পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

সপ্তম পর্ব- নীল লাল রুপালি নীরব

সপ্তম পর্ব- নীল লাল রুপালি নীরব

রাসবিহারী মোড় থেকে দেশপ্রাণ শাসমল পার্কের দিকে সামান্য বেঁকতেই সাদা বিরাট বাড়িটা চোখে পড়ল অপর্ণার। আগে বহুবার গেছে, কিন্তু খেয়াল করেনি। সামনের বোর্ডে একটা ‘ফরগেটমি নট’ ফুলের ছবি আঁকা। পাশে লেখা ‘ব্লু ফ্লাওয়ার’। নিচে ‘হেলথকামস হোম’। এই ফুল অপর্ণার চেনা। ম্যাসনিক চিহ্ন। বাবা ছোটোবেলায় তাকে এই ফুলের একটা ব্রোচ কিনে দিয়েছিলেন। সে কোথাও গেলে পরে যেত।

গাড়ির চালককে নির্ঘাত সব নির্দেশ দেওয়া আছে। গাড়ি মেন এনটান্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীদের কয়েকজনকে পেরিয়ে সোজা গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গেল। সামনে একজন গার্ড পোস্টেড। দেওয়ালে নির্দেশ “ হসপিটাল পার্সোনেলস অনলি”। গাড়ি বিনা বাধায় ঢুকে গেল। ভিতরে প্রচুর গাছগাছালি দিয়ে সাজানো। লম্বা লন। বাইরের গাড়িঘোড়ার আওয়াজ অনেকটাই স্তিমিত। অপর্ণা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই, উবেরওয়ালা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল। অপর্ণা গাড়িটার চলে যাওয়া দেখল। ঘড়ির কাঁটার মতো সময় মেনে ঠিক তখনই বিল্ডিংয়ের ভিতর থেকে নার্সের পোশাক পরা এক মাঝবয়সি মহিলা এগিয়ে এলেন হাসিমুখে। সঙ্গে আরও দুটি অল্পবয়সি মেয়ে। নার্স মহিলাটি একটু হেসে দুহাত বাড়িয়ে বললেন, “আসুন, আসুন। ভিতরে চলুন।”

অপর্ণা দাঁড়িয়ে রইল। ভদ্রমহিলা এবার অপর্ণার হাত ধরে একটু জোর করেই যেন বললেন, “দাঁড়িয়ে কেন? চলুন ভিতরে।”

“না। যাব না। আগে বলুন এসব কী? আমাকে এখানে ডেকে আনা হল কেন?”

নার্সটি আবার শান্ত গলায় বলল, “সেসব আপনাকে স্যার বলবেন। আপনার শরীর ভালো না। এতটা জার্নি করে এসেছেন। চলুন প্লিজ।”

“বলছি তো যাব না।” এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল অপর্ণা। “কে বলুন তো আপনারা? কেনই বা আপনাদের কথা শুনছি আমি? না গেলে কী করতে পারবেন? ভিতরে কে বসে আছে? কে আপনাদের স্যার? সেই মাস্টার?” এতক্ষণের পুষে রাখা রাগ ফেটে বেরিয়ে আসে। নার্স রাগ করে না। মৃদু হাসে শুধু। “সব জানতে পারবেন ম্যাডাম। কিন্তু আগে ভিতরে তো চলুন। আমাদের স্যার এই নার্সিংহোমের মালিক অশোক মল্লিক। আপনার বাবা ফার্গাস অ্যাভেরি স্যারকে আমি চিনতাম ম্যাডাম। স্যারের বন্ধু ছিলেন। অনেকবার এসেছেন এখানে। আপনি ভয় পাবেন না। প্লিজ চলুন।

বাবার নাম শুনে একটু চমকে গেল অপর্ণা। তারপর ভাবল, কিছু না ভেবেই যখন এতটা এসেছে, এখন আর ভিতরে না ঢোকার কোনও মানেই নেই। বরং গেলে কাজ হতে পারে। তার চারদিকে যে রহস্যটা ধীরে ধীরে আঁট হচ্ছে, সেটার যদি সন্ধান পাওয়া যায়। মাথা নিচু করে খানিক দাঁড়িয়ে তারপর বলল, “চলুন তবে।” পাশের দুটো মেয়ে এসে তার দুই হাত ধরল। যেন সে ভয়ানক অসুস্থ, এমন করেই নিয়ে গেল একটা ঘরে। সেই ঘরে একটা আলট্রাসোনোগ্রাফি মেসিন। পাশে সবুজ চাদরে ঢাকা লোহার মেডিক্যাল বেড। অ্যাপ্রন পরে এক কমবয়সি ডাক্তার বসে আছে। তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই ডাক্তার উঠে দাঁড়াল, “নমস্কার ম্যাডাম। আমি ডাক্তার অনীকেন্দু চৌধুরী। গাইনোকোলজিস্ট। স্যার আমায় বললেন আপনার চেক আপ করতে।”

“কেন? আমি তো ভালোই আছি।”

“অবশ্যই আছেন ম্যাম। আর থাকবেন সেটাই তো কাম্য। জাস্ট রুটিন টেস্ট। কাইগুলি একটু কো-অপারেট করুন। এসব মিটে গেলেই স্যার আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।”

“কিন্তু দরকারটা তো আমি বুঝতে পারছি না।”

“ম্যাডাম, আপনি ডাক্তার অপরেশ বসুকে দেখাতেন তো?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“তিনি এখন কোথায়?”

“দিল্লিতে। কোন একটা কনফারেন্সে গেছেন। সামনের উইকে চলে আসবেন।”

“সরি ম্যাডাম। দিল্লিতে যাননি। উনি ফেরার। আজকেই আনন্দবাজারে খবর হয়েছে। দেখেননি বোধহয়”, বলে একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজ অপর্ণার হাতে তুলে দিল। একটা খবরের চারদিকে গোল দাগ দেওয়া। যেন তাকে দেখানোর জন্যেই। খবরটা খুঁটিয়ে পড়ল অপর্ণা। যা লেখা, তা যদি সত্যি হয়, তবে ভয়ানক ব্যাপার। অপরেশ বসু ভুয়ো ডাক্তার। তার ক্লিনিকটাও নাকি শিশু পাচারের আখড়া। গতকাল পুলিশ সেখানে রেইড করে। অপরেশ আগেই খবর পেয়ে ফেরার। পুলিশ গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।

“দেখলেন তো ম্যাম, কোন লোকের হাতে বাচ্চার দায়িত্ব দিয়েছিলেন আপনি। স্যার তাই বলেছেন এখানে আপনাকে এনে চেক আপ করাতে।”

“আপনাদের স্যারের এত মাথাব্যথা কেন আমাকে নিয়ে?”

“সেটা তো জানি না ম্যাম। সেটা স্যারের সঙ্গে দেখা হলে আপনি নিজেই জেনে নেবেন। এখন কাইন্ডলি যা বলছি শুনুন। সময় চলে যাচ্ছে।”

অপর্ণা আর বাধা দিল না। ধীর পায়ে উঠে গিয়ে শুল সেই লোহার খাটে। তারপর প্রায় ঘন্টা দু-এক নানারকম পরীক্ষা করল ওরা। রক্তপরীক্ষা, ইউএসজি, আরও নানারকম। সব শেষ হবার পর নার্সমহিলাটি একটা ট্রে ভরে নানারকম ফল আর শুকনো খাবার নিয়ে এলেন। অপর্ণা বিনা বাক্যব্যয়ে খেয়ে নিল। খেতে খেতেই দেখল নার্সের মোবাইলে ফোন এসেছে। নার্স “হ্যাঁ, হ্যাঁ স্যার। হয়ে খাচ্ছেন। খাওয়া হলেই নিয়ে যাচ্ছি”, বলে অপর্ণার দিকে চেয়ে হাসিমুখে গেছে। বলল, “চলুন তবে। স্যার ডাকছেন।”

এই মুহূর্তের জন্যেই এত অপেক্ষা। অপর্ণার আপত্তি সত্ত্বেও তাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে একটা লিফটে চাপিয়ে চারতলায় নিয়ে যাওয়া হল। করিডরের দুপাশে ক্যানভাসে আঁকা সব ছবি। এর মধ্যে একটা অরিজিনাল এম এফ হুসেন আর বিকাশ ভট্টাচার্য চিনতে পারল অপর্ণা। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে গ্যালারি ‘৮৮ আর সিমায় প্রায়ই যেত। তখন বাবাই তাকে ছবি চিনিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতা শহরে এক নার্সিংহোমের মালিক একইসঙ্গে একটা হুসেন আর একটা বিকাশ ভট্টাচার্য রাখার ক্ষমতা রাখেন, এটা তার চিন্তার বাইরে। করিডরের বাঁদিকে একটা ঘরের সামনে এসে থামল হুইলচেয়ার।

“এবার উঠে দাঁড়ান ম্যাম।”

অপর্ণা দেখল অশোক মল্লিকের চেম্বারের সামনে চলে এসেছে। কিন্তু দরজা খুলতেই যে দৃশ্যটা দেখতে পেল, সেটার জন্য সে বিন্দুমাত্র তৈরি ছিল না। বিরাট চেম্বার। সামনের দেওয়ালে একটা ক্যানভাসে আঁকা ছবিতে খড়ের টুপি মাথায় দেওয়া এক নীল জামা প্যান্ট পরা শিল্পী তাঁর ইজেল, ক্যানভাস, তুলি নিয়ে চলেছেন রাস্তা দিয়ে। পিছনে দুটো গাছ। ধানের জমি। দূরে কিছু বাড়িঘর। শুধু এই ছবিটাই অপর্ণাকে চমকে দেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু তার চেয়েও বড়ো চমক, চেম্বারের একপাশে পাশাপাশি বসে রয়েছেন নিশীথ দত্ত, সুপর্ণা আর ঊর্ণা। ওরা আগেই এসেছে। উর্ণার মুখ দুই হাতে ঢাকা। অপর্ণা ঢুকতেই উর্ণা মাথা তুলে তাকাল। কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলে গেছে। অপর্ণা এক ঝলক ওদিকে তাকিয়েই সোজা তাকাল সেই লোকটার দিকে, যার সঙ্গে মোলাকাতের জন্য এখানে আসা।

অশোক মল্লিক প্রায় নিশীথ দত্তের সমবয়সি। কিন্তু মাথাজোড়া টাকের জন্য বয়স বেশি মনে হয়। গোল মুখ, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, মুখ হাসি হাসি। তিনিও অপর্ণাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

“এসো অপর্ণা। তোমার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। না না ওদিকে না, আমার সামনের এই চেয়ারটায় বসো।”

বাধ্য মেয়ের মতো অপর্ণা বসে পড়ল। ভদ্রলোকের টেবিল ভরা কাগজপত্র। কালো ইউএসজি প্লেট। ভদ্রলোক সেগুলোই দেখছিলেন এতক্ষণ। তাদেরই একটা অপর্ণার দিকে বাড়িয়ে বললেন, “অভিনন্দন। তোমার বেবি খুব ভালো আছে। আমরা বেশ টেনশনে পড়ে গেছিলাম।”

“কেন?”

“কেন মানে? অনীকেন্দু কিছু বলেনি তোমায়?”

“বলেছে। কিন্তু সেটা তো আমার টেনশনের কারণ হতে পারে। আপনি কেন টেনশন করছেন? আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না। কোনও দিন দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। নামও আজ প্রথম শুনলাম।”

অপর্ণার মা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। হাত উঠিয়ে তাঁকে থামিয়ে ডাক্তার মল্লিক বললেন, “সেটাই স্বাভাবিক। চিনলে বরং অবাক হতাম। কিন্তু ফার্গাস আমার বন্ধু ছিল।”

“বন্ধু! কেমন বন্ধু আপনি? বাবার যখন অ্যাটাক হল, তখন কোথায় ছিলেন? একদিনও তো দেখিনি আপনাকে?” অপর্ণা দেখল না চাইতেই হুড়হুড় করে শব্দ বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে। চাইলেও থামাতে পারছে না। “নাকি আপনি লর্ড ভোলডেমর্টের মতো? হু ক্যাননট বি নেমড! ডার্ক লর্ড! ম্যাসনিক মাস্টার!”

“চুপ করো। মাস্টারের নাম এর মধ্যে এনো না। উনি আমাদের সবার উপরে। অনেক উপরে। ওঁকে আমাদের লেভেলে নামিয়ো না প্লিজ।”

“কেন? উনি কে? ভগবান? ভগবান মোবাইলে কথা বলেন বুঝি? উত্তর দিচ্ছেন না কেন? আপনারা মাস্টারের ক্রীতদাস হতে পারেন। আমি না। আমার কী দায় পড়েছে আপনাদের মাস্টারের কথা মেনে চলব?”

“কিন্তু তুমি তো চললে। তাই না?” শান্ত গলায় বললেন ডাক্তার মল্লিক।

“এখানেই মাস্টার আলাদা। অবিশ্বাসীদেরও নিজের কথা মানাতে পারেন।”

“সরি টু সে, আমি আপনাদের সো-কলড মাস্টারের কথায় এখানে আসিনি। এসেছি নিজের ইচ্ছায়। এসেছি নিজের কানে শুনতে। জানতে।”

“কী জানতে?”

“সত্যিটা। অবশ্য যদি বলেন। আদারওয়াইজ…”

“আদারওয়াইজ? কী করবে?”

“আপনার নামে পুলিশে খবর দেব। পুলিশ বাকিটা বুঝে নেবে।”

“কী অভিযোগে?” মল্লিক যেন বেশ মজা পেয়েছেন।

“আপনার পিছনের এই ছবিটা। যদি এটা অরিজিনাল হয়, যেটা হওয়া কোয়াইট পসিবল, কারণ এখান থেকে ছবির ফাটাফুটিগুলো দেখতে পাচ্ছি, তবে এটা The ArtIst on the Road to Tarascon। নাৎসি অ্যামলে ম্যাগডেবার্গ মিউজিয়াম থেকে হারিয়ে যাওয়া ভ্যান গঘ। সারা বিশ্ব পাগলের মতো এটাকে খুঁজছে। আর আপনি একে নিজের চেম্বারে বন্দি করে রেখেছেন?”

“তোমাকে এর কথা কে বলল?”

“আপনি হয়তো ভুলে গেছেন, আমার বাবা, আপনার বন্ধু, ফার্গাস অ্যাভেরি শখের আর্ট কনৌসার ছিলেন। এই ছবির কথা বাবার মুখে কতবার শুনেছি!”

“ফার্গাস জানত। আমার এই চেম্বারে সবাই আসে না। কিন্তু আজ অবধি যারা এসেছে, প্রথমবারেই এই ছবি চিনেছে দুইজন। ফার্গাস আর তুমি। ইন ফ্যাক্ট এই ছবির জন্যেই…” চুপ করে গেলেন ডাক্তার অশোক মল্লিক।

“বলুন। কী বলছিলেন, শেষ করুন।”

“তুমি বলছিলে তুমি সত্যিটা শুনতে চাও। শোনাতে পারি। কিন্তু তুমি সেটা সহ্য করতে পারবে তো? বিশেষ করে এইরকম শারীরিক অবস্থায়?”

“পারব। বরং না বললেই আমার অনেক বেশি ক্ষতি হচ্ছে।”

অশোক মল্লিক এবার অপর্ণার ঘাড়ের উপর দিয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কিচ্ছু করার নেই সুপর্ণা। এই দিনটা আসার ছিলই।”

নিশীথ দত্ত “আমি একটু ঘুরে আসছি” বলে উঠে গেলেন। উর্ণা একবার মুখ উঠিয়ে আবার দুই হাতে মুখ গুঁজে দিল। গলাটা একটু খাঁকরে অশোক মল্লিক জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি নীবারের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ। আপনাদের এনজিও। এককালে ম্যাসনিক ব্রাদারদের অংশ ছিল। পরে ভেঙে বেরিয়ে এসে আলাদা সংগঠন করে।”

“হুমম। সবাই সেটাই জানে। আজ থেকে একশো বছরের কিছু আগে সাতজন মানুষ মিলে এই সংগঠনটা শুরু করেন। এঁরা সবাই এককালে ম্যাসনিক ব্রাদারহুডের সদস্য ছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়ার ডায়মন্ড জুবিলিতে ম্যাসনিক লজে খুনের ঘটনা ঘটে। এরপরেই এঁরা লজের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে এক ছোট্ট পরিবারের মতো সাতজনের সমিতি খোলেন। ব্রাদারহুডে সাত পবিত্র সংখ্যা। সেটাও এঁদের মাথায় কাজ করেছিল ম্যাসনিক হয়তো।”

“এঁরা কারা?”

“এঁদের একজন ছিলেন সাহেব। চিফ ম্যাজিস্ট্রেট চার্লস টমসন, যিনি রিটায়ারের পর ভারত ছেড়ে কিছুদিন ইংল্যান্ডে চলে গেলেও মন টেকেনি। ফিরে এসেছিলেন। এ দেশেই মারা যান। বাকি ছয়জনের সবাই নেটিভ। হাটখোলার দত্তবাড়ির ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্ত, চন্দননগরের এক নামী বড়োলোক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী, গোয়েন্দা তারিণীচরণরায়, আর এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, নাম ম্যানুয়েল ডিব্যাসি।”

শেষ পদবিটা শুনে অপর্ণার চমকে ওঠা মল্লিকের নজর এড়াল না। খানিক থেমে বললেন, “এর বাইরেও একজন লন্ডনবাসী ছিলেন। নাম সাইগারসন মোহেলস। ইনি সম্ভবত ভারত আর ইংল্যান্ডের মধ্যে যোগসূত্র।”

“কীসের যোগসূত্র?”

“বলব। তার আগে আরও একটা কথা জানিয়ে রাখি। টমসনের এক দেশীয় স্ত্রী ছিল। রক্ষিতা বলা চলে। নাম মঙ্গলা। মঙ্গলার গর্ভে টমসনের এক মেয়ে হয়। সেই মেয়ে পরে বিয়ে করে এক নেটিভ খ্রিস্টানকে। নাম জর্ডন অ্যাভেরি।”

এবার স্পষ্টতই অপর্ণা চমকে উঠল। “কিন্তু এই ক্লোজড নিট গ্রুপ কেন?”

“তোমার জন্য। ইন ফ্যাক্ট তোমাদের জন্য।”

“বুঝলাম না।”

“তুমি ‘প্রায়রি অফ সায়ন’-এর নাম শুনেছ?”

“হ্যাঁ। ড্যান ব্রাউন। দ্য ভিঞ্চি কোড।”

“ওটা তো টোকা বই। আসল বই ‘হোলি ব্লাড, হোলি গ্রেইল’। যাই হোক, ওইগুপ্ত সমিতির কাজ কী ছিল?”

“বলা হয়, প্রভু যিশুর ব্লাডলাইন রক্ষা করা।”

“একজ্যাক্টলি। আমাদের কাজও অনেকটা তাই। তোমাদের ব্লাডলাইন রক্ষা করা।”

“কেন? আমরা কে?”

“বলছি। আগে বলো, তুমি তো এত কিছু জানো। জ্যাক দ্য রিপারের নাম শুনেছ?”

“জানি সেই কেস। বাবা গল্প করত। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?”

“স্টিফেননাইট নামের এক ভদ্রলোক ব্রাদারহুড আর রিপার নিয়ে কিছু তথ্য জেনে ফেলায় খুন হয়েছিলেন, তাঁর কথা জানো?”

“এটাও বাবা বলেছে। রিপার নাকি আসলে রানি ভিক্টোরিয়ার লোক। ওই পাঁচজনকে খুন করা হয়, কারণ ওরা একটা ভয়ানক সত্যি জানত।”

“কী সত্যি?”

“রানির এক অবৈধ বংশধর ছিল। অ্যালিস নামে। ওরা তার খোঁজ জানত।”

“অ্যালিসের কী হল?”

“সেটা কেউ জানে না।”

“সেটা আমি তোমায় বলছি। অ্যালিসকে গোপনে ভারতে নিয়ে আসা হয়। কাউকে না জানিয়ে। শুধু এই সাতজন জানত তার আসল পরিচয়। রানির ব্লাডলাইন। নীবারের কাজ সেটাকে নষ্ট না হতে দেওয়া। আরও বুঝিয়ে বলতে হবে?”

“আমার মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। আপনি বলতে চাইছেন আমি রানির বংশধর?”

“বলতে চাইছি না। বলছি। তুমি, তোমার মা, উর্ণা। সবাই। এমনকি তোমার পেটের বাচ্চাটাও।”

“আমাদের টিকিয়ে রেখে আপনাদের কী লাভ?”

“রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক। তোমরা আমাদের তুরুপের তাস। প্রতি বছর ইংল্যান্ড এই স্ক্যান্ডেল চেপে রাখার জন্য আমাদের বিরাট অঙ্কের টাকা দেয়। একটা গোপন খাতের থেকে এই টাকার ব্যবস্থা মহারানি নিজেই মারা যাবার আগে করে দিয়ে গেছিলেন। রাজপরিবার এখনও সেটার ভরপাই করে চলেছে। আমাদের কাজ শুধু তোমাদের বাঁচিয়ে রাখা। আর বছর বছর তোমাদের বেঁচে থাকার সাক্ষ্য পাঠিয়ে যাওয়া।”

“সেটা কীভাবে?”

“আগে প্রত্যেক বছর লোক পাঠাত ওরা। নীবারের নজরদারিতে তোমাদের অজ্ঞাতে দেখে যাবার জন্য। এখন ডিএনএ স্যাম্পল পাঠাতে হয়।”

“কিন্তু আমাদের ডিএনএ স্যাম্পল আপনারা পান কীভাবে?”

“মাথার চুল, চামড়া, লালা, যে-কোনো কিছু থেকেই স্যাম্পল নেওয়া যায়। আর তোমাদের বিয়ে যাতে নীবারের সিলেক্ট করা মানুষদের সঙ্গেই হয়, সে ব্যাপারে আমরা খেয়াল রাখি। আমাদের এখানে বাইরে থেকে খুব কম সদস্য নেওয়া হয়। মূল সাতজনের পরিবারের লোক বাদে কেউ স্পার্ম ডোনেট করতে পারে না। নীবারে এই ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ আছে।”

“মানে দেবাশিস?”

“একেবারেই। আমাদের ইমপ্ল্যান্ট করা। কিন্তু ও সব হিসেব গুলিয়ে দিয়েছিল।”

“তাই দেবাশিসকে আপনারা খুন করান?”

“মোটেও না। দেবাশিসকে আমরা মারিনি। আমরা খুনোখুনি করি না। বরং উলটোটা হয়েছিল। ওর মারা যাবার কিছুদিন আগে মাস্টার খবর পান, দেবাশিস গোপনে ডার্ক ওয়েবে একটা ডিল চালাচ্ছে। তিনি ওকে ভয় দেখান, ভূত ফেরত না দিলে দেবাশিসের কিছু কীর্তি তিনি পুলিশের কাছে এক্সপোজ করে দেবেন। দেবাশিস উলটো থ্রেট দেয়। বলে, তার কাছেও বাসু আছে। সেও দেখে নেবে।”

“বাসু কে?”

“জানি না। খুব ভুল না করলে দেবাশিসের শুনি। কিন্তু দেবাশিস ছাড়া তাকে কেউ কোনও দিন দেখেনি।”

খানিক চুপ করে কী যেন ভাবলেন ডাক্তার। তারপর আবার নিজের মনেই বলতে শুরু করলেন, “আসলে সমস্যাটা শুরু হয়েছিল সুপর্ণার সময় থেকেই। সুপর্ণার সঙ্গে ফার্গাসের বিয়ে হয়। ফার্গাস ইম্পোর্টেন্ট ছিল। আমরা বাধ্য হই নতুন লোককে নিয়ে আসতে। দেয়ার কামস নিশীথ দত্ত। ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্তের দুই ছেলে। বড়োটিকে তিনি ত্যাজ্য করেন। ছোটোটির বংশধর মলয় এখনও বেঁচে আছে। বিদেশে। বড়োর বংশধর নিশীথ।”

অপর্ণা চুপ করে শুনে যায়।

“তারপরেই প্রথম সমস্যা আসে। আমরা ঠিক করেছিলাম তুমি জন্মানোর আগেই ফার্গাসের সঙ্গে সুপর্ণার ডিভোর্স করিয়ে নিশীথের সঙ্গে বিয়ে দেব। কিন্তু ফার্গাস রাজি হয় না। এই ঘরে ঢুকে সে আমায় ব্ল্যাকমেল করে। ঠিক যেভাবে তুমি আমায় করলে। নিশীথ তোমাদের বাড়ি যেত তোমায় দেখতে। জানি না তুমি কী ভাবতে। ওর ভালো আয় ছিল। ফার্গাস ফ্রিল্যান্সার। পরে সেই কাজটাও যায়। সুপর্ণা ফাইনালি ফার্গার্সকে ছেড়ে নিশীথের কাছে আসে। কিন্তু ততদিনে তুমি আর ফার্গাস এতটাই অ্যাটাচড হয়ে গেছ যে আলাদা করা গেল না। আর তোমাকে ও ইচ্ছে করেই কিছু জানায়নি।”

“মানে….” উত্তেজনায় এবার অপর্ণার গলা ধরে আসে। “মানে আমরা কী করব, কার সঙ্গে থাকব, কার বাচ্চা পেটে নেব, সবটাই আপনারা ঠিক করে। দেবেন? এটা কি মগের মুলুক পেয়েছেন?” অপর্ণার গলা চড়তে থাকে, “একটা চরম প্যাট্রিয়ার্ক সংগঠন, সে আমার জীবন ঠিক করে দেবে? এই ২০১৮ সালেও? জানেন আমি এই সব কিছু ফ্ল্যাশ করে দিতে পারি?”

“তাই? করবে? পারবে না। গঘের ছবির কথা বলেও না। আমি তোমায় এত কিছু বললাম ভয় পেয়ে না। মনে হল তোমার জানা উচিত, তাই। অ্যাভেরিকেও দয়া করে তোমার সঙ্গে থাকতে দেওয়া হয়েছে। তোমাকে একটু আগে কী বললাম ভুলে গেছ বোধহয়। তোমাদের বাঁচিয়ে রাখার প্রথম তাগিদ রাজনৈতিক, পরে অর্থনৈতিক। তোমরা কনস্ট্যান্ট ব্ল্যাকমেলিং-এর অস্ত্র। গোল্ডমাইন, বুঝলে গোল্ডমাইন। সরকারি তরফে তোমাদের কথা কেউ জানে না ভেবেছ? জানে, তবে সবাই না। একেবারে মাথারা জানেন। তাঁদের জানানো হয়। তাই চিৎকার করতেই পারো, কিন্তু সে চিৎকার এই ঘরের বাইরে বেরুবে না। মাস্টারের ক্ষমতা আর নীবারের পয়সা নিয়ে তোমার কোনও ধারণাই নেই। নাথিং। শুধু বিরূপাক্ষ বুঝতে পারেনি। চিরকাল ছেলেকে নীবারের বাইরে রেখে গেছে। কী লাভ হল? দেবাশিস মরার আগে সেই তো ওর ছেলেকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেল।”

“দেবাশিসের কথাই যখন উঠল, আপনারা জেনেশুনে ওইরকম একটা লোকের হাতে আমায় তুলে দিলেন?”

“শিট হ্যাপেনস। আমাদের আবার ভুল হয়েছিল। দেবাশিসের যে একটা টুইস্টেড সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশান আছে, সেটা আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা পরে শুনি। শুনেই ব্যবস্থা নিয়েছি।”

“কী ব্যবস্থা নিয়েছেন শুনি? আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, আমার সঙ্গে… আপনি জানেন আমার পেটের এই বাচ্চাটা কার?”

“জানি বোধহয়। ইন ফ্যাক্ট জানি বলেই পরের সমস্যাগুলো হয়েছে। দেবাশিসকে মাস্টার বাধ্য করেন ওই কাজ করতে। আমাদের দরকার ছিল সন্তান। তোমার সন্তান। তাই রিস্ক নেওয়া যাচ্ছিল না।”

“আর তা বলে অজ্ঞাতকুলশীল একজনের সঙ্গে…”

“অজ্ঞাতকুলশীল না একেবারেই। খুবই ভালো বংশের ছেলে। নীবার নিয়োগের আগে অনেক ভেবে নেয়। কিন্তু দুবার ভুল হওয়াতে আমরা নিশ্চিত না হয়ে পারিনি। দেবাশিসের অনিচ্ছাতেও ঘটনাটা ঘটানো হয়। যে করেছিল, ও তার নাম বলেনি মাস্টারের ভয়ে। কিন্তু আমি যতদূর জানি তোমাকে একটা ভিডিও দেখিয়েছিল ও। তাই তো?”

উপরে নিচে মাথা নাড়ল অপর্ণা

“ওটা তোমাকে দেখানোর কথা না। আমাদের পাঠানোর কথা। কাজটা ঠিকঠাক হল কি না প্রমাণ রাখতে। কিন্তু দেবাশিস তোমায় ক্লু দিতে চেয়েছিল। তোমাকে ওই ভিডিও দেখানোর অপরাধে নীবার থেকে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। যাবার আগে বলেছিল দেখে নেবে। আমাদের অস্ত্রেই আমাদের বিনাশ করবে। ওর একটা গ্যাং আছে। খবর পেয়েছি তারা নাকি রেডি হচ্ছে। ওদের হোয়ার অ্যাবাউটস এখনও জানতে পারিনি। তাই মাস্টারের কথায় তোমাকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। যতদিন না তোমার ডেলিভারি হয়, তুমি এখানেই থাকবে।”

“বন্দি?”

“ওভাবে ভেবো না। ভাবো রানির মতো।”

“আর ওরা? মা? ঊর্ণা?”

“উর্ণার ক্ষেত্রে এ সমস্যা নেই। রাজবংশে জ্যেষ্ঠ সন্তান আর তার জ্যেষ্ঠ সন্তানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। জানো নিশ্চয়ই।”

“মানে আমার মেয়ে হলে তাকেও…”

“হলেও না। মেয়েই হবে”, ইউএসজি রিপোর্ট তুলে দেখালেন ডাক্তার মল্লিক, “তুমি আপসেট হোয়ো না অপর্ণা। সিস্টেমের সঙ্গে মানিয়ে নাও। বিলেতেও রানিরা কি কখনও স্বাধীন হয়? দেশের দশের জন্যে এটা একটা স্যাক্রিফাইস করছ ভেবে নাও।”

অপর্ণার দুচোখ বেয়ে জল পড়ছিল। কোনওমতে শুধু জিজ্ঞাসা করল, “মাস্টার কে?”

“সরি। এটা বলা যাবে না। টপ সিক্রেট। তবে বলি মাস্টারের হাত অনেক দূর লম্বা। ধরতে চেয়ো না। বোকামো করবে।”

“আর বাচ্চার বাবা?”

“তুমি সত্যিই জানো না? তুমি তো ভিডিওটা দেখেছিলে!”

“মন দিয়ে দেখিনি। প্রবৃত্তি হয়নি।”

“তুমি আমার মেয়ের মতো। তবু বলব আর-একবার মন দিয়ে দ্যাখো। চিনতে পারবে হয়তো। এখন আর দেখালে ক্ষতি নেই। সব তো জেনেই গেছ”, বলে মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলেন ডাক্তার মল্লিক।

অপর্ণার দেখার ইচ্ছে ছিল না। তবু এবার তাকে দেখতেই হবে। ঝাপসা চোখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েরইল সে। পুরুষদেহটা তখন চেনেনি। এখন চেনা চেনা লাগছে। ক্যামেরা একটু উপরে উঠে কাঁধের কাছে যেতেই কালো জডুলটা স্পষ্ট দেখতে পেল অপর্ণা। যদিও এক ঝলকের জন্য। এই দেহ, এই মানুষ তার অতি চেনা। চারিদিকের সবকিছু, সব ভালোবাসা, সব বিশ্বাস, আস্থা মিলেমিশে বিরাট এক ধোঁকায় পরিণত হল এক লহমায়।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠল অপর্ণা। জানে না এরপর কী নিয়ে বেঁচে থাকবে। টেবিলে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতেই শুনতে পেল দরজা দিয়ে কেউ ঢুকছে আর মল্লিক তাকে বলছে, “এবার তুমি ওকে সামলাও। খুব আপসেট হয়ে গেছে। আসলে তোমার সঙ্গে কানেকশানটা আইডিয়া করতে পারেনি বোধহয়।”

অপর্ণা বুঝতে পারল আগন্তুক তার দিকে এগোচ্ছে। সে গোটা শরীর শক্ত করে রইল। তার একেবারে কাছে এসে আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখল ভূদেব মুখুজ্যের চন্দননগরের বন্ধু সুরেশ বাঁড়জ্যের প্রপৌত্র সুতনু ব্যানার্জি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *