সম্পর্কের সমাপ্তি

সম্পর্কের সমাপ্তি

ঋতিকার ফোনটা বাজছে৷ অতি পরিচিত নম্বরটা৷ ইচ্ছা করেই রিসিভ করল না ও৷ আবারও মিথ্যের জালে নিজেকে জড়াতে চাইছে না ও৷ বার পাঁচেক কন্টিনিউ ফোন করেই চলেছে উৎপল৷ বিরক্ত হয়েই রিসিভ করল ঋতিকা৷ হ্যালো বলার আগেই উৎপল বলল, ‘পারলে ক্ষমা করো৷ আমি অনেক মিথ্যে বলেছি তোমায়৷ মিথ্যে না বললে তুমি কোনোদিন ফিরেই তাকাতে না আমার দিকে৷ আসলে তোমরা হলে হাই প্রোফাইল মেয়ে৷ লেখাপড়া, গান-নাচ, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড— সবেতেই তুমি এক নম্বরে৷ আর আমি নেহাতই লাস্টবেঞ্চার৷ আচ্ছা ঋতিকা, লাস্টবেঞ্চারদের প্রেম হয় না কেন? সবাই নাক সিটকে নেয় কেন? সকলের কি লেখাপড়া হয়? আমি ভালো ছবি আঁকতে পারি, গাড়ি চালাতে পারি, ব্যাবসাটাও মন্দ করি না৷ তবুও গায়ে স্ট্যাম্প মারা হয়ে গেছে লাস্টবেঞ্চার৷ ফার্স্ট বেঞ্চে বসা সব ছেলে যে সব সময় জীবনে সফল হবেই এমন কোনো কথা নেই কিন্তু৷ তবুও দেখো লোকের চোখে কত সম্ভ্রম ওদের জন্য৷ আর পাড়ার লোক অসুস্থ হলে, হসপিটাল থেকে শ্মশানে যেতে হলে, ব্লাড লাগলে ডাক পড়ে আমাদেরই৷ কিন্তু ওই যে লাস্টবেঞ্চার স্ট্যাম্পটা ওঠানোর ক্ষমতা আমার নেই৷ আমি জানি না, পুলিশ তোমায় কতটা কী বলেছে৷ তবে আমি বলছি৷’

ঋতিকা বলল, ‘আমি কিছু জানতে চেয়েছি, উৎপল? চাইনি না? ফার্স্ট বেঞ্চ বা লাস্ট বেঞ্চের কথা যদি বলতেই হয় তাহলে তুমি আমার বন্ধু অনুরূপাকে দেখে কেন বলেছিলে, এর বয়ফ্রেন্ড খুব উদার, বুঝলে? এমন একটা কালো মেয়ের প্রেমে পড়েছে৷ আমার তো সুন্দরী ছাড়া অনুভূতিটাই আসবে না৷ উৎপল, তুমিও ফেসবুকে আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলে আমার সবকিছু দেখেই৷ সুতরাং অযথা সেন্টিমেন্টাল হওয়ার কিছু নেই৷ বাই দ্য ওয়ে, আমি তোমাকে সব সত্যি বলেছিলাম৷ আমার বাবা ইউনিভার্সিটি টপার ছিল৷ তারপরও মায়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল৷ সুতরাং ফার্স্ট বেঞ্চের হলেই সে প্রেম টিকে যাবে এমন নয়৷ যে সম্পর্কের ভিত্তিতে মিথ্যের পাঁচিল গাঁথা, হয় সে প্রেম এখন টিকে গেলেও পরে ভেঙে যেত৷ সুতরাং আমাদের সম্পর্কের মেয়াদ ওই সত্যিটুকু প্রকাশকাল পর্যন্তই ধার্য ছিল৷’

উৎপল বলল, তুমি আমায় একটা কথা বলো, আমি যদি বলতাম, আমার দুটো প্রাইভেট কার আর একটা লরি আছে৷ আমি এগুলো ভাড়া খাটাই৷ আর আমি উচ্চমাধ্যমিকে দুবার ব্যাক পেয়ে পাস করেছি৷ সত্যি বলতাম যদি৷ তাহলে আমাদের সম্পর্কটা কি সম্ভব হত?’

 ঋতিকা ব্যঙ্গাত্মক হেসে বলল, ‘ধরো, আমি তোমায় বললাম, আমি আই.এস.সি. ক্যান্ডিডেট৷ আমি লোকের বাড়ি বাসন মেজে নিজের লেখাপড়ার খরচ জোটাচ্ছি৷ তুমি এগোতে সম্পর্কে? ভেবে বলো উৎপল৷’

উৎপল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তাহলে আমাদের সম্পর্কটা দি এন্ড তা-ই তো?’

ঋতিকা বলল, ‘তুমি আমার ভালো বন্ধু থাকবে বলে ফর্ম্যালিটি করতে পারলাম না৷ আমিও আমার মায়ের মতো একটু কাঠখোট্টা হয়েছি৷ তাই যে সম্পর্কের শুরুটাই মিথ্যের ওপরে দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছিল, সেটা আর না থাকাই ভালো৷’

উৎপল বলল, ‘বেশ তবে তা-ই হোক৷ কিন্তু একটা কথা বলার আছে৷ আমি কাউকে খুন করিনি৷ ইন ফ্যাক্ট, আমি বার দুয়েক টাকা ধার দিয়েছিলাম, জয়ন্তদা আমায় একটু বেশি ইন্টারেস্টসহ ফেরত দিয়েছিল ঠিকই৷ কিন্তু আমি সত্যিই কাউকে খুন করিনি৷ আমি পুলিশকে সত্যিটা বলে দিয়েছি, কে সেদিন আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে গিয়েছিল, আর কার বলায় আমি সেটা দিয়েছিলাম৷ জানি না, পুলিশ কতটা বিশ্বাস করেছে৷’

ঋতিকা বলল, ‘পুলিশ বিশ্বাস করেছে৷ পুলিশ আমাকেও জানিয়েছে, উৎপল খুনটা করেনি৷ ওকে ফাঁসানো হয়েছিল৷ সত্যি বলতে কী এটা শুনে আমি বোধহয় একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছি৷ না হলে বার বার মনে হত আমি একজন খুনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলাম৷ সেটা আরও কষ্টদায়ক হত উৎপল৷’

 উৎপল বলল, ‘রাখার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, তুমি কি আমায় ক্ষমা করলে?’

ঋতিকা হেসে বলল, ‘তাতে আমাদের কারোই আর বিশেষ কিছু যায়-আসে না৷ আমার মা বলে, ক্ষমা চাওয়াটা অপরাধীর একটা মুখোশ৷ অপরাধীকে ক্ষমা করা মানে তাকে আরেকটা অপরাধ করার সুযোগ করে দেওয়া৷ এসব থাক৷ ভালো থেকো৷ নিজের মতো করে জীবনকে গুছিয়ে নিয়ো৷ পারলে সত্যি দিয়ে গড়ে নিও৷’

উৎপল বলল, ‘তুমি কিছুটা আমার জেঠিমার মতো কথা বলো৷ আমার জেঠিমা বলে, সময় থাকতে সত্যের হাত ধরলে মানুষ একটা গভীর নদীও সাঁতরে পেরিয়ে যেতে পারে৷ আর মিথ্যাকে ভরসা করলে এঁদো নালায় এসে পা পিছলে পড়তে হয়৷ জেঠিমা সেদিন বলেছিল পুলিশের কাছে গিয়ে সত্যিটা বলতে৷ কিন্তু জেঠু বলেছিল চুপচাপ গা-ঢাকা দিতে৷’

ঋতিকা বলল, ‘তোমার কখনো মনে হয়নি, তোমার জেঠু একটা মারাত্মক অন্যায় কাজ করছেন? নিজের স্কুলের ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ড্রাগ অ্যাডিক্টেড করে দিচ্ছেন মানুষটা সব জেনে-বুঝে কিছু টাকার জন্য৷

উৎপল বলল, ‘আসলে কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বোঝানোর মতো মানুষ খুব কম, ঋতিকা৷ সেদিন তোমায় দেখলাম, এক ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প করছিলে রেস্টুরেন্টে৷ ওটাই কি তোমার বাবা ঋতিকা?

 যা-ই হোক, আমি আজ এটুকুই বলব বলে ফোনটা করেছিলাম, খুনটা আমি করিনি৷’

ঋতিকা একটু চুপ করে থেকে ফোনটা রেখে দিল৷ ইদানীং নাচের ক্লাসে গিয়েও আর ভালো লাগে না৷ সোনাঝুরি অসুস্থ৷ অনুরূপা ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে যাচ্ছে৷ আর ঋতিকারও মন খারাপ থাকে উৎপলের সঙ্গে সম্পর্কটার ব্রেকআপ নিয়ে৷ যারা এভাবে ওষুধের নামে, চকোলেটের নামে মাদক দিয়ে মানুষকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলছে, ডিপ্রেশনের রোগী করে দিচ্ছে, তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত৷ ঋতিকার হাতে ক্ষমতা থাকলে ও তাদের ফাঁসির হুকুম দিত৷ সোনাঝুরি তো সেদিন বলল, স্পা করতে গিয়ে ওকে অ্যারোমা থেরাপির নামে কোকেন শুঁকিয়েছিল অনেকক্ষণ ধরে৷ মাথা ঝিমঝিম করছিল ওর৷ ওষুধ খেলে একটা অদ্ভুত ড্রাউজিনেস আসে ঠিকই৷ কিন্তু ওই ফিলিংসটা আলাদাই৷ সেই ফিলিংসটা পেতেই ও প্রায় কুড়িটা মতো ক্যাপসুল খেয়ে নিয়েছিল৷ তারপর আর ও কিছু জানে না৷ অ্যাট্রাকটিভ নামের ক্যাপসুলে যে নেশার জিনিস আছে,সেটা ঋতিও বুঝতে পেরেছিল৷ কারণ বিকেল পাঁচটা বাজলেই শরীর কিছু যেন একটা চাইত৷ এখনও ওই নেশাটা পুরো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ঋতিকা, শুধু চেষ্টা করে যাচ্ছে৷ এই প্রথম ও সুবর্ণা গোস্বামীর চোখে ভয় দেখেছিল৷ ভয় না আতঙ্ক কে জানে!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *