পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

সপ্তম পরিচ্ছেদ— সম্পর্ক

সপ্তম পরিচ্ছেদ- সম্পর্ক

সেদিন রাতে আমরা কেউ ঘুমাইনি।

পুলিশ ফোর্স আসার খানিক বাদে উর্ণারাও চলে এসেছিল শপিং সেরে। কেমন একটা অদ্ভুত হতভম্ব দশা। উর্ণার মা, কাকিমা, একটানা কাঁদছিলেন আর মাঝে মাঝেই বলছিলেন, “আমার কপাল, আমার কপাল।” অদ্ভুতভাবে উর্ণার বাবা অনেক বেশি শক্ত, অবিচল। উনি অমিতাভ মুখার্জির থেকে অনুমতি নিয়ে ওঁর উকিলকে ফোন করলেন। শান্ত গলায় তাঁকে সোজা থানায় গিয়ে উপস্থিত হতে নির্দেশ দিলেন। তারপর স্ত্রী-কন্যার দিকে চেয়ে বললেন, “চিন্তা কোরো না। আমাকে ওরা ধরে রাখতে পারবে না। আমি কিছু করিনি।” আমি সঙ্গে যেতে চেয়েছিলাম। উনিই বারণ করলেন।

“তুমি বরং বাড়িতে থাকো। ওদের খেয়াল রাখো। এই অবস্থায় বাড়িতে একজন পুরুষমানুষের খুব দরকার।”

ঊর্ণা বা কাকিমা কেউই রাতে খাবার মতো অবস্থায় ছিল না। একের পর এক প্রশ্ন জাগছিল আমার মনে। কিন্তু সেসবের সময় এখন না। বাইরে দোকানপাট বন্ধ। ঘরে স্টোভ জ্বালিয়ে ম্যাগি বানিয়ে খেয়ে নিলাম। উপরের তলা থেকে মৃদু কথার আওয়াজ আসছে। ঊর্ণা আর ওর মায়ের। বিছানায় শুয়ে আমি ভাবতে শুরু করলাম। যত সময় যাচ্ছে গোটা ব্যাপারটায় তত জট পাকাচ্ছে। টেবিল ল্যাম্পের তলাতেই সেই খাতাটা রাখা, যাতে কিছুদিন আগে পয়েন্ট ধরে ধরে দশটা প্রশ্নের এক লিস্ট বানিয়েছিলাম। কিছু প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর পেয়েছি। কিন্তু মুশকিল হল তার চেয়েও কঠিন কিছু প্রশ্ন এই কয়েকদিনে সামনে এসেছে। তড়াক করে উঠে আবার সেই খাতা খুলে বসলাম।

দেবাশিস গুহ খুব সম্ভবত খুন হলেন ভূতের জন্য। আততায়ী হয়তো সন্দেহ করেছিল ভূতের ফর্মুলা তাঁর কাছেই আছে। কিন্তু ছিল না। তবে কার কাছে থাকতে পারে? চমকে উঠলাম। আমার তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। অন্য কালিতে লেখা, “তুর্বসু জানে।” মানে দেবাশিসদা মরার আগে আততায়ীকে আমার নাম বলে গেছেন। শুধু বলেননি, লিখে গেছেন। কিন্তু দেবাশিসদা সেটা জানলেন কীভাবে? একটাই উত্তর। প্রিয়নাথের কাগজের মধ্যে নিশ্চয়ই উল্লেখ ছিল ভূতের ফর্মুলার কথা, পো-র বইয়ের কথা, ডিরেক্টরের কথা। এই ডিরেক্টর কী, সেটা খুব সম্ভবত দেবাশিসদাও জানতেন না (প্রিয়নাথ তাঁর শেষ হাড়ে স্পষ্ট করে লেখেননি হয়তো), তাই অমিতাভ মুখার্জিকেও বলতে পারেননি। দেবাশিসদা মারা গেলে অমিতাভবাবু ডিরেক্টরের খোঁজে হন্যে হয়ে ওঠেন 1 আমায় বলেন তাঁর পিছনে লোক লেগেছে, যাদের ধারণা গণপতির ভূতের বাক্সের সন্ধান তাঁর কাছে আছে। এরা কারা? আমাকে অত রাতে হোয়াটসঅ্যাপ পাঠাল কে? এবং কেন? এখন যা মনে হচ্ছে আততায়ীই ওটা পাঠিয়েছে। দেবাশিসদা না। আর এখানেই কোনও লজিক কাজ করছে না। এবার আসি বিশ্বজিতের কথায়। প্রায় একই সময়ে তিনটে ঘটনা ঘটল। কাছে দেবাশিসদা চিঠি দিলেন, দেবাশিসদা খুন হবার ঠিক পরের দিন বিশ্বজিতের কাছে কেউ এল, যাতে সে ভয় পেয়ে দোকান থেকে পালাল, আর নিজেও খুন হল। তাঁর মুখে অগুকোশ পুরে দেওয়া, পেটে ছুরি দিয়ে চিরে এক ত্রিভুজ আর ইংরাজিতে JAHBOULON লেখা। অনেকটা একইভাবে খুন হয়েছিলেন একশো বছর আগের সেই নাট্যকার শৈলচরণ। আর রামানুজ? সেও কি সব সত্যি বলছে? খিদিরপুরের ঘটনার পরপরই তার সঙ্গে বিশ্বজিতের দেখা। নেহাতই কাকতালীয়? এই ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে মুখার্জিকে নেওয়া যাবে না। যেতে হবে একা।

বাকি থাকল নাটকের আর দুই প্রধান চরিত্র। নিশীথ দত্ত আর অমিতাভ মুখার্জি। নিশীথ দত্ত গভীর জলের মাছ। বাইরে নীবার নামের সাধাসিধে এক এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু এঁদের আসল উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য বলতেই প্যাডে ছাপানো সেই প্রাচীন চিনা চিহ্নের কথা মনে পড়ল। প্যাডের পাতাটা এখনও আমার টেবিলেই রাখা। এ চিহ্ন ওখানে কেন? আর ল্যাটিনেও চারটে শব্দ লেখা। Dissimulo, Fraternitati, Unio. Oblitus. কী মনে হল, গুগলে সার্চ করতেই মানেগুলো পেয়ে গেলাম। চারটেই ল্যাটিন শব্দ। গোপনীয়তা, ভ্রাতৃত্ব, একতা, বিস্মৃতি। সঙ্গে টীকায় এটাও লেখা আছে, এই বিস্মৃতি মানে ভুলে যাওয়া না। চোখের আড়ালে থাকা। আরও একটু খোঁজাখুঁজি করে দেখতেই যা পেলাম তাতে চোখ কপালে উঠল। এর প্রতিটাই ছিল আদি ম্যাসনদের উদ্দেশ্য। পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতকে ম্যাসনিক লজের উদ্দেশ্য নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক বাধে। ম্যাসনদের অনেকে এই বিস্মৃতির বিপক্ষে ছিলেন। অন্য দল আবার এই গোপনীয়তা পছন্দ করতেন। এই নিয়ে ম্যাসনিক লজ দুইভাগ হয়ে যায়। এর বেশি কিছু গুগলে জানা গেল না। নিশীথ দত্ত কোনওভাবে এই গুপ্ত ম্যাসনদের সঙ্গে যুক্ত। শুধু যুক্তই না, সবকটা সুতো, দেবাশিসদা, আমার বাবা থেকে তারিণী, প্রিয়নাথ-ও হয়তো তাঁর কাছে এসেই মিশেছে। তবে তিনি দেবাশিসদাকে খুন করেছেন বলে মনে হয় না। আর কিছু না, ভদ্রলোকের যা বয়েস, আর যা শরীরের অবস্থা, তাতে দেবাশিসদার মতো জোয়ান মানুষকে কাবু করাই তাঁর পক্ষে অসম্ভব। বাকি তো ছেড়েই দিলাম। কিন্তু অফিসার মুখার্জি সিসিটিভি ফুটেজে যা দেখালেন। তা তো মিথ্যে হতে পারে না। খুনের দিন, খুনের সময় নিশীথ দত্ত খুব সম্ভব ওই বাড়িতে ঢুকেছিলেন। আর কেউ ঢোকেনি, বা বেরোয়নি। যদি না… যদি না বাড়ির পিছনের খিড়কি দিয়ে কেউ ঢোকে। কিন্তু সেটা তো বেশিরভাগ সময় বন্ধই থাকে! অফিসার মুখার্জিকে ওটার কথা বলতে হবে। লিখে রাখলাম।

বাকি থাকেন অমিতাভ মুখার্জি নিজে। এই লোকটাকে যত দেখছি, তত কনফিউজড হচ্ছি। প্রথমে মনে হল ইনিই আসল ভিলেন, পরে খানিক ভিক্টিম প্লে করলেন, তারপর এমন সব তথ্য দিলেন, মনে হয় অনেক কিছু জানেন, আবার তারপরেই হয়তো একেবারে বোকা সাজছেন। সোজা কথা এই লোকটা আমায় ল্যাজে খেলাচ্ছে। কিন্তু কেন? আমার ধারণা সত্যি হলে ইনি প্রিয়নাথের বংশধর। দেবাশিসদা আমার মতো এঁকেও খুঁজে বার করেছিলেন। আমাদের দুজনকে নিয়ে ঠিক কী করতে চেয়েছিলেন তিনি? তাঁর খুনের পর যা যা হচ্ছে, সেসব যদি ঠিক হয়, তবে আমি আর অমিতাভবাবু এখন টার্গেটে। লোকটা নিজে পুলিশ, কিন্তু প্রায়ই আইন হাতে তুলে নেয়। সর্বদাই যেন কিছুর অপেক্ষায় আছে। একটা অস্থির ভাব। কিছু লোককে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে মন চায় না। ইনি সেই গোত্রের। এঁর মুখ হাসলেও চোখ হাসে না কখনোই।

খাতাভরা আঁকিবুকি। মাথা যন্ত্রণায় দপদপ করছে। টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে খাটে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ জ্বালা করছে, কিন্তু ঘুমের লেশমাত্র নেই। সাড়ে চারটে বেজে গেছে। একটু বাদেই আলো ফুটবে। এমন সময় বাইরে গাড়ির শব্দ। কে এল এত সকালে? মাথার কাছে জানলাটা খুলে উকি মারলাম। সাদা রঙের একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। ছোটো প্রাইভেট কার। সেখান থেকে নামলেন এক ভদ্রলোক আর এক ভদ্রমহিলা। টপ শটে দেখছি বলে কাউকেই চেনা সম্ভব না। মহিলা দরজার বেল বাজালেন। দরজা খুলে গেল। দুজনে ঢুকে গেলেন ভিতরে। তারপর প্রায় আধঘণ্টা কোনও সাড়াশব্দ নেই। শুধু উপরের ঘর থেকে মৃদু কথার আওয়াজ ভেসে আসছে।

চোখটা বুঝি একটু লেগে এসেছিল। চটকা ভাঙল দরজার খুটখুট আওয়াজে। কেউ দরজায় টোকা দিচ্ছে। লাফিয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখি উর্ণা। ঘড়িতে চোখ পড়ল। পাঁচটা চল্লিশ। উর্ণার চোখ কেঁদেকেঁদে ফুলে গেছে। ধরা গলায় আমায় বলল, “তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। সরি।”

“আরে না, না। কী হয়েছে বলো।”

“আমার সঙ্গে একটু উপরে আসতে পারবে? জরুরি দরকার।”

“আরে হ্যাঁ। পারব না কেন? কিন্তু কী হল?”

“না না, তেমন কিছু না। আসলে দিদি তোমাকে ডাকছেন।”

“দিদি?” উর্ণার যে একটা দিদিও আছে তা আমার জানা ছিল না।

“তোমার দিদি আছে? কোনও দিন দেখিনি তো! তুমিও বলোনি!”

বড়ো কষ্টের এক হাসি হাসল ঊর্ণা, “জানলে তো বলব। এত বছর বাদে, আজ এক ঘণ্টা আগে জানলাম।”

“নিজের দিদি?”

“না। সৎ দিদি। মায়ের আগের পক্ষের। এতকাল আমাকে কেউ কিচ্ছুটি বলেনি। সব চেপে গেছিল। বাবা-মা দুজনেই।” আবার টপ টপ করে জল পড়তে লাগল উর্ণার দুই চোখ বেয়ে।

মনে মনে বললাম “DIssImulo”, মুখে বললাম, “সেই দিদি এতদিন পরে?”

“মা ডেকেছে। বাবাকে তো পুলিশে নিয়ে গেছে, তাই।”

“কিন্তু তাতে তোমার এই দিদি কী হেল্প করবেন?”

“জানি না। তুমি উপরে তো চলো।”

ঊর্ণাদের ড্রয়িংরুমের বাইরে থেকেই গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ঊর্ণা ঘরে ঢুকতেই সবাই চুপ মেরে গেল। ঘরে দরজার দিকে মুখ করে উর্ণার মা বসে, আর সামনে সোফায় এক ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। দরজার দিকে পিছন করে বসায় তাঁদের মুখ দেখতে পাচ্ছি না। তবে গাড়ি করে এঁদেরই আসতে দেখেছি।

ঊর্ণা মৃদুস্বরে “তুর্বসু এসেছে” বলায় উর্ণার মা কিছু বললেন না। ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ে রইলেন।

সোফায় বসে থাকা ভদ্রমহিলা বেশ কষ্ট করেই উঠে দাঁড়ালেন। ফিরলেন আমার দিকে।

ভদ্রমহিলা সুশ্রী। ভদ্রমহিলা প্রেগন্যান্ট। সবচেয়ে বড়ো কথা, কিছুদিন আগেই এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাখানেক কলেজ স্ট্রিটের প্যারামাউন্টে কাটিয়েছি।

“অসময়ে বিরক্ত করলাম”, বললেন অপর্ণা গুহ। দেবাশিস গুহের প্রাক্তন স্ত্রী। উর্ণার সৎ দিদি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *