শুন বরনারী – ৬

সন্ধ্যাবেলা বেড়াতে এলেন গণেশবাবুর স্ত্রী অর্থাৎ লতিকার মা অর্থাৎ রমা মাসিমা। বসতে না বললেও বসে পরেন, প্রশ্ন না করলেও কথা বলেন, আর গায়ে পড়ে হাজার কথা বলে মানুষকে জ্বালাতে পারেন যে মহিলা, তাঁকে দেখা মাত্র কুসুম ঘোষের মুখ অপ্রসন্ন হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ভুলতে পারবেন কি করে কুসুম, ইনিই তো সেই প্রচণ্ড মতলবের আর কৌশলের মহিলা, যিনি নরেনের কাছে লতিকাকে গছাবার জন্য বছরে পাঁচবার পাটনা দৌড়চ্ছেন। ভাগ্য ভাল, যূথিকার মামী কণিকার মত শক্ত মানুষ পাটনাতেই থাকে; তাই নরেনকে টেনে নেবার অনেক চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত টেনে নিতে পারেন নি। কণিকা বাধা দেয় বলেই পারেন নি। তা না হলে এতদিনে বোধহয় নরেনের সঙ্গে লতিকার বিয়ে হয়েই যেত।

কিন্তু লতিকার মা এসেই হেসে হেসে সবার সামনে যে গল্পটা বললেন, সেটা একটা দুঃসহ বিস্ময়ের গল্প। শুনে বিশ্বাস করতেই ইচ্ছা হয় না। লতিকার মা যেন উদাসীনের আকাঙ্ক্ষার সব গর্ব মিথ্যে করে দিয়ে বিজয়িনীর মত ভঙ্গী নিয়ে একটা কৃতার্থতার কাহিনী বলছেন। যূথিকা সামনেই বসে রয়েছে; তবু বলতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করলেন না লতিকার মা।

লতিকার মা বললেন—আমি আজই পাটনা থেকে এসেছি। খবর নিয়েছি, কণিকা ওর ছেলেপিলে নিয়ে ভালই আছে।…হ্যাঁ, বোম্বাই থেকে হঠাৎ একদিনের জন্য পাটনাতে এসেছিল নরেন। নিজেই ফোন করে শীতাংশুকে জানিয়ে দিল, আমি এসেছি শীতাংশু-দা। জানই তো, আমার শীতাংশুর অভ্যাস, মানুষকে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে কত ভালবাসে শীতাংশু!

কোন প্রশ্ন করবেন না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসেছিলেন যিনি, তিনিই, সেই কুসুম ঘোষই চমকে উঠে প্রশ্ন করে বসলেন।—শীতাংশু শেষ পর্যন্ত গায়ে পড়ে নরেনকে নিমন্ত্রণ করেছিল বোধহয়?

—হ্যাঁ; দুপুরে এল নরেন; সন্ধ্যা হবার পর চলে গেল। লতিকার গান শুনে কত প্রশংসা করলো নরেন।

কুসুম—গায়ে পড়ে গান শোনালে কে না প্রশংসা করবে বলুন?

লতিকার মা—এটা আবার কেমন কথা হলো। গায়ে পড়ে গান শোনাবে কেন লতি? নরেন নিজেই বারবার বললে, অগত্যা বাধ্য হয়ে…। হ্যাঁ, নরেন তোমাদেরও কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি বলেছি, সবাই ভাল আছে।

কুসুম—আবার পাটনাতে কবে আসবে নরেন?

লতিকার মা—তা জানি না। নরেন বললে, মাঝে মাঝে হঠাৎ দু’এক দিনের জন্য চলে আসতে পারে।

লতিকার মা চলে যেতেই যূথিকার মুখের দিকে আতঙ্কিতের মত তাকিয়ে প্রশ্ন করেন কুসুম—এসব কি শুনলাম?

যূথিকা হাসে—যা শুনতে পেলে তাই শুনলে; আবার কি?

কুসুম—আমার মনে হয়; সব মিথ্যে কথা।

যূথিকা—সত্যি কথা হলেই বা কি?

কুসুম রাগ করেন—বাজে কথা বলিস না।…কিন্তু আমি ভাবছি; কণিকা বসে বসে করছে কি? এরকম একটা কাণ্ড হয়ে গেল, অথচ তার কোন খবরই রাখে না কণিকা? হইতেই পারে না।

লতিকার মা’র কথাগুলিকে অবিশ্বাস করতেই ইচ্ছে করে; কিন্তু অবিশ্বাস করবার মত মনের জোরটাই যেন বার বার দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই ভাবতে গিয়ে এক-একবার সত্যিই শিউরে ওঠেন কুসুম ঘোষ; ভগবান না করেন, লতিকার মা’র কথাগুলি যদি মিথ্যে কথা না হয়, তবে যূথিকার জীবনে যে একটা ভয়ানক অপমানের জ্বালা লাগবে। মেয়েটার মনের দশাও যে কি হয়ে যাবে, ভগবান জানেন! জানেন কুসুম ঘোষ, কণিকার কাছ থেকে অনেক চিঠিতে যে-খবর এতদিন ধরে জেনে এসেছেন, তাতে আর কোন সন্দেহই নেই যে, নরেনকে ভালবাসে যূথিকা। নরেনের ভালবাসার উপরেও মস্ত বড় একটা বিশ্বাস নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে আছে যূথিকা। এর পর, লতিকার সঙ্গে সত্যিই যদি নরেনের বিয়ে হয়ে যায়, তবে…।

কুসুম ঘোষের চোখ দুটো করুণ হয়ে যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এ কি ব্যাপার? যূথিকার মুখে কোন উদ্বেগের বেদনা ফুটে উঠেছে বলে মনে হয় না। ঘরের ভিতরে কেমন স্বচ্ছন্দে ঘুরে ফিরে আর গুন্‌গুন্‌ করে চাপা-গলায় গান গাইছে যূথিকা!

কণিকার অসাবধানতার উপর রাগ হয়; আর যূথিকার এই চাপা-গলার গানের গুঞ্জনের উপরেও রাগ করেন কুসুম ঘোষ। এরা ভেবেছে কি! কণিকা কি ক্লান্ত হয়ে সব চেষ্টাই ছেড়ে দিল? আর যূথিকা কি আচমকা একটা শক পেয়ে; একেবারে আশাশূন্য হয়ে, দুর্ভাগ্যের আর অপমানের জ্বালা চাপবার জন্য চাপা-গলায় গান গেয়ে উঠলো?

—যূথি। ডাকতে গিয়ে কুসুম ঘোষের গলার স্বরটা যেন দুশ্চিন্তার প্রতিধ্বনির মত বেজে ওঠে।

—কি মা? গান থামিয়ে, আর একটু আশ্চর্য হয়ে উত্তর দেয় যূথিকা।

—তুই ভাবিস না। লতিকার মা নিশ্চয় মিথ্যে কথা বলেছে।

হেসে ওঠে যূথিকা।—বললাম যে, সত্যি হলেই বা কি আসে যায়?

—ছিঃ, ওকথা বলতে নেই। বলবার কোন দরকারও হয় না। লতিকার মা’র মতলব শেষ পর্যন্ত আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু তবু একটু সাবধান হওয়া ভাল।

—বুঝতে পারছি না মা।

—আমার মনে হয়; তোর এখন পাটনাতে থাকাই ভাল।

—এখন পাটনাতে গিয়ে লাভ কি? কলেজ খুলতে এখনও অনেকদিন বাকি আছে।

—তা জানি; কিন্তু নরেনের যে হঠাৎ মাঝে মাঝে পাটনাতে এসে পড়বার সম্ভাবনাও আছে।

—আসুক না।

—কি ছাই বলছিস? তুই এখানে বোবা হয়ে পড়ে থাকবি, কণিকা ওদিকে হাবা হয়ে পড়ে থাকবে; আর শীতাংশু ডাক্তার বার বার নরেনকে নেমন্তন্ন করে চা খাইয়ে, লতিকার গান শুনিয়ে…ছিঃ ছিঃ…ওরা যে নরেনের একটা ভয়ানক ক্ষতি করে দেবে।

—কিন্তু আমি কি করতে পারি বল?

—তুমি কালই পাটনাতে চলে যাও; তারপর যা করবার কণিকা করবে।

—আমি এখন পাটনা যেতে পারবো না।

যূথিকার কথা শুনে আশ্চর্য হন কুসুম ঘোষ। এবং একটু শঙ্কিতও হয়ে ওঠেন। যূথিকার চোখ-মুখের এই অবিচল প্রশান্তি, পাটনার উপর হঠাৎ এই তুচ্ছতা, এ যে যূথিকার মনের একটা অভিমানের বিদ্রোহ। খুবই ব্যথিত হয়েছে যূথিকা। মেয়েটার সম্মানে লেগেছে।

চলে যান কুসুম ঘোষ; এবং একটু পরেই ফিরে আসেন; সঙ্গে চারুবাবুও আছেন। যূথিকা ঘোষ ততক্ষণে একটা নতুন উপন্যাসের কুড়ি পাতা পড়ে ফেলেছে।

চারুবাবু বলেন—তোমার এখন পাটনা যাওয়া খুবই দরকার যূথি।

যূথিকার চোখে ছোট অথচ শক্ত একটা আপত্তির ভ্রুকুটি ফুটে ওঠে।

চারুবাবু বলেন—দেরি করবারও দরকার নেই। ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি; কাল সকালে হিমু নামে সেই লোকটাকে একটা খবর দিয়ে আসবে।…

যূথিকা ঘোষের ভ্রুকুটিই যেন হঠাৎ একটা চমক লেগে গলে যায় আর সুস্মিত বিস্ময়ের মত উথলে ওঠে। খোলা উপন্যাস বন্ধ করে টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে যেন ছটফট করে উঠে দাঁড়ায় যূথিকা—কালই রওনা হতে বলছো?

চারুবাবু—হ্যাঁ। সকাল দশটার ট্রেনে।

যূথিকা—বেশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *