সমাপ্তি – মনোজ সেন

সমাপ্তি

বাগবাজারে বিমল কুণ্ডু স্ট্রিটে সকাল বেলা কাগজ আসে সাড়ে ছ-টা থেকে সাতটার মধ্যে। ব্রজকিশোরবাবু ঠিক সাতটায় কাগজ নিয়ে রোয়াকে বসেন, ওঠেন আটটায়। গভীর মনোযোগ দিয়ে আগাপাস্তলা পড়েন। সেইসময় কোনোরকম গোলযোগ হলে খুব বিরক্ত হন।

সেদিন কিন্তু তিনি কোনোমতেই মনঃসংযোগ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারছিলেন না। তার কারণ, তিনি রোয়াকে এসে বসা পর্যন্ত দেখছেন যে, একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক উলটোদিকের ফুটপাথে ষোলো নম্বর বাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মতলবটা কী? ব্রজকিশোরবাবুর বাড়ি দশ নম্বর। মাঝে মাত্র দুটো বাড়ি। লোকটির পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা রঙের শার্ট। হাতে একটা পোর্টফোলিও ব্যাগ। হয় উকিল নয়তো বাড়ির দালাল। ষোলো নম্বর সম্পর্কে কিছু জানবার থাকলে তাঁকে এসে জিজ্ঞাসা করলেই পারেন। তা তো নয়ই, রাস্তা দিয়ে যে লোকজন যাচ্ছে তাদেরও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না। ব্যাপারটা কী? অমন করে সারাদিন দাঁড়িয়েই থাকবেন নাকি?

শেষপর্যন্ত, আর কৌতূহল দমন করতে না-পেরে ব্রজকিশোরবাবু লুঙ্গি সামলে রোয়াক থেকে নেমে রাস্তা পার হয়ে লোকটির কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কে? দেখছি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কী ব্যাপার, কোথায় যাবেন আপনি?’

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনয়ী। লজ্জিতভাবে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি যে আমার এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা বেশ দৃষ্টিকটু হচ্ছে। আমার নাম সুকুমার হালদার। আমি শেয়ার কেনা-বেচা করে থাকি। আসলে আমি যেতে চাই ষোলো নম্বর, বিমল কুণ্ডু স্ট্রিটে। ওই বাড়িটাই তো ষোলো নম্বর, বিমল কুণ্ডু স্ট্রিট, তাই না? কিন্তু একটা গোলমাল হচ্ছে।’

‘গোলমাল? কীসের গোলমাল?”

‘না মানে, আমি যাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাঁর নাম শ্ৰী হরিশঙ্কর রায়বর্মন। অথচ, গেটে লেখা আছে অধীরচন্দ্র বসাক। এখানে আসবার আগে দু-চার জন ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করেছিলুম। সকলেই বললেন ষোলো মন্ত্রের বসাক। ঝাড়ি। তাই এখানে ওই বাড়ি থেকে কারোর বেরোবার অপেক্ষা করছিলুম। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই নিশ্চিত হওয়া যেত যে, আমি যে ঠিকানাটা পেয়েছি সেটা ঠিক না ভুল।’

ব্রজকিশোরবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি ঠিক ঠিকানাই পেয়েছেন। ওই বাড়িটা কিছুদিন আগে পর্যন্ত অধীরচন্দ্র বসাকের বংশধরদেরই ছিল। তিনি প্রায় এক-শো বছর আগে বাড়িটা বানিয়েছিলেন। তাঁর বর্তমান বংশধরদের এত পুরোনো সাবেকি ডিজাইনের বাংলো টাইপের বাড়ি পছন্দ হচ্ছিল না। তাই, বছরখানেক আগে বাড়ি বিক্রি করে তাঁরা নিউ আলিপুরে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছেন। এখন যিনি মালিক, তাঁর নাম হরিবাবুই বটে। তিনি গেটের নেমপ্লেটটা আর পালটাননি। আর, পাড়ার লোকেরাও এতদিনের অভ্যস্ত বসাকবাড়ি নামটাই চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই, আপনি স্বামুনের ঝুড়িতে যেতে পারেন।’

সুকুমার হালদার হাসলেন। বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই যাচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। তবে, যদি কিছু মনে না করেন তো আপনাকে আর একটু বিরক্ত করতে পারি?’

‘কী ব্যাপারে?’

‘মানে, এই হরিশঙ্কর রায়বর্মনবাবু সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন? শুনেছি উনি খুব বড়োলোক, তার ওপরে ভীষণ রাসভারী। ওঁকে আমার ক্লায়েন্ট করতে পারলে আমার খুব সুবিধে হত। কাজেই, ওঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলব বলে এসেছিলুম । তবে, এ বিষয়ে একেবারে কিছু না-জেনে কথা বলতে যেতে একটু নার্ভাস লাগছে। আপনি যদি সে বিষয়ে আমাকে কিছু বলে দেন, এই আর কী!

ব্রজকিশোরবাবু হাসি চেপে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। আপনি আমার বাড়ির রোয়াকে ছায়ায় এসে বসুন। রোদটা বাড়ছে তো । হরিবাবু সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি, বলব আপনাকে।’

ব্রজকিশোরবাবু বললেন, ‘হরিশঙ্করবাবু আদৌ ত্রিপুরার লোক। ওঁর পৈতৃক বাড়ি আগরতলায়, মেলার মাঠের পাশে। এ পাড়ার বাড়িটা কিনে এখানে আসেন বছর পাঁচেক আগে। পরিবার বলতে উনি আর ওনার স্ত্রী। ওঁর স্ত্রীর নাম বোধ হয় অন্নপূর্ণা। ওঁরা বড়োলোক না গরিবলোক তা আমি জানি না, তবে এটা জানি যে ওঁরা আদ্যন্ত সজ্জন আর শ্রদ্ধেয়। দু-জনের কেউই গালগল্প করতে ভালোবাসেন না, তবে দু-জনেরই ব্যবহারে এমন একটা আভিজাত্য আছে যে ওঁদের সঙ্গে থেবড়ে বসে পরনিন্দা পরচর্চা করবার কথাও কেউ চিন্তাই করতে পারে না।

‘দুঃখের কথা, হরিবাবু ইদানীং বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তা অবশ্য হতেই পারেন। বয়েস তো কম হল না। নব্বই পার হয়ে গেছে। চোখে একেবারেই দেখতে পান না। তা ছাড়া নানারকম বার্ধক্যজনিত রোগে প্রায় শয্যাশায়ী। তবে, ওনার স্ত্রী আশি পেরিয়েও বেশ শক্তসমর্থই আছেন। দু-জনেরই মাথা এখনও বেশ পরিষ্কার।’

সুকুমার হালদার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওঁর ছেলেপুলে?’

‘ওঁর বোধ হয় একটিই ছেলে। সে মনে হয় বিদেশে থাকে। আমি একবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম যে অতবড়ো বাড়িতে একটিমাত্র মাঝবয়সি কাজের মেয়ে কমলার ভরসায় থাকতে ভয় করে কি না। অন্তত একজন দারোয়ান তো রাখা যায় । তা, উনি বলেছিলেন যে ওঁদের ছেলে থাকতে ভয়ের কোনো কারণই নেই। অথচ, মজা কি জানেন? সেই ছেলেকে গত পাঁচ বছরে আমরা, মানে পাড়ার লোকেরা কোনোদিনই দেখিনি। সে কখনোই বাবা-মাকে দেখতে আসে না। তাই, আমাদের সকলেরই ধারণা যে সেই ছেলে বিদেশে থাকে এবং এত বড়ো চাকরি করে যে ছুটি পায় না। ওখান থেকেই হরিবাবুদের নিরাপত্তার ব্যাপারটা নিশ্চিত করে থাকে।’

‘উনি কখনো বার্মা মানে আজকাল যাকে মিয়ানমার বলে সেখানে ছিলেন?’

ব্রজকিশোরবাবু সহাস্যে বললেন, ‘একদিন কথায় কথায় বলেছিলেন বটে যে বার্মায় ওঁর শ্বশুরবাড়ি। ওঁর স্ত্রীর ওখানেই জন্ম, ওখানেই পড়াশুনো। তবে? আপনি তো অনেক কিছুই জানেন দেখছি।’

‘না, না, ও কিছু নয়। ওনার শেয়ারের ব্যাপারে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখেছি ওঁর স্ত্রীর নামে শেয়ারগুলো বার্মার এক দালালের থু দিয়ে কেনা। আর, ইয়ে, মানে, উনি কি খুব কিপটে টাইপ?’

‘জানি না মশাই। তবে আমাদের পাড়ার পুজো বা কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভালোই চাঁদা দেন আর সন্তুষ্ট চিত্তেই দেন।’

‘শেষ প্রশ্ন, উনি আগরতলা ছেড়ে একেবারে শেষ বয়সে এখানে এলেন কেন?’

‘এ-রকম ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করবার দুঃসাহস আমার কোনোদিন হয়নি। কাজেই, আপনার এই প্রশ্নেরও উত্তর আমার জানা নেই।’

সুকুমার হালদার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমার খুব উপকার করলেন আপনি।’

সুকুমার হালদার বসাক বাড়িতে ঢোকার পরেও ব্রজকিশোরবাবু রোয়াকে বসেই রইলেন। বোধ হয়, সুকুমার কতক্ষণ ও বাড়িতে টিকে থাকতে পারেন, সেটাই দেখবার জন্য। সুকুমার তাঁকে হতাশ করেননি। মিনিট পনেরোর মধ্যেই ব্যাজার মুখে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে তাঁকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল।

ব্রজকিশোরবাবুকে দেখে ম্লান হেসে বললেন, ‘পাত্তা দিলেন না। আমি ডিটেলসে কিছু বলে ওঠবার আগেই জানিয়ে দিলেন যে ওনার সমস্ত সম্পত্তির ম্যানেজমেন্টের ভার ফক্স অ্যান্ড ঘোষালের ওপর দেওয়া আছে। কাজেই, আমার বাক্যব্যয় করে কোনো লাভ নেই। ঠিকই, কোথায় ফক্স অ্যান্ড ঘোষাল আর কোথায় আমি! পত্রপাঠ উঠে চলে এসেছি।

ব্রজকিশোরবাবু বললেন, ‘ভালোই করেছেন। মিসেস চা খাওয়াননি?’

‘অফার করেছিলেন। আমি আর খাইনি। কি হবে সময় নষ্ট করে?’

এই ঘটনার দু-তিন দিন বাদে পাড়ার পার্কে বৈকালিক ভ্রমণ সেরে বাড়ি ফিরছিলেন ব্রজকিশোরবাবু। তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। দিনের আলোটি পশ্চিম আকাশে তখনও গড়িমসি করছে, যাওয়ার একেবারেই ইচ্ছে নেই। সেই আলোয় দূর থেকে দেখলেন যে সুকুমার হালদার একটি লোককে ষোলো নম্বরটা দেখিয়ে দিয়েই ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল।

ব্রজকিশোরবাবুর ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগল না । তাঁর মনে হল যেন সুকুমার হালদার পালিয়ে গেল। কেন? তার ওপরে তার সঙ্গের লোকটির চেহারাও কেমন যেন সন্দেহজনক। লোকটির বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। তার বেশিও হতে পারে। মোটাসোটা শরীর, চোখে বাহারে ফ্রেমের চশমা, কানের তলা পর্যন্ত ঝোলা মোটা জুলপি, মাথায় চকচকে কালো চুলে অ্যালবার্ট কাটা, পরনে সবুজ রঙের প্যান্ট আর বড়ো বড়ো লাল ফুলের ছাপওলা হাওয়াই শার্ট। বাঁ-হাতে একটা মোটা ফাইল। তার বয়েসের সঙ্গে একেবারে বেমানান চ্যাংড়া ছেলেদের ভঙ্গিতে হেঁটে রাস্তা পার হয়ে লোকটি ষোলো নম্বরের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেল৷

ব্রজকিশোরবাবু চিন্তিতভাবে বাড়িতে ঢুকে কাজের মেয়ে বিনুকে ডেকে বললেন রোয়াকে একটা ইজিচেয়ার আর বিকেলের জলখাবারটা দিয়ে যেতে। পাড়ায় একটা সন্দেহজনক ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। হয়তো, পুলিশ-টুলিশ ডাকতে হতে পারে। এখন কি ঘরে বসে টিভি দেখা উচিত? নজর তো রাখতেই হবে। কাজেই রোয়াকেই আজকের সন্ধেটা কাটাতে হবে মনে হচ্ছে। আর, তারজন্যে যদি অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় তো থাকা যাবে।

ষোলো নম্বরের সদর দরজা খুলে দিল কমলা। তার মুখ দেখে একবারও মনে হল না যে এই সময়ে একজন অতিথিকে দেখে সে কিছুমাত্র আশ্চর্য হয়েছে। দরজা খুলে হাসিমুখে নবাগতকে ভেতরে নিয়ে এল।

বাড়িটা একটা বড়ো উঠোনের চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পর পর ঘর। কমলা পথ দেখিয়ে শিবনাথকে হরিশঙ্করের শোবার ঘরে নিয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দাদামশাই, একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

একটি প্রকাণ্ড পালঙ্কের একপাশে সাদা সুতির চাদর মুড়ি দিয়ে হরিশঙ্কর রায়বর্মন শুয়ে ছিলেন চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা। উঠে বসে বললেন, ‘কে?’

অতিথি ঘরের ভেতর ঢুকে এল। বলল, ‘নমস্কার জ্যাঠামশাই। আমার নাম শিবনাথ, শিবনাথ তরফদার। আপনার কি আমাকে মনে পড়ে?’

নির্বিকার গলায় হরিশঙ্কর বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়ে। তুমি আগরতলায় থাক বা থাকতে। তোমার একটা ট্রাভেল এজেন্সি ছিল। যতদূর মনে পড়ে, তার নাম ছিল গ্র্যান্ড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস।’

শিবনাথ মুখ বেঁকিয়ে হাসল। বলল, ‘আমি এখন আর আগরতলায় থাকি না জ্যাঠামশাই। আপনি কলকাতায় চলে আসার মাস ছয়েক আগে আমিও এখানে চলে আসি। এখান থেকেই গ্র্যান্ড ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস চালাই। তবে আপনার দেখছি দারুণ স্মৃতিশক্তি! পুরোনো দিনের প্রায় সব কথাই মনে আছে।’

‘হ্যাঁ, আমার চোখ দুটো চলে যাওয়ার পর দেখছি আমার স্মৃতিশক্তি খুব বেড়ে গেছে। তা, শিবনাথ, তুমি কি আমার কুশল সংবাদ নেবার জন্যে এখানে এসেছ? নাকি অন্য কোনো দরকার আছে?’

জানলার বাইরে তখন রাত ঘনিয়ে আসছে। প্রকাণ্ড ঘরটার কোনায় কোনায় অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠছে। শিবনাথের কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। অথচ শিবনাথ ভয় পাওয়ার লোক নয়। জীবনে সে কাউকে বা কোনো কিছুকে কখনো ভয় পায়নি। দু-পাঁচটা যে খুন-টুন করেছে— সেসব কোনো ব্যাপারই নয়। একবার একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে গলা টিপে মেরে তার পাশে শুয়ে সারারাত ঘুমিয়ে, ভোর রাত্রে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে গেছে। কোনো অসুবিধে হয়নি। কিন্তু, আজ তার শরীর আর মন দুই-ই বলছে এই বাড়ি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। এর জমাট বেঁধে আসা অন্ধকারের মধ্যে কোথাও একটা ভয়ংকর বিপদ লুকিয়ে আছে।

তবে, খামোখা ভয় পেলে তো চলবে না। অনেক টাকার ব্যাপার। পকেট থেকে একটা ছোটো কিন্তু শক্তিশালী টর্চ বের করে ঘরের দেওয়াল আর ছাদটা দেখে নিল শিবনাথ। না, কোথাও সিসিটিভির ক্যামেরা লাগানো নেই। এঁর একমাত্র ছেলে তো বছর ছয়েক আগেই মরে গেছে। তাহলে বোধ হয় অন্য কেউ বিদেশে বসে এঁদের ওপর নজর রাখে। তাকেই উনি ছেলের মতো দেখেন। কিন্তু, নজর রাখে কী করে? ওই কাজের মেয়েটি যেন কেমন। ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু খটকা একটা আছে। সে দরজা খুলে দিয়ে এমনভাবে হাসল যেন এই সময়ে শিবনাথের আসাটা সে আশাই করছিল। কেন? তবে কি কেউ তাকে খবর দিয়ে রেখেছে? কে দেবে? একমাত্র সুকুমার ছাড়া তো কেউ হতে পারে না। এটা তো সুকুমার ঠিক কাজ করেনি। তবে, হরিবাবুর কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি কিছু সন্দেহ করেননি।

এইসব ভাবতে ভাবতে শিবনাথ অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আপনাদের কুশল সংবাদ তো আছেই। কাজের কথাও আছে।’

হরিশঙ্কর বললেন, ‘আমার এই বয়েসে আবার কুশল সংবাদ কী? বেঁচে যে আছি, সেটাই তো কুশল সংবাদ।’

‘তা তো বটেই। তবে, দেশ ছেড়ে এই শেষবয়সে এখানে এলেন কেন? নিশ্চয় চিকিৎসার জন্য?’

‘সেটাই আসল কারণ তা ঠিক। তবে, আরও একটা কারণ আছে। তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই। তুমি তো আমার দেশের লোক। কত বছরের পরিচয় বলোতো?’

‘আজ্ঞে, তা অনেক বছর হল। কারণটা যদি বলেন।’

‘হ্যাঁ, তুমি কি জানতে যে আমাদের বাড়িতে একটা মহামূল্যবান জিনিস আছে? সেটার ওপরে যদি কারও নজর পড়ে, তাহলে আগরতলার মতো খোলামেলা শহরে সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। তাও যদি আমার ছেলেটা আমার সঙ্গে থাকত, তাহলে একটা ভরসা ছিল। কেন যে ঘর ছেড়ে চলে গেল। আমি ওকে ত্যাজ্যপুত্র করেছি। সে যাকগে। এখন ওই জিনিসটা কলকাতায় নিয়ে এসেছি। কোনো বিদেশি মিউজিয়ামে বিক্রি করে দেবার ইচ্ছে আছে। আমার অ্যাটর্নি ফক্স অ্যান্ড ঘোষালের ওপরে সেই ভার দিয়েছি। ওরা চেষ্টা করছে। তবে, জানোই তো, এসব ব্যাপারে সময় লাগে।’

শিবনাথ এটা একেবারেই আশা করেনি। গলাটা যথাসাধ্য অকম্পিত রেখে বলল, ‘কোন মহামূল্যবান জিনিস? আমি তো জানি না। জানেনই তো, এসব ব্যাপারে আমার আবার তেমন ইন্টারেস্ট নেই।’

‘তুমি জানো না, না? এটা একটা সোনার বুদ্ধমূর্তি, সারা গায়ে চুনি মানে রুবি, পান্না আর হিরের কারুকার্য। ইঞ্চি দশেক উঁচু। এখন এটার বাজারে দাম হবে কয়েক কোটি টাকা। অথচ, মজা কী জানো, আজ থেকে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে যখন আমার শ্বশুরমশাই তাঁর মেয়েকে, মানে আমার স্ত্রীকে, বিয়েতে যৌতুক দিয়েছিলেন তখন বার্মায় এর দাম ছিল মাত্র কয়েক হাজার টাকা। আমাদের বসবার ঘরে একটা কাচের আলমারিতে চিনেমাটির পুতুল-টুতুলের সঙ্গে সাজানো ছিল। এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। সবাই জানত কতগুলো ঝুটো কাচের স্টোন বসানো সোনালি রং করা একটা সস্তার মূর্তি।’

কয়েক কোটি টাকা! বলে কি? এ জানলে তো আরও একটু তৈরি হয়ে আসা যেত। সুকুমার হালদারটা একদম অপদার্থ! কোথায় কোটি টাকার অ্যান্টিক আর কোথায় লাখ টাকার শেয়ারের কাগজ। ইডিয়েট! কালকেই লাথি মেরে ব্যাটাকে তাড়াতে হবে। শিবনাথ মনে মনে সমস্ত প্ল্যানটা ঝটপট ঢেলে সাজাতে শুরু করল।

হরিশঙ্কর তখন বলে চলেছেন, ‘এটা যে আসলে কী সেটা আমি জানতে পারি রামপ্রসাদ গুপ্তার কাছ থেকে। রামপ্রসাদকে তো চেনই। চারিপাড়া পোস্টঅফিসের কাছে ওর গয়নার দোকান। ওকে একটা সোনার হার বানাতে দিয়েছিলুম। আমার বাড়িতে এসেছিল সেটা ডেলিভারি দিতে। আমার স্ত্রী তখন বসবার ঘরে বসে কাচের আলমারির জিনিসগুলো সেন্টার টেবিলের ওপরে রেখে পরিষ্কার করছিলেন।’

হরিশঙ্কর আরও কিছু বলতেন কিন্তু তার আগেই শিবনাথ বাধা দিয়ে বলল, ‘সেটা এখন আছে কোথায়? ফক্স অ্যান্ড ঘোষালের অফিসে?’

‘তুমি কি পাগল নাকি? এ জিনিস কি অন্যের হেপাজতে রাখা যায়? এমনিতেই তো কলকাতাতেই জানাজানি হয়ে গেছে। গত তিন মাসে দু-জন, এসেছিল ওটা চুরি করতে। পারেনি। ভাগ্যিস কমলা ছিল। এমন চেঁচামেচি জুড়ে দিল যে পালিয়ে গেল।’

‘ওটা এই বাড়িতেই রেখেছেন? সেটা ভালো করেননি। কোনো ব্যাঙ্কের লকারে রাখা উচিত ছিল।’

‘তা তো ছিলই। কিন্তু যা দিনকাল পড়েছে, আমি এখন ব্যাঙ্কওয়ালাদেরও বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া, ব্যাঙ্কে দৌড়দৌড়ি করবে কে? ছেলেটা চলে যাওয়ার পরেই আমার চোখ দুটোও গেল। কেন যে ছেলেটা এমনভাবে চলে গেল? আমি তো ওর বিদেশ যাওয়া নিয়ে তেমন ভাবে কোনো আপত্তি করিনি কোনোদিন। আর কোনোদিন যোগাযোগও করল না। এখন আমার ভরসা বলতে আমার জাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। সে শিকাগোতে থাকে। সে-ই আমাদের খোঁজখবর নেয়।’

শিবনাথ ঠোট টিপে হাসল। ভাবল, ‘যাক, ঠিকই অনুমান করা গেছিল। ছেলের ব্যাপারটা তাহলে এই।’ তারপরে বলল, ‘সত্যি, বিষ্ণুর চলে যাওয়াটা আমার কাছেও একটা বিরাট রহস্য। আমরা যখন শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যাই, তখন ওর এই মতলবের কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি আমি। চেরাপুঞ্জি পৌঁছে তারপরদিনই মাঝরাত্রে ট্যাক্সি ডেকে চলে গেল, হোটেলের রিসেপশনে বলে গেল শিলং এয়ারপোর্টে যাচ্ছি, একটা এমারজেন্সি দরকার আছে। আমাকে কিছু বলেও গেল না।’

ভাবলেশহীন গলায় হরিশঙ্কর বললেন, ‘হ্যাঁ, এ গল্পটা তুমি আমাকে আগেও বলেছ।’

শিবনাথ বুঝতে পারল না যে কথাটার মধ্যে কোনো শ্লেষ আছে কি না। তার মনে হল, শ্লেষ বোধ হয় নেই। বুড়ো যেরকম গড়গড় করে সব গোপন কথা বলে যাচ্ছে তাতে বিষ্ণুশঙ্করের সপরিবারে হাপিস হয়ে যাওয়ার পেছনে তার কোনো যোগ আছে সে-রকম সন্দেহ তাঁর থাকতেই পারে না।

তবে, তখন আর সেসব চিন্তা করবার সময় নেই। তার মনের ভেতরে ভয়টা আরও চেপে বসেছে। তার অন্তরাত্মা বলছে যত তাড়াতাড়ি হয় কাজ শেষ করে এখান থেকে পালাতে হবে। তাই, এখুনি জানতে হবে যে মালটা বাড়ির কোথায় আছে। বুড়ো যখন ব্যাড়ব্যাড় করে সব কথাই বলে যাচ্ছেন, তখন এ কথাটাও বলবেন বলেই মনে হয়। এই ঘরে তো কোনো সিন্দুক-টিন্দুক নেই। থাকার মধ্যে হলদে রঙের একটা কাঠের দেওয়াল আলমারি। তবে কোথায়? সেটা যদি না বলেন, তখন অন্য রাস্তা বের করতে হবে।

ঠিক এই সময়, হরিশঙ্কর বললেন, ‘কি শিবনাথ, ঘরে আছ নাকি?’

শিবনাথ বলল, ‘আছি, জ্যাঠামশাই।’

‘কিছু ভাবছ? চুপচাপ কেন?’

‘কী ভাবছি, সেটা আপনাকে বললে আপনি আমার ওপরে অসন্তুষ্ট হবেন। ভাববেন আমি অনধিকারচর্চা করছি।’

হরিশঙ্কর ম্লান হেসে বললেন, ‘কী যে বলো। অনধিকারচর্চা আবার কী? তুমি নিশ্চিন্তে বলো কী ভাবছিলে।’

শিবনাথ থেমে থেমে বলল, ‘আমি ভাবছিলুম আপনার নিরাপত্তার কথা। দেখুন, আপনার কথা শুনে আমার মনে হল আপনি খুব সাবধানী লোক। তার মানে, ওই মূর্তিটা আপনি যথাসাধ্য নিজের হাতের কাছে রাখবেন। অথচ এ ঘরে ওই একটা কাঠের দেওয়াল আলমারি ছাড়া আর কোনো রাখবার জায়গা দেখছি না। এটা ঠিক হচ্ছে না। অন্তত একটা লোহার সিন্দুক থাকা উচিত। আপনি যদি বলেন তাহলে আমি ছোটো দেখে একটা কিনে এনে দিতে পারি।’

হরিশঙ্কর বললেন, ‘আরে, না না। তার কোনো দরকার হবে না। ওটা একটা যে সে কাঠের আলমারি ভেব না। দু-ইঞ্চি মোটা লোহা কাঠ, ভেতরে এক জ মোটা স্টিলের লাইনিং দেওয়া। ওটার ওপর কামানের গোলা মারলেও ওটা টসকাবে না।’

তাহলে এখন প্রশ্ন আলমারির চাবিটা কোথায়? সেটা জানতে পারলে, তিন জনকে খুন করে আলমারি খুলে মূর্তিটা নিয়ে বেরিয়ে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না।

হরিশঙ্কর যেন প্রশ্নটা আঁচ করে বললেন, ‘ওটা খোলাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। দুটো চাবি লাগে খুলতে। একটার পর একটা। কোনটার পর কোনটা সেটা জানেন একমাত্র তোমার জ্যেঠিমা। তুমি তো জানো নিশ্চয়ই যে, তিনি একজন খুব কঠিন ধাতুর মহিলা। মরে গেলেও কাউকেই সেই গোপন তথ্যটি জানাবেন না।’

শিবনাথ প্রায় বলে ফেলেছিল যে সেটা পরে দেখা যাবে। ভাগ্যক্রমে ঠিক সেই সময়ে কমলা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে একটা ট্রেতে এক প্লেট লুচি আর একবাটি কষা মাংস এনে শিবনাথের চেয়ারের পাশে একটা ছোটো টেবিলের ওপরে ঠক করে রাখল। শিবনাথ চমকে উঠে ঘুরে বসতে গিয়ে তার হাতটা কমলার হাতের সঙ্গে লেগে গেল। কমলার হাতটা বরফের মতো ঠান্ডা! শিউরে উঠল শিবনাথ, কিন্তু আর কিছু ভাববার আগেই কমলা মিষ্টি হেসে বলল, ‘এটা খেয়ে নিন, দিদিমা আপনার জন্যে বানিয়েছেন।’

হরিশঙ্করও বললেন, ‘লুচি মাংস এনেছ? নাও, শিবনাথ, আগে গরম গরম খেয়ে নাও। তারপরে কথা হবে।’ খাবারটা এতই লোভনীয় যে কার হাত ঠান্ডা কার হাত গরম সেসব বিচার করবার মতো সময় তখন শিবনাথের নেই। খাওয়াটা তো চটপট সেরে নেওয়া যাক।

শিবনাথের খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, হঠাৎ দরজার কাছে অন্নপূর্ণার গলা শোনা গেল, ‘কি, খেয়েছে?’

মৃদু হেসে হরিশঙ্কর বললেন, ‘হ্যাঁ, খেয়েছে।’

শিবনাথের ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। খেয়েছে? খেয়েছে মানে কি? লুচি-মাংস না কোনো ঢপ? ঢপ হলে কীসের ঢপ? এই বুড়ো-বুড়ির মনে কি কোনো অভিসন্ধি আছে? তা যদি হয়, তবে তো আর দেরি করা চলে না। এক্ষুনি অ্যাকশন নিতে হবে।

ঠিক এই সময়ে হরিশঙ্কর বললেন, ‘অনু, শিবনাথ বুদ্ধমূর্তিটা একবার দেখতে চায়। ওকে একবার দেখাও না।’

শিবনাথ চেয়ার ছেড়ে উঠছিল, আবার বসে পড়ল। কার মুখ দেখে উঠেছে আজ? সব কিছু যে না চাইতেই হাতে এসে যাচ্ছে! কোনো খুনখারাবির তো দরকার নেই। মুর্তিটা একবার হাতে এলে তাকে আর ঠেকায় কে? সোজা দরজা খুলে বেরিয়ে গেলে কেউ আটকাতে পারবে? যদি কেউ ঠেকাতে আসে তবে তার অদ্যই শেষ রজনী। ওই কাজের মেয়েটা যদি চেঁচাতে যায় তখন তার চ্যাচানি চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই নয়।

হরিশঙ্করের কথা শুনে অন্নপূর্ণা প্রায়ান্ধকার ঘরের এক কোনায় চলে গেলেন। একটু পরেই ঠুনঠুন শব্দে বোঝা গেল কিছু চাবি নিলেন। আলমারিটা ঘরে ঢোকার দরজার ঠিক উলটোদিকে। উঠোন থেকে আসা ম্লান আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। অন্নপূর্ণা যখন আলমারিটা খুলতে শুরু করলেন, শিবনাথ যথাসাধ্য নিঃশব্দে, প্যান্টের পকেট থেকে ফ্লিপ ড্যাগারটা বের করতে করতে তাঁর পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। ঠিক তখুনি উঠোন থেকে আসা আলোটা ঝপ করে কমে গিয়ে সমস্ত ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল।

তার পেছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে কি না সেটা দেখে নেবার জন্যে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাতেই শিবনাথের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল! দেখা গেল, কাজের মেয়ে কমলা কখন যেন নিঃশব্দে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আলোটা পেছনে থাকায় তার নাক-মুখ কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু অন্ধকারে তার চোখ দুটো হিংস্র মাংসাশী শ্বাপদের চোখের মতো একটা নীলাভ-সবুজ দ্যুতিতে জ্বলছে।

সর্বনাশ, এখন কী করা কর্তব্য? সেটা ঠিক করে ওঠার আগেই অন্নপূর্ণা বললেন, ‘আলমারিটা খুলে দিয়েছি, শিবনাথ। বুদ্ধমূর্তিটা দেখে নাও।’

চিন্তিত শিবনাথ চমকে মুখ ঘুরিয়ে বিস্ফারিত চোখে আলমারিটার দিকে তাকাতেই, তার ভেতর থেকে একটা প্রচণ্ড তীব্র আলো ক্ষিপ্ত একপাল নেকড়ের মতো তার ওপরে যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই আলোর অভিঘাতে শিবনাথ ছিটকে মেঝের ওপরে পড়ে ব্যথায় কাতরে উঠল, ‘ও মাগো… ও জ্যেঠিমা, এত আলো এল কোত্থেকে? আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না…’

এই প্রশ্নের উত্তর দিল একটি পুরুষকণ্ঠ, ‘যেখান থেকে আলোটা আসছে, সেইখানেই তুমি যাবে, শিবনাথ। গেলেই বুঝতে পারবে।’

‘তার মানে? কে তুমি?’

‘তার মানে বুঝতে পারলে না? ওই আলো যেখান থেকে আসছে, সেখানেই তুমি যারে এখন আর আমি? আমার গলাটা ভুলে গেলে, শিবনাথ? চিনতে পারলে না? আমি বিষ্ণু, তোমার প্রাণের বন্ধু বিষ্ণুশঙ্কর রায়বর্মন।’

‘তুমি বিষ্ণু? হতে পারে না। আমি তাকে নিজের হাতে… বিষ্ণু মরে গেছে।’

‘তোমার তাই ধারণা। সেটা ঠিক নাও হতে পারে। তুমি যে লোহার স্প্যানার দিয়ে পেছন থেকে মেরে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে আমাকে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে, কাজটা হয়তো পরিষ্কার হয়নি।’

একটি উৎফুল্ল নারীকণ্ঠ বলল, ‘আমিও এসেছি, ঠাকুরপো, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।’

শিবনাথ কেঁদে উঠল, ‘ওরে বাবা, এ যে বউদির গলা! আমি কোত্থাও যাব না! আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও!’

‘আমিও তো তোমাকে বলেছিলুম আমাকে ছেড়ে দিতে। আমার সেই অনুরোধে। কান দিয়েছিলে? তোমার ইচ্ছেমতো সব জঘন্য কাজ শেষ করে আমার গলা টিপে ধরেছিলে। তারপরে, মরে গিয়েছি ভেবে বিষ্ণুর পেছনে ছুঁড়ে দিয়েছিলে। আমার ছেলেটাকে পর্যন্ত রেয়াত করোনি। ওই খাদে ফেলে দিয়েছিলে। আজ তোমার নাকিকান্নায় গলে গিয়ে তোমাকে ছেড়ে দেব, তার কোনো কারণ আছে কি?’

‘ওমাগো! আমাকে ছেড়ে দাও। মা কালীর দিব্যি, আর কোনোদিন খারাপ কাজ করব না। মাইরি বলছি। কোন শালা মিথ্যেকথা বলে। আর ওই আলোটা নিভিয়ে দাও না। আমার যে গা পুড়ে যাচ্ছে!’

বিষ্ণুশঙ্করের গলা শোনা গেল, ‘এ আর কী দেখছ? তোমাকে যখন ওই আলোর একেবারে ভেতরে নিয়ে যাব, তখন দেখবে তোমার শরীরটা ভয়ংকর উত্তাপে আস্তে আস্তে গলে ধোঁওয়া হয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত তোমার মগজটা কিছুক্ষণ টিকে থাকবে যাতে সেই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার প্রতিটি মুহূর্ত তুমি অনুভব করতে পারো। নাও, সময় হয়েছে। চলো এবার।’

হঠাৎ শিবনাথ হুংকার দিয়ে উঠল, ‘না, আমি কোথাও যাব না। তোমরা মানুষ হও, ভূত হও, প্রেত হও— যা খুশি হও, আমার গায়ে হাত দেবার চেষ্টা করবে না বলে দিলুম। যদি দিয়েছ তো আমি এমন চিৎকার করব, যে পাড়াসুদ্ধু লোক দৌড়ে আসবে।’

বিষ্ণুশঙ্করের গলা হেসে উঠল, ‘বেশ তো। চিৎকার করতে চাও তো করো। এসো কমলা।’

পরমুহূর্তেই কেউ শিবনাথের মোটাসোটা শরীরটা শূন্যে তুলে নিল আর অবলীলাক্রমে ছুঁড়ে দিল আলমারির ভেতরে। সেখানে একটা ভয়ংকর বুকফাটা আর্তনাদ যেন দূর থেকে আরও দূরে চলে গেল।

অন্নপূর্ণা আলমারির পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিলেন। বললেন, ‘এতদিনে একটা বিভীষিকা শেষ হল। এবার আমরা যেতে পারি।’

কমলা বলল, ‘আমি এখন কী করব, দাদামশাই?’

হরিশঙ্কর বললেন, ‘আমরা যতদিন আছি ততদিন থাকতে পারো। তার পরে যেখান থেকে এসেছ, সেখানেই চলে যেও। অথবা তোমার দাদাবাবুর সঙ্গে কথা বলে নাও। তিনিই তো তোমাকে এনেছেন। তিনি যা বলবেন তাই হবে।’

ব্রজকিশোরবাবু অপেক্ষা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। বসাক বাড়ি থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না, কেউ বেরোলও না। রংচঙে জামা পরা লোকটা তাহলে রাতের খাওয়াটা সেরেই বেরোবে বা, রাত্রিটা থেকেও যেতে পারে। তাহলে আর বসে থেকে লাভ কী? ব্রজকিশোরবাবু ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠেই পড়লেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *