সমুদ্র-যাত্রা – ৭

নিউ দিল্লি স্টেশনে দাদার আসার কথা। দেখলুম না। নিজের ব্যাগটা দু পায়ের মধ্যে রেখে পকেট থেকে দাদার ঠিকানা বার করি। গ্রেটার কৈলাস। প্রথমে দাদা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকত। এখন গ্রেটার কৈলাস, মানে সেই অরোরাদের বাড়ি। স্টেশন থেকে কতটা দূর কোনও ধারণাই নেই আমার। এখানে শুনেছি ট্যাক্সি, অটো কিছুই মিটারে চলে না। চললেও টুপি পরাবার বন্দোবস্ত করে। একটু ভেবে নিতে হবে, কালীবাড়িটাড়ি গিয়ে আস্তানা নেওয়া ভাল। ওখানে মোটের ওপর সস্তা শুনেছি। তারপর ফোন করব। আমার পিঠে হাত পড়ল। দাদা।

—ভীষণ জ্যামে পড়েছিলুম। তুমি খুব ভাবছিলে?

—হ্যাঁ, ভাবছিলুম কোথায় যাই। কালীবাড়িটাড়ি…

—আরে! আমার একটা দায়িত্ব নেই।

—তুমি পুরো সাড়ে তিন বছর এসেছ দাদা। একবারও বাড়ি যাওনি।

—থিসিস শেষ করতেই তো তিন বছর চলে গেল! তার সঙ্গে চাকরি, খুব টাফ। অ্যাডজাস্ট করতে সময় লাগে। দিজ পিপল আর সো স্মার্ট! আমাদের ঐতিহ্য তো… ভেতো আপ ব্রিঙ্গিং একেবারে!

দাদার পোশাক—আশাক চলন—বলন সত্যিই এখন খুব স্মার্ট। ইংরেজি সিনেমায় যেমন দেখা যায়। চেহারাটাও খুব ভরেছে। পুরো স্যুট পরনে। চকচকে জুতো মোজা। চশমার ফ্রেমটা পাল্টেছে।

বাইরে দেখলুম একটা কালো অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে।

—ওঠো। দাদা আমার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে পেছনের সিটে চালান করে দিল। তারপরে ড্রাইভিং সিটে বসল।

—তুমি গাড়ি কিনেছ?

—তুমিও যেমন! অরোরাজির গাড়ি। আমি ড্রাইভিং শিখে গেছি। ও বাড়ির সবাই—ই জানে। আর একটা ফিয়েটও আছে। যখন যার যেটা দরকার হয়…

দাদাকে দেখে আমার সম্ভ্রম জাগার কথা ছিল, কিন্তু আমার ঈষৎ মজাই লাগছিল। দাদা যেন বিশেষভাবে আমাকে অভিভূত করবার চেষ্টা করছিল। এর আগে দাদার সঙ্গে আমার দিনগুলো ছিল খুব চুপচাপ। একটা দুটো কথা, কাজ, দুজনের দুদিকে চলে যাওয়া। এত কম কথা বলত, এত একা—একা থাকতে পারত যে মনে হত দাদার পছন্দের মানদণ্ড এমনই যে হয় দাদার কাউকে পছন্দ হয় না, নয় দাদাকে কেউ পছন্দ করে না, এবং দাদা সেটা জানে। সেই চুপচাপ প্রায় ধ্যানস্থ মানুষটা যদি হঠাৎ খুব হাসি উপছে—পড়া, বাচাল মতো হয়ে যায়, তখন অনেকগুলো সম্ভাবনা মনে আসে। হয় তো বাইরের কর্মজগৎটা এতটাই ওর স্বভাবের বিপরীত এবং সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া ওর এতই অসম্ভব যে সেই জগতের বাইরের পোশাকটা ও পরে ফেলেছে, এক রকম ঝাঁকের কই হবার মরিয়া চেষ্টা এটা। আবার এও হতে পারে, আমার কাছে ধরা পড়ে যাবার একটা শঙ্কা ওর মনে কাজ করে যাচ্ছে। ও কিছু লুকোতে চায়। এমন আমূল বদলে যাওয়া কি সম্ভব?

—মা কেমন আছে? কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করল।

—যেমন থাকে।

—বোন?

—অনেক বড় হয়ে গেছে।

—দাদু?

—বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন।

—তুমি কি ভেবেছিলে, দাদু ইয়াং হয়ে যাবেন? দাদা ছোট্ট একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসল। আমি কিছু বললুম না। ভেবে দেখতে গেলে দাদুর বুড়ো হয়ে যাওয়ার তথ্য তো আমি দিইনি। দিতে চেয়েছি সম্পর্কের সুতো ধরে একটু টান, দাদার মধ্যে দাদুর লালিত যে বড় নাতি লুকিয়ে আছে তাকে। ভেবে দিইনি। তবে দাদা বুঝতে পেরেছে। না হলে ওই হাসি আর ওই মন্তব্যের আড়াল খুঁজত না।

 গ্রেটার কৈলাসের প্রথম দিনটা ছিল নির্মল, স্বচ্ছ, স্ফটিকের একটা দানার মতো। খুব সুন্দর জিজাইনের একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালুম। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, প্রচুর লেভেল ব্যবহার করা হয়েছে বাড়িটিতে। যিনিই করে থাকুন অল্প জায়গাকে বেশি করবার মন্ত্র তিনি জানেন। একেবারে ডান দিকের দরজা চাবি দিয়ে খুলল দাদা। ভেতরে একটা দারুণ সাজানো ঘর। মোটা মোটা সোফা, তাতে ঝলমলে কভার। দেয়াল থেকে নানা রকম জিনিস ঝুলছে। যিনিই সাজিয়ে থাকুন খালি দেওয়ালে তিনি বিশ্বাস করেন না।

—বোসো। দাদা সগর্বে চাবির রিংটা ঘোরতে লাগল।

—তোমার ঘরে তুমি বাইরে থেকে যখন খুশি ঢুকতে পারো তা হলে?

—না হলে আর স্বাধীনতা কী?

—পুরো স্বাধীনতা নয়, তুমি অন্যের ওপর নির্ভরশীল তো বটেই।

—পার্টলি। বাট আ অ্যাম পেয়িং ফর ইট।

পাশের ঘরটা দাদার শোবার ঘর। এখানে কাজ করবার টেবিল—চেয়ার, পাতলা একটা খাট, দেয়ালের সঙ্গে আটকানো আলমারির পাল্লা। বইপত্রের জন্য তাক।

—তুই আমার খাটটায় শুবি, বুঝলি। আমি এই ঘরে ডিভানটা পেতে নেব। নিশ্চয় চান করবি। চলে যা। শোবার ঘরের সঙ্গে টয়লেট, শাওয়ার অ্যান্ড এভরিথিং পাবি।

অনেকক্ষণ পরে দাদা আমাকে তুই বলল। অর্থাৎ আড়ষ্টতাটা একটু কেটেছে।

—কী খেতে চাস? ভাত না রুটি!

আমার মনে পড়ল দাদার চিঠির কথা। বললুম—রুটি। দাদার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল আয়।

একতলা থেকে একটা মেজানিনের মতো ঘরে গেলুম। এটা খাবার ঘর। দাদা হিটারে কিছু একটা গরম করল। একটা কৌটো রাখল টেবিলে।

—মাংস আর রুটি, এখানে নানান রকম চাটনি আছে। ক্ষীরা খাবি তো?

—ক্ষীরা?

—শসা, শসা।

আমি জানাই হ্যাঁ। তখন দাদা ফ্রিজ থেকে কাটা আধখানা করা তিন—চারটে শসার প্লেট মাঝখানে রাখল।

—অসুবিধে হবে?

—একেবারেই না।

আমি বয়—স্কাউটে ছিলুম বলে ঘর গোছানো, রান্না করা, বাসন মাজা, বিছানা করা সবই শিখে গেছি। কিন্তু দাদা ছিল মার্কামারা বাঙালি বাড়ির ছেলে। এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেতেও আপত্তি। মা ওর টেবিলে একটা ঘটিতে জল রেখে চাপা দিয়ে পাশে একটা গ্লাস উপুড় করে রেখে দিতেন। এখন দূর বিদেশে একলা চাকরি করতে এসে দাদাও দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু শিখে গেছে।

—ভাল না?

—ভাল, তবে একটু বেশি ঝাল। ঠিকই আছে।

—রুটিটা?

—খুব ভাল।

এই ‘ভাল’, ‘খুব ভাল’গুলোও যেন দাদার যথেষ্ট বলে মনে হল না। মুখ দেখে একটু হতাশ মনে হল।

—এ বাড়ির লোকেরা কোথায়?

—অরোরাজি তো ইউনিভার্সিটিতে। মাম্মি সোশ্যাল সার্ভিস করেন, একটা সংস্থা আছে। এই ধর, গরিবের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, দুঃস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী হতে শেখানো। শি ইজ এ প্যারাগন অব ভার্চু। সবাইকার কাছেই একেবারে মায়ের মতো।

—আর?

দাদার মুখ একটু লাল হল, বলল—সোনু, মানে ওঁদের মেয়ে এয়ার লাইনস—এ কাজ করে। তাই…আমি তো ছুটি নিয়েছি।

আমি বললুম আমি কিন্তু কালই ফিরতি ট্রেনে চাপব দাদা।

—বলিস কী রে! দিল্লি দেখবি না?

—পরে, এখন না। দিল্লি দেখা পালিয়ে যাবে না।

—কলেজ?

—হ্যাঁ,—আমার অন্য কারণও ছিল, সেগুলো বলি না।

বসবার ঘরে—অলস ভাবে বসে দাদা একটা সিগারেট ধরাল।

বলল—কী ওয়র্মথ আর কী লাইফ তুই কল্পনা করতে পারবি না।

কার আমি জিজ্ঞেস করি না।

—এরা জানে কীভাবে লাইফ এনজয় করতে হয়। বুঝলি? খোলামেলা দরাজ হাসি। যেমন রোজগার করে তেমন খরচ করে। ফ্যান্টাস্টিক।

আমি চেয়ে থাকি।

—তুই চিন্তা করে দেখ, এরা কিন্তু লাহোরের উদ্বাস্তু। এরই মধ্যে পুরো দিল্লি শহর এদের দখলে। মানে, ডমিনেটেড বাই পঞ্জাবিজ। ড্যাশিং পিপল, অনেক কিছু শেখার আছে…

এতক্ষণে আমি বলি—এঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের ঢালাও সাহায্য পেয়েছিলেন দাদা। দিল্লির আশেপাশের অঞ্চল, প্রপার দিল্লিসুদ্ধু কলকাতার মতো ক্রাউডেডও ছিল না তখন।

—ইয়া, দে স্টার্টেড উইথ অ্যান অ্যাডভান্টেজ। রাইট।

একটু চুপ। তারপর সিগারেটে দুটো টান দিয়ে বলল—সমু, আমি কলকাতা ফিরে যাবার কথা ভাবতে পারি না। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

আমি হেসে বলি—কে বলেছে ফিরে যেতে? যেখানে তোমার কর্মক্ষেত্র সেখানে তো থাকতেই হবে। আজ যদি তুমি ভারতের বাইরে ভাল সুযোগ পাও, যাবে না?

—ব্যাপারটা তা নয়, বুঝলি? এঁরা আমাকে জামাই করতে চাইছেন। সোনু মানে মেয়েটি, ডিভোর্সি। এখন এই পরিস্থিতিতে আমাদের রক্ষণশীল বাড়ি চাইবে না বিয়েটা, তাই না?

—আমার তা মনে হয় না।

—হয় না? সোনুর একটি বাচ্চাও আছে, ছেলে, স্কুলে যায়। পাবলিক স্কুল। ভেরি ব্রাইট। বুঝতে পারছিস সিচুয়েশনটা একটু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে।

আমি একটু ভাবিত হয়ে পড়েছিলুম ঠিকই। কিন্তু দাদাকে সেটা জানতে দেওয়া ঠিক মনে করলুম না।

দাদা বলল এই যে বাড়ি, ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ওর বাবার, কিন্তু ওর ব্যবসায়ী স্বামীর কাছ থেকেও ও অ্যালিমনি বাবদ এককালীন থোক টাকা নিয়ে নিয়েছে বুদ্ধি করে। ইনভেস্ট করেছে। ভাল ভাল শেয়ার।

শী ইজ কোয়াইট রিচ।

আমি চেয়ে আছি।

দাদা খুবই অস্বস্তিতে পড়ল। প্রশ্নের উত্তরে কথা বলা যত সহজ, প্রশ্নহীনতার মুখোমুখি ততটা নয়।

বলল—তুই কি রাগ করছিস?

—না তো! তুমি বলছ আমি শুনছি।

—আসলে ওদের একটা শর্ত আছে। ওরা চায় বিয়েটা কোয়ায়েটলি এখানেই হয়ে যাক। এবং এই বাড়িতেই আমাকে থাকতে হবে। কিন্তু বাড়ি বা সম্পত্তির ওপর সোনুরই অধিকার। আমি যেন না ভাবি এই বাড়িতে আমার আত্মীয়স্বজনকে… মানে…রাখতে—টাখতে পারব।

—বিয়ের সময়েও আমরা কেউ উপস্থিত থাকতে পারব না? —আমি বিরক্ত হয়ে বলি,—এ কেমন শর্ত!

—না না, বিয়েতে অবশ্যই যে যে পারবে উপস্থিত থাকবে। যার যার সুবিধে হবে। ধর দাদু তো পারবেন না। মা—বাবা এঁদের পক্ষেও তো সম্ভব নয়। ধর তুই, ফিনকি। তোরা…

আমি দাদার সিগারেটের ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। খোলামেলা কথা কোনওদিন দাদার সঙ্গে বলিনি। বাড়িতে টাকা—পয়সা পাঠাবে কি না, এটাও জিজ্ঞেস করতে পারলুম না।

—রাতে ঘুম হয়নি। আমি একটু ঘুমোতে চাই দাদা। এইখানে ডিভানেই আমার হয়ে যাবে।

—শিওর, একটু ঘুমিয়ে নে, তারপর বিকেলবেলা তোকে দিল্লি দেখিয়ে আনব। কালকেও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

—কিন্তু ওঁরা তো এটা চান না!

—কী?

—এই যে তোমার পরিবারের কেউ এখানে আসুক!

—ননসেন্স। এই স্পেসটার জন্যে আমি খরচ করছি। তা ছাড়া তোর কথা আলাদা।

—কেন?

—তুই একটা বাডিং এঞ্জিনিয়ার…

আমি একদম চুপ করে যাই।

—ওরা এমনিতে কিন্তু খুবই অতিথিবৎসল। সে সব না। একটা দুর্ঘটনা হয়ে গেছে তো। তাই একটু সাবধান।

দাদা আমাকে কুতুবমিনার চত্বর হয়ে লাল কেল্লার সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শো দেখাল। ইন্ডিয়া গেট যেতে আসতেই দেখা যায়। শহরের কেন্দ্রে পার্লামেন্ট হাউজ, রাষ্ট্রপতি ভবন হয়ে চাণক্যপুরী দেখে দাদা গ্রেটার কৈলাসের পথ ধরতে আমি বলি—দাদা, রাতের খাওয়াটা কোনও একটা ধাবা—টাবায় খেয়ে নিলে হত না? দিল্লির পরোটাগলির খুব নাম শুনেছি!

—সে তো অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। পুরনো দিল্লিতে। বলবি তো আগে? কিন্তু আজ ডিনারে ওঁরা তোর জন্যে অপেক্ষা করবেন, আলাপ করবেন।

—সো কাইন্ড অব দেম। কিন্তু আমি আর ওখানে ফিরতে চাইছি না। এখানে কোথাও একটা থেকে নিতে পারব। তুমি যে এই আমাকে গাড়িতে এত ঘোরালে পেট্রলের দামটাও…

—কী বলছিস? পেট্রল আমি দিই! দে নো যে তুই আসছিস। আমাদের বাড়ির প্রতিনিধি। ওঁরা কথা বলবেন তোর সঙ্গে।

এত ক্রুদ্ধ যে আমি হতে পারি আমার জানা ছিল না। বললুম—আমি আমার বাড়ির প্রতিনিধি নই দাদা, হতে পারি না। আমি এসেছিলুম শুধু তোমার ভাই হিসেবে। তোমার কী সব বলবার কথা আছে…শুনতে। শোনা হয়ে গেছে। এবার ওখান থেকে ব্যাগটা নিয়ে আমি চলে যাব।

—সমু, তুই এত রাগ করবি—আমি বুঝতে পারিনি। প্লিজ বি রিজনেবল। আমার কথা থেকে যতটা তোর মনে হয়েছে ওঁরা অতটা ওরকম নন। তুই চলে গেলে ভীষণ ইনসাল্টেড ফিল করবেন!

—আমরা যে কতটা ইনসাল্টেড হচ্ছি সেটা তা হলে তুমি বুঝতে পারছ না! তাতে তোমার কিছু যায় আসে না!

—শোন শোন, তোকে যা—যা বললুম, মানে বাড়ির লোক আসা—যাওয়ার কথা, সে সব ওঁরা ইন সো মেনি ওয়র্ডস বলেননি কখনও। এগুলো আমি জাস্ট বুঝে নিয়েছি।

এত জোর করতে লাগল যে আমি যেতে বাধ্য হলুম। বেশি না না করা আমার কোনওদিনই আসে না।

দাদার ঘরে ঢুকে চান করে একটা পাজামা—পাঞ্জাবি পরলুম। ভিজে চুল আঁচড়ালুম। বসার ঘরে ঢুকে দেখি এক বিশাল বপু সালোয়ার কামিজ পরা মহিলা খুব জমজমে গলায় কথা বলছেন, তাঁর পাশে একটি বছর আট—দশের ছেলে।

আমি নমস্কার করে দাঁড়িয়ে থাকি।

—বৈঠিয়ে বৈঠিয়ে। আপ তো মেরি বেটা জৈসা। সোনু সোনু! উনি গলা তোলেন, এবং একটি লম্বা—চওড়া লালচে ফর্সা মেয়ে ঘরে ঢোকে।

—নমস্তে।

আমি নমস্কার করি।

মেয়েটির কোনও জড়তা নেই। অভিজ্ঞতার ছাপ মুখটাতে, ব্যক্তিত্ব। ও আমার মেরুদণ্ডহীন দাদাকে চালিয়ে নিতে পারবে। আমার দাদা যোগ্য হাতে পড়েছে দেখে আমি নিশ্চিন্ত হই।

বিনা বাক্যব্যয়ে ডিনার সারতে যাই। দলজিৎজি স্ত্রীর মতো অতটা বেঢপ নন। দিল্লি ইউনিভার্সিটির সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ডিন, একটু অহঙ্কার আছে বোধহয়। সরসোঁ কি শাক, দু তিন রকমের আচার, তরকা, শুকনো মাংস, ঘন ডাল। এত রকম পদ। আমার কথা ভেবে ওঁরা ভাতও রেখেছিলেন।

—আপ তো সাগর সে ভি হ্যান্ডসাম হ্যাঁয়—সোনু বলল।

—রাইট—তার বাবা একমত হলেন।

দাদা জানাল আমি কীভাবে যোগ—ব্যায়াম করে আমার শরীর তৈরি করেছি।

ওঁরা জানতে চাইলেন—ওঁদের মেয়েকে আমার কেমন লেগেছে।

আমি জানাই খুব ভাল। ওঁদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। জিজ্ঞেস করেন বিবাহ—প্রস্তাবে আমার সায় আছে কি না। আমি জানাই আমাদের নিয়ম বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠতম অর্থাৎ আমার গ্র্যান্ডফাদারকে ওঁদের লিখতে হবে। মনে হয় না কেউ আপত্তি করবেন। ওঁরা স্বস্তি পান।

তখন প্রায় ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। দাদা একটু কঠিন স্বরে বলল—তা যদি বলিস, আমরা কী পেয়েছি ওই বাড়ি থেকে? রাজকুমারকে কেন্দ্র করে ঘুরছে ওখানে জীবন। মায়ের মতো নির্লিপ্ত, ছেলেদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন মা আমি আর দেখিনি। পাগল জ্যাঠামশাইয়ের খরচ কেন আমাদের বইতে হবে? কাকার মেয়ের ভারই বা কেন আমাদের? দুই বুড়ি তো চিরটাকাল দাদুকে আর মাকে এক্সপ্লয়েট করে গেল। এখন আমাকেও করছে। দাদুকে বলিস টাকাপয়সার জন্যে কাকাকে ওঁর লেখা উচিত। কোনওক্রমে রান্না, একটা মুখে দেবার মতো জিনিস নেই, ওটা একটা হানাবাড়ি। তুই যা—ই—ই মনে করিস আমি ওখানে আর ফিরছি না। তুই—ও যত তাড়াতাড়ি পারিস কেটে পড়। রাজকুমার বুঝুক।

সারারাত ঝমাঝ ঝম করে গাড়ি চলে। বাইরে ভেতরে। একটু ঘুম আসে, আবার চলতি স্টেশনের আলো চোখে পড়ে, ভেঙে যায় ঘুম। তারপর শেষ রাতে ঘোর নিদ্রা আমায় অধিকার করে। ভাবনা, চিন্তা, রাগ, দুঃখ সমস্ত লয় পেয়ে যায়, এক সমৃদ্ধ প্রশান্তির মধ্যে আমি জেগে উঠি এবং মাটিতে পায়ের সামান্য ধাক্কা দিয়ে শূন্যে উঠে যাই। পাখা নেই, তবু মহানন্দে উড়তে থাকি। নীচে বাড়িঘর, ট্রেন, ট্রাম, বাস, মানুষের ভিড়, পুকুর, হ্রদ এবং সমুদ্র। আমার পায়ের সামান্য তলায় গজরাচ্ছে সমুদ্র। যেমনটা বয়স্কাউটের দলের সঙ্গে পুরী গিয়ে দেখেছি। ফুঁসে উঠছে ঢেউয়ের সাদা পাগড়ি। এক্ষুনি বুঝি ছুঁয়ে ফেলল। কিন্তু আমি শূন্যেই পায়ের একটা ধাক্কা মারি। গিয়ার বদলে উঠে যাই আর একটু ওপরে। চন্দ্রতারকাহীন মহাকাশ এবং অকূল সাগর। কোথা থেকে একটা আলো আসছে। মৃদু। এ কি আমাদের ঘরের রাত—আলো? জানলার বাইরে থেকে ঢুকে পড়া রাস্তার আলো? সূর্য গ্রহণের সময়ে একটা না—আলো না—আঁধার নেমে আসে চরাচরে। এ কি সেই? আকাশ এবং সাগর নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই। তাদের অবস্থান এবং দুইয়ের মাঝখানে আমার ওড়া যেন একরকম স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু আলোটার উৎস এবং প্রকৃতি নিয়ে আমি ভেবে চলেছি। উড়তে উড়তে ভেবে চলেছি। এমন একটা রহস্য এটা যা আমায় ভেদ করতে হবে।

বাড়ি পৌঁছনো পর্যন্ত এই ঘোর আমার ছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *