সভ্যতার সংকট
চায়ের টেবিলে ঝড় উঠলো। রমা দজ্জাল মেয়ে নয়, বরং ভালোমানুষই বলা যায়—তবু এক-আধ দিন এমন হয়। কারণটা খবরের কাগজ।
জানালা দিয়ে ‘টুক’ করে ‘অমৃতবাজার’খানা পড়লেই রমাতে আর আমাতে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। রমা চায় কাগজের প্রথম ভাঁজ খুলবে ও, অথচ আমারও চাহিদা একই। একই জিনিস দুইজনের কাম্য হ’লে সাম্য থাকে না, এটা কে না জানে?
বলতে পারেন—যেহেতু আমি পুরুষ, অতএব শিভালরি জ্ঞান থাকার প্রয়োজন আমারই, কিন্তু ভাবুন—বর্তমান দিনে সকালবেলা সংবাদপত্র খুলে কলকাতার কোন কোন রাস্তায় কতো ঘণ্টা করে ‘কারফিউ’ আদেশ বলবৎ আছে এবং গত কালকের আহত ও নিহতর সংখ্যা কি, সেটা না দেখেই যদি কেউ ‘চিত্রায়’ কি চলছে, ‘রূপবাণীর’ পুরনো ছবিটা উঠে গেল কিনা, ‘পূর্ণ’ আর ‘বিজলীতে’ নতুন কি আসছে ইত্যাদি তথ্যানুসন্ধান করতে বসে, কতোক্ষণ শিভালরি দেখানো যায়? কতোদিন?’
সংবাদপত্রের ভিতর থেকে কেবলমাত্র এই সংবাদগুলি চয়ন করে নেয় রমা। শহর এবং শহরতলির সর্বত্র কি কি সিনেমা হাউস আছে, কোনদিন কোথায় কি কি ছবি দেখানো হচ্ছে, সব রমার নখদর্পণে।
অথচ মজা এই, চাক্ষুষ প্রত্যক্ষে ক’বার বা ক’টা ছবি দেখেছে সে, বোধ হয় আঙুল গুণেই বলা যায়।
ঝড় ওঠার কারণটাও এই।
একে তো আমার সময়ের একান্ত অভাব, তার ওপর সিনেমা দেখাটাকে আমি সময়ের চরম অপব্যবহার বলে মনে করি।—কি নিজের, কি অপরের। …তা’ ছাড়াও আবার অপরাধ স্বীকার করছি—’তুতো ঠাকুরপো’ বা ‘পাতানো দিদির’ বরের সঙ্গে যাওয়াটা আমার রীতিমত অপছন্দ।
কাজেই দুধের স্বাধ ঘোলে মেটানো ছাড়া উপায় কি রমার!
ঘোল এক আধ দিন ঘুলিয়ে ওঠে।…একটা ভালো ছবি নাকের সামনে দিয়ে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়ে, হয়তো বা জয়ন্তী-উৎসব পর্যন্ত সেরে, যখন হঠাৎ একদিন কেটে পড়ে, সেইদিনই খবরের কাগজের ভাঁজ খুলে বিচলিত হয়ে ওঠে রমা। অনেক অভিযোগ, অনুযোগ, হতাশা বেদনা উজাড় করে রমা শেষ মন্তব্য করে—ছ’মাসে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে সামান্য দু’ঘণ্টা সিনেমা দেখিয়ে আনার মতো সময়েরও যার অভাব, সে আবার বিয়ে করে কোন লজ্জায়? এগারো বছর আগের সেই নিদারুণ দুর্ঘটনাটি স্মরণ করে কে যে বেশি অনুতপ্ত হই কে জানে, তবু আমিই অনুতপ্তের ভান দেখাই।
অনুতাপের প্রমাণ দিতে সিনেমার টিকিট কেটে আনি।
আজও তাই গিয়েছিলাম, ফিরে এসে দেখি হৈ-হৈ ব্যাপার!
সদর দরজার কাছ থেকে জিনিস ছড়ানো—ট্রাঙ্ক আর সুটকেস, বাক্স আর বিছানা, কুঁজো আর হোল্ডঅলে পা ফেলবার জো নেই।
তারকদা এসেছেন। একলা নয় সস্ত্রীক—সপুত্রকন্যা। অপ্রত্যাশিত এই আসা।
শুনলাম তারকদার নিজের কর্মস্থল এবং তাঁর শ্বশুরের কর্মস্থল দৈবক্রমে এমন বিপরীতমুখী হয়ে উঠেছে যে কোনো প্রকারেই একলক্ষ্যে একদমে যাওয়া চলে না। কাজেই কলকাতায় এই ব্রেকজার্নি। দশদিনের ছুটিতে বৌকে বাপের বাড়ি রেখে আসতে চলেছেন তারকদা।
শুনে আমিও হৈ-হৈ করে উঠলাম—বলো কি, দশদিন ছুটি? আর বলছো কিনা কাল যাবে? অসম্ভব! যেতে দিলাম আর কি!
বাল্যে বহুদৃষ্ট এবং যৌবনে বহুদিন অ-দৃষ্ট মামাতো দাদাকে নিজের বাড়িতে পেয়ে এটুকু আগ্রহ না দেখালে চলে? অবশ্য তাঁর লটবহর আর সেনাবাহিনীর বহর দেখে আগ্রহটা যে স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছিল এমন নয়, কিন্তু করা যায় কি?
মফঃস্বলি বোকামির বশে আমার সৌজন্যটুকু নির্জলা মনে করে তারকদা আমার পিঠ ঠুকে দিয়ে অমায়িক হাসি হেসে বলেন—জানি তুই শুনলে রসাতল করবি, ছাড়বি না।…কেমন গো বলিনি?…উনি বলছিলেন—ওঁর পিত্রালয়ে ক’টা দিন থেকে আসতে, বুঝলি মন্টু? আমি বললাম—মন্টুর বাড়ি উঠলে তোমাকে পৌঁছে দেওয়ার দিনটাও হাতে থাকে কি না দ্যাখো।
হা হা করে হেসে ওঠেন তারকদা।
আমিও—মানে আমাকেও হাসতে হয়।
তিনটি ছেলে আর তিনটি মেয়ে একুনে এই ছ’টি।
ছোটটি ঠিক দস্যিবৃত্তির উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি, বড়টি অপেক্ষাকৃত সভ্য। বাকি চারটি? তারা যে কী চীজ আমি এই একমিনিটেই বুঝে ফেলি। আমার এই নিঃসন্তান সংসারে এক মুহূর্তে যে ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয় সে আপনাদের ধারণার বাইরে।
চারটি চৌকস ছেলেমেয়ের ‘চাল্লি’, আর তার সঙ্গে তারক বৌদির বাক্যস্রোত—ওমা কী করলি? তেলের বোতল ভাঙলি? কী কাণ্ড বাবা!…ঠাকুরপো, তোমরা কী অসাবধান ভাই? এতো নিচু শেলফে তেলের বোতল, শেভিং সেট রেখেছো? রাখ শিগগির। ধন্যি বলি রমা তোমাদের সাহসকে! এইখানে এতো হাতের কাছে ছুরি?…ঝড় বইতে থাকে।
আমাদের বাড়িতে অবশ্য ওই রকমই ব্যবস্থা। রমার ভয়ে তেলের বোতল উঁচু তাকে তুলে রাখা উচিত কি না, অথবা আমার ভয়ে ছুরি আর ব্লেড ড্রয়ারে লুকানো উচিত কি না, সে প্রশ্ন করবার ফুরসৎই পাই না…ততক্ষণে বৌদি প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন।
তারকদার ‘অতাত’ শরীর। তাঁর কাছে এগুলো যে নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনামাত্র, মুখ দেখলেই বোঝা যায়। …সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমার সঙ্গে মনের আনন্দে গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে নিস্পৃহভাবে হলেন—এই বাচ্চু, আলমারীর মাথায় উঠছিস যে? ঠ্যাঙ ভাঙবি?…লতি, সোরাইয়ের জলটা সব ফেললি? দেখ, বিছানাটা ভেজেনি তো?…বাবলু কি হচ্ছে? নাঃ, তোরা আর কাকার কাছে এক ঘণ্টাও সভ্যতা দেখাতে পারলি না! দেখিস কাকা নিন্দে করবে!
—না না, সে কি? ছেলেপিলে দুরন্ত হবে বৈকি! দুরন্ত হওয়াই তো ভালো—বলে মাখনের কৌটায় খাবল বসানো হাত-ভর্তি মাখন সমেত ছেলেটাকে সস্নেহে কোলে তুলে নিই। …তারকদা বিগলিত স্নেহে বলেন—তা যা বলেছিস, ম্যাদামারা ছেলে আমার দু’চক্ষের বিষ!
অনেক চেষ্টায় রমাকে একবার নির্জনে পেয়ে বলি—সিনেমার টিকিট দু’টোর কি গতি হবে?
কুটনোবাটনা, চা-জলখাবারের বিশাল অরণ্য থেকে মুখ তুলে রমা জ্বলন্ত স্বরে বলে—আঁস্তাকুড়ে ফেলে দাওগে যাও!
নগদ আড়াই টাকার মাল! তা’ছাড়া রমার এই বিপন্ন মূর্তি দেখে মনটা কেমন করে ওঠে। সানুনয়ে বলি—মানে—খুবই বোকার মতো হচ্ছে কথাটা বুঝেও বলি—এদিকের খানিকটা গুছিয়ে রেখে যাওয়া যায় না? এসে না হয় রান্না করবে?
—ধাষ্টামো করো না, যাও।
এতো সংক্ষিপ্ত ও এমন প্রাঞ্জল ভাষা রমা বড় একটা ব্যবহার করে না। কিন্তু এখন সময়টা সংক্ষিপ্ত, কে কোন দিক থেকে শুনে ফেলে এই ভয়। তা’ছাড়া—মেজাজটাও ক্ষিপ্ত। কাজেই ক্ষুদ্র অথচ সারগর্ভ এই বাণীটি প্রয়োগ করেন ভদ্রমহিলা।
—বাঃ, ঠাকুরপো বেশ—বৌদির কণ্ঠ ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে পিছনে—অমনি ভাঁড়ার-ঘরে এসে ঢুকেছো? বাবাঃ, একদণ্ড আর অদর্শন সয় না!
—তা’ আপনাদেরই বা কি কম?
এটুকু পরিহাস করতেই হয়। না করলে চলে না। পরিহাসের উত্তরে হাঁড়িমুখ করে থাকা সভ্যতা-সঙ্গত নয়।
—আমাদের? তারক-বৌদি রুমাল দিয়ে মেঝের একাংশ ঝেড়ে নিয়ে বসে পড়ে সহাস্যে বলেন—আমাদের কথা আর বোলো না, চব্বিশ ঘণ্টা ঝগড়া!
এমন সুরে বলেন যার মানে—জীবনেও কোনদিন উঁচু কথাটি হয় না তাঁদের।
এদিকে আমি কিন্তু মনে মনে প্রমাদ গণি।
রমার ভাঁড়ারে কি আছে কি নেই, রমাই জানে। যা নেই হয়তো আমাকে জানাতো, তারপর সৌষ্ঠব করে ওদের সামনে ধরে দিতো চা-জলখাবারের থালা। তারপর আয়োজন সুরু করতো রান্নাবান্নার। মাঝখানে ইনি বসলেন!
কেটলির বদলে রমা যে একটা সসপ্যানে চায়ের জল তৈরি করে—এ সত্য এতো শিগগির প্রকাশ হয়ে যাওয়াটা রমা পছন্দ করবে কি?…কিছু বলবে না, মুখখানি আষাঢ়ের আকাশ করে রেখে দেবে হয়তো!
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে রমা হেসে ওঠে—তা’ আর নয়? বটঠাকুরকে দেখলে আর কেউ বিশ্বাস করবে না যে ওঁর সঙ্গে আবার ঝগড়া হয় মানুষের। তা’হলে আপনি পাড়াকুঁদুলি।
—দেখছো ঠাকুরপো, তোমার বৌ আমাকে কি যা-তা বলছে?
—বলবো না কেন? আপনি আমার ভাসুরের নিন্দে করছেন কেন? সত্যি দিদি, আপনাদের দেখে যে কী আনন্দ হল! কখনো তো দেখিনি, সেই যা বিয়ের সময়। এতো ইচ্ছে করতো দেখতে! এবার থেকে কিন্তু আসতে হবে মাঝে মাঝে।
—এলেই হয়। আমারও ইচ্ছে হয় রে! তা’ছাড়া কলকাতার মুখ দেখিনি কতোদিন তার ঠিক নেই, কিন্তু ওই যে মানুষ! আঠারো মাসে বছর! ‘যাচ্ছি যাবো’ করতে করতে যুগ উল্টে যায়। নেহাৎ এবার মা বার বার লিখছিলেন তাই।…কি রে ডলি? কি? খোকা কাণ্ড করেছে?…কাকার খাটে?…ওমা তোরা কি বোকা রে, কাকার খাটে ওকে শোয়াতে আছে? এই সন্ধ্যেবেলা বিছানা ভিজিয়ে দিল?…দেখছিস তো রমা? তুই বাপু আছিস বেশ!
অবশ্য এমন সুরে বলেন, যার মানে দাঁড়ায় ‘আহা মরে যাই, কী দুঃখী তুই!’
কিন্তু রমার এ ভাবের অর্থ কি?
আমার ওপর প্রতিহিংসা? কিন্তু প্রতিহিংসার বশে এত অমায়িক আর প্রসন্নতার ভান দেখাতে পারে মানুষে?
—যান দিদি গা’টা ধুয়ে আসুন, ট্রেনের গরমে সারা হয়ে যাচ্ছেন। ছেলেদেরও মুখটুখ ধুয়ে দেবেন।
অর্থাৎ জলখাওয়ার ওয়ার্নিং!
—মরে যাই, ওদের আবার মুখ ধোওয়া! চব্বিশ ঘণ্টা খাচ্ছে। আমি যাই। এসব কাপড়-চোপড় কোথায় ছেড়ে রাখবো ভাই? গোসলখানার কোণে?
আবার প্রমাদ গণি। কাপড়-চোপড় ছেড়ে রাখবার প্রথা আমাদের বাড়িতে নেই। একটি ঠিকে-ঝি, বাসন মাজা ঘর ধোওয়া করেই মনে করে মাথা কিনে নিচ্ছে, কাপড় কাচতে বললে তো তখুনি কাজ ছেড়ে দেবে।
রমা কিন্তু ইতস্ততঃ করে না, স্বচ্ছন্দে বলে—হ্যাঁ দিদি, তাই রাখুনগে। শিগগির আসবেন কিন্তু, চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
—আমার শিগগির? তা হ’লেই হয়েছে! বৌদি হি হি করে হেসে ওঠেন—এক ঘণ্টার কম আমার গা ধোওয়া হয় না। কি ক’রে যে লোকের শিগগির হয়!…হ্যাঁ, গোসলখানায় সাবান আছে তো? নতুন সাবান? আমি আবার ঘষা সাবান মাখতে পারিনে বাপু!
—সাবান?…ও! এই শুনছো, আমার টেবিলের টানায় সাবান আছে, বার করে দাও তো দিদিকে। সোপকেসে আছে।
এই সোপকেসের ইতিহাস জানি।
পছন্দসই এই সৌখিন সোপকেসটিতে একখানি ভালো সাবান ভরে রাখা রমার সখ। সর্বদা কিছু আর দামী সাবান ব্যবহার করতে পারি না আমরা। একখানি দামী সাবান সোপকেসে আছে—সেই সাবানটি।
বৌদি চলে যেতেই রমা কুইনিন-গেলা স্বরে বলে—ঘষা সাবান মাখতে পারেন না! লোকে নতুন সাবান কিনে চৌবাচ্চার পাড়ে রেখে এসেছে ওঁর জন্যে! ধন্যবাদ আক্কেলকে! একখানা সাবান মানুষ নিজে বার করে না?
আমি বললাম—আর তুমি যে কাপড় ছেড়ে রাখবার কথা বললে, তোমার নন্দর-মা কাল জবাব দিয়ে বসবে না তো?
—নন্দর মা! তা’ আর নয়! আমাকেই কাচতে হবে ভোরবেলা উঠে। আশ্বাস দিলেন কি না একঘণ্টা সময় চান করতে লাগে। কি যে করবো আমি! তুমি তো দিব্যি দু’-পাঁচ দিনের নেমন্তন্ন করে রাখলে। তোমার আর কি?
আমার যে ‘কিছুই’ নয় তাই বা বলি কি করে? কিন্তু রমা কি গ্রাহ্য করবে? পকেটের দুরবস্থার কথা কি বৌরা বিশ্বাস করে? তাই ম্লানভাবে বলি—কি আর করি বলো, না বললেও তো ভাল দেখায় না।…কিন্তু টিকিটটার কি হবে তাই ভাবছি।
—এই তো আগুন জ্বলছে উনুনে, দাও না ফেলে! অতো ভাবনার কি আছে?
চা-পর্ব সমাধান হ’তেই তারকদা বললেন—চ’ল একটু বেড়িয়ে আসি।
আবার প্রমাদ!
এখন সখ করে বেড়াতে বেরোলে রমা রক্ষে রাখবে? আর সত্যি এতোগুলি মুখ হঠাৎ বেড়ে গেলে তার ব্যবস্থা আছে তো?
মাছ চাই, আলু চাই, পান চাই—মাছ না পেলে ডিম চাই! তা’ছাড়া হয়তো ঠিক আজকেই তেলের টিন খালি, ঘিয়ের জার পেন্সন চাইছে—এরকম ক্ষেত্রে রমার মাথায় পাষাণভার চাপিয়ে বেড়াতে যাওয়া?
ইতস্ততঃ করে বলি—এই কাল থেকে ট্রেনজার্নি, আবার বেড়াতে যাওয়া কেন? একটু বিশ্রাম করো না?
—আরে দূর—তারকদা হেসে ওঠেন—ওসব বিশ্রাম-টিশ্রাম তোদের কলকাতার বাবুদের জন্যে! আমরা জঙ্গলের লোক, না হাঁটলে আমাদের ক্ষিদে হয় না।
ক্ষিধে না হওয়ার সংবাদ পেয়েও যদি বেড়ানোর বিরুদ্ধে ওকালতি করি, সেটার উল্টো মানে হবে না তো? মরিয়া হয়ে বলি—তবে চলো—
সঙ্গে সঙ্গে বৌদি এসে উদ্ধার করেন, ‘ওগো শুনছো? বেরিও না। সিনেমা দেখে আসি চলো।’
—সিনেমা? —তারকদা বলেন—আরে দূর, আবার এখন এক মুঠো টাকা খরচ করে সিনেমা! এই মেয়েদের, বুঝলি মন্টু, সিনেমা হচ্ছে ইষ্টমন্দির। সিনেমায় যাবার আর বৈকুণ্ঠে যাবার দু’টো টিকিট যদি দাও ওদের, কোনটা বেছে নেবে বল দিকি? ওই সিনেমা।
—বেশ তাইত! বৌদি লেশমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেন—এতে তোমার পয়সা লাগবে না। ঠাকুরপোরা যাবে বলে কিনেছিল—রমা বলছে ওর ভীষণ মাথা ধরেছে, যেতে পারবে না। কেন ফেলা যাবে পয়সার জিনিস? আর আমাদের তো কলকাতায় এসে থিয়েটার সিনেমা দেখার কথা রয়েছে।
‘কথা রয়েছে’! সিনেমা থিয়েটার দেখার কথা রয়েছে! অথচ এসেই বললেন—’কাল যাবো।’ ওটা বোধ করি লাঠি ডুবিয়ে জল মেপে দেখা।
নিতান্তই কড়ির জিনিস ফেলা যাবার ভয়ে তারকদা রাজি হন।
জামাজুতো প’রে প্রস্তুত হয়েছেন, হঠাৎ —ঘরের মধ্যে বোমা পড়লো। শুধু বোমা? সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন নয়? কাচের আলমারীর মাথা থেকে কার্নিশ ভেঙে পড়ে গেছে লতি। রমার পুতুলের আলমারীর।
লতির হাত পা ভাঙলো কি না জানি না, তবে হাত পা নাক মুখ যাদের ভাঙলো তাদের দিকে চেয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। শব্দ শুনে রমা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসবে এটা বিচিত্র নয়। ছুটে এসেছে সে। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আজন্ম সঞ্চিত এই পুতুলগুলির ওপর রমার যা বাৎসল্যস্নেহ তা’ তো আমার অজানা নয়!
—ওমা কি কাণ্ড! লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে! ভাঙলি তো পুতুলগুলো?—বৌদি ঘোরানো শাড়ির আঁচলটা কোমরে টান করে জড়িয়ে মেয়ের দিকে তেড়ে যান—মেয়ে তো নয়, দস্যি! একরাশ পুতুল সব শেষ করলে গো! কি পাহাড়ে মেয়ে বাবা!
এতক্ষণে মেয়ের গালে ঠাঁই করে একটা চড় পড়ে।
আর সঙ্গে সঙ্গে কলের পুতুলের মতো এগিয়ে যায় রমা লতির দিকে। মার কবল থেকে মেয়েটাকে টেনে নিয়ে অবহেলাভরে বলে—দিদির সব বাড়াবাড়ি! ভারি তো দুটো কাচের পুতুল! তার জন্যে আবার মেয়েকে মারা! আমার যেন এখনো পুতুল খেলবার বয়েস আছে?…হ্যাঁরে বেশি লাগেনি তো? ওমা এই যে ছড়ে গেছে, কপালটা ঢিপি হয়ে উঠেছে! মরে যাই! আয় আইডিন লাগিয়ে দিই। …দিদি আপনারা বেরিয়ে পড়ুন, সময় হয়ে গেছে। অন্ধকারে হোঁচোট খেতে খেতে চেয়ার খুঁজে বেড়ানো বাপু আমার দু’চক্ষের বিষ।
তারক-দম্পতি চলে যান। কিন্তু গলা খুলে প্রাণের কথা বলবার পথ খোলা থাকে না। বড় মেয়েটি বছর বারো, লতিও দশের কম নয়। বাঙলা কথার মানে বুঝতে পারবে না এমন মনে করবার হেতু নেই।
যা বলাবলি গলা নামিয়ে। —বাজার যাবে, না সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?
চমকে উঠে বলি—কি চাই?
কি না চাই?…মাছ, তরকারি, আদা, কাঁচালঙ্কা, দই, মিষ্টি, সরষের তেল, পাঁচফোড়ন। কুঁড়েমি করে দেরি করবে না। এখুনি এনে দিতে পার তো ভালো, নইলে দেখে নেব তোমায়।
—আর এই যে কাচ ভাঙা পড়ে রইল—
—থাক না, তোমার কি? তোমায় যা বলছি করো গে।
—যাচ্ছি, যাচ্ছি, রোস না।…আচ্ছা ওঁদের খামোকা সিনেমা যেতে বললে যে?
—কি করবো? এখানে এসেছেন, তোমার তো ওদের ভাল করে খাওয়ানো দাওয়ানো, থিয়েটার, বায়স্কোপ দেখানো উচিত। এ তবু সুবিধের হোলো।
—তা হলে থিয়েটারটা তোলা থাকলো? তুমি অতো বাড়াবাড়ি কোরো না রমা।
তা’ কি করবো। সাতজন্মে আসেন না—শেষে পরে তুমিই হয়তো বলবে—’আর একটু যত্ন করা উচিত ছিল, তেমন হলো না’, হ্যানো ত্যানো।
—আমার তো ভারি! নেহাৎ ছেলেবেলায় মামারবাড়ির আদরযত্ন মনে করেই একটু বলা। কিন্তু যা শয়তানের ধাড়ি ছেলেপুলে, চার পাঁচ দিন থাকলে তো পাগল হয়ে যাবো।
—পাগল শুধু? আমার তো মনে হচ্ছে হার্টফেল না করি।
বাজার থেকে আসার খানিক পরে ছোট ছেলেটা এমন কান্না শুরু করলো যে আমারই হার্টফেল হবার যোগাড়। অনেকক্ষণ পরে ‘হিমশিমের’ চরম অবস্থায় পৌঁছে বাধ্য হয়ে রমার শরণাপন্ন হ’তে হল। বললাম—কি করবে? একে একটু দুধ-টুধ খাওয়াবে?
রমা রন্ধন-সমুদ্র থেকে মুখ তুলে বলে—ও কি খায়, কি ক’রে জানবো?
—ছোটছেলে আবার কি খাবে—দুধ ছাড়া?
—আহা! ফুড খেতে পারে না যেন? বড়ো মেয়েটাকে জিগ্যেস করো তবে।
—সেটা ঘুমিয়ে পড়েছে।
—ভালো। বড়োটি ঘুমিয়েছেন, পাহাড় ক’টি জেগে আছেন তো?…ওরে বাবা, দিচ্ছি দুধ খাইয়ে, রোসো।
সানাই তখন জগঝম্পয় পরিণত হয়েছে।
অনভ্যস্ত হাতে চামচে করে দুধ খাওয়াতে গিয়ে মাছের ঝাল পুড়ে গেল রমার। অতঃপর এলেন তারকদা’রা।
তারক বৌদি সবিস্ময়ে বলেন—ওমা কেঁদেছিল বুঝি? কী আশ্চর্য! ও তো এতো শান্ত, ধারণা করতে পারবে না তুমি। খালি ঘুমোয়।…বোধ হয় গরম হয়েছে, যা চাপা ঘর তোমাদের! কি করে যে ফ্যান না নিয়ে থাকতে পারো! উঃ! খোকার আবার এমন ধাত, সারারাত মাথার কাছে টেবিল ফ্যান ঘোরা চাই।…কি করলে? রাস্তায় নিয়ে গিয়ে বেড়ালে?
বাড়ির অখ্যাতিতে অপ্রস্তুত আমি তাড়াতাড়ি বলি—না না, গরম নয়, বেজায় ক্ষিধে পেয়েছিল। দুধ খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
—দুধ খেয়ে? বলো কি? কী দুধ খাওয়ালে? গয়লার দুধ?
—তা ছাড়া ? তবে সত্যি গরুর দুধ…মানে, দুয়ে দিয়ে যায় সামনে।
—ও তোমাদের সামনে দোয়ার কথা বলো না, কলকাতার দুধের কথা আর জানতে বাকি নেই আমার। ছোট বাচ্চার পক্ষে সাক্ষাৎ বিষ!…কি হবে, হ্যাঁগো?
তারকদা বলেন—কি আর হবে! একটু নাক্স খাইয়ে দিও।
ভাবলাম একটু মেজাজ দেখিয়ে বলি, তা’হলে আপনাদের বলে যাওয়া উচিত ছিল কি খাওয়ানো হবে। কিন্তু বললাম না। দুধের গ্লানিতেই অপরাধী ভাব দেখিয়ে বসে থাকলাম। যতোই হোক অতিথি! ভদ্রতা-সভ্যতা একটা কথা আছে তো?
তারপর—খাওয়া শোয়ার কাণ্ড!
সে এক মহাভারত।
”থলির ভিতর হাতী পোরা” শুনেছেন? যদি না শুনে থাকেন, অনুমান করুন।…আমাদের যুগল জীবনযাত্রার মতো সংসারে মাত্র আর আটজনকে স্থান দেওয়া? বিছানাটিছানা খুলতে চাইলেন না বৌদি। ক’দিন পরেই তো আবার বাঁধতে হবে। …ওঁর ছেলেমেয়েরা আবার বড়ো বড়ো থালা না হলে খায় না। ছোট ছোট লোকদের বড়ো বড়ো থালায় খাইয়ে আবার থালা মেজে নিয়ে তবে সত্যিকার বড়ো থালার দাবিদারদের খেতে দিতে হল!
—এঃ রাতে ভাত! আরে আমরা যে পশ্চিমের মানুষ সে বুঝি খেয়াল ছিল না?
তারকদার মন্তব্যে অপ্রস্তুত আমি লজ্জায় লাল হয়ে বলি—খেয়াল থাকবে না কেন? রমার শরীরটা তেমন—ইয়ে—একা মাখা, ‘বেলা’ ক’রে নিয়ে—
—তা বেশ বেশ! যাক নতুনত্ব হল একদিন, কি বল গো?
তারকদার ‘ওগো’ সহাস্যে বলেন—আমার তো বাপু ভাতই পছন্দ, ভালই খাবো।
মনে হ’ল, সস্ত্রীক আমরা ধন্য হয়ে গেলাম।
পরদিন সকাল থেকে কি হ’ল লিখবো? অতো কথা কি এই ক্ষুদ্র পুঁথিতে লেখা সম্ভব? ”ঝটিকা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র” দেখবার অভিজ্ঞতা হয়তো সকলের নেই , কিন্তু ”ষোলোই আগষ্ট” প্রমত্ত পার্ক সার্কাস, জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট, কলুটোলা, রাজাবাজার দেখেছেন নিশ্চয়ই? সবটা না হোক, কিছু কিছু? ভুলে গেছেন কি? একেবারে ভুলে গিয়ে না থাকলে তো—হয়তো আমার সংসারের অবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পারবেন।
সাতদিন, না সাতবছর! এর মধ্যে আরো একদিন সাতজনের সিনেমার টিকিট, আর অপর একদিন দু’জনের থিয়েটার। …নইলে ভালো দেখাবে কেন?
সুযোগ পেলেই আমি রমাকে বলি—রমা, আর তো সহ্য হচ্ছে না, কি করা যায়?
সুবিধে পেলেই রমা আমাকে বলে—দেখো সাতদিন যে ফুরোচ্ছে না—যা হয় কিছু বলো ওদের!
আমার অফিসের হঠাৎ বদলির খবর, রমার মার হঠাৎ মারাত্মক অসুখ শুনে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, পাড়ায় কলেরার প্রাদুর্ভাব, শহরে ডাকাতের আমদানি প্রভৃতি কতো কি-ই ভাবলাম ক’দিনে। কিন্তু বলে ফেলতে পারলাম কই?
নৈতিক সাহসের অভাব!
তার বদলে যখন-তখন তাই তারকদাকে বলি—কী অন্যায় করেছ তারকদা, মাত্র এই কদিন ছুটি নিয়ে! এবার যখন আসবে, মাসখানেক ছুটি নিয়ে এসো কিন্তু বলে রাখছি।
তারকদা হেসে বললেন—তা সত্যি, অন্তত মাসখানেক না থাকলে সব হয়ও না। কিছু তো দেখাই হ’ল না কলকাতার!
রমা বৌদিকে বলে—কী আনন্দেই যে কটা দিন কাটলো দিদি! একলাটি মুখ বুজে থাকি, সংসার করি না ভূতের ব্যাগার খাটি! আপনারা রয়েছেন, ছেলে-পুলে খেলে বেড়াচ্ছে, দেখে যেন চোখ জুড়োচ্ছে!
বৌদিদি হেসে বলেন—সে কথা মিথ্যে নয়, বাচ্ছাদের হাসি-খুসি গোলমাল নইলে বাড়ি মানায়?
অবশেষে যাত্রাকাল এল।
বিষণ্ণ মুখে বিদায় দিয়ে তারকদার হাত ধরে বলে দিলাম—ভুলো না কিন্তু, পুজোর সময় আসা চাই। এক মাসের ছুটিতে।
রমা বৌদিকে আলতা পরিয়ে দিতে দিতে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে—শ্বশুরবাড়ি এসে পর্যন্ত একলা। আপনি যদি থাকতেন দিদি, কি যে ভালো লাগতো! আবার আসবেন কিন্তু, কিছুদিন থাকতে হবে।
—আচ্ছা! মন্টু, জয় হিন্দ!
—জয় হিন্দ! আবার এসো তারকদা!
—দুর্গা, দুর্গা! চললাম রমা!
—আবার আসবেন দিদি! দুর্গা, দুর্গা!
—