পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ— মহাপতন

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ— মহাপতন

৪ জুন, ১৮৯১, রাইখেনবার্গ জলপ্রপাত, সুইজারল্যান্ড

“গুড আফটারনুন, ডিটেকটিভ।”

শুনে গোয়েন্দা ভদ্রলোকটি সোজা সামনের দিকে তাকালেন। তাঁর দুই হাত পিছনে, দুই পা দুপাশে ছড়িয়ে রাখা। যেন কোনও অদৃশ্য কমান্ডারের নির্দেশে এখন বিশ্রামে আছেন। আদেশ পেলেই চকিতে অ্যাটেনশান হয়ে যাবেন। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তার একদিকে খাড়া পাথুরে পাহাড়, অন্যদিকে অতল খাদ। সামনে ভিজে, পিচ্ছিল সরু রাস্তা। শতাব্দীপ্রাচীন শৈবালদাম ঘিরে রয়েছে চারদিকে। বিন্দু বিন্দু জলকণায় গোটা পথ জুড়ে এক অদ্ভুত জলজ সোঁদা গন্ধ। একটু এগোলে এই পথই সোজা চলে গেছে রাইখেনবার্গের বিরাট প্রপাতের দিকে। এখান থেকে শোনা যাচ্ছে জলের একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে গাছের পাতার মর্মর। কিন্তু কোথাও কোনও পাখি ডাকছে না আজ।

“বড্ড মনখারাপ করা জায়গা”, বিষন্ন, উৎকণ্ঠিত এক হাসি হেসে বললেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অধ্যাপক। তাঁর প্রায় হাড় জিরজিরে রোগা দেহখানা আর উড়ন্ত ফ্রককোট মিলেমিশে বিরাট এক বাদুড়ের মতো দেখাচ্ছে। গোটা পথ জুড়ে তবুও তিনিই দাঁড়িয়ে। একা। যেন কোন অশুভ ভবিতব্যের আশায়।

“এত জায়গা থাকতে এখানে কেন?” অবশেষে মুখ খুললেন ডিটেকটিভ।

“লন্ডনে কোনওরকম আলোচনার পরিস্থিতি নেই। চারিদিকে গুপ্তচর ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার উপরে নজর রাখা হচ্ছে চব্বিশ ঘণ্টা।”

“কার গুপ্তচর?”

“সেটা আপনি খুব ভালো করেই জানেন।”

“আলেকজান্দ্রিনার?”

“সে কী মিস্টার! এ নাম আপনি মুখে নিলেন কেমন করে? আমি তো ভাবতেও …”

“কাজের কথায় আসুন প্রফেসর”, এবার একটু রুক্ষভাবেই বললেন ডিটেকটিভ। “অ্যালিস মার্গারেট কোথায়?”

“কোথায় মানে? এই মুহূর্তে কোথায়?”

“হ্যাঁ।”

“আমার জানা নেই। তবে যে জানে, আমি তার খবর দিতে পারি।”

“কে সে?”

“এখানে দাঁড়িয়েই সব আলোচনা শেষ করবেন ডিটেকটিভ মশাই? চলুন না, একটু এগিয়ে রাইখেনবার্গের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আলোচনা করা যাক। আমার একটা প্রস্তাব আছে আপনার কাছে। সেটা বলতেই মূলত আপনাকে এখানে ডাকা।”

ডিটেকটিভ এমনই কিছু একটা আশা করছিলেন। তিনিও গররাজি হলেন না। শুধু বললেন, “আমি আমার এক বন্ধুর জন্য ছোটো একটা চিঠি লিখে যেতে পারি?”

“অবশ্যই, তবে দেখবেন যেন ছোটো হয়। আমার হাতে সময়বেশি নেই।” পকেট নোটবুক থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে ডিটেকটিভ লিখলেন,

“প্রিয় দাদা মাইক্রফট,

এই চিঠি যদি তোমার হাতে পৌঁছায়, তবে তার একটাই মানে। আমি আর বেঁচে নেই। তবে শাস্তি এটুকুই, অপরাধ জগতের নেপোলিয়ান জেমস মরিয়াটি আর তার দলবলকে শেষ করে তবেই আমি শেষ হয়েছি। কাল থেকে ইংল্যান্ড নতুন করে বাঁচতে পারবে, যেখানে মরিয়াটি বা তার কালো ছায়া সমাজে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারবে না।

আমার দেহ খুঁজে না পেলে এই চিঠিকেই আমার এপিটাফ বলে ধরে নিয়ো।

তোমার ছোটো ভাই”

চিঠি লিখে পাতাটা মুড়ে নিজের রুপোর সিগারেট কেসের তলায় চাপা দিয়ে রেখে দিলেন ডিটেকটিভ। তারপর প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে একপেশে একটা হাসি হেসে বললেন, “বলুন, কোথায় যেতে হবে।”

সরু পাকদণ্ডির মতো পথ। পা হড়কে যাচ্ছে থেকে থেকে। কিছুটা একসঙ্গে গিয়ে আচমকা পিছন ফিরে দাঁড়ালেন প্রফেসর। ডিটেকটিভ অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, প্রফেসরের দুচোখের কোণে জল। ঠোঁট দুটো অল্প কাঁপছে। এই ব্যাপারটা একেবারেই ডিটেকটিভের অনুমানের বাইরে ছিল। এমন তো হবার কথা না!

“কী হয়েছে প্রফেসর?”

“আমি বাঁচতে চাই মিস্টার হোমস। আমি চাই না এই সাক্ষাৎকার আমাদের শেষ সাক্ষাৎকার হোক।”

“বলুন, আমি শুনছি।”

“ভয়ানক এক খেলা চলছে। তাতে আমরা নিতান্ত বোড়ে মাত্র। রাজা উজির আমাদের নিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে, দরকারে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। আমার যক্ষ্মা হয়েছে। জানি বেশিদিন বাঁচব না। তবু আজ আমাকে এখানে ডেকে আনা হল কেন? আপনার মোকাবিলা করতে না, আপনাকে বৃদ্ধির খেলায় হারাতে না, শুধু… শুধু একটা টোপ হিসেবে। আমাকে বাধ্য করা হচ্ছে আত্মহত্যা করতে। এতদিন ব্রাদারহুডের জন্য এত কিছু করে এই অসম্মান, এই হেনস্থা কি আমার প্রাপ্য ছিল? বলুন তো?”

“আপনি ব্রাদারহুডের সদস্য?”

“না। ভাড়াটে গুন্ডা বলতে পারেন, কিংবা কনসালটেন্ট ক্রিমিনাল।”

“জাবুলনদের বিষয়ে আপনি কিছু জানেন?”

এই নামটা শুনেই প্রফেসরের চোখমুখে ভয়ংকর এক আতঙ্কের ছায়া দেখলেন ডিটেকটিভ। পৃথিবীর সেরা অপরাধীও তবে কাউকে ভয় পায়?

সেটা বলতেই বারবার জোরে জোরে মাথা নাড়লেন প্রফেসর।

“আপনি কিচ্ছু জানেন না মিস্টার। কিচ্ছু না। এদের হাতে রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো আছে। আর রাষ্ট্র যদি অপরাধপ্রবণ হয়, তবে তার সঙ্গে কে মোকাবিলা করতে পারে?”

“আপনি কার কথা বলছেন?”

“সব বলব। আমি যা জানি সব। তবে তার আগে আমার সম্পূর্ণ ইমিউনিটি চাই। আপনার থেকে না। আরও বড়ো কোনও অথরিটির থেকে। আমি জানি আপনার দাদা মিস্টার মাইক্রফট ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের সর্বেসর্বা। এক কথায় সে নিজেই ব্রিটিশ সরকার। সরকারের সমাস্তরালে তার বাহিনী কাজ চালায়। আমি যা জানি, সব খুলে বলার বদলে আপনাকে আমার প্রাণরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। আমাকে নতুন নামে নতুন পরিচয়ে অন্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাজি?”

হাত বাড়িয়ে দিলেন ডিটেকটিভ, “রাজি। আমি অবশ্যই দাদাকে বলব। কিন্তু একটা প্রশ্নের জবাব এখুনি চাই। অ্যালিস মার্গারেটের খবর কে জানে?”

“বেডলামের এক ডাক্তার। রিচার্ড হ্যালিডে।”

“কোন হ্যালিডে? ডাক্তার হেনকির শিষ্য?”

“একেবারেই ঠিক। খুব সম্ভবত ভারতবর্ষে…”

কথাটা শেষ করতে পারলেন না প্রফেসর। বিরাট এক পাথরের চাঁই ডিটেকটিভের ঠিক কান ঘেঁষে রাস্তায় আঘাত খেয়ে প্রফেসরকে নিয়ে সোজা গিয়ে পড়ল সেই ভয়ানক গহ্বরের মধ্যে। প্রফেসর আর্তনাদের সময়টুকু পেলেন না। কয়েক সেকেন্ড বাদেই আরও একটা। তারপর আরও এক। এ জিনিস আর যাই হোক, দুর্ঘটনা নয়। ডিটেকটিভ জানেন প্রথমবার সাক্ষাৎ, দ্বিতীয়বার দৈবাৎ হতে পারে, কিন্তু তৃতীয়বার তা সংঘাত। কেউ বা কারা সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে সংঘাতে নেমেছে। কে হতে পারে? ভাবতে ভাবতেই উপরের দিকে তাকালেন ডিটেকটিভ। দেখতে পেলেন ভয়াবহ এক মুখ। মরিয়ার্টির সেকেন্ড ইন কমান্ড, যার নীল দুই চোখে প্রতিশোধের আগুন।

ওহহ! মরিয়ার্টি তবে একা আসেননি! তাঁর পিছনে তাঁকেই খুন করতে তাঁরই ডান হাত কর্নেল সেবাস্টিয়ান মোরানকে লাগানো হয়েছে! কিন্তু এইসবের পিছনে তবে কি…

ভাবার আগেই এবার দৈত্যাকার এক পাথর মাত্র কয়েক ইঞ্চির জন্য দিকভ্রষ্ট হল। ডিটেকটিভ কোনওমতে পাহাড়ের একটা খাঁজ বেয়ে উঠতে লাগলেন। অতি কষ্টে। বুঝতে পারলেন উপরের লোকটা দেখতে চেষ্টা করছে তার পাথর অভীষ্ট লক্ষ্য সিদ্ধ করল কি না। প্রতি মুহূর্তে খাদে তলিয়ে যাবার ভয়। উপর থেকে পাথর এসে পড়ার আতঙ্ক। প্রতিবার জলজ উদ্ভিদ, শ্যাওলাধরা পাথরে হাত পিছলে গেলেই মনে হচ্ছে এই বুঝি সব শেষ। অদ্ভুত এক ঘোর লাগল ডিটেকটিভের মনে। যেন তিনি শুনতে পেলেন রাইখেনবার্গের তলার সেই মহাপঙ্ক থেকে মরিয়াটি তাঁর নাম ধরে ডাকছে।

অবশেষে এমন একটা চ্যাটালো পাথরের ফাঁকে ছোট্ট গুহা পাওয়া গেল, যেখানে লুকিয়ে থাকা যায়। আরও কয়েকটা পাথর এসে পড়ল রাস্তায়। গড়িয়ে গেল খাদে। পাহাড়ের উপরের হত্যাকারী বুঝি ভাবল সে ডিটেকটিভকে অবশেষে সাবাড় করে দিয়েছে। এক অর্থে ভালোই। মনে মনে হাসলেন ডিটেকটিভ। গোটা পৃথিবীর কাছে এখন তিনি মৃত। মাইক্রফটকে বলতে হবে ভালো করে যেন তাঁর মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে দেয়। ওই সিগারের কেসে ঢাকা চিঠিই হবে তাঁর মৃত্যুর প্রমাণপত্র। স্ট্র্যান্ডে যেন আলাদা অবিচুয়ারি কলাম হয়। না মরলে জাবুলনরা তাঁর পিছু ছাড়বে না।

আরও খানিক বাদে যখন বিকেলের রোদ চলে এসেছে, পকেট থেকে একটা সিগার বার করে সাবধানে ধরাতে গেলেন ডিটেকটিভ। জোলো হাওয়ায় বারুদের কাঠিগুলো ভিজে একশা। অগত্যা তামাকের আশা ছেড়ে আধশোয়া হয়ে ভাবতে লাগলেন তিনি। যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। খেলা শুরু হয়ে গেছে। মারা যাবার আগে মরিয়াটি অদ্ভুত ভালো একটা প্ল্যান দিয়ে গেছেন। যদিও তাঁর নিজের জন্য, কিন্তু ডিটেকটিভ সেটাকেই এবার কাজে লাগাবেন। প্রথমেই লাগবে একটা ছদ্মনাম আর ছদ্মপরিচয়। তারপর পালিয়ে যেতে হবে এমন এক দেশে যেখানে জাবুলনরা তাঁকে ধরতে পারবে না। কিন্তু অ্যালিস? তার কী হবে? ভাবতেই বিদ্যুৎচমকের মতো একটা আইডিয়া এল মাথায়। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। মরিয়ার্টি খাদে পড়ার ঠিক আগে কী বলেছিল, এখনও কানে ভাসছে ডিটেকটিভের। দাদাকে বলতে হবে সব ব্যবস্থা করতে।

এবার ছদ্মনাম নিয়ে ভাবা যাক বরং। কী নাম…. কী নাম…. ডিটেকটিভ ভাবতে থাকেন… তাঁর বাবার নাম ছিল সাইগার হোমস। সেখান থেকে যদি কিছু…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *