৫
এ কি অদ্ভুত কথা বলছে দিদি! বাবা শুনলে যে রাগ করবে। আর মা নিশ্চয় আরও রাগ করে শেষে ধমক দেবে, না, এরকম বিশ্রীভাবে বেড়াতে যাবার কোন মানে হয় না।
যূথিকার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে দুই ভাই, বীরু আর নীরু। একবার বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে আসতে চায় দিদি; বীরু আর নীরুকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়।
কিন্তু ঠিক কোথায় যে বেড়াতে যেতে চায়, সেটা ঠিক স্পষ্ট করে বলতে পারছে না দিদি। উশ্রীর দিকে নয়; বরাকরের দিকে নয়; বেনিয়াডি কোলিয়ারি যাবার সড়কের দিকে, যেখানে মাঠের উপর অনেক পলাশের মাথা লাল ফুলে রঙীন হয়ে রয়েছে, সেদিকেও নয়। তবে কোথায়? কোন্ দিকে?
যূথিকা বলে—ওসবই তো দেখা; তার চেয়ে বরং…
বীরু—মহেশমুণ্ডার দিকে?
যূথিকা—না, অতদূরে নয়।
নীরু—তবে কি পরেশনাথের দিকে?
যূথিকা—না; পায়ে হেঁটে কি অতদূরে বেড়াতে যাওয়া যায়?
বীরু আর নীরু একসঙ্গে আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে—পায়ে হেঁটে?
যূথিকা—হ্যাঁ, তাতে কি হয়েছে? এত বড় বড় চোখ করে আশ্চর্য হবার কি আছে?
উদাসীন নামে এত বড় বাড়ির আত্মাটাও বোধহয় চমকে উঠেছে। বেড়াতে যেতে চায় যূথিকা। কিন্তু এত সুন্দর জায়গা থাকতে ঐ শ্রীহীন শহরের ভিতরে একটু ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে আসতে চায়। তাও আবার গাড়িতে নয়, শুধু পায়ে হেঁটে। তা ছাড়া এমন একটা অসময়ে।
শহরের দিকে, যে-দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে জগতের যত ধুলো-ময়লার ভিড়, যত বাজে মানুষের ছুটোছুটি আর শোরগোল, যত দীনতা আর হীনতার ছায়াও পথের উপর আর দু’পাশে ছড়িয়ে আছে। শর্মা ব্রাদার্সের অমন সুন্দর ভ্যারাইটি স্টোর্সের কাছে যেতে হলেও অনেক বাজে মানুষের ভিড়ের গা ঘেঁষে এগিয়ে যেতে হয়। গাড়ি ছাড়া কোনদিনও পায়ে হেঁটে শহরের কোন দোকানে আসেনি চারু ঘোষের ছেলে মেয়ে।
কিন্তু যূথিকা যে-কথা বলছে, সেটা দোকানে-টোকানে যাবার পরিকল্পনাও নয়। কোন শখের জিনিস কেনবার কথাও ওঠেনি। শুধু শহরের ভিতরেই এদিকে-ওদিকে একবার ঘুরে আসতে চায় যূথিকা। বাজারের দিকে, চকের দিকে, স্টেশনের দিকে। বিনা দরকারে শহরের যে-সব পথে ঘুরে বেড়াবার কোন অর্থ হয় না, সেই সব পথেই বেড়িয়ে আসবার জন্য অদ্ভুত এক ইচ্ছার খেয়ালে যেন দুরন্ত হয়ে উঠেছে যূথিকা ঘোষের মন।
ভয় পায় নীরু।—কিন্তু রাস্তায় যে ভিখিরী আছে দিদি; নোংরা খেঁকি কুকুরও আছে।
যূথিকা হাসে—থাকুক না; ভয় কিসের?
দিদির সাহসের হাসি দেখে আশ্বস্ত হয় নীরু।
এবং, তারপর আর দেরি হয় না। চারু ঘোষের মেয়ে যূথিকা ঘোষ, সঙ্গে চারু ঘোষেরই দুই ছেলে বীরু আর নীরু, যখন উদাসীনের ফটক পার হয়ে সড়কের ধুলো মাড়িয়ে শহরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, তখন উদাসীনের মালীটাও একটু আশ্চর্য হয়ে হাঁ করে তাকিয়ে দেখতে থাকে।
মাত্র বিকেল হয়েছে। আদালত থেকে চারু ঘোষের বাড়ি ফিরতে এখনও বেশ দেরি আছে; এবং চারু ঘোষের স্ত্রীও এখন ডাক্তারের উপদেশ অনুযায়ী তিন ঘণ্টার রেস্ট নেবার জন্য উপরতলার একটি ঘরে নীরবতার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে আছেন।
এত রোদ! এখন যে ঠিক বেড়াতে যাবার সময়ও নয়। কিন্তু যূথিকা ঘোষের প্রাণটা যেন উদাসীনের জীবনের এতদিনের নিয়মের শাসন ভঙ্গ করবার কৌতুকে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। বীরু আর নীরুকে হেসে হেসে আশ্বাস দেয় যূথিকা—না না; বাবা কিচ্ছু বলবে না বীরু। মা’ও বলবে না নীরু। দেখো, আমার কথা সত্যি হয় কিনা।
আরও কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর, যূথিকা ঘোষের প্রাণের এই দুরন্ত অবাধ্যতার আনন্দ যেন মুখর হয়ে হেসে ওঠে। বীরু আর নীরুর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে—যদি একটু বকুনি খেতে হয় তো খাব।
যূথিকার সাজটাও বেড়াতে যাবার মত সাজ নয়। বীরু বলে—তোমাকে বড় অভদ্র দেখাচ্ছে দিদি।
—কেন? চমকে ওঠে যূথিকা।
নীরু বলে—বিচ্ছিরি ড্রেস করেছো, একেবারে গরীব লোকের মত।
ঠিক কথাই বলেছে বীরু আর নীরু। যূথিকা ঘোষের পায়ে এক জোড়া চটি, আর গায়ে এলোমেলো করে পরা একটা রঙীন ছাপাশাড়ি ও ছিটের ব্লাউজ। খোঁপা নয়; বিনুনীও নয়; সাবান-ঘষা মাথার চুল এতক্ষণে শুকিয়ে আর রুক্ষ হয়ে ফেঁপে উঠেছে। স্নানের পর ঘাড়ে আর গলায় যে সামান্য একটু পাউডার ছড়ানো হয়েছিল, সে পাউডারের কোন চিহ্নও এখন আর নেই। স্নানের সময় গলার হার আর কানের দুলও খুলে রাখা হয়েছিল। সেগুলিও আর পরা হয়নি। আয়নার দেরাজের মধ্যেই সেগুলি পড়ে আছে।
চেহারাটা অভদ্রের মত দেখাচ্ছে, গরীবের মত দেখাচ্ছে, কিন্তু খারাপ দেখাচ্ছে কি? প্রশ্নটা হয়তো মুখ খুলে বলেই ফেলতো যূথিকা ঘোষ; আর বীরু ও নীরুর চোখের বিস্ময়ের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলতে পারতো যূথিকা, একটুও খারাপ দেখাচ্ছে না নিশ্চয়।
কিন্তু প্রশ্ন করতে হয় না; কারণ বীরুই হঠাৎ যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে একটা ছেলেমানুষী আনন্দের কথা বলে ফেলে—তোমার গায়ে অনেক রক্ত আছে দিদি।
—কি করে জানলে?
—তোমার মুখটা কি চমৎকার লাল হয়ে উঠেছে।
হাসতে গিয়ে আরও লাল হয়ে ওঠে যূথিকার মুখ। তবে আর সন্দেহ নেই; উদাসীনের মেয়ের মুখ পথের রোদের ছোঁয়ায় একটুও অসুন্দর হয়ে যায়নি; একটুও খারাপ দেখাচ্ছে না যূথিকাকে। বরং, বীরুর চোখের ঐ বিস্ময় লক্ষ্য করবার পর বিশ্বাস করতে হয়, যূথিকার এই সাজহীন মূর্তিটা নতুন রকমের একটা প্রাণের আভায় রঙীন হয়ে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে।
যূথিকা জানে না, বীরু আর নীরুও জানতে পারে না, কিসের জন্য আর কি দেখবার জন্য পথের এত ভিড় পার হয়ে, এত শোরগোল শুনতে শুনতে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। কোন কাজ নেই, দরকার নেই, কোথাও থামবার আর জিরোবার কথা নেই, শুধু শহরের ভিতর এদিকে-ওদিকে একটু ঘুরে বেড়ানো, এই মাত্র।
ঘুরে বেড়াতে একটুও খারাপ লাগে না। লোহার পুলটা পার হবার সময় ট্রেনছাড়া একটা একলা ইঞ্জিন ভয়ানক চিৎকার করে আর ঘন কালো ধোঁয়ার স্তবক ধমকে ধমকে উড়িয়ে দিয়ে ছুটে চলে গেল। চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে উদাসীনের দিদি আর দুই ভাই। ইঞ্জিনের ধোঁয়ার কুণ্ডলী থেকে মোটা মোটা কয়লার গুঁড়ো যূথিকার রুক্ষ চুলের উপর ঝরে পড়ে।
ছুটন্ত ইঞ্জিনের দিকে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে হেসে ওঠে বীরু আর নীরু। তারপর যূথিকার চুলের উপর কয়লার গুঁড়োর ছড়াছড়ি দেখে আরও জোরে হাততালি দেয়।
যূথিকা বলে—দুষ্টুমি করো না; ছিঃ—আচ্ছা, এইবার চল, একবার চকের কাছে গিয়ে…তারপর একবার স্টেশনের দিকটা ঘুরে এসে, তারপর…
বিচিত্র এক উদ্ভ্রান্তির অভিযান! এগিয়ে যেতে থাকে যূথিকা, আর বীরু, নীরু। চকের দোকানগুলিতে যেমন ভিড় তেমনই হৈ-হৈ। কত মানুষ আসছে আর যাচ্ছে, কত ব্যস্ততা। কত কথা বলছে, হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করছে, আবার ঝগড়াও করছে মানুষগুলি। গাড়িতে করে এই চক কতবার পার হয়ে গিয়েছে যূথিকা, কিন্তু কোনদিন ভিড়ের মুখগুলির দিকে তাকাবার কোন দরকার হয়নি। তাকাতে ইচ্ছেও করেনি।
কিন্তু আজ বারবার তাকাতে ইচ্ছে করে। দরকারের মানুষগুলি আসছে যাচ্ছে আর ভিড় করে থমকে রয়েছে, দেখতে বেশ লাগে। কিন্তু…কি আশ্চর্য, একটা চেনা মুখ এখন পর্যন্ত দেখতে পাওয়া গেল না। পথের ভিড়গুলি যেন একটা নিরেট অচেনা জগতের কতগুলি হাসাহাসির, মুখরতার আর ব্যস্ততার ভিড়।
মাঝে মাঝে এক-একবার চমকেও ওঠে যূথিকা ঘোষের খেয়ালের চোখ। ঠিক হিমাদ্রির মত নীল রঙের কামিজ গায়ে, এক ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে একটা ফলের দোকানের ভিড়ের সঙ্গে মিশে রয়েছেন। আশ্চর্য, হিমাদ্রি নয় তো? কিন্তু আশ্চর্য হবার কি আছে? চকের এই সব দোকানে এসে এত মানুষের যদি ভিড় করবার দরকার থাকে, তবে হিমাদ্রিই বা আসবে না কেন?
না হিমাদ্রি নয়। নীল রঙের কামিজ বটে, কিন্তু আস্তিন দুটো গোটানো নয়। আর পায়ে এক জোড়া নাগরা, সাদা রবারের জুতো নয়।
স্টেশনের কাছে এদিকে ওদিকে ঘুরে ঘুরে, আর পথের ভিড়ের অনেক মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যেন ক্লান্ত হয়ে যায় যূথিকা ঘোষের এই বিচিত্র উদ্ভ্রান্তির অভিযান। নীল রঙের কামিজ, আস্তিন দুটো গোটানো, আর পায়ে সাদা রবারের জুতো, এমন কোন মূর্তি শহরের এত ভিড়ের কোন ভিড়ের মধ্যে দেখা গেল না।
বীরু বলে—এবার কোন দিকে যাবে দিদি?
যূথিকা বলে—আর কোন দিকে না।
নীরু—কেন দিদি?
যূথিকা—সন্ধ্যে হয়ে এসেছে।
বীরু—তাতে কি হয়েছে?
যূথিকা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে—কারও মুখ স্পষ্ট করে যে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে চিনতে পারা যাবে না।
নীরু ভয়ে ভয়ে বলে—তবে এবার বাড়ি ফিরে চল দিদি।
যূথিকা বলে—হ্যাঁ, চল।
ফটক পার হয়ে উদাসীনের বারান্দার উপর এসে দাড়াতেই বুঝতে পারে যূথিকা, হ্যাঁ বকুনি খেতে হবে। বীরু আর নীরুও বুঝতে পারে বোধ হয়, তা না হলে ওরা দু’জনে ওভাবে যূথিকার এলোমেলো চেহারাটার আড়ালে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবার চেষ্টা করে কেন?
অনেকক্ষণ হলো আদালত থেকে ফিরেছেন চারু ঘোষ। অনেকক্ষণ হলো বিরামের ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন চারু ঘোষের স্ত্রী কুসুম ঘোষ। অনেক ডাকাডাকি করেও উদাসীনের ছেলে-মেয়ের কোন সাড়া না পেয়ে অনেক আতংক অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করেছেন। তারপর মালীর কথা শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। কিন্তু মনের রাগটাকে শান্ত করতে পারেননি। বলা নেই কওয়া নেই, অনুমতি না নিয়ে, একটা জানান না দিয়ে বাচ্চা ভাই দুটোকেও সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে কোথায় গেল বাইশ বছর বয়সের কাণ্ডজ্ঞানহীন ধিঙ্গি? গণেশবাবুর স্ত্রীর মত নিন্দুকের চোখে পড়লে আর রক্ষা নেই। এক বেলার মধ্যেই বোধ হয় সারা গিরিডির সব পাড়া ঘুরে দুর্নাম রটিয়ে দেবে, কিপটে চারু ঘোষ শুধু নিজে একাই গাড়ি চড়ে; ছেলেমেয়েগুলো পায়ে হেঁটে ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়।
কি আশ্চর্য, ভেবে কোন কারণই ঠাহর করতে পারেন না চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষ; উদাসীনের সুশ্রী জীবনের শিক্ষা-দীক্ষা পেয়েও আর এত বড় হয়ে ওঠবার পরেও যূথিকার মত মেয়ের মনে আবার এ কোন্ রকমের অপরুচির অনাচার? গাড়ি ছাড়া কোন দিন বেড়াতে বের হয়েছে যূথিকা, এমন ঘটনা স্মরণ করতে পারেন না কুসুম ঘোষ; কারণ এমন ঘটনা কোনদিনই ঘটেনি। তবে আজ হঠাৎ এমন অধঃপতনের ধুলো পায়ে গায়ে আর মাথায় মাখবার জন্য এ কেমন নোংরা শখের খেলা খেলে এল মেয়েটা? কেন, কিসের জন্য, কোথায় গিয়েছিল যূথিকা? কার সঙ্গে কথা বলে এল?
সন্দেহ করেন কুসুম ঘোষ, নিশ্চয় একটা কাণ্ড করে এসেছে যূথিকা। তা না হলে, না বলে-কয়ে একটা চুপি-চুপি চেষ্টার মত বাইরে বের হয়ে গেল কেন? বিশ্রী কাণ্ড করতে হলে যে ঠিক এই ধরনের চুপি-চুপি চেষ্টা করতে হয়। কুসুম ঘোষের জেঠতুতো দাদা, আই—সি—এস মোহনদা’র বউ বর্ণালীর কথা মনে পড়ে। চাল—চলনে প্রায় মেম সাহেব হয়ে গিয়েছে যে বর্ণালী বউদি; একশো টাকা মাইনের মগ কুকের হাতের রান্না যত রোস্ট গ্রিল আর ফ্রাই ছাড়া যার মুখে কোন বাংলা রান্না রোচে না; সেই বর্ণালী বউদি লুকিয়ে লুকিয়ে চাপরাশিকে দিয়ে বাজারের তেলেভাজা বেগুনি আনিয়ে আর ঘরের দরজা বন্ধ ক’রে লুকিয়ে লুকিয়ে খেত।
যূথিকার কাণ্ডটা প্রায় এই রকমের একটা চুপি-চুপি সেরে আসা নোংরা শখের কাণ্ড। যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে ধমক দেন কুসুম ঘোষ— ছিঃ।
যূথিকা হাসে—কি হলো মা?
—হঠাৎ এরকম একটা কাণ্ড করবার মানে কি?
যূথিকা—শহরের ভেতরে একটু এদিক-ওদিক বেড়িয়ে এলাম।
—কেন? কারণ কি?
যূথিকা হাসে—এমনি; কোন কারণ নেই।
—তার মানে পাগলামিতে পেয়েছিল?
চারুবাবু বলেন— যাক্ গে; আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কুসুম ঘোষ চুপ করেন; এবং চারুবাবু আরও গম্ভীর হয়ে বলেন— মোট কথা; তোমার কাণ্ড দেখে আমি বড় দুঃখিত হয়েছি যূথিকা। আমাদের প্রেস্টিজের দিকে চোখ রেখে কাজ করবে। উদাসীনের মেয়ে উদাসীনের কালচার ভুলে যাবে কেন?
উদাসীনের কালচারের উপর আবার একটা উপদ্রব। এই উপদ্রবও উদাসীনের মেয়ে যূথিকা ঘোষের একটা খেয়ালের কাণ্ড। এবং এই খেয়ালটাও একটা নোংরা শখের খেয়াল। খুব দুঃখিত হলেন চারু ঘোষ, এবং খুব রাগ করলেন কুসুম ঘোষ।
দিনটা ছিল যূথিকা ঘোষেরই জন্মদিনের উৎসবের দিন। সেদিন আদালতে যাননি চারু ঘোষ। সেদিন স্কুলে যায়নি বীরু আর নীরু। সেদিন শহরে গিয়ে শর্মা ব্রাদার্সের ভ্যারাইটি স্টোর থেকে যূথিকার জন্য ছ’শো টাকা দিয়ে এক গাদা ফরাসী পারফিউমারির সৌরভ-সামগ্রী আর প্রসাধনের উপচার কিনে এনেছেন চারু ঘোষ ৷ দশ শিশি সেন্ট, পাস্তুরাইজ্ড্ ফেস ক্রীম, অল-টোন শ্যাম্পু, স্কিন টনিক লোশন, ওয়াটারপ্রুফ মাসকারা আর ব্রিউটি গ্রেন।
সকাল আটটা থেকে শুরু করে বেলা বারটা পর্যন্ত অনেক স্নেহময় আগ্রহ উৎসাহ আর যত্ন নিয়ে কুসুম ঘোষ রান্না করেছেন, মিষ্টি পোলাও, রুই মাছের ক্রোকে, মাংসের দম্পক্ত, নারকেল-চিংড়ি আর ছানার পায়েস।
তখনো টেবিলে খাবার সাজানো হয়নি; আর চারু ঘোষের স্নান সারাও বাকি ছিল। কিন্তু উদাসীনের মেয়ে যূথিকা ঘোষ ওর সেই সুরভিত আর প্রসাধিত সুন্দর চেহারাটাকে নিয়ে, ঝলমলে শাড়ির আভা ছড়িয়ে ছলিয়ে আর ছুটিয়ে বার বার যেন একটা পেটুকে লোভের আবেগে রান্নাঘরের দরজার কাছে এসে কুসুম ঘোষকে বিরক্ত করতে থাকে।—রান্না শেষ হলো কি মা?
কুসুম ঘোষ হাসেন—হ্যাঁ রে লোভী মেয়ে। শেষ হয়ে এসেছে; শুধু জলপাই-এর চাটনিটা বাকি ৷
জলপাই-এর চাটনি রাঁধতে এমন কি আর সময় লাগে? পনর মিনিট পার হতে না হতে আবার ছুটে আসে যূথিকা। —হলো চাটনি?
কুসুম ঘোষ হাসেন—হ্যাঁ। এবার ওকে স্নান সেরে নিতে বল।
যূথিকা — বলছি… হ্যাঁ… একটা কথা।
—কি?
যূথিকা—তিনটে থালাতে খাবার সাজিয়ে দাও তো।
কুসুম ঘোষ আশ্চর্য হন—তিনটে থালাতে?
যূথিকা — হ্যাঁ।
—কিসের খাবার?
যূথিকা—এই যে, এইসব পোলাও টোলাও… সবই কিছু কিছু করে তিনটে থালাতে সাজিয়ে দাও।
কুসুম ঘোষের চোখে এইবার একটা ভ্রুকুটি ফুটে ওঠে—কার জন্যে?
যূথিকা—গিরধারীর জন্যে; জানকীরামের জন্যে আর সোমরার জন্যে।
– কি বললি? কুসুম ঘোষ যেন একটা আর্তনাদ করে তাঁর যন্ত্রণাক্ত বিস্ময়টাকে সামলাতে চেষ্টা করেন।
ড্রাইভার গিরধারী; চাকর জানকীরাম আর মালী সোমরার জন্য তিনটে থালাতে এই সব আভিজাতিক খাবার নিজের হাতে সাজিয়ে দিতে হবে, যূথিকা যেন কুসুম ঘোষের হাত দুটোকে একটা অভিশাপ সহ্য করতে বলছে। বলতে একটুও লজ্জা পেল না যূথিকা? একটু ভেবে দেখলো না, কি অদ্ভুত কথা বলছে? ভুলে গেল মেয়েটা, এরকম নোংরা কাণ্ড যে এই উদাসীনের পঁচিশ বছরের জীবনে কোনদিন সম্ভব হয়নি। কুসুম ঘোষ বলেন— না; তোমার বাজে খেয়াল বন্ধ কর যুথি।
যূথিকাই এইবার আশ্চর্য হয়—আমার জন্মদিনে আমরা সবাই পোলাও টোলাও খাব, আর ও বেচারারা বাড়িতে থেকেও খাবে না?
—না।
যূথিকা নাক সিটকে বিড়বিড় করে—কি বিশ্রী ব্যাপার!
—বিশ্রী হয়ে গিয়েছে তোর বুদ্ধিসুদ্ধি।
—যাকগে! আবার নাক সিঁটকে নিয়ে গম্ভীর হয়ে, আর ছটফট করে চলে যায় যূথিকা।
কুসুম ঘোষের সন্দেহ হয় এবং দু’চোখের ক্ষুব্ধ দৃষ্টি তুলে দেখতে থাকেন, কেমন যেন একটা আধপাগলা রকমের মুখ করে ধেই ধেই ক’রে চলে গেল মেয়েটা। মেয়েটার ব্যবহারের রকম-সকম, কথা বলবার ঢং, চোখের চাউনি, হাঁটা—চলা আর বুদ্ধি রুচি ইচ্ছে টিচ্ছে সবই যেন কেমনতর বিশ্রী হয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটার জন্মদিন; তাই খুব বেশি ধমক-ধামক করতে ইচ্ছে করে না। তাই রাগ সামলাতে চেষ্টা করেন কুসুম ঘোষ।
চারু ঘোষও সবকথা শুনতে পেয়ে গম্ভীর হয়ে গেলেন। মেয়েটাকে যেন উদাসীনের জীবনের রীতি আর অভ্যাসগুলিকে অপমান করবার শখে পেয়েছে। কিংবা কাণ্ডজ্ঞানই হারিয়েছে।
তা না হলে বুঝতে পারে না কেন, এরকমের কাণ্ড করলে উদাসীনের প্রেস্টিজ নষ্ট করা হয়।
যাই হোক, খাবার টেবিলের আনন্দটা আর নষ্ট করেনি যূথিকা। কোন বিশ্রী উপদ্রব করেনি। বরং, শেষ পর্যন্ত দেখতে পেয়ে খুশি হলেন, আর একটু নিশ্চিন্ত হলেন চারু ঘোষ এবং কুসুম ঘোষ, বীরু আর নীরুর লোভের সঙ্গে সমানে তাল দিয়ে সব খাবারের সব স্বাদুতা একেবারে চেটেপুটে খেল যূথিকা; প্রত্যেকবার জন্মদিনের উৎসবের দিনে একটু বেশি উৎফুল্ল হয়ে বীরু নীরুর সঙ্গে যে সব গান গায় আর গল্প করে যূথিকা, এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
উদাসীনের পিতা আর মাতার মুখের অপ্রসন্ন ভাবটাও শেষ পর্যন্ত হাসিচাপা পড়ে। মনে মনে বোধহয় একটু আশ্বস্ত হন এবং একটু হাঁপও ছাড়েন চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষ; না, যূথিকার মনের এই ছন্নছাড়া খেয়াল বোধহয় একটা বুদ্ধিহীন আমোদের খেলা মাত্র; ফিটের ব্যারামের মত কোন ব্যারাম নয়। গিরধারীকে, জানকীরামকে, আর সোমরাকে—একটা ড্রাইভার, একটা চাকর আর একটা মালীকে হঠাৎ সমাদর করে পোলাও—টোলাও খাওয়াতে গেলে ওরাই যে ভয় পেয়ে চমকে উঠবে; যূথিকা বোধহয় ওদের ঐ ভয়ের চমক দেখে একটু মজা পেতে চায়। তাই কি?
কুসুম ঘোষ বলেন— আমার মনে হয়, যূথিকা শুধু একটু মজা করবার জন্য এরকমের একটা কাণ্ড করতে চেয়েছিল।
চারু ঘোষ—তা যদি হয়; তবে রাগ করবার কিছু নেই। কিন্তু আমার কেমন একটা সন্দেহ হয় যে…
—কি? কুসুম ঘোষ আতঙ্কিতের মত তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
চারুবাবু বলেন—আমার সন্দেহ হয়, যূথিকা বোধহয় আজকাল বাজে বই-টই পড়ছে।
কুসুম—হ্যাঁ, গাদা গাদা নভেল পড়ে দেখেছি।
চারুবাবু—না না, নভেল-টভেলের কথা বলছি না। ওতে কিছু হয় না; আমার সন্দেহ হয়, যূথিকা আজকাল বিবেকানন্দের বই-টই পড়ছে না তো?
কুসুম অবিশ্বাস করেন— বিবেকানন্দের বই যূথিকা পড়বে কোন্ দুঃখে?
চারুবাবু—দুঃখে নয়; খেয়ালে। বাতিকে। সেই জন্যেই তো বলছি। এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা আছে।
কুসুম আশ্চর্য হন—তুমি কবে বিবেকানদের বই পড়লে?
চারুবাবু — আমি না; আমি দেখেছি একজনকে, বিবেকানন্দের বই পড়তে পড়তে শেষে জীবনের সব প্রসপেক্টের কি ভয়ানক সর্বনাশ করে কি হয়ে গেলেন নন্তুকাকা।
কুসুম—নন্তুকাকা কে?
চারুবাবু—আমারই বন্ধু—এক কলেজের বন্ধু ফটিকের আপন কাকা। ভদ্রলোক কেমব্রিজের এম-এ; দেশে ফিরে এসেই আটশো টাকা মাইনের একটা সরকারী সার্ভিস পেলেন; ভেবে দেখ, সে-সময়ের আটশো টাকা; তার মানে, আজকের প্রাইস ইনডেক্স অনুসারে বত্রিশ শো টাকা। ভদ্রলোক সে সার্ভিস নিলেন না; একটা অজ পাড়া-গাঁয়ে গিয়ে নিজেই একটা স্কুল করলেন। আমি নিজের চোখে দেখেছি, স্কুল বাড়ির কাছে কাউ-শেডের মত একটা ঘরের ভেতর বসে নিজের হাতে রান্না করছেন নন্তুকাকা; ভাত, ডাল আর ঢেঁড়সের চচ্চড়ি; বাস্! কী সাংঘাতিক অবস্থা।
কুসুম—ইচ্ছে করে কেন এরকম অবস্থা করলেন নন্তুকাকা?
চারুবাবু—বললাম তো, বিবেকানন্দের বই পড়বার অভ্যাসে পেয়েছিল। গরীব হয়ে যাবার বাতিকে ধরেছিল।
চারুবাবুর সন্দেহটাকে সন্দেহ করবার মত মনের জোর আর পান না কুসুম; এবং একটু ভয়ও পান বোধহয়। এবং, একদিন হঠাৎ যূথিকার পড়ার ঘরে ঢুকে ভয়ের কথাটা একটু কৌশল করে বলেই ফেললেন কুসুম। ভাল বই-টই পড়বি; বিবেকানন্দের বই-টই পড়ে কোন লাভ নেই ৷
যূথিকা হাঁ করে আর চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে— বিবেকানন্দ কে?
কুসুম — বিবেকানন্দ, আবার কে?
যূথিকা — আমি জানি না; কোনদিন এরকম একটা নামও শুনিনি।
কুসুমের চোখের দৃষ্টিটাই যেন হঠাৎ খুশি হয়ে হেসে ওঠে।
তাঁর কৌশলের প্রশ্নটাই সার্থক হয়েছে। বৃথা সন্দেহ, অযথা দুশ্চিন্তা।
এবং চারুবাবুর কাছে গিয়ে হেসে ফেলেন কুসুম। মেয়েটার সামান্য দুটো-একটা খেয়ালের কাণ্ড দেখে মিছিমিছি বড় বেশি ভাবনা করা হচ্ছে; ছিঃ।
চারুবাবুও একটু লজ্জিত হয়ে হাসতে থাকেন।
উদাসীনের বারান্দার চেয়ারগুলির উপর রোজই সকাল বেলায় যে—সব মানুষকে বসে থাকতে দেখা যায়, তারা সবাই মক্কেল। মাঝে মাঝে সন্ধ্যাবেলাতেও দু’চারজনের সমাগম দেখা যায়।
কিন্তু আজ সন্ধ্যায় উদাসীনের ফটক পার হয়ে, দু’চোখে কেমন একটা উৎসাহের দৃষ্টি নিয়ে, আর আস্তে আস্তে হেঁটে এসে উদাসীনের বারান্দার উপর দাঁড়ালো যে মানুষটা, তাকে দেখলেই বোঝা যায়, মোটেই মক্কেল মানুষ নয়। তবে কে কিসের জন্যই বা এসেছে?
চারুবাবু বাড়িতে নেই। কুসুম ঘোষও নেই। উদাসীনের বাপ-মা দু’জনেই বেড়াতে বের হয়েছেন। বীরু-নীরুও সঙ্গে গিয়েছে। বাড়িতে আছে শুধু যূথিকা। যূথিকাকে আজ সকাল থেকে বিকালের মধ্যে অনেকবার হাঁচতে আর কাশতে দেখা গিয়েছে; একটু টেম্পারেচারও হয়েছে। কুসুম বলেছেন, সাবধান যুথি! তুমি আজ জানালার কাছেও দাড়াবে না, বেড়াতে যাওয় তো দূরের কথা।
উপর তলার সেই ঘর; যেটা যূথিকা ঘোষের পড়ার ঘর; তারই ভিতরে একটা চেয়ারের উপর বসে উলের মাফলার গলায় জড়াতে জড়াতে হঠাৎ চোখে পড়ে যূথিকার, ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলো একটা মানুষ, যে মানুষকে মক্কেল বলে মনে হয় না। হিমাদ্রি গোছের একটা মানুষ বলে মনে হয়। বয়সের দিক দিয়েও প্রায় হিমাদ্রিরই মত। গায়ের জামা-কাপড়ের চেহারাও প্রায় সেই রকমের। খয়েরী রঙের একটা আধা—আস্তিন পাঞ্জাবি, কেজো মানুষে মত মালকোঁচা দিয়ে পরা ধুতি; ধুতিটা অবশ্য ময়লা নয়। হিমাদ্রিরও ময়লা ধুতি পরা অভ্যাস নয়। সাদা রবারের জুতো না হলেও আগন্তুকের পায়ে সাদাটে এক জোড়া চামড়ার চটি দেখা যায়। কি আশ্চর্য, ভদ্রলোককে দেখলে হিমাদ্রিরই কথা মনে পড়ে যায়।
উদাসীনের যে মেয়েকে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে গায়ে ঠাণ্ডা লাগাতে নিষেধ করে গিয়েছেন উদাসীনের মা, সেই মেয়ে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে; জানালার কাছে গিয়ে একবার দাড়ায়। তার পরেই উপরতলা থেকে তরতর করে নেমে এসে একেবারে বারান্দায় এসে দাড়ায়, যেখানে সারি সারি টবের ফুলগাছগুলিকে দুলিয়ে দিয়ে ফুরফুর করছে অফুরান ঠাণ্ডা হাওয়া।
—কাকে চান?
যূথিকার প্রশ্ন শুনে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় আগন্তুক, যুবক। এবং উত্তর দেয়—আমি চারুবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
—বাবা এখন বাড়িতে নেই।
– তাহলে…. আচ্ছা তাহ’লে আর একদিন আসবো।
চলে যাবার জন্য তৈরী হয় যুবক ভদ্রলোক। দেখতে পায় যূথিকা, ভদ্রলোকের হাতে ছোট একটা খাতা আর রসিদ—বইয়ের মত দেখতে একটা বই।
— আপনি নিশ্চয় কোন দরকারী কাজে এসেছিলেন? প্রশ্ন করে যূথিকা।
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—তাহ’লে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন না কেন? বাবা বড় জোর আর আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে পড়বেন।
যুবক ভদ্রলোক বেশ খুশি হয়ে, এবং যেন একটু কৃতার্থ ভাবে বলে— আজ্ঞে হ্যাঁ, আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে আমার কোন অসুবিধা নেই ৷
—তাহলে বসুন।
যুবক ভদ্রলোক আবার চেয়ারে বসে; কিন্তু যূথিকা ঘোষ চলে যায় না। বরং, অদ্ভুত এক কৌতূহলের আবেগে বাচাল হয়ে ওঠে।—কিছু মনে করবেন না, যদি একটা প্রশ্ন করি।
—বলুন।
—বাবার কাছে আপনার কিসের কাজ?
—চাঁদা চাইতে এসেছি।
—কিসের চাঁদা?
—রিলিফের কাজের জন্য।
যূথিকা বোকার মত তাকায়। তার মানে?
যুবক ভদ্রলোক বলে — বাংলা দেশে একটা বন্যা হয়ে গিয়েছে। প্রায় দু’ লাখ মানুষের ঘর ভেসে গিয়েছে। ঘর ভেসে গিয়েছে। ক্ষেতের সব ধান পচে গিয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছেন বোধহয়…।
যূথিকা — খবরের কাগজ আমি পড়ি না।
—যাই হোক, দেশের সব বড়—বড় নেতা সাহায্যের জন্য আবেদন করেছেন। একটা রিলিফ কমিটিও হয়েছে।
— ঠিক বুঝলাম না।
—বন্যার জন্যে যে-সব লোক কষ্টে পড়েছে তাদের সাহায্য করবার জন্য রিলিফ কমিটিকে অনেকেই টাকা পাঠাচ্ছেন। আমরাও ঠিক করেছি, চাঁদা করে আমাদের গিরিডি থেকে অন্তত শ’ পাঁচেক টাকা রিলিফ কমিটিকে পাঠাবো।
—আপনারা কারা?
—আমরা এখানেই চাকরি-বাকরি করি।
—তাই বলুন। হাঁপ ছাড়ে ঘুধিকা ঘোষ। এতক্ষণ ধরে ভদ্রলোকের কথাগুলিকে একটা রহস্যের মত মনে হচ্ছিল, এবং কিছু বুঝতে পারা যাচ্ছিল না।
বারকয়েক এদিকে—ওদিকে পায়চারি করে, আর গলার শিথিল মাফলার ভাল করে জড়িয়ে, আবার আচমকা প্রশ্ন করে উঠে যূথিকা—কত টাকা পেলে আপনি খুশি হবেন?
যুবক ভদ্রলোক হেসে ফেলে—আপনারা খুশি হয়ে যা দেবেন, তাতেই খুশি হব।
যূথিকা —দশ টাকা?
—হ্যাঁ।
—বেশ; তাহলে…
যূথিকার কথা শেষ না হতেই উদাসীনের ফটকের কাছে মোটর গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যায়। বেড়িয়ে ফিরেছেন চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষ, এবং বীরু ও নীরু।
বীরু—নীরু দৌড়তে দৌড়তে ছুটে এসেই বাড়ির ভিতর চলে যায়। এবং চারু ঘোষ ও কুসুম ঘোষ আস্তে আস্তে হেঁটে বারান্দার উপরে উঠেই চমকে ওঠেন।
যুবক ভদ্রলোকও ব্যস্তভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাড়ায়।— আপনারই কাছে এসেছি।
—হেতু? চারু ঘোষের গলার স্বর একটা গম্ভীর বিরক্তির শব্দের মত বেজে উঠে।
—আপনি নিশ্চয় জানেন বাংলা দেশে যে বন্যা হয়েছে…
—জানি, কিন্তু সেকথা জানাবার জন্য তোমার এখানে আসবার কি দরকার বুঝতে পারছি না।
—রিলিফ কমিটিতে কিছু টাকা পাঠাতে হবে। সেইজন্য আপনার কাছে কিছু চাঁদা চাই।
—নো চাঁদা। দেয়ার ইউ স্টপ।
—আজ্ঞে?
—আমি চাঁদা দেব না।
—যে আজ্ঞে। আমি চলে যাচ্ছি।
যুবক ভদ্রলোক তখনি চলে যেত নিশ্চয়; কিন্তু যূথিকা হঠাৎ বলে ওঠে।—আমি যে ভদ্রলোককে কথা দিয়ে ফেলেছি বাবা।
যূথিকার মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে চারু ঘোষের চোখ দুটো যেন চমকে ওঠে।—কি কথা?
যূথিকা— দশ টাকা চাঁদা প্রমিস করেছি। সেই জন্য উনি অনেকক্ষণ ধরে এখানে বসে আছেন।
—কতক্ষণ ধরে?
—আধ ঘণ্টা হবে?
চুপ করে কিছুক্ষণ ধরে আনমনার মত কি যেন ভাবেন চারু ঘোষ। তারপর কুসুম ঘোষের হতভম্ব মুখটার দিকে তাকান। ছোট একটা ভ্রুকুটির ছায়াও চারু ঘোষের চোখের উপর সিরসির করে কাপে। তারপরেই পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে যুবক ভদ্রলোকের হাতের দিকে এগিয়ে দেন চারু ঘোষ।
তাড়াতাড়ি পেন্সিল চালিয়ে খস খস করে একটা রসিদ লিখে চারু ঘোষের হাতের উপর ফেলে দিয়ে, আর দশ টাকার নোটটা হাতে নিয়ে চলে যায় যুবক ভদ্রলোক। দেখলে মনে হয়, হ্যাঁ, লোকটা এই প্রকাণ্ড উদাসীনকে অপমান করবার আনন্দে তৃপ্ত হয়ে ছুটতে ছুটতে পালিয়ে যাচ্ছে।
কুসুম বলেন—এ কি কাণ্ড যুথি? আবার এরকমের একটা নোংরা কাণ্ড কেন করলে তুমি?
যূথিকা হাসে—রাগ করছো কেন?
কুসুম চেঁচিয়ে ওঠেন—তোমাকে চড় মারা উচিত ছিল। কোথাকার কে না কে, যেমন চেহারা তেমনি আক্কেল, তাকে ইচ্ছে করে তুমি এই বাড়ির চেয়ারে আধ ঘণ্টা ধরে বসিয়ে রেখেছে?
চারু ঘোষের গম্ভীর স্বর আরও তপ্ত হয়ে ওঠে। আমার প্রশ্ন, তুমি লোকটার সঙ্গে কথা বললে কেন?
কুসুম—তোমার জন্যে যে ওকে আজ একটা বাজে লোকের কাছে অপমানিত হতে হলো, এটুকু বুঝতে পারলে কি মুখ্য মেয়ে?
যূথিকা ফ্যালফ্যাল করে তাকায়—অপমানিত?
কুসুম—হ্যাঁ। তুমি লোকটাকে চাঁদা প্রমিস করে বসে আছ বলেই না উনি বাধ্য হয়ে,… ছি ছি, লোকটা এখন বোধহয় মুখ টিপে হাসছে।
চারু ঘোষ—আমাকে জীবনে কোনদিন আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরকম বাজে কাজ করতে হয়নি। দশ টাকা গেল, টাকা কোন কথা নয়। কথা হলো, আমার প্রিন্সিপল নষ্ট করতে হলো। চ্যারিটি করে পৃথিবীতে ভিখিরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা আমার নীতি নয়।
কুসুম—সে যাই হোক্, কিন্তু তোমার মেয়ের মনের চাল-চলন ভিখিরী-ভিখিরী হয়ে যাবে কেন? বাজে লোকের সঙ্গে আধঘণ্টা ধরে কথা বলতে ওর প্রেস্টিজে বাধে না কেন?
চারুবাবু এইবার একটু শান্তস্বরে উপদেশ দেন।—আশা করি, অপরিচিত কোন লোকের সঙ্গে কোনদিন বেশি কথা বলবে না যূথিকা। ভদ্রতা করতে হবে না, অভদ্রতাও করতে হবে না। শুধু একটি কথায় হ্যাঁ বা না বলে বিদায় করে দেবে।
যূথিকার মুখটাকে অনুতপ্তের মুখের মত একটা করুণ মুখ বলে মনে হয়। বোধহয় ভুল বুঝতে পেরেছে যূথিকা; আর উদাসীনের বাপ-মা’কে এভাবে বিব্রত ও বিরক্ত ক’রে মনে মনে একটু লজ্জিতও হয়েছে। যূথিকা বলে— আচ্ছা! উদাসীনের বাপ-মা’র উপদেশ স্বীকার করে নিয়ে কাশতে থাকে যূথিকা।
কুসুমের চোখের দৃষ্টি এইবার একটু মায়াময় হয়ে ওঠে।— ছিঃ, দেখ তো, ঠাণ্ডা লাগিয়ে কাশিটাকে আবার বাড়িয়ে তুললি। …যা বলি, তোর ভালর জন্যেই বলি।
এই ঘটনারই মাত্র পাঁচটা দিন পরের একটি ঘটনা। সেদিন যূথিকা ঘোষের গলাতে কাশির খক্-খক্ শব্দের উপদ্রব ছিল না।
ঠিক আজকেরই মত সেদিনও উদাসীনের বাপ-মা আর বীরু-নীরু বাড়িতে ছিল না। কিন্তু বেলাটা সন্ধ্যা নয়, সকাল। বই হাতে নিয়ে ফিজিক্সের ফরমুলা মুখস্থ করতে করতে যখন নীচের তলাতেই বাড়ির বাইরের বারান্দায় পাইচারি করছিল যূথিকা ঘোষ, তখন একজন অপরিচিত ব্যক্তি উদাসীনের ফটক পার হয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে আসতে থাকেন।
আরও দেখতে পেয়েছে যূথিকা, ভদ্রলোক মোটর গাড়িতে এসেছেন। ফটকের সামনে রাস্তার উপরেই গাড়িটা দাড়িয়ে আছে।
মোটর গাড়ির সম্পর্কে যূথিকা ঘোষের মনেও বেশ একটা শখের কৌতূহল আর গবেষণা আছে। এ ব্যাপারে বীরু-নীরুর উৎসাহও যূথিকার উৎসাহের কাছে হার মেনে যায়। বীরু আর নীরু এক নিঃশ্বাসে যতগুলি গাড়ির নাম বলতে পারে; যূথিকা তার তিনগুণ বলে দেয়। ম্যাগাজিনের পাতা উল্টিয়ে নতুন ডিজাইনের গয়নার বিজ্ঞাপনী ছবির তুলনায় নতুন মডেলের গাড়ির বিজ্ঞাপনীর ছবি দেখতে বেশি ভালবাসে যূথিকা। বীরু আর নীরুও মাঝে মাঝে দিদির জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যায়। কলিয়ারির সাহেব মক্কেলদের গাড়ি এসে যখন ফটকের কাছে থামে, তখন উপরতলার ঘরের জানালার কাছে দাড়িয়ে, আগত্তক গাড়ির দিকে মাত্র একবার তাকিয়ে বলে দিতে পারে যূথিকা — ওটা নিশ্চয়ই নাইনটিন ফিফটি মডেলের বুইক্!
বীরু নীরু ছুটে যায়; এবং ফটকের কাছে গিয়ে গাড়িটাকে দেখে নিয়ে আর ফিরে এসেই আশ্চর্য হয়ে বলে— হ্যাঁ, তুমি ঠিক ধরেছ দিদি!
আগন্তুক ভদ্রলোকের গাড়িটা দেখে যূথিকার চোখে একটা নতুন রহস্যের মত বোধহয়। একেবারে অপরিচিত; কবেকার মডেল কে জানে? চকচকে ঝকঝকে গাড়িটা যে খুব দামী গাড়ি, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
ভদ্রলোকও বেশ চকচকে ও ঝকঝকে চেহারার মানুষ। দেখা মাত্র নরেনের কথা মনে পড়ে যায়। ভদ্রলোককে নরেনেরই সমান বয়সের মানুষ বলে মনে হয়। সিল্কের শার্ট আর ট্রাউজার; গলার টাই-ও সিল্কের। ভদ্রলোক যেন নরেনেরই মত, কিংবা, হতে পারে, নরেনের চেয়েও বেশি ঝকঝকে গৌরবের মানুষ।
বারান্দার উপরে উঠেই যূথিকার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে আর প্রীতিপূর্ণ উৎসাহের দৃষ্টি তুলে আগন্তুক ভদ্রলোক প্রশ্ন করেন—মিস্টার ঘোষ বাড়িতে আছেন?
যূথিকা — না।
—কখন আসবেন?
যূথিকা—বলতে পারি না।
—তাহ’লে … বলতে বলতে একটা চেয়ারের কাঁধে হাত দেন ভদ্রলোক; আর নিজেরই হাত ঘড়িটার দিকে তাকান।
—আমি তাহ’লে…। বেশ একটু বিড়ম্বিত স্বরে, আর একটু আশ্চর্য হয়ে আবার কথা বলেন আগন্তুক ভদ্রলোক। আর, যূথিকা ঘোষ তার হাতের বই—এর পাতা উলটিয়ে ফরমূলা খুঁজতে থাকে।
—আমি তাহ’লে চলি।
—হ্যাঁ।
ভদ্রলোক বারান্দা থেকে নেমে যাবার আগেই সরে গিয়ে পায়চারি করতে থাকে যূথিকা।
ফটকের কাছে গাড়ির শব্দ বেজে উঠতেই বুঝতে পারে যূথিকা; চলে গেলেন ভদ্রলোক। কিন্তু ফটকের দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পারে যূথিকা, না, ভদ্রলোকের ঝকঝকে গাড়িটা স্টার্ট নেয়নি। বাড়ির গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে। বাড়ি ফিরেছেন বাবা আর মা। আর বীরু-নীরু। এবং আগন্তুক ভদ্রলোকের সঙ্গে সবারই একেবারে মুখোমুখি দেখাও হয়ে গিয়েছে।
শুধু কি দেখা? যূথিকা ঘোষের চোখ দুটো একটু আশ্চর্য হয়ে, আর বেশ একটু ভয়ে ভয়ে বোকার মত তাকিয়ে দেখতে থাকে, বাবা আর মা যেন আগন্তুক ভদ্রলোকের পথ আটক করেছেন। ভদ্রলোককে এখনি চলে যেতে দিতে রাজি নন বাবা আর মা; তবে কি, সত্যিই কি ভদ্রলোক বাবা আর মা’র পরিচিত কোন মানুষ?
কোন সন্দেহ নেই। বারান্দাতে দাঁড়িয়েই শুনতে পায় যূথিকা, ভদ্রলোককে মাত্র পাঁচটি মিনিট বসে যেতে আর অন্তত একটি কাপ চা খেয়ে যেতে কি কাতর অনুরোধ করছেন বাবা আর মা!
কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা।—না; এক্সকিউজ মি!
ভদ্রলোকের গলার স্বর যেন একটা ব্যথিত অহংকারের সৌজন্যপূর্ণ গর্জন।
কুসুম ঘোষ অনুরোধ করেন—মাত্র পাঁচটা মিনিট বসে যাও সুমন্ত।
সুমস্ত? নামটা যেন বাবা আর মা’র মুখেই কয়েকবার শুনেছে যূথিকা ঘোষ। অনেকদিন আগে প্রায়ই এই নামটা বাবা আর মা’র মুখে শোনা যেত; আজকাল আর শোনা যায় না। ঐ ভদ্রলোক সেই সুমন্ত? বাবার এক ব্যারিস্টার বন্ধুর ভাই-পো যে সুমন্ত জার্মানী থেকে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফিরেছে আর মধ্যপ্রদেশে একটা মস্ত বড় কারখানার জেনারেল ম্যানেজার হয়েছে, যাকে অনেক দিন আগে একবার গিরিডিতে আসবার জন্য আর উদাসীনে এসে অন্তত সাতটি দিন থেকে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করেছিলেন বাবা, ঐ ভদ্রলোক কি সেই সুমন্ত? তাই তো মনে হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুমন্তের জেদই জয়ী হলো। চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষের কাতর অনুনয়গুলি একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল।
—আমার পাঁচ মিনিটেরও দাম আছে মিসেস ঘোষ। অকারণে আর অযথাস্থানে এক মিনিট সময়ও নষ্ট করতে পারি না। বলতে বলতে নিজের গাড়িতে উঠেই গাড়ি স্টার্ট করে সুমন্ত। উদাসীনের বারান্দা, উদাসীনের ফটক, আর উদাসীনের বাপ-মা’র দুটো দুঃখকাতর মুখের দিকে একটা ভ্রূক্ষেপও না করে উধাও হয়ে গেল সুমন্ত।
বিমর্ষভাবে আর ফিসফিস করে আক্ষেপের স্বরে, বোধহয় সুমন্তর এই অদ্ভুত রকমের রূঢ় ব্যবহারের কথা আলোচনা করতে করতে বারন্দার উপরে এসে দাঁড়ান চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষ। এবং যূথিকাকে দেখতে পেয়েই যেন একটা ভয়ানক বিস্ময়ের চমক লেগে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে কুসুমের চোখের চাহনি।
—সুমন্ত যে চলে গেল, তুই কি দেখতে পাসনি যূথি?
—পেয়েছি বৈকি।
—কোথায় ছিলি তুই?
—এখানেই।
—তবে কি সুমন্তের সঙ্গে তুই কোন কথাই বলিসনি?
—হ্যাঁ বলেছি; সামান্য দু’একটা কথা।
—তার মানে? সুমন্তের সঙ্গে সামান্য দু’একটা কথা কেন?
চারুবাবু বলেন—সুমন্তকে একটু বসে চা খেয়ে যাবার জন্য তুমি অনুরোধ করনি?
যূথিকা—না।
চারুবাবু—কেন?
যূথিকা—কি আশ্চর্য, আমি কি করে জানবো যে উনি সুমন্ত না শ্ৰীমন্ত? একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে গায়ে পড়ে চা খাওয়াবার জন্য অনুরোধ করতে গিয়ে শেষে কি…।
চারুবাবু—থাক, আর বলতে হবে না। তোমার চমৎকার কাণ্ডজ্ঞানের আর একটা প্রমাণ পাওয়া গেল।
কুসুম চেঁচিয়ে ওঠেন—ছি ছি ছি! এরকম অভদ্রতা তোর পক্ষে সম্ভব হলো কেমন করে বল শুনি? সুমন্ত যে নরেনের মাইনের চারগুণ মাইনে পায়। সুমন্তের তুলনায় নরেন তো বলতে গেলে একজন পেটি অফিসার মাত্র।…সুমন্তের সঙ্গে অভদ্রতা করে নিজেরই যে কি ক্ষতি করলি, তা যদি বুঝতে পারতিস তবে…।
যূথিকা—তোমরা যা খুশি বলতে পার; কিন্তু আমি কোন অভদ্রতা করিনি, ভদ্রতাও করিনি।
—তোমার কপাল করেছ! ধমক দেন কুসুম।
—আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কুসুমের ক্ষোভ শান্ত করতে চেষ্টা করেন চারু ঘোষ।
উদাসীনের বাপ আর মা যখন নীরব হয়ে ঘরের ভিতরে চলে যান, তারও অনেকক্ষণ পরে, অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর বই-এর পাতা হাতড়ে ফরমুলা খুঁজতে গিয়ে আনমনা হয়ে যায় যূথিকা।
যূথিকার অভদ্রতায় রাগ করে চলে গিয়েছে সুমন্ত; কিন্তু নরেন যদি আজ আড়ালে দাঁড়িয়ে চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষের এই সব কথা শুনতে পেত, তবে কি হতো? নরেনও কি রাগ করে চলে যেতো না?
বেশ হতো! যূথিকা ঘোষের মনটা যেন হঠাৎ কঠোর হয়ে নীরবে হেসে ওঠে। সব লেঠা চুকে যেত। মামীর কাছ থেকে এক একটা উদ্বেগের চিঠি তেড়ে আসতো না; আর যূথিকার পাটনা যাবার সব ব্যস্ততারও ইতি হয়ে যেত। তখন দেখা যেত, যূথিকার কাছে এসে নিজেদেরই ভুলের কোন কৈফিয়ৎ দিতেন চারু ঘোষ আর কুসুম ঘোষ?