শূন্যের খেলা
প্লেন এরোড্রামের মাটি ছোঁওয়ামাত্র আমাকে ভুলে গিয়েছিল নন্দিনী মিত্তির। হুড়মুড় করে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ুতে দৌড়ুতে নিজের লোকজনের ভিড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। প্রথমে বিস্ময়, পরে চাপা ক্ষোভে গরগর করতে করতে দেখছিলাম রঙীন প্রজাপতির মত ওদের গাড়িটা বাঁক ঘুরে গাছপালার আড়ালে মিলিয়ে গেল।
ক্লান্ত হতাশ, আর ক্ষুব্ধ আমি—একবার ভাবলাম, ত্বরিতে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিই—পরে ঠিক করলাম, হাঁটতে-হাঁটতে যাওয়াই স্বাস্থ্যের পক্ষে এখন মঙ্গল হবে। নন্দিনী যে এমনি করে হঠাৎ কেটে পড়বে, ভাবতেও পারিনি। তার এ অভদ্রতার কোন তুলনা হয় না। অন্তত একবার মামুলী ভদ্রতার খাতিরে ‘তাহলে চলি’ও বলতে পারত! বলল না তো!
যত রাগ গিয়ে পড়ল বৌদির ওপর। আসবার দিন সক্কালে জানিয়েছিল, গৌহাটি থেকে প্লেনে যাবার পথে এক আশ্চর্য সঙ্গিনী জুটিয়ে দিচ্ছে—আমার হয়ত ভালোই লাগবে তাতে। নন্দিনী মিত্রের মত ছটফট মেয়ের ক্ষেত্রে এই এসকর্ট দরকার হতে পারে। মুখ টিপে হেসেছিল বৌদি। সেই প্রথাসিদ্ধ হাসি—যার সরল অর্থ : সাবধান, এগারো হাজার ভোল্ট! সেই হাসির জবাবে বলেছিলাম, প্লেনে সে-সুযোগ কম। নেহাৎ চোখে-চোখে বড়জোর দু-চারটে ঝিলিক! ওতে আমার মত ক্রনিক ব্যাচেলারের চামড়া বেঁধে না। একেবারে শক-প্রুফ হয়ে গেছি এখন।
শুনে বৌদি বলেছিল, রোসো। এক্ষুনি এসে পড়ছে। দেখলেই ভিরমি খাবে।
ভিরমি অবশ্য খাইনি। মনে মনে ভয় পেয়েছিলাম একটুখানি। ঘোড়ার লেজের মত চুলের ছাঁদ আর বিশেষ করে হাতাকাটা লাল ব্লাউস দেখলে আমার অবস্থা হয় দেবর্ষি নারদের মত—হাতে ভরা তেলের পাত্র আর মুখে ঈশ্বরের নাম। দুদিক সামলাতে বড় বিব্রত হওয়া। তার ওপর ওই পক্ষীকণ্ঠশোভন অনর্গল কণ্ঠ-কাকলী। বাড়ি থেকে গাড়ি করে এরোড্রোমে আসবার পথটুকুতেই কয়েকশো কথা কয়ে দিচ্ছিল নন্দিনী। সেসব কথায় শুধু ভূগোলের বৃত্তান্ত। পাহাড়, নদী বন জঙ্গল, তারপর প্রত্নতত্ব, পরিশেষে জলবায়ু-আবহাওয়ার খবর। আমি কী জানি, তার চেয়ে সে কী জানে, তাই নিয়েই আধঘণ্টা পথ কেটে গেল। মুখ খুলবার বিশেষ সুযোগই পেলাম না। তবে মনকে বলেছিলাম, ধৈর্য ধরো—পৃথিবীতে কতকিছু অসম্ভব সম্ভব হয়ে যাচ্ছে, তো এই সামান্য একটুখানি মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার!
প্লেন ছাড়তে কিছু দেরী ছিল। এয়ার-অফিসের কান্টিনে দুজনে দুটো কোকোকোলা নিয়েছিলাম। দোমড়ানো নলটা সোজা করতে গিয়ে হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল নন্দিনী। বলেছিলাম, হাসলেন যে?
জবাবে ফের এক দমক হাসির আবর্ত। আমার মন থেকে আবর্জনা যতটা বাইরে গেল, বাইরের খড়কুটো এসে জমল তারও বেশি। দমে গিয়ে আর মুখ খুলিনি। আমার চেহারা বা পোশাক-আশাকে কি কিছু হাস্যকর ব্যাপার চোখে পড়েছে ওর। প্লেনে ওঠা অব্দি মনটা কুটকুট করছিল। তারপর প্লেন মাটিছাড়া হতেই গা শিরশির করে ওঠা, বেশ কিছুটা ঝাঁকুনি, কিছু দোলা—এসবের ফলে তখনকার মত নন্দিনীর দিকে কিছুক্ষণ আর মনোযোগ ছিল না। চূড়ান্ত উচ্চতায় প্লেন স্থির হয়ে চলতে থাকলে আড়চোখে দেখলাম, সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
এতে ধরে নিয়েছিলাম, তাহলে নন্দিনীর মন ছুঁতে পেরেছি সম্ভবত। এরপর সব যা-যা হওয়া উচিত, তাই নিয়ে মনে মনে ঘটনা সাজিয়ে ফেলছিলাম। দমদম পৌঁছনোর পর উভয়ের ডায়ালগ হওয়া উচিত নিম্নরূপ :
নন্দিনী। কী চমৎকার না লাগছিল! অনেকদিন মনে থাকবে।
আমি। আমারও।
নন্দিনী। কই আপনার ঠিকানাটা দিন তো!
আমি। বারে! আপনারটা?
ন। সে হচ্ছে। আপনারটা আগে চাই। এই নিন কলম।
আ। উঁহু। আগে আপনারটা দিন।
ন। উ: কী সাংঘাতিক মানুষ রে বাবা! নিন, লিখুন। কিসে লিখছেন? আমার কিন্তু অটোগ্রাফ বই।
আ। ইস, কত সব প্রখ্যাত লোকের সই নিয়েছেন।
না। (কেড়ে নিয়ে) উঁহু… দেখতে মানা।
এরপর হঠাৎ নন্দিনীর মৃদু টান। …ওকি, ট্যাকসি করুন। পায়ে হেঁটে যাবো নাকি? অত সোজা নয় মশাই, আগে আমায় পৌঁছে দিয়ে তারপর আপনার ছুটি।
আ। চিরকালের ছুটি নয়তো?
ন। (ভ্রূভঙ্গী করে মুখ ফিরিয়ে) জানি নে যান!
নাঃ এসব কিছুই ঘটল না। আমার দিকে আর চোখ তুলে তাকাল না পর্যন্ত। নিজেদের গাড়ি চেপে উধাও হয়ে গেল সে। কী নেমকহারাম মেয়ে!
দোটানায় দুলতে দুলতে হাঁটছিলাম একা। নিজের অসম্ভব নির্বুদ্ধিতার প্রতি ধিক্কার দিচ্ছিলাম। কে একটা নন্দিনী মিত্তির—বৌদির মাসতুতো বোনের বন্ধু—তার এসকর্টের কোন দরকারই ছিল না। একা প্লেনপথে অন্ধও বাড়ি ফিরতে পারে। শুধু বৌদি ওই ‘জুটিয়ে দেওয়া’ ব্যাপারটা এনে আমার মুণ্ডু ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার প্রথাসিদ্ধ হাসিটুকু এমন সর্বনাশ করে বসবে কে জানত!
অনেক ছোটখাটো ব্যাপারে অনেক সময় মানুষের রাগ হয়। কিন্তু মন তো বহতা নদী—একসময় সবই ভেসে হারিয়ে যায় বিস্মৃতির সাগরে। আশ্চর্যের কথা, নন্দিনীর সেই চলে যাওয়ার ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারলাম না। সারা মন দিনের পর দিন বিস্বাদে ভরে উঠতে লাগল। দেখা পেলেই তার সেই অভদ্রতার উল্লেখ করে দুটো কড়া কথা শুনিয়ে না দিলে এ জ্বালার শেষ হবে না।
কিন্তু ঠিকানা তো জানিনে! বৌদি হয়ত জানে। ঠিকানা চেয়ে পাঠালে সে আবার কত কী সব ভেবে বসবে হয়ত। তাই সে পথে গেলাম না।
কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে নন্দিনীকে আমি খুঁজছিলাম সবখানে। যদি হঠাৎ কোথাও দেখা হয়ে যায়। হয়ে যেতেও তো পারে। এ শহর এক আজব শহর। কত অ-ধরাকে ধরিয়ে দেয়, আবার কত ধরার জিনিস অ-ধরা করে তোলে। ছেলেবেলার এক প্রিয় বন্ধু সনাতনকে চৌরঙ্গীর মোড়ে দূর থেকে দেখে যেতে-যেতে সে ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিল। আবার সবচেয়ে শত্রুকে যতই এড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করেছি, সবিস্ময়ে দেখেছি—একই বাসের একই হাতলে ধরে গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি তার।
একদিন রাসবিহারী এভেন্যুর কাছে পিছনফেরা একটি মেয়েকে দেখে তার সঙ্গে ঘুরপথে কালীঘাট অব্দি হেঁটে গিয়ে পরে আবিষ্কার করলাম, সে নন্দিনী নয়। এরকম ভুল প্রায়ই হচ্ছিল। বিশেষ করে ঘোড়ার লেজওয়ালা মাথা আর হাত-কাটা লাল ব্লাউস দেখলে মাথায় জেদ চেপে যাচ্ছিল। এমনি করে কতদিন নন্দিনী মিত্রকে খুঁজে ব্যর্থ হলাম! তাকে না-বলা কটু কথাগুলো কেবল আমাকেই বিস্বাদে ঝাঁঝে বিষিয়ে তুলতে লাগল। তবু যখনই ফাঁক পাই, তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল একরকম।
অবশেষে এক সন্ধ্যায় এতদিন পরে নন্দিনী মিত্রকে আবিষ্কার করলাম। গড়ের মাঠের একপ্রান্তে ঝোপের আড়ালে খুব ঘনিষ্ঠভাবে একটি যুবকের সঙ্গে বসে ছিল সে। একা থাকলে কী হত বলতে পারব না—সঙ্গে ওই নর্দমা-প্যান্ট থাকায় রাগে শরীর জ্বলে উঠল আমার। নির্জন ঝোপঝাড়ে সন্ধেবেলা বেশ চলেছে তাহলে!
কিন্তু, নন্দিনীকে আর যাই ভাবি এত সাধারণ মেয়ে বলে আদৌ ভাবতে পারিনি কোনদিন! ওই বাজে মস্তানপ্রকৃতির ছেলেটির সঙ্গে এইভাবে সে প্রেম করবে, কল্পনাও করিনি। যাই করুক সে—তার স্থান কিন্তু উঁচুতেই দিয়েছিলাম। ও ছিল আসলে আমার এক অ-ধরা। ওকে ধরবার খেলায় মনও কি চুপিচুপি জীবনের ভিন্ন এক স্বাদ টের পাচ্ছিল না? যখনই ওকে ভেবেছি—দেখেছি, চিরকালের সেই প্রেমিকাদের একজন। অজস্র ভালোবাসার আলো মিলে গড়েছে এক জ্যোতির্বলয়। ওকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তার ছটায়ও আকাশের পরীদের মত সুন্দর আর পবিত্র! হয়ত কড়া কথা শোনাতে গিয়ে বলে বসতাম, দুষ্টু মেয়ে, সেদিন অমন করে পালিয়ে গেলে কেন বলতো? আমায় কষ্ট দিয়ে কী সুখ পেয়েছ তুমি! নয়ত শুধু মুখ টিপে হেসে বলতাম, মিস মিত্র, মনে পড়ে না?…যদি জবাব পেতাম : বলুন তো কী, বলতাম—কেন, সেই কয়েকটি ঘণ্টার আকাশযাত্রা, যখন ইচ্ছে করছিল যদি উধাও হয়ে যাই অনন্ত শূন্যের মাঝে কোন নীল কবোস্ব নক্ষত্রের দিকে, আর (প্লেনের পাইলট বাদে) আর সব যাত্রী হঠাৎ কর্পূরের মত উবে গেছে আমার ভালবাসার যাদুমন্ত্রের বিপুল চাপে, মাত্র আমরা দুজন যাত্রী!…মিস মিত্র কি ভয় পেয়েছিলেন? পাননি। আস্বস্ত হলাম তাহলে। দেখুন, ব্যাপারটা সামান্য, হয়ত তুচ্ছ—তবু ওই ইচ্ছেটা যেহেতু আকাশের ওপর জেগে উঠেছিল, ওর মহত্ব আপনি অস্বীকার করতে পারেন না! মাটিতে পা দিলে অবশ্য সবই উদ্ভট বা বাজে লাগে। কারণ, মাটি খুব নোংরা জিনিস দিয়ে তৈরী।
নন্দিনী ছিল আমার কাছে ভালবাসার এক বিশুদ্ধ প্রতীক। আর সে এখন এক মস্তানের নর্দমাপ্যান্টে শরীর এলিয়ে তার কুৎসিত মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। পাতা-ডালপালার ফাঁক দিয়ে যে আলোর কুচি ওর মুখে পড়েছে, তাতেই চিনতে পারলাম। সেই মুখ, সেই সরু নাক, চাপা চোখের টানা ভুরু, সুন্দর চিবুক। পাকা শশার মত মুক্ত বাহু পাপ-পুণ্যের মাঝামাঝি লোভনীয় সাঁকোর মত আলো-অন্ধকারে দুলছে। দেখতে দেখতে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। ঘৃণায় ক্ষোভে রাগে অস্থির হয়ে দ্রুত কাছে গেলাম। প্রথমেই ছেলেটিকেই বলে বসলাম, কী দাদা, খুব যে…
ছেলেটি লাফ দিয়ে উঠল। পরক্ষণেই ঝাঁপিয়ে পড়ল হাতের মুঠো পাকিয়ে। চোয়ালে প্রচণ্ড ঘা খেয়ে ছিটকে পড়লাম। মেয়েটি চিৎকার করছিল, পুলিশ, পুলিশ! তারপর আর উঠে দাঁড়ানোর ফুরসুৎ পাওয়া গেল না। কোত্থেকে কারা সব দুদ্দাড় দৌড়ে আসছিল। এসেই ভীষণভাবে মারতে থাকল আমাকে। একসময় আর কিছু টেরই পেলাম না।
হাসপাতাল থেকে মেজদা ছাড়িয়ে এনেছিলেন। তাঁর তদ্বিরে আর পুলিশের হাঙ্গামায় পড়তে হয়নি। বেশ কিছুদিন বাড়ি বসে থেকে শরীরটা সারিয়ে নিচ্ছিলাম। পৃথিবীকে বিস্বাদে ভরিয়ে দিল নন্দিনী এমনি করে। কেবল মানুষের নিষ্ঠুরতার কথা ভাবতে ভাবতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটি মানুষকে খুন করতে ইচ্ছে করছিল। পেন্সিল-কাটা ছুরিটা দিয়ে জানালার চৌকাঠ পেঁচিয়ে কেটে মানুষের গলাকাটার শোধ তুলি। শূন্যে ঘুরিয়ে তাক করে ছুঁড়ে মারি নন্দিনী মিত্রের দিকে—ছুঁড়েই চমকে উঠে দৌড়ে যাই। কুড়িয়ে নিয়ে মনে মনে বলি, কিছু মনে করো না। এ আমার শূন্যের খেলা।
পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো! এবং এই ভয়ে অবশেষে বাড়ি থেকে বেরোতেই হল। গড়িয়াহাটের মোড়ে হঠাৎ ফের দেখা পেয়ে গেলাম নন্দিনীর। আমি কাছে যাবার আগেই দোতলা বাসে চেপে বসল। দৌড়ে চলন্ত বাসটার দিকে এগিয়ে হাতল খুঁজতে গিয়ে পড়ে গেলাম নীচে। জোর বাঁচা বলতে হয়। কিন্তু উঠে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। বাঁ পায়ে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। কারা ধরাধরি করে নিয়ে গেল পাশের ডিসপেন্সারিতে। টিপে দেখে ডাক্তার বললেন, কমপাউন্ড ফ্র্যাকচার!
ব্যাস! ফের হাসপাতাল। ফের আরও কয়েকটা মাস। বেরিয়ে দেখি, আগের মত আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটা যাবে না। একটু খোঁড়াতেই হবে।
নন্দিনী আমার সর্বনাশ করে গেছে টের পেতে এতদিন লেগে গেল। ক্রমশ সে আমাকে আরো জঘন্যভাবে নীচে নামিয়ে দিচ্ছে আর নিজে বেশ দূরে বোতাম টিপে চলছে। সার্কাসের খেলোয়াড় হতে চেয়েছিল যে, সে হয়ে গেল নিতান্ত লোক-হাসানে ভাঁড় মাত্র। নন্দিনীর শূন্যের খেলাটাই জমেছে—আমি হেরেছি। ক্রমশ সে আমাকে পাতালের দিকে নিয়ে চলেছে—যেখানেই সম্ভবত নরকের স্থান। আমাকে দিয়ে আরও কত জঘন্য কাজ সে করাবে হয়ত।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ দেখা হয়ে গেল সুব্রতর সঙ্গে। সুব্রত আমার বাল্যবন্ধু। থাকে নৈহাটিতে। একথা-ওকথার পর সে জানাল, সম্প্রতি বিয়ে করেছে। আমার ঠিকানা জানা না থাকায় জানাতে পারেনি।
সুব্রত বলল, সামনের রোববার আয় আমার ওখানে। বৌ দেখে আসবি।
শুধু বললাম, দেখি।
সুব্রত চমকে উঠে বলল, আরে, আরে। তুই খোঁড়াচ্ছিস যে! কী ব্যাপার?
বাস থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।
গ্রহের ফের। কোন ভালো জ্যোতিষীর কাছে যা। তোর চেহারাটাও খুব খারাপ দেখাচ্ছে।…হ্যাঁ রে, প্রেমে-ট্রেমে পড়িসনি তো?
সুব্রত হেসে উঠল। কিন্তু এবার আমার চমকানোর পালা। আমার চেহারায় কি প্রেমে পড়ার কোন চিহ্ন ফুটে উঠেছে চর্ম রোগের মত। দাড়ি অবশ্য একদিন অন্তর কাটি। আজ ছিল কাটবার দিন। বেশ পরিচ্ছন্ন কাপড়চোপড় গায়ে চড়িয়েছি। তবু ও কী দেখল আমার মধ্যে। সুব্রতকে বরাবর বুদ্ধিমান আর হিসেবী বলে জানি। আমি বললাম, কী বলিস! এ-ভূতের মত কুচ্ছিত চেহারা নিয়ে প্রেম করার আশা কোথায়?
সুব্রত ধমকাল। …থাম, থাম। ওটা ব্যজস্তুতি। ওরকম কন্দর্পকান্তি থাকলে আমি…যাকগে। তাহলে সামনের রোববার যাচ্ছিস। কেমন? কখন যাবি? সকালে, না বিকেলে?
বিকেলেই যাবো!
মনের মেজাজ বোঝা কঠিন। রোববারের বিকেলে নৈহাটির মত জায়গায় গিয়ে সুব্রতর মত গেরস্থ সাধারণ চরিত্রের ছেলের বৌ দেখবার তাগিদ আদৌ ছিল না। কিন্তু কিসে কী হয়ে যায়। সুব্রত আমার চেহারার প্রশংসা করেছিল—কথাটা অনেকদিন ভোলা গেল না। আমি জানি, আমি কন্দর্পকান্তি নই; তবু এই মানসিক অবস্থায় সুব্রতর ওই ছোট্ট কথাটুকু সুড়সুড়ি দিচ্ছিল সম্ভবত। কথামত ওর ওখানে গেলাম রোববার বিকেলে।
গঙ্গার ধারে বেশ চমৎকার জায়গায় বাড়ি করেছে সুব্রত। বরাবর ওকে অধ্যবসায়ী ছেলে বলে জানতাম। পৈতৃক ছোট্ট একটা ব্যবসা ছিল। সেটাকে কামধেনুতে রূপান্তরিত করেছে প্রচুর সাধনায়। ওর উদ্যমের প্রতি ঈর্ষাবোধ হচ্ছিল। দিন-রাত্তির এত সব স্থূল কাজকর্মের বোঝা যাকে বইতে হয়, তার অবশ্য আমার মত উটকো মনোবেদনার ব্যাধি না থাকাই সম্ভব। নিষ্কর্মাদের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এক ঝক্কিকার।
ওর বাইরের ঘরে যখন অপেক্ষা করছি, তখন পর্দার ওদিকে একটা চাপা কলগুঞ্জন, তারপর মৃদু ধ্বস্তাধ্বস্তি, শেষে ধমকের ফিসফিস শোনা গেল। কাকে যেন টানাটানি করছে সুব্রত, সে ভারী অবাধ্য। ব্যাপার কী?
একটু পরেই সুব্রত এল পর্দা তুলে। ওর মুখটা কেমন থমথমে আর লাল—অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল, বোস, বোস। তোর খারাপ লাগছে না তো?
বললাম, না, না। খারাপ লাগবে কেন?
সুব্রত মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর তার ঘরবাড়ি ব্যবসা-পত্তরের কথা বলতে লাগল। ইতিহাস বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে সে আড়চোখে একবার করে অন্তরমহলের পর্দাঢাকা দরজার দিকে সতৃষ্ণ চোখে তাকাচ্ছিল।
দুম করে বলে ফেললাম, তোর বৌ কোথায়? আলাপ করিয়ে দিলিনে যে!
সুব্রত নীরস মুখে বলল, আসছে এক্ষুনি। মেয়েদের তো জানিস, অতিথি এলে যা সব করেটরে।…
আমি উঠে দাঁড়ালাম।…চল, ভিতরে গিয়েই আলাপ করে আসি। আপত্তি নেই তো?
সুব্রত হঠাৎ উৎসাহী হয়ে উঠল।… সেই ভালো। যা মুখচোরা মেয়ে, লজ্জায় একাকার। মাইরি, এসব ব্যাপারে ও একটু…যাকে বলে, ভীষণ ইয়ে…
আরও কী বলছিল সুব্রত। ওদিকে ভিতরে ঢুকেই আমি কাঠ। নন্দিনী, হ্যাঁ নন্দিনীই তো, পলকে লাল বেনারসীর ঘোমটা ছ’ ইঞ্চি ঝুলিয়ে পাশ ফিরে দাঁড়িয়েছে! একটু নীচু টেবিলে চায়ের কাপ খাবারের প্লেট রয়েছে। সম্ভবত কাপে চা ঢালছিল—একটা কাপের পুরোটা ভরতিও হয়নি—আমাকে দেখামাত্র চমকে উঠে হাত তুলে নিয়েছে। পিছন ফিরেছে।
সুব্রতর মত সাধারণ গেরস্থ ছেলের সঙ্গে নন্দিনীর বিয়ে হয়েছে! আপাতদৃষ্টে এটা যত বিষম দৃশ্যই বোধ হোক, এর কারণ আমি অনেকখানিই জানি। চরিত্রভ্রষ্টা মেয়েকে বাধ্য হয়ে এমনি সাদাসিধে জায়গায় গছাতে হয়েছে—নৈলে হালে পানি পেত না ওর বাবা। তাছাড়া আর কোন অর্থ হয় না এ বিয়ের।
সুব্রত ততক্ষণে ওকে টানাটানি করে আমার সামনে দাঁড় করানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। মুখটা একটুখানি দেখলাম ফের। নন্দিনীই তো! তবু নামটা যতক্ষণ না জানছি, আশ্বস্ত হওয়া কঠিন। এক ফাঁকে বললাম, দেখুন, ওসব লজ্জাটজ্জা করার কোন মানে হয় না—আমাকে তো ভালই চেনেন…
সুব্রত বলল, বলিস কী রে! তুই ওকে চিনিস!
বললাম, চিনি মানে—একদিন পথে আসতে-আসতে আলাপ।
তাই বল। সুব্রত ফ্যাঁচ করে হাসল।…তাহলে তো নন্দা, তুমি খুব অপমান করছ ওকে।
আমি বললাম, ওকে অবিশ্যি নন্দিনী বলেই জানতাম।
সুব্রত অবাক হয়ে বৌর উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ গো, তোমার আবার নন্দিনী নাম ছিল নাকি? বেশ মজার ব্যাপার তো!
নন্দিনীর মৃদু আওয়াজ শুনলাম। সেটা হ্যাঁ বা না, কিংবা অন্য কিছু, তা বোঝা গেল না। মনে হল, বেচারা ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। কাঁপছে হয়ত। খুব প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে ভেবে আমার যা আনন্দ হচ্ছিল বলার নয়। এবার যথেষ্ট হয়েছে। ওকে কিছুক্ষণ একলা থাকতে দেওয়া ভালো। আমরা বেরিয়ে বসবার ঘরে এলাম। নন্দিনীর ঘোমটা পূর্ববৎ রয়েছে—কোনরকমে এ ঘরে ভরা ট্রেটা পৌঁছে দিয়েই কেটে পড়ল। গড়ের মাঠের সেই সাংঘাতিক কাণ্ড নিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেল করব ভেবে হয়ত খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে কিন্তু হঠাৎ আমার মনটা বিস্বাদে ভরে উঠল। নন্দিনী তাহলে ফাঁকি দিয়ে হাতের নাগালের বাইরে চলে গেল! আর কিছু বলা যাবে না— শোনানো যাবে না কোন বড় কথা। সেজন্যেও হয়ত নয়—আমি টের পাচ্ছিলাম, এতদিন পরে স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে আমি নন্দিনীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম এটাই আসল কথা।
নিজের প্রতি রাগে ক্ষোভে অস্থির হয়ে একটা অছিলা দেখিয়ে কেটে পড়লাম তক্ষুনি। সুব্রত নিরাশ হয়ে বলল, খুব জরুরী কাজ যখন বলছিস, তখন আর আটকাবো না। ফের একদিন আয়। আসবি তো?
আমি বললাম, আসবো।
ফেরার পর যতবার মনে পড়ছিল যে নন্দিনী আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে চিরকালের মত—তত আমি উত্তেজিত হয়ে উঠছিলাম! এবং সেইসব জাতীয় উদ্ভট আচরণের মূলে ছিল নন্দিনীর প্রতি আমার অন্ধ প্রেম—এই সত্যটুকু বিষের মত পুরনো ক্ষতে সংক্রামিত হয়ে আমার জ্বালা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। না, নন্দিনীকে আমি জীবনে সুখী হতে দেব না!
ঝোঁকের বশে সুব্রতকে একটা চিঠি লিখে বসলাম। চিঠিতে নন্দিনীর গড়ের মাঠের সেই গোপন প্রেমচর্চার কাহিনীটুকু সবিস্তারে জানিয়ে দিলাম। সুব্রত এতে ক্ষেপে যাবে নিশ্চয়। কী ভাবে নেবে—সেটা অবশ্য অনুমান করা কঠিন আপাতত। কিন্তু নন্দিনীকে বলবে এবং নন্দিনী মনে মনে শিউরে উঠবে। আমাকে মনে পড়বে। গৌহাটী থেকে প্লেনে আসবার কথা—তারপর হঠাৎ কোন কথা না বলে চলে যাওয়ার ঘটনা—সবই ও বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করবে।
চিঠি পেয়েই সুব্রত হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির।…আরে, তুই কীসব মাথামুণ্ডু লিখেছিস!
দৃশ্যটা উপভোগ করছিলাম। কোন জবাব দিলাম না।
সুব্রত বলল, গড়ের মাঠে ওর বেড়ানোর চান্স কিছুতেই থাকতে পারে না। ও তো গ্রামের মেয়ে।
চমকে উঠে বললাম, গ্রামের মেয়ে মানে?
সুব্রত বলল, হ্যাঁ। কুতুবপুরের মেয়ে। তিনকুলে কেউ নেই। মামার বাড়ি মানুষ হয়েছে। তোকে বলতে লজ্জা নেই—সামান্য লেখাপড়া জানে মাত্র। তবে বুঝতেই তো পারছিস, ওর স্বাস্থ্য-টাস্থ্য বা চেহারা বেশ ইয়ে—তাই পছন্দ হয়ে গেল।
রাগে চেঁচিয়ে উঠলাম।…ব্লাফ দিস নে সুব্রত। ওর মুখের প্রত্যেকটি রেখা আমার চেনা। কোনমতে ভুল হতে পারে না। গৌহাটি থেকে প্লেনে ওকে সঙ্গে করে দমদম আসছিলাম—তারপর…
সুব্রত হাসতে হাসতে ফেটে পড়ল।…মাথায় জল ঢাল খানিক। প্লেনে আসছিল নন্দা—হি…হিহিহি…তারপর হাসি থামিয়ে বলল, তোর চোখের ভুল। আসলে সেই মেয়েটিকেই তোর একটুও মনে নেই।
মনে নেই? আমার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। নিঃসাড় হয়ে কিছুক্ষণ ব্যাপারটা ভাবতে চেষ্টা করলাম। সুব্রত একটা গোপন চাবি—যা এযাবৎকাল আমার হাত এড়িয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ টিপে দিয়েছে! আরে তাই তো! তাই তো! কয়েক ঘণ্টার দেখা মুখ—আমার কি সত্যি সত্যি মনে থাকা সম্ভব? নন্দিনীর মুখ বলে যে সুন্দর উজ্জ্বল মুখখানি আমি এতদিন যত্ন করে ধরে রেখেছি, তা আমারই বানানো নয়ত? দাদার বিয়ে হয়েছে আজ চার বছরেরও বেশি, থাকে গৌহাটিতে—সেই বৌদির মুখও তো স্পষ্ট মনে পড়ে না! মাঝে মাঝে মনে করতে চেষ্টা করি—মনে পড়ে আবার পড়েও না! মাঝে মাঝে যাদের সঙ্গে দেখা হয়—তাদের মুখও স্পষ্ট মনে থাকে না অনেক সময়। শুধু দেখা হলেই যা চেনা যায় এইমাত্র। নন্দিনীকে আমি কতক্ষণই বা দেখেছি!
আর ভুল মুখের বা ভুল চেহারার পিছনে ধাওয়া করা হাস্যকর। কিন্তু পুরনো ব্যথাটা থেকেই গেল। একবার মাত্র দেখা হলেই যেন সব নিরাময় হয়ে যাবে।
এর কিছুদিন পরে দাদাবৌদি এসে গেল। নির্জন বাড়ি আনন্দে ভরে উঠল! একথা ওকথার পর এক ফাঁকে বৌদিকে বলে বসলাম, আচ্ছা বৌদি, সেই মেয়েটির খবর কী?
বৌদি বলল, কোন মেয়েটি? তুমি এখনও মেয়েদের খবর রাখতে ভোলনি দেখছি। ভেবেছিলাম, ক্রনিক ব্যাচেলারদের নারীপুরুষ ভেদজ্ঞান থাকে না। তোমার আবার কী হল?
বললাম, ঠাট্টা নয়। তোমার সেই অদ্ভুত মেয়েটির খবর জানতে চাচ্ছি। বেশ ভালো সঙ্গিনী জুটিয়ে দিয়েছিলে! বাপস!
বৌদি হাসল।…নন্দিনীর কথা বলছ? কেন, কী করেছিল ও?
কিছু না। যা বকবক করছিল সারা পথ!
ও একটু খামখেয়ালী মেয়ে। বৌদি চোখ টিপে ফের বলল—তারপর বুঝি আর পাত্তা দেয়নি?
বাজে বকো না।
বুঝেছি। ওর কাছে পাত্তা পাওয়া কঠিন। চেষ্টা করেছিলে নাকি?
দায় পড়েছে! এবার আমি ফেটে পড়লাম।…ওরকম অভদ্র মেয়ে আমি কোথাও দেখিনি কিন্তু। দমদমে নেমেই কোন কথা না বলে নিজেদের গাড়িতে কেটে পড়ল! মামুলী ভদ্রতারও বালাই নেই।…
সব শুনে বৌদি একটু চুপ করে থেকে বলল, তাই নাকি! এতসব কাণ্ড হয়ে গেছে! কিচ্ছু জানাওনি তো! আমরা শুনেছিলাম, বাস থেকে পড়ে এ্যাকসিডেন্ট করেছ। কী আপদ!
বৌদি কেমন দমে গিয়েছিল যেন। বললাম, ওর ঠিকানাটা আমার ভারী দরকার।
ঠিকানাও দেয়নি বুঝি?
না।
ঠিকানা আমার কাছে আছে। কিন্তু যে এমন অভদ্র, তার ঠিকানা নিয়ে কী করবে? গাল দিয়ে আসবে নাকি?
ঠিক তাই।
বৌদি হাসতে হাসতে বাকসো খুঁজে একটা গানের খাতা আনল। তার কোন কোনায় একটা ঠিকানা লেখা রয়েছে। টুকে নিলাম তক্ষুনি। বৌদি বলল, সেই ভালো। ঝগড়া করে এসো। কিন্তু দেখো, ফের মাথা খারাপ না হয়ে যায়! একখানা পা গেছে, ফের আর একখানা না খুইয়ে বসো আবার।
মার্চের সুন্দর সকালে হাল্কা মনে, এতদিন পরে, সত্যিকার নন্দিনীর কাছে পৌঁছতে যাচ্ছিলাম। কিছুদূর এসে হঠাৎ মনে হল, কে যেন পিছন থেকে পা দুটোকে টেনে ধরছে ক্রমশ। বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে আর পা তুলতে পারলাম না সামনের দিকে। কী দরকার! কেন ক্ষোভ, কেন কটুকথা বলার এত সাধ! ক্ষণিকের এক সঙ্গিনী মেয়ে—আমাকে কী ভেবেছিলে, সম্মান না অপমান করেছিল, তা নিয়ে মাথাব্যথার কোন অর্থ হয় না। তার ওই অভদ্রতাটুকুর মূল্যে এদিকে আমি এতগুলো দিন কত কীসব বিচিত্র জিনিস কিনে বসে আছি—সে তো কম নয়!
শুধু একটা তীব্র কৌতূহল শেষঅব্দি থেকে যায়। সত্যিকার নন্দিনীর চেহারাটা কেমন ছিল? পা তোলার চেষ্টা করলাম। নাঃ, থাক। যা স্বপ্নে আছে, মায়ায় আছে, তা স্বপ্নে বা মায়ায় থাক—বাস্তবের রক্ত-মাংসে তা মিলিয়ে নিতে গিয়ে আবার কী ক্ষতি করে বসব কি না কে জানে। ক্ষণিকের দেখা একখানি মুখ অজস্র মুখের পিছনে আমাকে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে, অস্থির করেছে,—তা খুঁজে পাওয়া গেলেই তো সব খেলার শেষ। অ-ধরাকে ধরতে পারলেই যা ছিল, সব হারিয়ে কাঙাল হওয়া। নন্দিনীর ঠিকানাটা ছিঁড়ে ফেললাম। ফিরে এলাম আস্তে আস্তে। সারাজীবন ধরে ভিড়ের মাঝে কোন মেয়ের মুখ দেখে নন্দিনী বলে চমকে ওঠার স্বাদ আমি বারবার পেতে চাই।…