শ্বেত পাথরের থালা – ২৯

অধ্যায় ২৯

রাত বারোটা বেজে গেছে। উৎসববাড়ি নিস্তব্ধ। সানাই এতক্ষণে চুপ করল। মাঝের ঘরে ফুলশয্যা। তারপরে ছোট একটু ঘেরা দালান পেরিয়ে কলিদের পুরনো পড়ার ঘর। ওদিকের ঘরে ছোট দেওর। এখনও সে বন্দনার সঙ্গে ব্যবহারে একটু আড়ষ্ট। কিন্তু তার বউটি ধরা-ধরা গলায় সব সময়ে এক কথার জায়গায় একশ কথা বলে। সব সময়ে আলু-থালু, পাগল-পাগল। সে অন্তত আট ন-বার বন্দনাকে জিজ্ঞেস করেছে ‘ও দিদি, এখানে থাকবে তো! না, আবার আমাকে প্রেতপুরীতে একলা ফেলে চলে যাবে?’ বিয়েবাড়িতে শিশু দেখলেই সে তাকে আদরে আদরে আচ্ছন্ন করে দিয়েছে। শিশুটি প্রতিবাদ করলেই কেঁদে ফেলেছে। সুতপার অবস্থা দেখে বড় কষ্ট হয়। একবার অনেক কষ্টে সংকোচ কাটিয়ে বলেছিল—‘সুতপা, একটা দত্তক নিলে তো হয়!’

বিষন্ন মুখে মাথা নেড়ে সুতপা বলেছিল—‘তুমিও এই কথা বলছ দিদি! কোথাকার কোন বাচ্চা নেব, মল্লিকবাড়ির মেয়ে আমি, বন্ধ্যা হতে পারি, কাঙাল তো নই!’

বন্দনা বুঝেছিল সুতপার সমস্যা যা ভেবেছিল তার চেয়েও জটিল। সুতপা বলেছিল ‘রাগ করলে, দিদিভাই? তার চেয়ে নাতি। না না নাতনি তোক। মনের সাধে মানুষ করব এখন। অনাথ-আশ্রমের বাচ্চা নিয়ে শেষে ফ্যাসাদে পড়ি আর কি!’

এ বন্দনা কি করে তাকে বোঝাবে নাতি বা নাতনিকে মানুষ করতে পাওয়ার অধিকারও ইচ্ছে করলেই পাওয়া যায় না।

পরদিন বউকে রওনা করিয়ে দিয়েই ভবানীপুরে ফিরে এল সে। যে বাড়ি অভিমন্যুর, সে বাড়ি অভিমন্যু বিনা এখনও কী দুঃসহ। বাথরুমের দিকে তাকালেই মনে পড়ে যায় সেই দৃশ্য, সেই বিস্ফারিত দৃষ্টি। সে-সব স্মৃতি তো সে মনে করতে চায় না। তার নিজের ঘর, যে ঘর এখন রূপকে দিয়েছে, সেখানে ঢুকতে মনে হল অভিমন্যুও এক্ষুনি ঢুকল বারান্দার দিকে দরজা দিয়ে।

—‘বন্দনা, আমি আসব ভুলে গিয়েছিলে? আমাকে ছেলের বিয়েতে ডাকলে না তো! আমাকে পর করে দিয়েছ। বন্দনা, তোমরা আমাকে একেবারে ভুলে গেছ?’

বন্দনা দেখে তার বুকের কাপড় ভিজে উঠেছে। দেয়ালে তার ছবি, জুঁইয়ের মালা এক রাত্তিরেই শুকিয়ে এসেছে, বন্দনার স্বামী এখন বন্দনার থেকে বয়সে ছোট আটত্রিশ বছরের এক দুরন্ত যৌবনের যুবক। বন্দনা তাকে বহুকাল পেরিয়ে এসেছে, প্রায় দশ বছর হতে চলল। তবু সে তাকে এখনও, এমনি অনিবার্যভাবে কাঁদায়।

কি করে তাহলে থাকবে সে? তাকে যেতে হবে যেখানে স্মৃতি এমন করে প্রতি কোণে থমকে দাঁড়িয়ে নেই, বাঁচতে যখন হবেই তখন এমন স্মৃতি-পাগল হলে তো চলবে না!

কাকাবাবু কাকিমাকে প্রণাম করে সে বলল—‘আমি আসা যাওয়া করব, কাকিমা, ভাববেন না।’ সুতপাকে বলল—‘তুমি যখনই ইচ্ছে হবে আমার কাছে চলে যাবে। আমিও আসব। থাকব। কান্নাকাটি করো না।’

রূপ ভবানীপুরের পরিবেশে অভ্যস্ত। সে কিছুতেই শ্যামবাজারে থাকতে চাইছে না। সে থাকলেও বন্দনা এ বাড়িতে এসে থাকার কথা ভাবতে পারে না। কিন্তু মনে মনে সে এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার দায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। ছোট জায়ের প্রীতি স্বীকার করে নেয়। থাকা হবে না, কিন্তু আসা যাওয়ার যে স্রোত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাকে মুক্ত করতে হবে। কলি একবার ইতস্তত করে বলেছিল—‘বউমণি ওরা ভবানীপুরে থাকে থাকুক না, তুমি এখানে এসে থাক। অঞ্জুকে একলা সংসার করতে দিলে আমার মনে হয় সব দিক থেকেই ভালো হবে।’

সকালবেলার রান্নার খুঁটিনাটি অন্নকে বুঝিয়ে দিতে দিতে সে কথা ভেবে বন্দনার হাসি আসে। সে নিজে আজকাল অফিসে লাঞ্চ খায়। কিন্তু অঞ্জুর জন্য তাদের রান্নার ধরন-ধারন সবই পাল্টে ফেলতে হয়েছে। সেদ্ধ রান্না সে একদম খেতে পারে না, অথচ রাঁধতেও তার কোনও গরজ নেই। একদিন অন্ন আসেনি, বন্দনাও বেরিয়ে গেছে সকাল সকাল। রূপকে সেদিন বাইরের খাবার খেতে হয়েছে, অঞ্জুও পঞ্জাবি দোকানের রুটি-মাংস খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। মা না থাকলে রূপের খাওয়া-দাওয়ার খুব মুশকিল। সে আবার ঝাল খেতে পারে না। একদম।

সুতরাং জীবনযাত্রা আগের মতো চললেও তার চাল-চলন এখন বদলে গেছে। ছোট্ট বাড়িটাতে এখন প্রাণের জোয়ার। দু-টি যুবক-যুবতীর আনন্দ। হাসি-গল্প, খুনসুটিতে সরগরম। রূপ অফিস থেকে এসেই কোনমতে কিছু খেয়ে অঞ্জুকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে বেরিয়ে যায়। অঞ্জু একদম বাড়ি বসে থাকতে পারে না। সারাদিন ধরে সে লম্বা লম্বা নখ রাঙায়, সন্ধে হলেই বেরোবে। ফিরতে ফিরতে ন’টা দশটা এগারটা। হু হু করে হাসতে হাসতে, পরস্পরকে কিল মারতে মারতে ঝড়ের মতো ফেরে। রূপ বলে —‘তুমি খেয়ে নিও মা। আমাদেরটা ঢাকা দিয়ে রাখবে। এ পাগলির কবে কি মতি হবে জানি না তো! খাওয়ার হলে খেয়ে নেব, না হলে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে দেব।’

বন্ধুর দল এলে জমজমাট আড্ডা বসে। বন্দনা চা দিতে গিয়ে দেখে অঞ্জু মধ্যমণি হয়ে বসেছে, তার এক হাত রূপের কাঁধে তোলা, আরেক হাত দিয়ে সে প্রদীপের জামার ভেতরে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ক্ষ্যাপার মতো হাসছে সবাই। বন্দনাকে দেখেই তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় অঞ্জু। বলে —‘এই দেখ, আমাদের শাশুড়ি বউয়ে কিরকম সমঝোতা। শাশুড়ি চা করে দিচ্ছে, বউ সার্ভ করছে।’ ‘শাশুড়ি’ কথাটা, অঞ্জুর ধরন-ধারন কোনটাই ভালো লাগে না বন্দনার। সে সরে যেতে যেতে শোনে কেউ একজন বলছে, ‘মাসিমার মতো হতে হলে তোকে একজন্ম ঘুরে আসতে হবে অঞ্জু।’

অঞ্জু বলছে—‘যা যা, নিজের নিজের চরকায় তেল দি গে যা।’

কলি মাঝে মাঝে বলে, ‘বউমণি তুমি গোড়ার থেকেই ওদের বড় প্রশ্রয় দিচ্ছ, কিছু বলো না কেন?’

বন্দনা বলে—‘আমি বললে কিছু ফল হবে এ-কথা তোকে কে বলল কলি! আর বলবই বা কি! মাঝখান থেকে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে।’

—‘বাইরের একটি মেয়ে তোমার বাড়ির নীতি-নিয়ম তো বুঝতে না-ও পারে বউমণি!’

—‘না বোঝে না-ই বুঝুক কলি, আমি বোঝাতে পারব না। আমায় মাফ কর। যে ক’টা দিন আছি, কোনরকম সংঘর্ষ ছাড়া কাটিয়ে দিতে পারলে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করব।’

কলি তখন অঞ্জুকেই বলে—‘হ্যাঁরে অঞ্জু, সারাদিন বসে বসে তোর পা ধরে যায় না!’

—‘যায়ই তো। সন্ধে হলেই তো বেরিয়ে পড়ি।’

—‘সারাদিন বসে বসে কি করিস? ’

—‘পিসি তুমি কি আমাকে রান্না-বান্না করতে বলছ নাকি? আচ্ছা পিসি, আমি আসার আগেও তো এ বাড়িতে রান্না হত, নাকি! আজ আমি একটা মানুষ বাড়তি হয়ে গেছি বলেই কি আমারটা করে নিতে বলছ!’

কলি বলে—‘তুই এমন করে কথা বলিস!’

—‘আমার বাবা ঢাকঢাক-গুড়গুড় নেই। আমাকে যা বলবে সোজাসুজি বলবে। ওসব ঘর-গেরস্থালি, রান্না-টান্না আমার দ্বারা হবে না। আমি এসেছি বলে বেশি ঝঞ্ঝাট হলে বলবে, ওকে বলব স্রেফ দোকান থেকে আমার খাবার এনে দেবে।’

কলি বলে—‘বাবারে বাবা, আমার ঘাট হয়েছে, তুমি যেমন আছ, তেমনি থাক। আমি চললুম। বউমণি, সারাটা দিন ছুঁড়ি কি করে কাটায় একটু উঁকি মেরে দেখ তো!’

বন্দনা হেসে বলে—‘তুই এসে দেখে যাস।’

ওরা যেদিন বাড়ি থাকে সেদিন বন্ধু-বান্ধব আসে। আড্ডা চলতে থাকে দশটা পর্যন্ত। ঘন ঘন চায়ের ফরমাশ আসতে থাকে। চায়ের সঙ্গে কিছু কিছু অনুপানও প্রত্যাশা করে রূপ। তার নতুন চাকরি, নতুন বউ, বন্ধুরা কেউ এখনও তার মতো ভাগ্যবান নয়, আনন্দের আতিশয্যে ঢালাও নেমন্তন্ন, ঢালাও আপ্যায়ন।

এক একদিন বিছানায় ছটফট করে বন্দনা। এতদিনের এত কষ্ট করে অর্জিত স্বাধীনতা, অবসর যাপনের মুক্তি, বাড়ির আবহাওয়ায় এত যত্নের পারিপাট্য, পবিত্রতা নিয়ম সব তাসের প্রাসাদের মতো ভেঙে পড়ছে। এখন মনে হচ্ছে অঞ্জুকে অত সহজে মেনে নেওয়া তার উচিত হয়নি। সে যদি এ বিয়েতে মত না দিত, রূপ এখুনি চাকরি পেত না, সুদীপ্ত দিতেন না। আরও কিছুদিন সময় পাওয়া যেত। হয়ত রূপ বুঝতে পারত অঞ্জু মেয়েটি ঠিক তাদের বাড়ির উপযুক্ত নয়। কিন্তু কবে থেকে যে বন্দনা ছেলেকে ভয় করতে শুরু করেছে, সে জানে না। যত বয়স বাড়ছে, ততই বাড়ছে এই অসহায়তাবোধ। যদি রূপ তাকে ছেড়ে চলে যায়! এই বাড়িতে এখনও একদম একলা সে। দিন রাত। তবু তো রাত্রে সে পাশের ঘরে থাকে। দিনে রাতে দু’বার কি তিনবার সামান্য সময়ের জন্য হলেও তাকে তো দেখা যায়! এখনও রূপের মা মা ডাক এই বাড়িতে বাজে। এখনও অনেক আছে। যত সইবে, নিজের যন্ত্রণাকে যত গ্রাস করে নিতে পারবে, তত সংঘর্ষের সম্ভাবনাও কমবে। সংঘর্ষ নয়, কিছুতেই নয়। একদিন না একদিন রূপের চোখ থেকে পদা খসবেই। তখন অঞ্জলিকে তার এই আলগা গা-ছাড়া স্বার্থপর চরিত্র পাল্টাতে হবেই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *