সম্মান

সম্মান

‘মানে!’ মেয়েটা অবাক হয়ে তাকাল জোনাথন দাদুর দিকে।

জোনাথন দাদু হাসল। তারপর নিচু কিন্তু সুরেলা স্বরে বলল,

‘এত কিছুর পরেও
সূর্য তবু বলে না পৃথিবীকে,
“আমার কাছে ঋণী”
পরস্পরের দূরে
তবুও ভালবাসায় ভরে থাকে
আকাশ চিরদিনই…’

মেয়েটা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল জোনাথন দাদুর দিকে। তারপর অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় কিগানদা?’

‘কিগানদা? মানে, কিগান অর্ক ব্যানার্জি?’ মালিনী থতমত খেল। কিগানদাকে একটা মেয়ে খোঁজ করছে? এখানে খোঁজ করছে! ও তাড়াতাড়ি জোনাথন দাদুর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে দেখল। আরে! কিগানদাই তো! কিগানদা এখন রাবাংলায় আছে? কই, ও জানে না তো! কী করছে কিগানদা এখানে? এখানে কোথায় আছে? গত কয়েকদিনে বিশেষ ঘর থেকে বেরোয়নি মালিনী, তাই দেখতে পায়নি? আর এই মেয়েটা? মেয়েটা কে?

মালিনী বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তু…তুমি? তুমি কে?’

মেয়েটা এবার জোনাথন দাদুর সামনে থেকে উঠে এসে দাঁড়াল মালিনীর সামনে। বলল, ‘অনেক কষ্ট করে এখানে পৌঁছেছি। বাড়ির থেকে বাবা-মা প্রথমে ছাড়তে চায়নি। বন্ধুরাও প্রথমে আসতে চায়নি সঙ্গে। তারপর রিজার্ভেশন পাইনি, জেনারেল কমপার্টমেন্টে করে এসেছি। তারপর পঞ্চাশ জায়গায় ধাক্কা খেতে খেতে এই অবধি এসে পৌঁছেছি। আপনি বলুন প্লিজ।’

জোনাথন দাদু উঠে দাঁড়িয়ে হাসল। তারপর বলল, ‘তুই চিনিস মালি? একটু ওপর দিকে পাহাড়ি ঢালের এক বাংলোয় থাকে মানুষটা। অদ্ভুত মানুষ। শান্ত। সহজ। আর হ্যাঁ, দুঃখীও বটে।’

মেয়েটা বলল, ‘আমায় বলে দেবেন প্লিজ। কোথায় থাকে একটু…’

‘আমি নিয়ে যাচ্ছি। চলো,’ জোনাথন দাদু উঠে দাঁড়াল। তারপর মালিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাবি মালি? চল, আমরা সবাই আজ একসঙ্গে যাই। তুই ভেতর থেকে আমার জিপের চাবিটা এনে দে তো!’

ছোট্ট পাহাড়ি রাস্তা, লতানো গাছের মতো পাক খেয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। জোনাথন দাদুর পাশে বসে রয়েছে মালিনী আর ওর পাশে মেয়েটা। পিছনে বাকি চারজন।

পিছনের মোটা ছেলেটা প্রথম কথা বলল, ‘দিঘি, কিগানদা আমাদের খাওয়াবে তো? সকাল থেকে চক্কর কেটে কেটে পেটে জলহস্তী ঘাই মারছে।’

‘বাজে বকিস না গুন্ডা,’ ছোট করে কাটা চুলের মেয়েটা সামান্য বকল, ‘জলহস্তীর পেটে আবার জলহস্তী ঢোকে?’

‘দেখ রূপ, বেশি ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই করবি না। ভাল হবে না কিন্তু…’

‘ওই দেখো, বাড়ি।’ জোনাথন দাদু রাস্তার একপাশে জিপটাকে পার্ক করে পাশের ধাপ ধাপ করে উঠে যাওয়া রাস্তার শেষে বাংলোটাকে দেখাল।

‘ওটা?’ দিঘি লাফিয়ে নামল। কিন্তু ধাপ বেয়ে না উঠে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ।

মালিনীও জিপ থেকে নেমে দাঁড়াল। পথের পাশের সামান্য আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে দিঘিকে। যেন জলভরা পাত্র। যেন শ্রাবণের মেঘ। যেন গাছ থেকে খসে পড়বে এমন চেরি ফল। কেন এমন করছে মেয়েটা? কী হয় কিগানের? কে হয়?

জোনাথন দাদু ‘এসো তোমরা’ বলে এগিয়ে গেল। মালিনী মুঠোয় নিজের মোবাইলটা চেপে পা বাড়াল।

কাঠের সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে জোনাথন দাদু গলা তুলে ডাকল, ‘কিগান, কিগান।’

মালিনী একবার পিছন ঘুরে দেখল। দিঘিকে কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। ওর সঙ্গের সবাইও কেমন যেন অস্থির। কেন এসেছে এরা? সবাই এমন করে তাকিয়ে রয়েছে কেন? কী ঘটতে চলেছে সামনে? মালিনী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বারান্দার দরজাটার দিকে।

‘ও কিগান ভায়া,’ জোনাথন দাদু ডাকল আবার।

এবার কাঠের বাড়িতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। শব্দটা এগিয়ে আসছে। ওই খুলল দরজাটা। আর সামনে ঝোলানো চিকটা নড়ে উঠল। সাদা শার্টের অংশটা দেখা গেল প্রথমে। আর তারপর বারান্দায় এসে দাঁড়াল কিগান।

ছিপছিপে সেই চেহারা। কপালে নেমে আসা আগোছালো চুল। আর অদ্ভুত সুন্দর দুটো নীল চোখ।

‘আরে…’ কিগান জোনাথন দাদুকে দেখে হাসতে গিয়েও আচমকা পাথরের মতো হয়ে গেল। মালিনী দেখল কিগানের চোখ, আর কোনও কিছু নয়, শুধু সবাইকে ভেদ করে দেখছে দিঘিকে! কোনও কথা বলতে পারছে না কিগান। নড়তে পারছে না। চোখ ফেরাতে পারছে না। এ যেন দৃষ্টি-বন্ধন। যেন চিরন্তন মহাকর্ষ!

দিঘি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বারান্দার দিকে। কিগান এখনও স্থির হয়ে আছে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না কী দেখছে ও। যেন চোখের পাতা ফেললে ভেঙে যাবে এ দৃশ্য! সামান্য নড়লে নষ্ট হয়ে যাবে সব স্বপ্ন! দিঘি এগোতে লাগল। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিগান। জোনাথন দাদু আস্তে হাতের ইঙ্গিত করল বাকি সকলকে। আর সবাই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পিছিয়ে গেল। মুখ ফিরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঘাসে। শুধু মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আগে মালিনী দেখল কিগানের বুকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দিঘি। ওর দৃষ্টি আরও ঘন, আরও বদ্ধ হয়ে আছে।

মালিনী আকাশের দিকে তাকাল। কখন যে মেঘ কেটে গেছে, বুঝতেই পারেনি! ও দেখল এক আকাশ তারা ফুটে আছে মাথার ওপরে। যেন বকুল ফুল। যেন হিরের গুঁড়ো। আর সেই নিয়ে পৃথিবী ছুটে চলেছে অনন্তের পথে। এত অর্বুদ প্রাণ, এত অগণিত বৃক্ষসকল, এত অসংখ্য নদী ও জলসংগ্রহ বহন করে, তার সমস্ত নিয়ে পৃথিবী নিজেকে সমর্পণ করছে সূর্যের জীবনে। এ সমর্পণে কোনও দ্বিধা নেই, নেই কোনও বন্ধন। এ সমর্পণ শিশুর হাতে একমুঠো পয়সার মতো, এ সমর্পণ আলোর মতো, গাছ থেকে মাটির বুকে মুখ লুকোনো ফুলের মতো। মালিনী বুঝল আলো মানুষের ভেতরেই থাকে। যেমন সূর্য লুকিয়ে থাকে রাতের অন্ধকার গভীরে। জল সম্পূর্ণ করে আগুনকে আর রাত্রি পূর্ণ করে দিনকে।

মালিনী দেখল চারদিক নিস্তব্ধ। কেউ কথা বলছে না কোনও। যেন সামান্য শব্দও ভেঙে দেবে এই জাদুবাস্তবতা।

হঠাৎ নিঃশব্দে মোবাইলটা কেঁপে উঠল মালিনীর হাতের মুঠোয়। আর তার তরঙ্গে সর্বাঙ্গ ঝিকিয়ে উঠল ওর। কে ডাকল ওকে? কার মনে পড়ল মালিনীকে? কে এমন মুহূর্তে আসতে চাইছে ওর কাছে? দেখবে? মালিনী কি দেখবে একবার?

ফোনটা কাঁপছে। নিঃশব্দে সে শরীর ঝাঁকিয়ে ডাকছে মালিনীকে। মালিনীর চোখ বন্ধ হয়ে আছে। কে ফোন করল? সে?

তারপর ধীরে ধীরে মুঠো খুলল মালিনী। ধীরে ধীরে চোখ রাখল স্ক্রিনে আর ওর চোখের কোণে ধীরে ধীরে এসে জমা হতে লাগল হিরের কুচি, বকুল ফুল।

এমন দু’-চার কুচি হিরে আর টুপটাপ বকুল ফুলের জন্যই তো বেঁচে থাকে পৃথিবী। বেঁচে থাকে প্রাণীজগৎ। বেঁচে থাকি আমরা।

——

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *