সংস্কৃত সমাজের আড়কাটীরা

সংস্কৃত সমাজের আড়কাটীরা

ধূর্ত-পুরুষেরা রাজাকে বোঝাচ্ছিল—মহারাজ, আপনি যে নেশা করেন নিন্দুকেরাই একে নেশা বলে—আসলে এটুকু হল রাজ-সুলভ বিলাসিতা। আপনার ইচ্ছে লোকে জানুক—তাদের রাজা ইন্দ্রিয় পরবশ নয়। এই যে আপনি নিজের স্ত্রী পর্যন্ত ত্যাগ করে বসে আছেন, অনাসক্তির প্রমাণ এর থেকে বড় আর কী হতে পারে। আর পরস্ত্রী-গমনের কথা বলছেন—ওটুকুও যদি না থাকে, লোকে জানবে কী করে যে আপনি বিদগ্ধ পুরুষ। নৃত্য-গীত-বেশ্যা—এগুলো আপনার রসিকতা-বোধের পরিচয় দেয় মাত্র—এর বেশি কিছু নয়।

আমরা যে কাদম্বরী-চিত্রের একাংশ দেখলাম, তার কারণ এই নয় যে আমরা এইসব মহৎকর্মে কাউকে উৎসাহিত করতে চাই। তবে সংস্কৃত সাহিত্য পুরোহিত দর্পণ নয়—এই সাহিত্যের ধর্মীয় অংশ যেমন তৎকালীন সমাজকে ধারণ করেছে, তেমনি এক বিরাট জায়গা জুড়ে রয়েছে অন্যকিছু। সুন্দরের মধ্যে ছোট ছোট অসুন্দরের কথা, কল্পনার মধ্যে বাস্তবের ছোট ছোট রূঢ়তা, ভালোবাসার গভীরে কামনা-বাসনা লোভ—যা নাকি সমাজকে সত্যিকারের সমাজ করে তুলেছে। আলো যেমন সত্যি, অন্ধকারও তেমনি। কাজেই এই অন্ধকারের মধ্যে যাদের আনাগোনা তাদের কথা বলাও তো সত্যি কথা বলা।

এই যে ধূর্তপুরুষের কথা আমরা বললাম এরা সে যুগেও ছিল এ যুগেও আছে। বন্ধু-বান্ধব, দূত-দূতী—প্রেমের ক্ষেত্রে এদের মতো বড় সহায় আর কেউ নেই। কিন্তু এও তো আলোর কথা—প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয়ের আলো সমপ্রাণ সখা-সখীকে আলোকিত করে। চিরকাল তাই সে পৌঁছে দিয়েছে প্রেমিক-হৃদয়ের ভাবনা অন্যতরের কাছে। কিন্তু অন্ধকার যেখানে, প্রেম যেখানে অবৈধ, বড় বড় মানুষেরা যেখানে গতানুগতিক ভদ্র জীবনের গণ্ডি পেরিয়ে নিষিদ্ধ জায়গায় গেছে—কে তাদের নিয়ে গেছে সেখানে! যারা নিয়ে গেছে তারা রসশাস্ত্রের মার্কামারা দাস-দাসী নয়, সখা-সখীও নয়, বিদূষক তো নয়ই। যাদের কথা আমরা বলতে চাই—তাদের নামগুলো হয়তো ভরতের নাট্যশাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে সেদিনকার সাহিত্যদর্পণে পর্যন্ত পাওয়া যাবে, ভদ্রগোছের কিছু নাটকেও হয়তো দেখতে পাব এদের, কিন্তু বাস্তবে এদের ক্রিয়াকলাপ একেবারেই আলাদা, ভাব-ভঙ্গিও একটু অন্যরকম। নিরুত্তাপ হৃদয়েও মোহের সংক্রান্তি কাটিয়ে কখনও ভদ্রঘরের বউ-ঝিকে এরা ফুসলে নিয়ে আসে, কখনও তা তপ্ত-হৃদয়ে ইন্ধন জোগায় বহুতর।

অবশ্য প্রণয় যেখানে অবৈধ, রমণী যেখানে স্বৈরিণী, সেখানে সবসময় যে অন্যের সাহায্য লাগে তাও নয়—ইশারা-ইঙ্গিত সেখানে স্বমুখেই চলে। এদের বলে স্বয়ংদূতী—রমণী নিজেই এখানে মনের মানুষ জোগাড় করে—সে নিজেই নিজের দূতী। স্বামী প্রবাসে গেছেন, বিদেশি পান্থকে দেখে মনে হল ‘আহা মরি মরি’—শরীর-মন তাও তো ব্যর্থ—একে না পেলে। সে বলল—আমার বুড়ি শাশুড়ি শুয়ে থাকেন এখানটায়, আর শ্বশুর তিনি আবার বুড়োদের মধ্যেও বুড়ো—তিনি থাকেন এখানটায়, কাজের মেয়েটি সারাদিন ঘরের সমস্ত কাজে ক্লান্ত—গা এলিয়ে পড়ে থাকে এইখানে। আর আমি—কদিন হল আমার প্রাণনাথ প্রবাসে—এ অধমকে তাই একাই থাকতে হয় এ ঘরে।

উতলা স্বৈরিণী ভাবে-ভঙ্গিতে কথা কয়ে নিজেই পান্থকে জানিয়ে দিল তার একা থাকার ঠিকানা। বুঝিয়ে দিল—জড়, অক্ষম শ্বশুর-শাশুড়ি, আর গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন দাসী—কেউ ঘুণাক্ষরেও জানবে না পথিকের অবস্থিতি।

তবে স্বৈরিণী-সমাজে সবাই সুমুখেই ভোগের কথা বলে না, তারও বন্ধুবান্ধব আছে দাসদাসী আছে—তারা তাদের মতো করেই মানুষ জোগাড় করে। তবে অন্যায়, অবৈধতা যেহেতু সোজা রাস্তায় হয় না, তাই এদেরও সবসময় সাধারণ বেশে পাওয়া যায় না। এইরকম একটা নাম হল লিঙ্গিনী। লিঙ্গিনী মানে এমন এক মহিলা যিনি বৃদ্ধা এবং তপস্বিনী কিংবা পরিব্রাজিকা বলে পরিচিত—বেশবাসও তপস্বিনীর। সাধারণত এদের কেউ সন্দেহ করে না, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরা শ্রদ্ধাস্পদও বটে এবং সেই সুযোগেই এরা কুলনাশিনী। এইরকম একজন লিঙ্গিনীর সঙ্গে পরিচয় হবে কথাসরিৎসাগরে—বণিক গুহসেন বাণিজ্যের জন্য তাম্রলিপ্ত থেকে কটাহদ্বীপে গেছেন। অন্যদিকে চারজন লম্পট গুহসেনের স্ত্রী দেবস্মিতার চরিত্র নষ্ট করার জন্য তাম্রলিপ্ত পৌঁছান। উদ্দেশ্য সিদ্ধি করার জন্য তারা যোগকরণ্ডিকা নামে এক ভিক্ষুণীর সঙ্গে দেখা করল এবং অনেক টাকাপয়সার লোভ দেখাল। ভিক্ষুণী বলল—”তোমাদের মতো যুবকদের নিশ্চয়ই কোনো স্ত্রীলোক প্রয়োজন, তার পরিচয় বল, আমি তোমাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব। টাকাপয়সায় আমার দরকার নেই, আমার শিষ্যা সিদ্ধিকরীর দৌলতে টাকা আমার অনেক আছে।” বোঝা যায় ঘরভাঙার কাজ-এর পেশা ও নেশা, এখন সে টাকাপয়সারও ধার ধারে না। সিদ্ধিকরীও তপস্বিনী এবং মনে হয় এ হল ‘সাব-এজেন্ট’। এরপর দুই তপস্বিনী কাজে নামল এবং বুদ্ধির প্রখরতায় চার পাপিষ্ঠকে দেবস্মিতার ঘরেও তুলে দিয়েছিল। ঘরের কুকুরটিকে পর্যন্ত চেঁচাতে দেয়নি, লঙ্কামাখা মাংসখণ্ড খাইয়ে তাকে ব্যস্ত রাখা হয়েছিল লালা ঝরায়। তবু শেষ রক্ষা হয়নি, তার কারণ—দেবস্মিতার সতীত্ব নয়, তার কারণ—লিঙ্গিনীর চেয়েও তার বুদ্ধি বেশি।

যোগকরণ্ডিকার মতো ভিক্ষুণীরা যে এইসব কূট মধ্যস্থতার ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিল, সেটা বোঝা যাবে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। কৌটিল্য মূলত রাজনীতিক, তাই তিনি এদের ব্যবহার করেছেন রাজ্যের মধ্যে প্রতিকূল সংঘ, যাকে আমরা ইংরেজিতে ‘অ্যাসোসিয়েশন’ কিংবা ‘ইউনিয়ন’ বলি—সেগুলো ভাঙার কাজে। তাঁর মতে রাজা প্রতিকূল সংঘমুখ্যের (অ্যাসোসিয়েশন লিডার) বিরুদ্ধে আরেক সংঘমুখ্যকে লাগিয়ে দেবেন। ধরা যাক, যাঁর বিরুদ্ধে রাজা এইরকম ভেদনীতি গ্রহণ করেছেন, তিনি একটু পত্নী-প্রেমিক। তাঁর কাছে একটি স্ত্রী-গুপ্তচর যাবে এবং সে যাবে ভিক্ষুণীর বেশে। সে বলবে ”অমুক প্রধান যৌবনের উন্মাদনায় আপনার স্ত্রীর ওপর কামনা-মোহগ্রস্ত। তাঁর ভয়ে আমি এই চিঠি আর উপহার নিয়ে এসেছি দূতীয়ালি করতে। আমি জানি আপনার স্ত্রী নির্দোষ, সেক্ষেত্রে আপনি প্রচ্ছন্নভাবে এর ব্যবস্থা নিন।” কৌটিল্য এই ভিক্ষুণীদের আবার নিয়ে এসেছেন রাজমন্ত্রীর চরিত্র পরীক্ষার ব্যাপারে। সেখানে রাজমহিষীকে জড়িয়েই ভিক্ষুণী তার পরীক্ষার কাজ চালাবে।

ভিক্ষুণীর বেশের মধ্যে গুপ্তচর থাকুক আর যাই থাকুক, ঠিক এই ধরনের মধ্যস্থতায় ভিক্ষুণীর ব্যবহার অবৈধ প্রেমে তাদের কর্মকুশলতা সূচিত করে। তাছাড়া রাজমহিষীর ওপর বিশ্বাসের থেকে ভিক্ষুণীর ওপর কৌটিল্যের অবিশ্বাস বেশি ছিল কেননা তাঁর মতে রাজমন্ত্রীকে পরীক্ষার ব্যাপারে রাজমহিষীকে না জড়ানোই ভালো কেননা ভিক্ষুণীর পরিচালনায় রাজমহিষীই হয়তো ফেঁসে গেলেন, তখন? শুধু ভিক্ষুণী কেন, এদের কর্মকুশলতায় শঙ্কিত হয়ে কৌটিল্য বলেছেন—রাজমহিষীরা যেন কখনও কোনো মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ ভিক্ষুক কিংবা জটাধারী সাধু-সন্তদের সঙ্গে মেলামেশা না করেন। তার মানে উলটো দিক দিয়ে মেয়েদের মন ভাঙাতে এরাও কম নয়।

ভিক্ষুণী-পরিব্রাজিকা ছাড়াও আর কতকগুলো নাম পাওয়া যাবে বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রে এবং আলংকারিক শারদাতনয়ের ভাবপ্রকাশনে। পরিশীলিত রুচি এবং রূঢ় বাস্তব—এই দুয়ের দ্বৈরথে রুচিই যেহেতু আলংকারিকের কাছে বড়, বাৎস্যায়নের নামগুলোকেই তাই তাঁরা মেনে নিয়েছেন রসশাস্ত্রের অনুপান মিশিয়ে, কিন্তু হাজার খুঁজলেও সে চরিত্র কোনও ভালো কাব্য-নাটকে পাওয়া যাবে না—যেমন শারদাতনয়ের কাহিনি। শব্দটি অভিধানে পাওয়া যায় না, তবে নাম শুনে বঙ্কিমচন্দ্রের মৃণালিনীতে গিরিজায়ার কথা মনে পড়ে। বঙ্কিম এর পরিচয় দিয়েছেন ভিখারিণী বলে, তবে কথা এবং গানের দৌলতে তাকে কথিনী বলতে অসুবিধে নেই। আরও দুটি শব্দ পাওয়া যাবে ঈক্ষণিকা আর প্রেক্ষণিকা। প্রথমটির উল্লেখ করেছেন স্বয়ং বাৎস্যায়ন, দ্বিতীয়টি শারদাতনয়। ঈক্ষণিকা মানে মোনিয়র উইলিয়মস লিখেছেন দৈবজ্ঞ, মোটামুটি স্ত্রী-জ্যোতিষী। জ্যোতিষীরা অনেকে, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে গণিকার গুণগ্রাহিতায় সাহায্য করত, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে দণ্ডীর দশকুমারচরিতে। বেশ্যামাতারা এই জ্যোতিষীদের কাজে লাগাত কোনও গণিকার সুলক্ষণ ঘোষণা করার জন্য। জ্যোতিষে বিশ্বাসী অথচ কোনও লম্পট যদি সেই জ্যোতিষের কাছে আসে তবে সে বলবে—অমুক জায়গায় এক সুলক্ষণা গণিকা আছে, তার সংসর্গে প্রভূত কল্যাণ হতে পারে।

শারদাতনয়ের প্রেক্ষণিকা কিন্তু একেবারে আলাদা, প্রেক্ষণিকা মানে যারা খুব নাটক-থিয়েটার দেখতে ভালোবাসে। সুদূর অতীতে যারা বেশিমাত্রায় বাড়ির বাইরে নাটক-থিয়েটার দেখতে যেত তাদের খুব ভালো চোখে দেখা হয়নি কারণ সেই বৈদিক যুগে শতপথব্রাহ্মণে লেখা হচ্ছে—মেয়েরা স্বভাবতই অনর্থক গল্প করতে ভালোবাসে আর নাচা-গানা হলেই সেখানে তারা একেবারে আসক্ত হয়ে পড়ে। তৈত্তিরীয় সংহিতায় আছে—গায়ক দেখলেই মেয়েরা একেবারে ঢলে পড়ে—গায়ন্তং স্ত্রিয়ং কাময়ন্তে। কাজেই নাচ-গান-নাটকের আসরে যাদের গমনাগমন বেশি, বাইরে বেড়ানোর সুযোগ তো তাদের রয়েছেই—মনটাও তাদের একটু বেশি রস-নিষিক্ত। স্বাভাবিক কারণেই হৃদয়ে হৃদয়ে পরিচয় করানোর কায়দাটিও তারা জানে ভালোই। এই সব নাট্যামোদী মেয়েরা যে ভদ্রঘরের মেয়েদের মন উচাটন করতে পারে সে কথা আরও বোঝা যাবে হিন্দুসমাজের সর্বকালের অভিভাবক মনু-মহারাজের কপালে ভাঁজ পড়ায়। নবম অধ্যায়ের প্রথমেই তিনি সাবধান করে দিয়েছেন—মেয়েরা যেন গান-বাজনা এই সব বিষয়ে একেবারে আসক্ত না হয়। তা ছাড়া ছোটখাটো ব্যাপারেও দুষ্ট-স্বভাব স্ত্রীলোকদের কিংবা বদলোকের সঙ্গে মেলামেশা করা, যখন-তখন দোকানে-বাজারে, মেলায়-মন্দিরে যাওয়া—এসব তিনি একদম পছন্দ করতন না। আমাদের মনে হয় এই অপছন্দের কারণ হল—তিনি জানতেন এই সব জায়গায়ই দুষ্ট স্বভাবের মেয়েরা এবং ছেলেরা মেয়ে ধরার জন্য ওৎ পেতে বসে থাকে।

সাহিত্যদর্পণ আবার ঈক্ষণিকা-প্রেক্ষণিকা—এ সবাইকে বাদ দিয়ে দূতী হিসেবে নটীদের কথা বলেছে। নটীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেরাই গণিকা ছিল, কাজেই তারা যে মধ্যস্থতার কাজও ভালো করবে—তাতে সন্দেহ কি? আসলে নটীই কী আর ভিক্ষুণীই কী, ঈক্ষণিকাই হোক আর প্রেক্ষণিকা—এরা একটা জাত, যে জাতের সাধারণ নাম কুট্টনী। মালিনী কি তাম্বুলিকা—এটা এদের বাইরের মনভুলানো পেশা। পেশাটি এদের সুযোগ দেয় মাত্র—যে সুযোগে তারা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করে, কিন্তু অন্যেরাও তাতে সন্দেহ করে না। সংস্কৃত সাহিত্যের এই কুট্টনীকে রসশাস্ত্রের জারক মিশিয়ে একেবারে বাঙালি আদলে উপস্থিত করেছেন ভারতচন্দ্র—

সূর্য্য যায় অস্তগিরি আইসে যামিনী।
হেনকালে তথা এক আইল মালিনী।।
কথায় হীরার ধার, হীরা তার নাম।
দাঁত ছোলা, মাজা দোলা হাস্য অবিরাম।।
গাল-ভরা গুয়া পান পাকি মালা গলে।
কাণে কড়ি, কড়ে রাড়ী, কথা কয় ছলে।।
চূড়া বাঁধা চুল, পরিধানে সাদা শাড়ী।
ফুলের চুপড়ি কাঁখে ফিরে বাড়ী বাড়ী।।

প্রাতঃস্মরণীয় দীনেশ সেন মশায় লিখেছেন—”বিদ্যাসুন্দরের হীরা, বিদু ব্রাহ্মণী প্রভৃতি কুট্টনী ও কামিনীকুমারের সোনামুখীর ন্যায় দাসী বঙ্গীয় হিন্দু সমাজের খাঁটি চরিত্র নহে…হীরার ন্যায় নাগর ধরিবার ফাঁদ বিদেশের আমদানী।”—তা হলেও হতে পারে এবং তাতে আমরা গর্বিত। দীনেশ সেন মহাশয়ের কল্পিত বঙ্গীয় হিন্দু সমাজে হয়তো এরা ছিল না, কিন্তু বিদেশের, মানে ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজে এরা ছিল এবং বেশ ঠাট-বাট নিয়েই ছিল। কারণ ভারতচন্দ্রের এই সাদা শাড়ি পরা রাড়ীর সঙ্গে বাৎস্যায়নের ‘বিধবা’ দূতীর বেশ মিল আছে এবং বাৎস্যায়নের মতে এই সব দূতীর অন্যতম কাজ হল—এরা স্বামীর ওপর স্ত্রীর মন বিষিয়ে দেবে, বিচিত্র সুরতসম্ভোগের চিত্র দেখাবে, যে পুরুষের জন্য কাজ করতে এসেছে তার অনুরাগ এবং রতি-কৌশল জানাবে, আর সে পুরুষটিও যে অনেক রমণীর কাম্য, তাও বোঝাবে। দূতী-কুট্টনীর এই সমস্ত কর্মপদ্ধতি সাতবাহন হালের গাহাসত্তসঈ খুললে অনেক পাওয়া যাবে। অতদূর না গেলেও হাতের সামনে বাল্মীকি রামায়ণ খুললে দেখা যাবে, রাবণের কুট্টনীরা রাবণের অতুল রতিক্ষমতার বর্ণনা করে রামের প্রতি সীতার মন বিষিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। তবে এরা বিধবা কিনা সন্দেহ আছে। পাঠক আরও বলতে পারেন—এরা তো চেড়ী, অন্তত কৃত্তিবাসের প্রমাণে তো তাই। আমরা বলব—এ চেড়ী আর কিছুই নয়, আসলে এরা চেটী। চেড়ী শব্দটি সংস্কৃত চেটীর রূপান্তর মাত্র, যার অর্থ মোটামুটিভাবে দাসী। দাসী হলেও নায়িকার মনের মানুষ পাওয়াতে এরা সাহায্য করে, তবে এ চেটী বা দাসী ঠিক সাহিত্যের দাসী নয়, বাৎস্যায়নের দাসী। কৌটিল্যও ঠিক বাইরের দাস-দাসীদের রাজমহিষীর অন্দরমহলে প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছেন, কারণ কি কিছুই নেই? এই চেটী বা দাসী কী করতে পারে তার প্রমাণ পাব সুপ্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ মহাবস্তু অবদানের শ্যামা জাতকে, যে জাতকের আমূল রূপান্তর ঘটিয়ে অপূর্ব এবং ভদ্রস্থ করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।

শ্যামাজাতকের শ্যামা সুন্দরীপ্রধানা বটে, তবে গণিকা। অশ্ববণিক বজ্রসেনের মহেন্দ্রনিন্দিত কান্তি দেখে শ্যামা ‘শীঘ্র যা লো সহচরী’ বলে প্লুতস্বরে যাকে ডাকছেন সে কিন্তু আসলে চেটী। শ্যামার মন বুঝে সে কোটালের হাতে টাকাপয়সা গুঁজে দিয়ে বলল—একইরকম চেহারার আর একটি পুরুষ তোমায় দেব, তাকে মার—কিন্তু একে ছেড়ে দাও—এ আমার মালিকানীর মনে ধরেছে। কোটাল মেনে নিল তথাস্তু বলে। অন্যদিকে আর এক বণিকপুত্র এসে শ্যামার ঘরে ঢুকল—তিনি বারো বছরের জন্য গণিকা শ্যামাকে কিনে নিয়ে বাঁধাবাবু সেজেছিলেন। দশ বছর কেটেছে, তাই একটু মায়াও আছে শ্যামার ওপর। শ্যামা করল কী—অনেক খাবার-দাবার সাজিয়ে বাঁধা-বাবুকে বলল—আর্যপুত্র, একজনকে শূলে চড়ানোর জন্য বধ্যভূমিতে নিয়ে গেল, বড় মায়া লাগছে, তাই এই খাবারগুলো তাকে একটু দিয়ে আসব। বণিকপুত্র বলল—ওসব জায়গায় তুমি একা মেয়েমানুষ, যেয়ো না। তার চেয়ে দাও, আমিই দিয়ে আসি। শ্যামা বলল—আর্যপুত্র, সে কি হয়, আপনাকে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত শ্যামার ছলনায় ভুলে, লক্ষ্নৌ-এর বাবুর মতো ভদ্রতা দেখিয়ে বণিকপুত্র নিজেই গেল। এবার চেটীর কাজ। চেটী বণিকপুত্রের প্রাণের বিনিময়ে বজ্রসেনকে লুকিয়ে শ্যামার ঘরে এনে তুলল। বিলাসে, ব্যসনে ভালোই কাটছিল দিন কিন্তু ক্রমে বজ্রসেন সব জানতে পারলেন এবং ভাবলেন—একইভাবে তাঁকেও প্রাণ দিতে হতে পারে, আরেকজনের প্রাণের বিনিময়ে। পালাবার জন্য শেষ পর্যন্ত এক উপায় বার করলেন। বারাণসীর উদ্যানভূমি সংলগ্ন এক ক্রীড়া-সরোবরে কেলি করার নাম করে শ্যামাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। তারপর প্রেম-প্রেম চোখের ঠারে তাকিয়ে, শ্যামাকে প্রচুর পরিমাণ মদ খাইয়ে এবং তার থেকেও বেশিবার জলে ডুবিয়ে একেবারে মৃতপ্রায় অবস্থায় পদ্মপুকুরের সিঁড়ির ওপর ফেলে রেখে পালালেন। চেটীরা এতক্ষণ উদ্যানে—একটু দূরেই বসেছিল। মালিকানী প্রেমিকের সঙ্গে ক্রীড়া করছেন—দেখাটা একটু লজ্জাও বটে। শেষে কোনো শব্দ না শুনে সন্দেহ হল, দেখল শ্যামা মৃতপ্রায়। নানা কৌশলে শ্যামাকে বাঁচিয়ে তুলল চেটীরা। কাজেই গণিকা শ্যামার চেটী শুধু দুঃসাহসী কুট্টনী নয়, বিশ্বাসী দাসীও বটে। রামায়ণে রাবণের চেড়ীদের তাই অন্যরকম ভাবার কোনো কারণ নেই—তবে তফাত এইটুকু যে, তারা জাতে রাক্ষসী; ভালো কথায় পরস্ত্রীর মন ভাঙাতে অসুবিধা হলে একটু-আধটু ক্রোধাবেশ হয় চেড়ীদের, তাছাড়া পরস্ত্রীটিও তো আর পরের ঘরে নেই, সে রয়েছে তাদের নিজেদেরই অশোকফুলের বাগানে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শ্যামা দ্বিতীয়বার যাদের মাধ্যমে বজ্রসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল—তারা ছিল নট-অভিনেতা। নটীদের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, এখন দেখছি তাদের পতি-দেবতারাও এ বিষয়ে কম যায় না।

আসল কথা কুট্টনী চেটী হবে, না নটী হবে, দাসী হবে, না সখী হবে, মালিনী হবে, না ভিক্ষুণী হবে—তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তার চেহারাটিও যে সবসময় হীরা মালিনীর মতো হবে তাও নয়—যেমন দামোদর গুপ্তের বর্ণনায় বারাণসীর বেশযুবতী মালতী গণিকোচিত পাঠ-গ্রহণের জন্য বিকরালা নামে এক কুট্টনীর কাছে গেল। বিকরালা পাকা ঝানু এক মহিলা, সংসারের হালচাল দেখে তার চুল পেকে গেছে। তার বাড়িতে বিশ্ব-কামীর গমনাগমন। দাঁত প্রায় পড়ে গেছে, যা আছে তাও আবার উঁচু-উঁচু, নাকটা মোটা আর চ্যাপটা, স্তনযুগল শুষ্ক—তনু শিথিল। সে আসনে বসে আছে, তার অঙ্গুলি-মূলে এক তন্বী বালিকা—নবিশি করে মনে হয়। তার চারদিকে গণিকাগণের পরিবার। মালতীর জবানিতে বোঝা যায়—বিকরালা ভুবনত্রাতা হরির কৌস্তুভমণি খসিয়ে দিতে পারে, ধনীকে নির্ধন করে দিতে পারে, নির্ধনকে ধনী। এসব যে, সে করতে পারে না—তার কারণ তার অসামান্য বুদ্ধি, যে বুদ্ধির কথা, হাজারো উপদেশের কথা—শুনতে পাওয়া যাবে দামোদর গুপ্তের সারা ‘কুট্টনীমতম’ জুড়ে।

বিকরালার মতোই এক প্রবীণা কুট্টনীকে দেখতে পাব হালের ‘গাহাসত্তসঈতে’। সে তার কাঁচা বয়সের কথা স্মরণ করে এক নবীনাকে উত্তেজিত করছে। বলছে—তখন সে-সব যুবকেরাও ছিল, সেই সেই গ্রাম-সম্পত্তিও ছিল, আর আমাদের ভরা যৌবনও ছিল—লোকেরা গল্পকথার মতো সে-সবের বর্ণনা করবে, আর বেঁচে থেকে সেগুলো আমাদের শুনতে হবে। অর্থাৎ তোদের এখন সেই বয়েস,বসে বসে কচ্ছিস কী? এমনকি মহিলা কবির শিরোমণি বিজ্জকা—যাঁর এক-একখানি শ্লোক এক-একখানি কাব্য বলে আলংকারিকেরা নির্ধারণ করেছেন—তিনি কুট্টনীর বেশে সতীপনায় বিশ্বাসী এক যুবতীকে বলছেন—আমরা বাল্যবয়সে অল্পবয়সী ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খেয়েছি, যৌবনে তরুণদের আর এখন পরিণত বয়সেও প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের ইচ্ছা করি। দেখ বাপু পরিণয়-বিধির এই রীতি। আর তুমি কিনা একটা স্বামীর সঙ্গে দিন কাটিয়ে মানবজন্ম ব্যর্থ করতে বসেছ, আমাদের গোত্রে ওরকম সতীর মার্কামারা কেউ নেই বাপু—’ন নো গোত্রে পুত্রি ক্বচিদপি সতীলাঞ্ছনমভূৎ।’

এ একেবারে পাকা কুট্টনীর কথা। কুট্টনীরা আসলে প্রায়ই বেশ্যাপ্রেমের সঙ্গে যুক্ত, যে প্রেমের রাস্তা—বহু-কৈতব-মার্গ-বিনির্মিতানি—ছল-চাতুরির রাস্তা। কুট্টনীরা এই কৈতব-মার্গের আট-ঘাট সব জানে, আর তার কথাবার্তার বাঁধন অতি বিদগ্ধ সাহিত্যিককেও হার মানাবে, কেননা—অত্যুৎসাহী যুবকের কানে কানে যদি এমন কথা বলা হয়—যৌবনোদগমে পল্লীবধূর উত্তমাঙ্গ যেমন পীন হয়ে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে তার কটিদেশ, তার প্রিয়তম, তার কুটুম্বস্বজন, তার সতীনেরা, আর রোগা হয়ে যাচ্ছে পল্লীর যুবক ছেলেরা। অর্থাৎ ভাবখানা হল—যুবতীর ওপর তার কুটুম্বস্বজনেরও নজর আছে—সেখানে তোমার দোষ কী?

কুট্টনীদের মধ্যে সেরা কুট্টনী হল বেশ্যামাতা যাকে আমরা কাঁচা বাংলায় ‘মাসি’ বলি। বিজ্জকার যে শ্লোকটির কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি সেটি সম্ভবত কোনো মাসিরই জবানি হবে। এই মাসিরা বিনে পয়সার ভোগে গালাগালি দেয়, অর্থাভাবে যাকে ঘর থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল, টাকা হলে তাকে আবার ঘরে তোলার উপদেশ দেয়। কামি-পুরুষকে হাতে রাখার বুদ্ধিও তার অপূর্ব—যেমন এক জায়গায় সে বলছে—ওরে—তোকে আর সাজগোজ করতে হবে না, ওই আধাসাজেই প্রিয়জনের ঘরে ঢোক, দেরি হওয়ার জন্য যদি তার আগ্রহ কমে যায়, তবে তুই তার মনে আর জায়গা পাবি না। কথাগুলো জোরেই বলা হল, পুরুষটিও শুনে পুলকিত হল, কিন্তু সাজগোজের কথাটি বাহানা। আসলে দেরি হচ্ছিল—মেয়ের সঙ্গে অন্য মানুষ ছিল বলে।

বেশ্যামাতারা খদ্দের জোগাড় করার জন্য যে কত কিছু করে, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে দণ্ডীর দশকুমারচরিতে—একজন গণিকাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যত মানুষ সে কাজে লাগায়, পরোক্ষ কিংবা অপরোক্ষভাবে তারা সকলেই বেশ্যাপ্রেমের গুণগ্রাহী, তবে সবাই এরা জাত আড়কাঠি নয়। যেমন নৃত্য-গীত-বিশারদ যারা, তাদের কাছ থেকে আগে-ভাগেই অনুনয়-বিনয় করে প্রশংসা-পত্র জোগাড় করে বেশ্যামাতা। নানারকম শিল্পীদের দিয়েও একইরকমভবে সেই গণিকার যশ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, দৈবজ্ঞ-জ্যোতিষীর কাজ তো আগেই বলেছি। আর সোজাসুজি খদ্দের জোগাড় করবে যারা তাদের নাম হল পীঠমর্দ, বিট, বিদূষক এবং পরিব্রাজিকা। এরা গণিকার শারীরিক সৌন্দর্য, সৎস্বভাব, শিল্পনৈপুণ্য, আলাপের মধুরতা—আরও সব গুণের কথা রসিক লোকের মাঝে ছড়িয়ে দেবে, দরকার হলে প্রাথমিকভাবে পয়সা দিয়ে তাদের নিয়েও আসবে।

পরিব্রাজিকা ভিক্ষুণীর কথা আমরা আগেই বলেছি, দণ্ডী আর যে নামগুলো করেছেন তারা কুট্টনীদের পুরুষ সংস্করণ মাত্র। বাৎস্যায়নের মতে পীঠমর্দ হল ভদ্রবেশের গরিব মানুষ, পুত্র-পরিবারের বালাই নেই, রুজিরোজগারের জন্য এদিক-ওদিক ঘোরে, কলানৈপুণ্যও আছে ভালো আর বেশ্যাদের ব্যাপারেই তার জীবিকানির্বাহ হয়। নাট্যশাস্ত্রগুলোতে পীঠমর্দ কিন্তু গুণে প্রায় নায়কের মতোই। অভিধান আবার তা বলে না, সেখানে পীঠমর্দকে পাওয়া যায় গণিকাদের নৃত্য-প্রশিক্ষক হিসেবে। বাৎস্যায়নের দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এবং দণ্ডী এদের যেভাবে কাজে লাগিয়েছেন—তার নিরিখে এদের মূল চরিত্রটি খুব ভালো বলে মনে হয় না। দণ্ডী বিদূষকের নামও করেছেন, তবে আমরা জানি বিদূষক মোসাহেবিতে সিদ্ধহস্ত, কাজেই নায়ক যদি বিদগ্ধা নায়িকার প্রেমে মত্ত হয় সেখানেও সে আছে, নায়িকা যদি গণিকা হয় সেখানেও সে আছে। এরা ব্যক্তিত্বহীন এবং এদের মূলধন হল ভাঁড়ামি। তবে পীঠমর্দ কিংবা বিদূষক—এরা কেউ জাত আড়কাঠি নয়—পুরুষদের মধ্যে জাত আড়কাঠি হল ‘বিট’।

নাট্যশাস্ত্রগুলোতে বিটের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে অনেকবার, তবে সেগুলোতে বিটকে আমরা একটু ভদ্র-ভদ্র চেহারায় দেখি, আসলে সে তা মোটেই নয়। বাৎস্যায়নের মতে বিট হল তারাই—অল্পবয়সে, অতিরিক্ত শৌখিনতায়, বিলাস-ব্যসনে যাদের টাকাপয়সা ফুরিয়ে গেছে। সাহিত্যদর্পণও তাই বলেছে। বলেছে—সম্ভোগের কারণে তার সম্পদ নষ্ট হয়ে গেছে। তবে সম্ভোগ মানে, আমাদের ধারণা—এ প্রচুর স্ত্রী-সম্ভোগও করেছে যৌবনে, যে কারণে টাকাপয়সা ফুরিয়ে সে তখন ফতুর। ঠিক এই জায়গাটাতে সংজ্ঞাকারেরা আড়কাঠি হওয়ার মনস্তত্ত্বে গিয়ে পৌঁছেছেন, কেননা একথা আমাদের কুট্টনীদের সম্বন্ধেও খাটে। কুট্টনীরা হয় আগে গণিকা ছিল, না হয় কামোপভোগে তৃপ্ত হয়নি তত অথবা গলিত-যৌবনে কামনার বিকার কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে।

পদ্মপুরাণের ভূমিখণ্ডে দেখি—বারাণসীতে সুধীর নামে এক মহাপ্রাজ্ঞ, ধনবান ব্যক্তি ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম চিত্রা। সে কিন্তু স্বামীর থেকেও অন্য পুরুষের গুণগ্রাহী ছিল বেশি। পরগৃহে বাস তার ব্রত। তার কাজ হল স্বামীর সঙ্গে সবসময় ঝগড়া করা আর অভ্যাস হল—বাড়ি বাড়ি ঘোরা, পরের দোষ দেখে বেড়ানো আর সবসময় হাসা। এসব দেখেশুনে সুধীর আরও ধীরভাবে অন্য এক বৈশ্যকন্যার পাণি-গ্রহণ করলেন। কিন্তু সুধীর তো আর মনস্তত্ত্ববিদ নন—ফল হল বিপরীত। পদ্মপুরাণ লিখলেন, ”তখন চিত্রা অতি প্রচণ্ডরূপে পাপমতি দুষ্ট নরগণের সহিত ভূতলে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল। ক্রমে সেই পাপকারিণী তাহাদের দূতীকর্মে নিযুক্ত হইল। সে সাধু ব্যক্তিগণের গৃহভঙ্গ করিতে লাগিল; সাধ্বী রমণীগণকে পাপবাক্যে আহ্বান করিয়া প্রলোভিত করিতে থাকিল, সাধুপত্নীকে সে অন্যের হস্তে সমর্পণ করিতে লাগিল। এইভাবে সেই পাপকারিণী তাহাদের দূতীকর্মে নিযুক্ত হইল। সে সাধু ব্যক্তিগণের গৃহভঙ্গ করিতে লাগিল; সাধ্বী রমণীগণকে পাপবাক্যে আহ্বান করিয়া প্রলোভিত করিতে থাকিল, সাধুপত্নীকে সে অন্যের হস্তে সমর্পণ করিতে লাগিল। এইভাবে সেই পাপকারিণী চিত্রা শত শত গৃহ ভগ্ন করিল।”

করিবেই। সুধীর জানে না—সে কাকে ঘাঁটিয়েছে। এ হল জাত কুট্টনী; মহামতি ফ্রয়েড থাকলে এই গল্প থেকে কুট্টনীর কুষ্ঠি তৈরি করে ফেলতে পারতেন, আমরা তা পারি না, তবে কুট্টনীর প্রসঙ্গ আমরা দ্বিতীয়বার উত্থাপন করলাম এই জন্য যে, বিট একজন বিদগ্ধা কুট্টনীর পুরুষ সংস্করণ। বিট নাচা-গানা মোটামুটি জানে, কথাবার্তা চালাতে পারে দারুণ, সভাসমিতিতে বহুলোক তাকে আদরও করে। ভরতের নাট্যশাস্ত্রমতে—বিটের বিশিষ্টতা হল গণিকালয়ের আচার-ব্যবহারে সে একেবারে পাকাপোক্ত মানুষ, আর সবচেয়ে বড় কথা সে বুদ্ধিমান এবং চতুর। এর চাতুর্য কতখানি তা বোঝা যাবে ধ্বন্যালোকের একটি উদাহরণে। বিট তার প্রেমিক বন্ধুর জন্য প্রেমিকার কাছে জানতে এসেছে যে, কখন সে দেখা করতে পারবে তার বন্ধুর সঙ্গে। লোকজন থাকায় বিদগ্ধ প্রেমিকা হাসিমাখা চোখের ভঙ্গিতে তার হাতের লীলাপদ্মের পাপড়িগুলো বুজিয়ে দিলেন।

আমরা জানি সূর্যাস্ত হলে পদ্মফুল নিমীলিত হয়, এখানে বিট কতখানি ইঙ্গিতজ্ঞ এবং চতুর যে, সে বুঝে নিল—প্রেমিকার সঙ্গে মিলন হবে সূর্যাস্তের পর—সন্ধ্যেবেলায়। মধ্যস্থ হিসেবে বিটের কর্মকুশলতা, বুদ্ধি, বাগ্মিতা—এসবের থেকেও বিটের বড় পরিচয়—বিট নিজেই কাম-কলা-কোবিদ, নিজেই রমণীলম্পট। কবি-নাট্যকারেরাও বালিকা, কন্যা কিংবা রমণী—এইসব শব্দের সঙ্গে বিট শব্দের সমাস করে নায়কের লাম্পট্য প্রকাশ করেছেন, অবশ্য কখনো এই লাম্পট্য সত্যি, কখনো পরিহাস, কখনো বা ইচ্ছে করে ভয় দেখানো যেমন ভবভূতির মালতীমাধবে কপালকুণ্ডলা মালতীকে বলছে—তোমার মাধব হল কুমারীলম্পট—কন্যাবিটঃ পতিরসৌ। রসিকের শিরোমণি চৈতন্যদেব কিন্তু বিটের আসল চরিত্রটি ঠিক ধরেছেন। তিনি বললেন—কোনো এক শঠ গোপবধূ-লম্পট আমাদের জোর করে তাঁর দাসী বানিয়ে ছেড়েছেন—কেনাপি শঠেন বয়ং হঠেন, দাসীকৃতা গোপ-বধূ-বিটেন।

এই শঠতা আর লাম্পট্যই বিটের আসল স্বভাব। বিট কথাটা থেকে পরবর্তীকালে বিটলে, বিটকেল কিংবা বিটলেমি—এই শব্দগুলো এসেছে কিনা ভাষাতাত্ত্বিকেরা তার বিচার করবেন, কিন্তু সত্যিকারের বিটের মধ্যে বিটলেমি কিছু আছেই। পয়সা ফুরিয়ে গেলেও তার জমিদারি চালের সঙ্গে আরও কিছু দেখা যায়। একটি একাঙ্ক নাটকে দেখি—বুড়ো হয়ে গেলেও এ মাথায় কলপ লাগায়, আর যৌবন ফেরানোর জন্য মদনানন্দ মোদকের মতো হিমরসায়ন খায়। আর বিটলেমি—এ নিজে বিবাহিত, কিন্তু ঘরে মন বসে না। আরেক জায়গায় দেখি—বিট একজনের মধ্যস্থতা করতে যাচ্ছে। যেতে যেতে গণিকালয়ের রাস্তায় এসে খুব পুলক জেগেছে মনে। বলছে—আহা এইখানেই কত মারামারি করেছি, কত বেশ-যুবতীকে এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছি—কাঁচা বয়সের সেসব ভোগের কথা ভেবে আজ মজা লাগছে দারুণ। বিট আবার নিজেই বলছে—আসল বিট হল সে যে সারাদিন মহাজনের সঙ্গে ঝগড়া করবে, দিন শেষ হলে কোনো বন্ধুর বাড়িতে আচ্ছা করে খাবে আর রাত হলেই বেশ্যাবাড়ি চলে যাবে।

এ হেন লোকেরই বিট হওয়া সাজে। এ যেমন গণিকাদের জন্য খদ্দের জোগাড় করে তেমনি কুট্টনীমতম-এ দেখব সে গণিকার ভাড়া না দিয়ে পালিয়েছে, যে ভাড়া হয়তো সে জোগাড় করেছে খদ্দেরের কাছ থেকেই। চম্পট দিতে গিয়ে সেই গণিকার কাছে ধরাও পড়ল, তাতে আবার লজ্জা নেই। কোনও বিট আবার বড়লোক খদ্দের জুটিয়ে দিয়ে রসিকতা করছে গণিকার সঙ্গেই—তোমার জন্য আমি ঘর ছাড়লাম, আর এখন তুমিই হলে পরের মতো। এই রসিকতার পূর্বাভাসটি ভালো নয় মোটেই। বিট নিজে কামুক হোক আর মতলববাজই হোক, আমাদের আলোচনায় তার মূল চরিত্র কিন্তু—সে সবচেয়ে সার্থক মধ্যস্থ। মধ্যস্থ হিসেবে একজন বিদগ্ধ বিটের নাম পাব শূদ্রকের নামে প্রচলিত একটি একাঙ্ক নাটকে—তার নাম শশ। মহাকবি বাণভট্ট পর্যন্ত এর নাম উল্লেখ করেছেন রাজা মূলদেবের বন্ধু বলে। সে চলেছে—এলিচপুরের রাজা কর্ণিসুত মূলদেবের মনের মানুষ জোগাতে। মূলদেব কম মানুষ নন—জ্ঞানী, ধনী এবং রসজ্ঞ, আর এই তৃতীয় গুণটির জন্যই বাঁধা পড়লেন দেবসেনার রূপের ফাঁদে। কিন্তু এ বসন্তে দেবসেনা সত্য হলেও অন্য বসন্তে তার বড় বোন দেবদত্তাই সত্য ছিলেন মূলদেবের কাছে। দেবদত্তা খুব বড়মুখ করে খবর পাঠালেন রাজার কাছে—”আমি কালকে সময়মতো আসতে পারিনি বলে রাগ রেখ না মনে, আমার ছোটবোন দেবসেনা অসুস্থ—তার একটু ব্যবস্থা করে এই আমি এলাম বলে।” দেবসেনার শারীরিক অসুস্থতা আর রাজার মানসিক অসুস্থতা—কারণ কিন্তু একই। রাজা বন্ধুবর বিটকে বললেন—”শুনলে তো—এখনই আসছে।” বিট বলল—”তুমি কি দিনের বেলায় আলো জ্বালাচ্ছ, তোমাদের নট-ঘট কি আমি কিছুই জানি না? নিশ্চিন্ত থাক, আমি হলাম শশ—তোমার বন্ধু বিট। এখনই তোমার অসুখের প্রতিকার করছি।” রাস্তায় যেতে যেতে নানা লোকের সঙ্গে রঙ্গরসিকতা চলল—কারণ সময় নেওয়া, দেবদত্তা চলে আসে যাতে। এই রঙ্গরসিকতায় মানুষের মধ্যে কিন্তু পুরোনো সব নাগরিকারাও রয়েছে, যাদের সঙ্গে বিটের এককালে মন দেওয়া-নেওয়া ছিল নিশ্চয়ই। সময়মতো বিট এসে পৌঁছাল দেবসেনার বাড়িতে এবং শেষে তার অন্তর জয় করে ফিরে এল বন্ধু মূলদেবের কাছে।

এই কাজ হাসিল করাটাই ভালো মধ্যস্থের কাজ। সংস্কৃত সাহিত্যের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুসারে এদের নানারকম সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—বিট, পীঠমর্দ, চেটী কিংবা কারুশিল্পনী, কিন্তু অবৈধ প্রেমে মধ্যস্থতা করার জন্য কোনো উপাধি দরকার হয় না। বাণভট্টের ইতিহাসাশ্রয়ী রচনা হর্ষচরিতের সপ্তম উচ্ছ্বাসে এই চিরায়ত মধ্যমাচারের ইঙ্গিত পাই। হর্ষদেব যুদ্ধযাত্রা করেছেন গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর বিরাট সৈন্যবাহিনী চলেছে—তার বহুতর সাজ-সরঞ্জাম, বহুতর আয়োজন। এই সৈন্যবাহিনীর সঙ্গেই চলেছে কতকগুলো মেয়েমানুষ—বাণভট্ট এদের নাম বলেছেন—চুন্দী। অমরকোষের টীকাকার ক্ষীরস্বামী বলেছেন শব্দটি সংস্কৃত নয়—দেশী শব্দ। একটি অতি দেশজ গালাগালির সঙ্গে এ শব্দের অননুনাসিক মিল থাকায় আমরাও শব্দটিকে দেশজ মনে করি। এই চুন্দীদের পা-গুলো বাঁকা আর এরা এতই মোটা এবং থপথপে যে চলতে-ফিরতেই কষ্ট হয়, তবু এদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কেননা এই চুন্দীদের কাজ হল ভদ্রলোকের মেয়েদের ফুঁসলে নিয়ে আসা এবং তাদের বেশ্যাবৃত্তিতে প্রযুক্ত করা। আবার এই যুদ্ধযাত্রাতেই দেখা যাবে—কুলীন কুলপুত্রদের মহিষীরা বাহনে চেপে চলেছেন, কিন্তু বাহনের চলার পথ যেন অবরোধ করেছে কতকগুলো কুচরিত্র বদমাস লোক, কিন্তু মজার কথা হল এই কুচরিত্র লোকগুলোকে পাঠিয়েছে অন্য অভিজাত রাজপুত্ররাই—অভিজাত-রাজপুত্র-প্রেষ্যমান—কুপ্রযুক্তা…। এই বদমাশদের কাজ কিন্তু কুলবধূদের মন ভাঙিয়ে রাজপুত্রদের কাছে নিয়ে আসা।

বাণভট্টের এই সূক্ষ্ম বর্ণনা থেকে এবং এদের বাধা দেওয়ার মতো কোনো মানুষের বর্ণনা যেহেতু বাণভট্ট দেননি তা থেকেও বোঝা যায় এই কুচরিত্র মধ্যস্থদের কাজের সীমা কতদূর। স্থান-কাল-পাত্র-নির্বিশেষে এরা সর্বত্রগামী এবং স্বসাধনে সিদ্ধ। তবে এই মধ্যস্থেরা যেহেতু প্রায়ই সরাসরি বেশ্যারতির সঙ্গে যুক্ত, কর্মক্ষেত্রে তাই তারা স্বভাবতই মুক্ত এবং স্বাধীন কিন্তু তবু এমনও জায়গা আছে যেখানে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়; দৈহিক লেনদেন তাদের কাছে জলভাত হয়ে গেলেও একটি জায়গাতেই তারা দারুণ হোঁচট খায়—তা হল গণিকাও যদি প্রেমে পড়ে যায়। গণিকারা দেহসর্বস্ব—তবু মনের আনাচে-কানাচে কখনো কুলবধূর আশা দেহের আচরণ-ভঙ্গ করে বেরিয়ে পড়ে এবং মধ্যস্থের মুশকিল সেইখানেই।

গাহাসত্তসঈ-তে দেখি—এক নির্ধন পুরুষকে নির্ধনতার অপরাধে বার করে দিয়েছিল বেশ্যামাতা, পরে যখন তার অর্থসমৃদ্ধি ঘটেছে তখন কুট্টনী বেশ্যামাতাই কন্যাকে চাপ দিতে আরম্ভ করল পুরুষটিকে স্ববশে আনবার জন্য কিন্তু হায়, গণিকা যে তার প্রেমে পড়েছিল এককালে, সে এখন তাকে মুখ দেখাবে কী করে, সে বলল—মাগো, যে প্রেম আগে কেটে গিয়ে পরে আবার জোড়া লাগে সে প্রেমের সরসতা থাকে না। আগে জল গরম করে পরে সেটা আবার ঠান্ডা করলে সে জল যেমন তার স্বাভাবিক মাধুর্য হারিয়ে ফেলে—এ প্রেমও তেমনই, কাজেই আর ওকথা বোল না মা।

আর একটি ঘটনা পাব কথাসরিৎসাগরে—স্থান মথুরা। বারমুখ্যার নাম রূপণিকা। শহরের সমস্ত গণিকার শিক্ষাদাত্রী তার জননী। সে বৃদ্ধা কুট্টনী—নাম মকরদংষ্ট্রা, কন্যার রূপগুণে আকৃষ্ট যুবকদের চোখে সে বিষপিণ্ডের মতো। একদিন মন্দিরে পুজো দিতে গিয়ে লোহজঙ্ঘ নামে এক নির্ধন যুবকের প্রেমে পড়ে গেল সে, দাসীর মারফত যোগাযোগ করে ঘরেও এনে তুলল তাকে। রূপণিকার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বৃদ্ধা কুট্টনী বলল—কন্যা, কেন এই নির্ধন পুরুষকে নিয়ে এসেছ ঘরে। অভিজাত গণিকা প্রয়োজনে শবদেহ স্পর্শ করতে পারে কিন্তু বিত্তহীনকে কখনওই নয়। অনুরাগে রাঙাবেশ্যা-প্রেম রক্তরাগে রাঙা সন্ধ্যার মতো—দুই ক্ষণস্থায়ী। রূপণিকা বলল—অমন কথা বোলো না মাগো—ওকে যে আমি ভালোবাসি।

এর পরেও বেশ্যামাতা তার ধর্মে চেষ্টা করে গেছে রূপণিকাকে নিবৃত্ত করতে—কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হয়নি, রূপণিকার প্রেম পরিণতি লাভ করেছে, তার কারণ প্রেমের কোনো জাত নেই—তার বসতি অভিজাতের মনেও যেমন, গণিকা-হৃদয়েও তেমনই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *