ষষ্ট অধ্যায় – উপসংহার

ষষ্ট অধ্যায় – উপসংহার

সেনাবাহিনীর মদীনায় প্রত্যাবর্তন।
লুণ্ঠিত মালের ভাগাভাগি এবং যুদ্ধ-বন্দীদের ভাগ্য নিয়ে মতানৈক্য।
মদীনায় বিজয়ের সংবাদ।
পরাজয়ের প্রতি মক্কার প্রতিক্রিয়া।
মদীনায় বিজয়োত্তর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ।
মহানবীকে হত্যার প্রচেষ্টা।
আরবের অন্যত্র বিজয়ের প্রভাব।
স্মৃতি রোমন্থন ও শেষ কথা।

লুণ্ঠিত মালামাল বন্টনে মতানৈক্য

মহানবী মুসলমান সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিন দিন বদরে অবস্থান করেন এবং এই সময়ই লুণ্ঠিত মালামালের ভাগাভাগি নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।

যারা শত্রুদের পরাজয়ের পর তাদের পিছনে ছুটেছিলেন তারা বললেনঃ যারা শত্রুদের তাড়িয়ে তাদের মাল দখল করেছেন এ মাল আসলে তাদেরই প্রাপ্য। অনুরূপভাবে, নবীজির ব্যক্তিগত গার্ডরাও এ মালের ভাগ চাইলেন, কারণ তারা বললেনঃ নবীজিকে রক্ষা করতে না হলে তারাও এ মাল সহজেই দখল করতে পারতেন। এরপর যারা মালগুলির হেফাজত করেন তারাও ভাগ চাইলেন।

মুসলমানদের মধ্যে এই মতবিরোধ যখন চরমে উঠলো তখন নবীজি সমস্ত মালপত্র তাঁর সামনে আনার জন্য সাহাবীদের নির্দেশ দিলেন। এর একটু পরেই কুরআনের “আল-আনফাল” সূরাটি নাযেল হয় এবং লুণ্ঠিত মালামাল সংক্রান্ত বিরোধটিকে মিমাংসা করে দেয়। এই সূরার আলোকেই মহানবী সমস্ত লুণ্ঠিত মালামাল সব যোদ্ধার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেন। সূরাটি শুরু হয় এভাবেঃ

অর্থ : হে মুহাম্মদ, তারা তোমাকে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। তুমি বলঃ এ মাল আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর। অতএব আল্লাহর প্রতি কর্তব্য পালন কর এবং তোমাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেল। তোমরা যদি প্রকৃত বিশ্বাসী হও তাহলে আল্লাহ্ ও তাঁর নবীকে মান্য কর। (Viii: ১)

মুসলমান বাহিনী যখন মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন তখন আল-মুদিক ও আল-নাজিয়ার মধ্যবর্তী আল-সাফ্রা উপত্যকার কাছাকাছি একটা স্থানে লুণ্ঠিত মালামালের বন্টন কাৰ্য সম্পন্ন হয়।

মুসলমান সৈন্যদের মদীনায় প্রত্যাবর্তন

তিনদিন বদরে অবস্থানের পর মহানবী তাঁর বিজয়ী সেনাবাহিনীকে মদীনায় প্রত্যাবর্তনের[১] আদেশ দেন এবং মদীনাবাসীকে শুভ বার্তা পৌঁছানোর জন্য আগে দু’জন দূতকে (মুহাজিরিনদের মধ্য থেকে যাইদ বিন হারিস এবং আনসারদের মধ্য থেকে আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াদা) পাঠিয়ে দেন।

[১. নবীজি মুসলমান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ২৩শে রমযান বুধবার মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।]

আল-নাদার বিন আল হারিসের মৃত্যুদন্ড

নবীজি যখন আল-সাফায় পৌঁছেন তখন তিনি বদরে পৌত্তলিকদের পতাকা বহনকারী, অন্যতম যুদ্ধাপরাধী এবং ইসলামের ঘোরতর শত্রু আল-নাযার বিন আল-হারিসকে মেরে ফেলার নির্দেশ দেন এবং আলী বিন আবি তালিব সঙ্গে সঙ্গে তাকে হত্যা করেন।

কারো কারো মতে, নবীজি এই সুন্দর পংক্তিগুলি শুনে মন্তব্য করেছিলেন যে তার মৃত্যুদন্ডের আগে যদি তিনি এগুলো শুনতে পেতেন তাহলে হয়তো তিনি তাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিতেন না। ইবনে হিশাম অবশ্য এই ধারনাকে সত্য মনে করেন না। কারণ তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরই নবীজি তার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন এবং নবীজি এটা নিশ্চিতভাবেই জানতেন যে একমাত্র মৃত্যুদন্ডই হচ্ছে তার প্রাপ্য। এহেন খাঁটি বিচারকে কোনভাবেই কোন বাগ্মিতা কিংবা বিখ্যাত কোন কবির সুন্দর কাব্য দিয়ে বাতিল করা যায় না।

উকবাহ্ বিন আবি মুইতের মুত্যুদন্ড

মুসলমান সেনাবাহিনী যখন আর্ক-আজ জাবিয়ায় পৌঁছেন তখন মহানবীর নির্দেশে আসিম[১] বিন সাবিত বিন আল-আফলা বনি ওকাইয়া গোত্রের উকবাহ্ বিন আবি মুইতকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।

[১. ইনি প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করেন এবং একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন। কথিত আছে, বদরের যুদ্ধের আগের রাতে মহানবী তাঁর সাহাবীদের যুদ্ধের কৌশল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তখন আসিম তীর ও ধনুক হাতে নিয়ে বলেন, শত্রু দু’শ হাত দূরে আসলেই তীর মারা হবে; আরো কাছে আসলে বর্শা এবং আরো কাছে আসলে তরবারি ব্যবহার করা হবে।” নবীজি এই কৌশলকে সমর্থন করেন এবং সাহাবীদের তা অনুসরণ করতে বলেন। তিনি ৩ হিজরিতে হুদাইল এলাকায় আল-রাজিয়ের দিনে বিশ্বাসঘাতকদের হাতে নিহত হন। এ গল্প বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে ইবনু হিশামের নবীজির জীবন গ্রন্থে।]

কোন কোন বর্ণনাকারীর মতে, মহানবী যখন উকবার মৃত্যু-দন্ডাদেশ প্রদান করেন তখন উকবাহ্ বলেছিলেন, “হে মুহাম্মদ, কুরাইশদের মধ্য থেকে আমাকেই কি আপনি হত্যা করবেন?” মহানবী বলেছিলেন, “হ্যাঁ তাই”। এরপর তিনি সাহাবীদের দিকে ঘুরে বলেছিলেন “আপনারা কি জানেন এই লোক কি করেছিল? একদিন আমি যখন নামাযে সেজদারত ছিলাম তখন সে এসে এমনভাবে আমার গলায় পা রেখেছিল যে তাতে আমার চোখ উল্টে গিয়েছিল। আরেকদিন আমি নামায পড়ার সময় সে ছাগলের নাড়ি-ভুড়ি দিয়ে আমার মাথা ঢেকে দিয়েছিল। পরে ফাতেমা[২] এসে ওটা সরিয়ে আমার মাথা ধুয়ে দিয়েছিল।

[২. ফাতেমা আজ-জোহরা ছিলেন নবীজির কনিষ্ঠতম ও সবচেয়ে আদরের মেয়ে। নবীজির ৩৫ বছর বয়সে কাবা ঘর নির্মাণের সময় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।২ হিজরির প্রথম দিকে আলীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। ৪ বছর আগে নবীজি আয়েশাকে বিয়ে করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা এ ব্যাপারে একমত যে একমাত্র ফাতেমার মাধ্যমেই মহানবী বংশধারা অব্যাহত ছিল। আয়েশা বলেন, “নবীজির পরে ফাতেমার চেয়ে অধিক সম্মানী কোন ব্যক্তিকে আমি দেখিনি।” ইবনু আব্বাসের বরাত দিয়ে আকরামা বলেছেন যে মহানবী বলেছিলেন, “পৃথিবীর মহিলাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা হচ্ছেন চারজন : মেরী, আয়েশা, খাদিজা এবং ফাতেমা।” ফাতেমা ১১ হিজরিতে রমযান মাসের ৩য় দিন মঙ্গলবার মৃত্যুবরণ করেন।]

যুদ্ধ-অপরাধীবৃন্দ

বদরে যাদেরকে বন্দী করা হয় তাদের মধ্যে কেবলমাত্র আল-নাদার বিন আল-হারিস এবং উকবাহ্ বিন আবি মুইতকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তারা উভয়ই ছিলেন ইসলাম ও মহানবীর ঘোরতর শত্রু এবং অন্যান্যদের মধ্যে এরা দু’জনও বদরের যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলেন। এদের জীবিত রাখলে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বড় ধরণের ঝামেলা হত। তারা সর্বশক্তি- দিয়ে মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর সাহাবীদের এবং ইসলামের ক্ষতি করতে চেষ্টা করতেন।

এমতাবস্থায় তাদের মৃত্যুদন্ড ইসলামের স্বার্থেই আবশ্যক ছিল। এই কুখ্যাত যুদ্ধ-অপরাধীরাই ইসলামের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অন্যান্য মক্কী নেতা ও এদের বিদ্বেষ ও শত্রুতা না থাকলে বদরের যুদ্ধ পরিহার করা হয়তো সম্ভব হতো। উপরন্ত, তাদের মৃত্যুদন্ড ছিল তাদের কৃত আরো কিছু অপরাধের শাস্তি এবং মহানবী অন্যান্য বন্দীদের মুক্তিপণের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়। মুক্তিপণের মাধ্যমে বন্দীদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য আল্লাহ্ কুরআনে মহানবীকে তিরস্কার করেন, কারণ আল্লাহ্ চেয়েছিলেন যে মুসলমানরা তাদের শত্রুদের জীবন না বাঁচিয়ে এবং তাদেরকে মেরে ফেলবে। আল্লাহর তিরস্কার ছিল এরকম :

ইসলামের শত্রুদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা না পর্যন্ত কোন নবী কোন বন্দী রাখতে পারে না। তুমি চাও ইহলোকের মঙ্গল আর আল্লাহ্ (তোমার জন্য) চান পরলোকের মঙ্গল। আল্লাহ্ শক্তিশালী ও জ্ঞানী। আল্লাহর তরফ থেকে পূর্বে আদেশ না এসে থাকলে তুমি যা নিয়েছ তার জন্য তোমাকে ভয়াবহ শাস্তি পেতে হতো। (viii : ৬৭-৬৮) কারণ বন্দী হওয়াটাই কারো অতীত অপরাধের জন্য উপযুক্ত শাস্তি নয়। কিন্তু এরা কোন সাধারণ অপরাধী ছিলেন না বরং এরা ছিলেন আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর ঘোরতর শত্রু এবং এরাই তাদের নিজের লোকদের এবং মুসলমানদের উপর এই প্রচন্ড যুদ্ধটা চাপিয়ে দিয়েছিল। এদের কিভাবে বিনা শাস্তিতে মুক্তি দেয়া যায়।?

বদরের যুদ্ধই ছিল মুসলমান ও পৌত্তলিকদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ যেখানে মুসলমানদের চেয়ে তাদের শত্রুদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। হত্যা ও বন্দী করার মাধ্যমে শত্রুদের জনবলকে দূর্বল করা ছিল মুসলমানদের জন্য একটা বড় কীর্তি। কোন পরিমাণ সম্পদেই এহেন ক্ষতি পৌত্তলিকদের জন্য পূরণীয় ছিল না।

বিষয়টির আরো একটা দিক আছে। এই মৃত্যুদন্ডগুলির মধ্যে মুসলমানদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। “আল্লাহ্ যাতে বুঝেন যে এই সব পৌত্তলিকদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন ভালবাসা বা দয়া নেই”–এ কথা বলে ওমর যখন পৌত্তলিক বন্দীদের মৃত্যুদন্ডের পক্ষে কথা বলেন তখন তিনি অত্যন্ত সুষ্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই শিক্ষার প্রতি ইঙ্গিত করেন।

এই দু’টি কারণেই আল্লাহ্ মুক্তিপণের মাধ্যমে বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেননি। আল-নাদার বিন আল-হারিস এবং উকবাহ্ বিন আবি মুইতের মৃত্যুদন্ড কুরআনের এই আদেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল এবং তখনকার পরিস্থিতিতে তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।

অভিনন্দনকারী প্রতিনিধিবৃন্দ

যখন মহানবী আল-রোহায়[১] পৌঁছেন তখন তাঁর সঙ্গে কতিপয় মুসলিম মাদানী নেতার সাক্ষাত হয়। এরা বেরিয়েছিলেন মহানবীকে তাঁর বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাতে। তাদের অভিনন্দনের কথা শুনে সালমা বিন সালামা বলেছিলেন : “আপনারা কি জন্য আমাদের অভিনন্দন জানাচ্ছেন? আমরা সেখানে বৃদ্ধ দাসী ছাড়া আর কাউকে পাইনি। তারা দেখতে ছিল কোরবানীর পশুর মত যাদেরকে তাড়িয়ে মক্কায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।” একথা শুনে মহানবী হেসে বলেছিলেন : “হে আমার ভাতিজা! তারা ছিল গণ্যমান্য লোক।”

ওসাইদ বিন আল-হুদাইর (যারা মহানবীকে অভিনন্দন জানাতে আল- রোহায় গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন) বলেছিলেন, “হে আল্লাহর দূত, সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আপনাকে বিজয় এনে দিয়েছেন এবং আপনার চোখকে উদ্ভাসিত করেছেন। হে নবী, আমি আপনার সঙ্গে বদরে যাইনি, কারণ আমি ভাবতেই পারিনি যে সেখানে কোন যুদ্ধ হবে। আমি ভেবেছিলাম আপনারা শুধুমাত্র একটা কাফেলা দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যদি বুঝতাম যে সেখানে যুদ্ধ হবে তাহলে কখনোই আমি ঘরে বসে থাকতাম না। আল্লাহর রসূল বলেছিলেন : “আপনার কথা সত্য।”[২]

[১. আল-রোহার অবস্থান মক্কা ও মদীনার মাঝামাঝি মদীনা থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে।

২. আল-বিদায়া ওয়ান বিহায়া, তয় খণ্ড, পৃঃ ৩০৪]

মদীনায় বিজয়ের সংবাদ

যুদ্ধের সময় মদীনায় তিন গ্রুপের লোক ছিলেন : মুসলমান, ইহুদি এবং ভন্ডদের দল। এদের মধ্যে শেষোক্ত দুই গ্রুপ অর্থাৎ ইহুদি এবং ভন্ডদের প্রত্যাশা ছিল মুসলমানরা পৌত্তলিকদের হাতে পরাজিত হবেন। এজন্য যুদ্ধের ফলাফল মদীনায় পৌঁছার আগে তারা মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য কানাঘুষা শুরু করেছিল। তারা গুজব রটিয়েছিল যে যুদ্ধে মহানবী নিহত হয়েছেন এবং তাঁর সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত হয়েছে।

সব ধরণের গুজব ও বিভ্রান্তিকর রিপোর্টের এই পরিস্থিতিতেই মদীনার মুসলমানগণ একটা মানসিক যন্ত্রণা, উদ্বেগ এবং মহানবীর জীবন এবং তাদের ক্ষুদ্র সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সম্পর্কে একটা ভীতির মধ্যে বসবাস করছিলেন। মহানবীর সংবাদ-বাহক আব্দুল্লাহ্ বিন রাওয়াদা এবং যাইদ বিন হারিসের[১] আগমনে নগরের অবস্থার পরিবর্তন হয়। তারা আল্লাহ্ প্রশংসা ক’রে উচ্চস্বরে মুসলমানদের বিজয় এবং পৌত্তলিকদের শোচনীয় পরাজয়ের কথা ঘোষণা করতে করতে নগরে প্রবেশ করেন। তারা মদীনার লোকদের এটাও জানিয়েছিলেন যে মহানবী এবং তাঁর বিজয়ী সৈন্যরা একটু পরেই আসছেন।

[১. মহানবীর মুক্তি দেওয়া ক্রীতদাস। কথিত আছে, একদিন তার মা যখন বনি আল-কাইন ইবনু জাছর কর্তৃক আক্রান্ত তার লোকদের (বনি মা’ন) দেখতে যান তখন যাইদ দাসত্ব বরণ করেন। ছোট বালক যাইদকে দাস হিসেবে ধরে পরে উকাজের বাজারে হাকিম বিন হাযামের কাছে বিক্রি করা হয়। হাকিম এটি কেনেন তার চাচী খাদিজার জন্য। বিয়ের পর খাদিজা বালকটিকে নবীজিকে দিয়ে দেন। তার পিতা মক্কায় এসে মহানবীর কাছ থেকে ছেলেটিকে ফেরৎ চান। তখন যাইদকে ডেকে তার পিতার কথা বলা হলে তিনি মহানবীর সঙ্গেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। এই ঘটনা ঘটে হিজরতের আগে। এরপর থেকে তিনি বরাবরই নবীজির সঙ্গেই থাকেন। কালক্রমে তিনি একজন বড় সামরিক নেতা হন এবং রোমানদের বিরুদ্ধে মুয়াতায় মুসলমান সেনাদের যে তিনজন সেনাপত্তি নেতৃত্বদেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে প্রথম। এই যুদ্ধেই তিনি শহীদ হন।]

এই শুভ সংবাদ পেয়ে মুসলমানরা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেন অবশেষে ইহুদি এবং ভন্ডদের অপ-প্রচারণা ভিত্তিহীন প্রমানিত হয়।

শুভ সংবাদ বহনকারীদের একজন যাইদ বিন হারিস যখন নবীজির উটে (কুসওয়া) চড়ে মদীনায় পৌঁছেন তখন তার সঙ্গে একজন ভন্ডের দেখা হয় এবং ঐ ভন্ডটি তখন আবি লুবাবাহ্ আল-আনসারির উপস্থিতিতে বলে উঠে : “সত্যি সত্যি মুহাম্মদ নিহত হয়েছেন এবং এই যে তাঁর উট। আমরা সবাই তাঁর এই উটকে চিনি। এখানে যাইদও আছেন যিনি ভয়ে অবিশ্বাস্য কথা বলছেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছেন। ইহুদিরাও বলছে যে যাইদ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে এসেছেন।”

মুসলমান-বিরোধী প্রচারণা তখন এতই প্রবল ছিল যে অনেক মুসলমানই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে সন্দেহের মধ্যে ছিলেন।

ওসামাহ্ বিন যাইদ[১] বলেনঃ আমি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, যিনি ছিলেন নবীজির একজন সংবাদ বাহক। এবং তাকে একা পেয়ে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তুমি যে সংবাদ এনেছ তা কি আসলেই সত্য?” তিনি তখন বলেছিলেন,” হ্যাঁ, আল্লাহর দোহাই, আমি যা বলেছি তা সত্য।”

[১. ওসামাহ্ ছিলেন নবীজির মুক্তি দেওয়া ক্রীতদাস যাইদ বিন হারিসের পুত্র। যাইদের ইসলাম গ্রহণের পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুর সামান্য আগে মহানবী ১৮ বছরের যুবক ওসামাকে সিরিয়ার পাঠাবার জন্য বিশাল সেনাবাহিনীর সেনাপতি নিয়োগ করেন। এই বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ওমর বিন আল-খাত্তাব। কিন্তু এই সেনাবাহিনীর সিরিয়ায় যাওয়ার আগেই মহানবীর মৃত্যু হয়। সেজন্য আবু বকর খলিফা হয়ে নবীজির ইচ্ছামত তাদেরকে সিরিয়ায় পাঠানোর আদেশ না দেয়া পর্যন্ত তারা মদীনার বাইরে তাবুতেই অবস্থান করেন। আবু বকর অবশ্য মদীনায় তাঁর উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে ওমর বিন আল খাত্তাবকে রেখে যাওয়ার জন্য ওসামাকে অনুরোধ করেন। ওসামাহ্ ওসমানের হত্যার পরবর্তী গোলযোগের সময় বিবদমান দল দু’টির প্রতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিজেকে দূরে রাখেন। তিনি মুয়াইইয়ার শাসনামলের শেষদিকে মৃত্যুবরণ করেন।]

সংবাদটির সত্যতা যাচাই করে, ওসামাহ্ আরো বলেনঃ “আমি ভণ্ডটির কাছে ফিরে গিয়ে বললাম, ‘তুমি নবীজি এবং মুসলমানদের সম্পর্কে মিথ্যা কথা প্রচার করছ। এতএব, মহানবী এখানে এসে পৌঁছলে আমরা তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাব এবং আমরা তোমার মাথা উড়িয়ে দেব।’ এ কথা শুনে ভন্ডটি ভয় পেয়ে যায় এবং বিনীতভাবে বলেঃ “আমি শুধু অন্যের কাছ থেকে শুনা কথা বলেছি।”

মদীনায় বিজয়ী সেনাবাহিনী

ইহুদি এবং ভন্ডদের কানাঘুষা চলতেই থাকছিল। কিন্তু যখন তারা দেখলো যে কুরাইশদের বন্দী করে মুসলমান সৈন্যরা মদীনার পথে প্রবেশ করছেন তখন তারা খুব বিচলিত ও ভীত হয়ে পড়লো।

যখন তারা দেখলো যে সুহাইল বিন আমর, আমর বিন আবি সুফিয়ান, আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব, নাওফল বিন আল-হারিস এবং আল-ওয়ালিদ বিন আল-ওয়ালিদ সহ আরো অনেক মক্কী নেতার পেছন দিকে হাত বাঁধা তখন তারা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না।

বদরের যুদ্ধের ফলাফল সন্দেহাতীতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমগ্র আরব উপদ্বীপেই এর প্রতিঘাত অনুভূত হয়।

মহানবীর মদীনায় প্রত্যাবর্তন

মুসলমান যোদ্ধাদের আগমনের একদিন পরই মহানবী তাঁর সেনাপতিদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে মদীনায় প্রবেশ করেন।

মদীনার জনসাধারণ তাঁকে উষ্ণ সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন কিন্তু ইহুদি এবং ভন্ডরা এতে খুব মর্মাহত হয়। রাগে, দুঃখে এবং ঘৃণায় তারা বিচার বুদ্ধি হারিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। এরপর থেকে তাদের কাছে বুদ্ধিদীপ্ত আচরণ প্রত্যাশা করা ছিল সম্পূর্ণ বৃথা।

বন্দীদের ব্যাপার

মহানবী যুদ্ধ-বন্দীদেরকে মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। বদরের যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী মুসাব বিন ওমাইরের ভাই এবং একজন যুদ্ধবন্দী আবু আজিজ বলেনঃ “একদল আনসার বদর থেকে আমাকে বন্দী হিসেবে মদীনায় নিয়ে যায়। সকালের নাস্তায় এবং রাতের খাবারে তারা নিজেরা শুকনো খেজুর খেয়ে আমাকে রুটি দিতেন। তারা এটা করতেন নবীজির নির্দেশে। তারা নবীজির নির্দেশ এমনই কঠোরভাবে মানতেন যে তাদের মধ্যে কেউ এক টুকরা রুটি পেলেও সেটা আমাকে দিতেন। এতে আমি লজ্জিত হয়ে তাদেরকেই খেতে বলতাম কিন্তু তারা তা স্পর্শও করতেন না।”

বন্দীদের ভাগ্য নিয়ে মতানৈক্য

মহানবী মদীনায় এসে বন্দীদের সম্পর্কে সিদ্ধান্তের জন্য বিখ্যাত সাহাবীদের নিয়ে একটা উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন। এই বৈঠকে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্তিত ছিলেন আবু বকর, ওমর, ওসমান[১], আলী এবং আব্দুল্লাহবিন রাওয়াহা।

[১. ওসমান বিন আফয়ান বিন আবি আল-আস বিন ওমাইয়া বিন আবদ শামস বিন আব্দ মানাফ আল-ওমাঈ আল-কুরেশী সম্পর্কে কোন আনুষ্ঠানিক পরিচিতির দরকার নেই। তিনি ছিলেন ৩য় খলিফা। তিনি মহানবীর দুই কন্যা রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমকে বিয়ে করেন। যে দশজন বেহেস্তের শুভ সংবাদ পান তিনি ছিলেন তাদের একজন। তাঁর সম্পর্কে নবীজি বলেছিলেন : “প্রত্যেক নবীরই একজন সাহাবী থাকে এবং ওসমান হবেন বেহেস্তে আমার সাহাবী।” তাঁর স্ত্রী রুকাইয়া অসুস্থ ছিলেন বলে তিনি বদরের যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। মুসলমানদের বিজয় সংবাদ নিয়ে যেদিন সংবাদ-বাহকরা মদীনায় পৌঁছেন সেদিন রুকাইয়ার মৃত্যু হয়। তিনি অবশ্য লুণ্ঠিত মালের সমান ভাগ পান। ওমরের পর তিনি ৩য় খলিফা হন এবং বিদ্রোহীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। এই ঘটনার খারাপ প্রভাব মুসলমান দুনিয়া এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি ৬২ বছর বয়সে ৩৫ হিজরির ১৯ শে জুল-হিজ্জাহ্ তারিখে নিহত হন।]

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

দুই দলের মতামত পাওয়ার পর মহানবী সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে তাঁকে সাহায্য করার জন্য উভয় দলেরই প্রশংসা করেন। তিনি বন্দীদের মৃত্যুদন্ড সমর্থনকারী প্রথম দলের মতামতকে নূহ নবীর মতামতের সঙ্গে তুলনা করেন। নূহ নবী এভাবে তাঁর লোকদের ধ্বংস করার জন্য আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন :

অর্থঃ হে আমার প্রভু। দেশের এজন অবিশ্বাসীকেও আপনি রাখবেন না। (Lxxi : ২৬)

এবং তিনি দ্বিতীয় দলের দৃষ্টি ভঙ্গিকে ঈসা নবীর দৃষ্টি ভঙ্গির সঙ্গে তুলনা করেন যিনি বিচারের দিনে এই বলে তাঁর লোকদের জন্য আল্লাহ্ দয়া প্রার্থনা করবেন :

অর্থঃ আপনি যদি তাদের শাস্তি দিন, দেখুন তারা আপনার দাস এবং আপনি যদি তাদের ক্ষমা করেন তাহলে দেখুন, আপনিই একমাত্র শক্তিশালী এবং জ্ঞানী। (v : ১১৮)

প্রকৃতপক্ষে বদরের যুদ্ধ-বন্দীদের ব্যাপারে মহানবী (সঃ) একটা মধ্যপথ অবলম্বন করেন। তিনি তাদেরকে মৃত্যুদন্ড এবং মুক্তিপণ-এ দু’টোর মধ্যে যে কোন একটা বেছে নিতে বলেন। তিনি তাদেরকে বলেন : আজ তোমরা আমাদের উপর নির্ভরশীল এবং তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে না। মুক্তিপণ দিয়ে তোমরা মুক্তি না নিলে তোমাদেরকে মেরে ফেলা হবে।

বন্দীদের সমস্যার এভাবে সমাধান করা হয় এবং এই সিদ্ধান্ত মদীনা। থেকে মক্কায় পৌঁছে যায় এবং এরপর এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই বন্দীদের মুক্তি কার্যকর হয়। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা মুক্তিপণের মাধ্যমে তাদের মুক্তি অর্জন করেন এবং মহানবী কাউকে কাউকে দয়া করেও মুক্তি দেন। এছাড়া কয়েকজন গরীব বন্দীকেও পণ ছাড়াই মুক্তি দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে বন্দীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত ছিলেন তারা মুসলমানদের ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষা দানের মাধ্যমে তাদের মুক্তি অর্জন করেন।

বন্দীদের ব্যাপারে আল্লাহর অসমর্থনমূলক আয়াত

বন্দীদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর তরফ থেকে একটা ওহী নাযেল হয়। ওমর বিন খাত্তাব বলেছেন যে তিনি আল্লাহর নবী এবং আবু বকরের কাছে গিয়ে দেখেন যে তাঁরা কাঁদছেন। এ দেখে তিনি বলেন :

হে আল্লাহর দূত, আমাকে বলুন আপনি এবং আপনার সঙ্গী কি জন্য কাঁদছেন। তিনি জবাব দেন : মুক্তিপণ গ্রহণের জন্য আল্লাহ্ আমাদেরকে যে শাস্তির ভয় দেখিয়েছেন সেজন্যই আমরা কাঁদছি। এই গাছের কাছে এই শাস্তির নমুনা আমাকে দেখানো হয়েছে। আল্লাহ্ তাঁর অসমর্থনের কথা এই আয়াতে উল্লেখ করেছেন :

সারাদেশে যুদ্ধ করে বিজয় লাভ না করা পর্যন্ত কোন নবী বন্দী রাখতে পারেন না।

বিপর্যয়ের সংবাদে মক্কী-প্রতিক্রিয়া

বদরের যুদ্ধে চরম পরাজয়ের পর পৌত্তলিক বাহিনীর ৮৫০ জনের মত সৈন্য মক্কায় পালিয়ে যায় এবং তিহামার পাহাড় ও উপত্যকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তারা এতই বিচলিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েছিল যে মুসলমানদেরকে ধ্বংস করার জন্য যে শক্তি আর উদ্দ্যম নিয়ে মক্কা থেকে বের হয়েছিল সেখানে তারা কিভাবে প্রবেশ করবে সেটাই তারা বুঝতে পারছিল না।

এভাবে মদীনায় যখন মুসলমানদের বিজয়ে আনন্দ ও উৎসব চলছিল তখন মক্কায় নেমে এসেছিল বিপর্যয়ের ছায়া। মক্কাবাসীরা এতই বিভ্রান্ত ছিল যে পরাজয়ের প্রথম সংবাদকে অবিশ্বাস ক’রে সেই সংবাদ-বহনকারীকে তারা পাগল বলে অভিহিত করেছিল।

পরাজয় ছিল তাদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ব্যাপার। তারা কল্পনাই করতে পারেনি যে তাদের এক সহস্র সর্বোত্তম যোদ্ধা সাহসী ও ঝানু সেনাপতিদের অধীনে যুদ্ধ করে মদীনার একটা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ও নিকৃষ্ট বাহিনীর কাছে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে।

তার কি মস্তিষ্ক ঠিক আছে? Done page 207

যারা পরাজয়ের সংবাদ নিয়ে প্রথম মক্কায় পৌঁছেন তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আল-হেসুমান[১] বিন আয়াস আল-খুযাঈ। যুদ্ধের ফলাফল জানার জন্য মক্কাবাসীরা তাকে ঘিরে ধরে। তিনি অত্যন্ত কষ্ট করে তাদের সেনাবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি যখন যুদ্ধে নিহত মক্কী নেতৃবৃন্দের নামগুলি ঘোষণা করছিলেন তখন সাফওয়ান বিন ওমাইয়া[২] (অন্যতম মক্কী নেতা যিনি বদরের যুদ্ধে যাননি) তার এই ঘোষণা শুনে তাকে উচ্চকণ্ঠে পাগল বলে অভিহিত করেন। তার পাগলামীর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে কিছু প্রশ্ন করতে বলা হয়। লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করে : “সাফওয়ান বিন ওমাইয়া এখন কি করছেন?”

[১ ইনি মক্কার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে তিনি একজন ভাল মুসলমান হয়ে যান।

২ মুসলমানদের মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে যারা তাদেরকে প্রতিহত করেন সাফওয়ান বিন ওমাইয়া ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু ছিলেন এবং মক্কা বিজয়ের পর অন্যান্যদের মধ্যে তাকেও মহানবী বহিষ্কারের আদেশ করেন। মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয় যে তারা তাকে কাবা ঘরের সীমানার মধ্যে পেলেও হত্যা করবেন। এমতাবস্থায় তিনি মক্কা থেকে পালিয়ে যান কিন্তু পরে ফিরে আসলে মহানবী তাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি মুসলমানদের সঙ্গে থেকে হুনাইনের যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর ইসলাম গ্রহণ করে ভাল মুসলমান হয়ে যান। তিনি জাহিলিয়া যুগের অন্যতম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এবং বাকপটু বক্তা ছিলেন। তিনি একটা মুসলিম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে ইয়ামুকের যুদ্ধে অংশ নেন এবং খলিফা ওসমানকে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিনই তিনি মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।]

তিনি জবাব দেন : “তিনি ওখানে বসে আছেন এবং আমি নিজ চেখে তার বাবা ও ভাইকে নিহত হতে দেখেছি।” তার এই জবাবে মক্কাবাসীরা হতবাক হয়ে বিশৃঙ্খলায় পরস্পরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্যতম মক্কী সেনাপতি আবু সুফিয়ান বিন আল-হারিসের[৩] আগমনে পরাজয়ের অশুভ সংবাদটি নিশ্চিত হয়। তিনি আল-হেসুমানের প্রত্যেকটা কথার সত্যতা নিশ্চিত করেন।

[৩ ইনি ছিলেন নবীজির চাচাত ভাইয়ের ছেলে এবং তাঁর দুগ্ধ-ভ্রাতা, কারণ উভয়ই হালিমা আল-সাদিয়ার দুগ্ধ-পোষ্য ছিলেন অন্যান্যদের মধ্যে তিনিও নবীজিকে বিদ্রূপ করতেন এবং সর্বসমক্ষে তাঁর সমালোচনা করতেন। তিনি দূর্বল মুসলমানদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। যাই হোক, মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নবীজির সঙ্গে থেকে হুনাইনের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৫ হিজরিতে (মতান্তরে ২০ হিজরিতে) মৃত্যুবরণ করেন।]

আবু লাহাবের উপর সংবাদটির প্রভাব

মহানবীর মুক্তি দেওয়া ক্রীতদাস আবু রাফি[১] উল্লেখ করেন : “আমি একজন দূর্বল মানুষ ছিলাম এবং জমজম কূপের নিকট বাটিতে করে পানি বেচতাম। আল্লাহর কসম, আমি যখন একদিন সেখানে বসেছিলাম তখন নবীজির চাচা আবু লাহাব পা টানতে টানতে আমার কাছ থেকে একটু দূরে এসে বসলেন। আমরা পরষ্পরের দিকে পিঠ দিয়ে বসেছিলাম। এমন সময় আমরা লোকজনের মুখে সদ্য যুদ্ধ-ফেরত আবু সুফিয়ান বিন আল-হারিসের কথা বলতে শুনলাম। আবু লাহাব বিন আব্দুল মুত্তালিব তখন তাকে কাছে ডাকলেন এবং যুদ্ধের খবর জিজ্ঞেস করলেন।

[১. আবু রাফি ছিলেন সাঈদ বিন আল-আস বিন ওমাইয়ার ক্রীতদাস। একমাত্র খালিদ বিন সাঈদ ছাড়া সাঈদের সব ছেলেই তাদের ক্রীতদাসদের ছেড়ে দিয়েছিলেন। খালিদ বিন সাঈদ যখন তার সব ক্রীতদাসকে নবীজিকে দেন তখন নবীজি আবু রাফিকে মুক্ত করে দেন। এজন্য তিনি নিজেকে নবীজির ছেড়ে দেওয়া ক্রীতদাস বলতেন।]

“তিনি বসে পড়লেন এবং লোকজন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকলো। আবু লাহাব বললেন : বল ভাতিজা, আমাদের লোকেরা যুদ্ধে কেমন করেছে?”

আল-হারিস বললেন : “আল্লাহর কসম, শত্রুরা আমাদেরকে স্বাধীনভাবে হত্যা করেছে এবং আমাদের লোকদের বন্দী করেছে, অথচ আমরা কিছুই করতে পারিনি। এ ছাড়া, আল্লাহর কসম, আমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি তারা মানুষ ছিল না, তারা ছিল সাদা পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী একটা ভিন্ন জীব। তাদের সামনে কিছুই দাঁড়াতে পারেনি।”

একথা শুনে আবু রাফি বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম, ওগুলো ছিল ফিরিশ্তা। একথা শুনে আবু লাহাব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন এবং আমার গালে চড় মারলেন। এরপর তিনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং আমাকে প্রহার করতে লাগলেন, কারণ আমি শারিরীকভাবে অত্যন্ত দূর্বল ছিলাম। তখন আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের স্ত্রী উম্মে আল-ফাদাল[১] (যিনি ঘরের খামের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন) এসে আবু লাহাবের মাথায় আঘাত করে বলেন : “লোকটি দূর্বল এবং তার প্রভু দূরে বলেই কি আপনি তাকে মারছেন?” আল্লাহর কসম, এই ঘটনার সাত দিন পরেই তার গায়ে লাল দাগ দেখা দেয় এবং এতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।”[২]

[১. উম্মে আল-ফাদালের প্রকৃত নাম ছিল লাবাবা বিনতে আল-হারিস আল-হিলালিয়া। কথিত আছে বিবি খাদিজার পরে ইনিই ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম মহিলা। মহানবী এর বোন মাইমুনাকে বিয়ে করেন। তিনি মহানবীর বহু কথা অন্যের কাছে প্রচার করেন। অধিকাংশ সাহাবী এসব কথা তার বরাত দিয়েই বর্ণনা করেন। তিনি অত্যন্ত অমায়িক স্বভাবের মহিলা ছিলেন। তিনি ওসমানের শাসনামলে তার স্বামী আল-আব্বাসের জীবদ্দশাতেই ইন্তেকাল করেন।]

২. ইবনে কাসির তার আল-বিদায়া ওয়াল নিহায়া গ্রন্থে বলেছেন যে আবু লাহাব যখন মারা যান তখন তার ছেলেরা তাকে পরিত্যাগ ক’রে তিন দিন কাছে যায়নি, কারণ আরবের লোকেরা তখন ছোঁয়াচে বসন্ত রোগকে খুব ভয় পেত। এভাবে তার মৃতদেহ পঁচে যখন দূর্গন্ধ বের হয় তখন আশে পাশের লোকেরা বাবার মৃতদেহ ফেলে রাখার জন্য ছেলেদের ভৎসনা করতে থাকে। ছেলেরা তখন বলে যে তারা সংক্রমনকে ভয় করে। যাই হোক, তারা তার মৃত দেহকে না ধুয়ে দূর থেকে পানি ছিটিয়ে দেয় এবং মক্কা থেকে দূরবর্তী একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটা দেয়ালের পেছনে রেখে দেয়। তারপর দূর থেকেই পাথর ছুঁড়ে মেরে তাকে পাথর-চাপা দিয়ে রাখে।]

মক্কায় শোক নিষিদ্ধ

পরাজয়ের খবর যখন নিশ্চিত হলো এবং মক্কাবাসীরা যখন তাদের ক্ষয়-ক্ষতির কথা জানতে পারলো তখন দেখা গেল কুরাইশ বংশের প্রায় সব পরিবার সমানভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অবস্থায় অজ্ঞাতার যুগের মত মৃতদের জন্য শোক না করে সব রকম আনুষ্ঠানিক শোক প্রকাশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। ইসলাম চিরদিনের জন্য এই প্রথাকে রহিত করে। মক্কী নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিলেন যে নিজেদেরকে সম্বরণ করা যতই কঠিন হোক না কেন কোন পরিবারই তাদের যুদ্ধে নিহত আত্মীয়-স্বজনের জন্য কোন রকম বিলাপ করতে পারবে না। কারণ তাদের দুঃখে মুহাম্মদ এবং তাঁর সাথীরা যাতে আনন্দ করতে না পারেন তার জন্য এটা প্রয়োজন ছিল।

মক্কায় যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল ঐ নগরীর অতীত ইতিহাসে এমনটা আর কখনো দেখা যায় নি। এই শহরে এমন কোন পরিবার ছিল না বললেই চলে যারা একজন পুত্র, একজন স্বামী, একজন ভাই, বাবা কিংবা অন্য কোন নিকটজন হারায়নি। সত্যিকারের কোন কারণ ছাড়াই শুধুমাত্র আবু জেহেলের গর্ব ও ঔদ্ধত্যের কারণে যে যুদ্ধ কুরাইশদের ঘাড়ে চেপে বসেছিল সেখানে মক্কী নেতৃবৃন্দের নিজেদের সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজনও নিহত হয়েছিল। এ থেকেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা পরিমাপ করা যায়। সাফওয়ান বিন ওমাইইয়া হারিয়েছিলেন তার পিতাকে এবং ভাই আলী বিন ওমাইইয়াকে। আবু সুফিয়ানের পুত্র হামলা নিহত হয়েছিলেন এবং অন্যপুত্র আমর মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। একইভাবে আকরাম বিন আবি জেহেল হারিয়েছিলেন তার পিতাকে এবং চাচা আল-আস বিন হিশামকে। এই যুদেধ খালিদ বিন ওয়ালিদের ভাই আল-ওয়ালিদ ও নিহত হয়েছিলেন।

হৃত উটের জন্য কান্না?

মক্কাবাসীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি ছিলেন আল-আসওয়াদ বিন আল-মুত্তালিব। তিনি অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং কুরাইশদের মধ্যে গণ্যমান্য লোকদের একজন ছিলেন। এই যুদ্ধে তিনি তার তিন পুত্র জামা[১] আকিল এবং আল-হারিসকে হারিয়েছেলেন।

[১. যে পাঁচজন ভদ্র কুরাইশ নেতা মহানবী, বনু হাশিম এবং বনু মুত্তালিব গোত্রের উপর কুরাইশদের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন জামা বিন আল-আসওয়াদ বিন আল-মুত্তালিব ছিলেন তাদের মধ্যে একজন]

প্রচন্ড দুঃখে এই বৃদ্ধ তার মনের ও চিত্তের সব শান্তি হারিয়ে ফেলেন। ছেলেদের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর থেকে তিনি আর ঘুমাতে পারতেন না। তিনি চাইতেন মনকে হালকা করার জন্য মক্কী নেতারা তাকে কাঁদতে দিক। তার এহেন মানসিক অবস্থার মধ্যে একদিন রাতে তিনি একজন মহিলার উচ্চস্বরে কান্না শুনতে পান। তিনি ভাবলেন যে মক্কার নেতারা হয়তো শোক-প্রকাশের উপর তাদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন এবং তিনি এখন স্বাধীনভাবে তার ছেলেদের জন্য কাঁদতে পারবেন। নিজে অন্ধ ছিলেন বিধায় তিনি তার চাকরকে ডেকে পাঠালেন; চাকর গিয়ে দেখবে যে বদরের যুদ্ধে নিহতদের জন্য শোকের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছে কিনা এবং কুরাইশরা তাদের নিহতদের জন্য শোক করছে কিনা যাতে করে তিনিও তার ছেলে আবু হাকিমার (জামার ডাক নাম) জন্য কাঁদতে পারবেন। তিনি বললেন “আমার সমস্ত অন্তরটা দুঃখের আগুনে জ্বলছে।”

ব্যাপারটা কি জানার জন্য চাকরটা বাইরে গেল এবং ফিরে এসে বৃদ্ধকে জানালো যে শোকের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়নি এবং যে মহিলার কান্না তিনি শুনেছেন সে কাঁদছে তার একটা হারানো উটের জন্য। একথা শুনে শোকাহত বৃদ্ধ বুঝতে পারলেন যে উট হারানোর গল্পটা আসলে বানানো এবং মহিলা আসলে তার যুদ্ধে নিহত কোন আপনজনের জন্যই কাঁদছে। তিনি আর আত্ম-সম্বরন করতে পারলেন না। তিনি দুঃখের আতিশয্যে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন এবং একটি শোকের কবিতা রচনা করে ফেললেন। কবিতাটির শুরু এরকম :

“সে কি কেবল উট হারানোর জন্যই কাঁদছে?
সে কি এ দুঃখ ঘুমিয়ে ভুলতে পারে না?
বরং সে কাঁদুক, বদরে নিহতদের জন্য
যারা ছিল হতভাগা।”

বন্দীদের পণের মাধ্যমে মুক্তি

দুঃখ ও দ্বন্দ্বের প্রাথমিক প্রবাহের পর যখন আবেগ প্রশমিত হলো এবং অশান্ত পরিবেশ শান্ত হলো তখন মক্কীরা মদীনায় আটকা পড়া ৭০ জন বন্দীর কথা চিন্তা করলো। ঠিক এই সময় বন্দীদের ব্যাপারে মদীনার সুপ্রীম কাউন্সিলের সিদ্ধান্তের কথা তাদের জানিয়ে দেয়া হলো। অর্থাৎ তারা জানতে পারলো যে হয় বন্দীদেরকে মৃত্যুবরণ করতে হবে নয়তো প্রতিজনের জন্য চার হাজার দিরহাম পণ দিয়ে মুক্তিলাভকরা যাবে। বন্দীদের মুক্তি এবং মুক্তিপণ পরিশোধের ব্যাপারে তখনি মক্কা ও মদীনার প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের মুক্তি

আল-আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব (নবীজির চাচা এবং মক্কার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি) নিজেই নিজের মুক্তিপণ পরিশোধ করেন। এছাড়া তিনি তার চাচাত ভাই আকিল বিন আবি তালিব ও নওফল বিন আল-হারিস বিন আব্দুল মুত্তালিব এবং তার মিত্র উতবাহ্ বিন আমর বিন জাহ্দামের[১] জন্যও মুক্তিপন পরিশোধ করেন। প্রথমে নবীজি যখন তাকে এই তিনজনের জন্য মুক্তিপণ পরিশোধ করতে বলেন তখন তিনি টাকা নেই বলে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।

[১. আব্বাস নিজের জন্য, চাচাত ভাইদের এবং একজন মিত্রের জন্য মুক্তিপণ হিসেবে একশত অনউন্স ওজরের সোনা পরিশোধ করেন। অর্থাৎ প্রতিজনের মুক্তিপণ ছিল পঁচিশ আউন্স সোনা।]

তখন আল্লাহর নবী তাকে বলেন : “যে টাকাটা আপনি উম্মে আল-ফাদালের কাছে রেখে তাকে বলেছিলেন আপনি মরে গেলে এতটা পাবে ফাদাল এবং এতটা পাবে আব্দুল্লাহ্ সেই টাকাটা এখন কোথায়?” আব্বাস জবাব দেন : “আল্লাহর কসম,, এই টাকার কথা উম্মে আল-ফাদাল এবং আমি ছাড়া আর কেউই জানে না। আমি এখন নিশ্চিত যে তুমি প্রকৃতই আল্লাহর নবী।” এরপর তিনি তার নিজের জন্য, তার দুই চাচাত ভাই এবং একজন মিত্রের জন্য মুক্তিপণ পরিশোধ করেন।

যুদ্ধের পর আব্বাস যখন বন্দী হন তখনই মুসলমানরা তার কাছ থেকে ১৪ আউন্স সোনা পেয়ে তা তাদের জিম্মায় রেখে দিয়েছিলেন। সেজন্য মুক্তিপণ পরিশোধের সময় আব্বাস নবীজিকে অনুরোধ করেন আগের সেই ১৪ আউন্স সোনাও যেন তার মুক্তিপণের মধ্যে ধরা হয়। কিন্তু নবীজি তার অনুরোধ প্রত্যাখান করে বলেন : “না, ওটা মহান ও শক্তিশালী আল্লাহ্ আমাদেরকে দিয়েছেন”[১] (অর্থাৎ ওটা ছিল লুণ্ঠিত মাল এবং ওটা পাবার অধিকার ছিল দখলকারী মুসলমান যোদ্ধাদের)।

[১. ইবনে কাসির বলেছেন নবীজির সঙ্গে আব্বাসের নিকট সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে মুসলমানরা কোন রকম মুক্তিপণ না নিয়েই তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নবীজিকে অনুরোধ করেছিলেন কিন্তু নবীজি সে অনুরোধ রাখেননি। উপত্ত নবীজি আব্বাসকে নিজের ছাড়াও অন্যের জন্যও মুক্তিপণ পরিশোধে বাধ্য করেছিলেন।]

বন্দী স্বামীর জন্য নবী-তনয়ার মুক্তিপণ পরিশোধ

নবীজির কন্যা জয়নবের স্বামী আবুল আস বিন আল-রাবি বিন আব্দ শামসও বদরের যুদ্ধে বন্দী হন। তিনি ছিলেন নবীজির স্ত্রী বিবি খাদিজার ভগ্নি হালার পুত্র। নবীজির নবুয়ত লাভের আগেই তার সঙ্গে জয়নবের বিয়ে হয়।

নবুয়ত লাভের পর নবীজি যখন অন্যদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান জানান তখন জয়নব ইসলাম গ্রহণ করলেও আবুল আস আগের মতই বিধর্মী থেকে যান। হিযরতের আগে মক্কায় মহানবীর কোন শক্তি ছিল না বিধায় তিনি তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেননি।

আবুল-আসকে বন্দী করা হলে তার স্ত্রী জয়নব মক্কা থেকে তার মুক্তির জন্য পণ হিসেবে একটা গলার হার (যেটি তার মা খাদিজা তার বিয়েতে দিয়েছিলেন) পাঠিয়ে দেন। হারটি দেখে মহানবী এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েন যে তিনি আবুল-আসকে বিনা মুক্তিপণেই ছেড়ে দেয়ার জন্য মুসলমানদেকে অনুরোধ করেন। নবীজির অনুরোধে মুসলমানরা তাকে ছেড়ে দিয়ে হারটা তার স্ত্রীকে ফেরত দেয়ার জন্য তার হাতে দিয়ে দেন। নবীজি অবশ্য আবুল আসের কাছে প্রতিশ্রুতি আদায় করেন যে তিনি মক্কায় পৌঁছে জয়বকে মদীনায় পাঠাবেন। তিনি তার কথা রক্ষা করেন এবং জয়নবকে মদীনায় পাঠান। জয়নব মদীনায় আসলে মহানবী তাদের বিবাহ্-বিচ্ছেদ ঘটান কিন্তু আবুল আস পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে নবীজি তার সঙ্গে জয়নবের পুনর্বিবাহ দেন।

বক্তা সুহাইল বিন আমর

এই যুদ্ধে সুবিখ্যাত বক্তা, সাহসী যোদ্ধা এবং কুরাইশ বংশের অন্যতম সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সুহাইল বিন আব্দ্ শাম্‌স্‌ আল-আমরও[১] বন্দী হন। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে নামকরা বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

[১ ইনিই কুরাইশদের পক্ষে থেকে মহানবীর সঙ্গে হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পন্ন করেছিলেন। বদরের যুদ্ধে তিনি মালিক বিন আল-দাখশামের হাতে বন্দী হয়েছিলেন। মক্কা বিজয়ের পর তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ক’রে খাঁটি মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বিশেষভাবে নামায, রোযা ও যাকাতের পক্ষে ছিলেন। তিনি ইয়ামুকের যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেন। আল্লাহ্ তার আত্মাকে শান্তিতে রাখুন।]

এই কারণেই তিনি যখন নির্দ্ধারিত মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি লাভ করছিলেন তখন তার বক্তৃতা দেবার ক্ষমতা রোহিত করার লক্ষ্যে ওমর মহানবীকে তার দাঁত তুলে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মহানবী এই পরামর্শ প্রত্যাখান করে বলেছিলেন, “আমি কারো অঙ্গহানী করি না, কারণ তা করলে (আমি যদিও নবী) আল্লাহ্ আমারও অঙ্গহানী করতে পারেন।” তিনি ওমরকে সম্বোধন ক’রে আরো বলেন : “সে চলে যাক। একদিন সে আল্লাহর কথার বিরোধিতা না করে তাঁর প্রশংসাও করতে পারে।” নবীজি ঠিকই বলেছিলেন এবং তাঁর প্রত্যেকটা কথাই পরবর্তীতে সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। এতে করে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে তিনি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর নবী ছিলেন।

নবীজির মৃত্যুর পর কিছু কিছু মক্কীলোক ইসলামকে ত্যাগ করে আবার তাদের পূর্বের ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চেয়েছিল। এটি ছিল প্রকৃতপক্ষেই একটা সংকটময় মুহূর্ত যার জন্য ইসলামের শত্রুরা বহুদিন যাবৎ অপেক্ষা করছিল। কিন্তু সম্ভ্রান্ত নেতা এবং সাহসী পুরুষ সুহাইল যখন ব্যাপারটা জানতে পারলেন তখন তিনি একটা সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে তাদেরকে সম্বোধন করে বললেন : “হে মক্কাবাসী, তোমরা ইসলাম গ্রহণে সর্বশেষ আর উহা বর্জনে প্রথম হয়ো না। আল্লাহর কসম, তোমাদের মধ্যে কাউকে যদি আমাদের ধর্মদ্রোহী বলে সন্দেহ হয় তাহলে সে যেই হোক না কেন তার আমরা শিরচ্ছেদ করবো।” এভাবে সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে তিনি পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন এবং অশুভ কর্ম তৎপরতাকে অংকুরেই বিনষ্ট করেন।

নিজেদের সঙ্গেই রাগ করুন

সুহাইল বিন আমর তার সততা ও সাহসিকতার জন্য অত্যন্ত সম্মানিত হন। একদিন সুহাইল বিন আমর, আবু সুফিয়ান এবং আরো কয়েকজন সহ একদল কুরাইশ নেতা খলিফা ওমর বিন আল-খাত্তাবের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ওমর তাদেরকে উপেক্ষা করে বদরের সাথী রোমের সুহাইব এবং নিগ্রো বেলালকে ভিতরে ডাকেন। কারণ ওমর বদরের সাথীদের খুবই পছন্দ করতেন এবং খলিফা হিসেবে সব সময়ই তাদেরকে অগ্রাধিকার দিতেন।

এ দেখে আবু সুফিয়ান বললেন : “এ রকম দিন আমি কখনো দেখিনি। আমাদের এখানো অপেক্ষায় রেখে তিনি ঐ দাসদের ভিতরে ডেকেছেন। তিনি আমাদেরকে অসম্মান এবং উপেক্ষা করেছেন।” তার মুখে এরকম কথা শুনে সুহাইল বিন আমর বললেনঃ “হে লোক সকল, আমি সত্যি সত্যি আপনাদের মুখমন্ডলে রাগের ছাপ দেখছি। যদি বিরক্তই হয়ে থাকেন তাহলে নিজেদের সঙ্গেই হোন, কারণ এই লোকদের মত আপনাদেরকেও ইসলাম গ্রহণ করতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা ইহা গ্রহণ করেছিলেন আর আপনারা অপেক্ষা করেছিলেন। তিনি আরো বলেছিলেন : “ভদ্র মহোদয়গণ, এখন দেখুন তারা কিভাবে আপনাদের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছেন। যে কাজে তারা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন সেটাতে আপনারা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারেন না। একমাত্র জেহাদের মাধ্যমেই আপনারা আপনাদের অতীতের ব্যর্থতা ঘুচাতে পারেন। যান, অধ্যবসায়ের সঙ্গে আল্লাহর পথে যুদ্ধ করুন। আপনারা শাহাদৎ বরণ করে আপনাদের সম্মান ফিরে পেতে পারেন।” এরপর তিনি তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে সিরিয়ার পথে রওনা হন। একমাত্র তার কন্যা হিন্দ বাড়ীতে থাকে। তারা সিরিয়ায় যুদ্ধরত অবস্থায় সবাই শহীদ হন।

সাধারণ আরবীদের উপর যুদ্ধের প্রভাব

যে বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিলেন সেটা ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক উভয় দিক থেকে কুরাইশদের শক্তির উপর একটা মারাত্মক আঘাত। গোটা আরব দেশই মুসলমানদের এই বিস্ময়কর ও অপ্রতাশিত বিজয়ের বিপক্ষে ছিল।

ইহুদি এবং ভন্ডরা খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। মুসলমানদের বিজয়ের প্রতি তার প্রথম প্রতিক্রিয়া যাই হোক না কেন, এরপর তারা সমস্ত পৌত্তলিক শক্তিকে একত্রিত করে সংঘবদ্ধভাবে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার প্রয়াস পেলেন। কারণ একচ্ছত্র শক্তি হিসেবে তারা কোনভাবেই মুসলমানদেরকে মেনে নিতে পারছিলেন না। মুসলমানরা আরো সাফল্য লাভ করে সারাদেশে আরো ক্ষমতা ও প্রভাব বাড়াবেন এটা ঠেকানোর জন্য তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে পড়লেন।

তবে কিভাবে মুসলমানদের অগ্রগতি প্রতিহত করা যাবে এনিয়ে তাদের মধ্যে প্রবল মতবিরোধ দেখা দেয়। তারা বিভিন্ন জন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন ক’রে মুসলমানদের ঐক্য ও শক্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টায় লিপ্ত হন।

পরাজয়োত্তর মক্কা

যুদ্ধে নিহতদের জন্য কোন আনুষ্ঠানিক শোক পালন না করতে দিলেও কিংবা মক্কাবাসীদের গর্ব ভীষণভাবে চূর্ন হলেও তারা কিন্তু চুপ ক’রে বসে থাকেনি। পরাজয়ের প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠেই তারা সভা ডেকে আলোচনা করে কিভাবে তাদের পরাজয়ের অপমানটা মুছে ফেলা যায় এবং মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নেয়া যায়। পরাজয়ের ফলে মহানবীর প্রতি ঘৃণা তাদের আরো বেড়ে যায়।

তারা তাদের শক্তিকে আরো সুদৃঢ় করার প্রস্ততি নেয় এবং এর ফলশ্রুতিতেই পরবর্তীতের ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই পরাজয়ের আরো একটা প্রভাব ছিল এই যে মক্কায় অবস্থানকারী দূর্বল মুসলমানরা কুরাইশদের উন্মত্ততার শিকারে পরিনত হয়। কুরাইশদের অত্যাচারে তারা একটা শোচনীয় অবস্থায় পতিত হয়। নগরীর শক্তিশালী পৌত্তলিকরা দূর্বল মুসলমানদের উপর নানা রকম অমানুষিক অত্যাচার চালায়।

মদীনার পরিস্থিতি

মদীনার অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজয়ের পর মুসলমানরাই ছিলেন এই এলাকার একমাত্র প্রভাবশালী শক্তি। এ কারণে অনেক অমুসলমানও ইসলামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেন, কিন্তু মনে মনে তারা ইসলামের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।

ভন্ডদের নেতা আব্দুল্লাহ্ বিন উব্বাই বিন সালুল এবং তার সঙ্গীরাই সর্ব প্রথম ইসলামে বিশ্বাস করেন। কারণ বদরে মুসলমানদের বিজয়ের পর আব্দুল্লাহ্ বিন সালুল বুঝতে পারেন যে তিনি আর প্রকাশ্যভাবে মুসলমানদের বিরোধিতা করতে পারবেন না। এজন্য তিনি তার বন্ধুদেরকে ইসলাম গ্রহণের পরামর্শ দেন এবং তার পরামর্শ অনুসারে তারা সবাই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন।

কিন্তু আপাতঃ দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রহণ করলেও তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতেই থাকেন। মহানবী এবং তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে লড়াইয়ের অস্ত্র হিসেবে তারা ষড়যন্ত্র আর প্রতারণার আশ্রয় নেন এবং সব সময় সুযোগ খুঁজতে থাকেন কিভাবে মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরানো যায়। তাদের ষড়যন্ত্রের বিবরণ বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে পবিত্র কুরআন এবং ইসলামের ইতিহাসে।

যুদ্ধের পর ইহুদিরা

উপরে আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে মদীনায় বসবাসকারী ইহুদি এবং পৌত্তলিকদের একটা ক্ষুদ্র অংশ (যারা বদরের যুদ্ধের পর আপাতঃ দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং খোলাখুলিভাবে ইসলামের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন) ছাড়া অবশিষ্ট ইহুদি এবং পৌত্তলিকগণ স্বাধীনভাবে তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করেন। মহানবী ইসলাম গ্রহণের জন্য তাদের উপর কখনোই বল প্রয়োগ করেননি, কারণ ইসলাম ধর্মীয় ব্যাপারে কোন রকম বাধ্যবাধকতা কিংবা জুলুম সমর্থন করে না।

মহানবীর সঙ্গে ইহুদিদের চুক্তি

মহানবী মদীনায় পৌঁছেই ইহুদিদের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। এই চুক্তির সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল এই যে বাইরের কেউ তাদের কাউকে আক্রমণ করলে ইহুদি এবং মুসলমানগণ পরস্পরকে সাহায্য করবেন। মুসলমানরা অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে এই চুক্তি মেনে চলেন এবং আরবীয় উপদ্বীপ থেকে কখনোই ইহুদিদেরকে বহিস্কার করতে চাননি কিংবা চেষ্টা করেননি, যদিও বদরের যুদ্ধের পর এটা তারা সহজেই করতে পারতেন। এর কারণ ছিল এই যে মুসলমানরা সব সময়ই ইহুদিদেরকে তাদের স্বভাবিক মিত্র বলে মনে করতেন এবং প্রত্যাশা করতেন যে ইহুদিরা পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে একেশ্বর বাদের ধারণাকে সব সময়ই সমর্থন করবেন। মুসলমানরা এটাও প্রত্যাশ করতেন যে পুরাতন কেতাবের অনুসারী হিসেবে ইহুদিরা অশিক্ষিত আরবদের সামনে আল্লাহর বাণী এবং তাঁর নবীর সত্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবেন এবং পরকালে মুক্তির লক্ষ্যে নবীজির প্রতি তাদেরকে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলবেন। মুসলমানদের প্রত্যাশার ভিত্তি ছিল কুরআনের এই আয়াতটিঃ

অথাৎ আল্লাহ্ যখন তোমাকে স্বপ্নে সেসব কাফেরের পরিমাণ অল্প করে দেখালেন; বেশী করে দেখালে তোমরা কাপুরুষতা অবলম্বন করতে এবং কাজের বেলায় বিপদ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ্ বাঁচিয়ে দিয়েছেন। তিনি অতি উত্তমভাবেই জানেন; যা কিছু অন্তরে রয়েছে। (xiii ৪৩)

ইহুদিদের চুক্তি লঙ্ঘন

কিন্তু কা’ব বিন আল-আশরাফ আল-নাভানির[১] নেতৃত্বে ইহুদিরা মহানবীর সঙ্গে সম্পাদিত তাদের চুক্তি লঙ্ঘন করেন। তারা খোলাখুলি ভাবে ইসলামের বিরুদ্ধাচারণ করেন এবং নিজেদেরকে সম্পূর্নভাবে মুসলমানদের শত্রুদের (যারা সম্প্রতি বদরে পরাজিত হয়েছিল) সঙ্গে সম্পৃক্তকরেন। তাদের সমস্ত সহানুভূতি ছিল পৌত্তলিক মক্কীদের প্রতি।

[১. কা’ব বিন আল-আশবাফ আল-তাঈ ছিলেন বনি নাভান গোত্রের লোক, যদিও তার মা ছিলেন বনি নাদির গোত্রের। জাহিলিয়া যুগের কবি হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন তার লোকদের মোড়ল। বাস করতেন মদীনার কাছে একটা দুর্গে। এই দূর্গের ধ্বংশাবশেষ আজও রয়েছে। তিনি তার দূর্গের বাইরে ৩ হিজরিতে নিহত হয়েছিলেন।]

এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে তারা মহানবী ও ইসলামকে হেনস্ত করার জন্য পৌত্তলিক আরবদের (বিশেষ করে মক্কীদের) উদ্বুদ্ধ করেন এবং এ লক্ষ্যে তাদেরকে সব রকম সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন। উপরন্ত তারা তাদের বন্ধুদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে মদীনার মুসলমানদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য মক্কায় পাচার করতেন। এভাবে মহানবী ও মুসলমানদের কাছে তারা যে সব অঙ্গীকার ও চুক্তি করেছিলেন সেগুলোর সবগুলোকেই তারা পদদলিত করেন।

বদরে মুসলমানদের বিজয়ে মুসলমানদের প্রতি তাদের ঘৃণার মাত্রা আরো বেড়ে যায় এবং মহানবী ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র আরো সক্রিয় হয়। অনেক ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়ে পড়ে এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ইহুদিরা মুসলমানদের পেছনে থাকে।

কিন্ত এতকিছু সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের এই বিশ্বাসঘাতক মিত্রদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কিন্ত এক সময় তাদের মধ্যেকার ব্যবধান খুব বেড়ে যায় এবং মুসলমানদের সঙ্গে ইহুদি সম্প্রদায়ের উপর্যুপরি অসদারণের ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে। অবশেষে তাদের একটা অংশকে হত্যা করা হয় এবং মদীনাকে তাদের ষড়যন্ত্রের কবল থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তাদের আরেকটি অংশকে বহিষ্কার করা হয়। মদীনায় তাদের প্রধান গোত্র ছিল বনি কুরাইযা, বনি কাইকা এবং বনি আল-নাদির। এদের সকলকেই তাদের অপকর্মের শাস্তি পেতে হয়েছিল। আল্লাহ্ চায় তো, ইসলাম ও মহানবীর বিরুদ্ধে এই সব গোত্রের ভূমিকা আমরা বিস্তারিত ভাবে আমাদের পরবর্তী ওহুদের এবং আল-আহযাবের যুদ্ধ সম্পর্কিত বইতে বনর্না করবো।

বেদুইন আরবদের প্রতিক্রিয়া

মদীনার আশেপাশে বসতি স্থাপনকারী বেদুইনদের জন্যও মুসলমানদের বিজয়ের সংবাদ অত্যন্ত তাৎপর্য পূর্ণ ছিল। তারা এই ভয়ে ভীত ও বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে মদীনার নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামী শক্তি তাদেরকে আর দলে দলে লুঠতরাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে দেবেনা।

,

এটাই ছিল তাদের উদ্বিগ্নতার একমাত্র কারণ। অন্যথায় ইসলামের সঙ্গে পৌত্তলিকতার সংঘর্ষে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। তারা শুধু ঐ এলাকায় স্বাধীনভাবে চলতে চাইত। মক্কার লোকেরা যেখানে নিজেদেরকে পৌত্তলিকতার রক্ষক এবং কা’বাঘরের পুরোহিত তথা আরবের আধ্যাত্মিক নেতা ভাবতেন সেখানে বেদুইনদের এ ধরনের কোন রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় উচ্চাভিলাষ ছিল না। তারা ক্রমবর্ধমান মুসলমান প্রভাব প্রতিপত্তিকে শুধু এজন্য ভয় করতো যে এতে তাদের আক্রমণাত্মক কার্যক্রম সীমিত হয়ে পড়বে।

পক্ষান্তরে কুরাইশরা ইসলামকে এমন একটা প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি ভাবতো যা শুরু থেকেই তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবকে বিনষ্ট করেছিল। এবং এজন্যই ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের চরম শত্রুতা।

সংকটাপন্ন মুসলমান সম্প্রদায়

এ কারণেই বদরের যুদ্ধে বিজয়ের পর মহানবী ও মুসলমানদের চারদিকে বিপদ ঘনিয়ে আসে।

এই বিজয়ের ফলে মদীনায় তাদের কেন্দ্রীয় অবস্থান সুদৃঢ় হয় এবং নগরীর আশে পাশে বসবাসকারী গোত্রদের মধ্যে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ভীষণভাবে বেড়ে যায়। কিন্তু অন্যদিকে তারা আবার বিপদের সম্মুখীনও হয়। তাদের বিজয়ে যে শত্রুরা হতবাক হয়ে পড়েছিল তারাই আবার নতুন করে তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইহুদি এবং ভন্ডরা খোলাখুলিভাবেই তাদেরকে খোঁচাতে থাকে, কারণ উভয়ই বুঝতে পারে যে ইসলামের শক্তির কাছে তাদের শক্তি ও প্রতিপত্তি ভয়ানকভাবে হুমকির সম্মুখীন।

নবীজিকে হত্যার ষড়যন্ত্র

মুসলমানদের শুধুমাত্র মদীনার শত্রুরাই তাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল না, একই সঙ্গে মক্কার শত্রুরাও রাগে গড় গড় করছিল। মক্কার লোকেরা একটা ভয়াবহ অবস্থান গ্রহণ করেছিল এবং পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য ইতিমধ্যেই তারা তাদের শক্তিকে সংগঠিত করার আদেশ জারী করেছিল। তখনকার আদেশ ছিল; “মুহাম্মদকে তার বাড়ীতেই আক্রমণ কর।”

এছাড়া, তাদের রাগ ও ঘৃণা এতই চরমে উঠেছিল যে তারা মুহাম্মদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটা সহজ পন্থাও ভেবেছিল। এটি ছিল মহানবীর জীবন-নাশের চক্রান্ত। বদরে পরাজয়ের পর এটাই ছিল মক্কীদের এ ধরনের প্রথম প্রচেষ্টা।

হত্যাকারী

নবীজিকে হত্যা করার জন্য তাঁর এবং ইসলামের সবচেয়ে ঘোরতর শত্রু ওমাইর বিন ওয়াহাব আল-জামহি (যার পুত্র ওয়াহাব বদরে বন্দী হয়েছিল) কে নির্বাচন করা হয়। ছেলের বন্দীত্বই তাকে নবীজির ঘোরতর শত্রুতে পরিণত করেছিল।

তিনি মদীনায় রওনা হওয়ার প্রাক্কালে কতিপয় কুরাইশ নেতা (যাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সাফওয়ান বিন ওমাইয়া) তাকে কথা দেন যে তিনি নবীকে হত্যা করতে পারলে তারা তার সব ঋণ পরিশোধ করবেন এবং তিনি নিজে নিহত হলে তারা তার পরিবারের দেখাশুনা করবেন। এটি ছিল অত্যন্ত ভয়ানক একটি চক্রান্ত কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার মহিমায় মুসলমানরা রক্ষা পেয়েছিলেন।

মদীনায় যখন কোন মক্কী পৌত্তলিকের উপস্থিতি কোন রকম সন্দেহের উদ্রেক করবে না এমন একটা সময়কেই তারা বেছে নিয়েছিল। কারণ বন্দীদের মুক্তিপণ পরিশোধের কাজে ঐ সময় মদীনায় অনেক মক্কী প্রতিনিধির যাতায়াত ছিল। উপরন্ত অন্যান্যদের মত হত্যাকারী ওমাইর বিন ওয়াহাব তার ছেলেকে[১] মুক্ত করার জন্যও মদীনায় এসেছিলেন।

[১. তার পুত্র ওয়াহাব পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি মিশরে আমর বিন আল-আসের অধীনে মুসলমান বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং ২৩ হিজরিতে এমোরিয়া দখনকারী সমুদ্র অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তিনি সিরিয়ায় মৃত্যু বরণ করেন।]

এভাবেই ষড়যন্ত্র হয় যে ওমাইর বিন ওয়াহাব তার ছেলেকে মুক্ত করে মক্কায় ফিরিয়ে আনার অজুহাতে মদীনায় যাবেন এবং সেখানে গিয়ে মহানবীকে হত্যা করবেন। এর বিনিময়ে সাফওয়ান বিন ওমাইয়া তার সমস্ত টাকা পরিশোধ করবেন এবং আজীবন তার পরিবারের দেখাশুনা করবেন।

ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত

আপাতঃদৃষ্টিতে ওমাইর বিন ওয়াহাব মদীনায় আসলেন মুক্তিপণ পরিশোধ করে তার ছেলেকে মুক্ত করার জন্য।

ওমর বিন আল-খাত্তাবই সর্ব প্রথম তাঁর বৈশিষ্টসূচক ধূর্ততা এবং বুদ্ধি বলে ওমাইর বিন ওয়াহাবের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেন। মসজিদের কাছে দাঁড়িয়ে কয়েকজন মুসলমান যখন বদরের যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিলেন তখনই ওমর দেখতে পান যে মসজিদের দরজায় এসে কোমরে একটা তরবারি গোঁজা অবস্থায় ওমাইর বিন ওয়াহাব তার উটের পিঠ থেকে নামছেন। ওমর তার কু-অভিসন্ধি বুঝতে পেরে তার দিকে ইশারা করে তাঁর বন্ধুদের বললেনঃ “এ হচ্ছে আল্লাহর শত্রু ওমাইর বিন ওয়াহাব। নিশ্চয়ই সে কোন কুমতলব নিয়ে এখানে এসেছে। সে বদরে আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং আমাদের শত্রুদের সাহায্য করেছিল।”[২]

[২. ওমাইর ছিলেন বদরের যুদ্ধে মক্কী বাহিনীতে গোয়েন্দা দলের নেতা। তিনি মদীনার বাহিনীকে তিন শত যোদ্ধা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।]

ওমর তক্ষুণি মসজিদের ভিতরে গিয়ে নবীজিকে বলেন : “হে আল্লাহর নবী, আল্লাহর শত্রু ওমাইর বিন ওয়াহাব এখানে এসেছে একটা তরবারি নিয়ে।” নবীজি তাকে ভিতরে ডাকতে বলেন।

এই জঘন্য লোকের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন

নবীজির নির্দেশে ওমর বিন খাত্তাব বাইরে আসলেন ওমাইর বিন ওয়াহাবকে নবীজির কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আগেই তিনি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে ওমাইরের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য তাঁর সঙ্গীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ “তোমরা সবাই নবীজির কাছে গিয়ে তাঁর পাশে বসবে এবং এই জঘন্য লোকটির জন্য তাঁকে পাহারা দিবে। কু-অভিসন্ধি ছাড়া সে এখানে আসেনি।” এরপর ওমাইরের তরবারিটি ধরে তিনি তাকে নবীজির কাছে নিয়ে যান। নবীজি তার মুক্তির আদেশ দিয়ে বলেন : “ওমাইর, আরো কাছে আস।”

ওমাইর কাছে গিয়ে বললেনঃ “মুহাম্মদ, আমি আপনার জন্য একটা সুপ্রভাত কামনা করছি।” (এভাবেই আরবীয়রা অজ্ঞতার যুগে পরস্পরকে অভিবাদন জানাত।)

মহানবী জবাব দিলেন : “ওমাইর, আল্লাহ্ আমাদেরকে তোমাদের অভিবাদনের চেয়ে অনেক বেশী ভাল একটা অভিবাদন শিখিয়েছেন- বেহেস্তের লোকদের অভিবাদন।”

হত্যাকারীর ইসলাম গ্রহণ

এরপর নবীজি তাকে বললেনঃ “তুমি এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছ, ওমাইর?” ওমাইর বললেন : “আমি এসেছি আমার বন্দী ছেলের ব্যাপারে এবং আমার অনুরোধ আপনি আমার প্রতি সদয় হবেন।

“তোমার কাছে তরবারি কেন?”

“আমাদের কাছে আগে এই তরবারিগুলি মূল্য কি ছিল?”

“সত্য কথা বল। তুমি কেন এসেছ এখানে?”

“আমার আসার উদ্দেশ্য আমি আপনাকে জানিয়েছি। আমি সেজন্যই এসেছি।”

এ কথা শুনে নবীজি বললেনঃ “কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে এই যে একদিন তুমি সাফওয়ান বিন ওমাইয়ার সঙ্গে কা’বা ঘরে বসে বদরের যুদ্ধে নিহত কুরাইশ নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে কথা বলছিলে। কথার মধ্যে তুমি সাফওয়ানকে বলেছিলে যে তুমি মদীনায় এসে আমাকে হত্যা করবে। কিন্তু অন্যের কাছে তোমার ঋণ থাকায় এবং তোমার পরিবারকে দেখাশুনা করতে হয় বিধায় তুমি তা পারছিলে না। এতে সাফওয়ান তোমাকে কথা দেয় যে আমাকে হত্যা করতে এসে তুমি নিহত হলে সেই তোমার সব ঋণ পরিশোধ করবে এবং তোমার পরিবারের দেখাশুনা করবে। এরপর তোমার উদ্দেশ্য এবং আমার মধ্যে আল্লাহ্ হস্তক্ষেপ করেছেন।”

ওমাইর বলে উঠলেন : “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনিই আল্লাহর সত্যিকারের দূত। হে আল্লাহর দূত! আমরা আপনাকে এবং সত্যকে অস্বীকার করেছিলাম যা আপনি আমাদের জন্য এনেছেন। কিন্তু সত্যি সত্যি আমাদের এই আলোচনা সম্পর্কে সাফওয়ান এবং আমি ছাড়া আর কেউ জানতো না।”

তিনি আরো বললেন : “ আল্লাহর কসম, আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে আপনি আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কাছ থেকে এই তথ্য পাননি। প্ৰশংসা সেই আল্লাহর যিনি আমাকে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছেন।”

একথা শুনে নবীজি মুসলমানদের বললেন : “আপনাদের এই নতুন ভাইকে তার নতুন ধর্ম ও কুরআন সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে তার ছেলেকে মুক্ত করে দিন।”[১] নবীজির নির্দেশগুলো তখন পরিপূর্ণভাবে পালন করা হলো। তাকে ইসলাম ও কুরআন সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হলো এবং তার বন্দী ছেলেকে ছেড়ে দেয়া হলো। এবং এভাবেই নবীজির জীবনের বিরুদ্ধে জঘন্য চক্রান্তটি শেষ হলো এবং নবীজিকে হত্যা করার সংবাদ নিয়ে মক্কায় ফেরার পরিবর্তে তিনি সেখানে ফিরলেন একজন মুসলমান হিসেবে এবং সমগ্র মক্কাকে ইসলামে দীক্ষিত করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। শীঘ্রই তার ধর্মান্তরের কথা দাবানলের মত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। তিনি অত্যন্ত সাহসী লোক ছিলেন বিধায় কেউ তাকে কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না। তিনি খোলাখুলিভাবে মক্কা নগরীতে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করলেন বদরের যুদ্ধের পর যে কাজটা ছিল সত্যি খুব বিপজ্জনক।

[১. আল-বিদায়া ওয়াল নিহায়া, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৩১৪।]

ইবনে কাসির বলেছেন : “ওমাইর ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচারক হিসেবে তাকে মক্কায় যেতে দেওয়ার জন্য মহানবীর অনুমতি প্রার্থনা করেন এই বলে :

“হে আল্লাহর দূত! আমি এতদিন মুসলমানদের ঘোরতর শত্রু ছিলাম এবং আল্লাহর আলোকে নিভিয়ে দেওয়ার জন্য কঠোর চেষ্টা করেছি। অতএব এখন আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আল্লাহ্, তাঁর নবী এবং ইসলামের পথে তাদেরকে আহবান জানানের জন্য আপনি আমাকে মক্কায় যেতে দিন, কারণ আল্লাহ্ তাদেরকে সত্যের পথে আনতে পারেন। নতুবা আপনার সঙ্গীদের যেমন আমি ইসলাম গ্রহণের জন্য বিদ্রূপ করতাম এখন তাদেরকেও আমি অনুরূপভাবেই বিদ্রূপ করবো।”

মহানবী তাকে মক্কায় ফেরার অনুমতি দেন যেখানে তার দোসর সাফওয়ান তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন এবং মক্কায় প্রত্যাবর্তনকারী প্রত্যেক অশ্বারোহীকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। কিন্তু সাফওয়ানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি যখন তার নতুন ধর্ম বিশ্বাসের কথা বললেন তখন তিনি প্রচন্ডভাবে রেগে গেলেন এবং শপথ করে বললেন যে তিনি আর তার সঙ্গে কোন কথা বলবেন না। এবং ভবিষ্যতে তাকে কোন রকম সাহায্যও করবেন না।

ইবনে ইসহাকের মতে, মক্কাতে পৌঁছেই ওমাইর প্রকাশ্যভাবে মক্কাবাসীদের মধ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন এবং যারা তার বিরোধিতা করেন তাদের প্রতি চরম কঠোরতা প্রদর্শন করেন। এভাবে তিনি বহু সংখ্যক মক্কাবাসীকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন।

আর, সংক্ষেপে বলতে গেলে, এভাবেই বদরের যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধ তখনকার রাজনৈতিক আধ্যাত্মিক, সামরিক এবং সামাজিক পেক্ষাপটকে এমনভাবে মুসলমানদের পক্ষে নিয়ে আসে যে এতে করে তারা সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং বিশেষ করে ইয়ারব এলাকায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। উপরন্ত, এ যুদ্ধের ফলে আরব দেশে কুরাইশদের দূর্জয় রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির অবসান ঘটে।

একটি আরোপিত যুদ্ধ

এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে এই যুদ্ধটা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধ তারা করতেও চাননি কিংবা এর জন্য তারা প্রস্তুতও ছিলেন না, কিন্তু প্রতিপক্ষের চাপে এতে অংশ নেয়াটা তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।

মুসলমানরা সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারী একটি কাফেলা দখলের লক্ষ্যে মদীনা থেকে বের হয়েছিলেন। এই কাফেলায় ছিল মাত্র চল্লিশজন সশস্ত্র লোক। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই কাফেলাটি দখলের জন্য মুসলমানদের যা ছিল তদপেক্ষা বেশী সংখ্যক লোক কিংবা অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না।

উপরন্ত, মুসলমানরা বিশেষ করে তাদের মধ্যে মুহাজিরিনরা ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র। তাদের যা কিছুই ছিল মদীনায় অভিপ্রয়ানের প্রাক্কালে পৌত্তলিক মক্কাবাসী তা বাজেয়াপ্ত করেছিল। এজন্যই মুহাজিরিনগণ কুরাইশদের এই বিশাল কাফেলাটি (যাতে ছিল বিভিন্ন পশরা বহনকারী এক সহস্র উট) দখল করার ব্যাপারে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন।

এ সময় মুসলমানদের অবস্থা যে খুব গরীব ও কষ্টকর ছিল তা বদরে মহানবীর একটা প্রার্থনা থেকেই পরিষ্কার বুঝা যায়। যখন তিনি দেখলেন যে কুরাইশদের কাফেলাটি পালিয়ে গেছে তখন তিনি কায়মনবাক্যে প্রার্থনা করেন :

“হে আল্লাহ্, মুসলমানরা খুব ক্ষুধার্ত, তাদেরকে তুমি খেতে দাও। হে আল্লাহ্, তাদের পা নগ্ন, অতএব তাদেরকে বাহন দাও। হে আল্লাহ্, তারা উলঙ্গ, অতএব তাদেরকে বস্ত্র দাও।[১] এ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে মুসলমানরা শুধু কাফেলাটি দখল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। কাফেলার পরিবর্তে তারা সম্মুখীন হয়েছিলেন বিশাল এবং শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনীর। তদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল তরবারি হাতে এক হাজার শক্তিশালী কুরাইশ তরুণ। এদের মৃত্যুভয় ছিল না। সুদক্ষ সেনাপতিদের নির্দেশে তারা যে কোন সময় মুসলমানদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। এহেন পরিস্থিতিতে এই বিশাল শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া ছাড়া মুসলমানদের আর কোন বিকল্প ছিল না।

[১. ফিক আল-সিরাহ্, পৃঃ ১৮০।]

মুসলমানদের এই মানসিক অবস্থাই আল্লাহ্ কুরআনে এভাবে তুলে ধরেছেনঃ

অর্থঃ তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে স্বীয় পরওয়ারদেগারের নিকট, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরী দান করলেন যে, আমি তোমাদিগকে সাহায্য করব ধারাবাহিকভাবে আগত হাজার ফেরেশতার মাধ্যমে।। (viii: 9)

মুসলমানদের নজর ছিল সহজ-লভ্য কাফেলার প্রতি। পক্ষান্তরে, আল্লাহ্ চেয়েছিলেন সত্য ও মিথ্যার শক্তির মধ্যে একটা চূড়ান্ত যুদ্ধ যাতে করে সত্য টিকে থাকে এবং মিথ্যা ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দীত্ব ও মৃত্যু বরণের মাধ্যমে অবিশ্বাসীদের বিতাড়িত করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন ক’রে তাদেরকে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত করতে চেয়েছিলেন এবং সেই সাথে এটাও চেয়েছিলেন যে মুসলমানরা শুধুমাত্র ভাগ্য এবং অন্যের দয়ার উপর নির্ভর না ক’রে তারা বরং কঠিন সংগ্রাম ও জেহাদের মাধ্যমে ইসলামকে সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত করবে। শুধুমাত্র একটা কাফেলা দখল করে এই উদ্দেশ্যকে সফল করা যেত না।

আল্লাহর ইচ্ছা ছিল এরকম যে মুসলমানরা একটা জাতি, একটা রাষ্ট্র, একটা সরকার এবং একটা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। এবং এই উদ্দেশ্যে তিনি তাদের প্রকৃত শক্তিকে তাদের শত্রুদের শক্তির সঙ্গে যাচাই করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে মুসলমানরা তাদের শত্রুদের পরাজিত ক’রে এই রহস্য উৎঘাটন করবে যে প্রকৃত শক্তি মানুষের কিংবা মানুষের সহায়-সম্পত্তিতে নয় বরং সর্ব্বোচ্চ শক্তি আল্লাহর সঙ্গে মানবাত্মা সম্মিলনে। তিনি এই শিক্ষাটিকে একটা শূন্যগর্ভ কথামালা থেকে একটা বাস্তব অভিজ্ঞতায় পরিনত করতে চেয়েছিলেন।

আল্লাহর ইচ্ছা চিল এই আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থাও নির্দ্ধারণ করবে। এটা তাদেরকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিতে যে সংখ্যায় এবং সম্পত্তিতে দূর্বল হয়েও তারা তাদের প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারেন। এজন্যই বিশ্বাস এবং অবিশ্বাসের শক্তির মধ্যে একট সশস্ত্র সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল, কারণ অন্য কিছুতেই মুসলমানদের কাছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এত কার্যকরভাবে প্রতিভাত হতো না।

পূর্ব ঘটনার জের হিসেবে আজও আমরা বুঝতে পারি কিভাবে আল্লাহ্ মুসলমানদেকে এই যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিলেন। তারা চেয়েছিলেন একটা কিন্তু আল্লাহ্ চেয়েছিলেন অন্যটা এবং তাদের মূল পরিকল্পনা অপেক্ষা আল্লাহ্ পরিকল্পনাটাই তাদের জন্য অধিকতর ফলপ্রসূ ছিল।

এতে দেখা যায় মানুষ কিভাবে নিজেদেরই নিজেদের ভাগ্য-বিধাতা ভেবে ভুল করে। তারা ভাবে না যে আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তারা কোন কিছুই লাভ করতে পারেনা। মানুষ ভুলক্রমে কোন জিনিসকে বিপজ্জনক ভাবতে পারে, পক্ষান্তরে আল্লাহ্ তার মধ্যেই মানুষের জন্য এমন কল্যাণ লুকিয়ে রাখতে পারেন যা তারা কল্পনাই করতে পারে না।

মুসলমানরা যদি তাদের মূল পরিকল্পনা অনুসারে এগুতো এবং সেখানে যদি তাদের নেতৃত্বে আল্লাহ্ এগিয়ে না আসতেন তাহলে যে বদরের যুদ্ধ তাদের ইতিহাসের ধারাকেই পরিবর্তন করে দিয়েছিল সেই বদরের যুদ্ধ আর অনুষ্ঠিত হতো না। যা হতো তা ছিল একটা কাফেলা দখলের মত সামান্য ঘটনা মাত্ৰ।

বদরের যুদ্ধ মানুষের ইতিহাসে অসত্যের উপর সত্যের চুড়ান্ত বিজয়ের প্রতীক। সংখ্যা ও সম্পদে দূর্বল হয়েও সত্য কিভাবে সশস্ত্র ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে এটা হচ্ছে তারই গল্প। এতে প্রতীয়মান হয়েছে কিভাবে আল্লাহর সঙ্গে তাদের আত্মার সম্মিলন ঘটিয়ে এবং নিজেদের দূর্বলতা কাটিয়ে ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে একটা জাতি তাদের প্রতিপক্ষকে পরাজিত করতে পারে। এতে পরিলক্ষিত হয়েছে, কিভাবে যারা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ এবং দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করে তারা বিজয় লাভ করে। সর্বোপরি, এই যুদ্ধে দেখা গেছে আপাতঃদৃষ্টিতে মিথ্যার বিজয়ের মুখে বিজয় কিভাবে সত্যের পক্ষে চলে এসেছে।

এভাবে বদরের যুদ্ধের সার্বিক কারণ, ঘটনাবলী এবং পটভূমির মধ্যে মানবজাতির জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিহিত আছে। এতে বিধৃত হয়েছে সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রকৃত শর্তাবলী।এটা হচ্ছে এমনই একটা খোলা পুস্তক যা কিনা সব দেশের সবকালের মানুষরাই চিরকাল পড়তে পারবে। এর বিষয়বস্তুর কোন পরিবর্তন হবে না, কারণ এতে উপস্থাপিত হয়েছে আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কিত তাঁর নমুনা এবং অলঙঘনীয় আইন[১]।

১. ফিদিলাল-ইল-কুরআন, ৯ম খন্ড, পৃঃ ৮৩

মুসলমানদের বিজয়ের পিছনে বস্তুগত কারণসমূহ

বদরের যুদ্ধে যে দু’টি দল অংশগ্রহণ করেছিল তাদের নিজ নিজ শক্তি, প্রস্তুতি এবং সম্পদের বিবেচনায় কোন রকম বিতর্কের অবকাশ নেই যে তারা কোনভাবেই পরস্পরের সমকক্ষ ছিল না।

এক হাজার শক্তিশালী লোকের সমন্বয়ে গঠিত মক্কীবাহিনী যেখানে যুদ্ধের জন্য সুসজ্জিত হয়ে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মক্কা ত্যাগ করেছিল সেখানে মদীনার বাহিনীতে ছির মাত্র তিনশত লোক এবং যুদ্ধের জন্য তাদের কোন রকম প্রস্তুতিও ছিল না। এমন কি এমন একটা ভয়াবহ যুদ্ধে যে তাদের জড়িয়ে পড়তে হবে সেটাও তাদের জানা ছিল না।

তাহলে প্রশ্ন উঠে, যুদ্ধ জয়ের জন্য সচরাচর যে সব প্রস্তুতি আবশ্যক সেগুলো ছাড়াই মুসলমানরা মূলতঃ কি কি কারণে এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন।

কারণগুলোর সারসংক্ষেপ

এই যুদ্ধের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে আমরা ঐশ্বরিক সহযোগিতার বাইরে যে সব বস্তুগত কারণে মুসলমানরা বিজয়ী হয়েছিলেন সেগুলোকে সংক্ষেপে এভাবে পেশ করতে পারি:-

(১) মক্কী বাহিনীতে উৎসাহের অভাব

কুরাইশরা জানতো যে মহানবী এবং তাঁর সাহাবীরা তাদের বিশাল কাফেলা দখল করতে পারলে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। এজন্য নিজেদের কাফেলা এবং রক্ষার লক্ষ্যে এই বাহিনী প্রবল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু তারা যখন জানতে পারে যে তাদের কাফেলা বিপদমুক্ত তখন তারা যুদ্ধের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। বিশেষ করে তাদের সেনাপতিদের অনেকেই যখন যুদ্ধের প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন তখন অধিকাংশ সৈন্যই মুসলমানদের সঙ্গে আর যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায় না। রাবিগে আল-আখনাস বিন শারাক এবং বদরে উৎবা বিন রাবিয়া প্রকাশ্যভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা করেন এবং কাফেলা বিপদমুক্ত হওয়ার পর তাদের সেনাবাহিনীকে মক্কায় ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

আবু জেহেল যখন আল-আখনাস বিন শারাখ আল-থাকাফির পরামর্শ শুনলেন না তখন তিনি তার বনি জাহরার মিত্রদের সাথে নিয়ে মক্কী বাহিনী ত্যাগ করে রাবিগ থেকে মক্কায় ফিরে যান। আবার বদরেও উৎবা বিন রাবিয়া এবং আরো কয়েকজন মক্কী নেতা জনসমক্ষে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলেন।[১] কিন্তু উদ্ধত ও অহংকারী মক্কী নেতারা তাদের সুপরামর্শে কান দেননি।

[১. এ সময় যুদ্ধের বিরোধিতা করে উত্ত্বাহ্ বলেছিলেন : “ হে কুরাইশ বংশের লোকসকল, আল্লাহর কসম, তোমরা যদি মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের ক্ষতি কর তাহলে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে চিরন্তন ঘৃণা বোধের সৃষ্টি হবে, কারণ পরবর্তীতে তোমরা প্রত্যেকেই দেখতে পাবে তোমাদের সামনে লোকেরা তাদের নিজেদের ভাইদেরকেই হত্যা করছে।”]

এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় যে মক্কী বাহিনীর লোকদের (অন্ততঃ তাদের একটা বৃহৎ অংশের) মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপারে আর আগ্রহ ছিল না। আধুনিক সমর বিজ্ঞান অনুসারে এই উৎসাহ হীনতাই মক্কী সেনাবাহিনীর পরাজয়ের একটা বড় কারণ ছিল।

২. আগ্রাসন

এ কথা সত্য যে মানবজাতি কখনোই যুদ্ধকে সমর্থন করেনি, বিশেষ করে যে যুদ্ধ আগ্রাসনের ফলে সংঘটিত হয়। এহেন যুদ্ধ বরাবরই একটা জঘন্য অপরাধ বিবেচিত হয় এবং এতে আগ্রাসী শক্তিকেই পরিনামে চরম মূল্য দিতে হয়।

এই প্রেক্ষিতে আমরা দেখি যে বদরের যুদ্ধ প্রধানত: মক্কার লোকদের আগ্রাসী তৎপরতা এবং তাদের একগুঁয়ে নেতাদের বিশেষ করে তাদের সুপ্রিয় কমান্ডার আবু জেহেলের জেদের কারণেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রথমত: কুরাইশ বাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল মদীনার সেনাবাহিনীর আক্রমণ থেকে তাদের বিশাল কাফেলাকে উদ্ধার করা। এটা ছিল তাদের মক্কা ত্যাগের প্রাথমিক উদ্দেশ্য এবং সেই সঙ্গে মদীনার বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের যৌক্তিকতাও ছিল এখানেই। এটা ঘটলে তাদের কার্যক্রমকে আগ্ৰাসন বলা যেত না। মক্কীরা বুঝেছিল যে মদীনার বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ একটা হবেই এবং সে কারণেই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকে তারা যুক্তসঙ্গত মনে করেছিল।

কিন্তু এই বিশাল বাহিনীটি যখন যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে প্রায় ১২৫ মাইল দূরে রাবিকা নামক স্থানে উপনীত হয় তখন তারা সংবাদ পায় যে তাদের কাফেলা এখন নিরাপদ এবং বিপদমুক্ত; অতএব এ অবস্থায় তাদের যুদ্ধের আর কোন প্রয়োজন নেই। তাদের মধ্যে যারা বিচক্ষণ ছিলেন তারা রাবিগ থেকেই মক্কায় ফিরে যাওয়ার কথা বলতে লাগলেন। পুনরায় বদরে ঘাঁটি স্থাপনের পরও এই সব জ্ঞানী ও বিচক্ষণ নেতারা তাদের সৈন্যদের মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের আক্রমণ না করে শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় প্রত্যাবর্তনের আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই দু’বারই আবু জেহেল তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন। তিনি বারবারই মুসলমানদের বিরুদ্ধে তার আগ্রাসী তৎপরতাকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যে যুদ্ধের পক্ষে কথা বলেন। এভাবে বদরের যুদ্ধটাই ছিল মক্কীদের আগ্রাসন, অন্যায় ও নিষ্ঠুরতার পরিনাম এবং এই যুদ্ধ পরিনামে তাদের ধ্বংসই ডেকে এনেছিল।

৩. বিশ্বাস

যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাফল্যের দু’টি অত্যাবশ্যক শর্ত হচ্ছে বিশ্বাস ও প্রত্যয়। বদরের যুদ্ধ এই ঐতিহাসিক সত্যেরই প্রমাণ। এক পক্ষে ছিল মুসলমানরা যাদের ছিল বিশ্বাস এবং প্রত্যয় এবং যারা আল্লাহর জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিল এবং যে কোন রকম সাফল্য অর্জনের ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল যে যুদ্ধে নিহত হলে তারা শহীদ হবেন এবং বেহেস্তের চিরন্তন শান্তি লাভ করতে পারবেন, এবং বিজয়ী হলে তারা হবেন এমন পথিকৃৎ বা অগ্রদূত যাদের নিজেদের আদর্শসমূহেরই[১] প্রতিফলন ঘটবে তাদের চোখের সামনে।

[১. মুসলমানরা যে কিভাবে তাদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সবকিছু বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন তার দৃষ্টান্ত মেলে ওমাইর বিন আল-হাম্মামের গল্পে। তিনি একদিন যুদ্ধের সাড়িতে দাঁড়িয়ে খেজুর খাওয়ার সময় মুহাম্মদকে বলতে শুনলেন : “ যে মহান সত্ত্বার হাতে মুহাম্মদের জীবন ন্যস্ত সেই মহান আল্লাহর নামে কসম, যিনি এই যুদ্ধে পৌত্তিলিকদের মোকাবিলা করবেন এবং কখনোই তাদের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবেন না তারা আল্লাহর কাছ থেকে বেহেস্ত পুরষ্কার পাবেন।” একথা শুনে তিনি হাতের খেজুরগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেনঃ সাব্বাস! আমি অবশ্যই যুদ্ধে গিয়ে এদের হাতে নিহত হব এবং তার পুরস্কার স্বরূপ বেহেস্ত লাভ করবো।” এই বলে তিনি পৌত্তলিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং যুদ্ধের ময়দানেই শহীদ হয়েছিলেন।]

এহেন বিশ্বাস এবং আত্ম-প্রত্যয় ছাড়া কোন সেনাবাহিনীর পক্ষেই পৃথিবীতে বিরাট কোন সাফল্য অর্জন করা সম্ভব নয়। আত্ম-প্রত্যয়ই হচ্ছে যে কোন জাতির শক্তির মূল উৎস এবং পৃথিবীর ইতিহাসে যে সব জাতি আজ শক্তি ও মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন, আত্ম-প্রত্যয় ছাড়া তারা কখনোই এ অবস্থায় পৌঁছতে পারত না। আরব ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় সেগুলিই যেগুলিতে স্থান পেয়েছে ইসলামের পতাকাবাহী মহান মুসলমানদের জীবন।

পক্ষান্তেরে, বদরে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী মক্কার পৌত্তলিকদের সামনে বড় কোন আদর্শ বা বিশ্বাস ছিল না। তারা শুধু তাদের অহংকার ও নীতিহীনতাকে[১] প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল এবং তাদের শুধু শক্তি প্রদর্শনের আকাঙ্খা ছিল। মুসলমানরা যেমন একটা আদর্শের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন এবং জীবন দিয়েছিলেন, পৌত্তলিকদের সে ধরনের কোন আদর্শ ছিল না। বরাবরের মত। ঈমান বা বিশ্বাসেরই জয় হয়েছিল।

[১. রাবিগে পৌত্তিলিক বাহিনীর বিচক্ষণ নেতারা যখন আবু জেহেলকে মক্কায় ফিরে নেয়ার চেষ্টা করছিলেন তখন সেখানে আবু জেহেল যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতেই এ উক্তির সত্যতা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছিলেন : “ ঈশ্বরের কসম, বদরে না পৌঁছা পর্যন্ত আমরা ফিরবা না। সেখানে আমরা তিনদিন থাকবো এবং জীব-জন্তু মেরে পানাহারের উৎসব করবো এবং মেয়েদের দ্বারা সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করবো। সমগ্র আরব দেশ আমাদের অভিযানের কথা শুনবে এবং সব সময় আমাদেরকে ভয় করে চলবে। অতএব সামনে চলুন।”]

(৪) নতুন কৌশল

বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা এমন একটা নতুন কৌশল অবলম্বন করেন যা আরবদের জানা ছিল না। মুসলমানদের বিজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত এই নতুন কৌশলটি সংক্ষেপে নিন্মে বর্ণিত হলো :

নেতৃত্ব

জেনারেল মাহমুদ শিত খাত্তাব[২] তার আ-রাসুল-উল কাইদ গ্রন্থে বলেছেন :

“মহানবী ছিলেন মুসলমান সেনাবাহিনীর সুপ্রীম কমান্ডার এবং মুসলমানরা তাঁর নেতৃত্বাধীনে একক দল হিসেবে যুদ্ধ করেছিলেন। এবং একজন মহান সামরিক অধিনায়ক হিসেবে মহানবী তাদেরকে আদেশ দিতেন কখন আক্রমণ করতে হবে আর কখন হবে না। এগুলি ছিল যুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্ত।”

[২. জেনারেল মাহমুদ শিত খাত্তাব হচ্ছন ইরানী সেনাবাহিনীর অন্যতম বিখ্যাত জেনারেল। একজন আল্লাহুভক্ত মুসলমান হিসেবে তিনি হচ্ছেন একজন প্রবল বিশ্বাসী ও আত্ম-প্রত্যয়ী মানুষ যিনি কাসিমের কমিউনিষ্ট শাসনামলে অনেক নির্যানত সহ্য করেন কিন্তু কোন কিছুই তাকে কমিউনিজমের বিরোধিতা করা থেকে বিরত করতে পারেনি, কারণ এ ধরনের সব “ইজম” ই ইসলামী আদর্শের পরিপন্থী। তিনি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে এবং সাহসিকতার সঙ্গে কাসেম আরোপিত “প্রোলেটারিয়ান” একনায়কত্বের বিরোধিতা করেন। কাসিমের শাসনের পতন ঘটানোর জন্য তিনি ১৪ ই রমযানের বিদ্রোহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইহুদি আমলে তিনি শহর বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। তার রচিত আল-রাসুল-উল কাউদ (মহান নবী : মহান নেতা) হচ্ছে সামরিক অধিনায়ক হিসেবে মহানবীর উপর লেখা একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। মহানবীর সেনাপতিত্বে অনুষ্ঠিত যুদ্ধগুলির বর্ণনায় তিনি এমন শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন যে এটা পড়ে সকলেই বিশ্বাস করে যে মহানবী মুহাম্মদ নবী ছাড়াও মানবজাতির দেখা সবচেয়ে মহান একজন সামরিক অধিনায়ক ছিলেন। আমরা যেহেতু সবাই ইসলামের আদর্শে বিশ্বাসী, অতএব আমাদের সেনাবাহিনীগুলোতেও মহানবীর মত শ্রেষ্ঠ সেনপতি থাকুক এটাই আমাদের কামনা।]

“অধিনায়কের আদেশ পালনের ক্ষেত্রে মুসলমান যোদ্ধারা দৃষ্টান্তমূলক নিয়মানুবর্তিতা প্রদর্শন করেন। একটা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী হিসেবে তারা ছিলেন তাদের প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেক বেশী উৎকৃষ্ট। তারা সত্যিকার অর্থেই একটা সুশৃঙ্খল শক্তি ছিলেন।

“আমার মতে শৃঙ্খলার অর্থ হচ্ছে আনুগত্য এবং উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের আদেশের সঠিক ও দ্রুত বাস্তবায়ন। শৃঙ্খলার এই সংজ্ঞা মনে রেখে আমরা দেখতে পাই যে মুসলমানরা তাদের সেনাপতির আদেশ পালনে অত্যন্ত দ্রুততা, সততা এবং সদিচ্ছার পরিচয় দিয়েছিলেন। শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তারা ছিলেন একটা আদর্শ সেনাবাহিনী, ঠিক যেমনটি হওয়া তাদের উচিত ছিল এমন একজন আদর্শ সেনাপতির অধীনে যিনি সেনাপতি হিসেবে নিজে কোন বিশেষ সুযোগ ভোগ করেননি কিংবা কোন কষ্ট থেকেও নিজেকে দূরে রাখেননি। তিনি নিজে তাঁর সঙ্গীদের সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং চরম অবস্থাগুলোতে তিনি অভাবনীয় ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন। এবং যে কোন বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করার আগে তিনি কখনোই তাঁর সাথীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হননি।

“যুদ্ধ চলা অবস্থায়ও তিনি সামান্য কয়েকজন সাহাবী এবং তাদের সেনাপতি সা’দ বিন মুয়াদকে বাইরে” গার্ড হিসেবে রেখে তাঁর নিজের তাবু স্থাপন করেছিলেন।

“অন্যদিকে পৌত্তলিক মক্কীরা কোন সুপ্রীম কমান্ডারের নেতৃত্বাধীনে যুদ্ধ করেনি। তাদের বাহিনীতে বেশ কয়েকজন নেতার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দু’জন ছিলেন আবু জেহেল বিন হিশাম এবং উৎবা বিন রাবিয়া। এদের একজন সুপ্রীম কমান্ডার হিসেবে কাজ করতে পারতেন কিন্তু কোন কোন বিষয়ে তাদের মতবিরোধ এবং পুরনো কিছু পারিবারিক কলহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। সঙ্গতকারণেই, তাদের বাহিনীতে শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না এবং কোন রকম উপযুক্ত সংগঠন, শৃঙ্খলা এবং সুসংহত নেতৃত্ব ছাড়াই তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল।”

(খ) বাহিনীগঠনের নতুন পদ্ধতি

এই শিরোনামে মহানবী : মহান সামরিক অধিনায়ক গ্রন্থের (পৃষ্ঠা ৮৮) প্রণেতা বলেছেন :

“মহানবী মদীনা থেকে বদরে যাওয়ার সময় সেনাবাহিনী গঠনে এমন একটা পদ্ধতি অবলম্বন করেন যা অনেকাংশেই আধুনিক মরুভূমি যুদ্ধের কৌশলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

“মহানবীর গঠিত বাহিনীতে ছিল একটা অগ্র-বাহিনী, একটা প্রধান বাহিনী, একটা পশ্চাদ-বাহিনী এবং কিছু সংখ্যক প্রহরা যারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতেন। এদের সংগৃহীত তথ্য পুরোপুরি কাজে লাগানো হত। আধুনিক রণকৌশলের দৃষ্টিতে এটাই হচ্ছে মরুভূমির যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত কৌশল।”

“উপরন্ত, যুদ্ধের ব্যাপারেও মুসলমানরা ছিলেন অত্যন্ত সংগঠিত এবং তারা লড়েছিলেন যুদ্ধের শেষাবধি। পক্ষান্তরে তাদের প্রতিপক্ষদের পদ্ধতি ছিল “আঘাত কর এবং পালাও।” এ দু’টি পদ্ধতির পার্থক্যের মধ্যেই মুসলমানদের বিজয়ের একটা উল্লেখ্যযোগ্য কারণ নিহিত আছে।

“আঘাত কর এবং পালাও” পদ্ধতিতে শত্রুপক্ষের উপর তীর, তরবারি, গাদা এবং ঘোড়ার সাহায্যে পূর্ণ শক্তিতে আক্রমণ রচনা করা হয়। কিন্তু শত্রুপক্ষ প্রতিরোধ করলে এবং তাদের চাপ বৃদ্ধি পেলে আক্রমণকারী দল সাময়িকভাবে শক্তি প্রত্যাহার করে এবং নতুনভাবে আক্রমণের জন্য আবার নিজেদেরকে সংগঠিত করে। চুড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্দ্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত এই ‘আঘাত কর এবং পালাও’ পদ্ধতি চলতে থাকে।

“পক্ষান্তরে, যুদ্ধের ময়দানে দলভিত্তিক লড়াইয়ে গোটা সেনাবাহিনীকে দুই, তিন কিংবা সংখ্যা অনুসারে যতগুলো সম্ভব দলে বিভক্ত করা হয়। প্ৰথম দলের কাজ সম্মুখ ভাগে থেকে গাদার সাহায্যে শত্রুপক্ষের উপর তীর ছুঁড়ে মারা।

“উপরন্ত, বিভিন্ন দলের সৈন্যরা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সব সময় তাদের সেনাপতির সরাসরি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন এবং এতে করে শত্রু পক্ষ যখন উপর্যুরি আক্রমণের পর দূর্বল হতে থাকে তখন তারা পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন এবং পলায়নরত শত্রুকে ধাওয়া করতে পারেন।

“শোষোক্ত পদ্ধতির যুদ্ধই যে শ্রেষ্ঠ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এতে সেনাপতি তার সৈন্যদের উপর পূর্ণ কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। এই অবস্থানে থেকে তার পক্ষে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ও সংকটময় মুহূর্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সুবিধা হয়। তিনি বুঝতে পারেন কখন শত্রুদের আক্রমণ ঠেকাতে হবে, কখন ওৎ পেতে থাকতে হবে, কখন শত্রুদের পদাতিক কিংবা অশ্বারোহী বাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্থ নিজস্ব সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে এবং কখন বিজয়ের সুফল অর্জনের জন্য নিজেদের পশ্চাদ বাহিনীকে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে।

“এই সংগঠিত যুদ্ধ কৌশলে সৈন্যদের উপর সেনাপতির পূর্ণ নিয়ন্ত্ৰণ নিশ্চিত হয় এবং যে কোন আক্রমণাত্মক কিংবা আত্ম-রক্ষামূলক যুদ্ধেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে তড়িৎ ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইহা অত্যন্ত জরুরী। পক্ষান্তরে, “আঘাত কর এবং পালাও”[১] পদ্ধতিতে সৈন্যদের উপর সেনাপতির কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না এবং এতে জরুরী অবস্থায় কোন ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ থাকে না।

[১. এই পদ্ধতি আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়।]

জেনারেল মাহমুদ শিত খাত্তাব আরো বলেছেন :

“বদরের যুদ্ধে মহানবী এই সুসংগঠিত রণ-কৌশলটাই ব্যবহার করেছিলেন এবং এটাই ছিল মুসলমানদের জয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কারণ। সামরিক ইতিহাস থেকে আমরা জানি, পুরাতন যুগের আলেকজান্ডার এবং হ্যানিবল, এবং আধুনিক যুগের নেপোলিয়ন, মোল্টকে, রান্‌ড্‌ স্টেড এবং রোমেলের মত বিখ্যাত সামরিক আধনায়কদের অর্জিত বিজয়গুলি তাদের ব্যবহৃত নিজস্ব অস্ত্র ও কৌশলের মাধ্যমেই সম্ভবপর হয়েছিল।”

সংক্ষেপে বলা যায়, বদরের যুদ্ধে মুসলমানরা তাদের নিজস্ব যুদ্ধ-কৌশল অবলম্বন করেই তাদের প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছিলেন এবং মহানবীর নেতৃত্বাধীনে গৃহীত এই কৌশলটি তাদের শত্রুপক্ষের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা।

আমাদের দৃষ্টিতে এই চারটি প্রধান কারণেই বদরের যুদ্ধে পৌত্তলিক বাহিনী মুসলমান বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিল। পক্ষান্তরে, এগুলিই ছিল মুসলমানদের বিজয়ের মূখ্য কারণ। এই বিজয়ের পরেই মুসলমানদের শক্তি ও অবস্থান নিরাপদ ও সুদৃঢ় হয়েছিল।

শেষ কথা

এই ক্ষুদ্র বইটির লেখক অবশেষে বইটিকে সারা পৃথিবীর মুসলমান যুবকদের প্রতি উৎসর্গ করতে চান। বইটির উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমান যুবকরেদকে তাদের গৌরবময় ইসলামী অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া, যে অতীতকে তাদের শত্রুরা কলা-কৌশলে বিগত শতাব্দীগুলোতে তাদের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রেখেছে। এই বইটি তাদের গৌরবময় অতীতকে সঠিকভাবে জানতে সাহায্য করবে এটাই হচ্ছে লেখকের কামনা। দুঃখের বিষয়, মুসলমানদেরকে এই অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পড়তে দেয়া হয়েছে বিদেশীদের ইতিহাস, তাদের কীর্তি-কলাপ এবং এমন সব বিখ্যাত মনীষী, বীর এবং দার্শনিকদের কথা যাদের সঙ্গে মুসলমানদের অতীত কিংবা বর্তমানের কোনই সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে, তাদের ইসলামের ইতিহাসকে তাদের সামনে এমন বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তাতে করে মুসলমনারা এই গৌরবের বিশাল ভান্ডার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

একই সাথে আমরা ঐসব মুসলমানদের প্রতিও দু’একটা কথা বলতে চাই যারা তাদের নিজেেেদর দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন এবং তাদের দেশের মুসলমানদের শিক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা তাদেরকে তাদের শিক্ষা-পদ্ধতিকে নতুনভাবে বিচার করার আহ্বান জানাই, বিশেষ করে তাদের পাঠ্যসূচীর যে অংশে ধর্মীয় অনুশাসন এবং ইসলামের ইতিহাস শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে।

উম্মাহ্ হিসেবে মুসলমানদের জন্য এ দু’টি জিনিস সামাজিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু প্রায় সকল মুসলিম দেশেই এগুলিকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং এগুলি উপেক্ষিত হয়েছে তাদের গণ-শিক্ষার প্রতিটি স্তরেই। ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামী শিক্ষার প্রতি এই উদাসীনতা শুরু হয়েছে তখন থেকেই যখন অধিকাংশ মুসলিম দেশই বিদেশী শাসনাধীনে ছিল।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মুসলিম দেশগুলি তাদের স্বাধীনতা লাভের পরও বিদেশী শাসক ও শোষকদের আরোপিত শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই ধরে রেখেছে। এজন্যই এসব দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সত্যিকার অর্থে ইসলাম-মুখী নয়।

যে কতিপয় আরব দেশে সিলেবাসের অংশ হিসেবে ইসলামের ইতিহাস পড়ানো হয় সেখানেও তেমন কোন কাজ হচ্ছে না, কারণ তাদের শিক্ষাদান পদ্ধতি এতই নীরস ও হতাশাপূর্ণ যে তাদের শিক্ষকরা তাদের কোমলমতি ছাত্রদেরকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পারেন বিশেষ করে ইংরেজী, অঙ্কন, ভূগোলের মত অন্যান্য বিষয়ের তুলনায়।

মুসলমানদের জন্য এই ধরনের শিক্ষার চেয়ে অধিকতর ধ্বংসাত্মক আর কিছু হতে পারে না, কারণ আমাদের ধর্মীয় শিক্ষার অনুসরণ এবং আমাদের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ছাড়া জাতি হিসাবে শক্তিশালী ও অন্যের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে টিকে থাকা একদমই অসম্ভব আমাদের পক্ষে।

এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যে সব মুসলমান দেশ কখনো কোন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীনে ছিলনা তারাও এমন সব বিদেশী ধ্যান ধারণাকে আমদানী করতে শুরু করেছে যা ক্রমান্বয়ে ধর্ম-নিরপেক্ষতার প্রলেপ দিয়ে তাদের শিক্ষা-ব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। প্রতি বছরই এসব দেশের ধর্মীয় অনুশাসনের উপর উৎপড়ীন হচ্ছে এবং ধর্মীয় শিক্ষার স্থলে পশু পালন এবং অংকনের মত বিষয়গুলি স্থান পাচ্ছে। উম্মাহ্ হিসেবে মুসলমাদের কাছে এ সব বিষয়ের কোনই রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক তাৎপর্য নেই। দেশের পাঠ্যক্রমে এসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি থাকা প্রয়োজন তবে তা কোনভাবেই ধর্মীয় শিক্ষাকে বাদ দিয়ে নয়।

এই মুসলমানরা ভাবছেন যে ধর্মীয় শিক্ষক উপেক্ষা করে এবং তাদের ইসলামী অতীতের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করেই তাদের দেশকে সভ্য জাতিসমূহের দরবারে উন্নতি ও সম্মানের আসনে বসাতে পারবেন। কিন্তু তাদের এরকম ধারণা ভুল। এতে করে তারা বরং নিজেদের সংহতিকে বিনষ্ট করে তাদের শত্রুদের হাতকেই শক্তিশালী করছেন। কারণ তারা আজ যে সব চিন্তা-ভাবনাকে লালন করছেন সেগুলো আসলে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অনুসৃত রীতি-নীতর সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ। এই সাম্রাজ্যবাদী বর্তমানে মুসলমানদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রন করছে।

প্রকৃতপক্ষে, যে জাতির আধ্যাত্মিক ভিত্তি ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং ইসলামের বিধি-বিধান অনুসরণ করেই যে জাতি শক্তি লাভ করে সে জাতি কিভাবে ইসলামী শিক্ষাকে বাদ দিয়ে শক্তি ও সংহতি লাভ করতে পারে? ভাবতে অবাক লাগে মুসলমানরা কিভাবে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ধর্মীয় বিষয়ের তিরোধান তাদের জন্য জাতীয় কল্যাণ বয়ে আনবে কিংবা তাদের সম্মিলিত আশা-আকাঙ্খা পূরনে সহায়তা করবে।

আরব এবং আরবের বাইরের সব মুসলমান দেশের শিক্ষা-নীতি নির্দ্ধারকদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ধর্মীয় অনুশাসন এবং ইসলামের ইতিহাসের প্রতি উদাসীনতা তাদের উন্নতির পথে বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং মুসলমান যুবকদের তা আজকের ফ্যাশন হিসেবে গড়ে উঠা ঐ সব ধ্বংসাত্মক আদর্শের পথে ঠেলে দিবে। এবং বর্তমানের শিক্ষা-নীতি এভাবেই চলতে থাকলে তা স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান যুবকদের সব রকম ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্বের প্রতি উদাসীন ক’রে তুলবে এবং চুড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তা সমগ্র মুসলিম বিশ্বাসকেই একটা সার্বক্ষণিক অস্থিরতা, গোলযোগ এবং অরাজকতার মধ্যে ফেলে দেবে।

আজকের আরব বিশ্বে যে অস্থিরতা এবং অসন্তোষ পরিলক্ষিত হচ্ছে তাও ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা-নীতিরই ফল এবং এই শিক্ষানীতি মুসলমান যুবকদের জীবন গঠনে মোটেই ইসলামী মূল্যবোধকে অনুসরণ করে না।

আমাদের বিশ্বাস ইসলামের পথে ফিরে না আসলে এবং ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক ক্ষেত্রে ইসলামকে দিক-নির্দেশক হিসেবে গ্রহণ না করলে মুসলমানরা কখনোই শক্তি ও শান্তি অর্জন করতে পারবে না। কারণ অতীতের মত আজও ইসলামই এবং কেবলমাত্র ইসলামই মুসলমান সম্প্রদায়ের যাবতীয় অমঙ্গল দূর করতে পারে।

সমাপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *