শোকার্ত পাহাড়ী জনপদ : কল্পনা চাকমার সন্ধান মেলেনি এক বছরেও – বিপ্লব রহমান
আজ সংগ্রামী পাহাড়ী নেত্রী কল্পনা চাকমা অন্তর্ধান দিবস। গত বছর ১২ জুন নির্বাচনী ডামাডোলের সুযোগে রাতের অন্ধাকারে সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা তাকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে যায়। গত এক বছরে কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনায় দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। পত্র পত্রিকাগুলোতে তার উদ্ধারের দাবিতে জোরালো আওয়াজ তুলেছে। কল্পনা চাকমা পরিণত হয়েছেন আন্তর্জাতিক সংবাদে। কিন্তু তার সন্ধান মেলেনি আজো।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রভাবশালী তিন সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, পাহাড়ী গণপরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন কল্পনা চাকমাকে অপহরণের জন্য সরাসরি সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে। অপহরণ ঘটনার পর পরই সংগঠন তিনটি তার উদ্ধারের দাবিতে রাঙ্গামাটিতে ২৭ জুন হরতাল আহ্বান করলে হরতালকারীদের ওপর পুলিশের গুলি বর্ষণ ও সাম্প্রদায়িক হামলায় একজন পাহাড়ী ছাত্রকর্মী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। নিখোঁজ হন আরো তিনজন ছাত্রকর্মী।
এরপর পার্বত্য চট্টগ্রামে মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ জাতীয় কমিটি, তিন পাহাড়ী সংগঠনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা কল্পনার উদ্ধারের দাবিতে ঢাকায় ও পার্বত্য জেলাগুলোতে একাধিকবার মিছিল সমাবেশ করে। জনমতের চাপে অপহরণ ঘটনার প্রায় একমাস পর সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এদিকে সেনা সদর দফতর এক বিবৃতিতে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের জন্য পাহাড়ে সশস্ত্র সংগ্রামরত শান্তিবাহিনীকে দায়ী করে। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ২৪ ডিভিশন (পদাতিক) হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট বিলি করে নিখোঁজ কল্পনার সন্ধানদাতার জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। একই সঙ্গে বিতর্কিত একটি মানবাধিকার সংস্থা ও কয়েকটি জাতীয় দৈনিক দাবি করে যে, কল্পনা চাকমা সহচার্য ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থান করছেন। তিনি তার নিজেদের লোক দ্বারাই অপহৃত হয়েছেন ইত্যাদি।
সেনা সদর দফতর ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ঐ ভূমিকার পর হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও কল্পনার মা বাঁধুনি চাকমা (অপহরণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের জন্য নির্দিষ্টভাবে লাল্যাঘোনা সেনা ক্যাম্পের জনৈক লেপটেনেন্ট ফেরদৌসকে দায়ী করে। বাঁধুনি চাকমা তার মেয়ে শান্তিবাহিনীর দ্বারা অপহরণ বা স্ব-ইচ্ছায় ভারতের ত্রিপুরায় অবস্থান করার কথা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেন। হিল উইমেন্স ফেডারেশন ওই সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির কাজের ধরন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলো।
উল্লেখ্য, কল্পনা অপহরণ রহস্য উদঘাটনে বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের ৩ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি বেশ কিছুদিন নিষ্ক্রিয় থাকার পর রাঙ্গামাটি সদরেই অবস্থান করে ৪শ’র বেশি পাহাড়ি বাঙালি সাক্ষ্য গ্রহণ করে। চলতি বছর মার্চের প্রথোমার্ধে তারা তাদের তদন্ত রিপোর্ট সরকারের কাছে জমা দেয়-যা আনুষ্ঠানিক ভাবে সরকার এখনো প্রকাশ করেনি। তবে দায়িত্বশীল সূত্রের বরাত দিয়ে গত ১৮ মার্চ ‘আজকের কাগজ’ এক প্রতিবেদনে জানায় যে, তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্টে কল্পনা অপহৃত হওয়ার কথা স্বীকার করলেও তার অপহরণের জন্য কে বা কারা দায়ী-তা তারা বলেনি। কল্পনা চাকমার অপহরণের বিষয়ে শান্তিবাহিনী তথা জনসংহতি সমিতি এ পর্যন্ত কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সহ-সভানেত্রী কবিতা চাকমা তার নিখোঁজ সহযোদ্ধার প্রসঙ্গে বলেছেন, কল্পনার অপহরণকারীদের চিহ্নিত করা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে, সেনাবাহিনী কর্তৃক যে জুম্ম(পাহাড়ি) নারীরা নির্যাতিত লাঞ্ছিত হচ্ছিলো, সেগুলো প্রকাশ করে দেয়া কি কল্পনার অপরাধ হয়েছিলো? আর সরকারের দায়িত্ব কি শুধু ঐ তদন্ত কমিটি গঠনা করা পর্যন্ত? কল্পনা অপহরণের ঘটনা দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
সেনাবাহিনীর ঘৃণ্য মুখোশ আরো একবার দেশে বিদেশে উম্মোচিত হলো। কল্পনা অপহরণের ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এ যাবত কতো কল্পনা যে সেনাবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অপহৃত হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। এসব ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও তাদের দোসররা নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। তাদের অপকীর্তি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু কল্পনা অপহরণের ঘটনায় থলের বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। ধামাচাপা দিয়ে রাখা আর সম্ভব হয়নি। কল্পনা অপহরণের পর বলতে গেলে সবাই নিদারুণ ব্যথিত হয়েছেন। অনেকেই এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। দোষী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। কিন্তু বর্তমানে কল্পনার বৃদ্ধা মা, দুই ভাই, বৌদি কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন, তার খবর কেউ নিয়েছে কি না আমার জানা নেই। তারা যে কি দুর্বিষহ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তা ভাবাই যায় না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কল্পনা অপহরণের ঘটনা যেনো তাদেরই অপরাধ। এখনো সেনাবাহিনীরা তাদের বাড়ির আশেপাশে, কখনো দিনে, কখনো রাত্রে তল্লাশি চালায়। অহেতুক জিজ্ঞাসাবাদ করে মানসিকভাবে তাদেরকে চাপের মধ্যে রাখা হয়েছে। নির্যাতন করা হচ্ছে। সরকার অপহরণের মূল হোতাকে ক্যাপ্টেন পদে প্রমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। তার সহযোগী দুই ভিডিপি সদস্য, যাদেরকে কল্পনার ভাই চিনেছিলো, তারা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো পর্যন্ত কোন বিহিত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। অন্যদিকে কল্পনার দু’ভাই নিরাপত্তাহীনতার মধ্য ঘরছাড়া অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। ৭০ বছরের বৃদ্ধা মা মেয়ে হারানোর বেদনায় শোকাহত হয়ে দিনাতিপাত করছেন। এ দীর্ঘ সময়েও সরকার কল্পনার কোন সংবাদ দিতে পারেনি। এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে কত মায়ের কোল খালি হয়েছে তার কোন হিসাব নেই। (দ্র.পার্বত্য চট্টগামঃ নিপীড়ন ও সংগ্রাম, সংস্কৃতি প্রকাশনী, পৃ-৮৫-৮৬)
আজ কল্পনা চাকমার প্রথম অন্তর্ধান দিবসে সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে তিন পাহাড়ি সংগঠন একই সঙ্গে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এবং রাঙ্গামাটিতে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেছে।
আজকের কাগজ : বৃহস্পতিবার ১২ জুন ১৯৯৭