পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

ষষ্ঠ পর্ব— তাহারা মরেনি তবু

ষষ্ঠ পর্ব— তাহারা মরেনি তবু

১।

“হ্যালো, কী খবর?”

“একটা কথা ছিল।”

“বলে ফ্যালো।”

“কিছুদিন আগেই আপনি আমাকে আমার অফিসঘরে প্রায় গান পয়েন্টে জেরা করেছিলেন, মনে পড়ে?”

“হ্যাঁ। আসলে আমি কারও ওপরে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।”

“আমি একটু আগে অরুণবাবুর থেকে নিয়ে আসা কাগজপত্রগুলো পড়ছিলাম। কিছু কিছু ধরতে পারছি, আবার অনেকটাই ঠিক গ্রিপে আসছে না।”

“আমি কী করতে পারি বলো?”

“আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই। জেরা না। আমার মনে হয় কিছু জট একমাত্র আপনিই খুলতে পারবেন।”

“কীভাবে?”

“আসলে নিউটনের তৃতীয় সূত্র জানেন তো? সিস্টেমের মধ্যে থেকে সিস্টেমকে ঠেলা দিয়ে নড়ানো যায় না। বাইরের কাউকে লাগে। ধরে নিন আমিই সেই।”

“ওয়েল। তা শুরুতে বললেই হত, তুমি আমার জবানবন্দী নিতে চাও। এত ভণিতার কী দরকার ছিল?”

“এ মা! ছি! ছি! জবানবন্দি কেন হবে? কিছু ইনফরমেশান আপনার কাছে আছে। কিছু আমার কাছে। আমরা একসঙ্গে কাজ করছি ঠিকই, কিন্তু এখনও নিজেদের মধ্যে ইনফরমেশান শেয়ার করিনি। মনে হয় এবার সেটার সময় এসেছে।”

“আমি রাজি। তবে তুমি যা জানো সেটাও শেয়ার করতে হবে। ফেয় ডিল।”

“সে তো বটেই। কারণ যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তবে শুধু আপনি না, আমার পিছনেও লোক লেগেছে। না লাগলেও খুব শিগগির লাগবে।”

“কেন?”

“দেখা হলে বলব। কাল আমি চন্দননগরে আপনার অফিসে যাব?”

“না, না। অফিসে না। ওখানে অনেক লোক। তোমার অফিস?”

“একই সমস্যা। কেন যেন মনে হচ্ছে অফিসে লোক নজর রাখতে পারে। এমন কোনও জায়গা যেখানে বিশেষ লোকজন নেই।”

“তুমি সাজেস্ট করো।”

“আমার দেশের বাড়ি চুঁচুড়ায় ডাচদের একটা কবরখানা আছে। সারাদিন খালি পড়ে থাকে। আমি কাল বিকেল চারটে নাগাদ চলে যাব। আপনিও চলে আসুন। তবে পুলিশের গাড়িতে আসবেন না।”

“ওকে ডান। ওটা চিনি। মৃত্যুঞ্জয়ের মিষ্টির দোকানের পাশে তো? চলে যাব।”

“ভালো কথা, বিশ্বজিতের অটোপ্সি রিপোর্ট এল?”

“হ্যাঁ, এসেছে। অদ্ভুত রিপোর্ট।”

“কেন? কী হয়েছে?”

“কাল সাক্ষাতে বলব। এখন রাখি।”

.

২।

আমার মধ্যে যে একটা পরিবর্তন এসেছে সেটা উর্ণা খুব ভালো টের পেয়েছিল। আগে সময়ে অসময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চ্যাট করতাম। লুকিয়ে ঘুরতে যেতান। যবে থেকে দেবাশিসদার এই ঘটনা ঘটেছে, রাতে ঘুমানোর সময় ছাড়া বাড়ি ঢোকাই হয় না। উর্ণার মেসেজ সিন হয়ে পড়ে থাকে। উত্তর দেবার সময় পাই না। সেদিনই বেশ রাতে বাড়ি ফিরে একগাদা কাগজ ছড়িয়ে বিছানায় বলে আছি, উর্ণার ফোন এল।

“কোথায়?”

“নিজের ঘরে। তুমি এত রাতে ফোন করলে? গলা এত ভারী কেন?”

“দরকার আছে। একবার আসব?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত বারোটা বেজে দশ। এত রাতে উর্ণা আমার ঘরে আসতে চাইছে কেন? যদি বাই চান্স ধরা পড়ে যাই, তবে কী পারে, সেটা ও আমার চেয়ে ভালো জানে।

“কিছু বলছ না কেন? আসব? খুব দরকার। প্লিজ।”

“মা বাবা কোথায়?”

“মা ঘুমাচ্ছে। বাবা বাড়িতে নেই। আসব কি না বলো।”

“তবে এসো। দরজা ভেজানোই আছে।”

ফোন কেটে গেল। আর তার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘরে ঢুকল উর্ণা। কেঁদে কেঁদে দুই চোখ লাল। হাতে মুঠো করে ধরে রাখা কী যেন।

“কী হয়েছে?”

প্রথমে কিছুই বলল না। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। কথা বলতে পারছে না। দুই হাতে মুখ ঢেকে শুধু কাঁদছে। আমি খানিক ইতস্তত করে পিঠে হাত রাখলাম। কান্না আরও বেড়ে গেল তাতে। চুপচাপ বসে রইলাম। উর্ণার হাতে সেই কাগজটা এখনও ধরা। খানিক বাদে মাথা উঠিয়ে উর্ণা বলল, “প্লিজ, প্লিজ তুর্বসু। আমার বাবাকে তুমি বাঁচাও।”

“কী হয়েছে কাকুর?”

“আমি জানি না। কিন্তু বাবা আর আগের মতো নেই। সর্বদা কেমন যেন একটা ভাব। অস্থির। বিশেষ করে গত দশ-পনেরো দিন ধরে। তুমি সেই দেবাশিসবাবুর কেসটা নেবার পর।”

“কাকু কিছু বলেছেন তোমায়?”

“না। বাবা কি কিছু বলে? তবে হাবেভাবে বুঝতে পারছি। আজ বাড়িতে উকিল এসেছিল। বাবা উইল করছে।”

“সে তো উইল যে কেউ করতে পারে। এ নিয়ে এত ভাবছ কেন?”

“ভাবতাম না। কিন্তু গতকাল বাবা আমায় ডেকে অফিসের কাগজপত্র বুঝিয়ে দিল। হঠাৎ কিছু হয়ে গেলে কী করব, ফ্যামিলি পেনসন কীভাবে পাওয়া যাবে, পিএফের টাকা তুলতে কার কাছে যেতে হবে এসব বোঝাচ্ছিল। আমি অবাক। বাবাকে এত ভালোভাবে কথা বলতে শুনিনি কোনও দিন। আমি বারবার জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এত তাড়া কীসের? বলল, কিছু তো বলা যায় না মা, কখন কী হয়? ‘একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি’।”

“তুমি জানতে চাওনি এমন কেন বলছেন?”

“জিজ্ঞাসা করেছি। অদ্ভুত উত্তর দিল। বলল, মানুষ হয়ে ভগবান হতে চেয়েছিলাম। এখন সাক্ষাৎ শয়তানের কবলে পড়েছি।”

“এর মানে কী?”

“জানি না। বাবা বলেওনি।”

“তা এখন তুমি আমার কাছে এলে কেন?”

“বাবা আজ বাড়ি নেই। এনজিও-র কাজে কোথায় যেন গেছে। পারমিশান ছাড়া বাবার ঘরে ঢোকা আমার মানা। কিন্তু কাল কলেজে অনুষ্ঠান। ‘সোনার তরী’ কবিতাটা পড়ব ঠিক করেছি। নেটে দুরকম লেখা। কোনটা ঠিক জানতে চুপিচুপি বাবার ঘর থেকে সঞ্চয়িতাটা নিতে গেছিলাম। সেই বইয়ের ভিতর থেকেই এটা পেলাম।”

উর্ণার হাতে একটা প্যাডের কাগজ মুঠো করে ধরা। হাতে নিয়ে দেখলাম তাতে লেখা—

“সুধী সদস্যবৃন্দ,

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে, আমাদের সংস্থার সদস্য ও পরম সুহৃদ বিরূপাক্ষ রায়, সামান্য কিছুদিন রোগভোগের পরে পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করেছেন। তিনি যে গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন তা প্রায় মধ্যপথেই ত্যাগ করায় একসময় তিনি সংস্থার বিরাগভাজনও হন। তবু তিনি আমাদের ভ্রাতা এবং তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তবে আমাদের কাজ থেমে থাকা না। এগিয়ে চলা। স্বর্গীয় বিরূপাক্ষ রায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আগামী শনিবার, সন্ধে সাড়ে সাতটায় নিচের ঠিকানায় এক সভার আয়োজন করা হয়েছে। সদস্যদের সেই সভায় উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সভায় আগামী দিনের কর্মপন্থাও স্থির হবে।”

নিচে চন্দননগরের একটা চেনা ঠিকানা আর চেনা একজনের নাম।

সভাপতি—

দেবাশিস গুহ।

উফফ!! এই লোকটা মারা গিয়ে যেন আরও বেশি করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক যেন… ঠিক যেন… ভূতের মতো। আমি সেই কাগজটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। কেউ যেন আমার সব চিন্তাভাবনার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। এতদিন যেভাবে এগিয়েছি সবই কি ভুল তবে? চোখের সামনে থেকে একশো বছর আগের কালো পর্দাটা সরছে। কিন্তু তাতে যা দেখা যাচ্ছে তা আরও গভীরতর অন্ধকার।

“জেঠু, মানে তোমার বাবা ক্যান্সারে মারা গেছিলেন না?” উর্ণা প্রশ্ন করল।

“তাই তো জানতাম এতদিন।”

“তার মানে?”

“বাবা বেশিদিন ভোগেননি। বাবার পেটে একটা ব্যথা হত। কিছুদিন ধরেই। আমি ভালো ডাক্তার দেখাব বলেছি। বাবা রাজি না। বাবার চেনা ডাক্তার ছিল। রাসবিহারীতে বসেন। তিনিই বাবাকে দেখতেন। তাঁকে ছাড়া বাবার কাউকে পোষাত না।”

“ডা. অশোক মল্লিক?”

“হ্যাঁ, তুমি চেনো?”

“আমরাও তো ওঁকেই দেখাই। ওঁর নিজের একটা রিসার্চ ল্যাবরেটরি আর ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে।”

“হ্যাঁ, উনিই। উনিই বাবাকে দেখতেন। তবে শেষে ধরা পড়ল ক্যান্সার লাস্ট স্টেজ। তখন আর কিছু করার ছিল না।

“কী গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন তোমার বাবা, জানো?”

“না। বাবা-মা চিরটাকাল আমার থেকে কিছু একটা লুকিয়ে গেছেন। কেন চুঁচুড়ার বাড়ি ছেড়ে এলাম? কেন বাবা চাকরি থেকে ভলেন্টারি রিয়ারমেন্ট নিলেন,কিচ্ছু জানাননি। এমনকি আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ হওয়াতে দুজনেরই খুব আপত্তি ছিল। তাও আমি জেদ করায় বাবা রাজি হয়ে যান।স্টার্ট আপের জন্য এক লাখ টাকা দিতেও রাজি হন। তখন অদ্ভুত একটা কথা বলেছিলেন বাবা। বলেছিলেন, শোন, যার অফিসে বসছিস, আমার সেই ঠাকুর্দা কিন্তু চরম লোভেও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। আমিও করিনি। তুই যেন লোভের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিস না।”

“কী প্রসঙ্গে বলেছিলেন এ কথা?”

“তা বলেননি। সে কথা ছাড়ো। তুমি এত রাতে এত আপসেট হয়ে গেলে কি শুধু এই শোকসংবাদ দেখে?”

উর্ণার চোখের জল প্রায় শুকিয়ে গেছিল। আবার চোখ জলে ভরে এল। “তুমি কি কিচ্ছু বোঝো না তুর্বসু রায়? এই কাগজে যে দুজনের নাম আছে তাঁরা গত এক বছরে মারা গেছেন। বাবাও এখন উইল বানাচ্ছেন। এর মানে বোঝো?”

আমি এবার অনুমতি না নিয়েই জড়িয়ে ধরলাম উর্ণাকে। এই প্রথমবার। কপালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে বললাম, “এর মানে আর কিছুই না। বন্ধুরা মারা গেলে মানুষের মন এমনিতেই দুর্বল হয়ে যায়। তার ওপরে তাঁরা একই সংস্থায় কাজ করতেন। দেবাশিসদাকে যে কাকু চিনতেন সেটা আমারও জানা ছিল না। সে যাই হোক। তুমি চিন্তা কোরো না। নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যাও। কাকুর যাতে কেউ কোনও ক্ষতি না করতে পারে, সেটা আমি দেখব।”

মৃদু হাসি ফুটল উর্ণার মুখে। এতক্ষণে।

“বড়ো আমার বীর পালোয়ান রে। তবে শোনো, বাবা যেন না পারে।”

“আরে হ্যাঁ। সে তো বটেই। তবে আমি ড্যাম শিওর, ভয় পাবার মতো কিচ্ছু হয়নি। যদি হয়েও থাকে, তবে আমি আছি। তুমি চাপ নিয়ো না। রাত একটা বাজল। কাল সকালে কলেজ আছে তো?”

মাথা নাড়ল উর্ণা। আছে।

“তাহলে? যাও, শুতে যাও। আমারও ঘুম পেয়েছে। আর এই কাগজটা আমার কাছে থাক। আর হ্যাঁ, সেদিন চক্রবর্তী চ্যাটার্জীতে নাইট নামের এক ভদ্রলোকের একটা বই কিনলে না? ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে? ঘুমাতে যাবার আগে একবার ওটা দিয়ে যেয়ো তো। দরকার আছে।”

উর্ণা চলে গেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে একদৃষ্টে কাগজটার দিকে চেয়ে রইলাম। শত চেষ্টাতেও আজ রাতে আমার ঘুম আসবে না। একটা রেজিস্টার্ড সংস্থার প্যাডে গোটা চিঠিটা ছাপানো। উপরে বড়ো বড়ো করে লেখা-

NIBAR (RGTD).

A Non-Govermental Organisation fighting for Human Rights. Home & Abroad.

পাশে অদ্ভুত এক চিহ্ন। এই চিহ্ন আমি চিনি। চিনা অক্ষর ই-চিং। কিছুদিন আগেই অফিসার অমিতাভ মুখার্জি আমায় দেখিয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির ডাকবাক্সে কেউ ফেলে যাচ্ছিল। তিনটে লম্বা দাগের উপরের দুটো ভাঙা, নিচেরটা অক্ষত। মানেটাও বলেছিলেন অফিসার। ভয়াবহ পরিণতি, মৃত্যু। এখানে অবশ্য সেই চিহ্নের চারপাশে লেখা আছে চারটি ল্যাটিন শব্দ।

Dissimulo. Fraternitati. Unio. Oblitus.

.

৩।

খুব একবার বাবার হাত ধরে এই ওলন্দাজদের কবরখানাটায় ঢুকেছিলাম। তখন এখানকার ওবেলিস্কগুলো পাহাড়ের মতো বড়ো বড়ো লেগেছিল। এত বছরে কবরখানার হাল আরও বিগড়েছে। গতবার যেন আর- একটু পরিষ্কার দেখেছিলাম। এবার জঙ্গলে ভরা। অফিসার মুখার্জি এখনও পৌঁছাননি। কবরখানা শুনশান। শুধু বড়ো বড়ো গাছ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। সামনে বিরাট একটা জামরুল গাছ। তার সামনে থেকেই একের পর এক কবর। হাঁটতে হাঁটতে কবরের এপিটাফের নামগুলো পড়ছি। কিছু আছে। কিছু কবরচোরেরা উপড়ে নিয়ে গেছে। বাবার সেই পাতলা বইটা “চুঁচুড়া কথা” সঙ্গে নিয়ে এসেছি, আর মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছি। এই তো কর্নেলিস ডে জং- এর কবর। এই কবরখানার সবচেয়ে পুরোনো কবর। ১৭৪৩-এর। মজার ব্যাপার, একটু দূরেই সবচেয়ে নবীনতম কবরে শুয়ে আছেন এমা ড্রাপার। ১৮৪৭ সালে তাঁকে গোর দেওয়া হয়েছিল। সিপাই বিদ্রোহের তখনও দশ বছর বাকি। কিন্তু আমার মন অন্য জায়গায়। ভার্নেৎ-এর সমাধিটা কোথায়? সেই ভার্নেৎ, যাঁর তুতো বোন স্বয়ং শার্লক হোমসের ঠাকুমা ছিলেন? বইতে তাঁর কথা স্পষ্ট লেখা আছে। খুঁজতে খুঁজতে এক কোণে পেয়ে গেলাম সেই সমাধি। লম্বাটে। চুন সুরকি দিয়ে বাঁধানো। চমকটা খেলাম সমাধির মাথার কাছে গিয়ে। অন্য সমাধির মতো এখানে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্যাঁচার মতো মুখওয়ালা VOC খোদাই করা নেই। আছে গোল একটা সিল। তার দুই বিপরীত দিকে যোগচিহ্নের মতো বড়ো বড়ো দুটো ক্রস। প্রতিটাকে ঘিরে আরও চারটে। এমন অদ্ভুত চিহ্ন আমি আগে কখনও দেখিনি। ঠিক তার পাশেই আবার কোনাকুনি দুটো অন্য চিহ্ন। তিনটে তারা আর একটা রাজমিস্ত্রিদের ম্যাসন’স স্কোয়ার। এই চিহ্ন আমি চিনি। একেবারে শুরুতে এ দেশে ফ্রিম্যাসনরা এই চিহ্নই ব্যবহার করত। কিন্তু অন্যটা কী?

“খুব দেরি করে ফেললাম?”

গলার আওয়াজে বুঝলাম ইনস্পেক্টর মুখার্জি এসে গেছেন। আমি এতক্ষণ মন দিয়ে কবরটা দেখছিলাম বলে খেয়াল করতে পারিনি।

“কী দেখছ এত মন দিয়ে?”

“এই কবরটা আগে দেখেছেন?”

“আমি এখানে অনেক আগে একবার এসেছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে। তারপর এই এলাম।”

“আমারও সেই দশা। আচ্ছা অন্য সব কবরে VOC খোদাই করা, কিন্তু এই ভার্নেৎ সাহেবের কবরে অন্য চিহ্ন কেন? এই দেখুন এই দুটো তো ফ্রিম্যাসনদের চিহ্ন। অন্য দুটো কী?”

মুখার্জি একটু ঝুঁকে চিহ্ন দুটো দেখেই সোজা হয়ে গেলেন। বললেন, “স্ট্রেঞ্জ!”

“কেন? অবাক হবার কী হল?”

“এঁদের বলে জেরুজালেম ক্রস। ফাইভ ফোল্ড ক্রস-ও বলে অনেকে। দেবাশিসদার বাড়িতে দেখেছিলাম।”

“এর মানে কী?”

“পাঁচটা ক্রস হল যিশুর দেহের পাঁচ ক্ষতচিহ্নের প্রতীক। অনেকে আবার বড়োটিকে যিশু আর চারটিকে তাঁর চার শিষ্য হিসেবে মনে করেন। ১২৮০ সালে জেরুজালেমে প্রথমবার কোট অফ আর্মসে এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর অন্য একটা মানেও নাকি আছে। অষ্টাদশ শতকে ফ্রিম্যাসনদের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে যায়। একদল যিশুর অহিংসাবাণী মেনে চলতেন। অন্য দল তা মানেননি। যাঁরা মানতেন তাঁরা প্রকাশ্যে জেরুজালেম ক্রসকে নিজেদের কোট অফ আর্মসে ব্যবহার শুরু করেন। চরমপন্থী ফ্রিম্যাসনরা বিদ্রোহ করেন। তাঁদের বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু দলের মধ্যেই তাঁদের সমর্থক ছিল। গোপনে তাঁরা ঘোঁট পাকাতে থাকেন ও নানারকম স্যাবোটাজ করেন। তাঁদের আলাদা চিহ্ন ছিল। যদিও সেটা কী, কেউ জানে না।”

“আপনি স্টিফেন নাইটের নাম শুনেছেন?”

অফিসার মাথা নাড়লেন। শোনেননি।

“আমিও এতদিন শুনিনি। জাস্ট গতকাল এঁর লেখা একটা বই পেয়েছি। কাল সারারাত এঁর বই পড়ে ঘুমাতে পারিনি।”

“কেন? কী আছে তাতে?”

“ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে যতটুকু যা জানি তার নব্বই ভাগই নাকি এই ভদ্রলোকের জন্য। ভূমিকায় লেখা আছে। ১৯৮৩ সালে গ্রানাটা থেকে তাঁর একটা বই প্রকাশ পায়। দ্য ব্রাদারহুড। ফ্রিম্যাসনদের নিয়ে লেখা। এই সেই বই। সে বই কলকাতায় কোন পথে এল কে জানে? বইটা প্রকাশ মাত্র সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যায়। সেখানে নাইট পরিষ্কার দাবি করেছেন, এই ফ্রিম্যাসনরা ইউরোপের নানা দেশের বড়ো বড়ো পদ অধিকার করে আছে। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই ‘Freemasons applaud violence, terror and crime, provided it is carried out in a crafty manner’। এই বইতে তিনি এটাও দেখিয়েছেন বিশেষ করে ইংল্যান্ডের গোটা রাজনৈতিক ক্ষমতা এখন ফ্রিম্যাসনদের হাতে। সেটা তারা কী করে করল তা জানতে পারেননি নাইট। চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এটাও নাকি বলেছিলেন, ফ্রিম্যাসনরা একবার ভয়ানক এক চক্রান্ত করে, যাতে ইংল্যান্ডের অস্তিত্ব অবধি বিপন্ন হতে পারত। তিনি নাকি সন্ধান করে অনেকটা বারও করেছিলেন। প্রমাণ জোগাড় করছিলেন। কিন্তু তার আগেই মাত্র তেত্রিশ বছর বয়েসে নাইট আচমকা মারা গেলেন।”

“খুন?”

“এখানেই তো মজা। খুন হলেও সেটা প্রমাণ করা যাবে না। নাইটের মাথায় ১৯৮০ সাল নাগাদ একটা টিউমার ধরা পড়ে। সেটা সারাতে তিনি অনেকের কাছে যান। এমনকি আমাদের ভারতীয় গুরু ভগবান রজনীশের কাছেও। ১৯৮৪-তে টিউমার অপারেশন হয়। সাকসেসফুল। পরের বছরই এক টিভি প্রোগ্রামে নাইট ঘোষণা করলেন ফ্রিম্যাসনদের মধ্যের সেই চরমপন্থী গ্রুপের সন্ধান তিনি পেয়েছেন এবং তারা নাকি তখনও সক্রিয়। এই গ্রুপের নাম জাবুলন আর দুই বছরের মধ্যেই তার নতুন বই আসবে এদের নিয়ে। দুই মাসও গেল না। নাইট মারা গেলেন।”

“মৃত্যুর কারণ?”

“ডাক্তার বলেছিল ওই টিউমার নাকি আবার ফিরে এসেছিল। কিন্তু মিথ্যে কথা। মারা যাবার আগের দিনও বন্ধুদের এক পার্টিতে গেছিলেন নাইট। একেবারে স্বাভাবিক। তাই আমার ধারণা… খুন। যাই হোক, এসব আলোচনা পরে হবে। আগে বলুন, দারোগা প্রিয়নাথ মুখার্জি আপনার কে হন?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *