সপ্তম অধ্যায় – কলিকাতা-পুলিশ

সপ্তম অধ্যায় – কলিকাতা-পুলিশ

বাবু গোবিন্দরাম-সৃষ্ট সুসংহত ও সমুন্নত কলকাতা-পুলিশ ক্লাইভ এবং হেস্টিংসের শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কর্নওয়ালিশের সময় তার সামান্য অদল-বদল হয়েছিল। পূর্বতন কলকাতা পুলিশের মূল কাঠামো বর্তমান কলকাতা-পুলিশেও অপরিবর্তিত রয়েছে। লণ্ডন-পুলিশের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের ‘পুলিশে তার প্রভাব সুস্পষ্ট। কর্নওয়ালিশ জমিনদারী-পুলিশ অধিগ্রহণ করে তা রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পদগুলির বাংলা নামের বদলে ইংরাজী নামকরণ ব্যতীত তার মূল কাঠামো তিনি প্রায় অপরিবর্তিত রাখতে বাধ্য হন। কারণ, ওই পুলিশ অতি উন্নত থাকায় ওতে বদলাবার কিছুই ছিল না।

এবার গোবিন্দরাম-উত্তর কলকাতা পুলিশ সম্বন্ধে কিছু বলা যাক।

১৭৭৮ খ্রী. সকাউনসিল গভর্নর-জেনারেল কর্নওয়ালিশ একটি আইন বিধিবদ্ধ করলেন। তিনি সুবা-বাংলা প্রদেশের থানার সংখ্যা কমালেও শহর কলকাতার থানার সংখ্যা বাড়ালেন। হেস্টিংস-সৃষ্ট পৌরসভার একত্রিশটি ওয়ার্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে তার প্রয়োজন হয়। এতে কলকাতা শহরকে একত্রিশ জন থানাদারের অধীনে একত্রিশটি থানায় বিভক্ত করা হয়। থানাগুলিতে থানাদারের অধীনে সাত শত পাইক ও কিছু নায়ক রইল। তদন্ত ও অন্যান্য কাজের জন্য চৌত্রিশ জন নায়েব থানাগুলিতে ছিল। থানার নথিপত্র লেখার জন্য কয়েকজন মুন্সীও [ক্লার্ক] সেখানে বহাল হয়। একটি সুপারিনটেনডেন্ট-এর পদ সৃষ্টি করে সমগ্র কলকাতা পুলিশকে তাঁর অধীন করা হলো। কিন্তু পুলিশের ঐ ইংরাজ কর্তা কলকাতার মেয়রের অধীনে থাকলেন। এই মেয়র তাঁর পুলিশ ও বিচার বিভাগসহ পুনরায় অনুপযুক্ত বিবেচিত হলেন। তিনি প্রশাসনে অধিকর্তার অযোগ্য প্রমাণিত হন। তাঁর বিচারকার্যও অত্যন্ত কদর্য হতে থাকে। ভারতীয় ও যুরোপীয়দের মধ্যে তাঁর পক্ষপাতিত্ব ছিল। দেওয়ান গোবিন্দরামের ফৌজদারী ও দেওয়ানী আদালত তখন নেই। একমাত্র মেয়রের আদালতেই দেশীয়দের বিচার হতো। মেয়র য়ুরোপীয়দের স্বার্থ সর্বাগ্রে দেখতেন। জোর করে দেশীয় ভৃত্যদের তিনি মনিব-য়ুরোপীয়দের কাছে ফেরত পাঠাতেন। তাঁর কয়েকটি রায়ের নমুনা নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :

‘অমুক যুরোপীয়ের দেশীয় ভৃত্যকে ছয়বার বেত্রাঘাত। কারণ, মনিবের গৃহ হতে সে পলাতক ছিল। সার্ভেন্ট মেড ওভার টু হিজ মাস্টার।’ ‘অমুক আসামীকে গাধার পিঠে উলটো করে বসিয়ে ফিনিক-বাজারের মধ্যে দিয়ে ঘুরিয়ে আনো এবং ওই দেশীয় অপরাধীর মাথা মুড়িয়ে সর্বসমক্ষে ঘোল ঢালো।’ ‘অমুক দেশীয় আসামীকে বিশবার কানধরে ওঠ-বোস এবং দৌড় করিয়ে তার দাঁতে কুটো দিয়ে আধ-মাইল ঘুরিয়ে আনো’ ইত্যাদি।

কলকাতার এ’দেশীয় সভ্য নাগরিকগণ এইরূপ দণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এগুলি আপীল-অগ্রাহ্য সামান্য-দণ্ড হওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারের বাইরের বিষয়। কিংবা, দরিদ্র ব্যক্তিরা অত দূরে ইচ্ছা করেই যেতেন না। কিছু দুষ্ট দেশীয় পেশকারের পরামর্শ ও বুদ্ধি এতে ছিল।

এই শহরের প্রশাসন তখনও মেয়র ও তার অলডারম্যানের অধীন। পৌরসভা, কলকাতা-পুলিশ ও বিচার-বিভাগ তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। তখন পৌরসভায় কমিশনারের পদ ছিল না। শীঘ্রই মেয়র ও তাঁর অলডারম্যানরা অযোগ্য প্রমাণিত হয়ে বিদায় নিলেন। তৎস্থলে নিম্নোক্তরূপ এক নতুন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হলো।

কলকাতায় ১৭৮০ খ্রী. একটি কনসারভেন্সি সৃষ্টি করা হয়। এই সংস্থার জন্য কয়েকজন কমিশনার নাগরিকদের মধ্য হতে মনোনীত করা হলো। কমিশনারগণ অধিকাংশই য়ুরোপীয়রা ছিলেন। তাঁদের মধ্য হতে একজন ইংরাজকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হলো। কলকাতার স্থল ও নৌ-পুলিশ এবং তাঁদের সুপারিনটেনডেন্টকে এই কনসারভেন্সির চেয়ারম্যানের অধীন করা হলো। কলকাতা শহরের বিচার ব্যবস্থা পূর্বতন মেয়রদের মতো এঁদেরই অধীন থাকে।

এই কনসারভেন্সি কলকাতায় ১৭৮০ খ্রী. স্থাপিত হয়। কর ধার্য ও কর আদায় কলকাতা-পুলিশের সাহায্যে করা হতো। কর ধার্যের উপযুক্ত নাগরিকদের পুলিশই খুঁজে বার করতো। পুলিশী কাজের সঙ্গে পৌরকাজও পুলিশকে সমাধা করতে হতো। এজন্য কনসারভেন্সি বলতে লোকে পুলিশকেও বুঝতো। এ সময় পৌরসভা ও পুলিশের মধ্যে কোনও পৃথক সত্তা ছিল না। তবে ওই সংস্থার প্রেসিডেন্ট ও তাঁর সঙ্গে তাঁর সহকারীরা শহরের বিচারকার্যও করতেন।

দোকান-ভাড়ার উপর তাঁরা টাকা-প্রতি দু‘আনা এবং বাড়ি ভাড়ার উপর টাকা-প্রতি এক আনা কর ধার্য করেন। এই অর্থ থেকে পথ-ঘাট পরিষ্কার রাখা হতো। এ-কাজে তদারকির তার পুলিশের উপর ছিল। কলকাতা-পুলিশ তৎকালে একযোগে সমাজসেবী ও শান্তিরক্ষক।

১৭৯৩ খ্রী. বাংলা প্রদেশের আংশিক জমিনদারী-পুলিশ গ্রহণের বৎসরে কলকাতা-শহরের প্রশাসনে পুনরায় অদল-বদল হয়। কনসারভেন্সির কমিশনারগণ ও চেয়ারম্যান বিদায় নিলেন। স-কাউনসিল গভর্নর জেনারেল তাঁদের স্থলে ইংরাজ-নাগরিকদের মধ্য হতে কয়েকজন জাস্টিস অফ-পিস নিযুক্ত করলেন। এঁদের প্রধানকে ম্যাজিস্ট্রেট (বড় হাকিম) এবং মূল সংস্থাটি ম্যাজিস্ট্রেসি আখ্যা পায়।

[বি. দ্র.] তৎকালে রিটায়ার করার প্রথা ছিল না। (য়ুরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রে আজও তাই।) যতদিন সমর্থ তথা ফিট্‌ ততদিন তারা কাজে বহাল থাকতো। জমিনদার হলওয়েলের মতো জাস্টিস অফ পিস্রাও যাবজ্জীবনের জন্য নিযুক্ত হন। কলকাতার আভ্যন্তরীণ শাসন-ক্ষমতা ধীরে ধীরে জমিনদারদের অর্থাৎ দেওয়ানের হাত হতে মেয়র এবং মেয়র হতে কনসারভেন্সির চেয়ারম্যানে বর্তায়। এবার ঐ ক্ষমতা কনসারভেন্সি হতে ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন জাস্টিস অব-পিসের দ্বারা অধিকৃত হলো।

পুলিশের তদারকি, বিচারকার্য ও পৌরকার্য, আবগারী এঁদের অধীন হলো। এঁরা মাদকদ্রব্য ব্যবহার ও বিক্রয়ের নিয়ন্ত্রক হন। এজন্য জাস্টিস অফ-পিরা নিজেদের বড় হাকিমের অধীন কয়েকটি পৃথক সংস্থায় বিভক্ত করেন।

চব্বিশ পরগণা জেলায় জাতীয় পুলিশ অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তখনও অক্ষুণ্ন। আদর্শবাদী ডাকাতদের স্থলে বহু সাধারণ ডাকাত অপদলের সৃষ্টি হয়েছে। চব্বিশ পরগণা জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন গভর্নমেন্ট পুলিশ বিশ্বাস্য নয়। ডাকাত অপদল কলকাতার উপকণ্ঠেও হানা দেয়।

কলকাতা-পুলিশের এজন্য চব্বিশ পরগণার অভ্যস্তরে কুড়ি মাইল পর্যন্ত গ্রেপ্তার ও গৃহ-তল্লাসীর অধিকার হেস্টিংসের সময় হতে ছিল। তা না হলে কলকাতার অপরাধ নিরোধ ও নির্ণয়ে অসুবিধা। পুলিশের কর্তা বিধায় জাস্টিস অফ পিসদেরও ঐ অধিকারের প্রয়োজন হয়। ওয়েলেসলি [১৮০০-১৮০৬ খ্রী.] সাহেবের হুকুমে জাস্টিস অফ-পিসদের কলকাতার সঙ্গে তার চতুষ্পার্শ্বে কুড়ি মাইলের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেট করা হলো।

উক্ত ম্যাজিস্ট্রেসির জাস্টিসগণ প্রধান হাকিমের অধীনে কাজের সুবিধার জন্য চারটি পৃথক বিভাগে বিভক্ত হয় : ১. কনসারভেন্সি ২. ফেলনী ৩. মিসডিমোনার ৪. রিপোর্ট।

১. কনসারভেন্সি

এই বিভাগটি দু‘জন জাস্টিস অফ-পিসের অধীন হয়। এঁরা প্রতি কোয়ার্টার-সেসনে ও অন্য সময়েও একত্রিত হয়ে মিউনিসিপ্যাল তদারকি করতেন। পথঘাট পরিষ্কার রাখার জন্য মেথর, ঝাড়ুদার ও অন্যান্যদের নিযুক্ত করা এবং রাজপথ পাহারা ও তার মেরামতির ব্যবস্থা করার দায়িত্ব এঁদের উপর ন্যস্ত ছিল। এই জাস্টিস অফ-পিসরা গৃহ, অট্টালিকা ও উন্মুক্ত জমির মালিক, ভাড়াটিয়া ও অন্যদের উপর বাৎসরিক মূল্যের কুড়ি ভাগের একভাগ পর্যন্ত কর ধার্য করার অধিকারী হন। এইভাবে কলকাতা-শহরে পৌর-কর ব্যবস্থা কায়েম হয়।

এই কনসারভেন্সি হতেই বর্তমান করপোরেশনের সৃষ্টি। প্রথমে শুধু য়ুরোপীয়, পরে কিছু দেশীয় কমিশনার মনোনীত হয়। সেজন্য পরবর্তীকালে সীমিত নির্বাচনের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। দেশীয়দের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার সময় স্বীকার করা হয় যে জনগণ-শাসিত পৌরসভা খ্রী. পূ. ভারতীয় প্রথা। [স্যার জর্জ ক্যাম্বেল দ্র. 1]

কনসারভেন্সি-বিভাগের জাস্টিস অফ-পিসদ্বয়ের স্বতন্ত্র এজলাস ছিল। সেখানে কর বুদ্ধি ও অন্য অবিচারে করদাতারা দরবার করতে পারতেন। এঁরা মিউনিসিপ্যাল সংক্রান্ত মামলাগুলির বিচার করতেন এবং করদাতাদের আবেদন মতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতেন।

২. ফেলনী বিভাগ

ফেলনী বিভাগ দু‘জন জাস্টিস অফ-পিসের অধীন ছিল। ফেলনী অর্থে মিসডিমোনার অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। পুলিশের প্রেরিত ওইরূপ মামলা তাঁরা বিচার করতেন। প্রাইভেট-মামলা গ্রহণেও তাঁরা অধিকারী ছিলেন। উপযুক্ত মামলাগুলি তাঁরা নিজেরা বিচার করতেন। কিন্তু অতি গুরুতর মামলা বিচারের জন্য তাঁরা কলকাতার সুপ্রীম কোর্টে পাঠাতেন।

প্রতি বিভাগে দু‘জন জাস্টিস অফ-পিস থাকায় অবিচার হতোনা। দু‘জনকে একসঙ্গে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। এজন্য এ সময় হতে ব্রিটিশ-বিচারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ে। উপরন্তু এই তিন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল চলতো। তা বাদে, লণ্ডনে প্রিভিকাউন্সিল ছিল। সুপ্রীম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে প্রিভিকাউন্সিলে আপিল হতো। কলকাতায় মেয়র কোর্ট স্থাপনের সময় হতে (১৭২৬ খ্রী.) ব্রিটিশ-ভারতের উপর প্রিভিকাউন্সিলের এক্তিয়ার হয়। কিন্তু মহারাজ নন্দকুমারের পক্ষে সেখানে আপিল করা হয় নি।

৩. মিসডিমোনার বিভাগ

মিসডিমোনার অর্থে কম গুরুত্বের অপরাধ। এই বিভাগ দু‘জন জাস্টিস অফ-পিসের অধীন। এঁরা কম গুরুত্বের অপরাধের বিচার করতেন। যথা, প্রহারাদি, চুক্তি খেলাপ, ভৃত্য-সংক্রান্ত মামলা, ছোটখাটো চুরি-মামলা, ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তিভঙ্গ ইত্যাদি। টাউন-গার্ড পুলিশ তথা সশস্ত্র পুলিশ-বাহিনী এঁদের অধীন। এঁরা নিজস্ব এজলাসে টাউন-গার্ড সংক্রান্ত রিপোর্ট শুনতেন। ওই বিষয়সম্পর্কিত মামলাসমূহের বিচারও তাঁরা করতেন।

টাউন-গার্ড তথা সশস্ত্র-পুলিশে প্রথমে সিপাইদের [দেশীয় সৈন্য] নেওয়া হতো। কিন্তু প্রতিবাদ আসায় শুধু বাঙালী বরকন্দাজেদের [সশস্ত্র পাইক] নেওয়া হয়। প্রথমে এরা কয়জন বাঙালী নায়ক ও একজন বাঙালী দারোগার অধীন ছিল, পরে উহাকে চারজন সার্জেন্টে ও একজন টাউন-মেজরের অধীন করা হয়। এরাই কলকাতার তৎকালীন সশস্ত্র পুলিশ। এদের সকলকে বন্দুক বহন করতে হতো। প্রয়োজন হলে থানাদার-পুলিশদের সাহায্যের জন্য এদের পাঠানো হতো।

৪. রিপোর্ট বিভাগ

রিপোর্ট বিভাগ দুইজন জাস্টিস অফ-পিসের অধীন করা হয়। এঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল পুলিশ-বিভাগ। এই কলকাতা পুলিশ তখন চারটি বিভাগে বিভক্ত। যথা : ১. থানাদারী পুলিশ ২. বাউণ্ডারী পুলিশ ৩. রিভার পুলিশ ও ৪. টাউন-গার্ড পুলিশ।

পুলিশের কর্তা এই জাস্টিস অফ-পিসদ্বয় নিজেদের এজলাসে বসে প্রত্যহ প্রতিটি থানাদারের নিকট থেকে তাদের এলাকার যাবতীয় ঘটনার রিপোর্ট শুনতেন। এখানে বাদী ও সাক্ষীরা উপস্থিত থেকে নিজের নিজের বক্তব্য রাখতো। জাস্টিস অফ-পিসদ্বয় উচিত বুঝলে আসামীদের মুক্তি দিতেন। সন্দেহ হলে, তাঁরা অন্য অফিসারদের দ্বারা মামলা আবার তদন্ত করাতেন। প্রয়োজনে তাঁরা নিজেরাই তদন্ত করে সত্যাসত্য বুঝতেন। তাতে কোনো পক্ষেরই অবিচারের মনোভাব থাকতো না।

এরা নিজেরা ছোটখাটো কিছু-কিছু মামলার বিচার করতেন। এ যুগে ওই ধরনের মামলাগুলিকে ‘পুলিশ-অগ্রাহ’ তথা ‘নন-কগ’ অপরাধ বলা হয়। অন্যগুলি গুরুত্ব অনুযায়ী মিসডিমোনার বিভাগে কিংবা ফেলনী বিভাগে বিচারের জন্য পাঠাতেন। মামলাসমূহের মিটমাট করার ক্ষমতা এঁদের ছিল।

[বি. দ্র. উপরোক্ত রিপোর্ট-গ্রহণ পদ্ধতি একটি সুন্দর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষার্ধ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তৎকালের মতো বর্তমানকালের ডেপুটি পুলিশ-কমিশনারদের নিজস্ব এজলাসগৃহ ছিল। এজন্য পদাধিকার বলে এঁদের প্রত্যেককে জাস্টিস অফ-পিসও করা হতো। তাঁরা আসামীদের আইনত মুক্তি দিতে পারতেন। বিচার করা ও দণ্ডদান ছাড়া, হাকিমদের অন্য ক্ষমতা তাঁদের ছিল।]

প্রত্যহ সকালে প্রত্যেক থানা-ইনচার্জ এঁদের এজলাসে আসামী ও নথিপত্র সহ উপস্থিত হতেন। এ্যাসিসটেন্ট-কমিশনারগণ তাকে প্রয়োজন মতো সাহায্য করতেন। ডেপুটি-কমিশনার স্বয়ং এ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের সাহায্যে প্রতিটি মামলা পরীক্ষা করতেন। আসামীরা স্বয়ং বক্তব্য রাখতো। তাদের উকিলরাও উপস্থিত থেকে মামলা বোঝাতেন। উচিত বুঝলে তৎক্ষণাৎ তাঁরা আসামীদের মুক্তি দিতেন। এজন্য তাঁদের আদালতে হয়রানি-ভোগ ও অর্থনষ্ট হয় নি। নথিপত্র পূর্বদিন এ্যাসিসটেন্ট-কমিশনার খুঁটিয়ে দেখতেন ও বুঝতেন। পরদিন ঐগুলি পুনর্বার ডেপুটি কমিশনার দ্বারা পরীক্ষিত হতো। এই ডবল চেকিঙের পর আদালতের বিচার। তখন অবিচার হওয়ার সুযোগ কম ছিল।

তদন্তকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তৎক্ষণাৎ পুনঃ তদন্তের ব্যবস্থা হতো। তদন্তকারীর দোষ প্রমাণিত হলে তাদের জরিমানা ও অন্য কঠোর শাস্তি হতো। বহু ক্ষেত্রে তাঁরা মামলা অন্য অফিসার দ্বারা তদন্ত করাতেন। থানার ইনচার্জ অফিসার বা তদন্তকারী এঁদের বিনা অনুমতিতে মামলা কোর্টে পাঠাতে পারেন না। পূর্বে পুলিশের ডেপুটি কমিশনাররা পনের দিন পর্যন্ত আসামীদের পুলিশ হেপাজতে নিজেরাই রাখতেন। পরে কলকাতা-হাইকোর্ট তাদের ঐ অধিকার কেড়ে নেন। সেখানে বিনা ব্যয়ে সুবিচার পাওয়ার কিছুটা ব্যবস্থা ছিল। এঁরা মামলা-সমূহ মিট-মাট করার ও পুয়োর-ফাণ্ডে সামান্য চাঁদা নিয়ে দোষীকে মুক্তি দেওয়ার অধিকারী ছিলেন। এতে দৈব অপরাধীদের দাগী হয়ে জীবন নষ্ট হতো না। এই রিপোর্ট সিস্টেমের পুনঃ প্রবর্তন জনগণের উপকারে আসবে।]

কিছু পরে পুনরায় কলকাতা পুলিশের কিছু অদল-বদল করা হয়। কলকাতা পুলিশের তৎকালীন সংগঠন সম্বন্ধে বিবৃত করবো। ঐ কালে উহা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং উল্লেখ্য পুলিশ-সংগঠন ছিল।

এই পুলিশ সুগঠিত কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত ছিল, যথা ১. সশস্ত্র বাহিনী ২. কেন্দ্রীয় বাহিনী ৩. থানাদারী পুলিশ ৪. বাউণ্ডারী পুলিশ ৫. বিশেষ পুলিশ ৬. রিভার পুলিশ।

১. সশস্ত্র পুলিশ

সশস্ত্র পুলিশকে টাউন-গার্ড পুলিশ বলা হতো। এরা কলকাতার তৎকালীন আর্য, পুলিশ। প্রথমে এতে দেশীয় সিপাহী তথা সৈন্য নেওয়া হতো। কিন্তু সৈন্য দ্বারা পুলিশের কাজ সম্ভব নয়। প্রয়োজন মতো বল প্রয়োগে তারা অনভ্যস্ত। এদের বিরুদ্ধে পুলিশ-পাইক ও জনগণ হতে প্রতিবাদ আসে।

পরে এই বাহিনী শুধু বাঙালী বরকন্দাজ [বন্দুকধারী পাইক] দ্বারা গঠিত হয়। এরা প্রথমে কজন নায়ক ও একজন দারোগার অধীন ছিল। পরবর্তীকালে এদের একজন টাউন-মেজর ও চারজন সার্জেন্টের অধীন করা হলো।

২. কেন্দ্রীয় পুলিশ

এরা বর্তমান কালের হেডকোয়ার্টার-ফোর্সের অনুরূপ। এতে বারোজন য়ুরোপীয় নাবিককে য়ুরোপীয়-কনস্টেবলরূপে নিযুক্ত করা হয়। এরা কেন্দ্রীয় পুলিশ-অফিসের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এদের মধ্যে ছ’জন য়ুরোপীয়-অধ্যুষিত এলাকায় য়ুরোপীয় মামলাতে বা বিবাদে প্রয়োজন মতো দেশীয় থানাদারদের সাহায্য করতো। প্রয়োজন হলে দেশীয় থানাদাররা এদের তলব করতেন।

এই য়ুরোপীয় কনস্টেবলদের দেশীয় ভাষা-শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। দেশীয় ভাষা বলতে ও বুঝতে পারলে এরা বেতনের অতিরিক্ত কিছু ভাতা পেত। দেশীয়দের সঙ্গে এদের ব্যবহার খুবই ভালো ছিল। এইরূপ সৎ-শিক্ষা তাদের সকলকে দেওয়া হতো।

৩. থানাদারী পুলিশ

শহরের পরিধি বিস্তৃত হওয়ায় এদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। থানাগুলির এলাকা ছোট ছোট করা হতো। ওই কালের বহু থানা এখন নেই। যথা, ফিনিক বাজার, বামুনপাড়া, শাস্তি ভাঙা, ডুলাণ্ডা, হাটখোলা, ইত্যাদি।

এ সময় সমগ্র শহরকে চল্লিশটি থানায় বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক থানায় একজন থানাদার এবং তাকে সাহায্য করার জন্যে কয়েকজন নায়েব নিযুক্ত করা হয়। কয়েকজন মুন্সী থানার নথিপত্র লিখতো ও রক্ষা করতো। প্রত্যেক থানায় কুড়ি থেকে ত্রিশজন নায়ক, পাইক ও চৌকিদার ছিল।

এছাড়া প্রত্যেক থানায় তিনটি রাত্রিকালীন টহলদার পুলিশ দল ছিল। এদের প্রত্যেক দলে দুইজন নায়েব ও বারোজন চৌকিদার ছিল। এদের মূলতঃ রাত্রিকালীন বোঁদের জন্য ব্যবহার করা হতো। প্রত্যুষে ফিরে এরা থানাদারকে এলাকার খবরা-খবর রিপোর্ট করতো।

থানাদারদের ষোল টাকা, নায়েবদের দশ টাকা এবং চৌকিদারদের চার টাকা মাসিক বেতন ছিল।

একালে বাজারে কড়ির [১৭৭০ খ্রী. পরেও] ব্যবহার ছিল। তবে বেতন মুদ্রা দ্বারা দেওয়া হতো। দ্রব্যাদি ও শস্যও শহরে সুলভ ও সহজ লব্ধ ছিল। এদের সরকার থেকে যুনিফর্ম সরবরাহ করা হতো। এদের ব্যায়াম ও ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা ছিল। স্থানীয় বাঙালী হতে মূলতঃ এদের ভর্তি করা হতো।

৪. বাউণ্ডারী পুলিশ

বাউণ্ডারী পুলিশকে সীমানা-পুলিশ [সীমান্ত] বলা হতো। এদের চৌহুদ্দী-পুলিশ ও বলা হয়েছে। সমগ্র শহর ঘিবে বাইশটি সিদবালি [Sidwali] থানার বেষ্টনী ছিল। সমগ্র শহর ঘিরে চক্রাকারে ওগুলির অবস্থান। প্রত্যেকটি সিদবালি-থানায় নায়েবের অধীনে আট হতে ষোলজন বরকন্দাজ থাকতো। রাত্রে শহরের সীমান্ত অতিক্রমকারী যে-কোনো ব্যক্তির দেহ তল্লাসীর অধিকার এদের ছিল। চক্রাকারে অবস্থিত একটি থানা হতে অন্য থানার মধ্যবর্তী-রেখা দ্বিমুখী পদচারণ দ্বারা রক্ষা হতো।

চব্বিশ পরগণা জেলায় জমিনদারী-পুলিশ অধিগ্রহণের ফলে বহু বিক্ষোভ দেখা দেয়। জাতীয় পুলিশ বিলোপ-সাধনে জনসাধারণের মতো পুলিশ-পাইকরাও ক্ষুব্ধ ও রুষ্ট Į তৎসম্পর্কিত সমস্যায় তখনও সমাধান হয় নি। জনগণের ও জমিনদারদের সাহায্যপুষ্ট আদর্শবান ডাকাত দলের সংখ্যা তখন কম। তার পরিবর্তে বহু সাধারণ ডাকাত-অপদলের সৃষ্টি হয়েছে। এঁরা প্রতিশোধের জন্য রাত্রিকালে বারে বারে শহরের উপকণ্ঠে আক্রমণের চেষ্টা করতো। কিন্তু সুরক্ষিত নগরের অভ্যন্তরে তাদের কোনোও উৎপাত সম্ভব ছিল না।

৫. বিশেষ পুলিশ

বিশেষরূপে শিক্ষিত একদল পুলিশকে ‘বিশেষ পুলিশ [Special police] বলা হতো। এরা প্রধান-হাকিমের বাসগৃহ-সংলগ্ন গার্ডরুমে বহাল থাকতো। একজন জমাদার, ন’জন নায়েব এবং বাহাত্তর জন গিরদার-পাইক দ্বারা উহা গঠিত। এরা বন্দুকধারী সশস্ত্র বিশেষ পাইক। রণবিদ্যাতেও এরা সুশিক্ষিত ছিল। একপ্রকার অর্ধসামরিক মিলিশিয়া পুলিশ। জরুরী প্রয়োজনে প্রধান হাকিম, যিনি জাস্টিস অফ-পিসদের চেয়ারম্যান, স্বয়ং তাদের ঘটনাস্থলে পাঠাতেন।

বাগদী, ডোম, কিছু ভোজপুরী, কৈবর্ত ও অন্য বর্ণহিন্দুরাও এর সদস্য ছিল। এরা রীতিমতো প্রাত্যাহিক কুচকাওয়াজ করতো। বাদ্যযন্ত্ররূপে এরা পুরনো যুগের দামামা ও শিঙা ব্যবহার করেছে।

৬. রিভার পুলিশ

পূর্বতন নৌ-পুলিশ এই সময় রিভার-পুলিশ নামে পরিচিত হয়। এতে ন’জন নৌ-সরকারের অধীনে নৌ-চৌকিদার বাদে আঠারো জন পিওন এবং নিরানব্বই জন মাল্লা, মাঝি ও দাড়ি ছিল। প্রয়োজনে এরা কিছু গিরদারী তথা বন্দুকধারী পাইক সঙ্গে নিতো। সমগ্র বাহিনী একজন নৌ-দারোগা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। এই পদটি এ সময়ে অন্য-নামে অভিহিত হয়।

ভাগীরথী নদীতে টহল দেওয়া এদের কাজ। এরা জলদস্যু-দমন ও স্মাগলিং বন্ধ করতো। এদের প্রায় নদীবক্ষ বিপদমুক্ত থাকতো। বর্তমান পোর্ট-পুলিশ এদের উত্তরাধিকারী।

কলকাতা-পুলিশের অধীনে ওইকালে তিনটি আটক-ঘর তথা প্রিজন বা হাজত ছিল। যথা, ১. হাউস অব করেকসন (সম্ভবত জুভিনাইলদের জন্য)। ২. টাউন-গার্ডপ্রিজন তথা কুঠা-ঘর (নারীদের জন্য)। হাউস অফ করেকসনের সঙ্গে পুলিশ-হাসপাতাল যুক্ত ছিল।

কনসারভেন্সি

মিউনিসিপ্যালকে তথা পৌরকার্যকে কনসারভেন্সি বলা বলা হতো। এতে চারজন য়ুরোপীয় ঝাড়ুদার, দু‘জন য়ুরোপীয় কনস্টেবল এবং তাদের অধীনে মজদুর [মিনিয়্যালস] প্রভৃতি ছিল। পৌরকার্যের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক তখনও আছে। পুলিশ কনস্টেবল ঝাড়ুদারদের কাজের তদারকি করে।

এদের অধীনে কিছু পুলিশ-পাইক বে-আইনী গৃহ বন্ধ করতো। পৌরকর আদায়েও তারা সাহায্য করতো মিউনিসিপ্যাল-সম্পত্তিও তারা পাহারা দিতো। এই পুলিশদল কনসারভেন্সির কর্তৃপক্ষের অধীন ও আজ্ঞাবাহী।

[বর্তমানে কলকাতা-পুলিশে ‘সিটি আর্চিটেক্ট নামে একটি বিভাগ আছে। এই বিভাগেও ইনস্পেক্টর ও পুলিশগণ শহরের বে-আইনী গৃহ-নির্মাণ করপোরেশনের নির্দেশে বন্ধ করে।]

পৌরকার্য, বিচারকার্য, এবং পুলিশী-কার্য—সমাজ ব্যবস্থার এই তিনটির অঙ্গাঙ্গী সম্বন্ধ। বিভিন্ন বিভাগের কর্তৃত্বে একই ম্যাজিস্ট্রেসির [বড় হাকিম] অধীনে এই তিনটি সংস্থা থাকায় এদের মধ্যে সহযোগিতা নিবিড় হয়। এতে জনহিতার্থে কার্যক্রম দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হতো। তখন নাগরিকরা সুখী ছিল।

বি. দ্র ১৮১৮ খ্রী. ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজপথ চামড়ার মশকের সাহায্যে জলসিক্ত করার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু পরে লটারির টিকিট বিক্রয় করে বর্তমান বহু রাজপথ ও পুষ্করিণী তৈরি হলো। রাস্তা পাকা করার জন্য কলকাতা-পুলিশ বহু লটারির টিকিট বিক্রয় করে। এ যুগেও রেডক্রশ ও অন্যান্য জনকল্যাণে কলকাতা-পুলিশ টিকিট বিক্রয় করেছে।

[কলকাতা শহরের উপরোক্ত প্রশাসন-বিভাগের সঙ্গে পাটলিপুত্র ও রাজগৃহ প্রভৃতি প্রাচীন নগর প্রশাসন-বিভাগের মিল আছে। বহু বিশিষ্ট পণ্ডিত ওই যুগে ইংরাজ-রাজপুরুষদের বাংলা, সংস্কৃত ও পাশি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের শিক্ষণ সমূহ এই বিষয়ে তাঁদের প্রভাবিত করেছিল।]

কলকাতা-পুলিশের সুব্যবস্থা ও সুরক্ষণে ডাকাতি, রাহাজানি, হত্যা-অপরাধ ও সিঁদচুরি প্রভৃতি শহরে ছিল না বললেই চলে। এই নিরাপত্তার কারণে ধনী ব্যক্তিদের মতো মধ্যবিত্তরাও গ্রামাঞ্চল ও অন্যত্র হতে এসে কলকাতায় গৃহনির্মাণ করে। তাদের ধন-দৌলত কলকাতায় পুঞ্জীভূত হয়।

গোবিন্দরাম মিত্রের কাল থেকেই কলকাতা পুলিশের এই সুনাম। ফলে কলকাতা শহর ক্রমশ জনবহুল ও বৃহৎ আকার হয়। অন্য প্রদেশবাসী ব্যবসায়ী ও ধনীরা এই শহরে এসে বসবাস শুরু করে। কলকাতা কসমোপলিটন তথা পাঁচমিশালি শহরের রূপ নেয়।

কলকাতা-পুলিশের সংগঠন ও সুরক্ষণ-খ্যাতি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে ও মার্চেন্টদের ডেসপ্যাচ-সমূহের মাধ্যমে লণ্ডন শহরে পৌঁছলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লর্ড পিল কলকাতা-পুলিশের অনুকরণে ইংরাজি কায়দায় প্রথম লণ্ডন-পুলিশ তৈরি করেন ১৮২০ খ্রী.। ঐ সময়ে লণ্ডন শহরে সুগঠিত কোনো পুলিশ ছিল না। এ সম্বন্ধে কলকাতার সহিত লণ্ডনের তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। জনসংখ্যা ও আয়তনে

উভয় শহর তখন প্রায় সমান। উল্লেখ্য—লণ্ডন-পুলিশের একশত বৎসর পূর্বে কলকাতা-পুলিশ সৃষ্টি হয়। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা ও জোসেফ গোল্ডস্-এর স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড ডঃ। মূল ইংরাজি মূল বয়ান পরিশিষ্টে উদ্ধৃত হয়েছে।

“১৮২০ খ্রী. লণ্ডন শহরে কোনও পুলিশ-বাহিনী নেই। কতিপয় প্যারিস-ওয়াচম্যান অকর্মণ্য ও দুর্নীতি পূর্ণ। তাদের কোনও তদারকি কর্মী নেই। এরা অপরাধীদের মদত দেয় ও লুণ্ঠনে সাহায্য করে। লণ্ডন শহরে চব্বিশ জন নাগরিকদের মধ্যে একজন ক্রীমিন্যাল। তস্কর ও দুর্বৃত্তরা নির্ভয়ে ঘোরাফেরা করে। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে নাগরিকদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করে। পরে রাজপথে পোস্টে বেঁধে তাদের উলঙ্গ করে নির্মম ভাবে প্রহার করে। প্রতিদিন টেমস নদীতে রবারি ও ডাকাতি হয়েছে। [সেখানে রিভার-পুলিশ নেই] রবারি বারগ লারি ও চুরি অসংখ্য ও নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ফুটপাথ-সমূহ ফুট-প্যাডদের দ্বারা অধিকৃত। শহরে অসংখ্য নোঙরা বস্তি সমূহ। গাভীর কানে মটর দানা পোরা হয়। যন্ত্রণায় ছটফট করলে তাকে বল্লম দ্বারা খুঁচিয়ে মারা হয়। বস্তিবাসী বালকদের ঐ বয়েল-নিধন একটি প্রিয় ক্রীড়া। হৃতসর্বস্ব নাগরিকরা এবং তৎসহ ব্যাঙ্কারগণ শেষে সম্পত্তি উদ্ধারার্থে অপরাধীদের নিকট কেঁদে পড়তো। অপরাধীরা বহু অর্থ উৎকোচ গ্রহণ করে হৃত সম্পত্তির সামান্যাংশ তাদের ফেরত দিতো।

তবু ঐ সময়ে লণ্ডনে আগে পিছু স্বল্পকালে দুইশত ব্যক্তির শুধু জালিয়াতি-অপরাধে ফাঁসি হয়। এক দিনেতেই একবার চল্লিশ জনের বেশি লোকের ফাঁসি হয়। নিউগেট প্রিজনে বহু শিশু অপরাধী। সেখানে একটা স্কুল খুলতে হয়। লণ্ডনে শান্তিরক্ষার ভার সৈন্যদের উপর ছিল। তারা শুধু গুলিবর্ষণে অভ্যস্ত। ওই চরম মুহূর্ত এড়ানোর কোনও জ্ঞান তাদের নেই।

লর্ড পিল প্রথমে শহরের বস্তিগুলি উচ্ছেদ করে অপরাধী কমান। তরপর লণ্ডনববি [Boby] সম্বলিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লণ্ডন-পুলিশ তৈরি করেন। লণ্ডন-পুলিশে পুরনো কলকাতা-পুলিশের প্রভাব সুস্পষ্ট।”

[এই সময় গোলাবারুদ রসদ ও মাল বহনে গরুর গাড়ি ছিল অপরিহার্জ। অন্যদিকে যাত্রী বহনে একমাত্র পালকি সম্বল। শহরের উৎকলবাসী বাহকরা প্রতি বৎসর লক্ষ লক্ষ টাকা দেশেতে পাঠাতো।

১৮২৭ খ্রী. ২১শে মার্চ কলকাতা পুলিশের কর্তৃপক্ষ পালকি-বাহকদের বিশেষ ব্যাজ পরিধানের এবং ফি প্রদান করে নম্বর ও লাইসেন্স গ্রহণের হুকুম দিলেন। প্রতিবাদে বাঙালী ও ওড়িয়া পালকি-বাহকরা ধর্মঘট করে গড়ের মাঠে সভা করে। সেটাই ভারতের প্রথম শ্রমিক-ধর্মঘট ও প্রকাশ্য রাজনৈতিক সভা। তার ফলে পালকির বদলে শহরে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন হয়। এ সময় অন্যদের মতো পুলিশ-অধিকর্তারাও পালকি পরিত্যাগ করে দ্রুতগামী অশ্বশকট ব্যবহার করেন।]

লর্ড বেনটিঙ্ক [১৮২৯ খ্রী.] এ দেশীয় পুলিশকে ইংরাজি ধাঁচে তৈরি করতে চাইলেন। এজন্য তিনি একটি তদন্ত-কমিটি তৈরি করেছিলেন। সেই কমিটির সুপারিশ মতো পুলিশের বেতন কিছুটা বর্ধিত করা হলো। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ ও এ্যাসেসমেন্ট সম্বন্ধে নিয়ম-কানুনের অদল-বদল করা হয়। দেশীয় ব্যক্তিদের মিউনিসিপ্যাল কার্যে অধিকার দেওয়া হয়। কয়েকজন দেশীয় কমিশনার দেশীয়দের দ্বারা নির্বাচিত [?] হন।

লর্ড বেনটিঙ্কের নির্দেশে এই সময় কলকাতার স্থল ও নৌ-পুলিশ এবং বাংলা-পুলিশ যুক্তভাবে গঙ্গাসাগরে মানত-রক্ষা ও সতীদাহ বন্ধ করেছিলেন। তবে সতীদাহ বন্ধ করা তাদের মনঃপূত না হলেও তারা ওই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করেছিল। এজন্য কলকাতা ও বাংলা-পুলিশ প্রথম জনপ্রিয়তা হারায়।

[বি. দ্র.] সতীদাহ বন্ধ উপলক্ষ্যে দেশীয় পুলিশ সর্বপ্রথম জনগণের সহিত প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে আসে। বহুসংখ্যক জনগণ প্রতিরোধ করাতে পুলিশ সর্বপ্রথম লাঠিচার্জের আশ্রয় নেয়। তখন থেকেই পুলিশে লাঠিচার্জ প্রথা সৃষ্টি হয়। কিন্তু জনগণও অধিকার রক্ষার জন্য পুলিশকে প্রতি-আক্রমণ করতে দ্বিধা করে নি। এতে বহুসংখ্যক পুলিশ-কর্মী আহত হলে তাদের দ্রুত চিকিৎসার জন্য শহরে সর্বপ্রথম বৃহদাকারে পুলিশ-হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছিল।]

[বি. দ্র.] সতীদাহ বন্ধ উপলক্ষ্যে সর্বপ্রথম (তৎকালীন) ছাত্রদের সহিত পুলিশের সংঘর্ষ হয়। জনগণের সহিত সংস্কৃত টোলের (তৎকালীন স্কুল) এবং চতুষ্পাঠীর (কলেজ) কিছু ছাত্ররাও সতীদাহ বন্ধে ক্ষিপ্ত হয়। পাঠশালা বলতে তখন শিশুদের বিদ্যালয় বুঝাতো। এঁরা শাস্ত্র নির্দেশ না খুঁজে আইন করে সতীদাহ বন্ধ ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্ম বিশ্বাসে বিদেশী হস্তক্ষেপ বুঝেছিল। উপরন্তু ওদের মধ্যে মধ্যে ওই সতীদের উদ্ধার করে তাদের সসম্মানেই পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে বা স্ব সমাজে তাদের ফেরত না দিয়ে ক্রীশ্চান করে বিবাহ করা বা উপ-পত্নী রাখা তাদের পছন্দ ছিল না। এই দুষ্কার্য জবচার্নক প্রথম করে বাঙালীর বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

[পরবর্তীকালে এই ভুল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর করেন নি। উনি বিধবা-বিবাহের জন্য রাষ্ট্রীয় আইন, তৈরির পূর্বে প্রথমে শাস্ত্রীয় অনুমোদন খুঁজে বার করেছিলেন।] এর পর থেকে সাবধান হয়ে ব্রিটিশ শাসকরা ধর্মে কখনও হস্তক্ষেপ করেন নি। এতে বহু কুসংস্কার এদেশে ধর্মের নামেতে রয়ে যায়। ওরা বুঝেছিলেন যে বারংবার ধর্মে হস্তক্ষেপ করাতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল। ব্রিটিশরা ইতিহাস হতে প্রায়ই শিক্ষা নিতেন। তাই আমেরিকার ইংরাজ ঔপনিবেশিকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর ওঁরা আর কোনও ইংরাজকে ভারতে স্থায়ী অধিবাসী হতে দেন নি। তাঁদের ভয় ছিল যে আমেরিকার মতো ভারতে স্থায়ী অধিবাসী ইংরাজরাও ভারতের লোকদের সহিত একযোগে স্বাধীনতা চাইতে পারে।

বেনটিঙ্ক ভারতের প্রশাসন ক্ষেত্রে বহু সংস্কার সাধন করেছিলেন। তাঁর দ্বারাই বর্তমান আকারে [কর্নওয়ালিশের পর] ভারতীয় সিভিল সার্ভিস তথা কর্মকৃত্য সৃষ্ট হয়েছিল। এই আই. সি. এস. কর্মকৃত্য বস্তুতপক্ষে প্রশাসনের লৌহ-কাঠামো তথা স্টিপ-ফ্রেম ছিল। আই. সি. এস.দের সর্বজ্ঞ মনে করে যে কোনও বিভাগে তাঁদের বহাল করা হতো। তৎকালে এঁদের সকলকেই য়ুরোপ হতে সংগ্রহ করা হতো। এই সময় একটি সর্বভারতীয় পুলিশ সার্ভিসও (I. P.) তৈরি হয়। কিন্তু তাতে ভারতীয়দের প্রবেশ অধিকার ছিল না। উপরন্তু তাদের বিভাগের সর্বোচ্চ পদে জনৈক সিভিলিয়ানাকে (I. C. S.) বহাল রাখার রীতি ছিল।

১৮৩৭ খ্রীস্টাব্দেও ক্ষমতাবান জমিনদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পাঠানো হয়েছে। তাদের ক্ষমতা খর্ব করে অবশিষ্ট জমিনদারী-পুলিশ ভাঙা হচ্ছিল। অবশ্য তখন ও কিছু জমিনদারী-পুলিশ বাতিল করা হয় নি।* ফলে স্থানে স্থানে আরও বিদ্রোহ দেখা দিচ্ছিল। পাশাপাশি গভর্নমেন্ট ও জমিনদারী থানার অবস্থিতি। ওগুলির মধ্যে কিছু বে-আইনী ও কিছু আইনসম্মত ছিল। কিছু বংশামুক্রম বরখাস্ত জমিনদারী-পাইকরা ডাকাত-দলে ভর্তি হয়। স্বত্বভোগী পুলিশকে বেতনভোগী করা কারোরই পছন্দ নয়। বেতনভোগীদের সেবামূলক মনোভাব থাকে না পূর্বতন পাইক ও বরকন্দাজরা নতুন গভর্নমেন্ট পুলিশে ভর্তি হতে চায় না। কলকাতা থেকে পলাতক আসামীদের ওরা আশ্রয় দেয়। প্রদেশে গভর্নমেন্টের নতুন পুলিশ তখনও শক্তিশালী হয়ে ওঠে নি। সে জন্য বাংলা-পুলিশ এবং কলকাতা পুলিশের মধ্যে নিম্নোক্ত সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

[* ১৮৬৬ খ্রী. D. T. Me Niele I. C. S. স্পেশাল অফিসার রূপে তৎকালীন শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে নিম্নোক্ত রূপ একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন।
“দশশালা বন্দোবস্তের পূর্বের ন্যায় উহার পরেও দেশের পুলিশ কার্যের ভার এই দেশের জমিদারদের উপরই অর্পিত আছে। ওই জমিদাররাই চুরি ও ডাকাতি অপরাধ নির্ণয় ও নিরোধ ও শান্তি রক্ষার জন্ম এখনও যায়ী। তদন্ত করে অপহৃত উদ্ধারের কার্য এঁদের পুলিশেরই করণীয় কার্য।”]

এক কলকাতা পুলিশ মূলত শহরে শান্তিরক্ষার জন্য দায়ী থাকবে। তবে প্রয়োজন হলে তারা শহরগুলিতে পুলিশী-কাজ তো করবেই ; অধিকন্তু তারা কলকাতার চতুর্দিকে চব্বিশ পরগণার অভ্যন্তরে কুড়ি মাইল পর্যন্ত যাবে এবং গৃহতল্লাসী ও আসামী গ্রেপ্তার করবেন।

এজন্য কলকাতা-পুলিশের নিয়ন্ত্রক জাস্টিস অফ-পিসদেরও শহরের বাইরে প্রদেশের কুড়ি মাইল পর্যন্ত অভ্যন্তরে ম্যাজিস্ট্রেট করে তাঁদের ওই এলাকায় ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়।

[কলকাতার শহরতলি ক্রীত হওয়ার পর তা কলকাতা শহরের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু চব্বিশ পরগণা জেলা ১৭৫৭ খ্রী. অধিগ্রহণের পর তা চব্বিশ পরগণার অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে, কলকাতার শহরতলি-পুলিশ চব্বিশ পরগণা-পুলিশের অধীন হলো। পরে অবশ্য ঐ শহরতলি পুলিশকে পুনরায় মূল কলকাতার মধ্যে আনা হয়।]

দুই (জেলা পুলিশ) কলকাতার শহরতলিতে ও জেলাতে শান্তিরক্ষার জন্য দায়ী থাকবে। কিন্তু কলকাতার মূল শহরের মধ্যে তাদের কোনো ক্ষমতা থাকবে না। মূল কলকাতা শহরে অপরাধ-নিরোধ ও নির্ণয় ব্যাপারে তারা ক্ষমতাশূন্য। মূল কলকাতা শহরে থানাতল্লাসি ও গ্রেপ্তারেও তারা অক্ষম।

কলকাতা শহরে হেড কোয়ার্টারস স্থাপিত করে গভর্নরের প্রত্যক্ষ অধীনে মৌর্য-রাজাদের ফেডারেল-পুলিশের মতো কলকাতা পুলিশ এবং প্রদেশ-পুলিশের জন্য একটি যুগ্ম গোয়েন্দা বিভাগ [ক্রিমিনাল ইনভেসটিগেশন ডিপার্টমেন্ট] ছিল। এই বিভাগে বহু প্রাচীন খোঁজী-সম্প্রদায়ের জাত-গোয়েন্দা বহাল ছিল। এরা সমগ্র বাংলাদেশে ও কলকাতা শহরে গোয়েন্দার কাজ করতো। জেলাভিত্তিক বাংলা-পুলিশ ও কলকাতা পুলিশের সঙ্গে এদের সহযোগিতা ছিল।

১৮৩৭ খ্রী. এই যুগ্ম-ব্যবস্থা বাতিল করে কলকাতা পুলিশের নিজস্ব ডিটেকটিভ-বিভাগ স্থাপিত হয়। আজও উহা লালবাজার-ভবনে কার্যরত। জেলা-ভিত্তিক প্রদেশ পুলিশ উহার প্রতি জেলায় নিজস্ব গোয়েন্দা বিভাগ তৈরি করে। তার ফলে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে প্রদেশের জেলাগত পুলিশের শেষ-সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। কলকাতার থানাদারী ও জল-পুলিশ এবং নতুন গোয়েন্দা-বিভাগ এই তিনটি সংস্থা ই এই সময়ে এক য়ুরোপীয় পুলিশ সুপারের অধীন হয়। তবে এই য়ুরোপীয় পুলিশ সুপার জাস্টিস অফ-পিসদের অধীনে কর্মরত রইলেন।

পূর্বের যুগ্ম-গোয়েন্দা বিভাগ বংশানুক্রমে খোঁজী তথা গোয়েন্দাদের দ্বারা অপরাধ-নির্ণয় ও অপহৃত সম্পত্তি উদ্ধার করতো। সমগ্র বাংলাদেশে এদের সুগঠিত ব্যবস্থা ও গতিবিধি ছিল। এরাই আন্তঃজেলার সংযোগ রক্ষা করতো। জনগণ সব সময়েই এই কাজে তাদের সাহায্য করেছে। এরা জমিনদার-শাসকদের সাহায্যপুষ্ট ছিল। অধিকাংশ জমিনদারী-পুলিশ অধিকৃত হলে এরা ক্রমে বিরল হয়।

বিকেন্দ্রিত গোয়েন্দা বিভাগের বেতনভূক পুলিশ-কর্মীরা নিজেরাই ছদ্মবেশে গোয়েন্দাগিরি করতে থাকে। কিন্তু এতে তারা সকল ক্ষেত্রে সফল হতে পারে নি। পরে বশীভূত করে সাধারণ মানুষ ও অপরাধীদের মধ্য হতে গুপ্তচর সংগ্রহ করা হয়। এ প্রথা আজও পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু পূর্বের জাত খোঁজীদের মতো স্বল্পকালে সমগ্র সম্পত্তি এরা উদ্ধার করতে পারে না।

১৮:৮ খ্রী. বার্ড কমিটির সদস্য মিঃ এফ. সি. হ্যালিডের সুপারিশ মতো বাংলা ও কলকাতা পুলিশদ্বয়কে একই পুলিশ প্রধানের অধীন করার প্রস্তাব হয়। কিন্তু তখনও বাংলা-পুলিশ জেলাভিত্তিক। জমিনদারী-পুলিশ সম্পূর্ণ ভাঙা যায় নি। বাংলা-পুলিশ কলকাতা-পুলিশের মতো সুসংহত নয়। ঐতিহ্যময় কলকাতা পুলিশ সাম্রাজ্যের প্রথম পুলিশ। ইংরাজ জাতিরও ইহা একটি গর্বের বস্তু। দেশীয়দের মত লণ্ডন শহর হতেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়। ফলে এই অবাস্তর প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়।

১৮৪৫ খ্রী. কলকাতা-পুলিশ এবং বাংলা পুলিশেও পাইক বরকন্দাজদের প্রাধান্য বেশি। বাংলা-পুলিশের থানা-ইনচার্জের শুধু থানাদারদের বদলে দারোগা করা হয়েছে। কলকাতা পুলিশের থানা-ইনচার্জ তথা থানাদাররাও তখন দারোগা হলেন। কলকাতা-পুলিশে প্রত্যেকজন এবং বাংলা-পুলিশে [বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-ছোটনাগপুর] অধিকাংশ কর্মী তখন স্বস্ব প্রদেশীয়।

পুরানো বাংলা নাটকে কলকাতা পুলিশের মুখের ভাষা—‘কনে কনে?’ [অর্থাৎ কোথায় চোর] তাদের মুখে ‘কাহা কাহা’ শোনা যেতো না। আপদে লোকে পুলিশ-পুলিশ বলে হাঁক-ডাক না করে ‘পাইক-পাইক’ বলে ডাকাডাকি করতো। সেই কালে সাধারণ লোকে পুলিশকে পাইক বলতো।

থানায় কাজকর্ম বরাবরই বাংলা ভাষাতে সমাধা হতো। নথিপত্রের সারাংশ জনৈক ইংরাজীনবিশ ইংরাজ-সুপারিনটেণ্ডেন্টের নিকট তর্জমা করে পাঠাতো। সংখ্যায় স্বল্প হওয়ায় এরা থানাগুলিকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত করে নেয়। কলকাতা পুলিশের ১৯০৮ খ্রী. পর্যন্ত যাবতীয় নথিপত্র বাংলায় লেখা হতো। তারপরে ধীরে ধীরে থানার ভাষা ইংরাজি করা হয়।

[ওইকালে বাংলাদেশের বহুস্থানে বাংলা-পুলিশ জেলাভিত্তিক পুলিশরূপে একজন ইংরাজ পুলিশ-সুপারের অধীনে জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। অবশ্য জমিনদারী-পুলিশও তখনও কিছু-কিছু স্থানে ছিল।]

১৮৪৫ খ্রী. ডালহাউসির নিযুক্ত একটি কমিটির সুপারিসে লণ্ডন-পুলিশের কিছু আইন-কানুন তৎকালীন কলকাতা পুলিশে প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ কলকাতা পুলিশ হতে শেখা বিদ্যা লণ্ডন-পুলিশ কলকাতা-পুলিশকেই শেখায়। এঁরা কলকাতা পুলিশের পদগুলির দেশীয় নাম পরিবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু জনবিক্ষোভের ভয়ে বেশ কিছুকাল ওঁরা তা থেকে বিরত থাকেন।

এরা কলকাতা-পুলিশের বরকন্দাজদের মাসিক বেতন বর্ধিত করে পাঁচটাকা করেন। এতকাল সমগ্র কলকাতা পুলিশ (গোয়েন্দা ও জলপুলিশ-সহ), একজন সুপারিনটেনডেন্টের অধীন ছিল। এঁদের সুপারিশে আর একজন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হলো। এঁরা গোয়েন্দা পুলিশ তথা ডিটেকটিভ-বিভাগকে পৃথক করে ওই নবনিযুক্ত সুপারিনটেনডেন্টের অধীন করেন। সেই সঙ্গে জলপুলিশকেও এই নবনিযুক্ত পুলিশ সুপারের অধীন করা হয়। কলকাতা পুলিশে তখন দু‘জন পুলিশ-সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত হলেন।

১৮৫৬ খ্রী. ডালহাউসির নিযুক্ত কমিশনের সুপারিশে কলকাতায় মিউনসিপ্যাল, বিচার-বিভাগ ও পুলিশ-বিভাগ সম্পূর্ণ পৃথক করা হলো। জাস্টিস অফ-পিসদের পদগুলি বাতিল হয়ে যায়। কলকাতা পৌরসভা একজন পৌর-প্রধানের অধীন হয়। বিচারেব কাজের জন্য জাস্টিস অফ-পিসদের বদলে শহরে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেটদের তিনটি পুলিশ-কোর্ট স্থাপিত হলো। একজন পুলিশ কমিশনারের পদ সৃষ্টি করে কলকাতা-পুলিশকে জলপুলিশ, সল্‌ট-পুলিশ এবং আবগারী পুলিশ ও অগ্নিনির্বাপক দল আদি কয়টি বিভাগও তাঁর অধীন হলো। অবশ্য পরে আবগারী-পুলিশ পৃথক সংস্থা রূপে পৃথক অধিকারের অধীন হয়।

[পুলিশ কোর্টটি পুলিশের সঙ্গে ওই কালে লালবাজারে ছিল। পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য করতে উহাকে ঐ সময় পৃথক পৃথক ভবনে স্থাপিত করা হলো। বর্তমান ব্যাঙ্কশাল কোর্ট ভবনটি তৎজন্য ঐ সময় অধিগৃহীত হয়।]

এই নবনিযুক্ত পুলিশ কমিশনারকে সীমিত ক্ষমতা-সহ অপরাধী গ্রেপ্তার ও আটক এবং শহরে শাস্তি-রক্ষার জন্য জাস্টিস অফ-পিসও করা হলো। ইনি তখন একাধারে পুলিশ-কমিশনার এবং জাস্টিস অফ-পিস।

[কলকাতার পূর্বতন প্রশাসক জাস্টিস অফ-পিসদের নামগুলি এখনো আমি পাই নি। পোল্যাণ্ডের ওয়ারস’ ঘুনিভারসিটির প্রফেসর আমার ভ্রাতা ডঃ হিরণ্ময় ঘোষাল পি. এচ. ডি. আমার তরফে লণ্ডনের ইণ্ডিয়া-অফিসে ও অন্যত্র নথিপত্র ঘেঁটেছে। ওখানে গোবিন্দরাম সম্পর্কে তথ্যাদি পেলেও ঐ জাস্টিসদের নামে সে পায় নি। কিন্তু কারো নামে কিবা আসে যায়। গোবিন্দরামের পুলিশের পর এই জাস্টিস অফ-পিসদের কলকাতা-পুলিশই জনপ্রিয় রূপে স্বীকৃত।]

[বি. দ্র.] কলকাতা-পুলিশকে সৈন্য বাহিনীর সহিত সর্ব প্রথম রামগড়ে নেওয়া হয়। একথা পূর্ব আখ্যানভাগে আমি বলেছি। কলকাতা পুলিশকে দ্বিতীয়বার সৈন্যবাহিনীর সহিত তিতুমিয়ার বাশের কেরা নখলে বারাসতের নিকট একটি স্থানে পাঠানো হয়। অবশ্য বারাসত কলকাতা শহরের কুড়ি মাইলের মধ্যে হওয়ার তারা তার অধিকারী ছিল (তৃতীয়বার কলকাতা-পুলিশ টেগার্ট সাহেবের সহিত বিপ্লবী দমনে চন্দননগরে যায়।) কলকাতা পুলিশকে মোট তিনবার কলকাতার বাইরে অভিযানে যেতে হয়।]

[তিতুমিয়ার বাঁশের কেল্লা ধ্বংস-কালেও সৈন্যদের সাথে কলকাতা পুলিশের একদল তথা সশস্ত্র পাইক ছিল। ‘শুট টু’ কিল—অর্থাৎ হত্যার জন্য গুলি করো, নচেৎ গুলি করো না। এটা একটা পুরানো হুকুম। প্রথমে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করা হয়। তাতে তিতুমিয়ার সঙ্গীরা রটায় : ‘তিতুমিয়া গুলি খা লিয়া’ ফলে পরে বহু জীবনহানি ঘটে। সেই প্রতিবেদনে উক্ত হুকুম প্রথম দেওয়া হয়। সেই হুকুম আজও বাংলা ও কলকাতা পুলিশে রয়েছে।

এ যুগেও ব্লাঙ্ক-ফায়ার করলে বা শূন্যে গুলি ছুড়লে সংশ্লিষ্ট নেতারা লোককে বোঝান যে পুলিশ তাঁদের পক্ষে। এতে পরে বহু ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে। এজন্য পূর্বে বন্দুকের বদলে লাঠি ব্যবহার করা হতো। তৎকালে ঘূর্ণায়মান লাঠির দ্বারা দেশীয় লাঠিয়ালরা বন্দুকের গুলিও আটকেছে।]

এই সময় ভারতব্যাপী সিপাহী মিউটিনি শুরু হলো। এতে ব্রিটিশরা ভারতীয় মাত্রকেই অবিশ্বাস করতে থাকেন। সিপাহী মিউটিনির পর সমগ্র বাংলাদেশের প্রত্যেক স্থানের জমিনদারী-পুলিশ তথা জাতীয় পুলিশ ভেঙে দেওয়া হলো। অমান্যকারীদের এজন্য কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা হয়। ব্রিটিশরা দেশীয় সংগঠনগুলিকে ভয়ের চোখে দেখে। এজন্য প্রয়োজনে মিলিটারীও নিযুক্ত করা হতো।

[বি. দ্র.] সিপাহী মিউটিনির পর ইংলণ্ডেশ্বরী তথা ইংরাজ গর্ভমেন্ট কোম্পানীর নিকট হতে ভারতের শাসন ভার স্বহস্তে গ্রহণ করলেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীতে ইংরাজ ও স্কচ উভয় জাতিই ছিল। রাজত্ব হস্তাস্তরে অধিকাংশ স্কচ কোম্পানীর ব্যবসায় বিভাগে এবং অধিকাংশ ইংরাজ উহার গর্ভমেন্ট বিভাগে চলে এসেছিল। এতে ইংরাজদের জনপ্রিয়তা বাড়ে।

এবার সমগ্র প্রদেশব্যাপী নীরব বিক্ষোভ। কলকাতা পুলিশের পাইকুরাও সন্ত্রস্ত! এদের আশংকা ও অনুমান ভুল হয় নি। এই নীরব বয়কটের ফল অবিলম্বে ফললো। কলকাতা-পুলিশের নিম্নপদগুলি বাঙালীশূন্য করা হলো।

দেওয়ান, পূর্বতন দারোগা ও থানাদাররা পূর্বেই বাতিল হয়েছিল। এবার পাইক-বরকন্দাজদের বিদায় নিতে হলো। সুবা-বাংলার পুলিশেরও একই অবস্থা। ব্রিটিশরা নিম্নপদী বাঙালী পুলিশকে বিশ্বাস করেন নি। তবে পরবর্তীকালের থানাগুলির দারোগারা রাজভক্তির যথেষ্ট পরিচয় দেন। তাই তাদেরই শুধু বিশ্বাস করা হয়। এবং বহাল তবিয়তে রাখা হয়। সুবা বাংলার জাতীয় ঐতিহ্যের শেষ-চিহ্ন বিলুপ্ত হলো।

দায়িত্বহীন ও কর্তৃত্বহীন নতুন জমিনদাররা অলস ও উৎপীড়ক হয়। এদের অধিকাংশ পত্তনীদার ও কলকাতার ব্যবসায়ী। পূর্বতন রাজবংশের অধিকাংশই বিলুপ্ত। তাদের উত্তরপুরুষরা জানে না যে তারা কোন্ রাজবংশের সন্তান। কারণ এদের অধিকাংশ‍ই দু‘পুরুষের অধিক পূর্বপুরুষের নাম জানে না। এরাই বোধকরি ভারত হতে ব্রিটিশ-বিতাড়নে অধিক উৎসাহী ছিল।]

সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য কলকাতা হতে যাবতীয় সেনাবাহিনীকে উত্তরভারতে প্রেরণ করে কলকাতা পুলিশকে শহর রক্ষার ভার দেওয়া হয়। এই কার্য কলকাতা-পুলিশ সুষ্ঠুরূপে ও নির্ভয়ে দক্ষতার সহিত সমাধা করেছিল।

সিপাই মিউটিনিব পর দেশীয় সৈন্যদের বহু বাহিনী ভেঙে দেওয়া হয়। তাদের স্থলে ইংল্যাণ্ড হতে গোরা-সৈন্যদের আনা হলো। ঐ সকল বরখাস্ত অথচ অনুগত সিপাহীদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয়। তাই কলকাতা ও বাংলা-পুলিশের বাঙালী-পরিত্যক্ত নিম্নপদগুলি পূরণে আর অসুবিধা নেই। সিপাহী, জমাদার ও হাবিলদারদের দলে দলে কলকাতা ও বাংলা-পুলিশে ভর্তি করা হলো। পুরানো পুলিশের পাইক ও নায়কদের যথাক্রমে সিপাহী ও জমাদার নাম হলো।

[বি.দ্র.] ১৮৫৭ খ্রী. কলকাতার নিকটবর্তী বারাকপুর হতে সিপাই মিউটিনি শুরু হলো। তখন মাত্র বাংলাদেশে সুগঠিত ও বৃহৎ সমরশক্তি সম্পন্ন কলকাতা ও বাংলা-পুলিশ। তাবা নিয়োগ-কর্তাদেব প্রতি অনুগত থাকাই পছন্দ করে। বিশ্বাসঘাতকতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা তাদের ঐতিহ্য-বিরোধী। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ইংরাজ শাসকরাই তাদের প্রতি করলেন। সিপাহী-বিদ্রোহের পর তাদের বিদায় দিয়ে ঐ সিপাহীদের দ্বারাই কলকাতা ও বাংলা-পুলিশের নিম্নপদগুলি তাঁরা পূরণ করলেন।

[সিপাহী-বিদ্রোহ কলকাতার সন্নিকটে বারাকপুর ছাউনিতে প্রথম শুরু হয়। ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটি কলকাতা দখল না করে তারা দিল্লী-চলো ধ্বনি দেয়। নেতৃত্বহীন দেশওয়ালী মুল্লুকী সিপাহীরা তখন স্ব স্ব মুল্লুকে ফিরতেই বেশি আগ্রহী। ওরা কলকাতা দখল করলে কানপুরের পতন অতো সহজ হতো না।

সিপাহী-মিউটিনি দমনের খরচ ওঠাতে প্রথম আয়কর গ্রহণ করা হয়। পরে সমগ্র পৃথিবীতে তার অনুকরণে রাজস্ব বাড়াতে আয়কর প্রথার সৃষ্টি হয়।]

ব্রিটিশ প্রথম কিছু বাঙালী-সামস্তদের নিজস্ব ফৌজের বিলুপ্তি ঘটায়। হেস্টিংস তাঁদের বিচারালয়গুলি বাতিল করেন। কর্নওয়ালিশ ও পরবর্তীরা জাতীয় পুলিশ ভেঙে দেন। কিন্তু তাদের জাতীয় দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইন রঙ্গে যায়। এগুলি প্রাচীন হিন্দু-আইন ও মুসলিম-আইন অদল-বদল করে জমিনদার-শাসকরা যুগোপযোগী করে ব্রাহ্মণ ও মৌলবীদের সাহায্যে ও অনুমোদনে তৈরি করেছিলেন। অধিগৃহীত ব্রিটিশ-আদালতগুলিতেও এদেশীয় আইনে বিচার করা হতো। জনগণের ইচ্ছা ও বিবেকের সঙ্গে তা সংগতিপূর্ণ ছিল। অবশ্য সুপ্রীম কোর্ট মাত্র একবার, নন্দকুমারের বিচারে বিলাতি আইনের সাহায্য নেন। বাংলাদেশের আদালতগুলির বিচারপদ্ধতি বহুকাল পূর্বের অনুরূপ ছিল।

১৮৪০ খ্রী. বাঙালী-বিদ্বেষী বেনথাম ও মিল-সাহেব দেশীয় আইনের পরিবর্তে য়ুরোপীয় আইনের জন্য প্রতিবেদন দিলেন। মেকলের অধীনে এই উদ্দেশ্যে একটি আইন-কমিশন বসল। তাঁরা ইণ্ডিয়ান পিনাল কোডের আইনগুলি বিলাতি আইন-অনুসারে তৈরি করলেন। কিন্তু তখনও বাংলার বহু স্থানে বৈধ ও অবৈধ জমিনদারী-পুলিশ ও দেশীয় আইন বর্তমান থাকায় ব্রাহ্মণ ও মৌলভী সমাজ ও জনগণ তার বিরোধী হয়ে উঠলো। তাই পরবর্তী কুড়ি বৎসর ওই আইন কায়েম হলো না। ঐ সময় জনগণ এবং ব্রাহ্মণ ও মৌলভীদের সম্মিলিত মতবাদের সারাংশ নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।

“বিদেশী আইন এ-দেশের ধ্যান ও ধারণার উপযোগী নয়। আইন স্বল্পসংখ্যক, সুবোধ্য, জনপ্রিয়, সরল ও পালনযোগ্য হতে হবে। কিছু দেশীয় আইন তাতে সংযোজিত হলেও তার ইংরাজিকরণ দুর্বোধ্য। তার ব্যাখ্যার জন্য বহু টিকা টিপ্পনীর প্রয়োজন হবে। মামলাগুলির মিটমাট করার ব্যবস্থা ওতে নেই। এক শ্রেণী লোভী দালাল ও আইনজীবীর প্রয়োজন অনিবার্য। লোকে আর বিনা ব্যয়ে বিচার পাবে না। আইনের ফাকে দোষীরা সাজা এড়াবে ও নির্দোষীরা সাজা পাবে। জনগণ মিথ্যা-সাক্ষী দিতে শিখবে। আইন অমান্যকারী অপরাধী ও পাপীদের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। জনগণ অশাস্ত, মামলাবাজ, লোকমত-বিরোধী ও অসামাজিক হবে। বাদী, প্রতিবাদী ও উভয়পক্ষের সমর্থকরা ও সাক্ষীরা মুহু মুহুঃ উত্তেজনাজনিত মতিভ্রমগ্রপ্ত এবং অপরাধীমনা হবে।”

জনগণের অনিচ্ছা সত্ত্বেও কুড়ি বৎসর যাবৎ বহু বাদানুবাদ ও টালবাহানার পর কলকাতা ও বাংলা-সহ সমগ্র ভারতের জন্য স্যার বেরিয়া পিকরের কর্তৃত্বাধীনে ১৮৬২ খ্রী. এই আইন বিধিবদ্ধ হলো। কিন্তু উহা আরোপণের জন্য ১লা জানুয়ারী ১৮৬২ খ্রী. পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

বাঙালী এতদিনে তাদের জাতীয় ফৌজ, পুলিশ, আদালত এবং জাতীয় আইনহীন প্রায় পরাধীন জাতিতে পরিণত। কিন্তু মনের স্বাধীনতা তারা কোনও দিন হারায় নি। গ্রামীণ লোকদের পক্ষে একথা বিশেষরূপে প্রযোজ্য।

মিঃ ককবার্ন, আই. সি. এস.

[Mr. Cockburn, I. C. S.]

ভালহাউসির সময় কলকাতা পুলিশে কমিশনার-পদসৃষ্টির পর কলকাতা পুলিশকে পুনর্বার নূতন করে তৈরি করা হলো। ডালহাউসি নিযুক্ত একটি রিফর্ম কমিটির সুপারিশে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের মিঃ ককবার্ন, আই. সি. এস. কলকাতার প্রথম পুলিশ-কমিশনার হলেন [১৮৫০-৫৬ খ্রী.]

তাঁর সময়ে কলকাতা পৌরসভা, বিচার-বিভাগ এবং পুলিশ-বিভাগ তিনটি পৃথক সংস্থায় পরিণত হয়। কলকাতা শহরে প্রথম জুডিসিয়ারি ও একসিকিউটিভ এবং পৌরকার্য পৃথকীকৃত হলো।

পূর্বে কলকাতা পুলিশ হিংস্র পশুবধ ও অন্য পশু ধরার কাজ করতো। অগ্নিনির্বাপণের কাজও তাদের করতে হতো। পশুধরা (হিংস্র পশু তখন নেই) ও অগ্নিনির্বাপণ পুলিশের হাতে বইল। এই সব কাজ তখন থানাভিত্তিক ছিল।

[পরে অগ্নিনির্বাপণের ভার পৃথক সংস্থার অধীনে হেড-কোয়ার্টাবস পুলিশের অধীন হয়। এখন এই কাজ একটি পৃথক ডাইরেকটরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গবাদির জন্য ক্যাটেল পাউণ্ড ও কুকুরাদির জন্য ভগ পাউণ্ড আজও কলকাতা পুলিশের অধীন। সৃষ্টিকাল হতে কলকাতায় বিচারের কাজ দেশীয় আইনে হতো। জমিনদার-শাসকদের মতো কলকাতার পুলিশ-প্রধানরা নিজেরা আইন প্রণয়ন করতেন। কলকাতায় একসিকিউটিভ-ক্ষমতা পুলিশ কমিশনাবের উপর ছিল। প্রয়োজনমতো শহর-শাসনে কিছু উপ-আইন এঁরা তৈরি করতেন। পৃথকীকৃত বিচার বিভাগে ঐ সকল আইনে বিচারের কাজ করতেন। কিন্তু বিচার-ক্ষমতা ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেটের অন্য ক্ষমতা কলকাতা পুলিশের থাকে। তাঁরা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন। তদন্তান্তে কয়েদীদের নিজেরাই মুক্তি দিতেন। প্রয়োজনমতো কমিশনার কয়েদীদের হাজতে রাখতেন। [পুলিশ অ্যাক্টের একটি ধারামতো আজও তারা কিছু উপ-আইন পূর্বের মতো তৈরি করার অধিকারী।]

অভিযুক্তরা রাজী হলে কমিশনার সাহেব ছোট মামলা বিচার করে তাদের সামান্ত জরিমানা করে মুক্তি দিতেন। কিন্তু ওরা রাজী না হলে মামলা আদালতে যেতো। [উক্ত প্রথানুযায়ী পরবর্তীকালে কলকাতার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার পুওর ফাণ্ডে চাঁদা গ্রহণ করে আসামীদের কোর্টে না পাঠিয়ে মুক্তি দিতেন। এতে তারা সাবধান হবার ও শোধরাবার সুযোগ পেতো। দামী না হওয়াতে এদের জীবন বিফল বা মনোকষ্ট হতো না। ঐ প্রথা অপরাধীর সংখ্যা কমানোর সহায়ক। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা কায়েম ছিল।]

মিঃ ওয়াটচপ

[Mr. Wattchope]

মি. ওয়াটচপ, আই. সি. এস. (১৮৫৭-৬৩ খ্রী.) কলকাতা পুলিশের দ্বিতীয় পুলিশ-কমিশনার হলেন। তাঁর কর্মকাল ঘটনাবহুল ছিল। তাঁর কর্মকালের দ্বিতীয় বৎসরে (১৮৫৭ খ্রী.) সিপাই-বিদ্রোহ শুরু হয়। ওই বিদ্রোহের শেষে মহারানি ভিক্টোরিয়া কোম্পানির নিকট হতে ভারতের শাসনভার নেন। তখন কলকাতা পুলিশ ক্রাউন-পুলিশ আখ্যা পায়।

মিঃ ওয়াটচপের কর্মকালের পঞ্চম বর্ষে কুড়ি বৎসর যাবৎ মুলতবি রাখা ইণ্ডিয়ান পিনাল-কোড দেশীয় আইনের পরিবর্তে ১৮৬২ খ্রী. কলকাতা-সহ ভারতে প্রথম আরোপিত হয়। কিছুকাল পূর্বতন আইন ও উক্ত পিনাল কোড পাশাপাশি চলে। তাতে অসুবিধা হওয়ায়, বহু পরে দেশীয় আইনগুলি বাছাই করে কলকাতা-পুলিশ-অ্যাক্ট পরবর্তী কমিশনারের সময় ১৮৬৬ খ্রী. তৈরি হয়।

বি. দ্র. ইংরাজরা প্রথমে বাঙালীর সৈন্যদল ও পরেতে তাদের নিজস্ব বিচার-ব্যবস্থা ও তার পরে তাদের নিজস্ব জাতীয় পুলিশ কেড়ে নেয়। এইবার তারা তাদের দেশীয় আইনগুলিরও বিলোপ ঘটালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও জনগণ স্বেচ্ছায় পূর্বতন জমিনদার ও পল্লীর মান্যগণ্যদের নিকট বিচারপ্রার্থী হতো। এ অবস্থা এড়াতে এবং হৃতসর্বস্ব জমিনদারদের খুশি রাখতে শাসককুল তাদের ও পল্লীর ধনী মানীদের মধ্য হতে অনারারি হাকিম নিযুক্ত করতে থাকেন। এঁরা ধনী সম্মানীয় হওয়ায় উৎকোচ উপঢৌকন গ্রহণ করতেন না এবং সম্ভবমতো মামলা-সমূহ মিটিয়ে দিতেন। পল্লীর জনগণ আজও পর্যন্ত তাদের পূর্ব-অভ্যাস ত্যাগ করেন নি। এ যুগেও তারা বিচারের জন্য পল্লীর মোড়ল ও পাচজনের দ্বারস্থ হয়। মামলাবাজ না হলে ইলেকটেড পঞ্চায়েত ও যুনিয়ন-বোর্ডের বিচারও তাদের পছন্দ নয়। মান্যগণ্যদের বেছে নমিনেট করে এই অবস্থা এড়ানো যায়। কারণ সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিরা প্রায় ইলেকসনের ঝামেলা সহ্য করতেও দলভুক্ত হতে চায় না। অধিকন্তু এ-ও স্বীকার্য যে দল ও গোষ্ঠীভুক্ত ব্যক্তিগণ নিরপেক্ষ হতে পারে না।

কমিশনার ওয়াটচপের কর্মকালের শেষ বছরে বাঙালী পাইক ও নায়কদের কলকাতা ও বাংলা-পুলিশ হতে বিদায় দিয়ে সেক্ষেত্রে নিম্ন-পদগুলি হিন্দীভাষী ফৌজী সিপাহী জমাদার হাবিলদারদের দ্বারা পূরণ করা হয়। সিপাহী বিদ্রোহের পর ডিসব্যাডেড সিপাহী জমাদারদের পুনর্বাসনের জন্য তার প্রয়োজন হয়। তবে উভয়-পুলিশের মধ্যবর্তী পদগুলি পূর্বের মতো বাঙালীদের দ্বারাই অধিকৃত থাকে।

মিঃ ওয়াটচপের কর্মকালে হাওড়া-শহর চার বৎসরের জন্য কলকাতা পুলিশের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু নদী-পারাপারের সুব্যবস্থার অভাবে অসুবিধা দেখা দেয়। ফলে, পরবর্তীকালে হাওড়া-শহরকে কলকাতা পুলিশ হতে বার করে বাংলা-পুলিশে দেওয়া হয়।

তাঁর কর্মকালের শেষ বছরে তিনি কলকাতা সিপাই জমাদারদের পদগুলিকে কনেস্টবল ও হেড-কনেস্টবল করেন। পুলিশের মধ্যবর্তী পদগুলিরও তিনি ইন্সপেক্টর-আদি ইংরাজী নামকরণ করেন। তবে পুলিশের কাজকর্ম ও থানার নথিপত্র পূর্বের মতো বাংলায় লেখা হতে থাকে।

[তৎকালীন সেরেস্তা, লালকেতাব, অভিযোগ-বহি, বয়াম তথা ভিসারা, তদন্ত কার্য, মালখানা, ময়না-তদন্ত, সরজমিন তদস্ত, খানা-তন্ত্রাস, আসামী, এলাকা, চৌকী, ফাড়ী, থানা, ফরিয়াদী, গ্রেপ্তার, মুন্সীবাবু, হাতকড়া, হাজত ঘর, মামলা দায়ের, দায়রা আদালত, সোপর্দকরণ, উর্দী, পেটি তথা বেল্ট, জবানবন্দীগ্রহণ, বয়ান-লেখা, হাকিম-সাহেব, পেশকার, চৌহদ্দী, গরহাজির, গালতি বেয়াদবী প্রভৃতি বাংলা নাম আজও রয়ে গেছে।]

কমিশনার ওয়াটচপ বাংলা-পুলিশেও বহু পরিবর্তন ঘটান। বাংলা পুলিশের উন্নতির জন্য ১৮৯৩ খ্রী. একটি কমিটি গঠিত হয়। কলকাতার পুলিশ কমিশনার ওয়াটচপ ওই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন। মাদ্রাজের মিঃ রবীনসন, সীমান্ত-প্রদেশের মিঃ কট, পেগুর মিঃ ফয়েড তার সদস্য হন। উদ্দেশ্য—বাংলা ও কলকাতা পুলিশ হতে দেশীয় পদগুলি বাতিল করে লণ্ডনের মতো কনস্টেবল, ইনস্পেক্টর প্রভৃতি করা। এই কাজ উভয়-পুলিশেই (বাংলা ও কলকাতা) কিছু আগে ও পরে সমাধা হয়। উক্ত কমিশন বাংলা-পুলিশে উল্লেখ্য পরিবর্তন আনে। বাংলা-পুলিশে পুনর্গঠন একে বলা চলে। এই কমিশন আধুনিক বাংলা-পুলিশের কাঠামো তৈরি করে। অবশ্য এর পরে অন্য কমিশনও তার পরিবর্তন ঘটায়।

প্রদেশ-পুলিশে সুপারিনটেণ্ডেণ্টদের সাহায্যের জন্য একজন এ্যাসিসটেন্ট পুলিশ সুপার নিযুক্ত হয়। এদের অধীনে প্রতিটি সার্কেলের জন্য একজন সার্কেল-ইনস্পেক্টর বহাল হলো। দারোগার বদলে সাব-ইনস্পেক্টরকে থানা ইনচার্জ করা হলো। থানার অধীন ফাঁড়িগুলির ভার হেড কনস্টেবলদের উপর রইলো। পুলিশ জেলাভিত্তিক রূপে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীন থাকলো না। তাকে প্রদেশ-ভিত্তিক করে একজন ইনস্পেক্টর-জেনারেলের অধীন করা হলো। ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের এক ব্যক্তিকে ইনস্পেক্টর-জেনারেল করা হয়। থানার ইনচার্জদের তদস্তাদিতে সাহায্যের জন্য জুনিয়ার সাব-ইনস্পেক্টররা রইলেন। পূর্বে এ সকল কাজে পুলিশের নায়েবরা থানাদারদের সাহায্য করতো।

পুলিশ সুপার ও এ্যাসিসটেন্ট-সুপারগণের পদে মাত্র ইংরাজদের ভর্তি করা হতো। এঁদের সরাসরি ইংল্যাণ্ড হতে আমদানি করা হয়। কোনও ভারতীয়কে এ-পদগুলিতে নেওয়া হতো না। ব্যতিক্রম হিসাবে আমার পিতামহ রায়বাহাদুর কমলাপতি ঘোষাল-কে (জন্ম ১৮২০ খ্রী.) প্রথম ভারতীয় এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ-সুপার করা হয়। [এ সময়ে পুলিশ-ইনস্পেক্টর পদ হতে বহু ব্যক্তিকে ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেটের পদে উন্নীত করা হতো। এদের সাহেবী-পদ এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ সুপার করা হতো না। এ-পদ শুধু য়ুরোপীয়দের জন্য সংরক্ষিত ছিল। ডেপুটি পুলিশ সুপারের পদ তখনও সৃষ্টি হয় নি।

পুলিশ-ইনস্পেক্টর পদে নিয়োগের জন্য মাত্র এক বৎসর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু শীঘ্রই দেখা যায় যে পুঁথিগত বিদ্যায় ব্যুৎপন্ন ব্যক্তিরা দক্ষ পুলিশ-কর্মী হন না। এজন্য পরে এ-প্রথা পরিত্যক্ত হয় এবং তাদের পূর্বের মতো মনোনীত করা হতে থাকে। তবে কিছু ব্যক্তিকে বাহির হতে সরাসরি ইনস্পেক্টর পদে নিয়োগ করা হয়। ওদের কিছু ব্যক্তিকে ঐ-পদে সাব-ইনস্পেক্টর হতে উন্নীত করা হয়।] নতুন আইনে জেলাভিত্তিক বাংলা-পুলিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীন হতে মুক্ত হলো। তবে বিচার ও আইন-সম্পর্কিত তাঁদের আদেশসমূহ পুলিশকে মানতে হবে। পূর্বের মতো পুলিশ ছোট মামলা [Non-Cog] তদন্ত করতে পারবে না। অপরাধ-সমূহ পুলিশ-অগ্রাহ্য ও পুলিশ-গ্রাহ্য [Cog] রূপে বিভক্ত হলো। পুলিশ-অগ্রাহ্য মামলা শুধু হাকিমের এক্তিয়ারে থাকবে। সকল বিচার কার্য মাত্র হাকিমরা করবে। পুলিশ-প্রধানদের কোনও বিচার ক্ষমতা থাকবে না।

বাংলা-পুলিশে এ সময় ইনস্পেকটরদের একশত টাকা এবং সাব-ইনস্পেকটরদের পঞ্চাশ টাকা মাসিক বেতন ছিল।

[দারোগা পদটির নামও বিলুপ্ত হলো। পরে সাব-ইনস্পেক্টররা তাদের দারোগা বললে ক্রুদ্ধ হতো। এ নামের উপর জনতার আজও মোহ। জনগণ তাই এখনও তাদের এ নামে ডাকে।]

কলকাতা-পুলিশ অপেক্ষা বাংলা-পুলিশের জীবন বহু গুণে কঠোর। আমার পিতামহ রায় বাহাদুর (বাংলার তৃতীয় রায় বাহাদুর) কমলাপতি ঘোষাল প্রথম দেশীয় এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ সুপার হন। শৈশবে ছিয়ানব্বই বর্ষ বয়স্কা পিতামহীর নিকট পুরানো পুলিশের বহু কাহিনী শুনেছি। পিতামহীর মুখে শোনা বিবরণের কিছুটা নিয়ে উদ্ধৃত করছি।

“বজরাতে করে পিতামহ থানাগুলি বাৎসরিক পরিদর্শনে যেতেন। ঐ বজরাতে পিতামহীও থেকেছেন। সম্মুখে ও পিছনে দুইটি ছই-ঢাকা বড় নৌকা। তাতে ঢাল-তরোয়াল বর্ণা ও বন্দুকধারী শাস্ত্রী। ঘাটে ঘাটে পালকি থাকত। এ পালকিতে চেপে তিনি থানা-পরিদর্শন করতেন। পরে সেই বজরাতে তিনি ফিরতেন। মাসাধিক কাল নদীতে বাস করে তাঁরা বাংলোয় ফিরতেন। ঘাটে তাঁদের জন্য পালকি তৈরি থাকতো। বাংলোর সম্মুখে কয়েকজন শাস্ত্রী সারা রাত ডিউটি দিতো। একজন শাস্ত্রী রাত্রে সেখানে আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। অন্যান্য শাস্ত্রীদের ঢাক-ডিউটি থাকতো। নিকটে বাঘের গর্জন শোনা মাত্র তারা ঢাকে কাঠি দিত। তারা সারারাত্রি ঢাক পিটিয়ে বাঘ তাড়াতো। মধ্যে মধ্যে বাংলোর রোয়াক পর্যন্ত কুমির উঠে এসেছে। তাদের রেডির তেলের ডিবা ও মশালের আগুন ছিল সম্বল। সাপ-মশা তাড়াতে ধুনো দেওয়ার জন্য ধহুচি-আর্দালী ছিল। বাংলোর ঘরে মোমবাতির ঝাড় জ্বলতো। একজন সাপুডেকে ওইকালে সাপ তাড়াবার জন্য কনস্টেবলরূপে ভর্তি করা হতো।

বাংলা প্রদেশ-পুলিশ সম্বন্ধে কিছুটা বলা হলো। কারণ, একই সঙ্গে উভয়-পুলিশের পরিবর্তন ঘটে। এই সময় কলকাতা-পুলিশ পুনরায় কলকাতা পৌরসভার সহিত যুক্ত হয়।

১৮৬৪ খ্রী. স্যানিটারি-কমিশনার জন টার্চ কমিটির সুপারিশে ঠিক হলো যে একই ব্যক্তি কলকাতা-পুলিশের কমিশনার ও কলকাতা পৌরসভার চেয়ারম্যান হবেন। কারণ, কলকাতা-পৌরসভা পুলিশবাহিনী হয়ে ভালো চলছিল না। আজও কলকাতা করপোরেশন মধ্যে মধ্যে কলকাতা পুলিশের সাহায্য নেয়।

মিঃ স্কাল্‌চ

(Mr. Schalch)

১৮৬৪ খ্রী. উক্ত কমিশনের সুপারিশমতো মিঃ ওয়াট চপের পরে কলকাতা-পুলিশের তৃতীয় কমিশনার মি. স্কাল্‌চ এই যুগ্মপদে প্রথম অধিষ্ঠিত হলেন। বাগবাজারের কুমোরটুলিতে শক (Shalch) স্ট্রীট তাঁর স্মৃতি বহন করছে। করপোরেশন ও পুলিশ-বিভাগ : একত্রে এ দুটির গুরুভার বহন সহজ নয়। এ কারণে, তাঁকে সাহায্যের জন্য মাসিক একহাজার পাঁচশত টাকা বেতনে ১৮৬৪ খ্রী. একজন ডেপুটি পুলিশ কমিশনার নিযুক্ত হলেন। এঁদের দুজনকে একবার মিউনিসিপ্যাল অফিসে আর-একবার পুলিশ-অফিসে ছুটাছুটি করতে হতো।

মিঃ স্কাল্‌চ ১৮৬৪ খ্রী. হতে ১৮৮৬ খ্রী. পর্যন্ত কলকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন। তাঁর চেষ্টাতেই কলকাতার শহরতলিকে চব্বিশ পরগণা হতে বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় পূর্বের মতো কলকাতা-পুলিশের অধীন করা হয়। কলকাতার মিউনিসিপ্যাল এলাকাও সেই অনুযায়ী বাড়ে। তাঁর কর্মকালের মধ্যে কলকাতা-পুলিশ-এ্যাক্‌ট বিধিবদ্ধ হয়। কাউওয়েল-সাহেব এক সভায় তার সারমর্ম বোঝান। প্রচলিত দেশীয় আইন বাছাই করে এই এ্যাক্‌ট নগরবাসীদের ইচ্ছায় তৈরি হয়। কলকাতা-পুলিশ-এ্যাকুটের সারমর্ম নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।

‘কলকাতা-পুলিশের সমস্ত তত্ত্বাবধানের ভার পুলিশ কমিশনার নামে এক ব্যক্তির হস্তে থাকবে। তিনি লেফটেন্যান্ট গভর্নর তথা ছোট লাট কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। পুলিশ-কমিশনার সাহেব মাত্র ছোট লাটের কাছে জবাবদিহি হবেন। উক্ত পুলিশ-কমিশনার সাহেবের আদেশ কার্যকরী করার জন্যে ছোটলাট-বাহাদুর ইচ্ছামতো পুলিশ কমিশনারের অধীনে একাধিক ডেপুটি পুলিশ কমিশনার নিযুক্ত করবেন। কলকাতা শহরের জন্য বিশেষ এক প্রকার ফৌজ থাকবে। তার লোকসংখ্যা ভারত-গভর্নমেন্টের সম্মতিক্রমে ছোটলাট-বাহাদুর ঠিক করবেন। পুলিশ কমিশনার সাহেক স্বয়ং ঐ সকল লোককে নিযুক্ত করবেন। তাদের অর্থদণ্ড বা পদচ্যুতি গভর্নমেন্টের অনুমতি ব্যতিরেকে তিনি করতে পারবেন। তাদের য়ুনিফর্ম ও অস্ত্র বহন আদিও তাঁর মতে হবে। আবশ্যক হলে পুলিশ কমিশনার সাধারণের মধ্য থেকে পুলিশের ক্ষমতাবিশিষ্ট স্পেশাল কনস্টেবল নিযুক্ত করতে পারবেন।’

এই আইনে কলকাতার কোনও পুলিশকর্মী পুলিশ কমিশনারের হুকুমের বিরুদ্ধে কোথাও আপীল করতে পারতেন না। কিন্তু বাংলা-পুলিশকর্মীরা ইনস্পেক্টর-জেনারেলের আদেশের বিরুদ্ধে যথাক্রমে প্রাদেশিক ও ভারত গভর্নমেন্টে ও বিলাতের ইণ্ডিয়া-হাউসে আপীল করতে সক্ষম ছিলেন। বাংলা-পুলিশের বহু সাব-ইনস্পেক্টর ইণ্ডিয়া-হাউসে সেক্রেটারি অফ স্টেটের নিকট আপীল করে তাদের বরখাস্তের হুকুম বাতিল করেছেন। এঁদের একজন থানা-ইনচার্জ স্বয়ং বিলাতে উপস্থিত হয়ে তাঁর মামলার সওয়াল করেন। ওখানকার অধিকর্তা জনৈক লর্ড রায়-দান প্রসঙ্গ লেখেন : ‘বেশী এ্যাগ্রিভড না হলে উনি এত অর্থব্যয়ে এতদূর আসতেন না। অতএব তাঁকে আমরা পুনর্বহালের হুকুম দিলাম।’ জঘন্য অপরাধে অপরাধী* একজন অফিসরকে ওঁরা মুক্তি দেন। বরখাস্তকারী য়ুরোপীয় ঊর্ধ্ব তনকে তাঁরা কঠোর সমালোচনা করেন।

[* Committing Sodomy on the Maji [মাঝি] of a Nouka [নৌকা] and outraging the modesty of Chowkidar’s wife.]

কলকাতা পুলিশ এ্যাক্‌ট

ইণ্ডিয়ান পিনাল-কোড বিধিবদ্ধ হওয়ায় কলকাতা পুলিশের অন্য বিষয়ে অসুবিধা ঘটে। শহর সুরক্ষণে কলকাতা পুলিশ আবহমানকাল হতে অতিরিক্ত ক্ষমতার অধিকারী। প্রাচীনকাল হতে ভারতীয় পুলিশের কিছু ক্ষমতা সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে।

ঐগুলিকে আইনী ও তার বহির্ভূত কাজকে বে-আইনী বলা হতো। হিন্দু-আমলের ও জমিনদারী আমলের ঐ আইন মতো কলকাতা-পুলিশ কাজ করতো। তৎকালে প্রচলিত পুলিশ ক্ষমতা পৃথকরূপে ক্যালকাটা পুলিশ-এ্যাক্টে (১৮৬৬ খ্রী.) বিধিবদ্ধ হয়। তার ভাষায় পাণ্ডিত্যপূর্ণ আইনী মারপ্যাচ নেই। সেটি সহজবোধ্য বাংলার সরল ইংরাজী অনুবাদ। প্রাচীন ঐতিহ্যমতো তাতে উল্লিখিত দণ্ড যৎসামান্য। এই এ্যাটে ইণ্ডিয়ান পিনাল কোডের অতিরিক্ত বহু ক্ষমতা কলকাতা-পুলিশের আছে। তার প্রয়োগ ও বিচার পূর্বকালের মতো দ্রুত সমাধা হয়। কয়েকটি বিষয়ে (চোরাই মাল উদ্ধার এবং জুয়া প্রভৃতি) কলকাতার পুলিশ-প্রধান তল্লাসী-পরোয়ানা প্রদানেও সক্ষম।

“আমি এনফোর্সমেন্ট ও এ্যান্টি-রাউডির ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার থাকাকালে একটি বাসগৃহের সম্মুখে ওয়াচ মোতায়েন করি। প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কৈফিয়ত চান কোন্ আইনে উহা করা হলো। কলকাতা পুলিশ এ্যাক্টের ধারায় আছে যে, পুলিশ যে-কোনও স্থান হতে যে-কোনও উপায়ে সংবাদ সংগ্রহ করবে। হাকিমকে বলা হয় যে ঐ ধারা মতে আমার হুকুমে ওখানে পুলিশ-পোস্টেড হয়েছে।”

“এক ভদ্রলোক অনুমতি-সহ একদিন রাইটার্সে এলেন। সেখানে করিডরে তিনি থুতু নিক্ষেপ করায় গ্রেপ্তার হলেন। কমিটিঙ, নুইসেন্স ধারাটি মাত্র পাবলিক রোড বা প্লেস সম্পর্কে প্রযোজ্য। উপরন্তু থুতু নিক্ষেপ নুইসেন্সের মধ্যে পড়ে না। এখানে ওঁর লিগালি এন্টারিঙ হলেও ইলিগালি রিমেনিঙ হয়েছে। কারণ তারা সেখানে তিনি অন্যের বিরক্তি উৎপাদন করলেন। কলকাতা পুলিশ-এ্যাক্টের … সিম্পিল ট্রেসপাস ধারায় তিনি অভিযুক্ত হলেন।”

পূর্বকালে ব্যক্তিগত স্বার্থে নাগরিকদের হয়রানি করলে পুলিশ কর্মীর সাজা হতো। এই পুরানো ধারাটিও কলকাতা পুলিশ-এ্যাক্টে সংযোজিত হয়। ‘তাতে ম্যালিস’ প্রমাণ হলে পুলিশকর্মীর কঠোর দণ্ডের ব্যবস্থা আছে।

কলকাতা পুলিশ-এ্যাক্টের ধারা অনুযায়ী পুলিশ কমিশনার পূর্বের মতো প্রয়োজনে কিছু উপ-আইন স্বয়ং তৈরি করতে পারেন। হিন্দু-রাজারা, নবাবরা এবং জমিনদার-শাসকরাও এরূপ আইন প্রণয়ন করতেন। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন দেশীয় কানুনই কলকাতা পুলিশ-এ্যাটে বিধিবদ্ধ।

পুরানো কলকাতার হাকিমদের সামারি-ট্রায়েল-এর মতো বর্তমান কলকাতার প্রেসিডেন্সি-ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিচার কার্যে নথি লিখতে আইনত বাধ্য নন। কিন্তু মফস্বলের হাকিমরা প্রাচীন ব্রাহ্মণ-আদালতের মতো সুচারুরূপে নথি রক্ষণ করতে আইনত বাধ্য। কলকাতার প্রেসিডেন্সি-ম্যাজিস্ট্রেটরা পঞ্চায়েত ও কাজীদের মতো সংক্ষেপে নিম্নোক্তরূপ বিচার করতেন। পরে হাইকোর্ট নম্রভাবে জানান যে আইন যা-ই থাকুক, আপিলকালে তাঁদের বোঝবার মতো নথি রাখুন।

“Ex. P. W. I, 2, 3 +4 দে’ প্রভণ্ড, দি কেস U/S 379 I.P. C. হার্ড বোথ পার্টিস। একুইসড টু ফিফটিন্‌ ডেস্ R. I. প্রপারটি টু কমপ্লেন্ট।”

কলকাতা-পুলিশও কলকাতা-পুলিশ-এ্যাটের ধারায় ডায়েরি লেখে। তারাও সংক্ষেপে ডায়েরি লেখার অধিকারী। ইচ্ছা করলে তারা শুধু পকেট-বুকেও নোট নিতে পাবে। তবে পুলিশ-কমিশনারের প্রণীত উপ-ধারায় তারা বেঙ্গল-পুলিশ অপেক্ষাও বিস্তারিত ডায়েরি লেখে। বেঙ্গল-পুলিশে সমস্ত সাক্ষীদের বিবৃতি একসঙ্গে লেখা হয়। অর্থাৎ —‘অমুক অমুক সাক্ষীদের নিকট হতে নিম্নোক্ত তথ্যাদি ও কাহিনী অবগত হলাম।’ কোন সাক্ষী কতটুকু কি বলেছে তা ঠিকমতো বোঝা যায় না। তাই বিচারকালে জবানবন্দীর সঙ্গে ডায়েরিতে লেখা বিবৃতির অমিল ঘটানোর সুযোগ নেই। ওঁরা Cr. P. C. অনুযায়ী স্মারকলিপি রচনা করেন। কিন্তু কলকাতা-পুলিশে ডায়েরিতে কমিশনারের হুকুমে প্রত্যেক সাক্ষীর জবানবন্দী পৃথক পৃথকরূপে লিপিবদ্ধ করা হয়। এইভাবে লিখিত ডায়েরির সাহায্যে পুলিশের সাক্ষীর আদালতে প্রদত্ত-বিবৃতির কনট্রাডিকশন প্রমাণের সুযোগ বিপক্ষের উকিলদের আছে। পুলিশের কাছে সাক্ষী যা বলেছে বা যা বলেনি তা আদালতে বললে কিংবা না-বললে, তার সাক্ষ্য সন্দেহজনক হয়। বহু জজ এজন্য কলকাতা-পুলিশের ডায়েরি বেশি পছন্দ করেন। কলকাতা-পুলিশের ডায়েরিতে প্রাত্যহিক বিশদ বিবরণ (এ্যাক্‌টস্ ডান এণ্ড ফ্যাক্‌টস্ এসারটেণ্ড) মন্তব্যসহ তারিখ ও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয় এবং তাতে ঊর্ধ্বতনরা প্রত্যহ দস্তখত করেন বলে পরবর্তীকালে তা বদলানো যায় না। জজ সাহেবরা তাই ওই ডায়েরি আদ্যোপান্ত পাঠ করে মামলার প্রাথমিক ধারণা করে নেন। বেঙ্গল-পুলিশের ডায়েরির মতো তা গোপন নথিরূপে বিবেচিত নয়।*

[কলিকাতাতে নবাগত হাকিমরা কলিকাতা পুলিশ অ্যাক্ট, সম্বন্ধে উক্তি করতেন: ইজ ক্যালকাটা এ প্লেস আউট অফ ইণ্ডিয়া।]

কলকাতা-পুলিশ-এ্যাক্‌ট প্রদত্ত ক্ষমতা মতো ‘হোটেল ও টি-শপ প্রভৃতির লাইসেন্স কলকাতা পুলিশ দিতে কিংবা তা নাকচ করতে পারেন। জনগণকে নানাবিধ অধিকার দেওয়া এবং পরে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ক্ষমতাও তাঁদের আছে। হাইকোর্টের বহু জজ এগুলিকে ‘সেক্রেড ট্রাস্ট অন দি একসিকিউটিভ বাই দি জুডিসিয়ারি’ বলে অভিহিত করেছেন। বাবু গোবিন্দরাম মিত্রের কাল হতে কলকাতা পুলিশের এই বিশেষ ক্ষমতাগুলি আছে।

অস্ত্র-আইনে বন্দুকের এবং ভিহিক্‌ল-আইনে গাড়ির লাইসেন্স কলকাতা-পুলিশ দিতে পারেন। মোটর-ভিহিক্‌ল পূর্বে কলকাতা-পৌরসভার অধীন ছিল, কিন্তু সেখানে কাজ ভালো না-হওয়ায় তা কলকাতা পুলিশের অধীন হয়। আবগারি দোকানগুলির লাইসেন্সেও কলকাতা-পুলিশের অনুমোদন প্রয়োজন। কলকাতার জুডিসিয়ারি ও একসিকিউটিভ পৃথক। এখানে পুলিশের উপর একসিকিউটিভের ভার অর্পিত। বাংলাদেশে এই-সব কাজ শুধু ম্যাজিস্ট্রেটরা করে থাকেন। তবে পূর্বতন কলকাতা-পুলিশের পৃথক সত্তা সব ক্ষেত্রে রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।

এই সময়ের কিছু আগে কিংবা পরে, রাজপুরুষদের সম্পর্কে গোপন নথি [C. C. Roll] কনফিডেনসিয়াল কারেক্টর রক্ষা প্রচলিত হয়। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের দেশপ্রেমের জন্য তাঁর উপর লক্ষ্য রাখতে এই প্রথার প্রথম সৃষ্টি। ঊধ্বর্তন কর্মীরা প্রতি বৎসরের শেষে সংশ্লিষ্ট অধীন কর্মীদের সম্পর্কে তা নথিভুক্ত করতেন। এই গোপন নথির প্রথম শিকার হন বঙ্কিমচন্দ্রই। অভিযোগ—তিনি প্রচ্ছন্ন ব্রিটিশ-বিরোধী সাহিত্যিক। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরাজি অনুবাদকের নাম জানা সত্ত্বেও তিনি কর্তৃপক্ষকে তা জানান নি। অধিকন্তু ‘নীলদর্পণে‘র লেখক দীনবন্ধু মিত্রের তিনি বন্ধু। এ-সব কারণে তাঁকে জেলা-হাকিম পদে উন্নীত করা হয় নি। তবে ইংরাজ ঊর্ধ্বতন-কর্মী এ-ও লিখেছিলেন যে, অসীম প্রতিভাধর এই ব্যক্তি ইংলণ্ডে জন্মালে নামী-ব্যক্তি হতে পারতেন।

[বঙ্কিমচন্দ্র আমাদের বংশের দৌহিত্র-শাখার সন্তান। মাতামহের সম্পত্তির অর্ধাংশ পেয়ে তাঁরা কাঠালপাড়ায় আসেন। বঙ্কিমচন্দ্র আমার পিতামহ কমলাপতির মাসতুতো ভ্রাতাও হতেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী সংকলিত বঙ্কিম-প্ৰসঙ্গ পুস্তক পাঠে জানা যায় যে, বঙ্কিমবাবু কমলাপতির নিকট ইংরাজি শিক্ষা করেন। পিতামহ পদাধিকার বলে তৎকালীন প্রথম বাঙালী বিভাগীয় কমিশনার কে. জি. গুপ্তের নিকট উক্ত তথ্যাদি শুনেছিলেন। বঙ্কিম-পিতা যাদবচন্দ্র, কমলাপতি এবং বঙ্কিমচন্দ্র যথাক্রমে ভারতের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় রায়বাহাদুর ছিলেন।]

নিকট-আত্মীয় হওয়ায় বঙ্কিমবাবুকে ওই গোপন নথি সম্পর্কে কমলাপতিবাবু জানিয়েছিলেন, কিন্তু বঙ্কিমবাবু তাতে ভ্রূক্ষেপ করেন নি। তৎকালে সি. সি. রোল-এর কপি সংশ্লিষ্ট কর্মীকে দেওয়ার রীতি ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্র উপলক্ষ্য হলেও নব-প্রবর্তিত এই সি. সি. রোল রক্ষার প্রথায় পুলিশ-কর্মীরাই অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।

[বি. দ্র.] বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম লক্ষ্য করেন যে প্রান্তিক বিদ্রোহ অসম্ভব করতে ভারতের সমুদ্র কিনারা বরাবর রেল লাইন স্থাপিত হয়েছে। তাই উনি উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন : তুলে নাও তোমাদের টেলগ্রাফ ও রেললাইন।

ওঁরই গ্রন্থের নির্দেশিত পন্থাতে বাংলাতে বিপ্লবী দল সৃষ্টি হয়। উপরন্তু উনি একটি উদ্দীপক জাতীয় সঙ্গীত তথা ‘বন্দে মাতরম’ মন্ত্রও জাতিকে দিয়েছিলেন।

এ সময়ে কলকাতা অঞ্চলে উদ্যোগ-শিল্প শুরু হয়েছে। ঐগুলি তখনও ইংরাজদের একচেটিয়া কারবার। বয়লারে ঢুকানো বা পিলেফাটানোর কাহিনীও শোনা যায়। সর্বক্ষেত্রে না হলেও, ওদের শ্রমিকদের প্রতি উৎপীডন সুবিদিত। বে-সরকারী স্তরে ব্রাহ্মসমাজ শ্রমিক-কল্যাণে এগুলেন। ব্রাহ্মসমাজ-সম্পাদক বাবু শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৭৩ খ্রী. ‘ভারত-শ্রমজীবী’-সঙ্ঘ নামে প্রথম শ্রমিক-প্রতিষ্ঠানও তার মুখপাত্র পে ‘ভারত-শ্রমজীবী’ পত্রিকা স্থাপন করলেন। এর কিছু পরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৩ খ্রী. শ্রমিক-নেতারূপে একটি রেলওয়ে শ্রমিক-সঙ্ঘের কিছুকাল সভাপতি হন। এর বহু পরে ধীরে ধীরে শ্রমিকদের নিজস্ব ‘সংগঠন’ গঠিত হতে থাকে।

[সরকারী পর্যায়ে ১৯৩৮-১৯৪০ খ্রী.] লেবার কমিশনারের পদ সৃষ্টি হয়। কলকাতা-পুলিশের এ্যাসিসটেন্ট-কমিশনার মুরসিদ সাহেব ঐ পদে নিযুক্ত হন। আমি কিছুকাল ডেপুটেশনে তাঁকে ঐ কার্যে সাহায্য করি। আমরা ফ্যাক্টরি-সমূহে একটি করে সিলড-লেটার বক্স রাখি। শ্রমিকদের তাতে স্বনামে বা বেনামে অভিযোগ-পত্ৰ নিক্ষেপ করতে বলা হয়। বহু অভাব-অভিযোগ পত্র ঐ সকল বাক্সে জমা পড়ে। অভিযোগের স্বরূপ বুঝে আমরা প্রয়োজনীয় শ্রমিক আইনের খসড়া সাজেশন গভর্নমেণ্টে পাঠাই। পরে বাংলা-গভর্নমেন্ট সুগঠিত সরকারী লেবার-ডিপার্টমেন্ট তৈরি করে যোগ্য অ-পুলিশ লেবার কমিশনারদের নিযুক্ত করেন।]

[বি. দ্র.] প্রাচীন ভারতের ত্রিস্তরীয় শাসন-ব্যবস্থা ব্রিটিশরা অনুসরণ করেন। প্রদেশকে কয়েকটি ডিভিশনে বিভক্ত করে, প্রতি ডিভিশনে একজন ডিভিশন্যালকমিশনার (মহাসামন্ত) নিযুক্ত করেন। প্রতিটি ডিভিশন কয়েকটি জেলায় বিভক্ত করে প্রতিটি জেলা জনৈক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের (সামন্ত শাসক) অধীন করেন। প্রতিটি জেলা কয়টি মহকুমায় ভাগ করে তাতে একজন করে মহকুমা হাকিম (মণ্ডলেশ্বর) রাখেন।

অন্যদিকে—পুলিশ বিভাগের জন্য ডিভিশনগুলিতে ডি. আই. জি. এবং তাঁদের অধীনে জেলাতে পুলিশ সুপার রাখেন। একালে আই. সি. এ কর্মক্বত্যে কিছু দেশীয় নিযুক্ত হন। তাদের প্যারালাল পুলিশ সার্ভিসের ইংরাজ-সুপাররা ঊর্ধ্বতন হওয়া সত্ত্বেও দেশীয় আই. সি. এস. দের উপর নজর রাখতেন। ইংরাজদের পৃথক ক্লাবে ওঁদের সলা-পরামর্শ হতো।

কমিশনার মিঃ ওয়াইচোপ

Mr. Wanchope

কমিশনার মিঃ স্কাল্‌চ-এর পর মিঃ ওয়াইচোপ কলকাতা-পৌরসভা ও কলকাতা-পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার ছিলেন (১৮৭২-১৮৭৬ খ্রী.) ইনি কলকাতার চতুর্থ পুলিশ-কমিশনার। ইনি হাওড়াকে পুনরায় কলকাতা পুলিশের অন্তভুক্ত করতে চাইলেন। এমন-কি দক্ষিণে বেহালা ও উত্তরে বারাকপুর পর্যন্ত স্থান কলকাতা পৌর-সভা ও কলকাতা-পুলিশের অধীন করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অধিকিন্তু, তিনি বাঙলা-পুলিশ ও কলকাতা পুলিশের সংযোগরূপে একটি যুগ্ম-কমিটি স্থাপনের বিষয়ও বলেন।

মিঃ ওয়াইচোগের প্রথম প্রস্তাবটি বহু বাকবিতণ্ডার পর কার্যকর হয় নি। সিপাহীবিদ্রোহ দমনের খরচ ওঠাতে আয় কর প্রথম প্রবর্তন হয়। তখনও পর্যন্ত ওই নতুন কর দ্বারা যুদ্ধের খরচ ওঠে নি। তার উপর, কলকাতার বিস্তৃতির জন্য অত অর্থব্যয় সম্ভব নয়। তবে তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি বহু পরে উভয়-পুলিশের প্রতিভূদের ত্রৈমাসিক ও মাসিক মিটিং-এর ব্যবস্থা করে কিছুটা কার্যকর হয়।

পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ

স্যার স্টুয়ার্ট হগ ১৮৭৬-৮১ খ্রী. পর্যন্ত কলকাতা পুলিশে ও পৌরসভার কর্মকর্তারূপে যুগ্ম-পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ইনি বর্তমান মিউনিসিপ্যাল তথা হগ মার্কেটের স্রষ্টা। কলকাতা-পুলিশের পঞ্চম যুগ্মপদী পুলিশ-কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ পূর্ব-কলকাতার খালগুলি বুজিয়ে রাজপথ করার প্রতিবেদন দেন। অন্যথায় ওগুলিকে প্রশস্ত করে নৌ-বিহারের উপযোগী করতে বলেন।

এই সময় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে কয়েকজন ভারতীয়কে নিয়োগ করা হয়েছিল। প্রথম ভারতীয় আই. সি. এস্. একজন বাঙালীকে করা হয়।

স্যার হেনরি হ্যারিসন

[Sir Henry Harrison]

হেনরি হ্যারিসন কলকাতা-পুলিশ ও মিউনিসিপ্যাল-চেয়ারম্যানের যুগ্ম-পদের শেষ কমিশনার, ১৮৮১-৮৯ খ্রী.। তিনি ষষ্ঠ পুলিশ-কমিশনার। হ্যারিসন রোড তাঁর দ্বারা সৃষ্ট বা উন্নত হয়। এই রাস্তার বর্তমান নাম, মহাত্মা গান্ধী রোড।

হেনরি হ্যারিসনের কর্মকালে দ্বিতীয়বার বাংলা ও কলকাতা-পুলিশ একত্রিত করার প্রস্তাব আসে। (প্রথম বার ১৮৩৮ খ্রী.) কিন্তু বাংলা-পুলিশের ইনস্পেক্টর-জেনারেল মিঃ ডেভিড লয়েল ও কলকাতা পুলিশের কমিশনার হেনরি হারিসনের বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

১৭৮৯ খ্রী. ১লা এপ্রিল এই যুগ্মপদ বাতিল করে ১. পুলিশ কমিশনার এবং ২. মিউনিসিপ্যাল চেয়ারম্যান : এই দুটি পৃথক পদ পুনরায় সৃষ্টি হলো। কারণ দু‘জন ইংরাজ-সিভিলিয়ানকে দুটি বড় পদ দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সেই কালে কলকাতা-কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান পদটি গভর্নরের পরবর্তী লোভনীয় পদ ভাবা হতো। আসামের গভর্নর না হয়ে সিভিলয়ানদের সেটাই কামনা। তাই কমিশনার-সাহেব স্বয়ং কলকাতা-কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হলেন এবং তাঁর ডেপুটি কমিশনারকে পদোন্নতি ঘটিয়ে কলকাতা-পুলিশের কমিশনার করা হলো।

[ব্রিটিশ আমলে দারোগা-পদটিকে হাকিম ও পুলিশ সুপার হতে থানার দারোগা তথা থানদার করা হয়। পরে বাংলা ও কলকাতা উভয়-পুলিশে তাদের সাব-ইনস্পেক্টর করা হয়। কিন্তু তার স্মৃতিবাহী একটি মাত্র দারোগা-পদ কলকাতা পুলিশে থাকে। ইনি হেড-কোয়ার্টার্সের দায়িত্বপূর্ণ কাজে বহাল হন। পরে ঐ পদকে আরও অবনত কবে গুদাম-রক্ষক করা হয়।]

কলকাতা পুলিশকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা, ১. দক্ষিণ বিভাগ ২, উত্তর বিভাগ ৩. ডিটেকটিভ ডিপার্ট এবং ৪. রিভার পুলিশ। কর্নেল ক্রসের সুপ-রিশে সণ্ট-পুলিশ রিভার-পুলিশে সংযুক্ত হয়।

উক্ত চারটি পুলিশ-বিভাগের জন্য কলকাতার কমিশনার অফ পুলিশের অধীনে এই সময় চারজন পুলিশ-সুপারিনটেণ্ডেণ্ট ছিলেন। এঁরা সকলেই ইংল্যাণ্ড হতে আগত তরুণ য়ুরোপীয় হতেন।

এই চারজন ইংরাজ পুলিশ-সুপারিনটেণ্ডেন্টের অধীনে থানাগুলিতে এবং অন্যান্য স্থানে নিম্নোক্ত পুলিশ-কর্মীদের নিযুক্ত করা হলো।

১. মাসিক সত্তর হতে একশত পঞ্চাশ টাকা বেতনে ত্রিশজন ইনস্পেক্টর। ২. মাসিক কুড়ি হতে পঞ্চাশ টাকা বেতনে একজন দারোগা ৩. পঁয়তাল্লিশ জন য়ুরোপীয় সার্জেন্ট। ৪. মাসিক নয় হতে ষোল টাকা বেতনে বত্রিশ জন হাবিলদার। ৫. মাসিক পঁচিশ হতে ষাট টাকা বেতনে পঁচিশ জন য়ুরোপীয় কনস্টেবল এবং ৬.এক হাজার তিনশত পনের জন ভারতীয় কনস্টেবল। রিভার তথা জলপুলিশে পৃথক একশত ষোলজন সাধারণ ও একশত তিরাশি জন সশস্ত্র পুলিশ ছিল। নৌ-পুলিশ হতে রিভারপুলিশ এবং রিভার-পুলিশ হতে বহু পরে পোর্ট-পুলিশ তৈরি হয়। উপরোক্ত বাহিনী ব্যতীত ছয়জন মাউনটেড-আর্দালি ছিল। পরবর্তী অশ্বারোহী-পুলিশের তারা অগ্রদূত।

জাস্টিস অফ-পিসঙ্গের কালে একজন পুলিশ সুপার সমগ্র কলকাতা-পুলিশ, জল-পুলিশ-সহ, নিয়ন্ত্রণ করতো। পরে গোয়েন্দা বিভাগের জন্য একজন পৃথক পুলিশসুপার নিযুক্ত হন। এবার একজন পুলিশ কমিশনারের অধীনে চারজন পুলিশসুপারের প্রয়োজন হয়। পুলিশ কমিশনারকে সাহায্যের জন্য হেড-কোয়ার্টার্স-এ একজন ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার নিযুক্ত হলেন। সুগঠিত আর্মড-ফোর্স ও হেড কোয়াটার্স ফোর্সও তৈরি হলো।

১৮৯০ খ্রী. সমগ্র ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশের জন্য দ্বিতীয় পুলিশ কমিশন নিযুক্ত হয়। ১. গয়া-র জেলা-জজ মিঃ স্টিভেনসন, ২. বাংলা-পুলিশের ইনস্পেক্টর-জেনারেল মি: জে. সি. ভেয়ারি, ৩. প্রখ্যাত জমিনদার বাবু প্যারীমোহন মুখার্জি, ৪. বিহার প্ল্যানটারস-এ্যাসোসিয়েসনের মিঃ ই. আর. ম্যাকাউনটেন ওই কমিটির সদস্য এবং হ্যার, এইচ রিসলে তার সেক্রেটারি হন।

উক্ত কমিটির রিপোর্ট মতো দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলা-পুলিশ গঠিত হলো। তবে কলকাতা-পুলিশের বিষয়ে তারা কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ করে নি।

এই কালে বাংলা-পুলিশে কনস্টেবলদের ছয় টাকা, হেড-কনস্টেবলদের দশটাকা, ইনস্পেক্টরদের একশত টাকা মাসিক বেতন ছিল।

ওঁদের রিপোর্ট মতো এ্যাসিসটেন্ট-সুপারদের সংখ্যা বাড়ানো হয়। পুলিশ-ইনস্পেক্টরদেব ডেপুটি-ম্যাজিস্ট্রেটদের পদে প্রমোশন রহিত হলো কিন্তু ওই কালেও এ্যাসিসটেন্ট সুপারের পদগুলি ইংরাজদের জন্য সংরক্ষিত। দেশীয় ইনস্পেক্টরদের প্রমোশনের জন্য এঁরা ডেপুটি পুলিশ সুপার পদ-সৃষ্টির সুপারিশ করেন।

[তৎকালীন প্রবাদ—ইংরাজ ধনীদের মূর্খ পুত্রকে পুলিশ সুপার এবং দেশীয় ধনীদের মূর্খ পুত্রকে সাব-রেজিস্ট্রার করা হয়। অবশ্য—মূর্খ বলতে এখানে স্বল্প-শিক্ষিত বুঝায়। আরও একটি প্রবাদ, তেলা-পোকা আবার পাখি, সাব-রেজিস্ট্রার আবার হাকিম, ঘোষাল আবার বামুন।’]

ডেপুটি-সুপার পদে কিছু দেশীয় ইনস্পেক্টারের প্রমোশনের ব্যবস্থা করা হয়। ঠিক হয় যে—বাকী ডেপুটি-সুপারের পদে উচ্চ শিক্ষিত দেশীয় যুবকদের সরাসরি নিয়োগ করা হবে।

বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র ও সঞ্জীবচন্দ্রের পুত্র কৃষ্ণচন্দ্রকে এবং আমাদের পরিবারের একজনকে অন্যদের সঙ্গে প্রথম ব্যাচের ডেপুটি সুপার করা হয়। এই পদগুলিকে মনোনয়ন দ্বারা নিয়োগ করা হতো। ওই কালে পুলিশ ও বিচার বিভাগে উভয় পরিবারে : অর্থাৎ আমাদের ও বঙ্কিমবাবুদের অবারিত দ্বার ছিল। রাজভক্ত পরিবারগুলিকে তখনও কিছু সুযোগ সুবিধা দেওয়া হতো।

[বঙ্কিমচন্দ্রের মাতৃকুল এবং আমাদের পিতৃকুলের পূর্বপুরুষ রঘুদেব ঘোষাল। রাজ! দোলগোবিন্দের ত্যক্ত জমিদারী উভয় পরিবারে বিভক্ত হয়।

রায় বাহাদুর বঙ্কিমচন্দ্র, অন্য সম্পর্কে আমার পিতামহ রায় বাহাদুর কমলাপতির মাসতুতো ভ্রাতা ছিলেন। তবে আমাদের পরিবারের মতো ওঁদের পরিবার অতো বেশী রাজভক্ত ছিল না। আমাদের বাড়ির মতো ওঁদের বাড়িতে রাজা-রানীর ছবি থাকতো না।]

এই কালে বাংলা-পুলিশের জন্য অন্য একটি উত্তম ব্যবস্থা ছিল। দক্ষ পুলিশ-ইনস্পেক্টর দের অবসর-গ্রহণের পর, সমর্থ থাকা পর্যন্ত, কিছুকাল সাব-রেজিস্ট্রার করা হতো। তৎকালে সাব-রেজিস্ট্রারগণ বেতনের পরিবর্তে কমিশনে কাজ করতেন। এতে তাঁদের আয় যথেষ্ট বেশি হতো।

এই সময় বেতন-বৃদ্ধির দাবিতে বাংলা পুলিশে কয়েক স্থানে নিম্নপদী কর্মীরা সর্বপ্রথম স্ট্রাইক তথা ধর্মঘট করলো। ইংরাজ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পুলিশের বেতন অত কম জেনে অবাক হন। এই সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গভর্নর বার্ড-কমিটি নামে একটি কমিটি নিযুক্ত করলেন। তাঁরা বাংলা-পুলিশের পূর্বোক্ত বেতন-হার সংশোধন করেন। সংশোধিত বেতন-তালিকা নিম্নে উদ্ধৃত হলো :

বাংলা-পুলিশ

পদের নাম             
      
পূর্ব বেতন      
      
পরবর্তী বেতন

কনস্টেবল            
      
টা.       
৬      
      

হেড-কনস্টেবল      
      
টা.      
১০      
      
১৫—২০—২৫

সাব-ইন্সপেক্টর      
      
টা.      
৩০      
      
৪০—৬০—৮০

ইন্সপেক্টর            
      
টা.      
১০০      
      
১৫০—২০০—২৫০

[এই স্ট্রাইকে ডিসিপ্লিন রক্ষার জন্য নির্মমভাবে বহু কর্মী ছাটাই হয়। ঐ সকল ব্যক্তিদের স্থলে বহিবঙ্গ হতে লোক আসে। তবে—নিজেদের ক্ষতি হলেও তাদের কর্মরত সহকর্মীদের বেতন বাড়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয় বছর পরে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে দ্বিতীয়বার স্বল্প পুলিশ স্ট্রাইক হয়। এবারও বহু ব্যক্তির কর্মচ্যুতি ঘটলেও তাদের সহকর্মীদের বেতন-বৃদ্ধি ঘটে।]

উপযুক্ত হেড-কনস্টেবলদের বাংলা-পুলিশে ফাঁড়ির ইনচার্জ করা হয়। পূর্বের সাব-ইনস্পেক্টরদের অনুপস্থিতিতে তাঁরা থানা ইনচার্জ হতেন। তাঁদের অপরাধ তদন্ত করারও ক্ষমতা ছিল। এই-সব অধিকার হতে বার্ড-কমিটি তাঁদের বঞ্চিত করেন। ফার্স্ট আর্ট পাশ করা বাঙালী ও এনট্রান্স পাশ বেহারীদের বাংলা-পুলিশে সাব-ইনস্পেক্টর পদে মনোনয়ন করা হয়।

বাংলা-পুলিশে থানা-ইনচার্জ সাব-ইনস্পেক্টরদের জন্য যথাক্রমে বেতন-অতিরিক্ত দশ, পনের ও ত্রিশ টাকা চার্জ-এ্যালাউন্স দেওয়া হয়। থানার গুরুত্ব অনুযায়ী একাধিক জুনিয়র সাব-ইনস্পেক্টর এঁদের অধীন করা হয়।

এই কালে ইনস্পেক্টর-জেনারেল, পুলিশ সুপার ও এ্যাসিসটেন্ট পুলিশ সুপার পদে শুধু ইংলণ্ড হতে আগত ইংরাজ-নাগরিকদের নিয়োগ করা হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল ইংলণ্ডে বেকার না-রাখা। কিছুকালের জন্য দ্বিতীয়বার ইনস্পেক্টর পদের জন্যে কমপিটিটিভ-পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়। পরে পুনরায় এ-ব্যবস্থা রহিত করা হয়। কারণ, আবার প্রমাণিত হয় যে পণ্ডিত-ব্যক্তিদের দ্বারা পুলিশী কাজ হয় না। জেলা হেড-কোয়ার্টারসে একটি রিজার্ভ-ফোর্স স্থাপিত হয়।

[তৎকালে কলকাতায় তদারকি কাজে ঊর্ধ্ব তন কর্মীরা পালকি বাতিল করে ঘোড়ারগাড়ি ব্যবহার করেতেন। পুলিশ-কমিশনার স্বয়ং জুড়িগাড়ি চড়তেন। কলকাতা-পুলিশের সুপারিনটেনডেন্টরা বগিগাড়ি ও স্বচালিত ফিটনে চড়ে রোদে বেরুতেন। এই সময়ে ইংরাজরা ভেটারনরি-ডাক্তারদের অত্যন্ত সমাদর করতেন। কারণ, তাঁদের প্রিয় কুকুর ও ঘোড়ার এঁরাই চিকিৎসা করতেন। উচ্চপদী কর্মীদের উপর এই ডাক্তারদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। এঁদের সুপারিশে লোকের চাকরি হতো। এ’রা বিরূপ হলে চাকরি হতে লোকে বরখাস্তও হতো।]

[বি. দ্র.] বিগত শতাব্দীর শেষদিকে কলকাতার নাগরিকরা টাউনহলে সভা করে পুরাতন চোরদের স্বভাব-নিরাময়ের নিমিত্ত ‘প্রিজনার্স এইড, সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানে জেল-ফেরত অপরাধীদের থাকার ও শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। চোরদের ভাষায় এটিকে ‘চোর-অফিস’ বলা হতো। জেল হতে বেরিয়ে নিরাশ্রয় চোররা এখানে কিছুদিন থেকে ও বিশ্রাম করে এবং কিছু অর্থসাহায্য নিয়ে চলে যেতো। আজও পূর্ব-কলকাতায় গ্যাস কোম্পানির পিছনে এই অট্টালিকা ও শিল্প-যন্ত্রাদি পড়ে আছে। জজ স্যার মন্মথনাথ এই সোসাইটির শেষ সভাপতি ছিলেন।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে রিহ্যাবিলিটেশন-কমিশনার শম্ভুনাথ ব্যানার্জি, আই. এ. এস. এই প্রতিষ্ঠানকে পুনর্জিবিত করলে গভর্নমেন্ট আমাকে একপার্ট-রূপে তার কার্যনির্ধারক সমিতির অন্যতম সদস্য করেছিলেন।

বিগতশতাব্দীর এই সময় জুভেনাইল-অপরাধীদের জন্য পৃথক আটক-ঘর তথা হাউস অফ ডিটেনসন ও তাদের জন্য পৃথক আদালতসমূহ সৃষ্টি হয়েছিল। তাছাড়া, য়ুরোপীয় ভবঘুরে তথা ভেগাবওদের জন্য আমহার্স্ট স্ট্রীটে পুলিশের অধীনে ‘আটক-নিবাস’ তৈরি হয়েছিল।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে উক্ত হাউস অফ ডিটেনসন-এর কার্যনির্ধারক সমিতিতে পদাধিকার-বলে আমি কিছুকাল সদস্য ছিলাম।

১৯০০ খ্রী. বাংলা দেশের তথা ভারতের একটি স্মরণীয় বৎসর। এই বৎসর কলকাতায় বিশ্বের প্রথম টিপশালা তথা ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরো স্থাপিত হয়। এর দুই বৎসর পরে দ্বিতীয় টিপশালা স্থাপিত হয় লণ্ডন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে। এই বছর রবীন্দ্রনাথ শাস্তিনিকেতনে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

অঙ্গুলি টিপবিদ্যা বাংলাদেশে আবিষ্কৃত হয়ে বর্ধিত ও উন্নত হয়। আজ এই বিদ্যা বিশ্বের সর্বত্র সাদরে গৃহীত। য়ুরোপীয় পণ্ডিত ও বাঙালী পণ্ডিত উভয়েরই এতে অবদান আছে।

প্রাচীন ভারতে ও চীনদেশে অঙ্গুলি-টিপবিদ্যার মূলসূত্র কিছুটা প্রচলিত ছিল। অবশ্য আজকের মতো এত কার্যকর ও উন্নত না হয়ে উহা অবলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতে উহার বিভাগ ও উপরিভাগ বোঝাতে যথাক্রমে চক্র তথা হোর্ল, শঙ্খ তথা আলনেয়ার, পদ্ম ও অংকুশ প্রভৃতি শব্দ এবং চীনে Ho. KE. প্রভৃতি শব্দ কিছুটা সম-অর্থে প্রচলিত ছিল। এদেশে হস্তরেখা বিদ্যায় ও বাদশাহদের পাঞ্জাতেও তার মূলসূত্র আছে। বাদশাহের পাঞ্জার স্বরূপ হতে তা জাল নয় বুঝেই এক-সুবাদার অন্য সুবাদারকে বদলির সময় ধনাগার, অস্ত্রাগার ও রাজ্যপাট বুঝিয়ে দিতো।

হুগলীর ইংরাজ জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট এক পল্লীগ্রামের দোকানে, কাছারিতে, কাঠগোলায় সর্বত্র সই-এর পাশে টিপ নিতে দেখেন। তাঁকে বলা হয় যে সই জাল হলেও টিপ জাল হয় না। সেই ম্যাজিস্ট্রেট দেশীয় অফিসারদের সাহায্যে প্রথমে কয়েদীদের, পরে পেনসনের কাগজেও রেজেস্টারি দলিল টিপ-সই নেন। বহু বৎসর পরে রেজিস্টার রামগতিবাবুর সাহায্যে সেই-সব ব্যক্তিদের খুঁজে এনে দেখা যায় যে, কালের ব্যবধানেও তাদের টিপে কোনও পরিবর্তন হয় নি। তখন ব্যাপকভাবে বাংলা-পুলিশ বিভাগে তা গৃহীত হয়।

কয়েদীদের অসংখ্য টিপ-পত্র টিপশালায় জমা থাকে। এগুলিকে বেছে সঠিক টিপ বার করা কঠিন কাজ। বাংলা পুলিশের দু‘জন অফিসার, হক সাহেব ও হেমচন্দ্র বসু, টিপ ফরমূলা আবিষ্কার করলেন। এ ফরমূলার সাহায্যে তার শ্রেণী ও উপশ্রেণী হতে অল্প সময়ে প্রয়োজনীয় টিপ-পত্র বার করা সম্ভব। কিন্তু এই মহা-আবিষ্কার ইংরাজ উধ্বতন তাঁর নিজের নামে বিশ্বে প্রচার করেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে ক্যাথলিক পাদরির কাছে প্রথম কনফেশনে বলেন, ‘প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে আবিষ্কারকদের পুরস্কৃত করা হোক। নচেৎ মৃত্যুর পরেও আমার আত্মার শাস্তি নেই।’ ততদিনে এ-দু‘জন অফিসারও অবসর গ্রহণ করেছেন। বিলাতের পত্র এলে একজনকে বিহারের নিজস্ব খামারে এবং অন্য জনকে পূর্ববঙ্গের হরি-সভায় পাওয়া গেল। তাদের যথাক্রমে খান-বাহাদুর করা হয়। তাদের নগদ পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল।

১৯০২–১৯০৩ খ্রীঃ বাংলা ও কলকাতা পুলিশের উন্নতির জন্য দুটি পৃথক কমিশন নিযুক্ত হয়। এ কমিশন দুটি সম্বন্ধে পৃথক পৃথক ভাবে বিবৃত করবো।

কলকাতা-পুলিশ : ভারতীয় সিভিল সার্ভিস হতে কলকাতা-পুলিশ কমিশনারের মনোনয়ন ও নিয়োগ রহিত হয়। বাংলা-পুলিশ হতে সিনিয়র-মোস্ট ডেপুটি-ইনস্পেক্টর-জেনারেলদের মধ্য হতে উপযুক্ত ব্যক্তিকে কলকাতা-পুলিশের কমিশনার করা হবে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে প্রদেশ-গভর্নমেন্টের অধীন থাকবেন। পাঁচ বৎসরকাল তিনি নিযুক্ত হবেন। প্রয়োজন হলে কিছু বেশীদিনও তাঁকে বহাল রাখা যেতে পারবে। এঁকে প্রথম শ্রেণীর প্রেসিডেন্সি ও অন্য ম্যাজিস্ট্রেটও করা হবে। ম্যাজিস্ট্রেটরূপে তিনি শুধু শান্তিরক্ষা ও আসামীদের জামিন এবং মুক্তি দেওয়ার অধিকারী। বাংলা পুলিশ : এতে বাংলা-সহ ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের জন্য একজন ইনস্পেক্টরজেনারেল, প্রদেশের প্রত্যেক রেঞ্জের জন্য একজন ডেপুটি ইনস্পেকটর-জেনারেল, প্রতিটি জেলায় একজন ইংরাজ-এ্যাসিস্টেন্ট পুলিশ সুপার কিংবা দেশীয় ডেপুটি পুলিশসুপার নিয়োগের ব্যবস্থা হয়।

উক্ত প্রতিবেদনের মুখবন্ধে দেশীয় পুলিশকে উৎকোচ গ্রাহক ও উৎপীড়ক এবং যুরোপীয় ঊর্ধ্বতন পুলিশকে সৎ বলা হয়েছে। সার্কেল-ইনস্পেকটর তত বেশী নিন্দিত হন নি। কিন্তু, য়ুরোপীয় ঊর্ধ্বতনরা শৌখীন খাদ্য ও মদ্যাদি ও অন্য উপঢৌকন নিতেন কি না, তাঁদের মেমরা সস্তায় কর্মীদের দ্বারা শাকসবজী আণ্ডা-মোণ্ডা আনাভেন কিনা, দেশীয় অফিসারদের তাঁদের জন্য সুলভে কিংবা বিনা মূল্যে দৈনিক সংগ্রহ করতে হতো কিনা! সে-সব বিষয় সম্বন্ধে এই প্রতিবেদনে কোনও কিছুর উল্লেখ নেই। তবে প্রতিবেদনে য়ুরোপীয় ঊর্ধ্বতনদের কাজে সুবিধার জন্য দেশীয় ভাষা শিখতে বলা হয়েছে।

লর্ড কার্জন ভারতের গভর্নর-জেনারেল হয়ে কলকাতায় এলেন। তাঁর নির্দেশে কলকাতা বাদে প্রতিটি প্রদেশে একটি করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টা) স্থাপিত হয়। জেলাভিত্তিক গোয়েন্দা বিভাগ পূর্বে থেকেই বাংলাদেশে ছিল।

[বি. দ্র.] কলকাতা পুলিশের সৃষ্টিকাল হতে ১১১২ খ্রী. পর্যন্ত তার যাবতীয় নথিপত্র, স্মারকী (ডায়েরি), অভিযোগ-কেতাব প্রভৃতি বাঙলা-ভাষায় লেখা হতো। বাংলা ভাষা তখনও প্রাণবস্ত। কিছু ইংরাজী বাক্যকেও তারা বাংলা-করণ করে নেয়। যথা : রাউণ্ডকে তারা রোঁদ, সেন্টি কে শাস্ত্রী, ড্রিলকে তারা দলিল, প্লেটুনকে পল্টন, ট্রপকে টুলি, জেনারেলকে জাঁদরেল প্রভৃতি তারাই করে নেয়। তবে বেশী ক্ষেত্রে তারা খাঁটি বাংলা বাক্যই ব্যবহার করতো। আজও লাল-কেতাব সেরেস্তা মুন্সি, হাজত ময়না-তদন্ত বয়াম (ভিসারা) হাতকড়া, থানা, দাঙ্গা জামিন হেপাজত ভৃত্যচৌর্য সিদমারি আসামী ফরিয়াদী নজরবন্দী ফাঁড়ি দারোগা পাহারা টহল গরদথানা এলাকা, গ্রেপ্তার খানাতল্লাসী প্রভৃতি খাঁটি বাংলা শব্দ কলকাতা-পুলিশে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি সন্ধ্যায় জনৈক ইংরাজনবিশ থানার বাংলা নথিপত্র ও অভিযোগ-বই হতে উল্লেখ্য অংশ ইংরাজিতে তর্জমা করে বিভাগীয় ইংরাজ সুপারিনটেনডেন্টের নিকট পাঠাতো। সব অফিসারদের ইংরাজি জানার প্রয়োজন হতো না। ১৯১২ খ্রী-র পর ধীরে ধীরে থানাগুলি হতে বাংলা-ভাষা বিদায় করা হয়।

কলকাতা-পুলিশে ১৯০২-০৩ খ্রী. পুলিশ কমিশনের সুপারিশের দুই বৎসর পর, ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের বদলে পুলিশ কর্মকৃত্য (আই. পি.) হতে পুলিশ-কমিশনার নিযুক্ত হতে থাকে। সাধারণত বাংলা-পুলিশের সিনিয়র-মোস্ট ডেপুটি-ইনস্পেক্টরকে এই পদে পরপর নিযুক্ত করা হয়।

প্রথমে কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে সাহায্যের জন্য একজন মাত্র ডেপুটি কমি শনার হেড-কোয়ার্টারসে ছিলেন। পরে সুপারিনটেনডেন্টদের পদ বাতিল করে সেই জায়গায় জুনিয়ার ডেপুটি পুলিশ-কমিশনার নিযুক্ত হয়। কমিশনার, ডেপুটি কমিশনারদের নিজ-নিজ এলাকায় তাঁর সব ক্ষমতা আইন মতো অর্পণ করেন। তবে, পূর্ণ শাসনের ক্ষমতা ও তদারকির ভার তাঁরই থাকে। ইচ্ছামতো হস্তান্তরিত ক্ষমতা তিনি প্রত্যাহার করতেও পারেন।

কমিশনারের মতো তাঁর ডেপুটি কমিশনারদেরও জাস্টিস অফ-পিস করা হলো। এঁদেরও পুলিশ-কমিশনারের মতো প্রথম শ্রেণীর প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্য ম্যাজিস্ট্রেট করাও হয়। এঁদেরও বিচার ও দণ্ডদান ক্ষমতা বাদে হাকিমের অন্য ক্ষমতা থাকে। এরা ধরাপড়া আসামীদের জামিন বা মুক্তি দেবার অধিকারী ছিলেন।

তার ফলে আদালতে হয়রানি ও বাড়তি উকিল-খরচ হতে লোকে অব্যাহতি পেত। স্বাধীনতার পর তাঁদের এই ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। পূর্বে তাঁরা পনেরো দিন পর্যন্ত আসামীদের পুলিশ-হেপাজতেও নিতে পারতেন। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে কলকাতা-হাইকোর্ট হতে পুলিশের ঐ ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়া হলো।

[বি. দ্র.] বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে জেলা ডেপুটি কমিশনারদের সাহায্যের জন্য তার দুটি বিভাগে দু‘জন এ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের পদ তৈরি হয়। প্রত্যেক বিভাগে ছ’টি থানা থাকে। প্রত্যেক জেলার বারোটি থানা থাকে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ, গোয়েন্দা-বিভাগ ও পোর্ট-পুলিশে সেই-সেই ডেপুটি কমিশনারকে সাহায্যের জন্য একজন করে এ্যাসিসটেন্ট-কমিশনার নিযুক্ত হন। পূর্বের পোর্ট পুলিশ একজন এ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের অধীনে গোয়েন্দা-বিভাগের অধীন ছিল।

উপরোক্ত ব্যাপার পূর্বে পুলিশের বিভাগীয় এ্যাসিসটেন্ট কমিশনারের কার্যের জন্য তাঁদের স্থলে চিফ-ইনেস্পকটার নামে একটি পদ ছিল। এই পদগুলি আরও কিছুকাল উপ-বিভাগীয় কর্তা রূপে বিভাগীয় এ্যাসিসটেন্ট কমিশনারদের অধীনে রেখে পরে ওই পদগুলি বাতিল করা হয়।

১৯০২ খ্রী. স্যার জন উড় বার্ন নামে এক ব্যক্তির নাম কলকাতা-পুলিশ-সম্পর্কে পাওয়া যায। তিনি গভর্নর না-হলেও পুলিশ কমিশনার ছিলেন। কারণ, তাঁর বাসভবনে বাংলা ও কলকাতা-পুলিশের যুগ্ম-বৈঠকের বিষয় বলা হয়েছে।

লর্ড কার্জন সুবা-বাংলাকে সুশাসনের জন্য দুইভাগে বিভক্ত করলেন। প্রতিবাদে দেশব্যাপী মহা-আন্দোলন শুরু হয়। সমগ্র বঙ্গব্যাপী উত্তাল বিক্ষোভ। অরন্ধন, রাখী-বন্ধন, বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্য গ্রহণ এবং ব্রিটিশ বিতাড়নে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ চলতে থাকে। মুসলিমরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়। ঢাকার গভর্নর ফুলার কোনও এক যুবককে বলেন, ইউ নো, হু আই অ্যাম? সেই বিক্ষুব্ধ মুসলিম ছাত্র নির্ভয়ে উত্তর দেয় : ফুল ইউ আর তাই তুমি ফুলার। অবস্থা বুঝে ব্রিটিশ সেই সময় প্রথম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভেদনীতির আশ্রয় নেন।

ব্রিটিশ-গভর্নমেন্ট কঠোর হস্তে এই বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দমন করেন। কিন্তু তার ফল হলো বিপরীত। এই আন্দোলন ক্রমে গুপ্ত-বিপ্লবী আন্দোলনের রূপ নিলো। কিছুকাল এই উভয় আন্দোলন একসঙ্গে চলে। গুপ্তবিপ্লবী আন্দোলন দমনে কলকাতা গোয়েন্দা-বিভাগ ব্যর্থ হলে কলকাতা পুলিশের বিশেষ বিভাগ তথা স্পেশাল ব্রাঞ্চ সৃষ্টি হয়। বাংলা-পুলিশে সেই জায়গায় ইনটেলিজেন্স-ব্রাঞ্চের সৃষ্টি হলো।

আমার পিতৃকুলের রাজভক্তি তখনও অটুট। কিন্তু মাতৃকুল স্বদেশী-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। মাতামহ ‘পদ্মকুসুম’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা কবি গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গ্রামে গ্রামে গান বেঁধে বেডান। তিনি যুবকদের স্বদেশ-মন্ত্রে দীক্ষিত হতে আহ্বান করেন। ফলে, আমাদের উভয় পরিবারের মধ্যে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ। গভর্নমেন্ট ওই বৃদ্ধের পেনসন বন্ধ করে দেন।

এই কালে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ১৯০৩ খ্রী. শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ও তৎপরে ১৯০৫ খ্রী. তাঁর বঙ্গভঙ্গ স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হওয়া ইংরাজ গভর্নমেন্টের পছন্দ নয়। উনি ১৯০৩ খ্রী. রেলওয়ে ওয়ার্কস ধুনিয়নের সভাপতি হয়েছিলেন। ১৯০৬ খ্রী. তাঁর নাম জোড়াসাঁকো থানার সারভেলান্স রেজিস্ট্রারে রেজিষ্টি-ভুক্ত করা হয়। সেই থেকে তাঁর গতিবিধি ও বাটিতে উপস্থিত ও অনুপস্থিতির উপর গোপনে লক্ষ্য হতো। কোনো এক অ্যাংলো উর্ধ্ব তন কর্মী তাঁর সম্পর্কে তদজন্য নিয়ম মতো একটি হিস্টি, সিট তৈরি করেছিলেন। ওই লিপিবদ্ধ তথ্য হতে কিছুটা নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো।’

“রবীন্দ্রনাথ একজন জমিদার হওয়া সত্ত্বেও প্রজাদরদী। উপরন্তু উনি ধনী ব্যক্তি হয়েও বোলপুরে একটি ছোট্ট স্কুলে মাস্টারী করেন। দীর্ঘ শ্মশ্রু মণ্ডিত দীর্ঘকায় অতি গৌরবর্ণ আলখাল্লা পরা এই লোকটিকে হঠাৎ দেখলে যীশুখ্রীষ্ট বলে ভ্রম হয়। ওতে বিভ্রান্ত হয়ে বহু য়ুরোপীয় পণ্ডিতের ওর বাটিতে যাতায়াত। একটি ব্রিটিশ বন্ধু পরিবারে জন্মে ওঁর ব্রিটিশ বিরোধীতা দুঃখজনক।”

[বি. দ্র.] ওঁর নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির পরও ঊধ্ব তনদের নজর এড়িয়ে কিছুকাল পুরানো প্রথামতো ওঁর উপস্থিতি অনুপস্থিতি গোপনে জোড়াসাঁকো থানাতে লিপিবদ্ধ হতো। একদিন এক জমাদার গোপন তদস্তাত্তে ইনচার্জ কর্মীকে রিপোর্ট লেখাচ্ছিল :—‘দশ নং দাগী রবীন্দ্রনাথ হাজির নেহি। ওই সময় একজন রিটায়ার্ড ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সেখানে ডাইরী লেখাতে উপস্থিত ছিলেন। ওটি উনি শুনে স্যার যদুনাথ সরকারকে জানালে তিনি ওটি প্রবাসীতে প্রকাশ করলে আলোড়ন ওঠে। ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা তাদের অজ্ঞাতে ঐ প্রাচীন প্রথা থানান্তরে তখনও প্রতিপালিত জেনে অবাক হন ও তাঁদের নির্দেশে তখুনি তার নাম ওই থানা রেজিস্ট্রারি হতে ‘স্ট্রাক অফ’ করা হয়েছিল। পরে কবিগুরুকে দাগী বলাতে জমাদারদের দশ টাকা জরিমানা এবং গতানুগতিক হুকুম বজায় রাখাতে ইনচার্জ অফিসারের সার্ভিস বুকে কালো দাগ পড়ে।

[ওঁর নাটকগুলিও ওই সময়ে অন্য নাটকের মতো লালবাজারে পুলিশের প্রেস সেকসানে যথারীতি দাখিল করে ওগুলি অভিনয়ের পূর্বে অনুমোদিত করাতে হতো।]

উনি ভারতীয় পুলিশের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। মুকুট নাটকে উনি লিখেছিলেন : ‘পুলিশ যদি কারুর পা জড়িয়ে ধরে তাহলে লোকে মনে করে যে তার তাহলে জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব আছে।” এ হতে বোঝা যায় যে জনগণের পুলিশের প্রতি অহেতুক সন্দেহ ও বিরাগ তাঁর অপছন্দ ছিল ও তাতে তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। বস্তুত পক্ষে রাজনৈতিক কারণে দলগত ভাবে পুলিশ কিছুটা আনপপুলার তৎকালে হলেও ব্যক্তিগত ভাবে তারা জনপ্রিয় ছিল। সবকিছু ব্যক্তিগত জনসেবা ও সদ্ ব্যবহারের উপর নির্ভর করতো। রবীন্দ্রনাথ একদিন আমাকে বলেছিলেন : মিশনারীদের অপেক্ষা পুলিশের জনসেবার সুযোগ বেশী।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি [পরে স্যার] এবং অন্যেরা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় পুরোভাগে এসে দাঁড়ালেন। সুরেন্দ্রনাথ সিভিলিয়ন [আই. সি. এস.] কর্মকৃত্য হতে বেরিয়ে এসে মাঠে-ঘাটে ঘোষণা করলেন : ‘আই উইল শেক্‌ দি ফাউণ্ডেশন অফ ব্রিটিশ এম্পায়ার।’ অর্থাৎ : ‘আমি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল গুড়িয়ে দেবো।’ সুরেন্দ্রনাথের হাত থেকে তাঁর ‘নেশন ইন মেকিঙ’ গ্রন্থখানি গ্রহণ করার সময় মহাত্মা গান্ধী স্বীকার করেছিলেন যে বাল্যকালে সংবাদপত্রে তাঁর বক্তৃতা পাঠ করে তিনি অনুপ্রাণিত হন। তিনি পরে মন্ত্রী হয়ে নতুন আইনে কলকাতা-পৌরপ্রতিষ্ঠানের মেয়র পদটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

[মৈমনসিংহের মহারাজা এবং তৎকালীন জমিদারকুলও বঙ্গভঙ্গ রোধ আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। অবশ্য নতুন ব্যবসাদার-জমিদারদের কেউ ওই-সব আন্দোলনে থাকেন নি। কিন্তু বাংলার প্রত্যেক প্রাচীন জমিদার-বংশ এতে যোগ দিয়েছিলেন।]

এবার বাছা-বাছা ইংরাজ ও ভারতীয় রাজপুরুষদের পথে-ঘাটে গুপ্ত বিপ্লবীরা হত্যা শুরু করলো। উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা বাড়ে। এখানে বিপ্লবীদের ইতিহাস লেখা আমার উদ্দেশ্য নয়। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, কানাই, কিংসফোর্ড প্রভৃতি সম্পর্কে বহু পুস্তক আছে। বহু বিপ্লবী‘র ব্যবহৃত পুস্তক-বোমা প্রভৃতি শস্ত্র পুলিশ-মিউজিয়াম আছে। এখানে আমি পুলিশের প্রশাসনীয় ইতিহাস সম্বন্ধে শুধু বলবো।

উক্ত মুভমেন্টের পর হতে গভর্নমেন্টের বিশ্বস্ত কর্মী ও পরিবারদের ও পুলিশের আত্মীয়দেরই পুলিশে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই সুযোগ আমরাও নিয়েছিলাম। বাংলা, বিহার ও ওড়িশায় আমাদের বহু আত্মীয় বিচারক এবং উচ্চপদস্থ পুলিশ হন। কলকাতা পুলিশেও আমাদের বহু আত্মীয় থাকে।

ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রোধ করলেন। বংলাদেশ তার রাজধানী ও উল্লেখ্য অংশ হারালো। ফলে কলকাতায় আর রাজধানী পুলিশ রইলো না। সংবাদের জন্য অধীর আগ্রহে এ-সময়ে সুরেন্দ্রনাথ ও নেতারা একস্থানে অপেক্ষা করে ছিলেন। ওই সময় রাজধানী ও কিছু ভুমি হারানোর সংবাদ শোনামাত্র তাঁরা হায় হায় করে উঠেছিলেন। বাংলার কিছু নেতা এ ঘটনায় তাঁদের রাজনৈতিক পরাজয় মনে করেছিলেন।

[বি. দ্র.] মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, পুরুলিয়া ও পূর্ণিয়ার অংশ বিহারে এবং চৈতন্যদেব-খ্যাত সিলেট এবং গোয়ালপাড়ার অংশ আসামে রয়ে গেল। উদ্দেশ্য— একটি অবাধ্য বাঙালী সম্প্রদায়কে সংখ্যালঘু করে শাস্তি দেওয়া ও দুর্বল করা। সামগ্রিক ভাবে বাঙালীকে ইংরাজশাসকরা দুর্বল করে দিল।

পরে বাঙালীরা আরো শোচনীয় বঙ্গবিভাগ মেনে নেয়। কার্জন অখণ্ড বাংলাদেশ দু‘খণ্ড করেন। কিন্তু পরবর্তী নেতারা ভারতকে তিন খণ্ড করেন। কার্জনকে তা সত্ত্বেও তার পুরাকীর্তি প্রভৃতি রক্ষার জন্য স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর তৈরি পার্টিশন বর্তমান পার্টিশন অপেক্ষা উত্তম ছিল। ভারত-ত্যাগের সময় কার্জন এক বক্তৃতায় বলেছিলেন : ‘বাঙালী একদিন বুঝবে আমি তাদের কত উপকার করেছিলাম।’

গুপ্ত-বিপ্লব-আন্দোলন তখনও কিন্তু থামে নি। বিপ্লবীরা সমগ্র ভারতকে স্বাধীন করতে বদ্ধপরিকর। স্বদেশী-আন্দোলনও পুরাপুরি থামে নি। ভারতের অন্যত্রও স্বদেশীআন্দোলনে সাড়া জাগে। আমাদের পরিবারের কয়েকজন তরুণও তাতে যোগ দেওয়ায় বিতাড়িত হয়। বাংলার প্রতিটি পরিবারই তখন এই আন্দোলনে উজ্জীবিত।

জ্যেষ্ঠতাত রায়বাহাদুর কালিসদয় ঘোষাল তখন বাংলা-পুলিশের নামী অফিসর। তাকে স্পেশাল-ব্রাঞ্চ পুলিশ-সংগঠনের জন্য কলকাতায় নিযুক্ত করা হলো। পিতৃদেবকেও কলকাতা পুলিশে নেওয়া হয়। কিন্তু পরে তিনি রেলওয়েতে উচ্চপদী অফিসর হন। জেষ্ঠ্যতাত ও পিতৃদেব উভয়েই ডিরেক্‌ট ইনস্পেক্টর ছিলেন। সাব-ইনস্পেক্টর হতে ইনস্পেক্টর করার নিয়ম; কিন্তু বহু পরিবারের পুত্রদের সোজাসুজি ইনস্পেক্টর করা হতো। তখন দেশীয়দের জন্য পুলিশ সুপারের পদ [আই. পি.]ছিল না। এমন-কি পুলিশ-ইনস্পেক্টর পদগুলির অর্ধেক কলকাতায় ইংরাজ ও অ্যাঙলোদের অধিকারে ছিল।

[বি. দ্র.] আমি এমফোর্সমেন্ট-বিভাগের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার থাকার সময় প্রশ্ন ওঠে, যুদ্ধোত্তরকালে সিভিল সাপ্লাই বিভাগ হতে পুলিশে গৃহীত ইনস্পেক্টরদের ওই বিভাগে স্থায়ী করা প্রিসিডেন্টের অভাবে নিয়ম-বহির্ভূত কিনা। আমি হোমসেক্রেটারি মৃগাংকমৌলী বসু. আই. সি. এস, সমীপে ওই-রকম কিছু নথিপত্র উপস্থিত করি। ১৯২৮ খ্রী. শ্রীমেটা নামক একজনকে ও তার পূর্বে অন্য কয়েকজনকেও বাংলা-পুলিশে সরাসরি-ইনস্পেক্টর করা হয়। আমাদের পারিবারিক নথিপত্র হতেও সেই সম্পর্কিত প্রমাণ তাঁর নিকট দাখিল করি। ফলে, সিভিল সাপ্লাই হতে গ্রহণকরা কয়েকজনকে ইনস্পেক্টর পদে কনফার্ম করা সম্ভব হয়।

স্বদেশী-আন্দোলন ও বিপ্লবী-আন্দালন ও ১৮০৮ খ্রী-র পরেও বহুকাল থামে নি। বিপ্লবী ও পুলিশ-পক্ষে কিছু ব্যক্তি তখনও শহীদ হচ্ছে। সেই মহাযুগ-সন্ধিক্ষণে রাজভক্ত পিতৃকুল এবং দেশভক্ত মাতৃকুলের মধ্যে আমি জন্মগ্রহণ করলাম। অবশ্য তাতে পৃথিবীর লাভ বা ক্ষতি কোনও কিছুই হয় নি।

এই আন্দোলনে প্রথম বিদেশী বস্ত্র বহন ও বর্জন ও গভর্নমেন্টের সহিত অসহযোগিতার উদ্ভাবিত হয়।

কমিশনার হ্যালিডে

পুলিশ কমিশনার হ্যালিডে সাহেব [১৯০৫-১৯১৫ খ্রী.] দশ বৎসর পুলিশ কমিশনার ছিলেন। তাঁকে স্বদেশী আন্দোলনের সহিত বিপ্লবী আন্দোলনেরও সম্মুখীন হতে হয়। এঁরই শাসনকালে কলকাতা হতে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হলে কলকাতা পুলিশ রাজধানী পুলিশের গৌরব হারায়।

১৯১৩ খ্রী. হ্যালিডে সাহেবের নেতৃত্বে ভোর রাত্রে হিন্দু হোস্টেল তল্লাসী কালে কলকাতা পুলিশের সহিত ছাত্রদের সঙ্ঘাত ঘটে। ঐ হোস্টেলের ইংরাজ সুপারিনটেণ্ডেণ্টের নেতৃত্বে ছাত্ররা পুলিশকে তল্লাসীতে বাধা দেয়। পরে অবশ্য মাত্র সংশ্লিষ্ট ছাত্রটির বাক্সটি তল্লাস করতে দেওয়া হয়। এইটিই পরে স্থায়ী প্রথা হয়ে যায়। অর্থাৎ সমগ্র হোস্টেল তল্লাস নয়। পরে পুলিশ কমিশনারকে য়ুনিভারসিটি ক্যাম্পাসে ঢোকার জন্য ঘুনিভারসিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল।

[এতাবৎকাল ফরাসী চন্দননগর ও প্রাচীন ভারতীয় প্রথামত নাইট সার্চ নিষিদ্ধ ছিল। উপরন্তু পুরুষদের অবর্তমানে কোনও বাটীতে প্রবেশও রীতিবিরুদ্ধ ছিল। এই সময় নতুন হুকুমে সাধ্যমত ওইরূপ তল্লাস এড়ানোর নিয়ম হলো।]

কমিশনার হ্যালিডে সাহেব কলকাতা পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্ট হতে রাজনৈতিক অপরাধ দমন বিভাগটা তুলে নিয়ে তদ্‌জন্য পৃথক ‘স্পেশাল ব্রাঞ্চ, পুলিশ সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন কঠোর দমন নীতি দ্বারা নিষ্পেশিত করা হলে ‘আণ্ডার গ্রাউণ্ড’ বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়। তজন্য উহা দমনে উপরোক্ত রূপ একটি বিশেষ বিভাগের প্রয়োজন হয়েছিল।

এরই কালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। ঠিক হয় যে বাঙালী তরুণদের যুদ্ধস্পৃহা অন্যত্র বিক্ষিপ্ত করতে বাঙালী তরুণদের পৃথক পল্টন তৈরি করে ওই যুদ্ধে পাঠানো হবে। পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথমে বাঙালী এ্যামবুলেন্স ও পরে ওদের যোদ্ধবাহিনী মেসোপটামিয়ার রণক্ষেত্রে পাঠানো হলো। এতে হিন্দু মুন্নিম মধ্যবিত্ত গ্র্যাজুয়েট ও নিরক্ষর কৃষক তরুণরা একত্রে যোগ দিয়েছিল। তুর্কীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় জীগির কেউ দেয় নি। কলকাতা পুলিশের জনৈক ডেপুটি কমিশনার ক্যাপটেন উড সাহেব ওদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তুর্কীদের বিরুদ্ধে বাঙালী সৈন্য পরিচালনা কালে অন্যদের সহিত তাঁর মৃত্যু ঘটে। কবি নজরুল ইসলাম-এর অধীনে একজন হাবিলদার ছিলেন। কলকাতা পুলিশ ওই সময় বাঙালীদের যোদ্ধৃ-পল্টনে রিক্রুট করতে সাহায্য করেছিল।

[প্রখ্যাত দানবীর ব্যারিস্টার রাসবিহারী ঘোষকে নূতন ইংরাজ চিফ জাস্টিস হাইকোর্টের এজলাসে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলেন : ‘ওয়েল! জার্মানরা কলকাতাতে এলে তোমরা কি করবে? ওঁর এই উপহাসটি গভীরভাবে গ্রহণ করে বিখ্যাত বাগ্মী রাসবিহারী ঘোষ উত্তর করেছিলেন : আমরা তখুনি টাউন হলে একটা সভা করবো ও তার পরে মালা হাতে চাঁদপাল ঘাটে তাঁদেরকে অভ্যর্থনা জানাবো। ওই ইংরাজ জাস্টিস ওঁর ওই উত্তরে বিস্মিত হয়ে উনি সিরিয়াস কিনা’ জিজ্ঞাসা করলে রাসবিহারী ঘোষ বলেছিলেন : তাছাড়া আমাদের করণীয় কি আর আছে? বিগত দেড়‘শ বছরের ব্রিটিশ রাজত্বে তোমরা অন্য আর কিছু অর্থাৎ যুদ্ধ বিদ্যাদি আমাদের শেখাও নি।

এই বাগবিতণ্ডার পরই ইংরাজদের একাস্ত ‘ক্যালকাটা ক্লাবে’ ঊর্ধ্বতন ইংরাজদের পরামর্শ হয় এবং উত্তরে ডিনার টেবিলে ঠিক হয় যে বাঙালীদের একটি পৃথক রেজিমেণ্ট তৈরি করে ওদের শান্ত করা হোক। অন্য কারণ এই যে চন্দননগরে ফরাসীরা ইতিমধ্যেই বাঙালীদের বিমান বাহিনীতে ও গোলন্দাজ বাহিনীতে গ্রহণ করে ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছিল। সেখানে জার্মানদের বিরুদ্ধে তারা যথেষ্ট বীরত্ব দেখিয়েছিল। বাঙালী জনগণ কিন্তু জার্মানদের বিষয়ে তখন সহানুভূতিশীল ছিল।

[এ সময় ডালহাউসি স্কোয়ারের জলেতে পৃষ্ঠে বড় ডিম্বসহ একটি বিরাট হাঁস ভাসানো হয়। ওই ডিম্বের গাত্রে লেখা ছিল : ওয়ার বণ্ড কিনলে হোমরুল তথা ডিম্ব পাবে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ওই হোমরুল আসে নি। দেশীয় সংবাদ পত্রে ওই হোমরুলকে ভীমরুল বলা হতো।]

যুদ্ধ শেষ হলে বাঙালী পল্টন পল্টনীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভেঙে দেওয়া হলো। পরিবর্তে বছরে মাত্র এক মাসের মেয়াদে পঞ্চাশ টাকা বেতনে বাঙালীদের যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষার্থে টেরিটোরিয়াল ফোর্স খোলা হয়। বাঙালী কৃষকরা শহরে গরু কিনতে এলে একমাস গড়ের মাঠে ট্রেনিং নিতে ক্যাম্পে থাকতো। এক মাস পর ঐ পঞ্চাশ টাকাতে এক জোড়া বলদ কিনে গ্রামে ফিরতো। অবস্থা বুঝে বৃটিশ পরে ছাত্রদের জন্য ইউনিভারসিটি ট্রেনিং কোর খুলেছিল।

[বাঙালী পল্টনদের বিরুদ্ধে ওই কালে ইংরাজ অফিসারগণ একটি বিশেষ ঘটনাকে উপলক্ষ্য করে তাদেরকে মগজী বাঙালী বলে ওই সময় নিম্নোক্ত গণ-গল্পটি প্রচার করে ছিল।

মেসপোটেমিয়ার রণক্ষেত্রে বাঙালী সৈন্যদের হুকুম দেওয়া হলো। ‘কুণ্ডি কদম (স্পেশেশ) এগিয়ে গুলি ছোড়ো। এতে ওই মগজী বাঙালী সৈন্য তর্ক শুরু করে বললো : রাইফেলের রেঞ্জ বাড়ানো ও কমানো যায়। এখানে বসেই তো টোয়েন্টি স্পেশেশ রেঞ্জ বাড়ানো যেতে পারে। হুকুমটি ভুল হুকুমই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওটি তৎক্ষণাৎ প্রতিপালন না করে তর্ক করাতে তুর্কীরা এসে পড়ে সকলকে খতম করে দিয়েছিল।

প্রত্যুত্তরে বাঙালী পন্টনীরাও নিম্নোক্ত রূপ দুইটি গণ-গল্প মুখে মুখে তৈরি করে তারা, সেগুলি প্রচার করেছিল।*

[* পল্টন বাক্যটি ইংরাজী প্লেটুন শব্দটির বাঙলা-কৃত পরিভাষা। অনুরূপ ভাবে প্রাণবস্তু বাংলা ইংরাজী ‘টুপ’ [Troop] কে বাংলাতে স্কোয়াড অর্থে ‘টুলি’ করে নিয়ে ছিল। অনুরূপ ভাবে সেন্ট্রি কে শাস্ত্রী, রাউওকে রে দি ও জেনারেলকে এ দ্বিরেল ও ড্রিলকে দলিল করে নেয়।]

“এক ভদ্রলোক এক ডাক্তারের কাছে এসে বললো : ‘আমার ব্রেনটা (মগজ) খারাপ হয়ে গেছে। ওটা একটু মেরামত করে দিন। ডাক্তার ওটি মেরামতের জন্য অপারেট করে মস্তক হতে বার করে কাঁচের বোতলে রেখে তাকে সাতদিন পরে গুটির ডেলিভারি নিতে বললো কিন্তু এক মাস পরেও সেই লোক ওই ব্রেন ডেলিভারি নিতে এলো না। হঠাৎ একদিন ডাক্তারবাবু তাকে বাজারের পথে দেখে বললো : ওহে। তোমার ব্রেনটি চমৎকার ভাবে মেরামত করা হলো। কিন্তু তুমি ওটি নিয়ে গেলে না কেন? উত্তরে ওই লোকটি ডাক্তারবাবুকে বলে ছিল : ‘ওই ব্রেন আমার আর দরকার নেই। কারণ—ইতিমধ্যে আমি সেনা বিভাগে ঢুকে পড়েছি।’

“পরীক্ষার দিন কর্নেল সাহেব আমাকে আর্মির ওই স্কোয়াডটি কম্যাণ্ড করতে বললে আমি ভাবছিলাম যে কি করে কম্যাণ্ড শুরু করবো। হঠাৎ আমার মগজে একটা বুদ্ধি এসে গেল। আমি ছুটে গিয়ে একজন সিপাহীর গলাটা দুই হাতে চেপে ধরে খেঁকরে উঠে বলে ছিলাম : ‘উল্লুক কাঁহা কো! তুমি শির হেলাতা। আমি তোমরা শির তোড়েগা। আউর তোমার আঁখ উপাড় লেগা। এতে ওই পরীক্ষক কর্নেল সাহেব খুশী হয়ে বলে ছিলেন। ‘বহুৎ খুশ হুয়া। যাও তুম পাশ।’ অর্থাৎ : এদের মতে ‘যে যতো বড়ো বুলিই [Bully] সে ততো ভালো অফিসার।”

এঁর কালে চাকুরি সহ সর্বত্র সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি গর্ভমেন্ট গ্রহণ করে। এজেন্ট প্রপোগেটর দ্বারা মধ্যে মধ্যে ওই কাল হতে হিন্দু মুশ্লিমদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও বাধানো হয়। উদ্দেশ্য—এদেশের লোকদের স্বাধীনতার স্পৃহা স্তিমিত করে তাদের আত্মরক্ষার্থে ব্যস্ত রাখা। কিন্তু এতে বিপ্লবী আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে উঠে। বিপ্লবীরা বুঝেছিল যে সমগ্র জনগণের সাহায্য আপাতত নিষ্প্রয়োজন। বিপ্লবী পন্থাতে দেশোদ্ধারে সঙ্ঘবদ্ধ স্বল্প লোকই যথেষ্ট। বিপ্লবীরা পথে-ঘাটে স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারদের গুলি করতে শুরু করলো।

[ওই কালে ইংরাজরা বাঙালীকে শিরোপরি রেখেছিল। দেশ জয় করার পর তারা বাঙালীদের দ্বারা গর্ভমেন্ট স্থাপন করতো। কর্মীসহ সমগ্র ভারতে বড় সাহেব বলতে ইংরাজ ও ছোট সাহেব বলতে জনৈক বাঙালীকেই বুঝতো। বাঙালী যেখানেই গিয়েছে সেখানেই একটি কালীবাড়ি, একটি নাটশালা ও স্থানীয় ব্যক্তিদের জন্য কয়টি স্কুল ও কলেজ স্থাপন করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিপ্লব ও আন্দোলনের জন্য একালে বাঙালীরা ইংরাজদের অত্যন্ত বিরাগ ভাজন হয়েছিল।]

“প্রায়ই দেখা যেতো হাসপাতাল হতে নিহত অফিসারদের শবাধার বাহীদের পিছনে উদীপরা পুলিশ বাহিনীর শোভাযাত্রা। পুলিশ কোয়ার্টার্সের সুমুখে শবাধার নামলে পুষ্পাচ্ছাদিত মৃতদেহের উপর এক সত্য বিধবা বাটির ভিতর থেকে ছুটে এসে আছডে পড়লো। কয়েক জন তখুনি তাকে জোর করে তুলে ভিতরে নিয়ে গিয়েছে। এরপর শ্মশানে লাস্ট বিউগিল বেজে উঠলো। তারপর উচ্চ ও নিম্নপদী সহকর্মীরা একে একে মৃতদেহকে স্যালুট করে ফিরে এসেছে।”

ওই সময় সকালে বেরুলে বিকালে ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই। রাত্রে ফিরতে দেরি হলে ধরে নেওয়া হতো যে অমুক বাবু আর ইহজগতে নেই। কিন্তু তার জন্য ভীত হয়ে কেহ বদলী হতে বা কর্মে ইস্তফা দিতে চান নি। ইংরাজদের নিকট ভীত লোক প্রতিপন্ন হতে তাদের অসীম লজ্জা। কর্তব্য কর্মে ওঁদের কারো গাফলতি দেখা যায় নি।

তবে—একথাও ঠিক যে ওই পরিবারের নিহত কর্মীদের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার নিয়েছে। তাদের পুত্র কন্যার শিক্ষার ব্যয় ও কন্যাদের বিবাহের অর্থ গর্ভমেন্ট যোগাতো এবং পুত্রকে উপযুক্ত চাকুরিও দেওয়া হয়েছে। বেঁচে থাকলে স্ব স্ব পরিবারের জন্য তারা এতটা করতে পারতো না। তাদের বিধবারা আজীবন পেনসনভোগী হতো।

[ওই কালে বেসরকারী ও সরকারী ইংরাজ কর্মকর্তারা অবসর গ্রাহী বা‘মৃত কর্মীদের পুত্রদের খুঁজে ডেকে এনে চাকুরি দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে ওদেরই পুত্ররা ভেদনীতির ফলে ব্রিটিশ তাড়াতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে।]

এঁর কর্মকালে ডঃ বিধানচন্দ্র রায় মেডিকেল কলেজ হতে ডাক্তার হয়ে বেরুনোর পর কিছু সময় কলকাতা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের কেডেটদের ফার্স্ট এইড, পড়াতেন সেইদিন উনি কল্পনাও করেন নি যে ভবিষ্যতে একদিন মুখ্যমন্ত্রীরূপে ওই পুলিশেরই উনি অধিকর্তা হবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *