৮
জ্বরটর হয়নি, শরীর ভালই আছে, তবু মধুপুর থেকে ফিরতি ট্রেনেই গিরিডি ফিরে এসেছে যূথিকা। একি কাণ্ড! কি বিশ্রী ব্যাপার! কুসুম ঘোষ তাঁর দু’চোখের বিস্ময় সামলাতে গিয়ে শেষে সন্দেহ করেন, মেয়েটার মাথায় সত্যি সত্যি পাগলামির ছিট দেখা দিল না তো?
চারু ঘোষ বলেন—আমি তো যূথির মতিগতির কোন অর্থই খুঁজে পাচ্ছি না।
এখন পাটনা যেতে একটুও ভাল লাগছে না; এই কথা ছাড়া আর কোন কথা বলতে পারেনি যূথিকা। কথাগুলি একটুও মিথ্যে নয়। এবং বিশ্বাসও করেন উদাসীনের পিতা আর মাতা। কিন্তু, কেন পাটনা যেতে একটুও ভাল লাগছে না? এ যে একটা অত্যন্ত অন্যায় ভাল-না-লাগা! অনেকবার আক্ষেপ করেন কুসুম ঘোষ।
কেন পাটনা যেতে ইচ্ছে করছে না? এ যে নিতান্ত বোকার মত ইচ্ছে না-করা! বারবার এবং বেশ একটু রূঢ় স্বরে অভিযোগ করেন চারু ঘোষ।
এবং মাত্র আর তিনটে দিন পার হবার পর, পাটনা থেকে কণিকা মামীর একটা মস্ত বড় চিঠি এসে উদাসীনের পিতা আর মাতার মনে আবার একটা কঠিন উদ্বেগের বেদনা ছড়িয়ে দেয়।
জানিয়েছে কণিকা; আর তিন-চার দিনের মধ্যে নরেন পাটনাতে এসে পড়বে। এবং এইবার বেশ কিছুদিন পাটনাতেই থাকবে। নরেনের চিঠির ভাষা থেকে বুঝতে পেরেছে কণিকা; এবার পাটনাতে এসে মন স্থির করে একটা পাকা কথা দিয়ে ফেলবে নরেন। নরেনের মা’র সঙ্গেও আলাপ করে তাই মনে হয়েছে কণিকার। তা না হলে দেড় মাসের ছুটি নেবে কেন নরেন?
আরও কতগুলি কথা খুবই বিরক্ত হয়ে লিখেছে কণিকা;—কিন্তু আপনাদের প্রতিবেশী গণেশবাবুর বড় ছেলে, অর্থাৎ লতিকার ডাক্তার দাদা শীতাংশু যে কেন এত ঘন ঘন নরেনের মা’র সঙ্গে দেখা করছে বুঝতে পারছেন কি? মাঝে একদিনের জন্যে আমি সাসারাম গিয়েছিলাম। ফিরে এসে জানলাম, নরেনও একদিনের জন্য পাটনা এসেছিল। যূথিকার সঙ্গে নরেনের ভাবসাব আছে, একথা তো ওরাও জানে। তবু দেখুন, কি কুৎসিত মনোবৃত্তি? নরেনের কাছে লতিকাকে গছাবার জন্য কী চক্রান্তই না ক’রে চলেছে। লতিকার মা, আপনাদেরই প্রতিবেশিনী সেই সাংঘাতিক মহিলাটি, এরই মধ্যে একবার পাটনা ঘুরে গিয়েছেন। নরেনকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে লতিকার গান শুনিয়েছেন। নরেনের মা’র কাছে লতিকার একখানা ফটো আর লতিকার লেখা এক গাদা কবিতার একটা খাতা রেখে গিয়েছেন। কিন্তু ওদের কোন মতলবই সফল হবে না, যদি এইসময় যূথিকা এসে পাটনাতে থাকে।
সব শেষে লিখেছে কণিকা—যূথিকার একটা বিশ্রী দোষ এবার দেখলাম। মেয়েটা কি-যেন সন্দেহ করেছে আর হতাশের মত হাঁপিয়ে পড়েছে। ওরকম ভুল করলে চলবে না যূথিকার। ওকে একটু বুঝিয়ে দেবেন; নরেন যদি, ভগবান না করেন, কোন কারণে কিছু সন্দেহ ক’রে ফেলে, তবে কি পরিণাম হবে কল্পনা করুন। যদি লতিকার সঙ্গে নরেনের বিয়ে হয়ে যায়, তবে যূথিকার কি আর কারও কাছে মুখ দেখাবার উপায় থাকবে?
—এই নে, কণিকার চিঠি পড়ে দেখ। কুসুম ঘোষ রাগ করে চিঠিটাকে যূথিকার হাতের কাছে ফেলে দিয়ে যান।
পাটনার মামীর প্রকাণ্ড চিঠিটা পড়েই চমকে ওঠে যূথিকা। যেন হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠেছে যূথিকার প্রাণ। অনেকক্ষণ চুপ ক’রে যেন আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে যূথিকা। তারপরেই ছটফট ক’রে ওঠে।
লতিকার মনের আশার ইতরতা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে যূথিকা। লতিকার জীবনের জেদটাও কী ভয়ানক বেহায়া! তাইতো? কি হবে উপায়? নরেন সত্যিই যদি ভুল করে লতিকার মত মেয়েকে…ভাবতে গিয়ে উদাসীনের মেয়ে যূথিকার মনের ভিতরে একটা অস্বস্তি, বোধহয় একটা উদ্বেগের ছায়া ছটফট করতে থাকে।
নরেনের মনটা যদি এত উদার আর কোমল না হতো তবে এক মুহূর্তের জন্যও উদ্বেগে বিচলিত হতো না যূথিকার মন। কিন্তু নরেন খুব বেশি ভদ্র বলেই বোধহয় শীতাংশু ডাক্তারের ইচ্ছা আর চেষ্টার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ক’রে অভদ্রতা করতে পারে না। নইলে কবেই মাত্র একটি স্পষ্ট কথা বলে শীতাংশুদার উৎসাহ থামিয়ে দিতে পারতো নরেন।
বললেই তো পারতো নরেন; বললো না কেন? আমি যূথিকাকে ভালবাসি, যূথিকা আমাকে ভালবাসে, সুতরাং, আপনি বৃথা আর লতিকার গান শোনাবার জন্য আমাকে ডাকবেন না; একথাটাও শীতাংশু ডাক্তারকে বলে দিলে এমন কিছু অভদ্রতা হতো না।
কল্পনা করতে পারে যূথিকা, নরেনের সঙ্গে যূথিকার বিয়ে হয়ে যাবার পর শুধু লতিকা নয়, এই গিরিডির আরও অনেকে যূথিকার ভাগ্যকে হিংসে না করে পারবে না। ত্রিশ বছর বয়সে একহাজার টাকা মাইনের সরকারী সার্ভিস করে যে নরেন, সে নরেনের পক্ষে যূথিকার চেয়ে ঢের ঢের বেশি শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করবার অসুবিধা ছিল না। কিন্তু শুধু ভালবাসার সৌভাগ্যে যূথিকা ঘোষই যে নরেনের জীবনের সঙ্গিনী হয়ে যাবে! যদি হিংসে করতে হয়, তবে যূথিকার এই ভালবাসাকেই হিংসে করুক না সবাই।
কিন্তু যূথিকা যদি পাটনা যেতে চায়, তবে নিয়ে যাবে কে? শুনতে পায় যূথিকা, বাবা আর মা বাইরের ঘরে বসে এই সমস্যার কথাও আলোচনা করছেন। বলাইবাবু বাতের ব্যাথায় আবার পঙ্গু হয়ে গিয়ে উদাসীনের ভাবনাগুলিকে সমস্যায় ফেলেছেন।
—যূথি। চেঁচিয়ে ডাক দেন চারুবাবু।
বাইরের ঘরের দরজার কাছে যূথিকা এসে দাঁড়াতেই গম্ভীর-স্বরে আদেশ করেন কুসুম ঘোষ—তোমাকে এখনই, আজ এই সন্ধ্যাতেই পাটনা রওনা হতে হবে।
চারুবাবু—আমি এখনি সেই লোকটাকে খবর পাঠাচ্ছি…কি যেন তার নাম?
হেসে ফেলে যূথিকা—হিমাদ্রিবাবু।
হ্যাঁ, ডাক শুনে চলে আসতে দেরি করেনি হিমু। এবং যূথিকাকে সঙ্গে নিয়ে পাটনা রওনা হয়ে যেতে একবিন্দু আপত্তিও করেনি।
গিরিডির স্টেশনের ভিড় আর হল্লা পিছনে ফেলে রেখে ট্রেনটা যখন আবার রাঙা মাটির মাঠের উপর দিয়ে, দু’পাশের যত সবুজ শোভার ভিতর দিয়ে হু হু ক’রে ছুটে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন যূথিকা ঘোষের মুখে যেন একটা প্রাণখোলা হাসির এক ঝলক তরল আভা ছড়িয়ে পড়ে।—হিমাদ্রি যে আমাকে চিনতেই পারছো না।
হিমুও হাসে—তুমি জান, চিনতে পেরেছি কি না।
যূথিকা—তবে এরকম না চেনবার ভঙ্গী ক’রে গম্ভীর হয়ে আছ কেন?
হিমু—তোমার গম্ভীরতা দেখে।
যূথিকা—আমি গম্ভীর?
হিমু—হ্যাঁ, এতক্ষণ খুব বেশি গম্ভীর হয়ে কি যেন ভাবছিলে।
যূথিকা—হ্যাঁ, সত্যি হিমাদ্রি; মানুষের ইতরতার রকম দেখে খুবই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি।
হিমু—ওসব কথা ছেড়ে দাও। ওসব কথা যত ভাববে, তত নিজেরই ক্ষতি হবে।
যূথিকা উৎফুল্ল হয়ে বলে—ঠিক কথা বলেছো হিমাদ্রি, এরকম পরামর্শের জন্যেই যে মানুষের একটা বন্ধুমানুষ দরকার।
কিন্তু আবার কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে আনমনার মত চোখ নিয়ে কি-যেন ভাবতে থাকে যূথিকা ঘোষ। মানুষের ইতরতার কথা না হোক, অন্য কোন কথা নিশ্চয় ভাবছ। হিমু প্রশ্ন করে; এই বোধহয় হিমু নিজের থেকে যেচে, কে জানে কোন্ সাহসের ছোঁয়া পেয়ে, প্রশ্ন করে হিমু—আবার কি ভাবতে আরম্ভ করলে?
খিল খিল করে হেসে ওঠে যূথিকা।—যা ভাবছিলাম, সেকথা তোমাকে বলা উচিত কিনা, তাই ভাবছি।
—ভেবে দেখ। হিমুও হেসে হেসে জবাব দেয়।
যূথিকা—কলেজ খোলেনি, তবু কেন পাটনা যাচ্ছি বলতে পার?
হিমু—যদি বলতে পারতাম, তবে বলেই ফেলতাম। তোমার আর জিজ্ঞাসা করবার দরকার হতো না।
যূথিকা—অভিসারে যাচ্ছি।
হিমু মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।
যূথিকা—শুনে লজ্জা পেলে তো হিমাদ্রি?
হিমু—না। কিন্তু তোমার ইচ্ছেটা এই যে, তোমার কথা শুনে আমি যেন লজ্জা পাই। আসলে কিন্তু নিজে লজ্জা পেয়েছ।
যূথিকা—লজ্জা পাওয়ারই কথা বটে। বোম্বাই থেকে নরেন আর দু’এক দিনের মধ্যে পাটনা পৌঁছে যাবে। নরেন হলো আমার…।
হিমু—কি?
যূথিকা—আঃ, যেন একেবারে খোকাটি! স্পষ্ট ক’রে না বললে কিছু বুঝতেই পারে না।
হিমু হেসে ফেলে—এসব কথা যে শুধু মেয়ে-বন্ধুর কাছে বলতে হয় যূথিকা।
যূথিকা—তোমার মত পুরুষ-বন্ধু মেয়ে-বন্ধুর চেয়েও বেশি মেয়ে।
হিমু—একরকম প্রশংসা আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।
যূথিকা—সত্যি হিমাদ্রি, নরেন মানুষটি সত্যি ভালো। তোমার চেয়ে বয়সে একটু বেশিই হবে, তবে ত্রিশের বেশি নয়; কিন্তু এক হাজার টাকা মাইনের সরকারী সার্ভিসে আছে। কথাবার্তায় যদিও বেশ একটু অহঙ্কার আছে, কিন্তু সে অহঙ্কার মানিয়ে যায়। কেন মানাবে না বল? বেশ বড় অবস্থাপন্ন বাড়ির ছেলে, বেশ শিক্ষিত, তার ওপর চাকরিতেও এরকম ভাল কেরিয়ার। আমার মত মেয়ে ওর চোখেই পড়বার কথা নয়। কিন্তু…।
দুটি শান্ত চোখের দৃষ্টি আরও অলস ক’রে দিয়ে, সুন্দর একটি গল্প শোনবার আনন্দে যেন কৃতার্থ হয়ে বসে থাকে হিমু দত্ত। নস্যির ডিবে ঠুকতেও ভুলে যায়।
যূথিকা—কিন্তু ভালবাসায় সাত খুন মাপ হয়। আমারও সেই সৌভাগ্য হয়েছে হিমাদ্রি। নরেন আমাকে বিয়ে করবার আশায় রয়েছে।
যূথিকার গল্পটা বোধ হয় নিজের থেকেই থামতো না, যদি জগদীশপুরেতে এতগুলি ভদ্রলোক এবং তাঁদের সঙ্গে একটি নববর ও একটি নববধূ এই কামরাতে না উঠতো।
মধুপুরেতে গাড়ি বদল করতে অনেকখানি সময় হুড়োহুড়ি আর ছুটোছুটি করে পার হ’য়ে গেল। পাটনার ট্রেনে উঠে সীটের এক কোণে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে উপন্যাস পড়তে পড়তে অনেক রাত ক’রে দেবার পরও যখন যূথিকার চোখে ঘুমের আবেশ দেখা দিল না, তখন ডাক দেয় যূথিকা—হিমাদ্রি।
সামনের সীট থেকে উঠে এসে হিমাদ্রি বলে—বিছানাটা পেতে দিই?
যূথিকা—হ্যাঁ।
বিছানা পেতে দেয় হিমু।
যূথিকা বলে—নরেন আমার উপর মাঝে মাঝে রাগ করে মনে হয়।
হিমু—তুমি কি এখনও জেগে বসে থাকবে?
যূথিকা—আঃ, হ্যাঁ, তুমিও একটু জেগে থাক না কেন? একটু সরে বসে হিমুকে পাশে বসবার জন্য জায়গা ক’রে দেয় যূথিকা।
হিমুর বসবার রকম দেখে আবার বিরক্ত হয়ে বলে যূথিকা—এ-গল্প চেঁচিয়ে বলা যায় না, এটুকুও বুঝতে পার না কেন? আর একটু কাছে সরে এস।
উপন্যাসটাকে হাতে তুলে নিয়ে হিমাদ্রির কোলের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যূথিকা হেসে ওঠে—এটাতে ধানাই পানাই ক’রে কত কিছুই না বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে! ছাই হয়েছে! ওসবের চেয়ে অনেক অনেক মিষ্টি ব্যাপার আমার আর নরেনের মধ্যে হয়ে গিয়েছে। নরেনের সঙ্গে একবার আমার তর্ক হয়েছিল, কে বেশি ভালবাসে। আমি জোর করে বলেছিলাম, আমি বেশি ভালবাসি। হেরে গিয়েছিল নরেন, শেষে আমার কথাটাকেই সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
একটা স্টেশনে ট্রেনটা থেমেছে। স্টেশন অন্ধকার বেশি, আলো কম, এবং মানুষের গলার আওয়াজের চেয়ে ঝিঁঝির ডাকের জোর বেশি। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যূথিকা বলে—এটা বোধ হয় সেই স্টেশন, যেখানে চা আনবার নাম ক’রে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে।
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—আমার তাই মনে হয়েছিল। যাকগে,…নরেন এবার দেড় মাসের ছুটি নিয়েছে কেন বলতে পার?
—না, এটা সেই স্টেশনটা নয়। নস্যির ডিবে ঠুকে এক টিপ নস্যি বার করে হিমু। যূথিকার প্রশ্নের উত্তর দিতে বোধ হয় ভুলে যায়।
যূথিকা বলে—এবার একেবারে তৈরী হয়েই আসছেন বলে মনে হচ্ছে। বিয়ের শাঁখের শব্দ না শুনে আর ছাড়বেন না। মামী চিঠিতে যা লিখেছেন, সেটাই ঠিক। মনে হচ্ছে, এবার সাঙ্গ হলো ধুলোখেলা।
যূথিকার চোখের তারা ঝকঝক করে। এবং দেখে মনে হয়, হ্যাঁ, আর ধুলোখেলা নয়, যূথিকার জীবন এইবার মুক্তোখেলার আশ্বাস পেয়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছে। কল্পনায় তারই ছবি দেখছে যূথিকা।
যূথিকা বলে—কে জানে বোম্বাই শহরটা দেখতে কেমন? যেমনই হোক, নরেনের সঙ্গে যেখানে থাকবো সেখানেই তো আমার স্বর্গ।
বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারা যায়, মাঠ জুড়ে সাদা কাশের বন ছড়িয়ে রয়েছে। খুব জোরে সোঁ সোঁ শব্দ ক’রে ট্রেনটা বাতাস কাটছে। যূথিকা বলে—ক’টা বাজলো হিমাদ্রি? তোমার ঘুম পায়নি?
—তুমি এবার ঘুমিয়ে পড়। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ায় হিমাদ্রি, এবং সামনের সীটের উপরে গিয়ে বসে।
পাটনা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে শুধু মামী দাঁড়িয়ে আছেন। যূথিকার চেনা মানুষ বলতে আর কেউ নেই। ট্রেন থেকে নেমে মামীর কাছে এগিয়ে যায় যূথিকা। কুলির মাথায় যূথিকার জিনিসপত্র চাপিয়ে দিয়ে এক দিকে চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে থাকে হিমাদ্রি।
মামী বলেন—সেই ছেলেটি আবার এসেছে দেখছি।
যূথিকা—হ্যাঁ। বলাইবাবু বাতে পঙ্গু হয়ে রয়েছেন।
মামী—ছেলেটি বোধ হয় কিছু বলতে চায়।
যূথিকা—ও হ্যাঁ।
হিমুর কাছে এগিয়ে এসে যূথিকা হাতের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে।
হিমু বলে—টাকা দরকার হবে না।
যূথিকা—তার মানে? তুমি গিরিডি ফিরে যাবে না?
হিমু হাসে—ফিরবো বৈকি; কিন্তু ট্রেনভাড়ার দরকার নেই।
যূথিকা—হেঁয়ালি করো না হিমাদ্রি, স্পষ্ট ক’রে বল।
হিমু—আজই ফিরবো। কথা আছে, এখান থেকে লতিকাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। লতিকার বাবা গণেশবাবু বলে দিয়েছেন, গিরিডি ফিরে যাবার খরচ তিনিই দেবেন।
মামীর কানে হিমুর কথাগুলি পৌঁছেছে। শুনেই প্রসন্ন হয়ে ওঠে মামীর মুখটা। লতিকা গিরিডি চলে যাচ্ছে, তার মানে পাটনাতে থাকবার সাহস আর হচ্ছে না। বুঝে ফেলেছে শীতাংশু ডাক্তার, নরেনকে নেমন্তন্ন ক’রে লাভ নেই। এতদিনে আক্কেলের উদয় হয়েছে, এবং হার মেনে হতাশ হয়ে নরেনকে উদ্ভ্রান্ত করবার সব মতলব ছাড়তে হয়েছে।
কোন সন্দেহ নেই মামীর। নরেন পাটনাতে আসছে জেনেও লতিকা যদি পাটনা থেকে চলে যায়, তবে তার কি অর্থ হতে পারে? হয় নরেন চিঠি দিয়ে, নয় নরেনের মা নিজেই শীতাংশুকে ডেকে নিয়ে, লতিকার ফটো ফিরিয়ে দিয়ে স্পষ্ট ক’রে বলে দিয়েছেন, না, আমাদের রাজি হওয়া সম্ভব নয়।
এত তাড়াতাড়ি এরকম একটা সুসংবাদ শুনতে পাবেন, আশা করতে পারেননি মামী। আগে শুনতে পেলে যূথিকাকে এত তাড়াতাড়ি গিরিডি থেকে পাটনাতে চলে আসবার জন্য চিঠি দিতেন না।
শুনতে পেলেন মামী, ছেলেটিরই মুখের দিকে তাকিয়ে যূথিকা যেন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করছে—লতিকার এখন গিরিডি যাবার দরকার হলো কেন?
একটা আকাট আহম্মক মেয়ে! কাকে কি জিজ্ঞাসা করতে হয়, তাও বুঝতে শিখলো না, অথচ বয়স তো তেইশ পার হয়ে প্রায় চব্বিশে গিয়ে পৌঁছেছে। এ-কথা এই গোবেচারা ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা ক’রে লাভ কি? তা ছাড়া, এত আশ্চর্যই বা হয় কেন যূথিকা? লতিকা কেন গিরিডি চলে যাচ্ছে, এটুকু আন্দাজ করবার মত বুদ্ধি নেই কি মেয়েটার? খবরটা শুনে ওরই তো এখন সবচেয়ে বেশি হেসে ওঠা উচিত।
কি-যেন বলতে গিয়ে ব্যস্তভাবে যূথিকা আর হিমুর প্রায় কাছাকাছি এগিয়ে যেয়েই থমকে দাঁড়ান মামী। যূথিকার মুখের দিকে চোখ পড়তেই আশ্চর্য হয়ে যান। এ আবার কি-রকমের কাণ্ড! মেয়েটার চোখ দুটো জ্বলছে যেন; ছেলেটার মুখের দিকে যেন বিষদৃষ্টি হেনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে যূথিকা। ছেলেটি যেন ভয়ানক একটা বিশ্বাসঘাতক, একটা নিষ্ঠুর অপরাধী; যূথিকার জীবনের একটা সুখস্বপ্নকে যেন আচম্কা আঘাত দিয়ে দিয়ে ধুলোর উপর লুটিয়ে মিথ্যে ক’রে দিয়েছে…কি-যেন ঐ ছেলেটির নাম, হ্যাঁ, হিমাদ্রি।
মামীর চোখে একটা সন্দেহের বেদন থমথম করে। কে জানে কি ব্যাপার? যেখানে কোন সমস্যা আশঙ্কা করতে পারেনি কেউ, সেখানে সত্যিই বিশ্রী একটা সমস্যা কঠিন হয়ে ওঠেনি তো? যূথিকার বোকা মনটা কোন ভুল ক’রে ফেলেনি তো? নইলে এত বড় একটা মেয়ের পক্ষে এত বড় একটা ছেলের মুখের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকবার আর কি অর্থ হতে পারে?
মামী যে এত কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে, যেন দেখতেই পাচ্ছে না যূথিকা। হিমুর মুখের দিকে জ্বালাভরা দুটো অপলক চোখ তুলে যূথিকা বলে—তোমার লজ্জা করছে না?
হিমু হয়তো যূথিকার প্রশ্নের উত্তর দিত, কিন্তু মামীকে কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিব্রত বোধ করে হিমু; এবং স্পষ্ট ক’রে উত্তর দিতে পারে না বলেই অস্পষ্ট স্বরের একটা প্রতিবাদ হিমুর ঠোঁটের কাঁপুনিতে শুধু বিড়বিড় করে।
যূথিকা বলে—তুমি এখনি গিরিডি ফিরে যাও হিমাদ্রি। লতিকাকে নিয়ে যেতে পারবে না।
হিমু হাসতে চেষ্টা করে—সে কি কথা? আমি যে গণেশবাবুকে কথা দিয়ে এসেছি।
যূথিকা—কথা দিতে লজ্জা করেনি একটুও?
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মামী; মামীর কপালের রেখা কুঁচকে ওঠে।
যূথিকা বলে—কি? কথা বলছো না কেন হিমাদ্রি?
হিমু—কি জানতে চাইছো, বল।
যূথিকা—তুমি লতিকাকে গিরিডি নিয়ে যাবে না, আমাকে স্পষ্ট ক’রে কথা দাও।
হিমু—অসম্ভব।
যূথিকা—কি?
হিমু—লতিকাকে গিরিডি নিয়ে যেতেই হবে। মানুষকে কথা দিয়ে মিছিমিছি কথার খেলাপ করতে পারবো না।
প্ল্যাটফর্মের ভিড়; শতশত মানুষের কোলাহলে মুখর হয়ে রয়েছে পৃথিবীর একটা ব্যস্ততা; শুধু চলে যাবার টানে অস্থির ও চঞ্চল একটা সংসারের একটি টুকরো। এখানে থমকে দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য কেউ আসে না। কিন্তু চারু ঘোষের মেয়ে যূথিকা ঘোষ সত্যিই যেন চিরকালের মত থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবং সামনে বা পিছনে কোন দিকে এগিয়ে যাবার সাধ্যি নেই।
চেঁচিয়ে ওঠে যূথিকা—তাহলে আমিও গিরিডি ফিরে যাব। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব।
মামী ডাকেন—যূথিকা?
চমকে ওঠে যূথিকা। আর, মামীকে কাছে দেখতে পেয়েই আতঙ্কিতের মত ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকিয়ে থাকে, তারপরেই হাসতে চেষ্টা করে।
মামী বলেন—অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে, কুলিটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। চল এবার।
যূথিকা হাসে—হ্যাঁ, যাবই তো। এখানে চিরকাল দাড়িয়ে থাকবো, কে বলেছে?
মামী—তোমার কাজ শেষ হয়েছে তো?
যূথিকা—কাজ? কিসের কাজ?
মামী—ওকে যা বলবার ছিল, বলা হয়েছে?
যূথিকা ভ্রুকুটি করে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—ওকে আবার কি বলবার ছিল? কিছু না। চল।
পাটনাতে এসেছে নরেন; এবং লতিকা পাটনাতে নেই। সুতরাং যূথিকার মনের ভাবনায় এক ফোঁটা উদ্বেগও নেই। তা ছাড়া, মামীও খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, এবার আর শীতাংশু ডাক্তার নরেনকে চা-এর নেমন্তন্ন করবার চেষ্টা করেনি। এবং একথাও সত্যি, নরেনের মা লতিকার ফটো ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন, এবং সেই সঙ্গে যে চিঠিটা দিয়েছেন, তাতে শুধু ফটো ফেরত পাঠালাম ছাড়া আর কোন কথা লেখেননি। শীতাংশু ডাক্তারের পাশের বাড়ির সুব্রতবাবুর স্ত্রী একদিন বেড়াতে এসে মামীকে এই খবরও জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
গর্দানিবাগের মাঠের সেই পলাশে এখন আর ফোটা ফুলের শোভা রক্তময় হয়ে হাসে না। নতুন বর্ষার জলে মাঠের ঘাস সবুজ হয়ে উঠেছে। এই মাঠের সবুজের উপর নরেনের পাশে পাশে হেঁটে প্রায় রোজই সকালে আর সন্ধ্যায় বেড়িয়েছে যূথিকা। নরেনকে আর নিমন্ত্রণ ক’রে ডাকতে হয় না। নিজের প্রাণের আবেগে নরেন নিজেই রোজ এসে যূথিকার কাছে দাঁড়ায়। চা-এর জন্য নিজেই তাগিদ দেয় নরেন। আর মাঝে মাঝে, মামী কিংবা অন্য কেউ কাছে না থাকলে, যূথিকার কানের কাছে নরেনই হেসে হেসে ফিসফিস করে—তোমাকেই কন্গ্র্যাচুলেট করতে হয়।
—কেন?
—তোমার ভালবাসারই জয় হলো
—তা হলো বৈকি।
—অদ্ভুত!
—কি?
—তোমার ভালবাসার জেদ।
—হ্যাঁ, অদ্ভুত জেদ বৈকি! চার বছর ধরে বলতে গেলে তপস্যা করতে হয়েছে।
নরেন হাসে—তপস্যার সিদ্ধিও হয়েছে।
নরেনের দু’চোখের গর্বময় উৎফুল্লতার দিকে তাকিয়ে যূথিকা বলে—হ্যাঁ, চার বছর অপেক্ষায় থেকে থেকে তারপর যখন তুমি আমাকেই বিয়ে করতে রাজি হয়েছো, তখন স্বীকার করতেই হয়…।
—কি?
—সিদ্ধিলাভ করেছি। আমার ভালবাসাই জয়ী হয়েছে।
চার পাতা চিঠি লিখে কণিকা মামী গিরিডির উদাসীনের সব উদ্বেগ দূর ক’রে দিয়েছেন। রাজি হয়েছে নরেন। বিয়ের দিন ঠিক করবার কথাও বলেছে। নরেনের মা বলেছেন, পয়লা অঘ্রান খুব ভাল শুভদিন।
মামীর প্রাণটাও যেন হাঁপ ছেড়ে অনুভব করে, তাঁরও একটা জেদের তপস্যা সফল হয়েছে। নরেনের মত ছেলের সঙ্গে যূথিকার মত মেয়ের বিয়ে ঘটিয়ে দেওয়া চারটিখানি বুদ্ধি ও চেষ্টায় সম্ভব হয় না। গিরিডি থেকে যূথিকার মা তিন পাতা চিঠি লিখে মামীকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন, তোমার চেষ্টা আর বুদ্ধির জোরেই মেয়েটার ভাগ্য প্রসন্ন হতে পেরেছে কণিকা। নরেনের মাকে জানিয়ে দিও, আমরা পয়লা অঘ্রানেই রাজি।
মামীর চিন্তায় শুধু একটা অস্বস্তি মাঝে মাঝে ছটফট ক’রে ওঠে। যূথিকা এত বেশি ঘুমোয় কেন? জেগে থাকে যখন, তখনও যেন অদ্ভুত একটা কুঁড়েমির জ্বরে গুটিসুটি হয়ে এঘর কিংবা ওঘরের বিছানার এক কোণে বসে হাই তোলে, আর ফ্যালফ্যাল ক’রে তাকায়। যে-কথা কোনদিন যূথিকাকে বলতে হয়নি, সেই কথাই আজকাল বলতে হয়, একটু ভাল ক’রে সাজ করবার কথা। ভাল করে সাজবার নিয়মটাই যেন ভুলে গিয়েছে যূথিকা। কিন্তু খুব ভাল করেই জানে যূথিকা, সন্ধ্যা হবার আগেই নরেন এসে পড়ে। তবু, বিকেল হয়ে এলেও যূথিকার মনে পড়ে না যে, এইবার তাড়াতাড়ি সেজে নেওয়া উচিত। মামী মনে করিয়ে দেন, তবে বুঝতে পারে, এবং তারপরেই ব্যস্তভাবে সাত-তাড়াতাড়ি একটা এলোমেলো সাজ করে। আর, অরুণকে কোলে নিয়ে যত আজে-বাজে কথা বলতে থাকে। অরুণও টানা-ছেঁড়া ক’রে যূথিকার সাজ আর খোঁপাটাকে আরও এলোমেলো ক’রে দেয়।
নরেনের সঙ্গে বেড়িয়ে, বড় জোর এক মাইল পথ হেঁটে, আবার যখন ঘরে ফিরে আসে যূথিকা, তখন দেখে মনে হয়, যেন দু’দিন না খেয়ে একশো মাইল হেঁটে একেবারে ক্লান্ত ও আধমরা হয়ে গিয়েছে যূথিকার চেহারাটা। এ আবার কোন্ ধরণের মানসিক ব্যাধি? মামীর চোখ দুটো আবার সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে।
শুধু মামী কেন, যূথিকাও যে যূথিকাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে। ধুলোখেলার পালা সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে, হাতের কাছে মুক্তা এসে গিয়েছে, তবে আবার জীবনের অহঙ্কারটা এমন ক’রে মুসড়ে পড়ে কেন? জিত হলো, তবুও হেরে গিয়েছি বলে একটা সন্দেহের অস্বস্তি মনের ভিতরে কাঁটার মত খচখচ করে কেন?
কে হারিয়ে দিল? লতিকা? ভাবতে গিয়ে কপালের দু’পাশে একটা জ্বালার কামড় জ্বলতে থাকে যেন। মামী বুঝবেন কি ছাই? মামী কল্পনাও করতে পারেন না, পাটনা থেকে লতিকার গিরিডি যাবার ট্রেনযাত্রা যে লতিকার জীবনের একটা জয়যাত্রা। হিমাদ্রি চা এনে দিয়েছে, সেই চা হেসে হেসে খেয়েছে লতিকা। লতিকার ঘুম পেয়েছে, আর ব্যস্ত হয়ে বাঙ্কের উপর থেকে বেডিং নামিয়ে লতিকার জন্য বিছানা পেতে দিয়েছে হিমাদ্রি। লতিকা চালাক; কি ভয়ানক চালাক, সেটা মামীর ধারণাতেই নেই। নিরালা কামরার সীটের উপর পাতা বিছানায় টান হয়ে শুয়েছে লতিকা, আর হিমাদ্রিকে মাথার কাছে বসিয়ে রেখে সারা রাত গল্প করেছে।
আর হিমাদ্রি? হ্যাঁ লতিকাকে দোষ দিয়ে লাভ কি? হিমাদ্রিই যে যত নষ্টের মূল। কি ভয়ানক চালাক বোকা! চট্ ক’রে কত তাড়াতাড়ি জীবনের ট্রেনযাত্রার এক নতুন বান্ধবী জোগাড় করে নিল। পয়লা অঘ্রানের পর আর ক’টা দিনই বা গিরিডি ও পাটনার মুখ দেখবার সুযোগ পাওয়া যাবে? বড় জোর দশটা দিন। নরেনের ছুটি ফুরিয়ে যাবার আগেই নরেনের সঙ্গে যূথিকাকে বোম্বাই চলে যেতে হবে। তারপর? তারপর আর কি? লতিকা আর হিমাদ্রি অনন্তকাল ধরে পাটনা থেকে গিরিডি আর গিরিডি থেকে পাটনা যাওয়া-আসা ক’রে চমৎকার ট্রেনযাত্রার পুণ্যে ধন্য হয়ে থাকবে।
গিরিডি থেকে চিঠি আসে। কিন্তু সে চিঠিতে বিশ্বের যত খবর থাকুক না কেন, শুধু একটি খবরের কোন উল্লেখ থাকে না। হিমাদ্রি এখন কোথায়? লতিকা সত্যিই গিরিডি ফিরেছে তো? ফিরেছে নিশ্চয়। যাবে আর কোথায়? পাটনা ছেড়ে দিয়ে এখন গিরিডিতে গিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে লতিকা। এবং আশ্চর্য নয়, গণেশবাবুর বাড়িতে রোজ সন্ধ্যায় চা খেতে আসছে হিমাদ্রি।
পাটনা নয়, গিরিডিই যে যূথিকার জীবনের উদ্বেগ হয়ে উঠলো। কোনদিন কল্পনাতেও সন্দেহ করতে পারেনি, কোন মুহূর্তেও একটু সাবধান হয়ে কল্পনা করতে পারেনি যূথিকা, লতিকার মত মেয়ে যূথিকাকে এভাবে একটা মিথ্যা জয়ের কাছে ফেলে রেখে দিয়ে নিজে একটা খাঁটি জয়ের কাছে চলে যেতে পারে। পয়লা অঘ্রান আসতে দেরি আছে। তবে এখন আর পাটনাতে থাকবারই বা কি দরকার? এখন গিরিডি চলে গেলেই তো হয়।
গিরিডির চিঠি আসতেও আর বেশি দেরি হয়নি। মা লিখেছেন, যূথিকার এখন গিরিডি চলে আসাই উচিত মনে করি কণিকা। যূথিকাকে আসবার জন্য বলাইবাবুকে পাঠাবার ব্যবস্থা করছি; তুমি একেবারেই বরযাত্রী হয়েই এস। বর আনতে এখান থেকে যাবার লোক কেউ নেই। তোমার আর অরুণের বাবা, দুজনের ওপর বর আনবার সব দায়িত্ব রইল।
গিরিডির চিঠিটা যূথিকাকেও পড়তে দিলেন মামী। চিঠি পড়েই কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকে যূথিকা। তারপরেই বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে।—বলাইবাবুকে পাঠিয়ে লাভ কি? বাতে পঙ্গু একটা মানুষ।
মামী—তবে কি একাই গিরিডি যেতে চাও?
যূথিকা—একা যাব কেন? হিমাদ্রি কি নেই?
অপলক চোখ তুলে যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে কি-যেন ভাবেন মামী। মামীর দু’চোখের মধ্যে যেন একটা ভয়ের ছায়া ছমছম করে। আস্তে আস্তে এবং ভয়ে ভয়ে বলেন মামী— বারবার হিমাদ্রিকে বিরক্ত করা ভাল দেখায় না।
যূথিকা চেঁচিয়ে ওঠে।— হিমাদ্রি যে বিরক্ত হয় না, সেটা মা খুব ভালই জানে।
মামী—আমার মনে হয়, হিমাদ্রিকে না পাঠালেই ভাল হয়।
যূথিকা—বেশ। তাহলে বলাইবাবুকেও আসতে বারণ করে দাও।
মামী—তার মানে?
যূথিকা হেসে ফেলে—আমি একাই গিরিডি যাব।
দুলে দুলে হেঁটে ঘরের ভিতরে ঢোকে ছোট্ট অরুণ। অরুণের হাতে একটা চিঠি। অরুণ বলে—একটা লোক।
চিঠি খুলে দু’লাইন পড়তেই আশ্চর্য হয়ে যান মামী, এবং বাইরের রারান্দার দিকে উঁকি দিয়ে তাকান।
যূথিকা—কি ব্যাপার?
মামী বলেন— হিমাদ্রি এসেছে।
ঝক ক’রে হেসে ওঠে যূথিকার চোখ। শাড়ির আঁচলটাকে টেনে গায়ে জড়িয়ে ব্যস্তভাবে উঠে দাড়ায় যূথিকা। —তার মানে?
মামী বলেন—কুসুমদি লিখেছেন, বলাইবাবুর পক্ষে যাওয়া অসম্ভব। হিমুকেই পাঠালাম।
মামীর দুশ্চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে মামা বললেন—না, আমার মনে হয়, সে-রকম কোন ভয়ের কারণ নেই।
মামী— তবু, আমি কিন্তু নিশ্চিত হতে পারছি না।
মামা—ভদ্রলোকের মেয়ে মাথা খারাপ ক’রে বাজে লোকের সঙ্গে উধাও হয়ে গিয়েছে, এরকম কেস অবশ্য মাঝে মাঝে দেখা যায়। কিন্তু বেচারা যূথিকাকে এরকম মাথাখারাপ মেয়ে মনে করতে পারছি না।
মামী—কিন্তু হিমাদ্রি নামে এই ছেলেটার মনে কি আছে, সেটা কি ক’রে বুঝবে বল?
মামা কিছুক্ষণ ভাবেন। তারপর বলেন— আচ্ছা, একটা ব্যবস্থা ক’রে দিচ্ছি।
মামী—কি ব্যবস্থা!
মামা—আমি এখনি গিয়ে ভোলাকে… রেল পুলিশের ডি-এস-পি ভোলাকে চেন তো?
মামী—খুব চিনি।
মামা—ভোলাকে বলে দিচ্ছি, যেন ট্রেনের গার্ডকে প্রাইভেটলি বলে রাখে ভোলা, ওদের দু’জনের উপর একটু ওয়াচ রাখবার জন্য। আমি চললাম…ওদের তাড়াতাড়ি রওনা করিয়ে দাও।
রওনা হতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি করিয়ে দিলেন মামী, অর্থাৎ টেলিফোনে নরেনকে একটা খবর দিতে যতটুকু সময় লাগলো, তার বেশি নয়। এবং স্টেশনে পৌঁছবার পর খুশি হয়ে দেখলেন মামী, যাদের আসবার কথা ছিল, তারা সবাই এসেছে। মামা এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছেন, তার পাশে নরেন। এবং, কি আশ্চর্য, শীতাংশু ডাক্তারও এসেছে।
সব চেয়ে বেশি আশ্চর্য, শীতাংশু ডাক্তার হেসে হেসে নরেনের সঙ্গে গল্প করছে। এমন কি মামাকেও হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে ফেলে শীতাংশু—পয়লা অঘ্রানই বোধ হয় বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে?
মামা গম্ভীর হয়ে বলেন—বোধ হয়। শীতাংশু বলে—বড় ভাল হলো।
শীতাংশুর কথা শুনে মামীর মুখটা অপ্রসন্ন হয়ে যায়। কি রকম ঢং ক’রে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে শীতাংশু, যেন ছোট ভাইটির বিয়ের খবর শুনে আহ্লাদে মজে গিয়েছে। কিন্তু মামীই জানেন, এই শীতাংশুই এই কটা বছর এই বিয়ের সম্ভাবনাকে ভাংচি দিয়ে মিথ্যে ক’রে দেবার জন্য কী চেষ্টাই না ক’রে এসেছে। তবে আবার কিসের আশায়, কোন্ মতলবের উৎসাহে এখানে এসেছে শীতাংশু? মামী ডাকেন—এদিকে এসে একটা কথা শুনে যাও নরেন।
শীতাংশুর কপট শুভেচ্ছার স্পর্শ থেকে নরেনকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পাটনার প্রচণ্ড গরমের জন্য দুঃখ ক’রে অনেক কথা বললেন মামী।— কার্তিক শেষ হতে চললো, তবু দেখছো, গরমের গুমোট ছাড়ছে না।
ট্রেনে ওঠবার জন্য যূথিকার ব্যস্ততা দেখে মনে মনে রাগ করেন মামী। নরেনের কাছ থেকে অনেকক্ষণ হলো ইচ্ছে করেই সরে গিয়েছেন মামী। এই তো, এইবার একটা সুযোগ পেলি বোকা মেয়ে। নরেনের কাছে এসে একবার দাড়া। দু’টো কথা বল। কিন্তু কোথায় যূথিকা? কাণ্ডজ্ঞানহীন যূথিকা তখন ট্রেনের কামরার ভিতরে ঢুকে হিমাদ্রির সঙ্গে কী অদ্ভূত মুখরতা আর হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু মনের অভিযোগ মনেই চেপে রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন মামী।
—আমি কিন্তু জানালার ধারে বসবো হিমাদ্রি। হাত-ব্যাগটাকে সীটের নীচে রেখে দাও হিমাদ্রি।
বড় বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, আর কি বিশ্রী চেঁচিয়ে কথা বলছে মেয়েটা! যূথিকার কাছে এগিয়ে এসে মামী ফিসফিস ক’রে বলেন—আস্তে কথা বল যূথিকা।
ট্রেন ছাড়লো, এবং যূথিকা যেন এতক্ষণের ব্যস্ততার ভুলের মধ্যে বিমনা হয়ে থাকা মনটাকে চিনতে পেরে চমকে ওঠে। ভুল হয়েছে, ভয়ানক বিশ্রী ভুল। নরেনের সঙ্গে সামান্য একটু চোখে চোখে কথা বলে নিতেও ভুলে গিয়েছে। এই ভুলটুকু শুধরে দেবার জন্য জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে নরেনের দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠে যূথিকা।
হাসিভরা মুখটাকে জানালার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে যূথিকা, কারণ প্ল্যাটফর্মের কোন মুখ আর চেনা যায় না। ঝাপসা হয়ে গিয়েছে পাটনা স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।
এইবার চোখের কাছে যাকে খুব স্পষ্ট ক’রে দেখতে পায় যূথিকা, তারই শান্ত মুখের চেহারাটাকে সহ্য করতে গিয়ে ছটফট ক’রে ওঠে।
যূথিকা বলে—কেমন আছ হিমাদ্রি?
হিমু হাসে—ভাল আছি।
যূথিকা—লতিকা ভাল আছে?
হিমু—জানি না। ভাল থাকলেই ভাল।
যূথিকা—খোঁজ রাখ না?
হিমু—খোঁজ রাখা আমার অভ্যাস নয়।
যূথিকা—কিন্তু লতিকার তো সে অভ্যাসটি আছে।
হিমু—জানি না।
যূথিকা — কেন? লতিকা খোঁজ করেনি?
হিমু—কার খোঁজ?
যূথিকা—তোমার।
হিমু—না
যূথিকা—আশ্চর্যের ব্যাপার।
হিমু—কিসের আশ্চর্য?
যূথিকা—এত গরজ ক’রে পাটনা থেকে গিরিডি নিয়ে গেলে যাকে, তার সঙ্গে সামান্য একটু বন্ধুত্বও হলো না।
হিমু—না।
যূথিকা—তোমার দুর্ভাগ্য।
হিমু—একটুও না।
যূথিকা—কেন? লতিকা কি দেখতে সুন্দর নয়?
হিমু—সুন্দর বৈকি।
যূথিকা—আমার চেয়েও সুন্দর নিশ্চয়।
হিমু—লোকে তো তাই বলে।
যূথিকা—কে বলে?
হিমু—তোমার মা বলছিলেন।
যূথিকা—কার কাছে?
হিমু—তোমার বাবার কাছে।
যূথিকা—তোমার সামনেই?
হিমু — হ্যাঁ।
যূথিকা—আর তুমিও বেশ দু’কান ভরে কথাটা শুনে নিলে?
হিমু—হ্যাঁ, কানে শুনতে পাই যখন, তখন না শুনে পারবো কেন?
যূথিকা—কিন্তু কথাটা এত মনে ক’রে রাখতে বলেছে কে? মনে হচ্ছে, কানের ভিতর দিয়ে একেবারে মরমে পশেছে।
হিমু—না।
যূথিকা— জোর করে না বললে কি হবে?
হিমু—কত কথাই তে। শুনতে পাই, কিন্তু মরমে পশে আর কোথায়?
যূথিকা—মরম নেই তাহলে?
হিমু —হবে।
যূথিকা—আমার তো তাই মনে হয়।
হিমু—বেশ ভাল মন তোমার।
হিমু দত্তের শান্ত চোখ দুটোও যেন উদাসীনের মেয়ে যূথিকা ঘোষের এই অনর্থক বাচালতায় বিরক্ত হয়ে, এবং একটু তপ্ত হয়ে যূথিকার মুখের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে ভয় পেয়ে কেঁপে ওঠে হিমু দত্তের চোখ। বিনা দোষের আসামী ফাঁসির হুকুম শুনেও বোধহয় এমন ভয় পাবে না। দেখতে পেয়েছে হিমু, চারু ঘোষের মেয়ের চোখ দুটো জলে ভরে গিয়েছে।
এমন ভয়ানক বিপন্নতা, এত কঠোর শাস্তি, জীবনে কোন দিন সহ্য করবার দুর্ভাগ্য হয়নি হিমু দত্তের; এর চেয়ে যূথিকা ঘোষের চোখের সেই সব ভয়ানক অবহেলার আর কৌতুকের হাসিতে যে অনেক বেশি করুণা ছিল।
হিমু বলে—আমাকে মাপ কর যূথিকা; কিন্তু বুঝতে পারছি না, আমার কি অপরাধ হলো।
চোখ দুটোকে এক মুহূর্তের মধ্যেই সামলে নিয়ে শুকনো ক’রে ফেলেছে যূথিকা।
যূথিকা বলে—যাক গে, তুমি কিছু মনে করো না হিমাদ্রি। তোমাকে সত্যিই অপরাধী বলছি না।
হাঁপ ছাড়ে, বুকের ভিতরের একটা ভয়াতুর বেদনার গুমোট যেন নিঃশ্বাসের জোরে ভেঙ্গে দিয়ে হাঁপ ছাড়ে হিমু। নস্যির ডিবে ঠুকে ঠুকে হাসতে চেষ্টা করে।— গিরিডিতে এখন বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। সকাল বেলা রোদ ওঠবার পরেও উশ্রীর ওপর কুয়াশা একেবারে জমাট হয়ে থাকে।
যূথিকাও হাসে—সত্যি কথা বলবে?
হিমু—তোমার কি সন্দেহ আছে; আমি সত্যি কথা বলি না?
যূথিকা—না, তুমি সে বিষয়ে একেবারে খাঁটি গুড বয়। তাই জিজ্ঞাসা করছি।
হিমু – বল।
যূথিকা—লতিকা তোমাকে আমার মত বিরক্ত করেনি?
হিমু—একটুও না।
যূথিকা—চা এনে দাও, বিছানা পেতে দাও, হেন তেন কোন হুকুমই করেনি?
হিমু – না। বরং লতিকাই ওসব কাণ্ড করেছে। আমি আপত্তি করেছি, তবুও শোনেনি।
যূথিকার চোখের দৃষ্টি আবার কঠোর হয়ে ওঠে।—তার মানে; লতিকা তোমার খুব সেবাযত্ন করেছে?
হিমু—একটু বাড়াবাড়ি করেছে বলতে হবে। নিজেই হাঁক দিয়ে চা-ওয়ালাকে ডেকে এনে আমাকে চা খাইয়েছে। বিছানাটাকেও আমার জন্য ছেড়ে দিয়ে, নিজে সারারাত জেগে উলের টুপি বুনেছে। একটু বেশি ভদ্রতা করেছে লতিকা।
যূথিকা ভ্রুকুটি ক’রে মুখ ফেরায়—কিন্তু তাই বলে লতিকা তোমাকে বিয়ে করতে পারে না।
হিমু—আমিই লতিকাকে বিয়ে করতে পারি না।
যূথিকা—কেন?
হিমু—আমার মত মানুষকে লতিকার বিয়ে করা উচিত নয় বলে।
যূথিকা—নিজেকে কি তুমি এতই ছোট মনে কর?
হিমু—একটুও ছোট মনে করি না।
যূথিকা — তবে?
হিমু—লোকে তো ছোট মনে করে।
যূথিকা— আমিও মনে করি কি?
হিমু—তোমার মন জানে!
আবার হিমু দত্তের দু’চোখের দৃষ্টি উত্ত্যক্ত হয়ে, আর যূথিকার এই অকারণ বাচালতার উপর বেশ কুপিত হয়ে যূথিকার মুখের উপর পড়তেই চমকে ওঠে আর ভয় পায় হিমু। যূথিকা ঘোষের চোখের পাতা ভিজে ভারি হয়ে গিয়েছে।
হিমু দত্ত ভয়ে ভয়ে অনুরোধ করে। —গল্প করবার এত জিনিস থাকতে তুমি আজ কেন মিছিমিছি এসব কথা তুলে ট্রেনযাত্রার আনন্দটা মাটি করছো যূথিকা?
হিমুর কথার কোন উত্তর না দিয়ে হঠাৎ ব্যস্তভাবে উঠে দাড়ায় যূথিকা। নিজেই হাত বাড়িয়ে সীটের তলা থেকে একটা ছোট বাস্কেট বের করে। বাস্কেট খুলে খাবারের প্যাকেট ও একটা ডিস বের করে। আর, ডিসের উপর খাবার সাজিয়ে দিয়েই বলে—খাও হিমাদ্রি।
হিমাদ্রি অপ্রস্তুতের মত বলে—একি? তোমার খাবার কোথায়?
যূথিকা হাসে—এই তো। একই ডিসে দু’জনে খেতে পারা যায় না কি?
সত্যিই হাত বাড়িয়ে ডিসের উপর সন্দেশ ভাঙ্গে যূথিকা। এবং খেতেও কোন দ্বিধা করে না।
খাবার খেতে গিয়ে হেসে ফেলে হিমু—একটা কাণ্ডই করলে তুমি।
যূথিকা মুখ টিপে হাসে—কেন করলাম, বুঝতে পারলে কিছু?
হিমু — না।
যূথিকা—লতিকাকে হারিয়ে দিলাম। কেমন? ঠিক কিনা? লতিকা নিশ্চয় এতটা করতে পারেনি?
—না। কথাটাকে কেমন উদাসভাবে, যেন একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে চুপ করে খাবার খেতে খেতে হিমু আবার আনমনার মত হঠাৎ বলে ওঠে।—এই তো আমাদের শেষ ট্রেনযাত্রা।
—অ্যা, কি বললে? হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে যেন একেবারে ক্লান্ত হয়ে ঢুলে পড়ে যূথিকা ঘোষের চোখের চাহনি। শেষ ট্রেনযাত্রা? তার মানে কি? হিমাদ্রির সঙ্গিনী হয়ে এক ট্রেনে পাটনা থেকে গিরিডি আসা-যাওয়ার পালা চিরকাল চলতে থাকবে, এইরকম একটা জীবন কি সত্যিই কল্পনায় কামনা ক’রে রেখেছিল যূথিকা? নইলে এত আশ্চর্য হয়ে যায় কেন যূথিকা? এবং হিমুর এত সহজ ও সরল কথাটা বুঝতে এত দেরি করে কেন বুঝতে দেরি হয়নি যূথিকার। চোখের সামনে একটা শূন্যতার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, হ্যাঁ, হিমাদ্রির সঙ্গে এই শেষ ট্রেনযাত্রা। ধুলোখেলার বন্ধুত্বের এই শেষ। বেশ হলো, খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল।
যূথিকা বলে—খবরটা তাহলে তুমিও শুনেছ হিমাদ্রি?
হিমু — কিসের খবর?
যূথিকা — আমার বিয়ের।
হিমু—হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো বললাম।
যূথিকা — কি?
হিমু—এই আমাদের শেষ ট্রেনযাত্রা। তাই মিছে আর তর্ক-টর্ক ক’রে কেন শেষ দিনের আনন্দটা নষ্ট করা?
যূথিকা — আনন্দ?
হিমু—আনন্দ বৈকি। তুমি যা চেয়েছিলে, তাই পেলে, এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কি হতে পারে?
যূথিকা —সত্যি করে বল হিমাদ্রি। শুনে তোমার খুব আনন্দ হচ্ছে?
হিমু — হ্যাঁ।
যূথিকা—আনন্দের মধ্যে কি এতটুকু…
হিমু—কি?
যূথিকা—কষ্ট হচ্ছে না?
চমকে মুখ ফিরিয়ে নেয় হিমু দত্ত। নইলে হিমুর জীবনের একটা দুঃসহ বেদনার নিঃশ্বাস বোধহয় এখনি চারু ঘোষের মেয়ের মুখের উপর ছড়িয়ে পড়বে আর ধরা পড়ে যাবে হিমু। মাথা হেঁট করে, চোখ-মুখ একেবারে বিবর্ণ ক’রে আর বোবা হয়ে বসে থাকে হিমু।
হিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে যূথিকা হাসে—তোমার ওপর আমার আর রাগ নেই হিমাদ্রি।
হিমু—কেন বল তো?
যূথিকা—লতিকার কাছে হার মানতে হলো না। আমারই জিত হয়েছে।
ট্রেনটা থেমেছে। খুব আলোয় ভরা জমজমাট আর গমগমাট একটা স্টেশন। যেমন লোকের ভিড়, তেমনিই কোলাহল। ট্রেনের কামরার একই জানালার ভিতর দিয়ে পাশাপাশি দু’টি মুখ উকি দিয়ে যেন চঞ্চলতা আর মুখরতার একটা আলোকিত উৎসবের মত একটা দৃশ্য দেখতে থাকে। যেন চিরকালের বন্ধু ও বান্ধবীর ছ’টি হর্ষোৎফুল্ল মুখ। এবং দু’জনেই জানে না, কখন কোন্ মায়ার আবেশে দু’জনের দু’টি হাতের ছোঁয়াছুঁয়ি মুঠোবাঁধা হয়ে এক হয়ে গিয়েছে।
ট্রেন ছেড়ে দেয়। যূথিকা বলে—আমি সত্যিই কিছু বুঝে উঠতে পারছি না হিমাদ্রি।
হিমু কি?
যূথিকা—সত্যিই কি সোনা ফেলে দিয়ে আঁচলে গেরো দিলাম।
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—মানে জিজ্ঞাসা করো না হিমাদ্রি। বুঝতে না পার যদি, তবে চুপ করে থাক।
চুপ করে হিমাদ্রি। যূথিকা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—বড় ক্লান্ত লাগছে শরীরটা, বুকের ভিতরেও যে হাঁপ ধরছে হিমাদ্রি; আমি এভাবেই জানালায় মাথা রেখে একটু ঘুমিয়ে নিই, কেমন?
হিমু—নিশ্চয়। তুমি চুপ করে ঘুমোও।
যূথিকা — তুমি সরে যেওনা কিন্তু।
হিমু—না, কখখনো না।
কিন্তু ঘুমোতে পারে না যূথিকা। ঘুমটাই যেন থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ওঠে, আর হিমু দত্তের হাতটাকে আরও শক্ত ক’রে খিমচে ধরে রাখে যূথিকা।
সামনের সীটের এক ভদ্রলোক বলেন—ওঁর কোন অসুখ আছে বলে মনে হচ্ছে।
হিমু বলে—না। হঠাৎ কাহিল হয়ে পড়েছেন।
ভদ্রলোক আক্ষেপ করেন—তাইতো। বড় দুঃখের বিষয় হলো। আপনিও বড় নার্ভাস হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
ভদ্রলোকের কথার জবাব না দিলেও হিমু বোধহয় নিজের মুখটাকে কল্পনায় দেখতে পায়। যেন একটা ক্ষেপা হাওয়ার মাতামাতির মাঝখানে, রাতের নদীর বুকের উপর ভাঙা নৌকাতে দাড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদের শোভা দেখছে হিমু দত্ত। এই নৌকা ডুবে যাবে, অথই জলে তলিয়ে যেতে হবে, সবই জানে হিমু; কিন্তু, তবু পূর্ণিমার চাঁদ দেখবার লোভ যেন ছাড়তে পারছে না। হাসিটা কেঁদে ওঠেনি, হিমু দত্তের জীবনের কান্নাটাই যেন ওর মুখের ওপর হেসে রয়েছে।
হিমু দত্তের বুকের কত কাছে চারু ঘোষের মেয়ের মাথাটা! হাতের উপর কপাল নামিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে যূথিকা। যূথিকার খোঁপার সুগন্ধও হিমু দত্তের নাকের কত কাছে মাতামাতি করছে।
হঠাৎ বাইরে থেকে গুঁড়ো বৃষ্টির একটা ঝাপটা এসে যূথিকার মাথাটাকে ভিজিয়ে দেয়। রুমাল দিয়ে যূথিকার মাথা মুছে দিতে হিমু দত্তের হাতটা আজ আর কোন লজ্জায় আর কোন ভয়ে কাঁপে না।
মুখ তোলে যূথিকা।—আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি।
হিমাদ্রি—বল।
যূথিকা — দরকার হলে তুমি কি আমাকে বোম্বাই থেকে গিরিডিতে আনতে পারবে না?
হিমাদ্রি— দরকার কেন হবে?
যূথিকা — আমি বলছি, দরকার হবে।
—না। দরকার হলেও না।
যূথিকা—ঠিকই ভেবেছিলাম আমি, তুমি একথা বলবে। তুমি ভয়ানক চালাক।
হিমু—তোমার বোকামির জন্যেই চালাক হতে হচ্ছে।
যূথিকা আবার জানালার কাঠের উপর হাত রেখে আর মাথা পেতে ঘুমোতে চেষ্টা করে। তন্দ্রাটা মাঝে মাঝে নিবিড় হয়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু অদ্ভুত কতগুলি ঠাট্টার ভাষা যেন মাথার ভিতরে একঘেয়ে সুরে বাজতে থাকে। পাটনাতে মামীর সঙ্গে একবার হীরালাল বাবুর বাড়িতে কীর্তন শুনতে গিয়ে যে গানের ন্যাকামি সহ্য করতে না পেরে দু-মিনিট পরেই বাড়ি ফিরে গিয়েছিল যূথিকা, সেই গানেরই ভাষা যূথিকার এই ক্লান্ত মাথার ভিতরে প্রচণ্ড উৎপাতের শব্দের মত বেজে চলেছে। পীরিতিক রীতি শুন বরনারী!
আজ যূথিকাকে বাগে পেয়ে সেদিনের গানটা যেন যূথিকার অহঙ্কারের উপর প্রতিশোধ তুলছে। পীরিতের রীতিতে ভুল হলে কি দশা হয়, সেটাও ইনিয়ে বিনিয়ে শুনিয়ে দিয়েছিল গানটা তুহারি ভরম ফান্দে, তুহারি করম কান্দে। বাঃ, চমৎকার!
চান্দ কিরণ ছোড়ি, দাবানল পরশিলি। অব কাহে ফুকারে হুতাশা। কিসের ছাই হুতাশা? এত ভয় করবার কি আছে?
ধড়ফড় ক’রে জেগে আর মুখ তুলে হিমুর কানের কাছে যেন স্বপ্নের ঘোরে একটা প্রলাপ ফিসফিস করে যূথিকা — আমি যদি বোম্বাই না যাই হিমাদ্রি?
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—তার মানে নরেনের সঙ্গে যদি আমার বিয়ে না হয়?
—ছিঃ, মাথা খারাপের আর কিছু বাকি নেই তোমার? রুক্ষ স্বরে, প্রায় ধমকের মত একটা ভঙ্গী ক’রে উত্তর দেয় হিমু।
হেসে ফেলে যূথিকা—তার মানে আমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার সাহস তোমার নেই।
হিমু—না নেই।
যূথিকা—কেন?
যূথিকার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তীব্র তীক্ষ্ণ ও যন্ত্রণাক্ত একটা দৃষ্টি তুলে তাকিয়ে থেকে হিমু বলে—তোমাকে ভালবাসি বলে।
চমকে ওঠে যূথিকার চোখ আর মুখ। হঠাৎ সূর্যোদয়ের আভা ঘুমন্ত চোখ আর মুখের উপর ছড়িয়ে পড়লে যে-রকম চমক লাগে, সেইরকম চমক। যেন যূথিকার জীবনের একটা আশার স্বপ্নালু আবেশ হঠাৎ আলোকের ছোঁয়া লেগে জ্বলে উঠেছে। হিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যূথিকা; দুই চোখে নিবিড় তৃপ্তির স্নিগ্ধতা জ্বল জ্বল করে।
থেমে গেল ট্রেনটা। রাত প্রায় ভোর-ভোর হয়েছে। প্রায় নির্জন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে মচ মচ ক’রে জুতোর শব্দ বাজাতে বাজাতে জানালার কাছে এসে থমকে দাড়ালেন ট্রেনের গার্ড।—আপনাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো?
হিমু একটু আশ্চর্য হয়ে বলে—না।
চলে গেলেন গার্ড। এবং ট্রেনটাও আবার চলতে শুরু করে। যূথিকা চোখ মুছে নিয়ে আস্তে আস্তে বলে—তুমি এত স্পষ্ট ক’রে এ কি কথা বলে ফেললে হিমাদ্রি?
হিমু—মিথ্যে কথা বলিনি।
যূথিকা—কিন্তু শুধু আমার কাছেই বলতে পারলে। আর কারও কাছে বলবার সাহস আছে কি?
হিমু—সাহস খুব আছে; কিন্তু বলবার দরকার হবে না।
যূথিকা—যদি দরকার হয়?
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—যদি নরেন তোমায় হঠাৎ জিজ্ঞাসা ক’রে বসে, তবে? সত্যি কথাটা বলতে পারবে তো?
হিমু বলে—না।
যূথিকা—এই তো তোমার সাহস! আর এই রকমই সত্যবাদী তুমি!
হিমু—যা ইচ্ছে হয় বল, আমি তোমার ক্ষতি করতে পারবো না। দরকার হলে হাজারটা মিথ্যে কথা বলে দেব।
যূথিকা—তাই বল। পথে এসো এবার।
হিমু—কিন্তু তুমি কি পারবে?
যূথিকা—কি?
হিমু—নরেন বাবুর কাছে সত্যি কথা বলে দিতে?
যূথিকা—কোন্ সত্যি কথা?
উত্তর দেয় না হিমু। যূথিকার কথার জালে জড়িয়ে পড়ে হিমুর মনের সব চেয়ে লোভনীয় একটা লোভ এইবার ধরা পড়ে গিয়েছে। কি জানতে চায় হিমু?
যূথিকা হাসে—বল হিমাদ্রি, কোন্ সত্যি কথা জানতে চাইছো?
যূথিকার এই হাসিটা কি চারু ঘোষের মেয়ের মনের সেই শুকনো কৌতুকের হাসি? তাই যদি হয়, তবে হিমু দত্তের জীবনের চরম কৌতূহল এই মুহূর্তে হিমু দত্তের বুকের ভিতরে শেষ আর্তনাদ তুলে ফুরিয়ে যাবে। ভালই হবে। আর দুঃখ করবার, এবং সারা জীবন মনের মধ্যে গোপন রত্নের মত লুকিয়ে রাখবার কিছু থাকবে না।
যূথিকা বলে—হ্যাঁ হিমাদ্রি, আমি অনায়াসে নরেনকেও বলে দিতে পারি যে, আমি হিমাদ্রিকে ভালবাসি।
ভালবাসে যূথিকা! শুধু এইটুকু জানবার সাধ যে হিমুর জীবনের চরম সাধ হয়ে আর স্বপ্ন হয়ে হিমুর বুকের ভিতর জমা হয়েছিল; সে সত্য ধরা পড়িয়ে দিলো হিমুর চোখ দুটো। ভিজে গিয়ে চিকচিক করে হিমু দত্তের সেই শাস্ত ও নির্বিকার চোখ, যে চোখ কোন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয় না বলে বিশ্বাস করেন কৃষ্ণার মা, অতসীর কাকিমা, কল্যাণীর মামা, নির্ভার বাবা, সরযূর দাদা, আর প্রমীলার মা।
যূথিকা—এ কি করলে হিমাদ্রি? এর পরেও চাও, নরেনের সঙ্গে আমার বিয়ে হোক?
হিমু—নিশ্চয়।
যূথিকা —নিশ্চয় না।
হিমু—তাহলে নিশ্চয় কি? আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে কোনদিন?
যূথিকা—হলে মন্দ কি?
হিমু—অসম্ভব নয় কি?
যূথিকা—একটুও অসম্ভব নয়। শুধু তুমি রাজি হলেই হয়।
উত্তর দেয় না হিমু।
যূথিকা—বল, শিগগির বল, আমাকে যদি বিশ্বাস করে থাক, তবে এখুনি বলে দাও লক্ষ্মীটি!
—কি বিশ্বাস করবো? কি বলবো? প্রশ্ন করতে গিয়ে যেন দম বন্ধ ক’রে ছটফট করে হিমু।
যূথিকা—বিশ্বাস কর; আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলছি না; আমি তোমাকে ভালবাসি।
হিমু—বিশ্বাস করি।
যূথিকা—বিশ্বাস কর, তোমার সঙ্গে বিয়ে না হলে সুখী হতে পারবো না।
হিমু—বিশ্বাস করি।
যূথিকা—তবে আমাকে বিয়ে করতে তোমার বাধা কোথায়? রাজি হয়ে যাও হিমাদ্রি।
হিমু দত্তের মুখে যেন একটা করুণ ও খিন্ন হাসির আভা ফুটে ওঠে। যেন বুকভরা একটা হাসির সুন্দর জ্বালা বুকের ভিতরেই দমিয়ে দিতে চেষ্টা করছে হিমু। যূথিকার মুখের দিকে অনেকক্ষণ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে হিমু। কে জানে কি ফুটে উঠেছে হিমুর চোখে। আশা আনন্দ মায়া আর বিস্ময়? না, ভয় সন্দেছ কৌতুক আর ফাঁকি?
হিমু বলে—বেশ আমি রাজি আছি যূথিকা।
যূথিকা——তাহলে গিরিডি পৌঁছেই মামীকে একটা টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিই, এ বিয়ে হবে না।
হিমু—জানিয়ে দিও।
যূথিকা—কিংবা নরেনকেই একটা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিতে পারি, কেন এ বিয়ে হতে পারে না।
হিমু—জানিয়ে দিতে পার।
যূথিকা—হিমাদ্রি?
হিমু— বল।
যূথিকা—বড় ঘুম পাচ্ছে হিমাদ্রি।
হিমু—ঘুমোও।
ট্রেনের কামরা নয়। উদাসীনের দোতলার একটি ঘর। উদাসীনের চারদিকে উঁচু পাঁচিল; সেই পাঁচিলের উপর আবার সারি সারি লোহার সূচীমুখ স্পাইক। একটি পাখিও সে পাঁচিলের উপর উড়ে এসে বসবার মত ঠাঁই পায় না। বসতে এলেই ডানাতে স্পাইকের খোঁচা খেয়ে ছটফট করে সেই মুহূর্তে উড়ে পালিয়ে যায়।
উদাসীনের দোতলার ঘরের ভিতরে সোফা চেয়ার আর পালঙ্কের উপর গড়াগড়ি দিয়েও যূথিকা ঘোষের মন থেকে ট্রেনযাত্রার ক্লাস্তির ঘোর সহজে কেটে যায়নি। কিন্তু কেটে যেতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। সারা সকাল দুপুর আর বিকেল বেলাটা বাস্, তারপরেই যেন হঠাৎ চোখ মেলে জেগে উঠলো যূথিকা। উশ্রীর বালুতে বিকালের আলো লুটিয়ে রয়েছে এবং মনেও পড়ে যূথিকার, পৃথিবীর একজনের কাছে একটা প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করে এসেছে যূথিকা, পাটনার মামীকে আজই টেলিগ্রাম ক’রে জানিয়ে দিতে হবে, এ বিয়ে হবে না।
টেলিগ্রামের ফরম নিয়ে কথাগুলি লিখতে গিয়ে বার বার হাত কাঁপে, বার বার রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে যূথিকা। তারপরেই নীচের তলায় নেমে গিয়ে কুসুম ঘোষের কাছে এসে বলে—মামীকে এখুনি একটা টেলিগ্রাম করতে চাই, মা।
কুসুম ঘোষ—কেন?
উত্তর দিতে গিয়ে বিড়বিড় করে যূথিকা। তারপরেই যেন একটা ভয়ের চমক লেগে কেঁপে ওঠে। এবং তার পরেই কে জানে কার উপর রাগ ক’রে আর প্রায় দৌড় দিয়ে আবার উপর তলায় চলে যায়।
সত্যিই একটা রাগ, সে রাগে গজগজ করে বুকটা, আর ঘেমে ওঠে কপালটা। টেলিগ্রাম করা হলো না। কিন্তু মনে পড়ে যূথিকার, নরেনের কাছে অনায়াসে একটা চিঠি লিখে সত্যি কথা জানিয়ে দিতে পারা যায়। পৃথিবীর একজনের কাছে এইরকম একটা প্রতিজ্ঞার কথা বলে রেখেছে যূথিকা।
চিঠি লিখতে দেরি করে না যূথিকা। অনায়াসে অনেক কথা লেখে এবং তার পরেই হঠাৎ ভয়ের চমক লেগে ছটফট ক’রে ওঠে; এবং সেই মুহূর্তে অনায়াসে চিঠিটাকে কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে।
ট্রেনের কামরার ভিতরে যেন স্বপ্নের ঘোরে মিথ্যে কথা বলে একটা অদ্ভুত অসম্ভব ও ভয়ানক অঙ্গীকার ক’রে হিমাদ্রির মনের ভিতরে একটা আশার স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছে যূথিকা; মনে পড়ে সবই। এবং মনে পড়তেই বুকটা কেঁপে ওঠে, লজ্জাও পায় যূথিকা একটা অসার দুঃসাহসের লজ্জা। হিমাদ্রির সঙ্গে যূথিকা ঘোষের কোনদিন বিয়ে হতে পারে; একথা হিমাদ্রি কি সত্যিই বিশ্বাস করেছে?
বিশ্বাস করতে তো চায়নি মানুষটা। কিন্তু ঝোঁকের মাথায় কি-ভয়ানক ভুল ক’রে ফেললো যূথিকারই একটা অবুঝ বেদনা। বেচারাকে জোর ক’রে বিশ্বাস করানো হলো। রাজি হয়ে গেল হিমাদ্রি।
কে জানে এই শহরের কোন্ গলির কোন্ ঘরের নিভৃতে কেমন অন্ধকারের মধ্যে বসে এখন চারু ঘোষের মেয়ের অঙ্গীকারের কথাগুলিকে জীবনের এক নতুন সঙ্গীতের মত মনে মনে সাধছে, হিমাদ্রি? ছি ছি, কী ভয়ানক বোকা হিমাদ্রি বেচারার মন! সন্দেহ করেও শেষ পর্যন্ত নিজেই অদ্ভুত এক আশার হাসি হেসে সেই সন্দেহের জোর ভেঙ্গে দিল। উদাসীনের মত বাড়ির মেয়ের ট্রেনযাত্রার সাথী হতে পারে হিমাদ্রি; মনের কথা বলাবলি করবার বন্ধু হতে পারে হিমাদ্রি; আর একই ডিসে সাজানো খাবার খাওয়ার সঙ্গী হতে পারে হিমাদ্রি; কিন্তু উদাসীনের মেয়ে যূথিকা ঘোষের স্বামী হতে পারে না হিমাদ্রি। তাই যদি সম্ভব হতো, তবে যূথিকা ঘোষ সত্যি যূথিকা ঘোষ হবে কেন, আর হিমাদ্রিই বা হিমাদ্রি হবে কেন?
ছি ছি, শুধু কয়েকটা কথার ভুলে কি অদ্ভুত এক কাণ্ড বাধিয়ে, একটা মানুষের সাদা মনের উপর মিছিমিছি রং ছিটিয়ে দিয়ে এখন ভয় ক’রে আর লজ্জা পেয়ে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে! হিমাদ্রি এখন কোন দুঃস্বপ্নেও এমন সন্দেহ করতে পারছে না যে, পয়লা অস্ত্রান নরেনকে নিয়ে হাসতে হাসতে আর উৎসবের বাঁশি বাজাতে বাজাতে এই উদাসীনের মেয়ের জীবনের কাছে হু হু করে ছুটে আসছে। টেলিগ্রাম করে কিংবা চিঠি লিখে পয়লা অস্ত্রানের ইচ্ছাটাকে কোনই বাধা দেবার ক্ষমতা হয়নি যূথিকার। যূথিকা ঘোষ যে সত্যিই পয়লা অস্ত্রানের উৎসবে সাজবার জন্য এরই মধ্যে তৈরি হয়ে গিয়েছে। শর্মা ব্রাদার্সের স্টোর থেকে নানা ডিজাইনের ও নানা রং-এর একশো শাড়ি এসেছে। তার ভিতর থেকে দশটা শাড়ি এখনই পছন্দ করে ফেলতে হবে!
একটি চিঠি লিখে এখনি হিমাদ্রির বিশ্বাসের ভুল ভেঙ্গে দিতে পারা যায়। সত্যি তোমার কোন অপরাধ নয় হিমাদ্রি, অপরাধ আমার; আমিই মনের একটা মুখর খেয়ালের ঝোঁকে, একটা স্বপ্নের ঘোরে কয়েকটা অদ্ভুত কথা বলে ফেলেছি। বড় কষ্ট হচ্ছিল হিমাদ্রি; ভাই প্রলাপ বকেছিলাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করলে কেন? সত্যিই বিশ্বাস করেছ কি?
হিমুর ঠিকানা জানা নেই, তাই চিঠি লেখা সম্ভব হবে না। কিন্তু…ঠিকানাটা জানা থাকলেই বা কি হতো? অস্বীকার করে না যূথিকা, হিমাদ্রির মত মানুষের সঙ্গে এক ট্রেনের এক কামরায় একই সীটের উপর পাশাপাশি বসে গল্প করতে গিয়ে যা মন চায় তাই অনায়াসে বলে দিতে পারে উদাসীনের মত বাড়ির মেয়ে; কিন্তু উদাসীনের দোতলায় এই ঘরে বসে কাগজ কলম নিয়ে হিমাদ্রিকে একটা চিঠি লেখাও যে নিতান্তই অসম্ভব।
হিমাদ্রি যদি হঠাৎ এই ঘরের দরজার কাছে এসে দাড়ায় আর প্রশ্ন করে, সব কথা মনে আছে তো যূথিকা? কল্পনা করতেও ভয় পেয়ে থরথর ক’রে ওঠে যূথিকা ঘোষের নিঃশ্বাস। হিমাদ্রি যদি ঝোঁকের মাথায় এরকম একটা কাণ্ড ক’রে বসে, তবে কি উপায় হবে? বাবা ছুটে আসবে; মা ছুটে আসবে। হিমাদ্রির মুখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তার পর যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করবে সবাই, এ লোকটা কোন্ সাহসে এসব কথা বলছে যূথিকা? এ লোকটার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কি?
না, কোন সম্পর্ক নেই। জানি না, লোকটা কোন্ সাহসে এমন কথা বলে। ভয় পেয়ে, কেঁদে আর চেঁচিয়ে একটা কাণ্ড করতে পারবে যূথিকা, কিন্তু বলতে পারবে না যে, আমিই ওকে একথা বলবার সাহস দিয়েছি। হয়তো পুলিশ ডাকবে উদাসীন, এবং উদাসীনের মেয়ের মিথ্যে কথা প্রমাণ করবার সাধ্যি হবে না হিমাদ্রির। কোনও প্রমাণ নেই, কেউ সাক্ষী নেই।
এমন অপমানের মধ্যে এগিয়ে আসবার সাহস হবে কি হিমাদ্রির? ভয়ানক ভুল করবে, যদি সাহস করে। ছ’হাতে মাথাটাকে শক্ত করে টিপে ধরে মনে মনে যেন প্রার্থনা করে যূথিকা; এমন সাহস যেন না করে হিমাদ্রি। যেন চুপ করে নিজের ঘরের ভিতরে বসে দিন আর রাতগুলিকে পার করে দেয়; এবং একদিন হঠাৎ চমকে উঠে যেন বুঝতে পারে হিমাদ্রি; পয়লা অস্ত্রান পার হয়ে গিয়েছে; বোম্বাই চলে গিয়েছে যূথিকা।
বড় বেশি আশ্চর্য হবে, হতভম্ব হয়ে যাবে, আর কষ্ট পাবে বেচারা। যূথিকা ঘোষের একটা কথা বিশ্বাস ক’রে যে এত শাস্তি পেতে হবে, কল্পনাও করতে পারছে না হিমাদ্রি। তার চেয়ে ভাল, আর এক মুহূর্ত দেরি না ক’রে গিরিডি ছেড়েই চলে যাক না, পালিয়ে যাক না হিমাদ্রি; তাহলে তো আর এই শাস্তি পাওয়ার দুর্ভাগ্য সহ্য করতে হবে না। কিন্তু সেটুকু বুদ্ধি আছে কি হিমাদ্রির? মানুষটা যে বোকা হবার ভুলেই জীবনে শুধু মানুষের যত তুচ্ছতা আর তাড়া খেয়ে বেড়াচ্ছে। ওকে হিমাদ্রি বলেও কেউ ডাকে না। চলে যাক, চলে যাক হিমাদ্রি।
ফুঁপিয়ে উঠলেও, আর বার বার রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেও যূথিকা ঘোষের মনের প্রার্থনাটা যেন হিমাদ্রি নামে একটা মানুষকে এই মুহূর্তে গিরিডি থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য নিষ্ঠুর চাবুকের মত ছটফট করতে থাকে। পয়লা অস্ত্রানের উৎসব বন্ধ করবার সাধ্যি নেই যার, যূথিকা ঘোষকে ভয় পাইয়ে দেবার কিংবা জব্দ করবার মত একটা ভ্রুকুটি করবারও শক্তি নেই যার, সে-মানুষ মানে মানে এখনও সরে পড়ে না কেন?