পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

সপ্তম পরিচ্ছেদ— হামচুপামুহাফ

সপ্তম পরিচ্ছেদ— হামচুপামুহাফ

অধীশদার বাড়িতে কফি, শিঙাড়া খেয়ে বেরোতে বেরোতে দেরি হয়ে গেল। অধীশদা

প্রথমে বইটা রেখে দিতে চাইছিলেন, পরে কী যেন ভেবে বললেন “বাদ দাও। মোবাইলে ছবি

তুলে নিচ্ছি।” বেরিয়েই উর্ণার একগাল হাসি। বাংলায় যাকে বলে ‘হাইক্লাস’। “দেখলে তো? একদম খোদ জায়গায় নিয়ে এসেছি। ঘামি আগেই জানতাম, যদি কেউ পারে তো অধীশদাই পারবেন।”

“সে তো ঠিকই, কিন্তু আসল খটকাটা রয়ে গেল। এই নাটক পো-র বইয়ের ভিতরে গেল কীভাবে? আসল বইটাই বা কোথায়? শৈলচরণের সঙ্গে তারিণীর সম্পর্ক কী? শৈলচরণের খুনের যা বর্ণনা শুনলাম তা প্রায় পুরোটাই দেবাশিসদার খুনের মতো। একশো বছরের ব্যবধানে দুজন

মানুষ একইভাবে খুন হয় কীভাবে? এটা কি কাকতালীয়? না ইচ্ছে করে এমন কেউ করছে, যে আগের খুনটা বিষয়ে সব জানে?” উর্ণা গম্ভীর মুখে আমার কথা শুনতে শুনতেই হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল, “এই রে, সাড়ে আটটা বেজে গেছে! শিগগির বাড়ি যাই। টিউশানে যাব বলে বেরিয়েছি। আর দেরি হলে বাবা আমার পিঠের ছাল ছাড়াবে। তুমি গঙ্গার ধারে বসে বসে এসব ভাবো। এক ঘণ্টার আগে বাড়ি ঢুকো না।”

“তুমি বাড়ি ফিরবে কীসে?”

“চাপ নেই, ট্যাক্সি পেয়ে যাব।”

“পৌঁছে ফোন করবে?”

“না না। ইমপসিবল। “

মুচকি হেসে বললাম, “বাইকে করে একটা লিফট দিয়ে দিই?”

“আগে তো একটা সিট তো লাগাও বাইকের পিছনে, তারপর বড়বড় কথা বলবে” বলে উর্ণা ভুরু কুঁচকে এমন রাগি রাগি লুক দিল যে আর কিছু বলা সাহস পেলাম না। আমি বাইক ঘুরিয়ে সোজা গঙ্গার দিকে। অধীশদার বাড়ির একটু দূরেই ছোটেলাল ঘাট। আসল নাম নাকি ছোট্টলাল দুর্গাপ্রসাদ ঘাট। সামনে সরু রাস্তা, ঘিঞ্জি দোকান পেরিয়ে ঘাটের লাল বাড়ি। এখন ঘাটের ভিড় অনেকটা কম। কিছু মানুষ এদিক ওদিক বসে আছেন। জলে তিন-চারটে নৌকা উলটো দিকেই হাওড়া স্টেশন। হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গেলাম। জেটির ধারে। এখানে জল বেশ গভীর। কেউ পড়ে গেলে আর দেখতে হবে না। জেটিতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে থাকতে একটা কথা মনে হল। একশো বছর আগে তারিণীর বন্ধু শৈলচরণের খুন আর আমার বন্ধু দেবাশিসদার খুনে অদ্ভুত মিল। শৈল থাকতেন চুঁচুড়া, দেবাশিসদা চন্দননগর। দুজনেই সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত, পড়াশুনো করা মানুষ। এদিকে আমি আর তারিণীচরণ দুজনেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ। অবাস্তব শুনতে লাগলেও মনে হচ্ছে কেউ একজন সেই খুন সম্পর্কে জেনে আবার সেটাকে রিক্রিয়েট করছে। আমাকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে সেটা সমাধানের। কিন্তু তারিণী কি শৈলবাবুর মৃত্যুরহস্য সমাধান করেছিল? জানার উপায় তখনকার পত্রপত্রিকা। অধীশদাই তো বললেন বেশ হইচই হয়েছিল সেসব নিয়ে। আর কোথায় পেতে পারি? ভাবতেই চমকে উঠলাম। আরে! ব্লু তো দেবাশিসদাই আমায় দিয়ে গেছেন। মারা যাবার ঠিক আগে। “প্রিয়নাথের শেষ হাড়” আর “তারিণীর ছেঁড়া খাতা।”

এই হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই দুজনের যোগ ছিল। আমি নিশ্চিত। দুজনেই লিখতে ভালোবাসতেন। এত বড়ো ঘটনার কথা লিখে যাবেন না তা হতেই পারে না। কিন্তু দুটোকেই কেউ হাপিস করে দিয়েছে। প্রিয়নাথের লেখাটা আর্কাইভ থেকে দেবাশিসদা চুরি করে নিয়ে এসেছিলেন, যদিও অফিসার মুখার্জি জানিয়েছেন তিনি দেবাশিসদার ঘরে সেটা পাননি। তবে কি প্রিয়নাথের লেখাতে তারিণীর কথা ছিল? সেখান থেকেই তিনি ক্লাইভ স্ট্রিটের অফিসের  খোঁজ পেয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন? আমাকে দেবাশিসদা বারবার বলতেন আমার জন্যেই তিনি অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু কেন? শৈলর মৃত্যুর ডিটেইলস খুব সম্ভব তাঁর জানা ছিল। তার পরেও ঠিক একইভাবে তিনি নিজেই খুন হয়ে গেলেন। এই ব্যাপারটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকছিল না। এদিকে শুনছি অফিসার মুখার্জিও দারুণ ভয়ে আছেন। দেবাশিসদার মৃত্যুর পরে আমাদের দুইজনের কাছে দুটো জিনিস আসে। আমার কাছে সেই ছড়া আর ওঁর কাছে কাটা অণ্ডকোশ। এই ঘটনা দুটো কি বিচ্ছিন্ন? না পরস্পরের সঙ্গে জড়িত? উনি বলছেন কারা নাকি তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে। বাড়িতে চৈনিক চিহ্নযুক্ত চিঠি আসছে। যে বা যারাই এই খেলাটা খেলুক না কেন, খেলার দুই বোড়ে আমরা দুইজন। ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেল। রাত বাড়ছে। একঘণ্টার অনেক বেশি হয়ে গেছে। এবার বাড়ি ফেরা যাক। গলিতে ঢোকার মুখেই পুলিশের গাড়িটা দেখে কেমন একটা সন্দেহ হল। উর্ণাদের বাড়ির একটু দূরে দাঁড়ানো সাদা এসইউভি-টার নম্বর আমার চেনা। দিন পনেরো আগে এতে চড়েই চন্দননগরে দেবাশিসদার বাড়ি যেতে হয়েছিল। কিন্তু এ গাড়ি আবার এখানে কেন? আবার কী হল? গাড়ির পাশেই অমিতাভ মুখার্জি দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমায় দেখে হাত নেড়ে দাঁড়াতে বললেন।

“একঘণ্টা ধরে ফোন করছি। ধরছ না কেন?”

এই রে! অধীশদার বাড়ি ঢুকে মোবাইল সাইলেন্ট করেছিলাম। আর অন করা হয়নি।

মিথ্যে বললাম, “চাপ পড়ে সাইলেন্ট হয়ে গেছে। খেয়াল করিনি।”  

“সে কী! অ্যান্ড্রয়েড ফোনও আজকাল চাপ পড়ে সাইলেন্ট হয়ে যাচ্ছে! যাই হোক, তোমার বাড়ির মালিক বলল যাবে আর কোথায়, রাতে তো বাড়িতেই ফিরবে, তাই দাঁড়িয়ে আছি। তোমার অফিসেও গেছিলাম। তালাবন্ধ।”  

“আমি আর নতুন কোনও খবর পাইনি স্যার। পেলে আপনাকে অবশ্যই জানাব।”

“আমি তোমায় নতুন খবর দিচ্ছি। অন্য একটা কেসে আবার তোমার নাম উঠে এসেছে। এখন এসেছি সেটার এনকোয়ারি করতেই।”

“কী কেস?” আমি তো অবাক।

“বিশ্বজিৎ দে নামে কাউকে চেনো?”

“বিশ্বজিৎ দে? না তো… মনে পড়ছে না। কে বলুন তো?”  

“বড়বাজারে শাড়ির দোকানে কাজ করে। চেনো?”  

“ওহহ, বিশ্বজিৎ? হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনি। চিনি মানে ও আমার কিছু কাজ করে দেয় আর কি।”

“কী ধরনের কাজ?”

“জানেনই তো স্যার, কীভাবে পেট চালাই। এক ক্লায়েন্টের বর তার গোপন প্রেমিকাকে নিয়ে প্রায়ই ওর দোকানে আসে শুনেছি। তাই ওকে কিছু টাকা দিয়ে ফিট করেছিলাম ওদের দুজনের একসঙ্গে ভিডিও তোলার জন্য।”

“সে ভিডিও পেয়েছিলে?”

“কোথায় আর পেলাম? সেদিনই তো পুলিশ আমায় ধরল দেবাশিসদার কেসে। তারপর এমন ঘেঁটে গেছিলাম, ওই ব্যাপারটা মাথাতেই নেই।”

“আচ্ছা। তুমি বুঝি একটার বেশি দুটো কেস একসঙ্গে মাথায় রাখতে পারো না?”

আমি খোঁচাটা ধরতে পারলেও না বোঝার ভান করলাম।

“বিশ্বজিতের কী হয়েছে স্যার?”

“সেদিনের পর থেকে বিশ্বজিৎ নিখোঁজ।”

“সে কী!”

“পুলিশ যখন কাউকে কাজে লাগায় তখন তার সেফটির ব্যবস্থাও করে। তোমরা সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করো, কিন্তু ভাবো না সে ধরা পড়লে কী হবে। এবার কী করব বলো। কল রেকর্ডে দেখাচ্ছে লাস্ট কল তোমার সঙ্গেই হয়েছিল।”  

“পনেরো দিন ধরে যে নিখোঁজ, তার এতদিন পরে খোঁজখবর? আর তাও চন্দননগর পুলিশে?”  

“ভালো প্রশ্ন। আগে দ্বিতীয়টার উত্তর দিই। বিশ্বজিতের বাড়ি চন্দননগরের বোড় পঞ্চাননতলায়। তাই কেস আমাদের কাছে এসেছে। আর প্রথম প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক এখনও পাইনি। বিশ্বজিতের বাবা নেই। মা পাগল। এক বন্ধু থাকে বিশ্বজিতের সঙ্গে। এতদিন সেই ওর মায়ের খেয়াল রেখেছিল। কিন্তু বিশ্বজিতের গায়েবের খবর এতদিন সে কেন পুলিশে জানায়নি তার কোনও সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি এখনও।”

“তাহলে পুলিশে রিপোর্ট করল কে?”

“ওদের বাড়ির সামনে একটা বইয়ের দোকান আছে। তার মালিক বিশ্বজিতের বন্ধু। একসঙ্গে আড্ডা দেয়। বিশ্বজিৎকে ফোনে পাচ্ছে না, বাড়িতেও ঢুকতে বেরোতে দেখছে না। সেই বন্ধুও কিছু বলতে পারছে না দেখে দোকানদার ছেলেটাই গতকাল পুলিশে জানিয়েছে।”

“বিশ্বজিতের ফোন ট্র্যাক করা যাচ্ছে না?”

“নাহ। সিম খোলা। এখন একমাত্র কোনও নেটওয়ার্ক এরিয়াতে এসে ফোনে ওয়াই-ফাই কানেক্ট করলেই ট্র্যাক করা যাবে। তাও তো করছে না। কোম্পানি থেকে কললিস্ট চেক করে দেখি লাস্ট কল তোমাকেই। দোকানদার জানাল সেদিন একটু তাড়াতাড়িই দোকান থেকে ছুটি নিয়ে বেরিয়েছিল বিশ্বজিৎ। বলছিল শরীর খারাপ লাগছে। বেশ কবার চোখে মুখে জল ছিটিয়েওছিল। দেখে মনে হয়েছিল আচমকা কিছুতে একটা ভয় পেয়েছে। এমনকি সামনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে চোরের মতো পালিয়েছিল। পরদিন থেকে আর দেখা নেই। একটা ফোন এসেছিল পরের দিন মালিকের কাছে। মোবাইল নম্বর থেকে। বিশ্বজিতের। সে বলে সে নাকি নতুন কাজ পেয়ে গেছে। আর এই কাজ করবে না। মালিক বলে পাওনা বুঝে নিতে। সেও বলে সময়মতো আসবে। ব্যস! সেই শেষ।”

“সেই নম্বরটা পেয়েছেন?”

“পেয়েছি।”

“ট্র্যাক করেছেন?”

“দরকার নেই। চেনা নম্বর।”

“কার?”

“তোমার। এই দ্যাখো”, বলে অফিসার নিজের মোবাইলে একটা স্ক্রিনশট দেখালেন।

সেখানে জ্বলজ্বল করছে আমার মোবাইল নম্বর।

আমার হতভম্ব অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন অফিসার। “আরে ভয় পেয়ো না। এটা ফেক নম্বর। কোনও পাইরেটেড অ্যাপ দিয়ে নম্বর জেনারেট

করে কল করেছে। আমরা তোমার কললিস্ট চেক করেছি। তোমার নম্বর থেকে এমন কোনও ফোন যায়নি। কিন্তু মুশকিল হল কেউ তোমাকে ফাঁসাতে চাইছে। জড়াতে চাইছে। কেন?”

“সে তো আমিও বুঝতে পারছি না। শুধু আমি কেন, আপনিও তো আছেন আচ্ছা, আমি

একবার বিশ্বজিৎকে ফোন করে দেখব?” জিজ্ঞাসা করলাম। “করতে পারো। লাভ নেই বিশেষ। আমরা অনেকবার ট্রাই কমিশনারেটে টিম বসে আছে।

সিগন্যাল পেলেই ট্র্যাক করবে”।

আমি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে এমনিই বিশ্বজিতের নম্বরটা ডায়াল করলাম। আমাকে আর অফিসারকে চমকে দিয়ে বিশ্বজিতের কলার টিউন বেজে উঠল, “ইয়ে দিল তনহা কিউ রহে!” বাজতে বাজতে থেমে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা হোয়াটসঅ্যাপ ঢুকল বিশ্বজিতের নম্বর থেকে। বাংলা অক্ষর। কিন্তু ভাষা আমার অজানা। লেখা “হামচুপামুহাফ।”

অফিসারকে দেখাতে উনিও আমার মতোই অবাক। এর মানে কী রে বাবা!!

“আবার ফোন করো তো”, অফিসার বললেন।  

করলাম। আবার ফোন বেজে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফোন বেজে উঠল অফিসারের।

“হ্যাঁ হ্যাঁ। ট্র্যাক করতে পেরেছেন? বাহ। কোথায়? বিধান সরণি? আচ্ছা। আপনারা স্পেসিফিক লোকেশান জানান, আমি যাচ্ছি।” বলেই আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমিও যাবে নাকি হে?”

“আপত্তি নেই। তাহলে বাইকটা এখানেই রেখে যাই?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের গাড়িতে চলো।”

সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে মুখার্জি নিজে বসলেন। আমি পিছনে। সেই সেদিনের মতো। আমার কী মনে হল, খানিক গুগল খুলে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। অফিসার বলেই যাচ্ছিলেন, “কী মুশকিল বলো দেখি। বিধান সরণি কি আর একটুখানি জায়গা? আর ওই শব্দটারই বা মানে কী? তোমাকে আচমকা পাঠালই বা কেন?”

আমি ততক্ষণে একটা আলোর রেখা দেখতে পেয়েছি।

“স্যার, আমি বোধহয় জানি আমাদের কোথায় যেতে হবে।

“কোথায়?”

“১৩/১ বিধান সরণী। সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের উলটো দিকের বাড়ি।”

“কীভাবে বুঝলে?”

“বিশ্বজিতের পাঠানো মেসেজ। হামচুপামুহাফ।”  

“মানে কী এর?”  

“দেখুন স্যার, গুগলের এই আর্টিকেলটায় ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা লেখার উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনে আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ‘সঞ্জীবনী সভা’ স্থাপন। সভার বিবরণ জ্যোতিবাবুর বানানো এক সাংকেতিক ভাষায় লেখা হত। সেই সাংকেতিক ভাষায় সেই সভার নামটির উচ্চারণ ছিল ‘হামচুপামুহাফ’। কলকাতার ঠনঠনিয়ায় এক পোড়ো বাড়িতে এই গুপ্ত সভা বসত। কিশোর রবীন্দ্রনাথও সভ্যদের একজন ছিলেন। এই সভা যখন বসত, টেবিলে একটি মড়ার খুলি রাখা থাকত। খুলিটির চোখের কোটরে বসানো হত দুটি মোমবাতি। খুলিটি মৃত ভারতবর্ষ ও মোমবাতি দুটি ছিল ভারতের প্রাণসঞ্চার ও জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়ে তোলার সংকেত! সভা আরম্ভ হত বেদমন্ত্র পাঠ করে।”  

“স্ট্রেঞ্জ! এ তো পুরো ফ্রিম্যাসনদের সভার মতো! বাংলায় এমন সভার কথা আগে শুনিনি তো!”

“ফ্রিম্যাসন কারা?”

“ও বাবা! সে অনেক গল্প। দেবাশিসদার থেকে গল্প শুনতাম। আমাদের পার্ক স্ট্রিটেও এঁদের অফিস যাই হোক। আসল কথায় এসো। এ থেকে কী বোঝা গেল?”

“হ্যাঁ স্যার, সেই কথাতেই আসছি। এই বাড়িটার ঠিকানা কেউ কোনও দিন জানায়নি। এতটুকু জানা গেছে, সেটা ছিল এক পোড়োবাড়ি, উপর নিচ ভিতর সমস্তটা খালি ছিল। ‘কলিকাতা দর্পণ’ বইতে রাধারমণ মিত্র প্রমাণ করছেন, এই বাড়ি ছিল ১৩ নম্বর কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি। ১৮৮০ সালের পর থেকে এখানে লোক বাস করতে শুরু করে। আরও পরে এটি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ব্যারাকবাড়ি হয়। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু থেকে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সবাই এই বাড়িতে থেকে গেছেন।”  

“সে বাড়ির এখন কী দশা?”  

“আবার পোড়োবাড়ি হয়ে গেছে। নতুন ঠিকানা ১৩/১ বিধান সরণি। হেরিটেজ বিল্ডিং-এর তকমা নেই। যে-কোনো দিন ভেঙে দিয়ে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং উঠল বলে।”

মুখ দিয়ে চিকচিক করে একটা আওয়াজ করলেন অফিসার, “কিন্তু এই বাড়িতে বিশ্বজিৎ কী করছে? তার চেয়েও বড়ো কথা, একটা সামান্য কাপড়ের দোকানের কর্মচারী এতসব ইতিহাস ভূগোল জানল কীভাবে?”

“এক্ষুনি জেনে যাব স্যার। প্রায় এসেই গেছি।”

ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল বিরাট একটা পোড়ো বাড়ির সামনে। ড্রাইভার গাড়িতেই রইল। আমরা দুজন নামলাম। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। রাস্তার ভিড় পাতলা হতে শুরু করেছে। গেট বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। দোতলা বাড়ি। কিছু জানলায় এখনও কিছু খড়খড়ি আছে। দেওয়াল জায়গায় জায়গায় ভাঙা। চুন সুরকির পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে গেছে। ভিতরে জঙ্গল। প্রাচীর বেয়ে বট অশ্বত্থের চারা শিকড় চারিয়েছে। কর্পোরেশনের বুলডোজার না ভাঙলেও অবহেলাই একে একদিন মেরে ফেলবে নিশ্চিত। কিন্তু বিশ্বজিৎ কোথায়? “আর-একবার ফোন করো তো”, অফিসার বললেন।

“ফোন বেজে চলেছে। ধরছে না কেউ”, বলতে না বলতেই বাড়ির ভিতর থেকে একটা ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল। যান্ত্রিক শব্দ। রিংটোনের। কোথাও একটা ফোন বাজছে। আমি কেটে দিতেই আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল।

অফিসার মুখার্জি আমার দিকে তাকালেন। দুজনেই এক কথাই ভাবছি।

“আবার করো”। ফোন অন রেখেই রিংটোনের শব্দ অনুসরণ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। এটা আগে পোর্টিকো ছিল। ভেঙে পড়েছে। সেটা পেরিয়ে একটা বড়ো হলঘর মতো। তার এককোণে অপেক্ষাকৃত ছোটো একটা ঘর। হয়তো এখানেই বসত সেই সভা। এখন সেই ঘরের দিকেই আমরা যাচ্ছি। সেখান থেকেই মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ ভেসে আসছে। অফিসারের এক হাতে হাই পাওয়ারের টর্চ। অন্য হাত কোমরের বেল্টে আটকানো সার্ভিস রিভলভারে। আগে থেকেই কেমন একটা লাগছিল আমার, সেটা আরও স্পষ্ট হচ্ছিল। একটা গন্ধ। পচা গন্ধ। পচা মাংসের। ওই পোড়োবাড়িতে কোনও হাওয়া ঢোকে না। তাই গন্ধটা থমকে আছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। আর তারপরই দেখতে পেলাম। ঘরের ঠিক মাঝখানে শুয়ে আছে। গোটা দেহটা পচে ফুলে উঠেছে। চারিদিকে ডাঁশ মাছি উড়ছে ভনভন করে। পরনে একটুকরো সুতো নেই। ঠিক দেবাশিসদার মতো। পা দুটো দুপাশে ছড়িয়ে ত্রিভুজের দুটো বাহু তৈরি করেছে। দুই পায়ের ফাঁকে যে অঙ্গটা থাকার কথা সে জায়গাটাও কেউ নিপুণ হাতে কেটে নিয়েছে। বাঁ হাত পাশে ছড়িয়ে আছে। ডান হাত ভাঁজ করে বুকের উপরে রাখা, যেখানে হৃৎপিণ্ড থাকে। ঠিক তার নিচেই ছুরি দিয়ে চিরে কে যেন একটা ত্রিভুজ এঁকে তলায় লিখেছে, NO। অফিসারের টর্চের আলো গিয়ে পড়ল বিশ্বজিতের মুখে। যে জায়গায় চোখ থাকার কথা ছিল, সেই জায়গায় দুটো অন্ধকার গর্ত। মুখ হাঁ করা। কিন্তু মুখ থেকে কী যেন একটা বেরিয়ে আছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। তাও একটু ঠাহর করতে বুঝলাম কে যেন বিশ্বজিতের কাটা অঙ্গটা জোর করে পুরে দিয়েছে ওরই হাঁ করা মুখে।

শৈলচরণ সান্যাল। দেবাশিস গুহর পর এবার বিশ্বজিৎ দে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *