ষষ্ঠ পর্ব— বিভিন্ন কোরাস
বাইরে আবার অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে। আজ মনে হয় ভাসাবে। পনেরো মিনিট হয়নি, রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেছে। গত দুদিন যেরকম গুমোট গরম পড়েছিল, তারপর এই বৃষ্টিটা দরকার ছিল। দূরে কোথাও এফএম-এ গান বাজছে। অঞ্জন দত্তের ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’।
আমি আমার অফিসরুমের চেয়ারে বসে আছি। অফিসের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। আমার গায়ে একটা সুতো অবধি নেই। পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া। পাখা চলছে, তবু সারা গা দরদর করে ঘামছে। দুটো হাত মাথার পিছনে রাখা। এখন টনটন করছে। আমার ঠিক উলটো দিকে বসে আছেন পুলিশ অফিসার অমিতাভ মুখার্জি। হাতে রিভলভার।
ঘণ্টাখানেক আগেই আমি ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ছিলাম। ভেবেছিলাম আর আসব না অফিসে। কিন্তু অফিসার মুখার্জির ফোন এল। পরপর তিনবার। ধরিনি। তারপর হোয়াটসঅ্যাপ, “চলে এসো তুর্বসু। আমি সব জানি। তুমি অপর্ণা জানো, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট জানো, আমিও উর্ণা জানি।” উর্ণার নাম দেখে চমকে গেলাম। লোকটা উর্ণার ব্যাপারে জানল কীভাবে? আমার আর উর্ণার কথা তো ওর বাবা-মা অবধি জানে না! আমার পিছনে লোক লাগিয়েছিল নিশ্চিত। বুঝলাম পালিয়ে লাভ নেই। কতদিন পালাব? আর কোথায়? লোকটা আমার অফিস চেনে, চুঁচুড়ার বাড়ি চেনে, উর্ণাদের বাড়িও চেনে বোধহয়। যে দেবাশিসদাকে ওরকম করতে পেরেছে, সে আমাদেরও ক্ষতি করতে পিছপা হবে না। তাহলে? বরং দেখাই যাক না, কী হয়। এ লোক আমাকে খুন করবে না। করার হলে অনেক আগে করে দিত। আমি কিছু একটা জানি, বা জানি বলে ও ভাবছে। সেটার জন্যেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।
আমি ফোন ব্যাক করলাম, “আপনি দাঁড়ান। আমি আসছি।”
দেখলাম আকাশে ঘন মেঘ জমছে। মেঘের রং ঘন নীল। ঠিক সেই সহজ পাঠের মতো। বাইকে করে ফিরতে ফিরতেই ঠিক করলাম, আর যাই করি নার্ভাস হওয়া যাবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে। অফিসের দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন মুখার্জি। মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলেন। আমায় দেখে আচমকা গম্ভীর হয়ে গেলেন। শুধু বললেন, “ভিতরে চলুন।”
তালা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকেই মুখার্জি দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলেন।
“ফোনটা দিন”, ততক্ষণে ওঁর হাতে উঠে এসেছে সার্ভিস রিভলভার।
আমি বিনা বাক্যব্যয়ে মোবাইলটা ওঁর হাতে দিলাম। লক খুলে। রিভলভারটা আমার দিকেই তাগ করে অনেকক্ষণ ধরে কল লিস্ট, হোয়াটসঅ্যাপ চেক করলেন। তারপর মুখ উঠিয়ে বললেন, “আমাকে ফোনের পর আর কাকে কাকে ফোন করেছেন?”
“দেখতেই তো পাচ্ছেন। আপনিই শেষ। আর কাউকে না।”
“আমাকে কি বোকাচোদা পেয়েছেন? লাস্ট কল ডিলিট করা যায় না?”
“যায়, তবে কাকে করব? আর বলবই বা কী? আপনার মতো বুদ্ধিমান লোক কি কোনও প্রমাণ রেখে কাজ করেন? কিছু বলতে গেলে আমি বরং মানহানির মামলায় ফেঁসে যাব। আর কীসে কীসে ফাঁসাবেন কে জানে।”
শুনেই অফিসারের চোখ যেন জ্বলে উঠল। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেসে দিলেন দেওয়ালে। রিভলভার উঁচিয়ে বললেন, “জামাকাপড় খুলুন। এক্ষুনি। সব।”
আমিও বশংবদের মতো সব খুললাম। প্রথমে আমার জামা প্যান্ট, পার্স খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন অফিসার। তারপর গোটা গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কী যেন খুঁজলেন। শেষে বললেন, “জাঙ্গিয়া খুলুন আর উবু হয়ে বসুন।”
রাগে, হতাশায় কান্না পাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক করেছিলাম মাথা ঠান্ডা রাখব। কিচ্ছু না বলে তাই করলাম। অফিসার ভালো করে দেখে নিলেন পাছার ফুটোতে কিছু লুকানো আছে কি না। নেই দেখে একটু স্বস্তি পেলেন মনে হল।
—জাঙ্গিয়া পরে নিন। চেয়ারে গিয়ে বসুন। আর সিসি টিভির ক্যামেরাটা কোনদিকে?
—নেই।
—বলেন কী? আপনি গোয়েন্দা, আর অফিসে সিসি টিভি নেই?
—এতদিন দরকার পড়েনি। এবার মনে হচ্ছে লাগানো উচিত ছিল।
অফিসার শুনতে পেলেন না। পেলেও গা করলেন না বিশেষ।
—চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসুন। গোয়েন্দাদের বিশ্বাস নেই। আর হ্যাঁ, দুটো হাত মাথার পিছনে। বেশি সেয়ানা হতে যাবেন না যেন।
অফিসার আমার ছোট্ট অফিসে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন কোথাও কোনও গোপন ক্যামেরা আছে কি না। একদিকে ডাঁই করা পুরোনো কাগজের স্তূপ। সেই তারিণীর আমলের। ফেলব ফেলব করে ফেলা হয়নি। অফিসার সেখান থেকেই একটা ফাইল তুলে নিলেন।
“কী আছে এতে? ও বাবা! কবিতা? কে লেখে, আপনি?”
“না, এগুলো তারিণীচরণের কাগজ। বেশিরভাগ উইতে খেয়েছে, কিছু রয়ে গেছে।”
“আপনার সেই দাদু কবিতাও লিখতেন নাকি?”
“তাই তো শুনেছি।”
“তাহলে গোয়েন্দাগিরি করতেন কখন?” বলে পড়তে লাগলেন, “আমরা পুরুষ, নীরস অতি/ নহি অধিকারী সুখে/ কে দেবে মোদের সুধার কলস/ তৃষিত কাতর বুকে? কী বালের কবিতা মশাই!” শেষ লাইনটা আমাকে বলা।
আমি খুব শান্ত গলায় বললাম, “আপনি কি তারিণীর কবিতা পড়তে এসেছেন?”
ফাইলটা আমার টেবিলে ছুড়ে ফেলে দিলেন অফিসার। একরাশ ধুলো উড়ল। মাথা নেড়ে বললেন, “নাহ। এসেছি আপনার সঙ্গে কথা বলতে।” বলে উলটো দিকের চেয়ারে বেশ আরাম করে বসলেন অমিতাভ মুখার্জি। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছে।
“আসলে আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হয়। এই আর কি। বিশেষ করে আপনাদের মতো গোয়েন্দাদের থেকে। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে আমি গান্ডু টাইপই ভেবেছিলাম। আপনি তো বর্ণচোরা আম। দেখলে বোঝাই যায় না, এত বুদ্ধি ধরেন।”
আমি গলগল করে ঘামছি। হাত টনটন করছে। বললাম, “হাত নামাতে পারি?”
“নামান, তবে চালাকির চেষ্টা করবেন না। সামনে পেতে রাখুন। কায়দা করলে অবস্থা টাইট করে দেব।”
“যেমন দেবাশিসদার করেছেন?”
“দেবাশিসদাকে আমি মারিনি। সরি টু সে।”
“মানে? তাহলে মারল কে?”
“সে জেনে আপনার কাজ নেই। আপনি শুধু আপনার কাজটা করুন।”
“সেটা কী?”
“তারিণীর ডাইরিতে যে ডিরেক্টরের কথা আছে, তাঁকে খুঁজে বার করা।”
“তিনি কি এখনও বেঁচে আছেন? মানে থাকা সম্ভব?”
“বেঁচে থাকার প্রশ্নই নেই। কারণ যা মনে হয়, এই ডিরেক্টর কোনও ব্যক্তি না। বস্তু। তারিণীর খুব প্রিয় কোনও বস্তু। বাক্স, সিন্দুক, এই জাতীয়। যেখানে কিছু লুকিয়ে রাখা যায়। সেটা তাঁর পরিবারের লোক ছাড়া কারও জানা সম্ভব না। আর তাই আপনাকে প্রয়োজন।”
“দেখুন, একটা বেসিক মুশকিল আছে। ঘটনা হল, তারিণী নিয়ে আপনারা যা জানেন, আমি তার থেকে ঢের কম জানি। তাঁকে নিয়ে পরিবারে খুব বেশি আলোচনা শুনিনি। তাঁকে চেনা মূলত তাঁর ডায়রি পড়ে। যাতে অধিকাংশ কবিতা, আর কেসের কথাই লেখা। আপনাকে তো আগেই বলেছি, শুধু ১৮৯২-৯৩-এর শেষের দিকের কিছু পাতা আর ১৮৯৫-৯৬-এর ডায়রি আমি পাইনি। বাকি যা আছে পড়েছি। নিতান্ত মামুলি কেস। তাতে এই ডিরেক্টরের উল্লেখ অবধি নেই। আপনাকে সাহায্য করতে হলে আমাকেও কিছু তথ্য জানতে হবে। না হলে অন্ধকারে হাতড়াব কেমন করে? আমি আপনাকে সাহায্য করতে রাজি। কিন্তু কিছু খটকা দূর না করলেই নয়।”
অফিসারের মুখ দেখে কনভিন্সড মনে হল। মুখে কিছু বললেন না। একটু সাহস পেয়ে বললাম, “আমার কিছু জানার আছে। বলা যাবে কি? রেকর্ড যে হচ্ছে না সে তো বুঝতেই পারছেন।”
অফিসার রিস্ক নিলেন না। টেবিলে থাকা আমার ফোনটা তুলে একেবারে স্যুইচ অফ করে শেষে বললেন, “তা বটে। বলুন কী কী জানতে চান?”
—শুরু থেকে শুরু করি। দেবাশিসদা একজন চ্যালার কথা অনেককেই বলতেন। নাম করতেন না। সেটা কি আপনি?
—হ্যাঁ। দেবাশিসদা এককালে টিউশানি করতেন। আমি গরিব ঘরের ছেলে। বাবা ছিল না। আমাকে বিনা পয়সায় পড়াতেন। আপনাকে তো বলেইছি, স্টুডেন্ট ভালো ছিলাম। খুব ভালোবাসতেন আমায়। চ্যালা বলে ডাকতেন। মাঝে কিছুদিন যোগাযোগ ছিল না। পুলিশে চাকরি পাবার পরে আবার ওঁর কাছে যাই। তখনও ওঁর বিয়ে হয়নি। রাত জাগতেন। আমিও রাতেই যেতাম।
—কেন?
—আমার গবেষণার শখ ছিল। ইতিহাস নিয়ে। দেবাশিসদার বাড়ি গেলে নানারকম আলোচনার সুযোগ পেতাম। মনের খিদে মিটত।
—দেবাশিসদার বিয়েতে আপনি সাক্ষী ছিলেন?
—হ্যাঁ। আপনি যে এটা বার করে ফেলবেন সেটা আমার মাথাতেও আসেনি। বললাম না, যতটা গান্ডু ভেবেছিলাম আপনি তা নন।
—তারপর অপর্ণা দেবীর সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে?
—আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন। বউদি আর আমার সেরকম কিছু রিলেশান ছিল না। আসলে বিয়ের পর বউদি জানতে পারেন দেবাশিসদা ইম্পোটেন্ট। ওঁদের কোনও ফিজিক্যাল রিলেশান হত না। শেষে তো আলাদা খাটে শুত দুজন। দেবাশিসদা পাত্তা দিতেন না। পড়াশোনা নিয়েই থাকতেন। আমার সঙ্গে বউদির ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আভাসে ইঙ্গিতে আমায় সব বলেছিলেন। ২০১২-র শুরুতে ওঁদের বিয়ে হল, আর শেষের দিকে দেবাশিসদা ডাক্তার গোপালচন্দ্র দত্তর বাড়িতে ফাইলটা পেলেন।
—যে ফাইলে প্রিয়নাথের লেখা শেষ দারোগার দপ্তর ছিল?
—এটাও ধরেছেন? গুড। তবে দারোগার দপ্তর না। কারণ এ লেখা ছাপানোর জন্য ছিল না।
—আপনি পড়েছেন সেই লেখা?
—হ্যাঁ। দেবাশিসদাই গোপনে এক এক পাতা করে চুরি করে প্রায় গোটাটাই নিয়ে এসেছিলেন। প্রথম পাতা ছাড়া। ওঁর কাছেই ওটা দেখতে পাই।
—কী ছিল তাতে?
—তখনকার কলকাতার এক কেস। যার কিছুটা আপনিও জানেন। মঞ্চে দুই ম্যাজিশিয়ানের মৃত্যু আর চিনা পাড়ায় এক খুনের কথা। সেটা বড়ো কথা না। প্রিয়নাথের লেখা অনুযায়ী এই কেসে আরও তিনজন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। একজন তারিণী রায়, একজন জাদুকর গণপতি আর এক রহস্যময় সাহেব।
—রহস্যময় কেন?
—সাহেবের নাম সাইগারসন। এসেছেন লন্ডন থেকে। খাড়া নাক। পাইপ খান। ফ্রক কোট পরেন। এসেছিলেন সেই ম্যাজিকের দলের সঙ্গে। কিন্তু অসম্ভব ভালো অনুমান ক্ষমতা। পড়লে একজনের কথাই মাথায় আসে—
—শার্লক হোমস!
—একদম তাই। আবার টাইমলাইনও ম্যাচ করছে। দেবাশিসদা বেকার স্ট্রিট সোসাইটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা মানেন হোমস সত্যি সত্যি জীবিত ছিলেন। তাঁরা যা জানান, সেটা জেনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ।
—সেটা কী?
—তাঁদের থিয়োরি অনুযায়ী, মরিয়ার্টি মারা যাবার পরে নাকি হোমস গা ঢাকা দিতে ভারতে আসেন। সালটা ১৮৯২। ভাবতে পারেন! শুধু তাই না, এরপরেও একবার হোমস ভারতে এসেছিলেন। কবে জানেন? ১৮৯৫-৯৬। ভেবে দেখুন। ঠিক যবে যবে হোমস আসছেন, তারিণীর ডায়রি খোয়া যাচ্ছে। শার্লক হোমসের বাবার নাম ছিল সাইগার হোমস। তাই তিনি নাম নেন সাইগারসন। মজার ব্যাপার, প্রিয়নাথের লেখাতে সাহেবের নাম সাইগারসন মোহেলস। এই MOHELS-এর শব্দগুলো এদিক-ওদিক করলে কী হয় বলুন তো!
—HOLMES…!!!
—ঠিক তাই। এটা বুঝতে পেরে আমাদের ঘুম উড়ে যায়। কিন্তু প্রমাণের কোনও উপায় নেই। আর তারপরেই দেবাশিসদার চোখে পড়ল বইটার কথা।
—টেমারলেন?
—বাপরে! আমি তো সোজা জিনিস নন মশাই! হ্যাঁ, সেই কোটি টাকার বই। আর সেটা আঁচ করার পর থেকেই দেবাশিসদা আমায় ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা শুরু করলেন। সব কথা বলতেন না। আমিও রেগে যেতে শুরু করলাম। মাঝে মাঝেই আমার আর দেবাশিসদার তর্ক হতে লাগল। বুঝতাম উনি চাইছেন আমি যাতে না আসি। ইঙ্গিত দিতে শুরু করলেন, আমি আসলে বউদির সঙ্গে প্রেম করতে আসি। এমনকি একদিন বউদিকে এটাও বললেন, উনি চাইলে আমার সঙ্গে শুতে পারেন। ভেবেছিলেন এইভাবে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারবেন। এককালে যে লোকটাকে শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলাম, এক মুহূর্তে চরম ঘৃণা এল। বুঝতে দিলাম না। জোঁকের মতো এঁটে রইলাম। কিন্তু ভিতরে ভিতরে বউদির কাছে ওঁর বিপক্ষে বলতে থাকলাম। একদিন রাউন্ডে বেরিয়ে দেখি চন্দননগরের বেশ্যাপট্টিতে ঢুকছেন। কেন কে জানে! মনে হল এই যে ইম্পোটেন্সি, এটাও হয়তো ওঁর ভান। আমি বউদিকে ডেকে দেখালাম।
—তারপরেই তো সেপারেশান।
—হ্যাঁ। তখনই বউদির এখনকার বরের সঙ্গে আলাপ হয়। আর দেবাশিসদা আপনার খবর পান।
—সেটা কীভাবে?
—আমি বলেছি না, আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমি বুঝতে দিতাম না। আন্দাজ করার চেষ্টা করতাম উনি কীসের খোঁজ করছেন। পেপার দেখে একদিন নিজেই বললেন, তারিণীর সেই গোয়েন্দা অফিস আবার খুলেছে। একটু খোঁজ নাও তো, একই নামে, একই জায়গায় কে অফিস খুলল? আমিও খবর এনে দিলাম। আপনাকে যে কেসটা দেওয়া হয়েছিল, সেটা ধোঁকার টাটি। যাতে সন্দেহ না হয়। আসলে ওঁর দরকার ছিল আপনাকে।
—কেন?
—সেই জায়গাতেই আসব। কারণ দরকারটা এখনও ফুরোয়নি। প্রিয়নাথের লেখায় তারিণীর একটা সম্পত্তির কথা ছিল। যার নাম ডিরেক্টর। এটাও লেখা ছিল, এখানেই নাকি তারিণী গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিস লুকিয়ে রাখেন। শুধু তাই নয়, এই ডিরেক্টর বস্তুটি নিজেও অত্যন্ত দামি। দেবাশিসদা সেটার খোঁজ চালাচ্ছিলেন। আর তাই আপনাকে দরকার ছিল। উনি তারিণীর বংশধরের খোঁজ করছিলেন, এভাবে পেয়ে যাবেন, ভাবেননি।
—মানে ওই বইয়ের জন্য দেবাশিসদাকে আপনি খুন করলেন? কিন্তু বই কোথায় সে তো কেউ জানে না!
—প্রথমেই বলি, দেবাশিসদা খুন হয়েছেন নিজের দোষে। নিজের লোভের জন্য। আমি ওঁকে খুন করিনি।
—তাহলে?
—আগেই বলেছি, প্রিয়নাথের লেখায় চিনা পাড়া আর চিনা কিছু গুপ্ত সমিতির কথা আছে। আমি জানতাম না এখনও তাদের অস্তিত্ব বর্তমান। দেবাশিসদা কীভাবে যেন তাদের খবর পেয়ে গেছিলেন। টেরিটি বাজারে তাদের গোপন আড্ডা আছে। দেবাশিসদা রিসার্চ করে বুঝতে পেরেছিলেন, এই কাহিনির অন্য অংশটা চিনা পাড়ায় কোথাও লুকানো আছে। প্রিয়নাথ নিজেও যেটা জানতেন না, বা জানলেও লেখেননি, আমার ধারণা দেবাশিসদা সেটার সন্ধান পান।
—সেটা কী?
—আমিও পরিষ্কার জানি না। তবে চিনাদের গুপ্ত সমিতি, অক্ষর, নিয়ম নিয়ে নানা কথা বলতেন। আসল কথাটা এড়িয়ে যেতেন।
—কী কথা?
—কীসের সন্ধানে তিনি এমন পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করছেন।
—অবশ্যই সেই বই।
—নাহহ। আমিও তাই ভাবতাম। একদিন বলেওছিলাম। দেবাশিসদা অদ্ভুত হেসে বলেছিলেন, সিরাজের মৃত্যুর পর মিরজাফর সিরাজের প্রিয়তমা লুৎফাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। লুৎফা কী বলেছিলেন জানো? বললাম, জানি না। বললেন, বলেছিলেন, যে বাঘের সওয়ার হয়, সে কি গাধার পিঠে চড়ে? এককালে ভেবেছিলাম ওই বইটাই আসল। কিছু না অমিতাভ, কিছু না। সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনার মতো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি এখন । সামান্য চার-পাঁচ কোটি টাকা আমাকে দেখাচ্ছ?
—কোন গুপ্তধনের কথা বলছিলেন উনি? জানেন?
একটু থেমে অফিসার বললেন, “গণপতির ভূতের বাক্স।”
—সেটা আসলে কী?
—আমিও জানি না। আপনাকে তো তাও একটা বাক্সের কথা বলেছিলেন, আমাকে দেবাশিসদা সেটাও বলেননি। শেষের দিকে বেশ ভয়ে ভয়ে থাকতেন।
—সেটা আমিও বুঝেছি। কিন্তু কাদের থেকে?
—বললাম না জানি না। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন, ওরা জানলে মুশকিলে পড়ে যাব। আমার কী হয় ঠিক নেই। ওরা গণপতির বাক্সের খোঁজে আছে। সমন পাঠাচ্ছে। আমাকে খুঁজে দিতেই হবে।
—ওরা কারা?
—জানি না।
—কে আমাকে রাতে হোয়াটসঅ্যাপ করেছিল?
—দেবাশিসদাই করেছিলেন হয়তো। অন্তত আমি না। আমি সেই রাতে ওঁর কাছে যাইনি। যদি আমায় অপরাধী ভেবে থাকেন, ভুল ভেবেছেন।
—কিন্তু আমাকেই বা পাঠালেন কেন?
—দুটো কারণ হতে পারে। তাঁকে দিয়ে করানো হয়েছিল, অথবা কোনও এক সময় তাঁর বিবেক জাগ্রত হয়েছিল। বুঝেছিলেন তিনি আর বাঁচবেন না। তাই প্রকৃত উত্তরাধিকারীকে জানিয়ে মারা গেছিলেন, যাতে আপনার খোঁজ পড়ে, আর আপনি গোটা ব্যাপারটা জানতে পারেন।
—তার মানে যারা দেবাশিসদাকে খুন করল, তারা এখন আমার কথাও জানে?
—জানা অসম্ভব না।
—তারাই কি আমার চুঁচুড়ার বাড়িতে চিঠি দিয়ে এসেছিল?
—না। ও আমার লোক। চিঠির টাইপটা আমি করেছিলাম।
—আপনি আমার চুঁচুড়ার বাড়ির কথা জানতেন?
—দেবাশিসদা আপনার বিষয়ে সব বলেছেন। জগন্নাথ মন্দির, রাস্তার ওপর বাড়ি, রায়বাড়ি বললেই সবাই চেনে। আর কিছু লাগে? সেই রাতে আমি আপনাকে গাড়ি করে চুঁচুড়ার বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি চিঠিটা পান।
—কেন?
—সকালবেলা দেবাশিসদার মারা যাবার খবর পেতেই বুঝলাম এবার আমাকে হাল ধরতে হবে। আপনাকে ছাড়া যাবে না। তখনও হোয়াটসঅ্যাপের কথা জানতাম না। তবে দেবাশিসদা আপনাকে এতদিন অন্ধকারে রেখেছিলেন সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু আমার ডিরেক্টরের খোঁজ দরকার ছিল। ওই বইয়ের জন্য। আমার টাকার দরকার ছিল।
—আর উর্ণার খবর?
—আপনার কি মনে হয় এই কদিন আমি গাব জ্বাল দিচ্ছিলাম? আপনাকে নিয়ে কাজ করব, আর আপনার সম্পর্কে মিনিমাম খোঁজটাও নেব না?
—প্রিয়নাথের খাতা, তারিণীর ডায়রির পাতা আর ১৮৯৫-৯৬-এর ডায়রি, এই তিনটে এখন কোথায়?
—প্রথম দুটো কোথায় আমিও জানি না। দেবাশিসদার গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাইনি। তৃতীয়টা এখনও কেউ দেখেনি। দেবাশিসদাও না। দেবাশিসদার বিশ্বাস ছিল ওতেই গণপতির বাক্সের খোঁজ আছে। শেষের দিকে উনি ওটার খোঁজেই ছিলেন।
—সেটা কি ডিরেক্টরের মধ্যে থাকতে পারে?
—বলা মুশকিল। কারণ ডিরেক্টর যে কী বস্তু সেটাই অজানা।
—দেবাশিসদার অণ্ডকোশ লাইব্রেরিতে গেল কীভাবে?
খানিক চুপ থেকে অফিসার বললেন, “আমিই রেখেছি।”
—কেন?
—দেবাশিসদার মারা যাবার খবর আমি অফিসে আসার আগেই পেয়েছিলাম। যদিও বুঝতে পারিনি। সকালে উঠে দেখি দরজার সামনে প্যাকেটটা কেউ ফেলে রেখে গেছে। দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা অঘটন হয়েছে। ফেলিনি। ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলাম। পরদিন সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলাম। হাজার হোক এভিডেন্স। ফেলতে মন চাইছিল না। লাইব্রেরিতে ওই ম্যাজিক বাক্সটা দেখে মাথায় প্ল্যান এল। ওটা খুলতে আমাকে দেবাশিসদাই শিখিয়েছিলেন। আপনি ফটোকপি করাতে গেলেন, আমিও ওটা ঢুকিয়ে দিলাম। পরে এমন দেখালাম যে আচমকা খুলে ফেলেছি। আসলে আমার সাক্ষীর দরকার ছিল, যাতে সন্দেহ আমার ওপরে না পড়ে।
—আমার থেকে কী সাহায্য চান?
—একটাই। গণপতির বাক্সের খোঁজ। আর তার জন্য ডায়রি। আর ডায়রি পেতে গেলে ডিরেক্টরের সন্ধান লাগবে।
—কিন্তু একটু আগেই তো আপনি বললেন ওই বই পেলেই আপনার হবে। আপনার টাকার দরকার।
—ছিল বলেছি। এখন আর নেই।
—কেন? নেই কেন? টাকা পেয়ে গেছেন?
—ও বই বেচে যা টাকা পাবেন সব আপনার। আমার শুধু বাক্সের খোঁজ লাগবে। প্রাণের চেয়ে দামি কিছু নেই ভাই।
আমি অফিসারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওঁর চোখে অদ্ভুত এক আতঙ্ক।
—ওরা আমাকে মেরে ফেলবে এবার। দেবাশিসদার পরে আমার পিছনে লেগেছে। আমার বাড়ি কোথায় জেনে গেছে। আমাকে ফলো করছে। এর একটাই মানে। আমাকে এবার গণপতির বাক্স খুঁজে দিতে হবে। নইলে আমারও দেবাশিসদার মতো হাল করবে।
—কী করে বুঝলেন?
পকেট থেকে একটা কাগজ বার করলেন অফিসার। সাদা কাগজ। তাতে তিনটে সমান্তরাল লাইন। মাঝেরটা দুভাগে ভাঙা।
—এর মানে কী?
—চিনা অক্ষর ই-চিং। মানে অগ্নি। অর্থ— ভয়াবহ পরিণতি, ধ্বংস, মৃত্যু।
—এ জিনিস আপনার কাছে?
—গত তিনদিন ধরে আমার বাড়ির ডাকবাক্সে কেউ ফেলে যাচ্ছে। সমন…