শ্রাঙ্কেন হেড
জিপটা তাপসকে নামিয়ে দিয়ে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল৷ কী প্রচণ্ড ঠান্ডা! চামড়ার জ্যাকেট আর উলের কানঢাকা টুপি ভেদ করে শীত যেন কামড়ে ধরতে চাইছে তাকে৷ আর এত ঠান্ডা হবে নাই-বা কেন? আজ জানুয়ারির পাঁচ, তার ওপর আবার জায়গাটা দার্জিলিং! জিপের আলোটা পথের বাঁকে মিলিয়ে যেতেই চারপাশে একবার ভালো করে তাকাল তাপস৷ কেউ কোথাও নেই৷ টুরিস্ট সিজন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে৷ এ সময় এখানকার হোটেল-কনভেন্টগুলোও বন্ধ হয়ে যায়৷ ঠান্ডায় অর্ধেক লোক নীচে চলে যায়৷ ট্যাক্সি স্ট্যান্ড একদম খাঁখাঁ করছে৷ তার লাগোয়া ভুটিয়া জিনিসপত্তরের দোকানগুলোর ঝাঁপও বন্ধ৷ একটা কুকুর পর্যন্ত নেই! তাপসের রিস্টওয়াচে সাতটা বাজে৷ পঙ্খাবাড়িতে জিপটা খারাপ হয়ে গেছিল বলে তাপসের এখানে পৌঁছোতে ঘণ্টা খানেক দেরি হয়েছে ঠিকই, তা বলে শীতের দার্জিলিং সন্ধ্যা নামতেই যে এত শুনসান হয়ে যায় তা ধারণা ছিল না তার৷
চারপাশ একবার দেখে নেবার পর তাপস তাকাল ওপর দিকে৷ বেশ কিছুটা ওপরে একটা রেলিং ঘেরা জায়গাতে কুয়াশা মেখে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্ট৷ হলদেটে বাতি জ্বলছে৷ তাপস চিনতে পারল, ওটা ‘ম্যাল’৷ আগেও বার তিনেক দার্জিলিং-এ এসেছে তাপস৷ কখনো বন্ধুবান্ধব, কখনো-বা পরিবার পরিজনের সাথে নিছক বেড়াবার জন্য, গরমকালে৷ আর এবার সে এসেছে একটা কাজ নিয়ে৷ আসলে তাপস একটা বড়ো ক্যুরিয়র কোম্পানিতে মোটামুটি চাকরি করে৷ অফিসেই তার কাজ৷ কিন্তু সম্প্রতি কোম্পানির সাথে একটা গণ্ডগোলের জেরে স্ট্রাইক করেছে ক্যুরিয়ার ম্যানরা৷ এর ফলে সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম৷ এদিকে বেশ কিছু চিঠি আর মালপত্র ডেসপ্যাচের অপেক্ষায় কোম্পানির ঘরে জমা আছে৷ তার মধ্যে বেশ কিছু জিনিস আবার ইনসিওর্ড করা৷ সেগুলো ঠিক সময় প্রাপকের হাতে পৌঁছে দিতে না পারলে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতি তো হবেই, তার সাথে সুনামেরও ক্ষতি হবে৷ বিশেষত এই দ্বিতীয় ক্ষতিটা এড়াতেই কোম্পানির মুম্বাইয়ের হেড অফিস থেকে তাপসদের কলকাতার অফিসে নির্দেশ এসেছে যে, বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো আর স্ট্রাইক ওঠার অপেক্ষায় ফেলে রাখা যাবে না৷ অফিস স্টাফদের দিয়ে ডেলিভারি করাতে হবে৷ ওরকমই একটা ইনসিওর করা পার্সেল জায়গা মতো পৌঁছে দেবার জন্যই ওপরঅলার নির্দেশে এই প্রবল শীতে কলকাতা থেকে দার্জিলিং-এ এসে পৌঁছেছে তাপস৷ পার্সেলটা অবশ্য খুব বড়ো নয়, দেড় ফুট বাই দেড় ফুট একটা হালকা কাঠের বাক্স৷ তাপসের ব্যাগের মধ্যেই রয়েছে সেটা৷ তাপস একবার ভাবল, ব্যাগ থেকে পার্সেলটা বার করে তার গায়ে লেখা ঠিকানাটা দেখে নেবে৷ এর পরক্ষণেই তার মনে হল, কাছেপিঠে তো কোনো লোক নেই, কাকে সে জিজ্ঞেস করবে ঠিকানাটা৷ তার চেয়ে ওপরে উঠে কাজটা করাই ভালো৷ ম্যালে তো ঠিকানা জানার মতো কোনো লোক পাওয়া যাবেই৷ এই ভেবে, ব্যাগটা কাঁধে ফেলে জিপ স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে পাথরের ধাপ ভেঙে ম্যালের দিকে উঠতে শুরু করল তাপস৷
মিনিট দশেকের মধ্যেই সে ম্যালে উঠে এল৷ কিন্তু এ জায়গাটাও কেমন যেন শুনসান৷ বড়ো বড়ো দোকানপাটগুলো সব বন্ধ৷ দু-একটা হোটেলের কাঁচের জানলার ভিতর থেকে ক্ষীণ আলো ভেসে আসছে৷ হোটেলগুলোর সামনে বা ম্যালে কোনো লোকজন নেই, শুধু এক জন বুড়ো ঘোড়াঅলা রেলিং-এর একপাশে দাঁড়িয়ে তার ঘোড়ার পিঠে কী যেন মালপত্র তুলছে৷ তাপস একটা ল্যাম্পপোস্টের নীচে দাঁড়িয়ে পার্সেলটা বার করল৷ সেটা যে অনেক দূর থেকে এসেছে তা আগেই দেখেছে তাপস৷ কার্গো শিপের স্টিকার লাগানো আছে কাঠের ওপর হলদেটে মোটা কাপড় জড়ানো বাক্সটার গায়ে৷ কলম্বিয়া থেকে অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে পার্সেলটা এসেছে এদেশে৷ সেটা অবশ্য কোনো আশ্চর্য বিষয় নয়, পৃথিবী এখন অনেক ছোটো হয়ে গেছে৷ তাপসের পাড়ার একটা ছেলেই তো চাকরি সূত্রে ব্রাজিলে আছে৷ সেও মাঝে মাঝে সে দেশ থেকে এটা-ওটা পাঠায় তার কলকাতার বাড়িতে৷ কলম্বিয়া থেকে দার্জিলিং-এ পার্সেল তো আসতেই পারে৷
ল্যাম্পপোস্টের ফ্যাকাসে আলোয় পার্সেলের গায়ে লেখাগুলো আর-একবার ভালো করে দেখল তাপস৷ প্রেরক এবং প্রাপকের নাম দুই-ই সেখানে লেখা আছে-প্রেরক, এম. এম. সান্যাল, বোগোটা, কলম্বিয়া৷ বোগোটা যে কলম্বিয়ার রাজধানী, তা জানা আছে তাপসের৷ প্রাপকেরও নাম এম. এম. সান্যাল৷ ঠিকানা, ব্ল্যাক লগ হাউস, নিয়ার ম্যাল রোড, দার্জিলিং৷ প্রেরক এবং প্রাপকের নামের আদ্যক্ষর এবং পদবি যখন হুবহু এক, তখন তারা পরস্পরের নিকটাত্মীয়ই হবে৷ মনে মনে ভাবল তাপস৷ ঘোড়াওয়ালার কাছে এগিয়ে গিয়ে জানতে চাইল, ‘ম্যাল রোডের কাছে ব্ল্যাক লগ হাউস কোথায়?’
ঘোড়াওয়ালা তাপসের প্রশ্ন বুঝতে পারল কি না কে জানে, সে জবাব দিল, ‘মালুম নেহি সাব৷ আপ উস দুকান মে পুছিয়ে৷’-এই বলে সে আঙুল তুলে একটু দূরে একটা দোকান দেখিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিল৷
ম্যালের দক্ষিণ দিকে একটা গলির মুখে সেই দোকানের ঝাপ প্রায় বন্ধ৷ তবে ভিতরে লোক আছে৷ একটা ক্ষীণ আলো ভেসে আসছে দোকানের ভিতর থেকে৷ ঘোড়াওয়ালার সাথে আর বাক্য ব্যায় না করে তাপস পা বাড়াল সেই দোকানের দিকে৷ যা ঠান্ডা পড়েছে তাতে দ্রুত কাজ সেরে কোনো হোটেলের কম্বলের তলায় ঢুকতে হবে তাকে৷ ঠিকানাটা যদি কাছাকাছির মধ্যে হয়, তাহলে তেমন কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু যদি দূরে হয়, তবে এখন সে কোনো হোটেলে ঢুকে পড়বে৷ কাল ভোরে পাসের্লটা জায়গা মতো পৌঁছে দিয়ে তারপর ফেরার জন্য গাড়ি ধরবে৷ এই ঠান্ডার মধ্যে তার পক্ষে বেশি ঘোরাঘুরি করা সম্ভব নয়৷ এ কথা ভাবতে ভাবতে তাপস গিয়ে উপস্থিত হল দোকানের সামনে৷
কাঠের ঝাপ ঠেলে দোকানের ভিতর প্রবেশ করতেই তাপস বুঝতে পারল, সেটা একটা কিউরিও শপ৷ দোকানের ভিতর উজ্জ্বল আলো জ্বলছে৷ কাচের শোকেসে, দেওয়ালের গায়ে রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিক মূর্তি, থাংকা, তিব্বতি মুখোশ, নেপালি কুকরি ইত্যাদি৷ কাউন্টারে বসে ছিলেন, গলা বন্ধ কোট, কুকরির এমব্লম লাগানো টুপি পরা একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক৷ চোখে চশমা৷ তাপস কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস?’
তাপস পার্সেলটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি এই ঠিকানাটা খুঁজছি৷’
ঘসা কাঁচের ফাঁক দিয়ে ভদ্রলোক পার্সেলের গায়ের লেখাগুলো ভালো করে একবার পড়লেন৷ তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘এখানে কোনো বাড়ির নাম, ব্ল্যাক লগ হাউস আছে বলে তো আমার জানা নেই৷ তবে কাঠের বাড়ি তো এখানে অনেকেরই আছে৷’
তাপস একটু হতাশ হল তার কথা শুনে৷ ভদ্রলোক এরপর বললেন, ‘এ তো দেখছি চল্লিশ বছর আগের পার্সেল!’
তাপস বলল, ‘না, না, অত পুরোনো নয়, মুম্বাই থেকে কিছু দিন হল এখানে এসেছে৷’
তার কথা শুনে সেই ভদ্রলোক কোনো কথা না বলে পার্সেলের নীচের দিকের একটা অংশ আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন৷ বাক্সর ওপর জড়ানো হলদেটে কাপড়টা সম্ভবত ঘষা লেগে ছিড়ে গেছে সেখানে৷ হলদে কাপড়ের ভিতর একটা বিবর্ণ কাপড়ের আস্তরণ চোখে পড়ছে৷ সেখানে প্রায় অস্পষ্ট ভাবে লেখা, ভিক্টোরিয়া কার্গো, নাইন্টিন সিক্সটি, বোগোটা৷ ওই লেখাটা তাপসের চোখে পড়েনি৷ নাইন্টিন সিক্সটি মানে তাপসের জন্মেরও কুড়ি বছর আগে৷ এরকম মাঝে মাঝে হয় বলে শুনেছে যে৷ বিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে গুদামে পড়ে থাকা দাবিহীন পার্সেলের দাবিদারের সন্ধান মেলে৷ তখন আবার সেটা সেই দাবিদারের নতুন ঠিকানায় পাঠাতে হয়৷ একে বলে ‘রি-পার্সেলিং’৷
‘এটাও তাহলে সে রকমই একটা পার্সেল,’ মনে মনে ভাবল তাপস৷ সে লেখাটা দেখার পর বৃদ্ধকে বলল, ‘দারুণ চোখ তো আপনার৷’
তিনি উত্তর দিলেন, ‘কিউরিওর ব্যাবসা করি তো, তাই৷’
কিন্তু যে ঠিকানার খোঁজে তাপসের দোকানে ঢোকা বৃদ্ধ তা বলতে না পারায় সে পার্সেলটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘আপনাকে বিরক্ত করলাম বলে দুঃখিত৷ আমি যাচ্ছি৷’
এই বলে সে দোকানের বাইরে পা বাড়াতে যেতেই বৃদ্ধ হঠাৎ বললেন, ‘একটু দাঁড়ান৷’ দাঁড়িয়ে পড়ল তাপস৷
ভদ্রলোক একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘এখানে একটা অনেক পুরোনো কালো রঙের কাঠের বাড়ি আছে৷ তবে এখন সেখানে কেউ থাকে বলে আমার জানা নেই৷ বছর পঞ্চাশ আগে, আমি যখন নতুন দোকান খুলি তখন এক বাঙালি ভদ্রলোক ওই বাড়িতে থাকতেন৷ আমার দোকানে একই নামে তিব্বতি মুখোশ কিনতে আসতেন৷ তারপর দার্জিলিং ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেছিলেন তিনি৷ আপনি ওই বাড়িটাতে একবার গিয়ে দেখতে পারেন৷’
তাপস শুনে বলল, ‘ব্ল্যাক লগ হাউস যখন ঠিকানা, তখন সে বাড়িটা হলেও হতে পারে৷ তা বাড়িটা কোথায়?’
তিনি বললেন, ‘আপনি স্টেপ এসাইড চেনেন?’
তাপস বলল, ‘হ্যাঁ৷’
তিনি বললেন, ‘স্টেপ এসাইড, ভুটিয়া বস্তি পার হয়ে একটু এগোলে দেখবেন, ডান হাতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটা রাস্তা নীচের দিকে নেমে গেছে৷ ওই রাস্তার শেষ প্রান্তে বাড়িটা৷ রাস্তাটা একটু নির্জন ঠিকই৷ কিন্তু চোর-ডাকাতের ভয় নেই৷’
কিউরিও শপের মালিককে ধন্যবাদ জানিয়ে তাপস বাইরে এসে দাঁড়াল৷ কেউ কোথাও নেই৷ সেই ঘোড়াওয়ালাও চলে গেছে৷ আরও শূন্যতা যেন নেমে এসেছে চারপাশে৷ লাইট পোস্টের ক্ষয়াটে আলোর নীচে কুয়াশার মধ্যে পড়ে রয়েছে সবুজরঙা বসার জায়গাগুলো৷ অথচ গ্রীষ্মকালে এখানে এ সময় থিকথিক করে টুরিস্ট৷ দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে তাপস একবার ভাবল, পরদিন সকালেই সে বাড়িটার খোঁজে যাবে৷ তার পরক্ষণেই আবার তার মনে হল, তাহলে সারা রাত তাকে একটা চিন্তা নিয়ে কাটাতে হবে৷ স্টেপ এসাইড জায়গাটা তার চেনা, বেশি দূরে নয়, একবার দেখেই আসা যাক না বাড়িটা৷ আর পার্সেলটা যদি ওই ঠিকানারই হয়ে থাকে, তাহলে সে সেটা সেখানে গছিয়ে দিয়ে হোটেলে ফিরে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে৷ মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে৷ এক ঘণ্টার মধ্যেই সে নিশ্চয়ই ফিরে আসতে পারবে সে৷ এই ভেবে তাপস হাঁটতে শুরু করল৷
ম্যাল ছেড়ে তাপস স্টেপ এসাইডের রাস্তা ধরল৷ চেনা রাস্তা৷ এর আগে বেড়াতে এসে প্রতিবারই দেশবন্ধুর বাস ভবন স্টেপ এসাইড দেখতে গেছে৷ সত্যিই খুব ঠান্ডা লাগছে তার৷ মাফলরটা টুপির ওপর ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে তাপস হাঁটতে লাগল৷ রাস্তার পাশে বাড়িগুলো সব নিঝুম৷ শীতের মধ্যে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে৷
একসময় সে পৌঁছে গেল স্টেপ এসাইড৷ সেখানেও কোনো লোকজন চোখে পড়ল না তার৷ স্টেপ এসাইড, ঘুমন্ত ভুটিয়া বস্তি পিছনে ফেলে আর একটু এগোতেই ডান দিকেই ঢাল বেয়ে একটা রাস্তা নেমে গেছে দেখতে পেল তাপস৷ রাস্তা মানে পাথরের ধাপ৷ সেই ধাপ বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল সে৷ ঠিক তখনই আকাশ থেকে পেঁজা তুলোর মতো কী যেন ঝরে পড়তে শুরু করল তাপসের গায়ে৷ তুষারপাত শুরু হয়েছে৷ বেশ অনেকটা নীচে নামার পর তাপস একটা সমতল জায়গাতে এসে দাঁড়াল৷ রাস্তা চলে গেছে সামনের দিকে৷ তার দু-পাশে ইউক্যালিপ্টাসের ঘন বন৷
তাপস আবার হাঁটতে শুরু করল৷ চারদিকে কোনো আলো নেই৷ আস্তে আস্তে সাদা বরফের চাদরে ঢেকে যাচ্ছে গাছের মাথাগুলো৷ হিমেল বাতাসের ফিসফাস শব্দ শোনা যাচ্ছে ইউক্যালিপ্টাসের বন থেকে৷ এত নির্জন যে এবার তাপসের ভয় ভয় করতে লাগল৷ তার মনে হল, এত রাতে তার এ জায়গাতে আসা ঠিক হয়নি৷ বনের মধ্যে দিয়ে আরও কিছুটা এগোবার পর তাপস যখন ভাবছে এবার ফিরে যাওয়াই ভালো, ঠিক সেই সময় তার চোখে পড়ল সেই বাড়িটা৷ ক্ষীণ চাঁদের আলোতে প্রায় অন্ধকারের সাথে মিশে
দাঁড়িয়ে আছে কাঠের বাড়িটা৷ তুষারপাতের ফলে তার ঢালু ছাদটা শুধু একটু সাদাটে দেখাচ্ছে৷ বাড়িটা দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই তাপসের মনের মধ্যে ভয়টা উবে গিয়ে একটা উৎসাহের সৃষ্টি হল৷ যাক বাড়িটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল!
তাপস পৌঁছে গেল বাড়িটার সামনে৷ একটা অনুচ্চ পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটা৷ তিন দিকে ইউক্যালিপ্টাসের ঘন বন৷ কম্পাউন্ডের ভিতর প্রবেশ করে সোজা রাস্তা ধরে তাপস গিয়ে দাঁড়াল বাড়ির সদর দরজার সামনে৷ চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে তাপস দেখল দরজার পাশে একটা ফলকে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কয়েকটা হরফ-‘এম. এম. সান্যাল৷’ লেখাটা দেখেই মনটা নেচে উঠল তার৷ যাক এই প্রবল ঠান্ডার মধ্যে এতটা পথ আসা বিফলে যায়নি তার৷ ভাগ্যিস সেই বৃদ্ধ এই বাড়িটার কথা বলেছিল৷
বাড়ির ভিতর কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না৷ জানলার কাচের শার্সিগুলো পিছনে বিরাজ করছে জমাট বাঁধা অন্ধকার৷ কোনো শব্দও নেই বাড়ির ভিতর৷ অথচ সদর দরজা ভিতর থেকেই বন্ধ৷ অর্থাৎ লোক আছে বাড়িতে৷ তাপস প্রথমে দু-বার হালকা টোকা দিল দরজাতে৷ না, কোনো সাড়া পাওয়া গেল না৷ এর পর আবার টোকা মারল সে, একটু জোরে৷ এবারও কোনো সাড়া মিলল না৷ তৃতীয় বার বেশ জোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে তাপস একটু গলা তুলে বলল, ‘এই যে শুনছেন, বাড়িতে কেউ আছেন?’ তার গলার শব্দে আর দরজা ধাক্কানোর শব্দে কাছের ইউক্যালিপ্টাস গাছ থেকে কী একটা পাখি ডানা মেলে উড়ে গেল বিষণ্ণ চাঁদের দিকে৷ কয়েক মুহূর্ত একদম নিস্তব্ধ৷ তার পর তাপস যখন আবার দরজায় ধাক্কা দিতে যাচ্ছে ঠিক তখনই তার মনে হল একটা অস্পষ্ট শব্দ যেন ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে বন্ধ দরজার ওপাশে৷ কান খাড়া করল তাপস৷ হ্যাঁ, একটা শব্দ! ঠিক দরজার ওদিকে এসে শব্দটা থেমে গেল৷ আবার কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা৷ তার পরেই একটা শব্দ তুলে খুলে গেল ভারী কাঠের দরজা৷ তাপস দেখল দরজার কয়েক হাত তফাতে অন্ধকার ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক৷ তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না৷ শুধু তার অবয়বটুকুই বোঝা যাচ্ছে৷ তাপস তাকে দেখে বলল, ‘মিস্টার সান্যাল আছেন? আমি একটা ক্যুরিয়ার কোম্পানি থেকে আসছি৷ তাঁর নাম পার্সেল আছে৷’ তার কথা শুনে কোনো উত্তর দিল না সেই ছায়ামূর্তি৷ তাপসের মনে হল সে যেন তার ঘাড়টা একটু নাড়াল৷
তাপস এরপর বলল, ‘তাঁকে একটু ডেকে দেবেন৷ পার্সেলটা নিতে হলে সইসাবুদের একটা ব্যাপার আছে৷’ লোকটা এবারও মুখে কিছু বলল না, শুধু ইশারায় তাপসকে দাঁড়াতে বলে এগিয়ে এসে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিল৷
তাপস দাঁড়িয়ে রইল বাইরে৷ মনে মনে সে ভাবল, ‘লোকটা কেমনরে বাবা! কোনো কথা বলল না, তারপর দরজার পাল্লাটা তার মুখের ওপর এভাবে দিয়ে দিল!’ বাইরে তুষারপাত আরও বাড়ছে৷ তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডা বাতাস৷ ঠান্ডাতে জমে যাচ্ছে তাপস৷ মিনিট চার দাঁড়িয়ে থাকার পর বাড়ির ভিতর থেকে একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘ভিতরে আসুন৷’ দরজার পাল্লা ঠেলে বাড়ির ভিতর পা রাখল তাপস৷ প্রথমে একটা অন্ধকার ঘর৷ সেই ঘরের ওপাশে অন্য একটা ঘর থেকে মৃদু আলোক রেখা ভেসে আসছে৷ তাপস এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সেই ঘরের দরজায়৷ দরজার সোজাসুজি একটা টেবিল রাখা আছে ঘরের মাঝখানে৷ সেই টেবিলের ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছে৷ টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন ড্রেসিং গাউন পড়া পক্ককেশ এক ভদ্রলোক৷ তাপস দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি ইশারাতে ঘরের মধ্যে ঢুকতে বললেন তাকে৷
কাঠের ওপর দামি কার্পেট বিছানো ঘরের মেঝেতে পা রাখল তাপস৷ ভিতরে ঢুকেই সে অবাক হয়ে গেল৷ ঘরের চারদিকে দেওয়ালে টাঙানো আছে বিচিত্র সব মুখোশ৷ ঘরটা ঠিক যেন একটা মিউজিয়াম! ধীর পায়ে তাপস টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক ঠিক তাঁর মুখোমুখি একটা গদি আঁটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন৷ বাইরে ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকতে নিশ্চয়ই বেশ কষ্ট হল আপনার৷’ ভদ্রলোকের বেশ ভরাট গলা৷ তার বাচনভঙ্গিতেও বেশ একটা আভিজাত্য আছে৷
মৃদু হেসে তাপস চেয়ারটাতে বসল৷ তারপর পার্সেলটা টেবিলে রেখে ভদ্রলোকের উদ্দেশে বলল, ‘আমি তাপস বসু৷ কলকাতা থেকে আসছি৷ আপনি নিশ্চয়ই মিস্টার এম. এম. সান্যাল৷ আপনার জন্য এই পার্সেলটা আছে৷ কলম্বিয়া থেকে এসেছে৷’
ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ আমিই সেই লোক৷’ এই বলে তিনি এক বার তাকালেন টেবিলের ওপরে রাখা পার্সেলের দিকে৷ তাপস লক্ষ করল সে দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাঁর মুখবয়বে কোনো পরিবর্তন হল না৷ পার্সেলটা যে আসবে তা যেন জানাই ছিল তার৷
পকেট থেকে চালানের কাগজ বার করে ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাপস বলল, ‘পার্সেলের নম্বরের সাথে নম্বর মিলিয়ে চালানটাতে একটা সই করতে হবে৷’
কাগজটা হাতে নিয়ে বাক্সটা কাছে টেনে নম্বরটা মেলালেন ভদ্রলোক৷ তারপর কলমদানি থেকে একটা কলম তুলে কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে সই করতে লাগলেন৷ সেই সুযোগে তাপস একবার ভালো করে দেখল ভদ্রলোককে৷ তার বয়স সত্তরের বেশিই হবে৷ এই বয়সেও বেশ বলিষ্ঠ চেহারা৷ গায়ের রং একসময় বেশ ফর্সাই ছিল মনে হয়, এখন তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে৷ প্রশস্ত ললাট৷ টিকালো নাক, নিখুঁতভাবে কামানো মুখমণ্ডল৷ তবে, তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন বিষণ্ণ! যেসব বয়স্ক মানুষ নিঃসঙ্গতায় ভোগেন, তাদের চোখের দৃষ্টি যেমন হয় ঠিক সেরকম৷ ঘরটার দিকেও একঝলক তাকাল তাপস৷ রুচি আর আভিজাত্যের ছাপ ছড়িয়ে আছে ঘরে৷ দেওয়ালে নানারকম মুখোশ তো আছেই, পায়ের তলায় দামি কার্পেট, একপাশে ওক কাঠের বেশ কয়েকটা বড়ো আলমারি-ভরতি বই, সাবেক আমলের সোফাসেট, টেবিলের ওপর মোমদানিটাও মনে হয় রুপোর তৈরি৷ ফায়ারপ্লেসটিতে কাঠকয়লার আঁচ জ্বলছে৷ কারুকাজ করা ফায়ারপ্লেসের মাথার ওপর বসানো আছে বেশ বড়ো পিতলের মূর্তি৷ মনে হয় অ্যান্টিক হবে৷
সই করে কাগজটা তাপসের হাতে দিলেন ভদ্রলোক৷ গোটা হরফে পুরো নাম সই করেছেন-‘মৃগাঙ্ক মোহন সান্যাল’৷ পুরো নামটা দেখে তাপসের হঠাৎ কেন জানি মনে হল, এ নাম যেন আগে কোথাও শুনেছে বা পড়েছে৷ যাই হোক, সইটা ঠিক মতো হয়েছে কি না তা দেখে নিয়ে কাগজটা ভাজ করে পকেটে রাখল তাপস৷ তার কাজ হয়ে গেছে৷ এবার উঠতে হবে তাকে৷ তাই তাপস ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ধন্যবাদ৷ আমি তাহলে এখন উঠি?’
ভদ্রলোক তাকিয়ে ছিলেন কাচের শার্সিওয়ালা জানলার দিকে৷ তাপসের কথা শুনে বললেন, ‘কিন্তু আপনি এখন যাবেন কী করে? বাইরে তো তুষারপাত আর ঝড় শুরু হয়েছে৷ আপনি বরং একটু বসে যান৷’ তাপস তাকাল জানলার দিকে৷ বাইরের শব্দ ঘরের মধ্যে না ঢুকলেও তাপস দেখল বাতাসের প্রবল ধাক্কায় জানলার কাচের শার্সিগুলো থরথর কাঁপছে৷ মৃগাঙ্ক মোহনের কথা শুনে সে উঠতে গিয়েও থমকে গেল৷ সত্যিই তো এ অবস্থায় বাইরে সে কী করে বেরোবে! কিন্তু তুষারপাত আর ঝড় যদি না থামে তবে? এ কথা ভেবে মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেল তাপস৷
মৃগাঙ্ক মোহন মনে হয় তার মনের ভাব বুঝতে পারলেন৷ তাই তিনি বললেন, ‘এই ঝড় বেশিক্ষণ হয় না৷ সম্ভবত কিছুক্ষণের মধ্যেই থেমে যাবে৷’
তাপস বলল, ‘তা হলেই ভালো৷ আসলে, পাহাড়ি পরিবেশে আমরা ঠিক অভ্যস্ত নইতো৷ তুষারপাত আমি এই প্রথম দেখলাম৷’
মৃগাঙ্গ মোহন মৃদু হাসলেন৷ তারপর ধীর কন্ঠে বললেন, ‘জানেন, অনেক অনেক দিন আগে এরকমই এক রাতে জনমানব শূন্য উরাল পর্বতের ঢালে, সারা রাত তুষারপাতের মধ্যে একলা কাটিয়ে ছিলাম আমি৷ তিন ফুট তুষারের চাদরের নীচে ঢেকে গেছিল আমার দেহ৷ বাঁচার কোনো আশাই ছিল না৷ নেহাত ভাগ্যের জোরে পর দিন দুপুরে স্থানীয় ঘোড়াওয়ালারা আমাকে বরফের নীচ থেকে উদ্ধার করে৷’
আপনি কি মাউন্টেনিয়ার ছিলেন?’ তাপস প্রশ্ন করল৷
ভদ্রলোক বলল, ‘না, অনেক পাহাড়ে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু মাউন্টেনিয়ার বলতে যা বোঝায় তা আমি ছিলাম না৷’ একটু চুপ করে থাকার পর মৃগাঙ্ক মোহন বললেন, ‘আসলে আমি ছিলাম একজন ভূ-পর্যটক অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে গ্লোব ট্রটার৷
মৃগাঙ্ক মোহনের কথা এবার হঠাৎই যেন তাপসের স্মৃতির তন্ত্রীতে ঘা দিল৷ কেন ‘মৃগাঙ্ক মোহন’ নামটা তার চেনা মনে হচ্ছিল তা বুঝতে পারল সে৷ কয়েক মুহূর্ত আশা-নিরাশার দোলা চালে থাকার পর তাপস তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, আপনি কি পর্যটকের ডায়েরি বলে একটা বই লিখেছিলেন?’
একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল মৃগাঙ্ক মোহনের ঠোঁটের কোণে৷ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওটা আমার লেখা৷’
চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠতে যাচ্ছিল তাপস কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘ওটা তো একটা বিখ্যাত বই! আমি ছোটোবেলা থেকে আজ পর্যন্ত অনেক বার পড়েছি আপনার ওই ভ্রমণ কাহিনি৷ আমি ভাবতেই পারছি না আপনার মতো বিখ্যাত লোকের সামনে আমি বসে আছি!’
মৃগাঙ্ক মোহনের চোখ দুটো এবার যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল৷ তিনি বললেন, ‘আপনি পড়েছেন বইটা! আমি কিন্তু নিজে বই আকারে লেখাটা চোখে দেখিনি! ভুলেই গেছিলাম ওই লেখার কথা৷ এত বছর পর আবার আপনার মুখে সে বইয়ের কথা শুনলাম!’
তাপস একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনার লেখা বই আপনি দেখেননি কেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘আমি বিদেশ থেকে ডাকে পাঠিয়েছিলাম লেখাগুলো৷ প্রকাশক ছেপে ছিলেন৷ আমি বইটা হাতে পাইনি৷ আমার কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না, যেখানে তিনি বইটা পাঠাতে পারতেন৷ তা বইটা আপনার ভালো লেগেছিল?’ এই বলে তাপসের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি৷
তাপস বলে উঠল, ‘শুধু আমার কেন, যারা বইটা পড়েছেন প্রত্যেকেরই অসাধারণ ভালো লেগেছে আপনার লেখা৷ কী সুন্দর আপনার লেখনশৈলী! কী সুন্দর বিবরণ! সবাই তো বলেন, ভ্রমণ সাহিত্যের ক্ষেত্রে আপনার বই একটা ল্যান্ডমার্ক!’ এরপর একটু বিমর্ষ হয়ে সে বলল, ‘তবে আমি কিন্তু আপনার বইয়ের প্রথম খণ্ডটাই পড়েছি৷ মানে ওই আমেরিকা ভ্রমণ পর্যন্ত৷ অন্য খণ্ডগুলো আর পড়া হয়নি৷’
তাপসের কথা শুনে মৃগাঙ্ক মোহন চুপচাপ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে৷ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ভাবে কেটে গেল৷ তাপস একবার তাকাল জানালার দিকে৷ একটা ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে৷ ঝড়ের সাথে সাথে বরফের কুচিও এসে আঘাত করছে জানলার কাচে৷ এরপর তাপস আবার তাঁকে প্রশ্ন করল, ‘আপনার লেখাটা কিন্তু আমার মনে আছে৷ আচ্ছা, আপনার লেখার মধ্যে যে আরবে মরুঝড়ের মুখোমুখি হওয়া বা নীলনদে কুমিরের সাথে লড়াই করা, ইত্যাদি রোমহর্ষক কাহিনির বর্ণনা আছে, সেসব কি সত্যি! না কি লেখার প্রয়োজনেই ও সব লিখে ছিলেন আপনি?’
পার্সেলটা কাছে টেনে নিলেন মৃগাঙ্কমোহন৷ টেবিলের উপর রাখা একটা পেনসিল কাটার ছুরি তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে পার্সেলের কাপড়টা কাটতে কাটতে তিনি বললেন, ‘যা পড়েছেন সব সত্যি৷ লেখার প্রয়োজনে কোনো কিছু বানিয়ে লিখিনি আমি৷ যা পড়েছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি রোমহর্ষক ঘটনা এরপর আমার জীবনে ঘটেছিল৷’
তাপস শুনে বলল, ‘তাই নাকি, সেটা কি আপনার বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখেছিলেন? নিঃশব্দে হেসে মৃগাঙ্ক মোহন বললেন, ‘না৷ সেখানে লিখিনি আমি৷ কারণ, লেখার কথা থাকলেও সে খণ্ড আর লেখা হয়নি আমার৷’
তাপস একটু বিস্মিত হয়ে বলল, ‘ও দ্বিতীয় খণ্ডটা আর প্রকাশই হয়নি৷ সেটা আর লিখলেন না কেন আপনি?’
পার্সেলের ওপরের কাপড়গুলো খুলে ফেললেন মৃগাঙ্ক মোহন৷ তার ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে কালো রঙের পালিশ করা কাঠের বাক্স৷ ছোট্ট একটা ডালা আছে তাতে৷ বাক্সটা যে অনেক পুরোনো তা দেখেই বোঝা যাচ্ছে৷ কাপড়গুলো খুলে ফেলার পর মৃগাঙ্ক মোহন পরম মমতায় তার গায়ে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, ‘জানেন, এ বাক্সটা অনেক অনেক দূর থেকে এসেছে৷ তবে আসতে অনেক দেরি হল৷ কত বছর ধরে এর জন্য প্রতীক্ষা করে আছি আমি৷’
‘হ্যাঁ জানি, কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা থেকে৷’
বাক্সটার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে ভদ্রলোক অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, বোগোটা৷ সেখানেই তো ঘটেছিল আমার ভ্রমণ পথের সবচেয়ে রোমহর্ষক-রোমাঞ্চকর ঘটনাটা৷ যা কোথাও লেখা হয়নি আমার৷’-এই বলে চুপ করে গেলেন তিনি৷
বাইরে ঝড়ের বিরাম নেই৷ জানলার শার্সিগুলো কেঁপেই চলেছে৷ তার ঘরের মধ্যে এখন বেশ আরাম লাগছে তাপসের, ফায়ার প্লেসের আঁচে তার শীত শীত ভাবটা কেটে গেছে৷ শুধু তার একটাই ভয়৷ ঝড় থামলে ম্যালের হোটেলগুলোর দরজা বন্ধ হয়ে যাবে না তো? তবে বাইরে যা অবস্থা তাতে এখন বেরোনো তার পক্ষে অসম্ভব৷ ঝড় না থামা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে৷
কিছুটা তার সামনে বসে থাকা বিখ্যাত পর্যটকের মুখ থেকে কাহিনির শোনার লোভে, আর কিছুটা সময় কাটাবার জন্য এরপর তাপস মৃগাঙ্ক মোহনের উদ্দেশে বলল, ‘বোগোটা শহরে ভ্রমণের সময় যে রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছিল সে কাহিনি আমাকে বলবেন?’
মৃগাঙ্ক মোহন তাকিয়ে ছিলেন বাক্সটার দিকে৷ তাপসের কথা শুনে তিনি যেন একটু চমকে উঠে তাকালেন তার দিকে৷ তারপর তাপসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি সত্যি শুনতে চান সেই কাহিনি? অবশ্য এই পার্সেলটা যখন আপনি এনেছেন, তখন সে কাহিনি অন্তত আপনাকে জানানো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে৷ কিন্তু শুনে আপনি ভয় পাবেন না তো?’
প্রশ্ন শুনে তাপস এবার হেসে ফেলে বলল, ‘আমাকে কি আপনি একদম বাচ্চা ছেলে ভাবলেন! আপনি বলুন-‘
মৃগাঙ্ক মোহনের মুখে ফুটে উঠল একটা চাপা হাসির রেখা৷ তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে শুনুন?’ কয়েক মিনিট চুপ করে কী যেন ভাবার পর মৃগাঙ্ক মোহন বলতে শুরু করেন তাঁর কাহিনি৷
‘আমেরিকা ভ্রমণ শেষ করে মেক্সিকো, গুয়াতোমালা, এল সালভাদর হয়ে, নিকারাগুয়ার সামান্য অংশ ছুঁয়ে, হন্ডুরাসের মধ্যে দিয়ে কোস্টারিকা পৌঁছোতে আমার মাস দুই সময় লেগেছিল৷ বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল সে পথে৷ কিন্তু সে গল্পে আমি যাচ্ছি না৷ কোস্টারিকাতে একটা হপ্তা কাটিয়ে একটা আদ্যিকালের পালতোলা মালবাহী জাহাজের কোলে চেপে সামান্য পানামা যোজক পার হয়ে কলম্বিয়ার মাটিতে পা রেখেছিলাম আমি৷ প্রথমে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম মেডেলিন শহরে৷ তারপর আরও এগিয়ে ম্যাগদালেন নদী অতিক্রম করতেই আমার পথ আটকে দাঁড়াল আন্দিজের গিরিশিরা৷ জনমানবহীন আন্দিজের কন্দরে আমি একমাত্র মানুষ৷ একটা শকুন পর্যন্ত চোখে পড়েনি সে পথে৷ কীভাবে যে আমি আন্দিজের সেই দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অতিক্রম করেছিলাম তা আমিই একমাত্র জানি৷ অবশেষে কলম্বিয়ার ভূ-খণ্ডে পা রাখার সাতাশ দিন পর আমি উপস্থিত হলাম তার রাজধানী বোগোটা শহরে৷’
একটু দম নিয়ে ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আজকের বোগোটা শহর অনেক উন্নত হলেও সে সময় বোগোটা ছিল পাহাড়ের ওপর অবস্থিত একটা ছোট্ট শহর৷ সোনা আর পান্না ব্যবসায়ী কিছু ইউরোপিয়ান বাস করত শহরের কেন্দ্রস্থলে৷ আপনি হয়তো জানেন যে পৃথিবীর অর্ধেক পান্না কলম্বিয়াতে পাওয়া যায়৷ আর সেখানে বাস করত মাথায় ইগলের পালকের সাজ আর বিচিত্র পোশাক পরা রেড ইন্ডিয়ানরা৷ সংখ্যায় তারা প্রচুর৷ শহরের উপকন্ঠে তারা চাষাবাদ করত৷ কেউ কেউ আবার কাজ করত ইউরোপিয়ানদের বাড়িতে৷
যাই হোক বোগোটা পৌঁছে আমি মনস্থির করলাম, একটা মাস সেখানে কাটাব আমি৷ আন্দিজ পার হতে যে ধকল গেছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য একটা মাস বিশ্রামের প্রয়োজন৷ তারপর রওনা হব ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকার দিকে৷ আমার সিদ্ধান্তমতো বোগোটাতে থাকার জন্য এক ইউরোপিয়ানের ফাঁকা বাড়ি ভাড়া নিলাম আমি৷ একজন যুবক রেড ইন্ডিয়ান চাকরও জুটে গেল-পাচামাকি৷ বেশ শান্ত প্রকৃতির ছেলে৷ ইউরোপিয়ানদের সংস্পর্শে খ্রিস্ট ধর্ম নিয়েছে৷ তবে স্বজাতীর সাথেও যোগাযোগ রেখে চলে৷ আমরা দু-জনে থাকতে শুরু করলাম সেই ছোট্ট বাড়িটাতে৷
‘কোনো কাজ নেই৷ খাই আর ঘুরে বেড়াই এখানে সেখানে৷ তখন বসন্ত কাল৷ মনোরম পরিবেশ চারপাশে৷ পাহাড়ের ঢালে ফুলের সমারোহ৷ বসন্ত কাল আবার সেখানে রেড ইন্ডিয়ানদের বিবাহের ঋতু৷ গভীর রাতে শহর লাগোয়া পাহাড়ের মাথার ওপর অবস্থিত ছোটো ছোটো গ্রামগুলো থেকে ভেসে আসত তাদের বিবাহ উৎসবের ঢাকের শব্দ৷’ আবার একটু থামলেন মৃগাঙ্ক মোহন৷ এই ফাঁকে একবার জানলার শার্সির দিকে তাকিয়ে নিল তাপস৷ না, ঝড়ের কোনো বিরাম নেই৷ বরং তা যেন বেড়েই চলেছে৷ মুহূর্ত খানেক চুপ করে থাকার পর মৃগাঙ্ক মোহন আবার বলতে আরম্ভ করলেন-
‘ভ্রমণের পাশাপাশি আমার অন্য একটা নেশা ছিল৷ সে নেশা হল মুখোশ সংগ্রহের৷ এই যে দেওয়াল জুড়ে নানা ধরনের মুখোশ দেখছেন তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম আমি৷ ডান দিকের বুক কেসের পাশে যে সিংঅলা মুখোশটা আছে ওটা সাইবেরিয়ার৷ ওই সিং আর চামড়া বল্গা হরিণের৷ আর ওই যে ডান দিকের দেওয়ালে লম্বাটে দেখতে কাঠের মুখোশটা ওটা হন্ডুরাসের এক উপজাতীয়দের৷
‘বোগোটা শহরে বাস করার সময় রেড ইন্ডিয়ানদের মুখোশ সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে একদিন শুনতে পেলাম তাদের কাছে নাকি এক অদ্ভুত ধরনের মুখোশ পাওয়া যায়৷ সে ব্যাপারে আরও একটু খোঁজ নেবার পর এক বৃদ্ধ রেডি ইন্ডিয়ানের কাছে দেখলামও সেটা৷ জিনিসটা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম৷ মুখোশের মতো দেখতে হলেও সেটা আসলে মুখোশ নয়, সেটা মানুষের কুঁচকানো মাথা, শ্রাঙ্কেন হেড৷
তাপস বিস্ময়ে বলে উঠল, ‘সত্যিকারের মানুষের মাথা!’
মৃগাঙ্কমোহন বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যিকারের মানুষের মাথা৷ একরাশ চুলওয়ালা, মুখোশের মতো দেখতে মানুষের কুঁচকানো মাথা৷ চুল ছাড়াও তার দাঁত ঠোঁট নাক সব থাকে৷ শুধু চোখের পাতা দুটো সুতো দিয়ে সেলাই করা থাকে, যাতে অশুভ আত্মা তার মধ্যে প্রবেশ না করতে পারে৷ পরে অবশ্য বোগোটাতেই এক ইয়োরোপিয়ানের মুখে শুনেছিলাম কীভাবে শ্রাঙ্কেন হেড তৈরি করা হয়৷ রেড ইন্ডিয়ানরা বিজাতীয় লোককে সুবিধামতো পেলে তার মুণ্ডুসমেত গলা কেটে নেয়৷ তারপর সেই মাথার ভিতর থেকে চোখ-ব্রেন ইত্যাদি পচনশীল বস্তু বার করে ফেলে গরম পাথর ভরে দেয় সেখানে৷ এভাবে মাথাটাকে যাবজ্জীবন তারা রেখে দিতে পারে৷ পাথর ভরার ফলে মাথাটা ছোটো হয়ে কুঁচকে যায় ঠিকই কিন্তু তার অবয়ব মোটামুটি অবিকৃত থাকে৷ মাথার চুল আরও ঘন মনে হয়৷
‘বৃদ্ধ রেড ইন্ডিয়ানের কাছে ওই অদ্ভুত জিনিসটা দেখার পর সেটা সংগ্রহের ইচ্ছা জাগল আমার৷ কিন্তু সেই রেড ইন্ডিয়ান ভয়ে কিছুতেই সেটা আমাকে বিক্রি করতে রাজি হল না৷ কারণ, সরকারি আইন, কোনো রেড ইন্ডিয়ানের কাছে শ্রাঙ্কেন হেড পাওয়া গেল তাকে ফাঁসিতে লটকানো হবে৷ যদিও ইউরোপিয়ান বা বিদেশিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়, তবু তার ভয় হল, যদি আমি তার কথা কোথাও বলে ফেলি! কিন্তু শ্রাঙ্কেন হেডটা দেখার পর থেকেই, ওরকম একটা মাথা জোগাড় করার ইচ্ছা আমাকে ভীষণভাবে পেয়ে বসল৷ পাচামাকির মুখে শুনলাম, তার বাপ-ঠাকুরদার আমলে নাকি রেড ইন্ডিয়ান যুবকরা শ্রাঙ্কেন হেড যৌতুক দিত কন্যাকে৷ তার বাবাও দিয়েছিলেন তার মাকে৷ বসন্ত কালে বিবাহ ঋতুতে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত রেড ইন্ডিয়ান যুবকেরা৷ তারা লুকিয়েও থাকত পাহাড়ের নির্জন পথে৷ সে পথে একা কোনো ইউরোপিয়ানকে পেলে, ধারাল কুঠারের এক কোপে তার মুণ্ডু কেটে নিত৷ বহু ইয়োরোপিয়ানের বা ভিনদেশি মানুষের প্রাণ গেছে তাদের হাতে৷ এখন অবশ্য সরকারি আইনের ফলে সে প্রথা লোপ পেয়েছে৷ নিজেরাও অনেকটা সভ্য হয়েছে তারা৷ তবে প্রথা বজায় রাখতে এখন কাগজের তৈরি প্রতীকি মাথা যৌতুক দেয় রেড ইন্ডিয়ানরা৷
‘যাই হোক, একটা শ্রাঙ্কেন হেড জোগাড় করার ইচ্ছাটা ক্রমেই বেড়ে চলল আমার৷ অনেক চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমি সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়ে, শেষ পর্যন্ত আমি পাচামাকিকে বললাম সে যদি আমাকে সেটা সংগ্রহ করে দেয় তাহলে আমি তাকে মোটারকম বকশিস দেব৷ একটু দোনোমনো করে শেষ পযন্ত সে রাজি হয়ে গেল৷ কিন্তু সে বলল, তার জন্য দিন দু-একের ছুটি নিয়ে তাকে গ্রামে যেতে হবে৷ আমি সানন্দে তাকে ছুটি দিয়ে দিলাম৷ কিছু আগাম অর্থও দিলাম৷ সে গ্রামে চলে গেল৷
‘আমি তার প্রতীক্ষায় বসে রইলাম৷ কিন্তু দু-দিন কেটে যাবার পরও সে ফিরল না৷ তারপর একটা-একটা করে দিন কাটতে লাগল৷ এদিকে আমার বোগোটা ত্যাগ করার সময়ও এগিয়ে আসছে৷ তার ফেরার আশা ত্যাগ করলাম আমি৷ এক মাস বোগোটাতে থাকার পর যেদিন আমার সে শহর ত্যাগ করার কথা, ঠিক তার আগের দিন দুপুরে হঠাৎ ফিরে এল পাচামাকি৷ কিন্তু তার পরনে ইউরোপিয়ান বেশের পরিবর্তে রেড ইন্ডিয়ানদের সেই বিচিত্র পোশাক! মাথায় পালকের সাজ, কোমড়ে ঝুলছে কুঠার! সে আমাকে জানাল, খ্রিস্ট ধর্ম ত্যাগ করে বাপ-ঠাকুরদার সনাতন ধর্মে আবার ফিরে গেছে সে৷ গ্রামে একটা মেয়ে দেখেছে সে৷ তাকে বিয়ে করে গ্রামেই থাকবে৷ তবে এখন সে এসেছে, আমাকে দেওয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখতে৷ একটা শ্রাঙ্কেন হেডের সন্ধান পেয়েছে সে৷ সেটা নিতে হলে আমাকে তার সাথে সে দিনই রেড ইন্ডিয়ানদের গ্রামে যেতে হবে৷’
তন্ময় হয়ে মৃগাঙ্ক মোহনের গল্প শুনতে লাগল তাপস৷ তিনি তারপর বলে চললেন, ‘শ্রাঙ্কেন হেডের ব্যাপারে আমার এত আগ্রহ ছিল যে আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম৷ ও যেখানে আমাকে নিয়ে যাবে বলল, সে গ্রাম আমার বাসস্থান থেকে মাত্র মাইল চারেক দূরে একটা পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত৷ ঠিক করলাম, বিকালে সেখানে গিয়ে রাতে ফিরে আসব৷ তারপর পরদিন রওনা হব আমাজন উপত্যকার উদ্দেশ্যে৷ পরদিন নতুন পথে যাত্রা শুরু করার জন্য কিছু গোছগাছের প্রয়োজন ছিল আমার৷ সারাটা দুপুর ধরে সে কাজে আমাকে সাহায্য করল পাচামাকি৷ সে আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিল, মালপত্র বাঁধাছাঁদা করল, জুতো পালিশ করল৷ সব কাজ শেষ হবার পর বিকাল বেলা আমি তার সাথে যাত্রা করলাম তার গ্রামের দিকে৷
বসন্তের সুন্দর বিকেল৷ পাহাড়ের ঢালে নাম-না-জানা নানা ফুল ফুটেছে৷ বাতাসে ভাসছে তাদের মন পাগল করা সৌরভ৷ যাত্রা পথে হয়তো কখনো চোখে পড়ছে রেড ইন্ডিয়ানদের কুটির৷ ছোটো ছোটো শিশুরা খেলছে সেখানে৷ কোনো সময় দেখা হচ্ছে কোনো রেড ইন্ডিয়ান শিকারির সাথে৷ বল্লমের মাথায় গাঁথা ছাই রঙের জংলি খরগোশ৷ এ সব দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম আমি৷ তবে পাচামাকি গ্রামটা যে দূরত্বে বলেছিল তার চেয়ে বেশ কিছুটা দূর বলে মনে হল আমার৷ যখন গ্রামে পৌঁছোলাম তখন সন্ধ্যে৷
গ্রামে মানে গোটা পনেরো কুঁড়েঘর৷ জনা তিরিশেক নানা বয়সি রেড ইন্ডিয়ান নারী-পুরুষ বাস করে সেখানে৷ পাচামাকির সাথে আমি সেখানে উপস্থিত হতেই কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরিয়ে আমাদের চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল তারা৷ সেই দলের মধ্যে যেমন মাথায় ইগলের পালকের সাজওয়ালা, মুখমণ্ডলে অসংখ্য বলিরেখা আঁকা দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ, তেমনই আছে পাচামাকির মতো যুবক বা মাথায় দুটো মাত্র পালক গোজা, লম্বা বেনীঅলা রেড ইন্ডিয়ান যুবতীরা৷ এমনকী কাঠের চুষি কাঠি হাতে কয়েকটা বাচ্চাও সেই দঙ্গলে চোখে পড়ল আমার৷ তারা আমাকে দেখে নিজেদের মধ্যে তাদের ভাষায় কী যেন বলাবলি করতে লাগল, তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারলাম না আমি৷ সেই ভিড় ঠেলে পাচামাকি আমাকে নিয়ে ঢুকল একটা কুঁড়েঘরের মধ্যে৷ আমাকে সে সেই ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করতে বলে বাইরে চলে গেল৷ আমি বসে রইলাম সেখানে৷ বাইরে অন্ধকার নেমে এল৷ এক ঘণ্টা পর সে ফিরে এসে বলল, চলুন এবার বাইরে যাব৷ একটা অনুষ্ঠান হবে৷ সেটা শেষ হলে মাথাটা যেখানে আছে, সেখানে আপনাকে নিয়ে যাব৷
‘বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশে ধীরে ধীরে চাঁদ উঠছে৷ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিভুজাকৃতির কুঁড়েঘরগুলোর ঠিক মাঝখানে খোলা আকাশের নীচে জ্বালানো হয়েছে একটা অগ্নিকুণ্ড৷ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুখে বিচিত্র উলকি আঁকা রেড ইন্ডিয়ান পুরুষরা৷ তাদের প্রত্যেকের কোমরে রয়েছে ছোটো আকৃতির ধারাল কুঠার৷ আর তার কিছু দূরে মাটিতে ভিড় করে বসে আছে মহিলারা৷ দু-জন ঢাক বাদকও সেজেগুজে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে৷ বাইরে বেরিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম অগ্নিকুণ্ড থেকে একটু দূরে একটা পাথরের ওপর৷
‘আমরা সেখানে গিয়ে বসার পর একজন দীর্ঘদেহী সর্দার মতো রেড ইন্ডিয়ান দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন নির্দেশ দিল৷ তখন আগুনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ইন্ডিয়ানরা নিজেদের কোমর থেকে কুঠার খুলে নিয়ে অগ্নিকুণ্ড ঘিরে সার বেঁধে দাঁড়াল৷ বেজে উঠল ঢাক৷ ঢাকের তালে আর সংগীতের ছন্দে নৃত্য শুরু করল তারা৷ কখনো আকাশের দিকে মাথা তুলে কুঠার উচিয়ে, কখনো মাটির দিকে ঝুঁকে অগ্নিকুণ্ডকে বৃত্তাকারে পাক খেতে লাগল সকলে৷ প্রথমে ধীর গতিতে, তারপর দ্রুত লয়ে৷ চাঁদের আলোতে বসে আমি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম রেড ইন্ডিয়ানদের সেই অদ্ভুত নৃত্য৷ তাদের বিচিত্র সংগীত আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ের গায়ে৷ নাচ দেখতে দেখতে আমি পাচামাকিকে জিজ্ঞেস করলাম, এ নাচ কীসের জন্য? পাচামাকি আমার কথা শুনে সলজ্জে বলল, সামনের চন্দ্রমাসের পাঁচ তারিখে আমার বিয়ে৷ প্রাক বিবাহ উৎসব পালন করা হচ্ছে এই নাচের মাধ্যমে৷ মেয়েদের দঙ্গলে বসে থাকা তার নববধূকে সে আঙুল দিয়ে আমাকে দেখিয়েও দিল৷ এর কিছুক্ষণ পর যারা নাচছিল তাদের মধ্যে একজন বেরিয়ে এসে আমার পাশে বসে থাকা পাচামাকিকেও তাদের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল৷ কোমর থেকে কুঠার খুলে নিয়ে সেও তাদের সাথে নৃত্য শুরু করল৷ একলা বসে রইলাম আমি৷ সময় এগোতে লাগল৷ নেচে চলল পাচামাকি৷
‘একসময় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে৷ জিনিসটা নিয়ে আমাকে ফেরার পথ ধরতে হবে৷ আর দেরি হলে ফেরা যাবে না৷ ব্যাপারটা ভেবে নৃত্যরত পাচামাকির দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য উঠে দাঁড়ালাম আমি৷ তখন নাচের ছন্দ একদম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ রেড ইন্ডিয়ানদের ছন্দবদ্ধ সমবেত পদাঘাতে কেঁপে উঠছে মাটি৷ তাদের চিৎকার আর ঢাকের শব্দ পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে! আমি উঠে দাঁড়াবার পর মনে হয় আমাকে লক্ষ করল পাচামাকি, এবং সম্ভবত উঠে দাঁড়াবার কারণও অনুধাবন করল সে৷ তাই কিছুক্ষণের মধ্যে দল ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমাকে সে বলল, এবার চলুন৷ আপনার জিনিসটা এবার দিয়ে দিই- আমি বললাম, হ্যাঁ, চলো অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ এখন কোথায় যেতে হবে? কিছু দূরে পাহাড়ের খাদের ধারে একদম একলা দাঁড়িয়ে আছে একটা কুঁড়েঘর৷ সেটা দেখিয়ে পাচামাকি বলল, ওই যে আমার নতুন ঘর৷ বিয়ের পর ওখানেই থাকব আমি! ওই ঘরেই রাখা আছে মুণ্ডুটা৷ আসুন আমার সাথে-! পাচামাকির পিছন পিছন আমি গিয়ে দাঁড়ালাম সেই কুঁড়েঘরের সামনে৷ ইঙ্গিতে আমাকে তার ভিতরে প্রবেশ করতে বলল সে৷ প্রথমে ঘরের ভিতর পা রাখলাম আমি৷ আমার পিছন পিছন পাচামাকি৷ ঠিক সেই মুহূর্তেই বাইরে থেমে গেল রেড ইন্ডিয়ানদের চিৎকার আর ঢাকের শব্দ৷ ছোট্ট ঘরটাতে কোনো আলো জ্বলছে না৷ শুধু খোলা দরজা দিয়ে কিছুটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতর৷ ঘরে ঢুকে আমি পিছন ফিরে পাচামাকিকে বললাম, কোথায় জিনিসটা? আমার কথার উত্তরে পাচামাকি তার বেঁটে কুঠার সমেত হাতটা তার মাথার ওপর তুলে ধরে হেসে বলল, ওই যে ওই দেওয়ালের দিকে তাকান, ওখানে দেওয়ালের কোণে সেটা রাখা আছে৷ মুখ ফিরিয়ে ঘাড়টা একটু ঝুঁকিয়ে তাকালাম সামনের আধো-অন্ধকার দেওয়ালের দিকে৷’
এ পর্যন্ত বলে হঠাৎই চুপ করে গেলেন মৃগাঙ্ক মোহন৷ তাপস তন্ময় হয়ে তার কাহিনি শুনছিল৷ মৃগাঙ্ক মোহন থেমে যেতেই তাপসের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘তারপর?’
কয়েক মুহূর্ত তাপসের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি জবাব দিলেন, ‘তারপর এই যে-৷’
তাপস গল্প শুনতে শুনতে খেয়াল করেনি, কখন যেন তিনি বাইরে বার করে ফেলেছেন বাক্সর ভিতরে রাখা জিনিসটা! মৃগাঙ্ক মোহনের কথা শুনে তাপস তাকাল টেবিলের ওপর তাঁর হাতে ধরা জিনিসটার দিকে৷ সেটা দেখতে অবিকল যেন একটা মুখোশের মতো৷ ঘন কালো চুলওয়ালা কুঁকড়ে যাওয়া একটা মানুষের মুখ৷ নাক, ঠোঁট সব ঠিকই আছে শুধু তার চোখের পাতা দুটো সুতো দিয়ে সেলাই করা,-শ্রাঙ্কেন হেড! সেটা দেখে বিস্মিত হয়ে তাপস বলে উঠল, ‘এই মাথাটাই কি ছিল সেই ঘরের ভিতর? কার মাথা এটা? এরকম ঘন কালো চুল তো ইউরোপিয়ানদের থাকে না!’
একটা বিষণ্ণ হাসি ফুটে উঠল মৃগাঙ্ক মোহনের মুখে৷ আর ঠিক সেই সময় ঝড়ের ঝাপটে খানখান হয়ে গেল জানলার কাচের শার্সি৷ একরাশ ঠান্ডা বাতাসের ঝলকে নিভে গেল টেবিলে রাখা মোমবাতি৷ ঘর অন্ধকার হয়ে গেল৷ শুধু ফায়ার প্লেসের গনগনে আঁচের লাল আভা এসে পড়েছে মৃগাঙ্ক মোহনের মুখে আর তাঁর ডান হাতে ধরা শ্রাঙ্কেন হেডের ওপর৷ অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাপসের দিকে বিষণ্ণ হাসি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন তিনি৷ হঠাৎ যেন তাপসের মনে হল, এ দুই মুখের মধ্যে বড্ড বেশি মিল! চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তাপস৷ এর পরমুহূর্তে মৃগাঙ্কমোহন বাঁ-হাত দিয়ে তার নিজের ঘাড়ের ওপর থেকে একটানে তার মাথাটা খসিয়ে ফেললেন৷ ঘাড়ের ওপর শুধু জমাট বাঁধা অন্ধকার!
একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল তাপস৷ তারপর কোনো রকমে সেই অন্ধকার ঘর ছেড়ে ছিটকে বাইরে বেরোল৷ ঘরের ভিতর থেকে ভেসে এল মৃগাঙ্ক মোহনের গলা, ‘এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাচ্ছেন আপনি? গল্পটা তো পুরো বলাই হল না আপনাকে! সেই কুঁড়েঘরের ভিতর কী হল সেটা শুনে যান৷’
মৃগাঙ্ক মোহনের গল্পের বাকি অংশ শোনার জন্য তাপস আর সেখানে দাঁড়াল না৷ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সে ঝড়ের মধ্যেই ছুটতে শুরু করল৷