অধ্যায় ১৬
পরদিন স্কুলে গেল না বন্দনা। একটু উদ্বিগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করলেন সোমনাথবাবু কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। এখনও বন্দনার চোখ লাল, মুখ ফুলে আছে। নাই বা গেল একদিন। কিন্তু পরদিনও সে গেল না। তার পরদিনও না। তৃতীয়দিন সোমনাথবাবু বুঝতে পারলেন সে কোনদিনই আর স্কুলে যাবে না। সেদিন রাত্রে ঝোঁকের মাথায় অনেক কথা, প্রায় একটা বিরাট বক্তৃতাই দিয়ে ফেলেছেন বন্দনাকে। বিষয় খুবই স্পর্শকাতর। সেইজন্যেই কি সে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল? কিন্তু তিনি তো নিরুৎসাহকর কোনও কথা তাকে বলেননি! বরং যাতে অপরাধবোধ, পাপবোধ থেকে মুক্ত হওয়া তার পক্ষে সহজ হয়, বাকি জীবনটা মোটের ওপর ভারমুক্ত হয়ে চলতে পারে এমন কথাই তাকে বলেছেন। বন্দনা কি রাগ-অভিমান করল? হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে সব সময় যুক্তি কাজ করে না। তিনি যুক্তির আশ্রয় নিয়েছিলেন, তত্ত্ব এবং উদাহরণের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাতে কি বন্দনা কোথাও আঘাত পেয়েছে? সে একবার বলেছিল বটে তাকে এত কঠিন কথা তিনি কেন বলছেন! তাহলে কি সে তাঁর ওপর রাগ করে স্কুলের কাজটা ছেড়ে দিল? স্কুলে কাজ নিতে তিনি তাকে কখনও বলেননি। বন্দনার নিজেরই ইচ্ছে সেটা। তিনি দেখে সুখী হয়েছিলেন যে বন্দনা কত স্বচ্ছন্দ হয়ে গেছে। প্রতিদিন এটা তিনি অনুভব করেছেন। তাহলে? তিনচারদিন কেটে গেলে সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলেন; বন্দনা বলল, ‘তুমি কি চাও যেখানে আমাকে সব সময় মিথ্যাচরণ করতে হয়, যেখানে আড়ালে আমাকে লক্ষ্য করে লোকে বক্রোক্তি করে সেখানে আমি যাই?’ কিছুই বুঝতে পারলেন না সোমনাথবাবু। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর আসল ঘটনাটা প্রকাশ পেল। বন্দনা বলল, ‘সামনাসামনি ওরা উদার, আড়ালে আরও কত কি বলে থাকে, কি মনোভাব পোষণ করে আমার সম্পর্কে এই ধরনের উক্তি থেকেই তো বোঝা যায়।’ সোমনাথ ব্যথিত হয়ে বললেন, ‘কি যে নিষ্ঠুর এই মায়ের জাত। নিজেদের হেয় করতে এদের সত্যিই জুড়ি নেই। কিন্তু বুড়ি এতো ভঙ্গুর হলে তো তোর চলবে না। তুই দুর্বল হলে আঘাত বারবার আসবে। আর এসব আঘাত মনকে শুধু ছোট করে, এ সব আঘাতের কোনও মর্যাদা নেই। তুই যে কোনও সংস্কার মানিস না সেটা লুকোলে চলবে না নিজের মধ্যে জোর না থাকলে লোকে বারবার আঘাত করবেই, অনেক সময়ে না বুঝেই করবে যে।’
বন্দনা চুপ করে রইল। একবারও বলল না জোরের সঙ্গে যে সে এবার থেকে আরও সবল হবে, এত সহজে ভেঙে পড়বে না। আসলে সে মনে মনে বলছিল, ‘আমি পারব না। পারছি না যে কাকা।’ কিন্তু এ কথা বললে কাকা পাছে তাকে আরও জোর করেন, তাই সে চুপ করে রইল।
চুপচাপ গুমোট দিনগুলো কাটে। একমাত্র রূপ বাড়ি ফিরলে তার হাঁকডাক, কলকাকলিতে সে গুমোট কাটে।
সে বাড়ি এসেই সেদিনের স্কুলের মুখ্য ঘটনাটা নাটকীয়ভাবে বলবে—‘ওঃ জানো মা আজকে স্কুলে ফাটাফাটি কাণ্ড।’
—‘কেন রে?’ বন্দনার প্রশ্ন খুব নিরুৎসুক।
—‘আরে দুটো নতুন ছেলে অন্য স্কুল থেকে এসেছে, কথা বলছিল, ব্যস মিস তাদের জামার পেছনে ডঙ্কি আর মঙ্কি লিখে দিয়েছে বড় বড় করে।’
—‘কোন মিস?’ সোমনাথবাবু জিজ্ঞেস করেন।
—‘মিসেস রডরিগ্স। সেই যে গো যার ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। স্যামুয়েল। ভীষণ বিচ্ছু!’
—‘তারপর?’
—‘টিফিনের সময়ে তো ছেলে দুটো বাইরে বেরিয়েছে, আর স্কুলশুদ্ধু ছেলে তাদের নিয়ে হেসেছে। তখন কি সাহস! ছেলে দুটো প্রিন্সিপ্যালের কাছে গিয়ে কমপ্লেন করেছে, কেঁদেছে।’
বন্দনা অন্যমনস্ক ছিল, বলল, ‘আচ্ছা! সত্যি খুব সাহসী ছেলে তো?’
রূপ উৎসাহ পেয়ে বলে, ‘তারপর শোনো না, প্রিন্সিপ্যাল মিসকে ডেকে কি বকুনি! চাইল্ড সাইকলজি, নেভার ইনসাল্ট দেম, য়ু আর নট ফিট টু বী আ টিচার, ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই শুনেছি। কেন্ নিয়ে প্রিন্সিপ্যাল একটু পরে এসে আমাদের সবাইকে তাড়িয়ে দিলে কি হবে, তার আগেই আমাদের শোনা হয়ে গেছে।’
সোমনাথবাবু বলেন, ‘যাক তবু বুদ্ধিশুদ্ধি আছে মিঃ স্মিথের।’
রূপ বলল, ‘মা তুমি কখনও তোমার স্কুলের মেয়েদের এরকম শাস্তি দাও, পেছনে লিখে!’
বন্দনা মুখে বলে, ‘পাগল হয়েছিস।’ মনে মনে বলে ‘আমি লিখব কি? আমার পেছনেই সবাই নানান কথা লিখে দিচ্ছে, এমন কালি দিয়ে যে সে আর কিছুতেই উঠতে চায় না।’
সোমনাথবাবু খুব চুপচাপ হয়ে গেছেন। মানুষকে সাহায্য করা বড় কঠিন। কথায়, আচরণে, আদরে কোথাও তো চেষ্টার অন্ত নেই। তবু হয় না। তবু হল না। জীবনের ওপর মৃত্যু ক্রমাগত জয়ী হয়ে চলেছে। এতদিন পর তাঁর মনের মধ্যে গভীর আলস্য আসছে। অবসাদ, হতাশা। হতাশা থেকেই আলস্য। বন্দনার মায়ের মৃত্যুর পর, দাদার অবস্থা দেখে তাকে মানুষ করার ভার নিজেই তুলে নিয়েছিলেন যেচে। কোনদিন মনে হয়নি খারাপ করেছেন। একটি বালিকাকে আস্তে আস্তে গড়েপিটে তোলবার মধ্যে তিনি অসীম আনন্দ পেয়েছেন। সেই মেয়ে স্বামীকে হারালো। শ্বশুরবাড়িতে তার অবস্থা দেখে, নিজের মধ্যে সেই পুরনো জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল আবার। অসীম স্নেহও ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এই হার-না-মানা জেদ। মুমূর্ষ মেয়েকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এখন তাঁর মনে হচ্ছে স্নেহের চেয়ে কি জেদটাই বেশি ছিল। বেশ তো এগোচ্ছিল। এখন যেন মেয়ে তাঁর সামনে একটা দেয়াল তুলে দিয়েছে। এই পর্যন্ত, আর এগিও না। কিছুদূর পর্যন্ত তোমার চেষ্টা আমি মেনে নেব। কিন্তু স্বপ্নেও ভেব না অনুশাসনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি আমি স্বীকার করে নেব। হঠাৎ সোমনাথের মনে হল তাঁর আর কোনও কাজ নেই। সত্যি সত্যি তিনি অবসর নিয়েছেন। বুড়ো হয়ে গেছেন। একেবারে বুড়ো। ইজিচেয়ারটায় আধশোয়া হয়ে ভেতরের বিমর্ষতায় কিরকম একটা চুলের মতো আসে। সেটা ঠিক ঘুম নয়। ঘোর। ঘোরের মধ্যে নিজেই নিজেকে বলেন, ‘চলো এবার ফেরো।’
‘কোথায়?’
—‘না, হিমালয় নয়। এবার আরও উঁচু অলটিচ্যুড, আরও উত্তরে। যেখানে সব প্রশ্নের শেষ উত্তর, সব তীর্থের সেরা তীর্থ।’
—‘ওদের কি হবে?’
—‘ওদের আর অত আগলে রাখতে হবে না। তুমি আড়াল করে আছ বলে বাড়তে পাচ্ছে না। সরিয়ে নাও তোমার পক্ষপুট। অভিজ্ঞতার মোকাবিলা নিজেদের করতে শিখতে দাও।’
‘কিন্তু বালকটি?’
—‘ওকে ওর মা দেখবে, মানুষ করবে, তুমি কে?’
ঘোরের মধ্যেই সোমনাথবাবু শুনতে পেলেন বন্দনা বলছে—‘ওমা, তুমি! হঠাৎ! এতকাল পরে!’
অপরিচিত নারী কণ্ঠ বলে উঠল, ‘বউমণি তুমি আবার কবে থেকে আমাকে তুমি বলতে আরম্ভ করলে গো?’
—‘কতদিন দেখা নেই! কিছু মনে করিসনি! সবাই ভালো আছেন?’
—‘ওমা মনে কি করব? কার ভালোর কথা জিজ্ঞাসা করছ?’
—‘সবার। মা, বাবা, কাকা, কাকিমা, মেজদা, ছোড়দা, মিলি।’
—‘সবাই ভালো। মেজদার তো বম্বেতেই বিয়ে হয়েছে। ভটচায্যি বাড়ির থোঁতা মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে একেবারে, জানো তো? বিরাট পয়সা বউদিদের। মেজদা গিয়ে তাদের এক্সপোর্টের ব্যবসার হাল ধরেছে। মেজবৌদি বাঙালি হলে কি হবে? একেবারে বম্বেওয়ালী হয়ে গেছে। বাংলা বলে ভাঙা ভাঙা। মিলিটার বিয়েটা কিছুতেই লাগছে না। আসলে কাকা-কাকিমা বোধহয় স্বপ্নে-দেখা রাজপুত্তুরটি পাচ্ছেন না। যাই হোক, তোমাকে কিন্তু যেতেই হবে।’
সোমনাথবাবু আস্তে আস্তে চোখ মেললেন। একটি বউ, দেখলে মনে হয় বেশ বড়লোকের ঘরের। ঝলমল করছে চেহারাখানা। শাড়ি গয়নার জাঁকজমক ছাড়াই। ঝলমলানিটা কিসের? সোমনাথবাবু নিজেই জিজ্ঞেস করলেন নিজেকে, উত্তর দিলেন—বোধহয় সুখের। সমৃদ্ধিও আছে অন্তরালে। কিন্তু জানান দিচ্ছে না।
বন্দনা বলল, ‘আয় কলি, কাকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। কাকা, এই আমার ননদ কলি, তুমি বোধহয় ওকে চিনতে পারছ না, এত বদলে গেছে!’
কলি বলল, ‘আমি একটুও বদলাইনি বউমণি, বিশ্বাস করো। একটু মোটা হয়েছি শুধু। কোন বাঙালিনী বিয়ের পর মোটা হয় না গো? তুমিও হয়েছিলে!’ বলতে বলতে কলি কাকাকে প্রণাম করল; বলল, ‘কাকু, আমার মেজ দেওরের বিয়ে, বউমণি, আপনি, খোকা সবাই অবশ্যই যাবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার কর্তা অফিসের কাজে দিল্লি গেছেন। সেই বিয়ের দিন সকালে আসবেন। তাই আসতে পারলেন না।’