সন্দেশ

সন্দেশ

‘সন্দেশ’ যারা পড়ো। তারা কেউ জানো না, বছর খানেক আগে আমি একটা বেজায় নিষ্ঠুর কাজ করেছি। সাতাশ বছর ছিলাম সে বাড়িতে, সে বাড়ি ছেড়ে নতুন একটা ভাড়া বাড়িতে চলে এসেছি। আসার সময়ে কতজনকে যে দুঃখ দিয়েছি, তা বলতে পারি না। দেয়ালে টাঙানো ছবির পিছনে থাকত একজোড়া মোটাসোটা।

টিকিটিক। টিকটিক বিষয়ে তোমাদের তেমন পরিচয় নেই।

গৃহপালিত ক্ষুদে জন্তুদের মধ্যে টিকটিকিদের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী আর নেই। বইয়ের তাকে আরশোলা? ওরা মিটমিট করে তাকাতো। তারপর খপাখপ আরশোলা ধরত আর খেত। এ রকমই চলছিল। পিঁপড়ে কিছু কম ছিল না। তবে আমাকে তেমন কামড়াত না। ছিল কাঠবিড়ালি। চড়াই পাখি। ছাতে ধান, মুড়ি বা চাল ছড়িয়ে দিলে আগে আসত পায়রার ঝাঁক। পায়রাদের পিছন পিছন আসত কাক। তারপর গোটা কয় শালিক দেখা দিত। ওই সব বন্ধুদের ফেলে চলে এলাম কেন বলো তো? ন্যাদোশের জন্যে।

ও বাড়িতেই ন্যাদোশ যখন তখন ঢুকতে শুরু করল। যখন বেঁচেছিল, কী রকম স্বাধীনচেতা গোরু ছিল তা তো জানোই। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা আসার অনেক আগেই ন্যাদোশ মরে যায়। তারপর পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে।

আবার হঠাৎ একদিন দেখি, আমার ঘরে ন্যাদোশ। এর আগে কয়েকবার এসেছে। তারপর আবার…

—তুমি?

—এই…দেখা করতে।

—এলে কী করে?

—মাঝে মাঝে মন খারাপ তো হয়।

—ঢুকলে কী করে?

—কেন। জানলাটা খোলা ছিল না?

—কিছু খাবে?

ন্যাদোশ হ্যা হ্যা করে হাসল। বলল—জানো, আমি থাকি গো—স্বর্গে? নন্দনকাননের পাশে আমাদের জন্যে বিশাল তরকারির খেত। যত ইচ্ছে খাও। মন্দাকিনীর জলে স্নান করো, আমি একজন…যাকে বলে—সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোরু।

—কেন? মাছ মাংস খেতে বলে?

সত্যি বলতে কি ন্যাদোশ কী করে ‘সর্বজন শ্রদ্ধেয়’ হতে পারে তা ভেবে আমি মনে মনে ভির্মি খেলাম। যদিও তোমরা আমার মতো শিবরাম চকরবরতির অথবা লীলা মজুমদারের গপপো পড়ে বড়ো হওনি, তবু একটা নিশ্চয় জানো ‘ভির্মি’ কোনো সুখাদ্য নয়। ভির্মি খাওয়া মানে কি, তা কোনো বুড়োবুড়ি পেলে জেনে নিও। আমি তো বড় হতেই পারলাম না, ঝপ করে বুড়ো হয়ে গেলাম।

আমার কথা শুনে ন্যাদোশ নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার বুদ্ধি আর পাকল না। মাছ, মাংস খেতাম বটে। কিন্তু সে জন্যে কি সর্বজন শ্রদ্ধেয় খেতাব পেয়েছি? সর্বজন শব্দটা খেয়াল করো। এই ‘জন’ মানে মানুষ নয়, গোরু। আমি গো—লোকের প্রতি গোরুর শ্রদ্ধেয়।

—বটে? তুমি এখন শ্রীকৃষ্ণের গোলোকে আছ?

—ইডিয়ট! কি জানো স্বর্গ সম্পর্কে? কৃষ্ণ আছে গোলোকে। আর একদা গোরু চরাতেন বলে আমরা, বিখ্যাত গোরুরা আছি গো—লোকে, অর্থাৎ গোরুদের স্বর্গে। সেখানে আমি সর্ব গোরুদের শ্রদ্ধেয়। কেন বলো তো?

—বলছি বলছি।

তোমরা, যারা লেখাটা পড়ছ, তারা দৃশ্যটা কল্পনা করো। ঘরটা বড় জোর দশ বাই পনেরো ফুট।

ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হয়। যে জানলার পাশে আমার লেখার টেবিল, সে জানলার ওপারেই এক টুকরো ছাত। জানলায় কাক বসছে, রোজই বসে। ঘরে আমার সাধের বেড়াল সুন্দরী কুট্টি ঘুরছে।

ন্যাদোশ ধরাধামে, মানে পৃথিবীতে, মানে বহরমপুরে যেমন দেখতে ছিল, তেমনই আছে। পেট মোটা। ল্যাগবেগে পা, উচঁনো শিং আর ট্যারা চোখ। সে আমার সামনেই বসে আছে। অথচ ওর মধ্যে দিয়ে কুট্টি ঘুরছে, চেনা পিওন এসে চিঠি দিয়ে গেল। ন্যাদোশ আছে, কিন্তু নেই। এযে কি ঝামেলা কী বলব। যখন তখন জানলা দিয়ে ঢুকে পড়ে।

—বলি শুনছ, না শুনছ না?

—শুনছি, শুনছি।

—যখন তোমাদের বাড়ি ছিলাম, তখন মাছ মাংস খেতাম বটে, আবার তোমাদের ভাইবোনদের স্কুলের বইও খেতাম, মনে আছে?

—থাকবে না কেন? বছরে কয়েকবার ওদের বই কিনতে হোত।

—বই খেয়ে খেয়ে আমার ইংরিজির নলেজটা যাকে বলে ভেরি ডীপ!

—ছি ছি, বাংলা ইংরাজির ফোড়ন দিচ্ছ?

ন্যাদোশ অতি বিচ্ছিরি ভাবে হাসল। বলল, বাংরেজি তো সেই বুড়োটার কাছে শেখা, যে তোমার ভাইদের মাঝে মাঝে অঙ্ক শেখাত?

—ছি ন্যাদোশ! মধুময়বাবু গরম কালে আম আর ইলিশ মাছ বরাবর পাঠাতেন। তুমি অনেক খেয়েছ। তাঁকেই বলছ বুড়ো?

—আহা হা! সে বলত না। ডগটা আমাকে অ্যাটাক করবে বলে চেজ করেছিল, কিন্তু বাইট করতে পারে নি।

—বলতেন…বলতেন…যাক গে, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ন্যাদোশ! আজ আগমনের কারণ কী?

ন্যাদোশ বেজায় লজ্জা লজ্জা মুখ করল। আমি ভাবলাম জীবনে ভাবিনি ন্যাদোশ এমন কিন্তু কিন্তু মুখ করবে! কী বজ্জাতি না করেছে একদা! সর্বদাই তো বেপরোয়া নির্ভীক!

—বলতে লজ্জা পাচ্ছ?

—মানে…তুমি আমাকে নিয়ে ‘গল্পের গরু ন্যাদোশ’ লিখেছিলে বলেই তো যাকে বলে…আমার নামডাক হল!

—ভুলে যাচ্ছ। ভুলে যাচ্ছ ন্যাদোশ! ওই বইয়ের কথা জানাজানি হয়ে যাবার পর তোমাদের গো—স্বর্গের পঞ্চায়েত তোমাকে একঘরে করে নি?

—করেছিল। বেজায় বিপদে পড়েছিলাম। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, হিমাচলের হাতি মার্কা। গোরুগুলো ‘বেটা মাছ মাংস খেত’ বলে বেজায় ক্যাচাল বাধায়! তখন…

—তুমি যথারীতি আমার কাছে এলে। আমি বোঝালাম আমেরিকা আর ইংল্যান্ড এখন গোরুদের অ্যানথ্রাকস রোগ নিয়ে ভীষণ ভাবছে। তা তুমি হচ্ছ গোরুদের মধ্যে প্রথম শহীদ! মাছ মাংস খেয়ে শরীরে ওই রোগটি তুমিই বাধালে, মরেও গেলে!

—তাই তো বটে!

—তারপরে?

—সবাই আমাকে ধন্যি ধন্যি বলল।

—দেখ ন্যাদোশ, আমার কাছে এখন লোক আসবে, আমার কাজ আছে।

—কাজ দেখিও না তো! কাজের মধ্যে কাজ তো বসে বসে লেখা! আর লোক আসবে মানে? তারা কি ধরাধামে আছে? না আমার মতো জানলা দিয়ে ঢুকবে?

—রীতিমতো জলজ্যান্ত মানুষ। সিঁড়ি ধরে উঠবে।

—আসুক না! আমিও থাকি।

—না ন্যাদোশ! প্লিজ!

—ধুস! আসল কথাটাই বলতে দিলে না।

—আরো কথা আছে?

—হ্যাঁ, একটা ডেট দিতে হবে।

—ইচ্ছে মতো যাচ্ছ আসছ। ডেট দিতে হবে কেন?

ন্যাদোশ টপ করে পেছনের দু ঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে গেল। সামনের দুটো ঠ্যাঙ জোড়া করে বলল, তোমার গল্প ওদের বলেছি। ওরা তোমাকে দেখতে চায়।

—কেন?

—তার কারণ তুমি ‘গল্পের গরু ন্যাদোশ’ লিখে আমাকে বিখ্যাত করেছ। ওরা দল বেঁধে আসবে। তোমাকে সম্মান জানাবে। আমার ইজ্জতের ব্যাপার!

—আমি…আমি তো বাইরে যাচ্ছি।

—কোথায় যাচ্ছে?

—ভাবছি একবার মেদিনীপুরে যাব।

—ক’দিন থাকবে?

—ঝাড়গ্রামে ক’দিন…কানাইসর পাহাড়…বেশ ক’দিন লাগবে।

—আমাদেরও তৈরি হতে সময় লাগবে।

—তোমরা ক’জন আসবে?

—আসতে তো চায় অনেকেই! তা তোমার ঘরদোর যা! ধরো কেটেছেঁটেও জনা পঞ্চাশেক তো হবেই।

—পঞ্চাশটা গোরু?

—তা হবে না? প্রতি রাজ্য থেকে একজন আসবে। তা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণের বেন্দাবনী গোরুরাও..

—বসবে কোথায়?

—তুমি বসবে তোমার ছাতে। আমরা নয় শূন্যে ভেসে থাকব।

—তার চেয়ে একটা হলঘর ভাড়া করি?

—সেটাই ভালো হবে। তাই করো। পাকা কথা তো?

—একদম পাকা।

—বাববা! বাঁচা গেল। আজ দেখ, আড্ডা মারতে আসিনি। কাজের কথা বলতে এসেছিলাম।

সিঁড়িতে ধুপধাপ শব্দ। নিশ্চয় ভোম্বল আর পল্টু উঠছে! ন্যাদোশ বলল—বাই বাই।

আমিও বললাম—বাই!

ন্যাদোশ জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

আর আমি? ন্যাদোশদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আগেই বেজায় তাড়া লাগালাম সকলকে। বাড়ি চাই, বাড়ি! যে বাড়িতে ন্যাদোশ আর আসবে না। অথবা এলেই আমি বলব, নিকাল যাও। এতদিন আসছিল, আসছিল। গোরুদের স্বর্গের পঞ্চাশটা বড় বড় গোরু এসে আমাকে সম্মান জানাবে?

হিমাচলের গোরুরা (মানে গো—স্বর্গবাসী গোরুরা), না কি সংস্কৃত বলে, ন্যাদোশই বলেছিল। আমি কেমন করে সংস্কৃত বলব? ক্লাশ সেভেন আর এইটে কী পড়তাম, তাই কী মনে আছে?

বেজায় তাগাদা লাগালাম সকলকে, বাড়ি দেখো। বাড়ি খোঁজো।

আমি বাড়ি খুঁজছি জেনে কুট্টি একদিন ওর দারুণ সুন্দর লেজটা তুলে টা টা জানিয়ে দেশে চলে গেল। বেড়ালরা এমন যে করেই থাকে, তা বেড়াল পুষিয়েরা জানে।

টিকটিকিরা জানিয়ে গেল, ওরা মনক্ষুণ্ণ হয়েছে।

আরশোলাদের সঙ্গে তেমন বন্ধুত্ব কোনোদিনই হয়নি। তবে লাল পিঁপড়েদের বক্তব্য, ওরা কোনদিনই আমাকে তেমন কামড়াইনি। ওদের উৎপাতে আমি চলে যাচ্ছি। এমন কথা যেন না বলি!

পায়রা, শালিক কাক আর চড়াইরা খুব অভিমান করেছিল। আর মশারা বলেছিল, যেখানেই যাও, আমরা সেখানেও যাব। ভাবছ গা—ঢাকা দেবে? অলিতে গলিতে মশাদের ইউনিয়ন আছে। তারাই খবর দেবে।

ওই ন্যাদোশের জন্যেই বাড়ি ছাড়লাম। ন্যাদোশের হাত থেকে কি মুক্তি পাব?

দেখাই যাক।

যদি এখানেও আসে, সবচে’ আগে জানবে তোমরা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *