৃত্যু ছাড়া আর কেউ এমন সৌন্দর্যে মানুষের চোখ রাঙিয়ে দিতে পারে না।

অনাদি থমকে গেল। নাড়ী দেখে, পেট দেখে অনাদির চোখে জল এল।

আহা, জটি ঠাকুরনীর কাছে সে বছরে পাপ স্খালন করতে দু—একবার আসত।

‘মা, পাপ হয়ে গেল মা।’

দিনেমানে জটি ঠাকুরনীকে কেউ মা বলত না, ঠাকুরনী বলতে হত। অনাদি আসত রাতের কালোয় মুখ ঢেকে।

‘কি পাপ, অ আমার বাপ, কি পাপ?’

‘মেয়েটা মরে গেল মা।’

জটি ঠাকুরনী নিশ্বাস ফেলে বলত ‘মহাপাপী ছিল যি উ। তুমি কি জানবে বাপ, উ—র আঁতাটা (আত্মা) লিয়ো এখন যমদূত ডাঙশমারা করবে। মহাপাপে বাপের মুখে কালি দেয় নাই উ? ভদ্দর ঘরের মিয়ে তু, তুর এমন বেভ্রম?’

‘কী হবে মা?’

‘এই লাও বাপ। গোসাপের কণ্ঠহাড়টি মাদুলিতে আছে। বালিশের তলে রেখে লিদ যাবে। আর তে—সন্ধে গঙ্গাজল দেবে ঘরে, কেমন?’

অনাদির মতো পাপী—তাপীদের জন্যে আঁতুড়ের মরাছেলের নখ, গোসাপের কণ্ঠ—হাড়, ধনেশ পাখির তেল কে সংগ্রহে করবে? পয়সা নয়, কড়ি নয়, শুধু একপালি চাল নিত জটি ঠাকুরনী। সন্ধ্যে হলে ঠাকুরনী হয়ে যেত সাধনের মা। ঠাকুরনী হয়ে যে চাল পেত, মা হয়ে তার ভাত রেঁধে ওর হাবা ছেলেকে খাওয়াত।

এখন অনাদিকে কে দেখবে? দুঃখে অনাদির চোখে জল এসে গেল। অনাদি বলল, ‘সাধন, হাঁসপাতালে লিয়ে যেয়ে দেখা। ঠাকুরনীর শরীল আমি ভালো বুঝি না।’

অনাদি টাকা দিল। বলল, ‘ট্যাক্সি চাপিয়ে লিয়ে যাবি।’

সাধনের মহাপ্রাণী ভয়ে উড়ে গেল। টাকা নিয়ে ও তাড়াতাড়ি মিঠাইয়ের দোকানে গেল। মনের দুঃখে মুড়ি—বাতাসা—গজা কিনে দোকানে বসে বসেই খেল সাধন। ঘটি ঘটি জল খেল।

ট্যাক্সি—ড্রাইভার জটিকে নিল না। বলল, ‘মুর্দা হ্যায়। গাড়িমে মর যায়গা।’

তখন সাধনের মনিব বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ দিল। খাটুলি তৈরি করে জটি ঠাকুরনীকে নিয়ে সাধন বাঙ্গুর হাসপাতালে গেল।

হাসপাতাল বড় অচেনা জায়গা। এত বড় বাড়ি, এত মানুষ—জন, সাধন বলল, ‘ভাই বলরাম! ডরে মোর হাত পা পেটের লাড়ীতে সান্ধায়। ওই আঁসপাতালে এত দরজা, কিন্তুক কুন পথে ঠাকুরনীকে ভিতরে লিয়ো যাই তা বল?’

‘তুই এক জেতের মানুষ সাধন।’

বলরাম, জগদীশ আর উদ্ধব ডাক্তারকে ডাকল। জটি ঠাকুরনীকে ওরা ভর্তি করবেই করবে। ডাক্তার যত বলে ‘বুড়ি এখনি মরবে’, সাধন তত কাঁদে ‘ঠাকুরনীকে বাঁচিয়ে দেন গো! ঠাকুরনী বিনে মোর জগৎ আন্ধার! আহা! ঠাকুরনী যি সাঁঝ হলে মা হয় গো! মোর মাথায় সাদা চুল, তবু মোকে লিয়্যে কত সুহাগ করে ঠাকুরনী! লিজে না খেয়্যে মোকে খাওয়ায় গো!’

‘কী বলছ তুমি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না তোমার কথা।’

‘ডাক্তারবাবু গো’!

সাধন মাথা—কাটা বলির মোষের মতো মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ছটফট করতে লাগল।

বলরাম এই কুতঘাটে বিয়ে করেছে। কলোনীর মানুষ ও, ভদ্রলোক দেখে ভয় পায় না। যতদিন বলরাম গরিব ছিল ততদিন ভদ্রলোক দেখে ওর রাগ হত না। তখনো ওর গায়ে ধলেশ্বরীর নদীর শীতলতা, স্বভাবে ধানখেতের নম্র শ্যামলিমা ছিল।

এখন কলোনীতে বাড়ি, নিজের রিকশা ও বারুইপুরে ধানজমি করবার পর থেকে বলরাম বদলে গিয়েছে। ভদ্রলোক দেখলে, নম্র ব্যবহার পেলে, মিষ্টি কথা শুনলে ওর থুতু ছেটাতে ইচ্ছে করে। বলরাম জানে বর্তমানে এই বাংলা বাপের নয়, দাপের।

বলরাম এগিয়ে এল। কাটা—কাটা কথায় বলল, ‘উনি সামান্য মানুষ নয়, জানলেন? উনি দেবাংশী মেয়েছেলে, আমরা ওঁকে মান্য করি, ধর্মপুজোয় ওঁকে ডালা দিই। সিট থাকলে ভর্তি করে নিন না সার। সিট আমার নয়, আপনারও নয়, সর্বসাধারণের, তাই না?’

অবশেষে জটি ঠাকুরনী ভর্তি হল।

সাধনের কান্নাকাটি দেখে ডাক্তারের কষ্ট হয়েছিল। লজ্জা পেয়েছিল ডাক্তার। এতবড় সা—জোয়ান পুরুষকে মায়ের জন্য এমন করে কাঁদতে দেখেনি ডাক্তার।

‘ঠাকুরনী বাঁচবে না ডাক্তারবাবু?’

‘দেখি সাধন। অস্থির হয়ো না।’

‘কুন ওগ উয়ার লাই মশাই! উনি মনিষ্য নয়, উনি দেবতা গো! ওগ উয়ার কাছে আসতে ডরায়।’

‘তা তো বটেই।’

‘এই তো উনি দিনেমানে ঠাকুরনী থাকে গো মশায়! সাঁঝে সকালে আমার মা হয়। গঙ্গাজলে চ্যান করলে, আঙা কাপড় পরলে উনি ঠাকুরনী। ত্যাখন আর সভার মতো আমিও উয়াকে মান্য দেই গো!’

‘তাই নাকি?’

‘কিন্তু মা বলবার লেগ্যে আমার জীউটা ফাট্যে গো মশায়! তাই! য্যাখন সাঁঝ হয়, আমি যেয়্যে উয়ার কোলে মাথা রাখব আর মা! মা! মা! বলে সাধ মিটয়্যে ডাকব।’

ডাক্তার অবাক হয়ে সাধনকে দেখছিল। নার্স একটু হেসে বলল, ‘তোমার অতবড় মাথাটা ওঁর কোলে রাখ?

সাধন গভীর আন্তরিকতায় বলল, ‘মাথা আখব, মা বলে ডাকব, তা বাদে কত অঙ্গ করব মোরা! উয়ার দিনেমানে ভক্তজনা আছে। কিন্তুক এতের বেলা আমি বিনা উয়ার ক্যাও নাই।’

‘দিনে কী খেত তোমার মা?’

‘আমি কি জানি মশায়? এই ধরেন গা, চা খাবে, গাঁজা খাবে, গঙ্গাজল খাবে। দেবাংশী শরীলে কি ভাত—জল চায়?’

‘সন্ধেবেলা?’

‘ভাত রান্ধবে, মোকে দেবে, লিজে খাবে ত্যাতটুকুন। য্যামন কচিছেলা খায়।’

‘সেই জন্যেই রোগটা হয়েছে সাধন।’

‘লা গো! ওগ উয়ার লাই। ওগ কি দেবাংশী শরীলে পশে? মোকে মনে হয় ক্যাও রিষ করে বাণমারা করল বুঝি?’

‘দেখি, আমরা দেখি।’

‘ডাক্তারবাবু!’

‘বল?’

সাধন মাটিতে পা খুঁড়ে বলল, ‘আপোনাদের ঘরে তো লক্ষ্মী বান্ধা গো। ভাতের পাহাড়, ডালের সাগর। তা উয়ার ভাগের ভাতটা মোকে দিতে পার? উতো এখন খায় না!’

‘তা হয় না সাধন।’

ডাক্তার অবাক হয়ে সাধনকে দেখতেই থাকল। মানুষের শরীরে পশুর মতো সরল প্রবৃত্তি এমন করে ডাক্তার আর কখনো দেখেনি।

কিন্তু জটি ঠাকুরনীর চিকিৎসা হল না। ‘উয়ার কী হয়েছে, বলেন মাশায়,’ বলে ডাক্তারের মাথা খেয়ে ফেলল সাধন।

ডাক্তার কী বলবে? জটি ঠাকুরনীকে ওরা গ্লুকোজ দিল, স্যালাইন দিল, গলার নলি শুকিয়ে গিয়েছে বলে নল চালিয়ে খাবার দিতে চেষ্টা করল। চেষ্টার ত্রুটি হল না।

জটি ঠাকুরনীর অবস্থা ভালো হল না। মাঝে মাঝে যখনি ওর জ্ঞান হয় তখনি ও বলে, ‘আঁসপাতালে মোকে এখো না বাপ মোর। মোর সাধন বাপো। উ ডাক্তার মোর লাড়ী ছিঁড়বে, ডোমগুলান মোর খুলি—হাড় বিচে ফার্সা করবে। মোকে ঘরে লিয়া কর।’

তিনদিনের দিন ডাক্তার জটির রোগ ধরতে পারল। জটির রোগ বড় ছোঁয়াচে। আজও ভারতভূমিতে তার চিকিৎসা বেরোয়নি কোন। এ রোগের নাম অনাহার। না খেয়ে না খেয়ে খুদকুঁড়ো সাধনকে খাইয়ে জটি ঠাকুরনীর নাড়ী শুকিয়ে গিয়েছিল।

‘এ দেব—রোগ সাধন, এর চিকিৎসা আমি জানি না।’

ডাক্তার একটু ঠাট্টা করল।

‘তবে লিয়্যে যাই?

‘নিয়ে যা।’

জটি ঠাকুরনীও চোখ চেয়ে বলল, ‘আরে মড়া, আরে বোকা সাধন! মোর জন্মবিত্তান্ত তু জানিস না? জানিস না আমি কুন সামাজের মিয়ে? মোকে ঘরে লে, ঘরে আমি শরীল রাখব।’

বলরাম, জগদীশ, সাধন, আরও পাঁচজন সমারোহ করে জটি ঠাকুরনীকে ঘরে নিয়ে এল। জটির ঘরের সামনে একটা নিমগাছ। তার ছায়াতে জটিকে শোয়ানো হল।

‘নিমগাছের ছায়া ভালো সাধন। আমরা পাঁচজন আছি। তুই যেয়ে ওনার কাছে বস গা।’ বলরামের কথায় সাধন গিয়ে জটি ঠাকুরনীর কাছে বসল।

‘একোজনা বামুন ডাক গো!’

আছে, বামুন আছে।’

‘কে গো?’

‘অনাদি ডাক্তার।’

‘উনিকে ডাক। ঠাকুরনীর কাছে বসাও।’

অনাদি ডাক্তার জটি ঠাকুরনীর কাছে বসল। সাধন অভিভূত কাতর।

‘কথা বুলে যাও গো কিছু, ও আমার সাঁঝ—সকালের মা!’

‘বুলব।’

জটি এখন শেষ সময়ে চেতনা ফিরে পেয়েছে।

‘বুল গো!’

‘তোমার বাপ কান্দোরী। তোমরা জেতে বেদিয়া। বনে ঘুর, বাদাড়ে ঘুর, আর আশ্চাজ্জা চিকনপাটি বুন।’

‘তুমি?’

‘আমি?’

এখন আকাশে সূর্য, বেলা এখন দশটা। জটি যখন ভালো ছিল এই সময়ে ও ঠাকুরনী হয়ে ঘরে বসে থাকত, মানুষজনের পুজো নিত। এখন সাধনের খুব ইচ্ছে মা হয়ে যায় জটি, বলে—সাধন আমার কাছে আয়।

জটিরও ইচ্ছে হল সাধনকে কাছে ডাকে। বলে অ সাধন, কাছে আয়।

জটি তা বলতে পারত। জটি তা বলল না। এখন তার চারপাশে কত ভক্ত, কত মানুষ। এরা ওর কাছে আসে, প্রণাম করে, সম্মান জানায়। ওরাই তো বছরভোর নিত্য চাল যুগিয়ে সাধনকে বাঁচিয়ে রাখে। নিজের ইচ্ছেয় জটি একদিন ঠাকুরনী হয়েছিল। আজ ওকে ঠাকুরনী হয়েই মরে যেতে হবে।

‘তুমি কে গো?’

সাধন সরল ভক্তিতে জিগ্যেস করল। মা কে? জটি কে? সাধনের বাবা যদি কান্দোরী হয়, জটি কি অন্য সমাজের মেয়ে? সাধন, বলরাম, জগদীশ সবাই কাছে ঘিরে ঘন হয়ে এল।

‘তুমরা ছুট নও বাপো! তুমরা জেতে বড়, অ্যানেক বড়।’

‘তুমি?’

‘আমাদের বেত্তান্ত বড় আশ্চাজ্জ গো! মোর আদি পুরুষ সেই জারা ব্যাধ। নাম জান?’

‘জরা ব্যাধ?’

‘মোরা বলি জারা ব্যাধ। মোদের জিহ্বায় তুমাদের সাড় লাই ডাক্তার।’

‘ঘোর বিকার।’

অনাদি ডাক্তার সভয়ে বলল। এমন বিকারের রুগীকে হাসপাতাল ছেড়ে দিল কেন? এমন রুগীকে ঘিরে এত মানুষের ভিড় কেন? জারা ব্যাধ তো মহাভারতের মতোই পুরোনো, গল্প—কথা।

‘বিকার লয় ডাক্তার। মোর কথা সত্যি লা মিছা তা বলতে লারব। শুনেছি…’

জটি এক আশ্চর্য কথা বলতে লাগরল।

‘কুন দেশে য্যান সাগর, কুথায় য্যান দ্বারকাপুরী। জারা ব্যাধ সি দেশে যেঞে বাণমারা করেছিল।’

‘কাকে?’

‘কিষ্ণকে। পুঁথি পড় নাই?’

‘সবাই জানে।’

‘ই তো পাপের রাজা মাহাপাপ! ভগমানকে বাপমারা করে ই হতে বড় পাপ লাই। সি বাদে জারার বংশ সি দেশ তেগে ই দেশে এল।’

‘কোথায়?’

‘হিজলী—কাঁথি—তমলুক—মেদিনীপুরে।’

‘তারপর?’

‘মোদের সামাজ বড় ছোট। মোরা শ্মশানে—মশানে ঘুরি, সাপ ধরি, শ্মশানের কলসীতে জল খাই।’

‘ছি!’

‘মোরা পাখপক্ষী ধরি, মোদের বলে পাখমারা।’

‘পাখমারা কোন জাতি গো? নাম তো শুনিনি।’

‘মোদের আনসামাজে সাঙা হয় না। কিন্তুক আমার মন যেয়ে উ সাধনের বাপে বসল। সামাজে কথা হত, তাই মোরা চলে যেয়ে সাঙা করি গো।’

জটি গুছিয়ে বলতে পারল না। প্রথম বিয়ের নাম বিয়ে। দ্বিতীয় বিয়ের নাম সাঙা। পাখমারাদের জাতধর্ম অনুযায়ী জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিটি মেয়ের সঙ্গে ওদের দেবতার বিয়ে হয়। আগে দেবতাকে জল—নারকেল দিয়ে তবে ওরা মানুষের ঘর করতে আসে।

‘তারপর, অ্যানেক, অ্যানেক দিন বাদে আমি ঠাকুরনী হলাম গো। আমার পরে সাঁজ—সকালে দেবতার ভর।’

‘জটি ঠাকুরনী, জল খাবে, জল?’

‘না বাপো সকল। এখন আমি মাহানন্দে স্বর্গে যাব। কিন্তুক সাধন…’

জটি হেঁচকি তুলল।

‘কী? মোকে কী বল তুমি?’

‘আমি ঠাকুরনী হয়্যেছিলাম। দেখ, মাথার ‘পরে সূর্য।’

‘এখন দিনমান।’

‘তুর মা লয় সাধন, ঠাকুরনী স্বর্গে যায়। তুকে অ্যানেক দেব্য দিতে হবে যি।’

‘কী দেব্য?’

সকলের মনে মহা কৌতূহল। সাধনের মাটির উঠোনে পাড়া—পড়শীর ভিড়। যেন এক অন্ত্যজ, গরিব, হতভাগিনী মারা যাচ্ছে, যেন কোন মহামানী দামি মানুষ মারা যাচ্ছে তাই এত ভিড়।

সবাই চুপ করল। নিশ্বাস টানল। কী চাইবে তাদের জটি ঠাকুরনী শেষ সময়ে।

‘সাঁঝে মরতাম বিয়েনে মরতাম, তুর কানাকড়ি লাগত না। এ্যাখুন তু মোকে হাতি দিবি। ছরাদে হাতি দিবি।’

‘কিরে কাড়লাম।’

শোকে দুঃখে পাগল, ঘটনার অস্বাভাবিকতায় হতবুদ্ধি সাধন বলল, ‘সভে শুন, উনির ছরাদে আমি হাতি দান করব।’

‘ঘো…ঘো….ঘো….ঘোড়া দিবি।’

‘দিব।’

‘অন্ন—বস্ত—ভুঁই—সোনা—উপো অযচ্ছল দিবি।’

‘দিব।’

সাধন ডুকুরে কেঁদে উঠল, ‘সব দিব গো! তুমি মোরে ছেড়ে যেয়ে না। মোর ক্যাও লাই!’

‘তুর বো…বো….বো…

জটির গলায় কথা আটকে গেল। সাধনের যে বউটা পালিয়ে গিয়ে বাপের বাড়ি আছে তাকে নিয়ে আসবার কথাটা জটি বলে যেতে পারল না। তার আগেই ওর মাথা টলে পড়ল।

কোরা কাপড়ে সাজিয়ে, ফুলচন্দনে মুড়ে, ঢাকঢোল বাজিয়ে ওরা জটি ঠাকুরনীকে পোড়াতে গেল। সব খরচ অনাদি ডাক্তার দিল। জটির মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে অনাদি ডাক্তারের প্রথমেই মনে হল, যাক, আর নিত্য নিত্য চাল দেবার দায়—দায়িত্ব রইল না। চালের নাম যখন তালগাছের মাথায় ওঠে তখনো অনাদি জটি ঠাকুরনীকে চাল দিয়ে পেন্নাম করতে যেত। অনাদির বউ বড় রাগ করত, বলত, ‘দেবাংশী মানুষ, কিন্তু ভক্তজনের কষ্ট হয়, তা বোঝে না?’

বড় দুঃখ হল অনাদির। বলরামের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে অনাদি বলল, ‘তোরা যা খাবি খাস। কিন্তু ঠাকুরনীকে চন্নন কাঠে পোড়াবি। হ্যাঁ, কাঠ শুঁকে নিবি। ফুল দিস, খই ছেটাস, পয়সা ছেটাস, কেমন? তোর বোনাইয়ের না কেত্তন দল ছিল?’

জটির মৃত্যু এখন বলরামদের কাছে একটা অলৌকিক ব্যাপার। মরণকালে, ঘোর বিকারে জ্বরাচ্ছন্ন মাথায় জটি যা যা বলেছে সব কিছু এখন বলরামদের কাছে দৈববাণী। তাই বলরাম বলল, ‘না আইলে মাথা ছিঁড়িয়া ফালামু।’

ক্বচিৎ বললাম এ ধরনের কথা বলে। এই কথা শুনেই ওর ভগ্নীপতি এসে হাজির হল। নামে সদানন্দ, স্বভাবেও তাই। সরকারি আপিসে পিয়ন ও।

‘গুলি মার চাকরিতে। ক্যাজুয়াল লীভ নাই? কামাই করলে কখনো সরকারি আপিসে কাজ যায় না।’

এই কথা বলে ও কোমরে গামছা বাঁধল। মাথার চুল আঁচড়ে, গলায় কাগজের বনমালা পরে সদানন্দ আর ওর সেথোরা ‘হরিনাম অঙ্গে লিখে হরিপদে যাও’ গাইতে গাইতে জটি ঠাকুরনীকে নিয়ে চলে গেল।

দুই

সাধনের সাঁঝ—সকালের মা কেমন করে মানবী থেকে দেবী হল সে বড় আশ্চর্য কথা

ওরা মেদিনীপুরের পাখমারা, ওরা যাযাবর। ওরা বলে ওরা জরা ব্যাধের বংশধর। ঈশ্বরকে হত্যা করেছিল বলে ওরা অভিশপ্ত। সুদূর দ্বারকা থেকে ওদের চলে আসতে হয়েছিল।

ওদের ঘর থাকতে নেই। ওরা পাখি ধরে, পাখি বেচে। শ্মশানের গাছে রান্নার হাঁড়ি টাঙিয়ে রেখে ওরা সংসার করে। শবশয্যায় ওদের বর—বউ অবহেলে ঘুমোয়, ভালোবাসে। চিতায় আগুন দেখে ওদের মনে দেহতত্ত্ব জাগে না। মা ছেলেকে সোহাগ করে, স্বামী—স্ত্রী বসে গান গায়।

মেদিনীপুরে লবণ খালাড়িতে, কাজুবাদামের বাগানে, দক্ষিণ ভারতের এমন অনেক লোক আসে, যায়, কাজ করে।

ওদের সমাজের বাইরে বিয়ে করতে নেই। কিন্তু জটির শরীরে আশ্চর্য রূপ ছিল। তামাটে রং, নীল চোখ, কটা চুল। চুল চুড়ো করে বেঁধে জটি তাতে লাল পাথরের মালা জড়াত। বড় ভালো লাগত জটির নদীর জলে মুখ দেখতে, গাঢ় নীল কাপড় পরে নিজের শরীরটি সাজাতে।

শীতকালে জটিরা তখন সুবর্ণরেখার চরে। চরের বালিতে তখন যাযাবর পাখিদের ভিড়। শরবনে ফাঁদ পেতে জটি শিস দিয়ে দিয়ে পাখি ধরত।

সেখানেই একদিন উৎসবের সঙ্গে ওর দেখা। উৎসব জাতিতে কান্দোরী। ওর জাতব্যবসা চিকনপাটি বোনা। উৎসবের তখন বছর তিরিশ বয়স। বেঁটে, বলিষ্ঠ, শ্যামল চেহারা। কাঁধ অবধি বাবরী চুল। উৎসব গান বাঁধত, গান গাইত।

জটিকে দেখে ও গান বেঁধেছিল

‘ও নীল শাড়ি, আঙা মেয়ে

দেখ চেয়ে

তোর লেগে মোর পরাণ জ্বলে যায়।।’

জটির হাতে তখন জালে জড়ানো নীলকণ্ঠ পাখিটা ছটফট করছিল।

জটি ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। পিচ কেটে বলেছিল, ‘পরাণ জ্বলে যায়! খালভরার গান শুন। দিলে তো মোর পাখিগুলান উড়ায়ে?’

 ‘ও পাখি ধরে কি হবে সখী

 মোর প্রাণপাখি

 এনে ফেলে দিব তোর পায়ে

 হা তোর লেগে মোর পরাণ জ্বলে যায়।।’

উৎসব গেয়ে উঠেছিল।

খুব মজা লাগছিল ওর। ওদের সমাজের মেয়েগুলো তো এমন বন্য হয় না! এমন করে চোখ টানে না! মেয়েটার চোখ, ঠোঁট নাক যেন পাথর কেটে বের করা।

‘খালভরা!’

জটি গাল দিয়ে চলতে শুরু করেছিল। উৎসব লাফিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরেছিল।

‘তু আমায় গাল দিলি কেন?’

‘তু গান বাঁধলি কেন? আমার পাখি উড়ালি?’

উৎসব হা হা করে হেসেছিল। তারপর অতর্কিতে ওর হাত থেকে জালটা কেড়ে নিয়ে নীলকণ্ঠ পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছিল। হতচকিত, ক্রুদ্ধ জটির ওপর জালটা ফেলে দিয়ে বলেছিল, ‘তু আমার পাখি। পালাবি? তু আমার প্রাণপাখি।’

জটি কাঁদতে শুরু করেছিল। তারপর জাল ফেলে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল জটি। উৎসবের হাসি ওকে অনেকক্ষণ তাড়া করেছিল।

পরদিন উৎসব চলে এসেছিল ওদের ডেরায়। জটির ঠাকুমাকে গড় করে বলেছিল, ‘টুকো ওষুদ দেন দেখি। বনেবাদাড়ে ঘুরি, বুকে আমার বেথা করে গো। আপোনারা তো গুণী মানুষ, ওষুদের কারবারী, তা টুকো ওষুদ দেন।’

জটি ফোঁস করে বলেছিল, ‘উ খালভরাকে পেটন ওষুদ দিলে ভাল। উ মোর পাখি উড়ায়্যা দিল, তা জানু?’

জটির ঠাকুমা হেসেছিল। জটিকে গাল দিয়ে বলেছিল নিজের কাজে যেতে। এ সমাজের ছেলেমেয়েকে বাইরের দিকে চাইতে নেই, নিজের সমাজে থাকতে হয়। জটির চনমনে ভাব দেখে ঠাকুমার ভয় হয়েছিল।

উৎসব ওদের ডেরায় আর আসেনি। জটির পেছন পেছন ঘুরে ঘুরে ও জটিকে নতুন নতুন অচেনা সব স্বপ্ন দেখিয়েছিল।

ঘরের স্বপ্ন, মাচায় ধানের ডোল, বেতের দোলায় শিশু—সন্তান। সে ঘরে জটি আয়নায় মুখ দেখে, রুপোর গয়না পরে, লাল—নীল নানা রঙের শাড়ি সে ঘরের উঠোনে মেলা থাকে।

চিকনপাটির চেয়েও মনোহারী নকশায় স্বপ্নটার জাল বুনে বুনে উৎসব জটির ওপর জালটা ফেলে দিয়েছিল।

জটি আর জাল ফেলে পালায়নি।

ওরা পালিয়ে গিয়েছিল।

খড়্গপুর থেকে দীঘা। কাজুবাদামের মরশুমে দিনমজুর, মাছের মরশুমে মাছ শুঁটকি করার কাজ।

অনেকদূর না পালালে কাওয়ামারারা অভিশপ্তদের সমাজ ছেড়ে যাবার অপরাধে ওদের তির ফুঁড়ে ফেলত।

উৎসব স্বপ্নটাকে ঠিক সত্যি করতে পারেনি। কিন্তু জটি বড় সুখী হয়েছিল। কি জীবন! শুধু দুটি রাঁধ আর খাও আর ভালোবাসো। হাতে টাকা পেলে কাপড় কেন। কুঁচের মালা, গালার চুড়ি, রুপোদস্তার গোটা। অন্যরকম করে চুল বাঁধ, অন্য ছাঁদে কাপড় পর। এখন তো আর তুমি কাওয়ামারা নও। এখন তুমি জাতে উঠেছ, শ্রেণী বদলিয়েছ।

‘মোদের জাত ফেলনা লয় জটি। মোরা পণ দিয়ে মেয়ে লিই, সমাজকে ভাত—খাসি দিই।’

‘উ কথা থাক!’

জটি সভয়ে বলত, ওর শুধু মনে হত এই ঘর, এই ভালোবাসা থাকলে হয়! চির অভিশপ্ত ওরা, ঈশ্বরকে যারা হত্যা করে গোড়ালিতে বাণ মেরে, তাদের বুঝি ঘুরে ঘুরেই জীবন শেষ করতে হয়।

জটি তো তা করেনি!

যদি সেই রাগে ঠাকুমা বাণ মারে! মা জটি আর উৎসবের খড়ের পুতুল তৈরি করে শলা দিয়ে এ—ফোঁড় ও—ফোঁড় করে!

বড় ভয় পেত জটি, গুন গুন করে বলত, ‘উদের কথা রাখ দেখি, মোর সাথে আন কথা বল।’

‘তু ভর খাস?’

‘খালভরা!’

মৃদুস্বরে বলত জটি। পেছন ফিরে চুল বাঁধতে বসত। একেই কি বলে জাত হারানো, নিচু থেকে উঁচুতে ওঠা? কই, গলায় তো জোর খুঁজে পেত না জটি! বলতে তো পারত না ‘মর গা যা!’

মাঝে মাঝে শুধু ডুম—ডুম, ডুম—ডুম ঢোলের শব্দ শুনলে জটি চমকে উঠত।

পাখমারারা অমনি করে ঢোলে নরম চাঁটি মারতে মারতে আসে। দল বেঁধে ঘোরে ওরা, মৌমাছিদের মতো এক জায়গায় চাক বেঁধে থাকে।

ওই একসঙ্গে থাকাটা ওদের কাছে সবচেয়ে বড় জিনিস।

ওরা তো সামান্য নয়, ওরা যে জরা ব্যাধের বংশধর। ব্যাধ তো সামান্য নয়, সে যাকে মেরেছিল তিনি যে স্বয়ং কৃষ্ণ ভগবান। গাঁই—জ্ঞেয়াতি—সকল মানুষ এত পাপ করেছিল, এত শান্তি পাচ্ছিল যে মনের দুঃখে কৃষ্ণভগবান নির্জনে গিয়ে দুটো দণ্ড জিরোচ্ছিলেন। রাঙা টকটকে পদ্মফুলের মতো পা।

‘আঙা টকটকে, পদ্মফুলের মতো পা!’ জটির ঠাকুমা মাথা নেড়ে নেড়ে বলত, ‘সি শরঝোপ হতে দেখে উয়ার বুদ্ধি হরে গেল যেমন! দিলে টং করে বাণ মেরে! বাস! অমুনে কি হল জান?’

আকাশ অন্ধকার হল, সূর্য মুখ ঢাকল। সমুদ্র মনের দুঃখ জলের প্রাণীগুলিকে উগরে দিল। মাছের ডোঙা মারা পড়ে যারা জলের নীচে গেছে তারা অবধি প্রাণ পেয়ে কেঁদে উঠল। গোয়ালারা গাই দুইতে গিয়ে দেখে দুধের বদলে রক্ত পড়ছে। ফটফটে সকাল। কিন্তু রাতের মতো কালো আকাশে তারা জ্বলতে লাগল।

তখন সেই দৈববাণী হল।

ভগবানকে যারা মারে তাদের ঘরদোর থাকতে নেই। তাই দৈববাণী বললে, ‘জারা হে জারা! ব্যাধ হে ব্যাধ! ই ভোবনে ভগবান বার বার আসে। তুমার মতো একেকটা কসাই ভগবানকে বাণফুঁড়া করে। যারা ই কাজ করে, তাদের ঘরে থাকতে মানা। তুমি এখন তোমার আঁতের লোক, গাঁতের লোক লিয়ে—বে—উদ্দিশা হও গা। জানলে?’

‘কুথা যাই?’

‘যেদিকে দু—চক্ষু যায়।’

‘সামাজ লিয়ে যাব?’

‘সামাজ লিয়ে যাবে লয় তো কি থুয়ে যাবে? তোমার সামাজ এখুন মাহাপাপীর সামাজ। উ সামাজে যে ছেলেমেয়েরা বিয়া দিবে তার মরণ। তা দেখ বিয়াসাদী যা হবে নিজেদের সামাজে। সামাজ ছেড় না। আর দেখ, জারা হে জারা! ব্যাঘ হে ব্যাধ! মোর কণ্ঠ কানে যায়?’

‘যায়।’

‘আর দেখ, তুমার সামাজের প্রতিটি ছেলা বল, মেয়া বল, যেন সামাজ না ছাড়ে। তুমার পাপে উরাও তো পাপী, তাই। জন্মকালে উদের সাথে দেবতার বিয়া দিবে।’

‘দিব।’

জরা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল। আহা! দ্বারকা ছেড়ে যেতে কে চায় গো! কি সুন্দর দ্বারকাপুরী! নীল সমুদ্রের তীরে কি সুন্দর সোনার চুড়ো দেওয়া ঘরদোর। জরা অবশ্য বনেবাদাড়ে থাকে, দূর থেকে দেখে, কিন্তু পরের সুখ, পরের রমরমা, দেখেই কি সুখ কম?

তারপর কি জরার কম শাস্তি হয়েছিল? গাঁতের লোক আতের লোক, পোঁটলাপুঁটলি, শিকারী কুকুর, সব নিয়ে কি কম ঘুরতে হয়েছিল?

কোথায় সত্যপুত্র, কোথায় কেরলপুত্র, কোথায় চোল, কোথায় পাণ্ড্য, শুধু ঘুরে ঘুরেই মরল জরা। ঠাঁই আর পেল না।

হ্যাঁ! ভগবানকে বাণমারা করে এলেন মোদের দেশকে সর্বনাশ করতে। ওরে আমার চালাক শিয়াল! দ্বারকাপুরী শ্মশান করেছ, এখন আমাদের মারবে?’

জরা জায়গা আর পায় না। থিতোতে আর পারে না। এদিকে ওপরে বসে দেবাদিদেব নিশ্বাস ফেলেন। দ্বাপর যুগ যায়, কলি যুগ আসে। ঘুরে ঘুরে জরার বয়েস হল অযুত নিযুত। পায়ে গোদ হল। অঙ্গে ব্যথা। কে যেন একদিন দয়া করে বললে, ‘রাঢ় জান? বঙ্গ জান? গৌড় জান? যাও! গঙ্গা যেখানে সাগরে মিশে, সেই দেশে যাও। সে দেশে সকল পাপী—তাপী—লোভী—তঞ্চক—শয়তান আশ্রয় পায়। সে দেশ কারেও ফিরায় না। সেই দেশে যাও তুমি।’

জরা এই দেশে এল।

সমাজের মধ্যে বিয়ে, শ্মশানের শয্যায় ফুলশয্যা, শ্মশানের কলসিতে বউ ভাত রাঁধে, গাঁই—জ্ঞেয়াতির পাতে দেয়। খুব স্বাধীন ওদের মেয়েরা পুরুষরা। ওদের মেয়েদের রূপের শেষ নেই। তামাটে চুল চুড়ো করে বেঁধে ওরা পলাকাটির মালা দিয়ে জড়ায়। ওদের চেহারায় পাথরের মূর্তির মতো স্বচ্ছ সৌন্দর্য। বহু পুরুষ ওরা কুল ভাঙেনি। স্বজাতে বিয়ে করেছে। রক্তের পবিত্রতা ওদের মহাপ্রাচীন। তাই ওদের চেহারা এত সুন্দর।

কমতে কমতে, মরতে মরতে, এখন ওরা মাত্রই শ—খানেক জন আছে। কখনো ওরা দল ছেড়ে সরে যায় না।

শহরের রাস্তা ধরে, গ্রামের পথ ধরে ওরা চলে যায়, ডুম—ডুম—ডুম—ডুম ঢোলক—বাদ্য বাজিয়ে।

পাখমারা যায়! পাখমারা যায়!

শহরে ওরা পারতপক্ষে আসে না।

মাঝে মাঝে, বছরে একবার দু—বার, ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার আপিসে ওরা নাম লেখাতে আসে। কেউ মরে গেলে নাম লিখিয়ে রেখে যায়।

সরকারি খাতায় ওরা বুঝি সংরক্ষিত উপজাতি।

জটি তাই, এক কানে, আধেক মনে উৎসবের কথা শুনত। আরেক কানে, আধেক মনে বাজনা শুনত ডুম—ডুম—ডুম—ডুম।

ওরা যদি আসে?

মা—বাবা, পিতামহী, গাই—গাঁতের মানুষ?

যদি বলে, ‘চল মোদের সঙ্গে? বনে চল, সামাজে ফিরে চল?’

জটি কী করবে?

উৎসব ওর ভয় দেখে হাসত। গান বাঁধত।

‘ওরে তোর মিছে ভয়।

পিরীত ফাঁদে ধরা দিতে কেন এত ভয়।’

জটি বলত, ‘খালভরা!’

উৎসব বলত, ‘আমার জান থাকতে তোকে ল্যায় কে? তোর উ বুনো বেটারা? তারা উৎসবকে চিনে? একবার দারোগাকে বলা করালে সব বেটাকে শায়েস্তা করে ছেড়ে দিবে।’

তবু জটির ভয় যেত না। কিন্তু ক্রমে ক্রমে, উৎসব ওকে অনেক ভয় ভুলিয়ে দিল। জটির কোলে এল এই মোটাসোটা, একমাথা চুল এক কালোকোলো ছেলে। দেখে আর বলে দিতে হয় না এ ছেলে উৎসবের। বাপের মুখ যেন অবিকল বসানো। শুধু চোখ দুটি মায়ের মতো। স্বচ্ছ, নীলাভ, টলটলে।

জাতে ওঠার আকাঙ্ক্ষা খুব বেড়ে গেল উৎসবের। জটিকে তো ও নিজের হাতে তুলেছিল। উৎসব মনে মনে জানে সে চিকনপাটি বোনে, সে পাখমারা—পাখধরাদের চেয়ে জাতে উঁচু। আবার এই যে এখন মজুর খাটা—এও আরেক ধাপ জাতে ওঠা।

ছেলের বাপ হয়ে উৎসবের মনে হল সে আরো উঠতে চায় জাতে। সে আর গরিব—গুরবোর বৃহৎ সমাজে থাকতে চায় না। ভদ্রলোকের ছোট্ট সমাজের এক কোনায় আসন পেতে চায়।

জটিকেও উৎসব তাই—ই বলল।

‘জটি লো জটি জটেশ্বরী! বিড্ডি আপিসে যেয়েছিলাম, তা বি—ডি—ও বাবুরা কী বললে জানিস?’

‘কী?’

‘একুন আর কুন বাধা নাই। আমি টাকা খর্চ করে কাছারিতে যেয়ে একুনি নাম পালটাতে পারি। কান্দোরী—মান্দোরী যে শুনে সেই বুঝে জেতে মোরা ছোট গো!’

‘নাম পালটাবি?’

‘কেন লয়?’ উৎসব কান্দোরী কেমন শুনতে? উৎসব দাশ, সাধনচন্দ্র দাশ কেমন শুনতে? তা বাদে অন্য কাজ লিয়ে বড় শওরে চলে যাস যদি, তাহলে তো কাজ সারা।’

‘কেন?’

‘বড় শওর জগন্নাথের ছিক্ষেত্তর। সেথা ক্যাও কারো খোঁজ ল্যায় না। নাম দেখলে চিন্তা করবে এ বেটা লিশ্চয় জেতে উঁচু, লইলে নামের পিছে দাশ কেন?’

উৎসবের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ আনন্দ হয়েছিল জটির। কোমরে হাত দিয়ে ও নাচতে শুরু করেছিল। ‘চল, চল, তাই চল। এখুনি যেয়ে জেতে উঠি।’

উৎসব সস্নেহে বলেছিল, ‘পাগলী! এখন কি? ছেলার বয়স হোক! মুখে অন্নপ্রসাদ দেই। দেব——ঠাঁইয়ে পুজো পাঠাই!’

জটির একবার মনে হয়েছিল যার পূর্বপুরুষ একবার ভগবানকে হত্যা করে, সে কি নিজের সমাজের নির্দিষ্ট দেবতা ছাড়া অন্য কাউকে পুজো করতে পারে? যদি পাপ হয়? যদি ক্ষতি হয়?

তারপর মনে হয়েছিল উৎসব ঠিকই বলেছে। সব ছেড়ে পালিয়ে গেল, সরকারের কাছারিতে লিখে—পড়ে জাত পালটালে তাহলে আর ওর মা—ঠাকুমা ওকে ধরতে ছুঁতে পারবে না।

‘তাই ভালো!’ জটি চোখ বুজে বলেছিল।

পাখমারাদের পূর্বপুরুষ জরা ব্যাধকে যে দেবতা দৈববাণী করেছিলেন, তিনি হেসেছিলেন?

হল, সাধনের মুখপ্রসাদ হল। উৎসব তখন খড়্গপুর স্টেশনে মোট বয়। কুলীদের সমাজকেও ও ভাত—খাসি দিল। তারপর চোরাই বিক্রির চোলাই মদ খেয়ে বমি করে হাসপাতালে মরে গেল।

নিজের দেখানো স্বপ্ন, প্রাণভরা ভালবাসা, কণ্ঠভরা গান, সব নিয়ে চলে গেল উৎসব। জটি আবার একা। জটি এখন স্বাধীন। জটি এখন ইচ্ছে করলে যেখানে মন চায়, চলে যেতে পারে। কিন্তু দোলায় শুয়ে ওই যে ছেলেটা কাঁদে আর মিটিমিটি চায়?

জটি বুঝতে পারল, এখন ওকে কি করতে হবে। চলে যেতে হবে ওদের সমাজে। পা ধরে কাঁদতে হবে পিতামহীর। জটি তো জানে উৎসব মরেছে পিতামহীর বাণে। ডাক্তার যা বলুক আর পুলিশ যা বলুক!

ভয়—পাওয়া পাখির মতো ছেলেকে বুকে নিয়ে জটি চলে গেল ওদের সমাজে।

হা ভগবান! কোথায় ওদের গাঁই—জ্ঞেয়াতি—আঁতের মানুষ? কোথায় সেই বিচিত্রবর্ণের পোশাক, কুকুর—ছাগল গাধার পিঠে জিনিসের বোঝা, পিতামহীর খলখল হাসি?

শ্মশানে নেই, মশানে নেই, কোথাও নেই ওরা। জটি ছুটে ছুটে শহরের ট্রাইবাল বোর্ডের আপিসে গেল।

‘পাখমারাদের ঠিকানা দেন মহাশয়, আপোনার ব্যাগ্যতা করি’, জটি পিয়নের পা ধরতে গেল।

শ্মশান—মশানে দেখগা যা! কোথা যেয়ে পড়ে আছে দেখ গা!’

জটির চোখ ফেটে জল এল। এ সমাজ ছেড়ে ও সমাজে, এ জাত ছেড়ে ও জাত, কত লোভ দেখিয়ে উৎসব তো সব স্বপ্ন কেড়েকুড়ে নিয়ে চলে গেল।

জটি এখন কী করে?

অনেক রূপ, অনেক স্বাস্থ্য, অনেক যৌবন নিয়ে জটি গিয়ে স্টেশনে বসল। কোলের কাছে ছেলে। জটি গালে হাত দিয়ে আকাশ—পাতাল ভাবে আর ভাবে।

জটি ভাবে ওর ছেলের কথা। আর পাঁচজন ভাবতে শুরু করল জটির কথা।

জটি এখন কী করে, কোথায় যায়? জটি গিয়ে কুলী লাইনের হনুমানতলার সন্নেসীর কাছে পরামর্শ চাইল।

‘এখানে থাক।’

সন্নেসী চোখ বুজেই বলল। প্রৌঢ় সন্নেসী। অনেক ঠাকুর—দেবতার পর এই হনুমানজীকে আঁকড়ে আছে বলে এখন ওর অবস্থা ফিরেছে খানিকটা।

জটি এসে এখানে বসবার সঙ্গে সঙ্গে হনুমানতলার ভিড় বাড়তে লাগল। সন্নেসী মনে প্রমাদ গনল।

কয়েকদিন বাদে তিন—চারজন লোক জটির কাছে এল। বলল, ‘ওই বুড়োর আশ্রয়ে থেকে কি হবে? চল আমাদের সঙ্গে। আমরা তোকে শহর দেখাব।’

মিছেমিছি জটি শিরায় শিরায় বহু বছরের প্রাচীন রক্ত বয়ে বেড়ায়নি। বন—জঙ্গল, বনের প্রাণী তার যেমন চেনা, অচেনা মানুষে তেমনি ভয়—ওর।

‘দূর হ, খালভরা’, বলে জটি ওদের গালাগালি করেছিল।

হয়তো তারাই গিয়ে নালিশ করে থাকবে।

কয়েকদিন বাদে পুলিশ এসে সন্নেসীকে শাসিয়ে গেল কড়া গলায়। বলল, ‘সব খবর পাওয়া গেছে।’

‘খবর, খবর কি পাবেন বাবামশায়? আমি সন্নেসী মানুষ। ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকি।’

‘ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাক না ঠাকুরনী নিয়ে?’

‘ছি ছি মুখ পচে যাবে তোমার…।’

‘এখানে মেয়েছেলে রাখ। এখানে বজ্জাতি, বদমায়েশি হয়। মদ চোলাই হয়, তাসের জুয়া খেলা হয়।’

‘সব ঝুট।’

সন্নেসীর ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিল।

পুলিশের লোকটি গেরস্ত মানুষ। সে বলেছিল, ‘কথা যে মিছে তা তুমিও জানছ, আমিও জানছি। ওই মেয়েটার জন্যে যত গোলমাল! তা ওকে কেন সরিয়ে দাও না?’

‘সরিয়ে দিলে তো ওদের খপ্পরে যাবে। ওরা তো তাই চায়।’

‘তবে মরগা যা!’

পুলিশের লোক রেগে চলে গিয়েছিল। যাবার সময় বলেছিল, ‘কেন ওসব গুন্ডা বজ্জাতকে চটাচ্ছ? গুড় যতক্ষণ রেখেছ, ততক্ষণ মাছি আসবে। ও মেয়েটা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ মানুষ আসবে এখানে। ওদের তো রাজত্ব এখন। এসে যদি মেয়েটাকে টেনে নিয়ে যায় তখন কোন বাপের সুমুন্দি এসে ঠেকাবে শুনি?’

সন্নেসী মহাচিন্তায় পড়েছিল। তবে জটি বুঝেছিল এখানে আরও থাকলে সন্নেসীর বিপদ, ওরও বিপদ।

‘লাও, আমার য্যাখন সোমসার ছিল, এই বাসনকুসন। সব গচ্ছিত রাখ ঠাকুর, আমায় টাকা দাও ক—টা!’

‘কোথা যাবি? ছেলেটা কোথা যাবে?’

‘জানি না।’

‘তোর কেউ নাই?’

‘জানি না।’

সন্নেসী শেষে নিশ্বাস ফেলে ওকে একটা লাল চেলি কাপড় দিয়েছিল। এমন রাঙাচেলি দিয়ে বিহারের মানুষ মড়া ঢাকে।

লালচেলি আর একটা ছোট ত্রিশূল দিয়েছিল সন্নেসী। বলেছিল ‘একদিন তোকে শেয়ালে—শকুনে ছিঁড়ে খাবে তা মনে জানতে পারছি। তবু তুই এই বস্তরে—অস্তরে চলে যা মা। এ ঘোর কলিতেও থাড় কেলাসে সাধুসন্নেসী চলে যেতে পারে, কেউ মাথায় পা দেয় না।

‘যদি শুধায় কিছু?’

‘বলবি আমি জটি ঠাকুরনী।’

‘ঠাকুরনী?’

‘আহা বলবি, বলতে মানা কি?’

‘ঠাকুরনী!’

সত্যিই ট্রেনে কেউ কিছু বলেনি জটিকে। ওর রূপ, রাঙা কাপড়, পিঠের পোঁটলায় ছেলে, হাতে ত্রিশূল দেখে সবাই অবাক হয়ে যাচ্ছিল।

জটি জানলা দিয়ে চেয়ে ছিল বাইরের দিকে। দুই চোখ জলে ভেসে যাচ্ছিল ওর। এই তো মানুষ ওকে মান্য দিল, সমীহ করল। এরই নাম কি জাতে ওঠা? আহা উৎসব যদি থাকত, তবে দেখতে পেত কাছারি নয়, আদালত নয়, শুধু একখানা কাপড় আর ত্রিশূলের জোরে জটি কেমন জাতে উঠে গিয়েছে।

আরেকটি লোক ওকে লক্ষ্য করছিল। লোকটি ট্রেনে গান গায়, কখনো শ্যামা সংগীত, কখনো হরিনাম। লোকটি বয়স্ক, রোগা, সংসারে ওর কেউ নেই।

জটিকে দেখে ও বলেছিল, ‘হাওড়া তো পৌঁছলে বাছা। এখন যাবে কোথা?’

জটি কথা বলেনি।

জটি চোখ বড় বড় করে হাওড়া স্টেশন, জনারণ্য দেখছিল। এই বুঝি সেই ছিক্ষেত্তর। যার কথা উৎসব বলেছিল! এত মানুষ এখানে, অসংখ্য, অগণন। জঙ্গলে বুঝি একটা গাছে এত পাতা নেই। এত মানুষের মধ্যে জটি কোথায় যাবে?

‘বলি যাবে কোথা?’

লোকটি আবার জিজ্ঞেস করেছিল।

জটি বলেছি, ‘তা তো জানি না।’

লোকটি বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে যাবে?’

‘কুথা?’

জটি ওকে ভয় পায়নি। তখন জটির ভেতরে সেইসব আদিম সহজাত প্রবৃত্তি কাজ করছে। মানুষ দেখলে ও পলকে বোঝে কাকে ভয় করবার, কাকে ভয় করবার নয়। এই লোকটিকে দেখে ওর ভয় হয়নি। তা ছাড়া সামনের আশ্চর্য সব দৃশ্য ওর চোখ টেনে রাখছিল।

‘আমার সঙ্গে।’

‘কুথা গো কথা?’

‘আমার বাসা। আমি গাড়িতে গান গাই।’

‘গান গাও?’

‘হ্যাঁ গো!’

লোকটি বুঝিয়ে দিয়েছিল সব। গান গেয়ে ও ভিক্ষে করে। যদি জটি সাধনকে কোলে নিয়ে ওর সাথে—সঙ্গে ঘোরে তাহলে ভিক্ষে পাওয়া সোজা হয় আরও।

‘তুর ঘর কুথা?’

‘তু মু বলিস না বাপু, যাবি তো চল।’

বেশ চলল এক বছর। জটি সঙ্গে থাকে, লোকটি গান গায়। পয়সা দিয়ে বাসায় গিয়ে সন্ধেবেলা জটি চাল কিনে ভাত রাঁধে, লোকটি দাওয়ায় শোয়, জটি ঘরে ঘুমোয় দোর আটকে।

‘সাধন রে সাধন! বাপো রে বাপো!’

জটি বন্য আদরে ছেলেটাকে অস্থির করে দেয়। তা ছাড়া স্টেশনের কাছাকাছি নেপালি ও ভোটবুড়িদের মালা—তাবিজ—শেকড়—পাখির পা—ব্যাঙের ছাল বেচতে দেখে ওরও শহুরে বুদ্ধি হয়েছে।

যখন কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘হ্যাঁ গো, তুমি সাধনী হয়েছ। তা গেঁটে বাতের টোটকা কিছু জান?’

জটি মুখ ভেংচে গালি দেয় না। পিতামহীর কাছে দেখা টোটকাটুটকি মনে আনতে চেষ্টা করে, মাঝে মাঝে ওষুধ দেয়।

বেশ চলছিল, বেশ চলে যেতে পারত, কিন্তু লোকটি একদিন দাওয়া ছেড়ে ঘরে এসে ঘুমোতে চাইল। কতদিন আর দাওয়ায় ঘুমোতে পারে ও? জটি কেমন করে জানবে দাওয়ায় ঘুমোবার কষ্ট কত?

জটি ত্রিশূলটা তুলে ধরল। বলল, ‘জানু আমি কে? কুন সামাজের মিয়ে? জানু মোর বাপ কে, মা কে, গাঁতি—জ্ঞেয়াতি আঁতের মনিষ কে? তু আমায় কুপস্তাব করিস? বাণ মেরে মেরে ফেলাব না!’

পরদিনই জটি চলে এল আশ্রয় ছেড়ে। অনেক ভেবে চিন্তে ও ঠাকুরনী হল। ঠাকুরনী না হলে জটি ওর হাবা ছেলেকে বাঁচাতে পারত না। নিজেকে বাঁচাতে পারত না মানুষের নজর থেকে।

জটি বুঝেছিল অলৌকিকতা দিয়ে নিজের চারদিকে বর্ম না আঁটলে নিজেকে ও বাঁচাতে পারবে না।

‘সোন্দর মুখের মরণ!’ জটি অস্ফুটে বলল।

তিন

‘সাধন! এখন তো তোমায় ছরাদ্দ করতে হবে বাপ।’

পাঁচজন এসে বলল।

‘করব হে পাঁচজন। মা—কে আমি হাতি দিব, ঘোড়া দিব, ভুঁই দিব, সোনা দানা দিব। কিরে কেড়েছি।’

সবাই মুখ চাওয়া—চাওয়ি করল। সাধনের কথা পাগলের প্রলাপ। কিন্তু সাধন যে কিরে কেড়েছে তাও তো মিথ্যে নয়।

তা ছাড়া, জটি তো সামান্য মানুষ ছিল না। সে যে ঠাকুরনী, অলৌকিক, আধিভৌতিক জগতের দোরধরুনী।

‘কি যে করলি সাধন! তুই যে বললি তা কত টাকার খেলা তা জানিস?’ বলরাম গভীর আন্তরিকতায় বলল।

‘কিরে কাড়লাম যি।’

‘এখন যা, ভিখ মাঙতে যা। দোরে দোরে ভিখ মেগে আয়।’

সাধন গলায় কাছা নিয়ে ভিক্ষে করতে বেরুল।

মা নেই, এখন আর কেউ সন্ধে হলে তপ্ত ভাত রাঁধে না। শোলমাছ পুড়িয়ে ছাল ছাড়িয়ে, আদার রস, লেবুর রস, লংকা, লবণ, তেল দিয়ে মেখে বলে না ‘বাপো, মোর কুলের কাছে বসে যাও।’

চোখে জল, গলায় কাছা, কোমরে ছেঁড়া কম্বল, সাধন ভিক্ষে করতে গেল।

কেউ দিতে চায় না। ঘুরে ঘুরে, পায়ের নড়া খসিয়ে সাধন একুশটি টাকা পেল। আর এক পালি চাল। এক পালি চাল দিয়ে অনাদি ডাক্তার জটির সঙ্গে জন্মের সম্পর্ক কাটাল।

অবশেষে বলরাম গেল কালীঘাট। সবচেয়ে দরিদ্র, সবচেয়ে হতভাগ্য চেহারার এক পুরুতকে সাষ্টাঙ্গ পেন্নাম ঠুকে বলল, ‘বড় বিপদ ঠাকুর। আমার নয়, আমার বন্ধুর। এমন একটা উপায় বাতলাও দেখি, সাপও মরে আবার লাঠিও না ভাঙে।’

‘কেমন করে? বলি বিপদটা কী?’

বিপদের বহর শুনে তো বামুন হেসে বাঁচে না। বলরাম বললে, ‘আপনারা তো চিরটা কাল মধুর ঠাঁইয়ে গুড দেন। সোনার ঠাঁইয়ে পাঁচসিকা। দেখুন দেখি শাস্তরে কোনো বিধান আছে কিনা।’

বামুন নাকে নস্যি টিপে বলল, ‘মূল্য ধরে দেবে, বলি তা পারবে তো?’

‘কত মূল্য?’

‘ধর গা একশো টাকা!’

‘একশো টাকার জোগাড় যদি থাকবে, তবে তোমার মতো পাঁচসিকের বামুনের কাছে আসি?’

‘আশি টাকা?’

বামুন লোভাতুর চোখে চাইল। এই সময়ে ইস্কুরুপ আঁটলে ক—টা টাকা আসে। কিন্তু কোন সাহসে বামুন দর কষবে? কালীঘাটের বামুন এখন উপোসী ছারপোকা। পাঁচ টাকা হাতে পেলে সসাগরা ভারতভূমি দান করিয়ে দেবে। বলরাম একটু ভেবে নিল। যাওয়া—আসার খরচ, একটু নেশার খরচ, কত কাটবে, কত রাখবে। তারপর, কড়া গলায় বলল, ‘দেখ ঠাকুর, তোমার হাতে আমি আঠারোটি টাকা দেব। কাজটি তুমি করিয়ে দেবে। নচেৎ আমি অন্য ঠেঁয়ে চললাম। পয়সা ফেললে পুরুতের অভাব? গুড় ছড়ালে পিঁপড়ে আসে না? ‘হ্যাঁ’ বলবে না ‘না’ বলবে ভেবে দেখ। আমার হাতে টাইন কম। তোমার সঙ্গে কেজে—কোঁদল করতে আমার টাইন নেই।’

‘নিয়ে এস তোমার বন্ধুকে। তা বাবা, মার্কণ্ডের কাপড়, পিত্তিপুরুষের কাপড়, ঘি, ফুল, কাঠ, তিল, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য—সব তোমরা আনবে তো?’

‘ও রে আমার চালাক মাধাই! তাই যদি আনব তবে আর তোমার ময়লা গামছার গন্ধ শুঙতে আসি?’

বলরাম সাধনকে নিয়ে এল।

সব জোগাড় করে রেখেছিল পুরুত। পুরুতের বাড়ির বারান্দায় বসেছিল সব জোগাড় করে।

‘দক্ষিণ মুখে বস বাপ!’

পুরুত খনখনে গলায় বলল। ও পাশে ছাঁটা চুল, লাল চোখ, ছাতার মতো ভুয়োরঙের একটা লোক বসে আছে।

‘উটি অগ্রদানী। দান নেবে।’

অগ্রদানী চোখ কুলে বলল, ‘লাও দেখি মামা! হাজার টাকার ছরাদ তো? দশ মিনিটে সেরে দাও দেখি, একবার চাকদা যেতে হবে।’

‘এই তো! নাও বাপু, আচমন কর।’

আচমন হল। শ্রাদ্ধ শুরু হল। একেকটা জিনিস সাধনের হাতে ছোঁয়ায় পুরুত আর বিদ্যুৎবেগে কেড়ে নেয়। আঠারোখানা একটাকার নোট নিয়ে বলরাম বসে আছে, মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।

খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল প্রেতক্রিয়া। একখানা চার আনার গামছার একেকটা সুতো ছিঁড়ে সাধন অজানা সব লোক ও লোকাতীতকে অজস্র বস্ত্র দান করল। তারপর পুরুত বলল, ‘বল, মা—কে কী দিতে চেয়েছিলে?

‘এঁগ্যে, হাতি!’

‘লাও বাপ, পাঁচসিকা ফেল। ইটিও তোমার হাতিদানের পুণ্য হল, জানলে? বিকল্পে মূল্য ধরলে, এইভাবে দান করা চলে, জানলে?’

বলরাম কাগজে লিখলে হাতি, তার পাশে লিখলে পাঁচসিকে।

সাধনের মুখ এখন বিহ্বল, বিমূঢ়। এ কি আশ্চর্য কথা! পাঁচসিকে মূল্য ধরে দিলে প্রতিশ্রুত গজদানের ফল হয়? এমন জানলে কি সাধন…

‘পাঁচসিকা ধর, অশ্বদান হল।’

তখন অদ্ভুত এক প্রতিযোগিতা শুরু হল। সাধন বলে অশ্ব—ভুঁই—সোনা—ধান—বস্ত্র—তৈজস। পুরোহিত বলে পাঁচসিকা—পাঁচসিকা। বলরাম শুধু দেখে এই অপরিমিত দান—যজ্ঞ আঠারো টাকার মধ্যে থাকছে কিনা।

‘বামুনকে গো—দানটা পাঁচ আনায় সেরে দেন ঠাকুরমশায়,’ বলরাম হেঁকে বলল।

প্যাঁকাটির ধোঁয়ায় চোখ কুঁচকে অগ্রদানী বলল, ‘পাঁচ আনায় গাই—গোরু হয়?’

‘না হলে মামা—ভাগ্নাকে আঙুল চুষে মরতে হবে। দক্ষিণা দিতে হবে না?’

সাধনের পরনে মা—র একখানা ছেঁড়াখোঁড়া লাল চেলি। সাধনকে দেখতে এখন ক্ষ্যাপা মোষের মতো। প্যাঁকাটির আগুনে মাটির এতটুকু খুরিতে কয়েক দানা চাল সেদ্ধ করা হয়েছে, শ্রাদ্ধান্ন। ভাতের গন্ধ নাকে যাওয়াতে সাধন এখন ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে।

‘লেঃ সাধন, আচমন করে বামুনকে পেন্নাম ঠুকে উঠে পড়।’

সাধন উঠে পড়ল। সাধনের চোখ মাটির দিকে। সাধনের গামছায় বাঁধা অনাদি ডাক্তারের দেওয়া এক পালি চাল। চালটা বামুন সবটা রাঁধল না কেন? চালটা তো মাকেই দেওয়া হল, তাহলে কয়েক দানা রাঁধবার অর্থ কী? সাধনের সন্দেহ হল। নাক দিয়ে ঘোঁত করে শব্দ করল ও।

‘তুই ব্যাটা আমার হাতে আঠারো টাকা ধরিয়ে দিয়ে হরিশ্চন্দোর হয়েছিলিস? রামচন্দোর হয়েছিলিস?’

বলরাম হাসতে গিয়ে থেমে গেল। সাধন উপুড় হয়ে পড়েছে, চাল গামছায় বাঁধছে।

‘কর কী, কর কী বাপ? ও চাল যে আমার পাওনা।’

‘চুবো শালা!’

সাধন বামুনকে গাল দিল। এই বামুন না ওকে দিয়ে জটি ঠাকুরনীকে অগাধ, অতুলন ঐশ্বর্য দান করিয়েছে? জটি ঠাকুরনী না এখন সোঁ সোঁ করে স্বর্গে যাচ্ছে? যে দেবতাকে ওর পূর্বপুরুষ মেরেছিল, তারই পায়ের কাছে? গোলকধামে? সাধন সব ভুলে গেল কেন?

‘সাধন, কী করিস?’

‘চাল লিয়ে যাই, ভাত আঁধব!’

‘আরে ও ছরাদের চাল, তোর খেতে নাই!’

‘চুবো বলরাম!’

মত্ত হাতির মতো চেঁচিয়ে উঠল সাধন। বলল, ‘ঘরে কানাকড়ি লাই যে চাল কিনে আঁধব। ই চাল আমি হাতছাড়া করি!’

‘বেটা মূর্খ, গজমূর্খ!’

‘চাল আমার! বলরাম! আমার পাছু আসিস না।’

পুরুত নিষ্ফল আক্রোশে বলল, ‘শ্রাদ্ধের চাল নিয়ে রেঁধে খাওয়া? এ শ্রাদ্ধ তোর নষ্ট হল ব্যাটা!’

‘কেন নষ্ট হবে, আমি হাতি দিই নাই? গোরু দিই নাই? সোনা—রুপা, বস্ত দিই নাই? কোন শালা আমার মায়ের ছরাদ নষ্ট করে শুনি?’

বুকের কাছে চালের পোঁটলা, সাধন হেলে দুলে বাড়ি যায়। সাধন বাড়ি যাবে, উনোন ধরাবে, ভাত রাঁধবে।

ভাতের গন্ধ বড় ভালো গন্ধ। ভাতের গন্ধে সাধন তার মাকে খুঁজে পায়। যতদিন ভাত রাঁধবে সাধন, তপ্ত ভাত খাবে, ততদিন ওর কাছে সাঁঝ—সকালের মা বাঁধা থাকবে।

মায়ের কথা মনে করতে গিয়ে পুরুতের ওপর দুর্ব্যবহারের অনুতাপে সাধনের চোখ জলে ভেসে গেল। মা, তুমি যেমন তেমন করে স্বর্গে যাও। সাধন এখন ভাত রেঁধে খাবে। তুমি দোষ নিও না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *