সপ্তম পর্ব— উন্মেষ
“তোমার কাছে এই ডিরেক্টর এল কেমন করে?” সাইগারসন জিজ্ঞাসা করলেন।
“আজ্ঞে, আপনি চিনেছেন? এ জিনিস আমার না। এই অফিস প্রায় নিজের হাতে ড্রিসকল সাহেব বানিয়ে দিয়েছেন। যা দেখছেন, সব ওঁরই দেওয়া।”
“এ বড়ো সাধারণ জিনিস না হে তারিণী। বিলেতেও এ জিনিস খুব কমই আছে। সাবধানে রাখবে। যত্নে রাখবে। আর এটা খুলতে জানো তো?”
তারিণী অবাক। ডিরেক্টরকে যে খোলা যায় সেটা তার ধারণারই বাইরে। সাইগারসন একগাল হেসে ডিরেক্টরের সামনে ঝুঁকে একটা ছোট্ট বোতামে চাপ দিলেন। ডালা খুলে এল। ভিতরে ফাঁকা।
“এককালে গোপন কিছু লুকিয়ে রাখতে এ জিনিসের জুড়ি ছিল না। এখন পাওয়াই যায় না। কিছুদিন বাদে তো লোকে নামও জানবে না। যাই হোক, তুমি কী কী জানলে বলো…”
গতকাল সারারাত গির্জায় ঘণ্টা বেজেছে। আজ নতুন বছরের প্রথম দিন। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একতলার বিরাট হলঘরটাকে পৃথিবীর সব দেশের পতাকা দিয়ে সাজানো হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘হল অফ অল নেশনস’। আজ এখানে মজুত থাকবে নানা খাদ্য আর পানীয়। সাহেবরা তাঁদের মেমসাহেবদের নিয়ে সেখানে এসে নতুন বছর উদযাপন করতে পারবেন। শোনা যায় সেখানে নাকি সাহেবরা এদেশীয়দের মতো কোলাকুলিও করেন। দেশীয় মানুষদের এই অনুষ্ঠানে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। তাই সত্যি মিথ্যে বলা মুশকিল। সবচেয়ে বড়ো ভোজ আজ বড়োলাটের প্রাসাদে। কলকাতার পাশাপাশি সুবে বাংলার বহু জায়গার রাজকর্মচারী আর সেনাকর্তারা এতে নিমন্ত্রিত। উৎসব শুরু হবে ব্রেকফাস্ট দিয়ে আর শেষ হবে ডিনার আর বলড্যান্সের পরে। অপেরা, থিয়েটার, বোট রেস, পিকনিক, ক্রিকেট, সব কিছুই আজ খোলা। আর আছে ঘোড়দৌড়। দৌড় হবে এলেনবরা কোর্স, খিদিরপুরের আখড়ার মাঠে, আর রেসকোর্সে। আজ সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেছে তারিণীর। সেই কাকভোরে একদল ধর্মপ্রাণ বাঙালি খ্রিস্টান খোল কর্তাল নিয়ে নগর পরিক্রমা করছিল। ধর্ম বদলালেও স্বভাব যাবে কোথায়? জানলা দিয়ে সবে আলো আসছে। তারিণী দেখল তার ভীষণ কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। এমনিতে নিজের লাল ডায়রিতেই সে কবিতা লেখে, কিন্তু সে ডায়রি তো আজকাল রোজনামচা লিখতেই ভরে যাচ্ছে। টেবিলে মোটা একটা ফাইল পড়ে আছে। এটা ড্রিসকল সাহেবের থেকে আনা। নানা টুকিটাকি কাজের জিনিসপত্র, হিসাব কিতাব। তারিণী তারই একটা তালিকা বার করে পিছনে কবিতা লিখতে শুরু করল, “আমরা পুরুষ, নীরস অতি/ নহি অধিকারী সুখে…” চার লাইন লিখতে না লিখতে না লিখতে দরজায় টোকা। তারিণী অবাক। এত সকালে কে এল! খুলে দেখল প্রিয়নাথ দারোগা আর সাইগারসন সাহেব হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। সাহেব সহবত জানেন। টুপি খুলে “গুড মর্নিং অ্যান্ড ভেরি হ্যাপি নিউ ইয়ার” বললেন। প্রিয়নাথ শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে হাসল। তারিণী দুজনকেই ঘরের ভিতরে নিয়ে এল। ঢুকেই আজ সাহেবের নজর পড়ল ডিরেক্টরের দিকে।
ডিরেক্টরের গোপন কুঠুরি দেখিয়ে সাহেব নিজের জায়গায় বসেই বললেন, “এখন বলুন, রাখহরির কী সংবাদ পেলেন?”
‘রাখহরি সম্ভবত আর বেঁচে নেই’, বলে তারিণী সব বলল। সোনাগাজির সেই বাড়ি, পাগলের আস্তানা, পেট চেরা ভেড়ারা, ময়নার নিরুদ্দেশ, কার্টারের আনাগোনা, নবীনচন্দ্রের চিঠি, ফ্রি ম্যাসনদের সভায় শোনা ব্রাদার পলের পাগলামোর কাহিনি, এমনকি মরার দিন নবীনকে বলা কার্টারের শেষ কথাগুলোও। প্রিয়নাথ দেখতে পেল শুনতে শুনতে সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যাচ্ছে। তারিণী বলা শেষ করতেই প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন সাহেব, “বাই জোভ! তুমি তো কেসটা প্রায় সলভই করে দিয়েছ হে! গল্পটা এতদিনে পরিষ্কার হয়ে এসেছে। আর ছোট্ট একটা জট খোলা বাকি। সেটাও খুলে যাবে, চিন্তা নেই। বিলেতে তোমার মতো একখানা গোয়েন্দা জন্মালে আমার আর পসার হত না। ওয়েল ডান।”
তারিণী আর প্রিয়নাথ দুজনেই ফ্যালফ্যাল করে সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা গোটা ব্যাপারের আগাপাশতলা কিছুই বুঝতে পারছিল না। সাহেব বোধহয় সেটা ধরতে পারলেন। একটু হেসে পাইপ ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, “আমি যতটা বুঝেছি, গল্পটা নিজের মতো বলছি। ছোটোখাটো কিছু পয়েন্ট এদিক-ওদিক হতেই পারে। কিন্তু এই একটামাত্র গল্প, যাতে জিগস পাজলের মতো সবকটা ঘটনা একেবারে নিখুঁতভাবে মিলে যায়।
এই গোটা কেসে দুটো দিন। তিনটে মৃত্যু। একটা গত ১২ ডিসেম্বর, চিনা পাড়ায় বড়োলাটের পাগল খুড়তুতো ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেল। অন্যটা ঠিক তার পাঁচদিন পরে। ১৭ তারিখ। করিন্থিয়ান হলে। মারা গেলেন দুই ম্যাজিশিয়ান। কার্টার আর চিন-সু-লিন। আমি ওঁদের মঞ্চের নামই বলছি।
প্রথম মৃত্যুটা সবচেয়ে চমকে দেবার মতো। বড়োলাটের বাড়িতে তাঁর ভাই থাকতেন। সেখানে যথেষ্ট কড়া পাহারা। সেই দুর্ভেদ্য লাটভবন থেকে একটা সুতো বার করে নিয়ে আসা মুশকিল, একটা মানুষ তো দূরের কথা। তাহলে যুক্তি আসে, পল নিজেই বেরিয়েছিলেন, অথবা তাঁকে বের করে আনা হয়েছিল। আমি শুরুতে প্রথমটাই ভেবেছিলাম, কারণ আমি জানতাম না পল পাগল ছিলেন আর বেশ কিছুদিন ভবানীপুরের পাগলা গারদেও তাঁকে ভরতি করে রাখা হয়েছিল। তারিণী খবরটা জানতে পেরেছে। সঙ্গে ও এটাও বলল, ভবানীপুর থেকে পলকে ছাড়িয়ে আনা হয়। কেন? উত্তরটা বোধহয় কোনও দিনই পেতাম না, যদি না আমরা ডালান্ডা হাউস যেতাম আর গোপালচন্দ্রের লেকচার শুনতাম।”
তারিণীর বিস্ময় বাড়ছে। সে হতবাক হয়ে বলল, “আপনি কী বলছেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না সাহেব!”
“বুঝিয়ে বলছি। গতকাল লেকচারে যা বুঝলাম, পাগলদের চিকিৎসায় দুটো পদ্ধতি আছে। একটা আইনি, যাতে খুলি ফুটো করে মাথার কিছু জায়গা খালি করে দেয় বা মগজের আক্রান্ত অংশকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এতে রোগী একেবারে গোরুর মতো শান্ত হয়ে যায়। কিংবা সারাজীবন জড়ভরত হয়ে কাটায়। বিশেষত যারা খুব দুর্দান্ত পাগল, বা খুনের প্রবণতা আছে, তাদের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা কার্যকরী। তবে যাই হোক, দিনের শেষে বড্ড নৃশংস। জানি না, কোনও দিন অন্য কোনও চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার হবে কি না, যাতে অনেক কম বেদনায় রোগীর চিকিৎসা করা যাবে।
ঠিক এখানেই এল দুই নম্বর পদ্ধতি। বহু বছর ধরে বেশ কিছু ডাক্তার লন্ডনে চেষ্টা করছিলেন সেটা। কিন্তু এতে রোগীর মৃত্যুর হার এত বেশি যে রানি নিজে আইন করে সেটা বন্ধ করে দেন।”
“সেটা কী?”
“ব্লাড ট্রান্সফিউশান। রক্ত বদলে দেওয়া। উন্মাদ মানুষের রক্ত বদল করে কিছুটাও যদি অন্য সুস্থ মানুষের রক্ত, এমনকি শান্ত কোনও পশু, যেমন ভেড়ার রক্ত পুরে দেওয়া হয়, তাহলে নাকি রোগীর পাগলামো অনেক কমে। লন্ডনে থাকতে এর কথা আমার কানে এসেছিল। কাল শুনে নিশ্চিত হলাম।”
“কিন্তু এভাবে কি পাগলামো কমানো যায়?” এবার প্রিয়নাথ প্রশ্ন করল।
“সেটা কে বলবে? বিজ্ঞানের কাজ নতুন নতুন উপায়ের সন্ধান করা। কাল তো শুনলেন, গোপালচন্দ্র বললেন, একজন মানুষের রক্ত একেবারে তার নিজস্ব। একজনের রক্ত অন্যকে দিলে সে মারা যাবেই। এদিকে যাঁরা এই রক্ত বিনিময়ের পক্ষে, তাঁরাও এমন অনেক উদাহরণ দেখিয়েছেন যেখানে একজনের রক্ত অন্যজনকে দিলেও সে বেঁচে থাকে। সত্যি এই দুটোর মধ্যে কোথাও একটা লুকিয়ে, যতদিন না জানব কিচ্ছু বলা যাবে না।”
“কিন্তু যেটা বলছিলেন…” তারিণী ধরিয়ে দিল।
“ও হ্যাঁ। কার্টার মানে হ্যারির মা ছিল পতিতা। কুমারী বয়সে জর্জের সঙ্গে সম্পর্কে হ্যারির জন্ম। কিন্তু জর্জ তার বাবার বয়সি। শার্লি কোনও দিন তার আর জর্জের সম্পর্ক স্বীকার করেনি। তবে আমার ধারণা, হ্যারি আঁচ পেয়েছিল। সে জর্জকে ভালোবাসত। আর ভালোবাসত তার মাকে। সৎ বাবা লিন্ডসে ছিল লম্পট। তাকে মারত, শার্লিকে মারত। হ্যারির মনে রাগ জমছিল। কিন্তু সেই রাগের বারুদে আগুন ধরানোর কেউ ছিল না। সেই আগুনটাই ধরাল রিচার্ড এসে। রিচার্ডও হ্যারির অবৈধ ছেলে। মায়ের কাছে মানুষ। মাকে ভালোবাসাই স্বাভাবিক। মা খুন হবার পরে যখন সে দেখল তার বাবা লোকটি নিশ্চিন্তে অন্য মহিলার সঙ্গে সংসার পেতেছে, তখন সে ঠিক করল লিন্ডসের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। কিন্তু নিজের হাতে লিন্ডসেকে খুন করার যে শক্তি বা সাহস কোনোটাই তার ছিল না। ফলে তাকে একজন হাতিয়ার খুঁজতে হল। শার্লির ছোটো ছেলে উইগিন্স তখন খুব ছোটো, কিন্তু হ্যারি তাগড়াই, বলশালী। লিন্ডসেকে সহ্য করতে পারে না। রিচার্ড তার হাতিয়ার পেয়ে গেল। হোয়াইট চ্যাপেলের আশেপাশেই কিছু চিনা বস্তি আছে। সেখানেই খুব সম্ভব রিচার্ড গংসিদের সংস্পর্শে আসে। এরা মারাত্মক হিংস্র দল। কাউকে খুন করতে পিছপা হয় না। হ্যারিও এদের দলে যোগ দিয়েছিল। মুশকিল হল, দলে যোগ দেওয়া কঠিন, আরও কঠিন বেরিয়ে আসা। এটা হ্যারি বুঝতে পারেনি। গংসিদের সাহায্য নিয়ে সে লিন্ডসেকে খুন করল। শুধু খুন না, গংসিরা খুনের যে বিশেষ পদ্ধতিতে নিজের স্বাক্ষর রেখে যেত, সেই পদ্ধতিতে। লন্ডন পুলিশ ভাবল, কোনও চিনা দল খুন করেছে। হ্যারি শান্তি পেল। ভাবল আর চিন্তা নেই। কিন্তু দুটো ঘটনা ঘটল, যা সে ভাবতেও পারেনি। এক, শার্লি পাগল হয়ে গেল। জানি না, সে বুঝেছিল কি না যে তার ছেলেই এই খুন করেছে। আর দুই, হ্যারি কিছুতে ভয় পেল। যদি আমার অনুমান সত্যি হয়, তবে গংসিরা তাকে আরও খুনের বরাত দিতে লাগল। কিন্তু সে তো খুনি না। যা করেছে রাগে করেছে। শার্লিকে বেডলামে ভরতি করে সে গা ঢাকা দিল। চলে গেল ফ্রান্সে। রবার্ট হুডিনির শিষ্য হল। হুডিনি মারা গেলে হ্যারি নতুন নাম নিল কার্টার। এই নামেই সে ম্যাজিক দেখাতে লাগল।
একসময় তার মনে হল লন্ডনে ফিরে আসা উচিত। পুলিশ বা গংসি তাকে এতদিনে ভুলে গেছে। সে লন্ডনে ফিরে এল। বেডলামে এল মাকে দেখতে, আর যাকে কোনও দিন দেখতে চায়নি, সেই রিচার্ড হ্যালিডেকে দেখল মায়ের চিকিৎসক হিসেবে। কার্টারকে দেখামাত্র সে চিনতে পারল। রিচার্ড বুদ্ধিমান আর ধুরন্ধর ছেলে। ডাক্তারের অ্যাপোথেকারিতে কাজ করতে করতে নিজের মেধাতেই ডাক্তার হয়ে গেছে। পাগলের ডাক্তার। কিন্তু যার রক্তে বেআইনি কাজ করার নেশা, সে কি আর সোজা পথে চলতে পারে? রক্ত পরিবর্তনের যে পদ্ধতি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তাতেই তার আগ্রহ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সে আর তার দলবল গোপনে বেডলামে কিছু রোগীর ওপর পরীক্ষাও চালাতে লাগল। হতে পারে শার্লিও তাদের একজন।
এদিকে ভারতে অন্য কাহিনি ঘটছে। ল্যান্সডাউন বড়োলাট হয়ে ভারতে এলেন। সঙ্গে তাঁর প্রিয় ভাই। সেই ভাই হাসিখুশি, সবাই তাকে ভালোবাসে, একদিন হঠাৎ করে পাগল হয়ে গেল। বড়োলাট বেশ কিছুদিন চেষ্টা করলেন ব্যাপারটা চাপা দিতে। তারপর ভবানীপুরে ভরতিও করলেন। এমনিতে যখন কাজ হল না, ডাক্তার বললেন খুলি ফুটো করতে হবে। প্রিয় ভাইয়ের ওপরে এই নৃশংস চিকিৎসা বেঁচে থাকতে হতে দেবেন না তিনি। তাই ভাইকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। ভাইয়ের পাগলামো বাড়তে লাগল। ঠিক এখানেই কেউ, আমি জানি না, ডাক্তার মার্টিন বা ডাক্তার উইলসন বা অন্য কেউ তাঁকে ব্লাড ট্রান্সফিউশানের কথা বললেন। হাতে সরু একটা নল লাগিয়ে অন্য মানুষের রক্ত বা পশুর রক্ত পুরে দেওয়া। অনেক কম কষ্টকর। বড়োলাট রাজি হলেন। কিন্তু যেখানে ব্রিটিশ সরকার নিজে এই পদ্ধতিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন, সেখানে সেই সরকারের একেবারে উপরে থাকা একজন মানুষ কীভাবে এই তথাকথিত অপবিজ্ঞানের চর্চা করবেন?
ঠিক হল গোটা ব্যাপারটা হবে ম্যাজিক শো-র আড়ালে। যখন ম্যাজিশিয়ান মঞ্চে ম্যাজিক দেখাবেন, সেই ম্যাজিকের আড়ালে হবে আসল ম্যাজিক। বড়োলাটের ভাই সুস্থ হয়ে উঠবেন। বেডলাম থেকে বাছা হল রিচার্ডকে। কিংবা সে নিজেই উদ্যোগী হল। হাজার হোক বড়োলাটের ভাই। কাজটা সফল হলে টাকা, সম্মান দুই-ই পাবে। আর ম্যাজিকের ধোঁকার টাটিটার জন্য দরকার হল কার্টারকে। কার্টার হয়তো প্রথমে রাজি হয়নি। কিন্তু একে শার্লি তখন বেডলামে রিচার্ডের অধীনে, আর দুই, গংসির দল আজও লন্ডনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কার্টারকে ব্ল্যাকমেল করা কঠিন হল না। যাতে রিচার্ডের আসল পরিচয় কেউ না জানে, তাই বুড়ো জর্জ বাদে সবাইকে সরিয়ে নতুন দল নেওয়া হল। জর্জকে খুব সম্ভব কার্টারই রাখতে অনুরোধ করেছিল। ভারতে যাত্রার ঠিক আগের দিন আমার দাদার কাছে খবর আসে। উনি কিছু একটা আঁচ করেছিলেন। এদিকে ডালান্ডা হাউসের পাগলদের সংখ্যা কমছিল ক্রমাগত। টমসন দাদাকে জানান। আমারও গা ঢাকা দেবার দরকার ছিল। নাম বদলে আমাকেও দলে ভিড়িয়ে দেওয়া হল।”
“কেউ কিছু আপত্তি করেনি?”
“আপত্তির লোক ছিল একজনই। রিচার্ড। ওকে বলা হয়েছিল আমি এক দাগি অপরাধী, পালানোর সুযোগ খুঁজছি। এতেও যদি কিছুমাত্র আপত্তি থাকত, যে একশো পাউন্ডের থলেটা ওকে দেওয়া হয়েছিল, তারপর আর কোনও আপত্তি করেনি। এখানে এসে আমি বুঝতে পারি কিছু একটা সমস্যা আছে। কার্টার আর রিচার্ড দলের কারও সঙ্গে মেশে না। প্রায়ই কোথায় বেরিয়ে যায়, ফেরে না। তারিণীর অনুসন্ধানে এখন সেটা বোঝা গেছে। কেন ডালান্ডা হাউস থেকে পাগল উধাও হয়ে যাচ্ছিল, আর তারা যাচ্ছিল কোথায়?”
“কোথায়?” প্রশ্ন করল প্রিয়নাথ।
“আপনি এখনও বুঝতে পারেননি অফিসার মুখার্জি? সোনাগাছির সেই বাড়ি কোনও সাধারণ বেশ্যালয় না। ওটা একটা পরীক্ষাগার। ডালান্ডা হাউস থেকে পাগলদের এনে তাদের গায়ে বিভিন্ন পশু আর মানুষের রক্ত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হত। একেবারে শুরুতেই বড়োলাটের ভাইয়ের ওপরে পরীক্ষার আগে বড়োলাট নিশ্চিত হতে চাইছিলেন পদ্ধতিটা ফুলপ্রুফ কি না। পাগলদের দেখাশোনার জন্য ময়নাকে রাখা হয়েছিল। ওই বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হত না। আর বাড়ির সামনে প্রায়ই রক্তশূন্য পশুদের পাওয়া যেত।”
“সেই পাগলরা কোথায়?” তারিণী বললে।
“পরীক্ষাগারে খরগোশদের ওপরে পরীক্ষা শেষ হলে সেই খরগোশদের কী করা হয় জানো তারিণী?”
তারিণী মাথা নাড়ল।
“কেটে পুঁতে দেওয়া হয়। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, যতদূর মনে হয় বড়োলাট আশ্বস্ত হন। ১২ ডিসেম্বর সকালে গোপনে লাটভবন থেকে পলকে বার করে এনে দুপুর নাগাদ অপারেশান শুরু হয়। ঠিক এখানে কিছু গণ্ডগোল হয়। কী গণ্ডগোল, তা আমার জানা নেই। আমি লাশ দেখেছি। আমার মনে হয়েছে অতিরিক্ত ক্লোরোফর্মের ব্যবহার হয়েছিল সেদিন। সঙ্গে রক্তমোক্ষণ শুরু করে দেওয়া হয়েছিল হাত থেকে। রক্তচাপ দ্রুত কমে গিয়ে অপারেশন টেবিলেই রোগী মারা যায়।”
“তাহলে এটা তো….”
“একেবারেই তাই। পিওর অ্যান্ড সিম্পল দুর্ঘটনা। অপারেশন টেবিলে যেটা হয়েই থাকে।”
“তাহলে একে এইরকম রূপ দেবার কারণ?”
“কারণ একটাই। বড়ো আঘাত ছোটো আঘাতকে ঢাকে। হাতে শিরায় যে ছিদ্রটা ছিল সেটাকে লুকানোর প্রয়োজন ছিল। তা না হলে যে কেউ বুঝে যেত ব্লাড ট্রান্সফিউশান করা হয়েছে। অন্তত ডাঃ মার্টিন বা ডাঃ গোপালচন্দ্রের মতো অভিজ্ঞ লোক তো বুঝতেই পারতেন। তাই গোটা দেহকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হল। তাও গংসিদের পদ্ধতিতে। বুকে এঁকে দেওয়া হল চিহ্ন। ভেড়ার রক্তে। আমি তো আগেই বলেছিলাম, ও রক্ত মানুষের না।
তারপর কুয়াশা আর অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে দেহ রেখে আসা হল চিনা পাড়ায়। যাতে একটু তদন্ত করলেই লোকে ভাবে এটা গংসিদের কাজ। তা না হলে এই বেআইনি কাজে বড়োলাট সহ সবার ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা!”
“এ তো ঠান্ডা মাথায় খুন!” প্রিয়নাথ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
“খুন না। দুর্ঘটনাকে চাপা দেবার চেষ্টা। খুনের রূপ দিয়ে। শুধু একজন মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি।”
“কে?”
“কার্টার। তার বিবেক বলছিল কিছু একটা ভুল হচ্ছে। তাই সে নেমে এসেছিল। কোন এক ফাঁকে খবরটা লিখে একটা চিঠিতে পুরে দিয়েছিল, যাতে অন্তত সংবাদপত্রে খবরটা আসে। তা না হলে তো এত কিছু হতই না।”
“কিন্তু কার্টার আর চিন-সু-লিন, মানে রিচার্ড মরল কীভাবে?”
“একটা আন্দাজ করেছি। সঠিক জানি না। আজকেই জেনে যাব। সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে আপনারাও যাবেন। মি. টমসনের নিমন্ত্রণ আছে। তাঁর সঙ্গে আমরাও যাব অনাহূত হয়ে।”
“কোথায়?”
“নিউ ইয়ারের ভোজসভায়। স্বয়ং বড়োলাটের প্রাসাদে।”