শ্রুতিতে-স্মৃতিতে নাস্তিকতা
আমার গুরুতমা সুকুমারী ভট্টাচার্য নিজেকে নাস্তিক বলতেন এবং নাস্তিকতার সপক্ষে মাঝে মাঝেই আমার কাছে যুক্তিজাল বিস্তার করতেন। সেসব শুনে আমার মতো বৈষ্ণববাড়ির লোক এমনই সমস্যায় পড়তাম যে, প্রাচীনদের মতো ‘ওম বিষ্ণু’ বলে কানেও হাত দিতে পারতাম না, আবার ‘তরু হতে যে বা হয় সহিষ্ণু তৃণ হতে দীনতর’ হয়ে বিনা তর্কে তাঁর বক্তব্যগুলো সুপ্রতিষ্ঠ বলেও মেনে নিতে পারতাম না। এই সমস্ত যুক্তি-তর্কের মধ্যে সুকুমারীর শেষ কথাটাই ছিল মারাত্মক। তিনি বলতেন—নিজেকে আস্তিক বলতে যতটুকু যুক্তি দিতে হয় তার থেকে হাজার গুণ বেশি যুক্তি তর্ক লাগে নিজেকে নাস্তিক বলে প্রমাণ করতে। এ-কথার সারমর্ম এটাই যে, নাস্তিক হতে গেলে আস্তিকের চেয়ে অনেক বেশি সুতার্কিক হতে হয়। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে আমার সুবিধের জায়গাটা এটাই যে, আমাকে ‘নাস্তিক্য’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো যুক্তি বিস্তার করতে হবে না। বরঞ্চ ভারতবর্ষে নাস্তিকতার দৃষ্টান্ত কিছু ছিল কি না, তার ঐতিহাসিকতা আমাদের কাছে অনেক জরুরি।
কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতবর্ষে আর দশটা ধর্মের মতো ‘নাস্তিক্য’ ও একটা ধর্ম এবং তার জন্ম হয়েছে ‘আস্তিক্য’র প্রায় সমবয়স্কতায়। যাঁরা সেই বিখ্যাত বেদমন্ত্রটির মধ্যে নাস্তিকতার প্রথম গন্ধ পান, সেটা বৈদিক প্রমাণেই তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা এ-ঘটনাটা ঘটেই থাকতে পারে যে, বৈদিককালে আচার—আচরণের আধিক্য এবং যজ্ঞ সামগ্রীর আড়ম্বর যখন অতিমাত্রায় বেড়ে গেল, তখন সেই উদাসী ঋষির মুখ দিয়ে সেই বিখ্যাত অনীহা মন্ত্রাকারে বেরিয়েছে—আর কোন দেবতার উদ্দেশে আমরা এত এত ঘি ঢালব—কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। নাস্তিক্যবাদীরা বৈদিকদের এই দেবতা-বিষয়িণী হতাশাটাকেই নাস্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রয়াস বলে দাবি করেন। যদিও এই দাবি নাস্তিকদের পক্ষে একটু বেশিই উচ্চাশাব্যঞ্জক বলে পণ্ডিতেরা উল্লেখ করেছেন। কেননা তাঁদের মতে বৈদিকদের বহু দেবতা-বিষয়ক যাজ্ঞিক আড়ম্বর এবং ক্লান্তি থেকে মুক্ত হয়ে ঔপনিষদিক ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ নিরাকার নির্বিশেষ ব্রহ্মের উপাসনার দিকে যাওয়াটাই পূর্বোক্ত বৈদিক মন্ত্রের মন্ত্রণা।
আমাদের দেশে যাঁরা নাস্তিকতায় বিশ্বাসী হতেন, তাঁদের বলা হত ‘চার্বাক’। ‘চারুবাক’ অর্থাৎ মন-ভোলানো চারুবাক্য ব্যবহার করে যাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরাই চার্বাক। তাঁদের সবচেয়ে বড়ো যুক্তি হল—ঈশ্বর বলে কিছু নেই। কেননা প্রত্যক্ষে যাকে দেখতে পাচ্ছি না, তাকে হঠাৎ বিশ্বাস করতে যাব কেন? এমনকি তার কোনো শক্তিও নেই, শক্তি থাকলে তাঁকে ডাকলেই তো তিনি বন্যা-ভূমিকম্প কিছুই হতে দিতেন না, এবং যে কোনো বিপদেই তিনি রক্ষা করতে পারতেন। এমনটা যখন হয় না, তাহলে এই বিশ্বাসের কী ফল? চার্বাকদের পরলোক সম্বন্ধে ধারণাটা সেই বিখ্যাত প্রবাদের জন্ম দিয়েছে। তাঁরা বলেন—দ্যাখো, যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন যথাসাধ্য সুখে থাকার চেষ্টা করবে। ওইসব সততা-ফততা ছাড়ো, দরকার হলে ধার নাও, খাও। কিন্তু সেটা শাকপাতা নয়, ঘি দিয়ে ভাত খাও—যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ/ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ। ন্যায়, নীতি, ধর্ম—এসব এক্কেবারে ছেঁদো কথা। বিশেষত আস্তিকরা যেসব পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক কিংবা কর্মফলের কথা বলে ভয় দেখায়, সেসবে একফোঁটাও বিশ্বাস করো না। সব ভুয়ো কথা—এই শরীর যেদিন স্বাভাবিক নিয়মে জীর্ণ হতে হতে মরণের কোলে ঢলে পড়বে, ব্যাস ওটাই শেষ—তুমি চিতায় উঠলে, শরীর পুড়ে ছাই হল, ওটাই শেষ; আবার ‘আত্মা’, ‘সূক্ষ্ম দেহ’, ‘পরজন্ম’ বলে ওসব কিচ্ছু নেই। শরীর একবার ভস্ম হয়ে গেলে আবার শরীর! এসব হয় নাকি? অতএব খাও-দাও-গান গাও, জীবনটা ভালো কাটাও—ভস্মীভূতস্য দেহস্য পুনরাগমনং কুতঃ।
এই চার্বাকরা নিশ্চয়ই নাস্তিক, কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে যে, নাস্তিকতার দর্শনটা আরও বেশি গভীর এবং তা প্রায় আস্তিকতার সমবয়সি। নাস্তিকদের সবচেয়ে বড়ো শক্তি এটাই যে, তাঁরা অপ্রত্যক্ষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। এবং প্রত্যক্ষ ছাড়া আর কোনো প্রমাণ না মানলে আস্তিকদের সবচেয়ে বড়ো বিপদ ঘটে এটাই যে, চোখের সামনে ঈশ্বর দেখা দিতে পারছেন না বুঝেও তিনি আছেন বলে তাঁকে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেন তাঁরা। একইভাবে ধর্মকর্মে ফলও তো প্রত্যক্ষ নয়, অর্থাৎ কিনা আমি যাগযজ্ঞ, পূজার্চনা করলাম, ভাবলাম তাতে এই পাব, অথচ সেটা হল না। তাহলে তো এটাই বলতে হবে যে, শ্রুতি-স্মৃতিতে যাগযজ্ঞ-পূজার্চনার ফল সম্বন্ধে যেসব ভালো ভালো কথা লেখা আছে, সেগুলো স্বার্থপর কতগুলো লোকের প্রচারমাত্র। নাস্তিকেরা নাস্তিক্যবাদের হোতা বৃহস্পতির মত উল্লেখ করে বলেন এইসব যাগযজ্ঞের কথা, বেদধর্মের কথা, ত্রিদণ্ডী সন্ন্যাসধর্মের কথা কিংবা গায়ে ভস্ম মেখে, তিলক কেটে ভগবানের আরাধনা করা—এগুলো সব বুদ্ধিহীন পুরুষকারহীন আস্তিকদের জীবিকা—বুদ্ধিপৌরুষহীনানাং জীবিকেতি বৃহস্পতিঃ।
জনান্তিকে বলি—মহাভারতে পাণ্ডবদের বনবাস পর্বে বনবাস-কষ্টে নির্বিকার যুধিষ্ঠিরকে উদ্যমী এবং উৎসাহী করে তোলার জন্য প্রচুর তিরস্কার করেছিলেন পঞ্চস্বামী গর্বিতা দ্রৌপদী। সেই সময় তিনি কথায় কথায় বলেছিলেন—আমার ভাইকে যখন এক আচার্য ঘরে এসে পড়াতেন তখন আমি বাবা দ্রুপদের কোলে বসেই বৃহস্পতি-নীতির কথা শুনেছি—নীতি বৃহস্পতিপ্রোক্তাং ভ্রাতৃনমে’গ্রাহয়ৎ পুরা। আমাদের শাস্ত্র পরম্পরায় এটাই প্রতিষ্ঠিত যে, এই বৃহস্পতিই নাস্তিক শাস্ত্রের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। হয়তো এই কারণেই দ্রৌপদীর মুখে প্রবল তিরস্কার শোনার পর তাঁর অকাট্য যুক্তি প্রত্যাখ্যানও করতে পারেননি যুধিষ্ঠির। আবার তাঁর যুক্তি সহ্যও করতে পারছিলেন না তিনি। ফলে কিছুই না পেয়ে তিনি বললেন—তুমি অত্যন্ত চোখা ভাষায় প্রচুর ভালো ভালো কথা বললে বটে, যাজ্ঞসেনী! কিন্তু কথাগুলোর মধ্যে একটা নাস্তিকতার প্রয়াস আছে—উক্তং তৎ শ্রুতমস্মাভি নাস্তিক্যন্তু প্রভাষসে।
আমাদের মতে নাস্তিকতার মধ্যে কূটতর্ক সাধনের যে অসামান্য ক্ষমতা আছে, সেটাই বোধহয় আস্তিক্যবাদীদেরও প্রশংসা কুড়িয়েছে। নইলে দেখুন, শরীরের মধ্যে প্রাণ-চৈতন্যের প্রমাণ, ঈশ্বরসিদ্ধির জন্য অনুমান-প্রমাণ, ঈশ্বর-কর্তৃক জগৎ সৃষ্টির প্রমাণ—এতসব প্রমাণ করতে আস্তিক শাস্ত্রের প্রাণ বেরিয়ে যায়। সেখানে নাস্তিকের যুক্তি কত সহজ এবং লোকগ্রাহ্য। নাস্তিক বলবেন—এই জীব-জগৎ সৃষ্টির মূলে ঈশ্বর, সংসার-মহীরুহের বীজ তাঁর মধ্যে লুকিয়ে আছে, এ-কথা অনুমান ছাড়া প্রমাণ করাই সম্ভব নয়, সেখানে অদৃষ্ট কর্মফল ইত্যাদি অনুমান চেষ্টা করার মতো ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করাটাই ভুল। বরঞ্চ এটাই একেবারে সিদ্ধ প্রত্যক্ষ যে, শরীর থেকে শরীরের সৃষ্টি।
নাস্তিকের তর্কদৃষ্টিতে জীবের সঙ্গে জীবাত্মা স্বীকার করার প্রয়োজন নেই, জীবাত্মা এই শরীর থেকে আলাদা কিছু নয়—চান্যো জীবঃ শরীরস্য নাস্তিকানাং মতে স্থিতঃ। আমরা যে বটগাছ দেখি, সেই বটগাছের পাতা, ফুল, ফল এবং মূল যেমন প্রচ্ছন্নভাবে বীজের মধ্যেই থাকে, তেমনই শরীরের কারণ যে রেতোবীজ, তার মধ্যে আমাদের মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার এমনকি প্রত্যেকটি ব্যক্তিশরীরের আকৃতিও প্রচ্ছন্নভাবে থাকে এবং সময়কালে ঠিক সেগুলো ফুটে বেরোয়। নাস্তিক বলেন যে, গোরু তো ঘাস খায়, কিন্তু পরিণতি হয় দুধে, তেমনই একটা বীজ থেকে স্বতোভিন্ন একটা পরিণতি ঘটতেই পারে। সবচেয়ে বড়ো কথা—পান্তাভাতের সার, গুড়—এইসব জিনিসের মিশ্রণে যেমন দু-তিন দিন পর তার মধ্যে মাদকতা তৈরি হয়, তেমনই বিচিত্র গুণের মিশ্র শুক্রবীজের সঙ্গে ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ—এই চতুর্ভুজের সংযোগে চৈতন্যের সৃষ্টি হয় জীবশরীরে। দুটি কাঠের ঘর্ষণে যেমন আগুন তৈরি হয়, তেমনই চতুর্ভুজের সংযোগে চৈতন্যের সৃষ্টি। চুম্বক যেমন লোহাকে চালিত করে, তেমনই জীবস্বরূপে উৎপন্ন চৈতন্যও ইন্দ্রিয়গুলোকে চালিত করে।
এইসব লোকগ্রাহ্য যুক্তি মানুষ তো বেশ তাড়াতাড়ি বোঝে এবং এই লোকগ্রাহ্যতা আছে বলেই নাস্তিক্যের অন্য নামই ‘লোকায়ত মত’। আমাদের দর্শনশাস্ত্রে এই নাস্তিক্যবাদ কিন্তু ‘ঈশ্বর আছেন কি নেই’—এই তর্কে তৈরি হয়নি। অর্থাৎ ইংরেজিতে theism বলতে ঈশ্বর-বিশ্বাসের যে প্রসঙ্গটা আসে, সেই কল্পনাতে যদি ‘আস্তিক’ শব্দটা বুঝি, তাহলে তার উলটো নাস্তিক বলতে ঈশ্বর-বিশ্বাসী নন, এমন মানুষকেই বুঝতে হবে। কিন্তু আমাদের দর্শনে কিন্তু এমনটা হয়নি। মাধবাচার্য তাঁর ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ গ্রন্থে একটি সর্বজনমান্য শ্লোক উদ্ধার করে লিখেছেন যে—যাঁরা বেদ মানেন না, বেদকে প্রমাণ বলেও স্বীকার করেন না এবং শাস্ত্র-বিচারের ক্ষেত্রে অবৈদিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁরাই নাস্তিক—এই কথাটা যে কত সত্যি, তা বোঝা যাবে এইখানে আমাদের ছয়টি আস্তিক-দর্শনের পরিকল্পনায়। আমাদের পূর্বমীমাংসা দর্শন এবং সাংখ্যদর্শন—এই দুই দর্শনই ঈশ্বর মানে না, কিন্তু বেদ মানে, বেদপ্রমাণ মানে, ফলত ঈশ্বর না মানলেও এই দুটি কিন্তু আস্তিক দর্শন—তাতে বুঝি যে—তর্কযুক্তির জায়গাটাকে ভারতবর্ষ বেশি মূল্য দেয়, ঈশ্বর আছেন কি নেই, তার চেয়েও বেশি কিন্তু তর্কযুক্তির পরিসর ভারতীয় দর্শনে বড় কথা।