অধ্যায় ৮
কলির বিয়ে লাগল শ্রাবণ মাসেই। আষাঢ় মাসে বিয়ে হলে কন্যা ধনধান্য ভোগসুখরহিতা হয়, গৃহিণী কোট ধরেছিলেন আষাঢ়ে কোনমতেই বিয়ে চলবে না। শ্রাবণে কন্যা মৃতবৎসা হয় বলেও আপত্তির কারণ ছিল, কিন্তু সবাইকার আগ্রহের আতিশয্য দেখে ঠাকুরমশাই একটা নির্দোষ সর্বশুভংকর লগ্ন বার করেছেন ঠিক খুঁজে। কলির এম এ পরীক্ষা নভেম্বর মাসে। সে রাজি নয় একদম। ভীষণ কান্নাকাটি করছে। এ. কে. বি বলেছেন ভালো করে পড়াশোনা করলে হাই-সেকেন্ড ক্লাস তার বাঁধা। বিয়ের হুজুগে পড়াশোনা ডকে উঠলে সে নিজের মুখ, এ. কে. বি’র মুখ রাখতে পারবে না। তাছাড়াও অন্য একটা কথা আছে। কলি জোর করে নিজের হৃদয় থেকে একটি ভদ্র সুশ্রী মুখের আগ্রহদৃষ্টিকে নির্বাসিত করতে চায়। পারে না। ছাদে পায়চারি করতে করতে, পড়া মুখস্থ করতে করতে হৃদয় উদ্বেল হয়ে ওঠে। পরিমল তাদের স্বজাতি। ঘটক-টটকের মাধ্যমে অনায়াসে ঘটানো যেত জিনিসটা। একটু সময় দিলেই তৈরি হয়ে নিতে পারত ও। কিন্তু এর বেশি কলির সাহস নেই। বিয়ের কথায় তার মুখ বুক শুকিয়ে গেছে। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু একমাত্র পরীক্ষার দোহাই ছাড়া অন্য কোনও ওজর-আপত্তির কথা কাক-পক্ষীতেও টের পায়নি। মিলি সর্বক্ষণ আঠার মতো লেগে আছে, সে-ও না। খালি বলছে—‘এতো কাঁদছিস কেন? তুই একটা বোকার রাজা। কত শাড়ি পাবি, গয়না পাবি, কত্ত রকম উপহার, কনে সেজে তোকে যা দেখাবে না! তার ওপর বর পাবি। হি, হিঃ আমায় যদি কেউ বিয়ে দিত এক্ষুনি রাজি হয়ে যেতুম। বি এস সি’র রেজাল্টটা বেরোবার আগে হলেই ভালো হত।’ কানের কাছে বকবকবক। কলি বলে—‘তুই চুপ করবি মিলি?’
আত্মীয়স্বজনরাও এক এক করে এসে পড়ছেন। বড় মাসি এসে থাকবেন, পিসিমাও। কাকিমার বউদি, কলিরা রাঙা কাকিমা বলে, তিনি খুব কাজের, যজ্ঞিবাড়ি হলেই তাঁর ডাক পড়ে। তিনিও এসে গেছেন। সবাই মিলে দিবারাত্র আদিরসাত্মক ঠাট্টা করে কলির কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন।
নেমন্তন্ন করতে এ. কে. বি’র বাড়ি গিয়েছিল কলি, স্যার কার্ডটা হাতে নিয়ে বললেন—‘আনন্দিত হলাম, বলতে পারছি না, কলিকা, আশীর্বাদ করছি যদিও।’
—‘কেন স্যার? পরীক্ষা আমি দোবই। সেইরকম কনডিশন করিয়ে নিয়েছি, ভালো রেজাল্টও করবই। আপনি দেখবেন।’
—‘তা আমি জানি। তোমার ওপর সে ভরসা আমার আছে। আমার নিরানন্দ অন্য কারণে।’
কলি মুখ নিচু করল।
এ.কে.বি.বললেন—‘পরিমল মুখার্জি অতো ব্রাইট ছেলে, ও তো ফার্স্ট ক্লাস পাবেই। তারপর হয়ত কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে চলে যাবে। পাত্র হিসেবে তো খারাপ ছিল না, তবু সাহস করতে পারলে না? এতো ব্যক্তিত্বহীন, অব্যবস্থিতচিত্ত তোমরা! তবে ওকে আশা দেওয়াই বা কেন?’
কলির দু চোখ ভরে এসেছে। গুমগুম করে মাদল বাজছে বুকের মধ্যে। ধরা গলায় সে বলেছিল—‘আমি কোনদিন কোনও আশা দিইনি স্যার কাউকে, আপনি জিজ্ঞেস করে দেখবেন!’ বলে একরকম ছুট্টে বাইরে চলে এসেছিল।
মা এখন আস্তে আস্তে একটার পর একটা গয়না দিয়ে তাকে সাজাচ্ছে। কলি মেয়ে হয়েও, বিবাহের পাত্রী হয়েও তার কি গয়না হল, শাড়ি হল খোঁজ নেয়নি। মা দু’হাতে পাঁচ গাছা করে চুড়ি পরালেন, তার মুখে কঙ্কন। গলায় সরু পাটি হার। হঠাৎ কলি চমকে বলল—‘মা এরকম বেঁকি চুড়ি, পাটি হার বউমণির ছিল না?’
মা আস্তে বললেন—‘বউমারই তো! তোকে দিয়েছে। ওর আর এসব কোন কাজে লাগবে? আর যা আছে খোকামণির জন্যে যথেষ্ট।’
কলি বলল—‘মা, বউমণি কোথায়? কই সে আমাকে তো বলেনি। এসব গয়না আমাকে দিচ্ছে? বউমণি নিজে হাতে না দিলে এসব আমি পরব না।’ কলির গলায় কান্না উঠে আসছে।
—‘এখানে স্ত্রী-আচার শুরু হচ্ছে। গায়ে-হলুদ দেওয়া হবে। বউমার এখানে আসতে নেই, কলি অসভ্যতা করো না।’
কলি বলল—‘একটু দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।’
আজ অনেকদিন পর রূপ স্বেচ্ছায় মায়ের আঁচল ছাড়া হয়েছে। বিয়ে-বাড়িতে অনেক মজা, তার ওপর সমবয়সী বন্ধুবান্ধব। দুড়দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা আর নামা, হঠাৎ চিৎকার করে এ ওকে ভড়কে দেওয়া এই সব হচ্ছে তার উৎসব। বন্দনার তাই আজ বিশেষ কাজ নেই। সকালের দিকে রাশীকৃত পান সেজেছে। এখন একদিকে নান্দীমুখের আয়োজন হচ্ছে। আরেকদিকে এয়োরা সব গায়ে হলুদের আয়োজন করছেন। ছাদনাতলা হচ্ছে নিচের উঠোনে, বন্দনা সেই দৃশ্য থেকে যতদূর পারে সরে নিজের ঘরের দক্ষিণের জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। গরাদ ধরে। ঝমঝম খসখস শব্দে পেছন ফিরে তাকাতেই নতুন হলুদ ডুরে পরা কলি তাকে জড়িয়ে ধরল। অদূরে বড়দি। কলি বলল—‘বউমণি, আমাকে এই সব তোমার গয়না পরানো হচ্ছে দেখ। এসব আমি কেন নেব? মোটেই নেব না।’
বন্দনা বলল—‘নিবি না কেন কলি? এসব আমি তোকেই দিয়েছি তো!’
—‘দিলে আশীর্বাদ করে তুমিই পরিয়ে দিও। আর এতেই বা কেন? এতো তুমি আমাকে দেবে কেন? একটা কিছু দাও। যা হোক একটা কিছু।’
বন্দনা মৃদুস্বরে বলল—‘কলি, একটা গয়নায় তো মেয়ের বিয়ে হয় না রে! গা সাজিয়ে দিতে হয়। তোর দাদা থাকলে যা করতেন, আমি সেটা আমার সাধ্যমতো করেছি। কেন কষ্ট পাচ্ছিস, এই সব আমি তোকে দিয়েছি। মুক্তোর সেট দিয়ে আশীর্বাদ করব।’
—‘আবার মুক্তোর সেট? বউমণি তুমি কি পাগল হলে?’
বন্দনার চোখ ছলছল করছে, বলল—‘গয়নার সার্থকতা কিসে বল? কেউ তাকে পরলে তবে তো? তুই পরলে, আমার ভালো লাগবে, বিশ্বাস কর।’
—‘তাহলে তুমি একবার ওখানে এসো!’
—‘যাব’, একটু ইতস্তত করে বন্দনা বলল, ‘যাব, একটু পরে। তুই যা। আমার হাঁতের ক’টা কাজ আছে। সেরে যাব।’
কলি নিচে চলে গেল। বড়দি বলল—‘দেখলি তো?’
মা বলল—‘দেখলে তো? আমি কি মিছে কথা বলছি, না তোমার বউমণির আঁচল থেকে চাবি খুলে নিয়ে তার আলমারি থেকে গয়না চুরি করেছি? লেখাপড়া শিখলে মেয়েছেলের মতিভ্রম ছাড়া আর কিছু হয় না।’ মার গলায় ভীষণ রাগ।
গায়ে হলুদ হয়ে গেলে হুলুধ্বনির মধ্যে দিয়ে কলি চার কলাগাছের মধ্যিখানে শিলের ওপর দাঁড়াল। তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে। একটা খুরিও সে ভাঙতে পারল না। তার হয়ে বড়দি, বড়মাসি, বড়মাসির বউ, পাশের বাড়ির মাসিমা এঁরা ভেঙে দিলেন। কে কোথায় বলল—‘খোকার বিয়ের পর বাড়িতে এই প্রথম কাজ। কোথায় বন্দনা বউ এয়ো হয়ে দাঁড়াবে, ছিরি হাতে করে ছাদনা তলায় ঘুরবে, তা নয়…।’
বড়দি বলল—‘এই কলি, এখন থেকেই এতো কাঁদতে শুরু করলি, বিয়ের সময়ে মুখ যে ভিমরুলের চাকের মতো হয়ে যাবে রে!’
কাকিমা বললেন—‘চার দাদার এক বোন। তুই তো কোন জন্মেই চলে গেছিস। দিদির কোল-পোঁছা। কত আদর। যা চেয়েছে মুখের কথা খসতে না খসতে হাজির। কাঁদবে না! দিদির কোলের ওই তো ঘর আলো করে ছিল রে!’
কলির চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। একমাত্র কলি ছাড়া কেউ জানে না, বাড়ি-ছাড়ার, মা-বাবার কোল-ছাড়ার কান্না এ নয়। তাকে কাঁদাচ্ছে স্মৃতিতে ওতপ্রোত হয়ে মিশে থাকা একটি বিষণ্ণ তরুণ মুখ, প্রৌঢ় মাস্টারমশাইয়ের র্ভৎসনা, তীব্র এক মৃত্যুদৃশ্য যা সে এখনও ভুলতে পারেনি, এবং নিরাভরণ একটি একদা-শ্ৰীমতী-এখন শ্রীহীন নারীমুখ। কলির বাস্তবিক মনে হচ্ছে বউমণির হাত থেকে, গলা থেকে জোর করে করে গয়নাগুলো উপড়িয়ে নিয়ে তাকে পরানো হল। তারপর একটা অদৃশ্য নারী-কণ্ঠ চেঁচিয়ে বলল—‘যা যা এবার এখান থেকে দূর হয়ে যা শতেকখোয়ারি, হতভাগী!’ নির্জন, নিরানন্দ, তমসাবৃত পথ দিয়ে বউমণি শূন্যহাতে একলা একলা চলে যাচ্ছে। কলির এমন শক্তি নেই, এমন সাহস নেই যে তার জন্য কিছু করে।
কলির উপলব্ধি ঠিকই। শাশুড়ি বন্দনার কাছে প্রথমে টাকাই চেয়েছিলেন। বন্দনা ভয়ানক বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। ফিক্স্ড্ ডিপপাজিটের ওই পঁচিশ হাজার টাকাই তার একমাত্র ভরসা। ব্যবহার হয়তো করে না, কিন্তু আছে যে এটাই তার আত্মবিশ্বাসের একমাত্র কারণ। খানিকটা ভেবে নিয়ে সে বলেছিল—‘টাকা তো তেমন কিছু নয় মা, আমি বরং আমার গয়না কিছু দেবো।’ সোনার গয়না দেবার কথা সে আদৌ ভাবেনি। কারণ সোনাও যে টাকা পয়সার মতোই মূল্যবান এটুকু জ্ঞান তার এতদিনে হয়েছে। সে তার মুক্তো-চুনীর জড়োয়া সেটটা বার করে দিয়েছিল।
শাশুড়ি তখনই বলেছিলেন ‘এ তো পোশাকি, তোলা গয়না বউমা। এ দিয়ে তুমি না হয় ওকে আশীর্বাদ করো। টাকাটা পেলে সোনার গয়নাগুলো গড়াতুম। পঁচিশ ভরি মোট লাগবে। আমার মফ চেনটা থেকে সাতভরি বেরোবে, টাকা না দেবে বাকিটুকু না হয় তুমিই দাও। যেমন আছে তেমনি দিয়ে দেবো, বানিটা আর লাগবে না। খোকা থাকলে তো সে-ই ব্যবস্থা করত। দিয়ে-থুয়েও তোমার ছেলের বউয়ের জন্য যথেষ্ট থাকবে।’
গয়নার প্রয়োজন যে শুধু ছেলের বউয়ের জন্য নয়, সেগুলো তার মূল্যবান সম্পত্তি, অনিশ্চিত জীবনের পাথেয়, অসুখ-বিসুখ, ছেলের উচ্চশিক্ষা নানা কারণেই দরকার হতে পারে এ কথা বন্দনা শাশুড়িকে মুখ ফুটে কিছুতেই বলতে পারল না। বাবার দেওয়া চুড়ি, হার, কানবালা, এঁদের দেওয়া কঙ্কন, সবই তাকে বার করে দিতে হল।
মনটা সেইদিন থেকে এতো খারাপ, এতো তেতো হয়ে আছে যে বন্দনা ভয় পেয়ে যাচ্ছে—কলির যেন আবার কোনও অমঙ্গল না হয়। কলিকে সে খুবই পছন্দ করে। ভালোও বাসে। ভালোমনে দিতে পারছে না, মাঝ রাত অবধি ওই গয়নার জন্য তাকে কাঁদতে হয়েছে। সেই চোখের জলে ভেজা গয়না পরে কলি শ্বশুরবাড়ি যাবে। বন্দনা মনে মনে বারবার কলির মঙ্গলকামনা করে।