সমুদ্র-যাত্রা – ৬

কোথা থেকে টাকা জোগাড় করি! দিল্লি যাওয়া—আসার, এবং যদি কোথাও নিজের থাকবার ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়, বলা তো যায় না। দাদা যখন দরকারি কথা বলতে চাইছে, তখন কথাটা শোনা দরকার। কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে কিছু ধার নিলুম। বাড়ি। ফিনকির ছুটে আসা। মায়ের মাথার আঁচল খসে পড়ে যাওয়া। দুই ঠাকুমার নিদন্ত মুখে ছেলেমানুষি হাসি। বাবা পিকনিকে গেছেন। এবার গিয়ে দেখলুম দাদু বুড়ো হয়ে গেছেন। এত দিন এককাথা পাকা চুল সত্ত্বেও, ‘বুড়ো মানুষ বুড়ো মানুষ’ বলা সত্ত্বেও দাদুকে বুড়ো ভাবা যেত না। এখনও, চুল একটু পাতলা হয়ে গেলেও দাদুর দাঁত অটুট, একটুও ঝুঁকে পড়তে দেখলুম না। তবু যেন স্বাস্থ্যের মধ্যে সেই ইস্পাত নেই, কোথাও একটা শীর্ণতা, শুষ্কতা। আমাকে দেখে দাদু তেমন কিছু বললেন না। কেন দু সপ্তাহ আসিনি, জিজ্ঞেসও করলেন না। আমিই ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বলি—দাদু কেমন আছ?

দাদু উত্তর দিলেন না। অভিমান হয়েছে না কি? দাদু এত প্র্যাক্টিক্যাল চরিত্রের মানুষ যে মান—অভিমানে তাঁকে খুব বেশি বিচলিত হতে দেখিনি।

—দাদা আমাকে একটা চিঠি লিখেছে, যেতে বলছে খুব করে।

—যাও। থাকবে কোথায়?

—দাদা ব্যবস্থা করবে বলেছে।

—তা হলে শুধু গাড়ি—ভাড়া আর কিছু হাত—খরচ?

—হ্যাঁ, সেটা আমি জোগাড় করে নিয়েছি।

—ধার?

—হ্যাঁ।

—বেশ।

—দাদার পিএইচ. ডি. হয়ে গেল, রীডার হয়ে গেছে, তোমায় লিখেছে নিশ্চয়।

—এখনও না। লিখবে…হয়তো।

—নিশ্চয়। এতদিন তো আমাকে একটা চিঠিও লেখেনি। এই প্রথম। বোধহয় মনে করে একজনকে খবরটা দিলেই সবাই পেয়ে যাবে।

—হতে পারে। দাদু চুপ করে রইলেন। আমি একই ভাবে বসে থাকি। আমার মনে হল দাদুর আর আমার মাঝখানে একটা ভ্যাকুয়াম। শব্দ পৌঁছয় না, চিন্তাতরঙ্গও না। শুধু আলো কখনও হার মানে না। জানলা দিয়ে বেলা ন’টার ঝকঝকে রোদ এসেপড়েছে দাদুর সাদা চুলে। ফতুয়ার বাঁ কাঁধে। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বসে আছেন, বাহু পেরিয়ে গিঁটবহুল আলগা চামড়ার হাতে পাতার উল্টো পিঠে। সেই একই আলো এক ছিট ছিটকে এসে পড়ে আছে আমার হাঁটুতে।

—আমি জাস্ট যাব আর আসব।

—কেন? জীবনে প্রথমবার দিল্লি যাচ্ছ, ভারতের বহু শতাব্দীর রাজধানী। ইতিহাস দেখে এসো। শুনে এসো। তোমার দাদার কথা বিশেষ কিছু শোনবার নেই।

আমি চমকে দাদুর দিকে চাই, মাথাটা ঝুলে গেছে। দাদুর সেই বহুদিনের পরাজিতের ভঙ্গি।

 কেন জানি না আর কোনও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল না। কেন ও কথা বললেন, তার কিছুটা তো আন্দাজ করতে পারিই। দাদুর ওই ভক্তির মধ্যে এমন একটা দাঁড়ি টেনে দেওয়া সমাপ্তি আছে, যার পর যে কোনও সান্ত্বনাই স্তোক বচনের মতো শোনায়।

—যাও, চান—টান করে ফেলো, একটু থামলেন—তারপর বললেন—তুমি বড় হয়ে গেছ।

এক পক্ষকালের মধ্যে কী এমন বড় হয়ে গেলুম। ভেতর থেকে একটা লজ্জা উঠে আসে। এই দু সপ্তাহের মিথ্যে, অনাচার কি দাদু ধরতে পেরে গেছেন? কী করে? আমার চেহারায়, ব্যবহারে কি কোনও ছাপ পড়েছে? হ্যাঁ, মৃণালের চেহারায় একটা চোয়াড়েমি, চোখের চাউনিতে কেমন একটা অশ্লীলতার ছাপ পড়েছে নিশ্চিত। কিন্তু নৃপেশ নিয়মিত পাতাখোর, ওর চোখে একটা রোম্যান্টিক ভাবালুতা ছাড়া কিছু বোঝা যায় না তো! দু—চার দিন অনিয়ম করেই আমার কী এমন পরিবর্তন হল? চান করি অনেকক্ষণ ধরে, ঘরে আসি। এ ঘরে এখন দাদার ভাগ নেই। আমি সাত দিন গেলে তবে আসি। কখনও কখনও আসিও না। কেমন একটা অব্যবহারের ছাপ পড়েছে ঘরখানায়। যেন ঝাঁট দেওয়া হয়, অথচ মোছা হয় না, একই চাদর, বেডকভার, বালিশের ওয়াড় যেন পরানো অনেকদিন ধরে। অপেক্ষা করছিল, অপেক্ষা করছিল, ঘরের মালিক আসেনি, নিশ্চেতন বস্তুর নিজেকে সাফ—সুতরো রাখার, নতুন করে নিজেকে পাওয়ার কোনও উপায় নেই, সচেতনের সাহায্য ছাড়া। দেয়ালে টাঙানো গোল আয়নাটার ওপরেও কেমন একটা ছ্যাৎলা। আমি আমার মুখ রাখি আয়নায়। একটু দাড়ি উঠেছে। ভিজে চুলগুলো একটু বড়। ঘাড়ের কাছে গুটিয়ে রয়েছে। আয়না বলল—আমি তোমাকে চিনি না।

—আামি সমুদ্র, বিশ্বাস কর আমি সমুদ্রই।

—হতে পারে, কিন্তু সমুদ্র তো একটা নয়। তুমিও অন্য। অন্য সমুদ্র। ও চলে গেছে।

আমিই আমাকে বলছি আমি চলে গেছি! বিশ্বাসও করছি কোথাও একটা সমূহ চলাচল চলছে।

দরজায় ধাক্কা পড়ল। ফিনকি। এক মুখ হাসি। লুটিপুটি চুল। নরম গালগুলো দেখা যায়। ফিনকির উচ্চ—মাধ্যমিক টেস্ট হয়ে গেছে। ওর উত্তরগুলো কষে দেখেছি ঠিকঠাক হয়েছে। ফিনকিকে দেখে আমি প্রাণপণে ফিরে আসার চেষ্টা করি।

—এতক্ষণ কী করছিলি রে?

—এ—ই। চান করে ঘরে এসে দেখি সব কেমন ধুলো পড়া। ভাবছিলুম পরিষ্কার করব কি না। একটা চাদর আর বালিশের ওয়াড় দিতে পারিস?

অবাক হয়ে ফিনকি বলল—কাল রাতেই তো পাল্টে দিলুম। সব ধোপার বাড়ির। ধোপার বাড়ি গিয়ে গিয়ে বোধহয় রংগুলো একটু কটে গেছে।

—তা হলে একটা ঝাড়ন দে। আয়নাটা মুছি।

—ঝাড়নে হবে না। দাঁড়া আমি ঠিক করে দিচ্ছি।—কোথা থেকে খবরের কাগজ আর এক মগ জল নিয়ে এল ফিনকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়না পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি চোরা চাউনি দিই আয়নাটার দিকে। চাউনিটা রিবাউন্ড করে আমার দিকে ফিরে আসে। আঘাত করে। আয়না আমার প্রতিবিম্ব নেবে না।

ঘরের মেঝেয় সাধারণ ছাইরঙা সিমেন্ট। খানিকটা মসৃণ, কিন্তু জায়গায় জায়গায় কেমন খরখরে হয়ে গেছে।

খেতে বসে দেখি দুই দিদাও এসে ঘুরে গেলেন। মেজদিদার খুব শুচিবাই। উনি এক ধারে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন—দাদুভাই, এক মাত্তর রোববারগুলোয় তোমার দেখা পাই। জানি কাজ পড়েছিল, তবু, বুড়োবুড়িগুলোকে মনে রেখো, হঠাৎ আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন উনি। আস্তে আস্তে চলে গেলেন। বড়দিদা বয়সে বড় কিন্তু শক্ত বেশি, বললেন—আর একটু মাছের তরকারি দাও দাদাভাইকে, ও বউমা। পার্শে মাছ আনিয়েছি দাদা, তুমি ভালবাস। খাও ভাল করে। হস্টেলে কী—ই বা খাও!

হারাই—হারাই ভয় যেন চোখে। এতদিন গেছে কখনও ওঁদের এভাবে আমার খাওয়া—দাওয়া নিয়ে খোঁজ করতে দেখিনি। আমি হাত দিলে থালা ঢাকবার আগেই মা আর দুটো পার্শে মাছ আমার পাতে ফেলে দিলেন। ফিনকিকে বললুম—তুই একটা তুলে নে তো আমি খেতে পারব না।

—দে—ফিনকি থালা বাড়াল।

—তুই তুলে নে।

দিদারা চলে গেলে ফিনকি বলল, মাছটা দিদারা আনিয়েছেন, তোর জন্যে—বলে হাত চাটতে চাটতে নিগূঢ় হাসি হাসতে লাগল।

 শেষ বেলায় আমরা তিনজন সিনেমা দেখতে গেলুম। আমি, ফিনকি আর মা। কোনওমতেই মাকে রাজি করানো যায় না। ফিনকি বলল—তা হলে আমিও যাব না। কতদিন থেকে ‘বর্ন—ফ্রি’ দেখব বলে বসে আছি।

আমি এভাবে জোর করতে পারতুন না। ফিনকি যা পারে আমি তা পারি না। শুধু ফিনকি কেন, অনেকেই যা পারে, আমি তা পারি না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *