৪
গর্দানিবাগের মাঠের কিনারায় পলাশের মাথা ফুলে ফুলে লাল হয়ে উঠলো যখন, তখন যূথিকা ঘোষের প্রাণটাও যেন গিরিডি ফিরে যাবার আশায় ফুলেল হয়ে ওঠে। কলেজের ছুটি হয়েছে, এবং এখন আর পাটনাতে পড়ে থাকবার দরকার নেই। কারণ, নরেন এখন আর ছুটি পাবে না, আর পাটনাতে আসতেই পারবে না। কাজেই, এখন গিরিডিতে চলে যাওয়াই ভাল।
লতিকা অনেকদিন আগেই গিরিডি চলে গিয়েছে। এবারের পাটনা-জীবনের ঘটনাগুলির ইতিহাস মনে পড়লে মনে মনে হেসে ফেলে যূথিকা। নরেনকে নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে অন্তরঙ্গ হবার জন্য কতই না চেষ্টা করেছিলেন লতিকার দাদা ডাক্তার শীতাংশু। কিন্তু যূথিকার মামী লতিকার ঐ ডাক্তার দাদার চেয়ে অনেক চালাক। যে দুটো দিন পাটনাতে ছিল নরেন, সে দুটো দিন চারবেলা নরেনকে নিমন্ত্রণ করে রেখেছিলেন মামী। লতিকার ডাক্তার দাদার নিমন্ত্রণ স্বীকার করবার সুযোগই পায়নি নরেন।
কিন্তু নরেনের মনটা একটু উদার, এবং কোমলও বটে। যূথিকার কাছেই কথায় কথায় অভিযোগ করেছিল নরেন, মামী এরকম চারবেলা ধরে একটা জবরদস্ত নেমন্তন্ন না খাওয়ালেই ভাল করতেন। শীতাংশুদা বেচারা নিজে এসে বারবার কত অনুরোধ করলেন; ওঁদের বাড়িতে গিয়ে এককাপ চা খেয়ে এলেও কত খুশি হতেন শীতাংশুদা।
যূথিকা গম্ভীর হয়ে বলেছিল—লতিকাও নিশ্চয় খুশি হতো।
নরেন—তা, খুশি হতো নিশ্চয়।
যূথিকা—গেলেই পারতে।
নরেন হাসে—যেতে পারলে ভালই ছিল, কিন্তু পারলাম কোথায়?
সব ভাল নরেনের, শুধু ওর মনের এই দুর্বলতাটা ভাল লাগে না যূথিকার। লতিকার ডাক্তার দাদা শীতাংশুবাবুর জন্য নরেনের এত বেশি শ্রদ্ধার আবেগও যূথিকা ঘোষের ভাল লাগে না।
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত জয়ি হয়েছিল মামীর চেষ্টা, এবং যূথিকার ইচ্ছা। যে দু টি দিন পাটনাতে ছিল নরেন, যূথিকার সঙ্গে চারবেলা দেখা হয়েছে। দু’দিন সন্ধ্যাবেলা দু’জনে বেড়িয়ে এসেছে। এবং দু’জনের মনের কথা দু’জনের কানের কাছে আবার নতুন করে বলে বলে অনেক মুখরতা করছে দু’জনে। কোন সন্দেহ নেই যূথিকার, নরেনের মনও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে, শুধু এ ভাবে বছরে কয়েকবার চোখের দেখা দেখে, আর যূথিকাকে শুধু দু’দিনের বেড়াবার আর গল্পশোনার সঙ্গিনীরূপে কাছে পেয়ে তারপরেই বোম্বাই চলে যেতে ভাল লাগে না নরেনের। কিন্তু এখনও তৈরি হতে পারছে না নরেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, কলকাতায় বদলি হবার সুযোগ পাওয়ার আগেই যূথিকাকে বিয়ে করে হঠাৎ অত দূরে বোম্বাই-এ নিয়ে যাওয়া উচিত হবে কিনা।
যূথিকা বলে—বিয়েটা হয়ে যাক না; বোম্বাই না হয় পরে যাব।
হেসে ফেলে নরেন—অপেক্ষা করতে কি তোমার ভয় হচ্ছে, কোন সন্দেহ হচ্ছে যূথিকা?
—ছিঃ, কি যে বল! বরং তোমার মুখে এরকমের প্রশ্ন শুনতেই আমার ভয় করে।
—তবে অপেক্ষা কর। মৃদু হাসি হেসে যূথিকাকে আশ্বাস দেয় নরেন।
কিন্তু এভাবে আশ্বস্ত হতে হতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে যূথিকার প্রাণ। মনের ভিতরে কোথায় যেন একটা কাঁটার খোঁচা খচখচ করে। ভালবেসেও শান্ত হয়ে শুধু অপেক্ষা করবার একটা ভয়ানক শক্তি যেন নরেনের আছে। লতিকাদের বাড়িতে যাবার জন্য, ডাক্তার শীতাংশুদার অনুরোধ রাখবার জন্য নরেনের মনের দুর্বলতাগুলিও যেন নরেনের একটা শক্তি। তাই যূথিকার মনটা যেন মাঝে মাঝে অবসন্ন হয়ে যায়। ভালবাসতে গিয়ে কি এভাবে কেউ হাঁপিয়ে পড়ে? এত সাবধান হতে হয় কি? বারবার এত দুর্ভাবনা নিয়ে গিরিডি থেকে ছুটে আসবার দরকার হয় কি? হারাই হারাই সদা ভয় হয়, এই বুঝি ভালবাসার লক্ষণ।
নরেনের বোম্বাই রওনা হবার দিন স্টেশনে গিয়েছিল যূথিকা। মামীও গিয়েছিলেন। আর, কি আশ্চর্য লতিকার ডাক্তার দাদাও গিয়েছিলেন। লতিকা অবশ্য যায়নি, এবং কেন যাবার সাহস হয়নি লতিকার, সেটা অনুমান করতে পারে যূথিকা। যূথিকা আছে যে! একেবারে জলজ্যান্ত যূথিকার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে নরেনের সঙ্গে কথা বলবে লতিকা, এমন সাহসী প্রাণী নয় লতিকা। যাই হোক, ডাক্তার শীতাংশুদার এসেও কোন লাভ হয়নি। ট্রেন ছাড়বার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত নরেনের সঙ্গে অনর্গল কথা বললেন মামী; শীতাংশুদা নরেনের সঙ্গে একটা কথা বলবারও সুযোগ পেলেন না।
পাটনার এই জীবনের কয়েক মাস আগের এই ইতিহাসের এক একটি ঘটনায় যূথিকা ঘোষের আশা জয়ের গর্বে ভরে উঠেছে। শুধু একবার মনে হয়েছিল, এবং মনটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, নরেনের একটা চিঠির ভাষাতে একটু অবান্তর কৌতূহলের মায়া ছিল। লিখেছিল নরেন, লতিকা বোধহয় এখন পাটনাতে আছে। যূথিকাকে চিঠি লিখতে গিয়ে লতিকার কথা মনে পড়ে নরেনের, এটা যে নরেনের মনের পক্ষে একটুও উচিত নয়; সরল মনের নরেন এটুকুও বুঝতে পারে না?
গর্দানিবাগের পলাশের লাল দেখতে আর কি-এমন সুন্দর! মধুপুর পার হলেই দু’পাশের মাঠে পলাশের মাথাগুলি এখন যে রঙীন আগুনের স্তবকের মত ফুটে রয়েছে। যূথিকাকে গিরিডি নিয়ে যাবার জন্য কবে আসবেন বলাইবাবু?
মামী এসে বললেন—গিরিডি থেকে কুসুমদির চিঠি এসেছে। বলাইবাবু আসবেন না। লিখেছেন…
মামীর হাত থেকে চিঠিটা তুলে নিয়ে যূথিকা পড়ে।—ব্যবস্থা হয়েছে, হিমুই তোমাকে গিরিডি নিয়ে আসবে। পরেশবাবুর পিসিমাকে কাশী রেখে আসতে গিয়েছে হিমু; হিমুকে বলে দেওয়া হয়েছে, টেলিগ্রাম করে তোমাকে আগেই জানিয়ে দেবে, কখন কোন্ ট্রেনে দানাপুর পৌঁছবে হিমু। মামী যেন তোমাকে বাড়ির গাড়িতে দানাপুর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
—হিমু কে? প্রশ্ন করেন মামী।
—হিমাদ্রিবাবু। হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উত্তর দেয় যূথিকা। আর, মুখের উপরেও যেন মাঠের পলাশের লাল আভাটা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ে।
—হিমাদ্রিবাবু কে? আবার প্রশ্ন করেন মামী।
—তুমি তো তাকে দেখেছো। ঐ যে, যে ভদ্রলোক এবার আমাকে গিরিডি থেকে নিয়ে এল।
—তাই বল। ছেলেটিকে দেখে বড় ভাল ছেলে বলে মনে হলো।
—ভাল বৈকি।
—ছেলেটি দেখতেও বেশ।
—তা, খারাপ কেন হবে?
—তেমন শিক্ষিত নয় বোধহয়?
—একটুও শিক্ষিত নয়। কিন্তু…
—অবস্থাও বোধহয় খারাপ।
—ঠিক জানি না, তবে গরীব মানুষ বলেই মনে হয়। কিন্তু তাতে কি আসে যায়?
মামী মুখ টিপে হাসেন—দূর পাগল মেয়ে; যার তার সম্বন্ধে ওভাবে কথা বলতে নেই।
পাটনা থেকে কতবার গিরিডি যেতে হয়েছে, কিন্তু যূথিকা ঘোষের মুখটা সে যাত্রার জন্য তৈরি হতে গিয়ে এরকম খুশিতে লালচে হয়ে উঠেছে কি কখনও? কোনদিনও না। এতদিন তো শুধু গিরিডি থেকে পাটনা ছুটে আসার পালাটাই জীবনের একটা ভাবনামধুর আর উদ্বেগসুন্দর পালা ছিল। কিন্তু গিরিডি থেকে ফিরে যাওয়ার হয়রানিটাও যে কল্পনায় মিষ্টি হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারছে কি যূথিকা?
হিমুর টেলিগ্রাম এল, আজই রাত আটটা পঁয়ত্রিশের ট্রেনে দানাপুর পৌঁছবে হিমু, এবং যূথিকা ঘোষ যেন কলকাতার টিকেট কিনে সেই ট্রেনেই ওঠবার জন্য যথাসময়ে দানাপুরে উপস্থিত থাকে।
এখন দুপুর মাত্র; অনেক সময় আছে। কিন্তু যূথিকা ঘোষের ব্যস্ততা দেখে হেসে উঠলেন মামী—মামীর বাড়িতে কি খেতে পাচ্ছিলে না যূথি, গিরিডি যাবার নাম শুনেই লাফিয়ে উঠলে কেন?
দানাপুরের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আগন্তুক আটটা পঁয়ত্রিশের ট্রেনটাকে দেখতে পেয়ে হেসে ওঠে যূথিকা ঘোষের মুখ। এবং ট্রেন থামবার পর, একটি কামরা থেকে হিমুকে নেমে আসতে দেখে সে হাসিটা আর একবার চমক দিয়ে যেন আরও সুন্দর হয়ে গেল।
ট্রেন ছাড়লো যখন, তখন কামরার একই সীটের উপর হিমুর পাশে ধপ করে বসে পড়ে যূথিকা ঘোষ, আর হাঁপ ছেড়ে বলে—আঃ, আমাকে গিরিডি নিয়ে যাবার জন্য আপনিই আবার আসবেন, আমি কোনদিন ধারনাও করতে পারিনি।
হিমু—হ্যাঁ, আমি কাশী যাচ্ছি শুনতে পেয়ে আপনার মা ডেকে পাঠালেন, আর…
যূথিকা—সব জানি, সব জানি। আজই মা’র চিঠি পেয়েছি।… যাই হোক, আমাকে কিন্তু পরের স্টেশনেই চা খাওয়াতে হবে; সেই বিকালে এক কাপ চা খেয়েছিলাম, তারপর আর… আমার ব্যাগটা ওপর থেকে একবার নামিয়ে দিন তো হিমাদ্রিবাবু, প্লীজ… আর দেখুন তো একবার… সীটের নীচে একবার উঁকি দিয়ে দেখুন না, জলের কুঁজোটা উঠেছে, না দানাপুরেই পড়ে রইল?
উঠে দাঁড়ায় হিমু, আর যূথিকা ঘোষের এতগুলি নির্দেশের ইঙ্গিতে খাটতে গিয়ে যেন তাল সামলাতে পারে না। বাঙ্কের উপরে তাকিয়ে হিমু বলে—না, জলের কুঁজো নেই। আর উবু হয়ে বসে মাথা নীচু করে সীটের নীচে তাকিয়ে বলে—কই, আপনার ব্যাগ এখানে নেই।
খিল খিল ক’রে হেসে ওঠে যূথিকা—আপনারও এরকম ভুল হয়? আপনি না খুব স্মার্ট কাজের মানুষ!
বিব্রতভাবে তাকায় হিমু—কি হলো?
যূথিকা বলে—ব্যাগটা বাঙ্কের ওপরে, আর কুঁজোটা সীটের নীচে।
লজ্জিত হয় হিমু। আবার বাঙ্কের দিকে আর সীটের নীচে তাকিয়ে নিয়ে বলে—হ্যাঁ, ঠিক সবই আছে।
যূথিকা—তবে দিন।
হিমু—কি?
যূথিকা—এক গেলাস জল।
কুঁজো থেকে গেলাসে জল ঢেলে যূথিকার হাতের কাছে এগিয়ে দেয় হিমু।
যূথিকা হাসে—আপনি খান। আপনার জন্যেই জল চেয়েছি।
হিমু একটু আশ্চর্য হয়ে তাকায়। যূথিকা বলে—আমি দেখেছি হিমাদ্রিবাবু, দানাপুর স্টেশনে আপনি জলের কলের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন…কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দিল বলে জল না খেয়েই চলে এলেন।
জল খেয়ে নিয়ে হিমু বলে—ওঃ, এরকম কাণ্ড তো সারা জীবন ক’রে আসছি। ওসব গা-সহা হয়ে গিয়েছে।
যূথিকা ঘোষের চোখ, উদাসীনের কঠোর আভিজাত্যে তৈরি দু’টি চোখ অপলক হয়ে হিমু দত্তের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। বোকা হিমু দত্তের মুখের ভাষাকে যে কবির ভাষার মত মনে হয়! তেষ্টা পায়, তেষ্টার জল দেখতে পায়, এবং ছুটেও যায় হিমু দত্ত। কিন্তু বেশি দূর এগিয়ে যাবার সৌভাগ্য হয় না। তেষ্টার বেদনা বুকে নিয়ে ছুটতে ছুটতে ফিরে যায়, নইলে ট্রেন ছেড়ে যাবে।
চারু ঘোষের মেয়ে তার নিজের মনটাকে বুঝতে চেষ্টা করে, এবং আশ্চর্যও হয়। হিমু দত্তের উপর আজ আর একটু রাগ করতে পারছে না কেন মনটা? যার উপকার সহ্য করতে করতে বিরক্ত হয়ে গিরিডি থেকে পাটনা পর্যন্ত সারাটা পথ বিশ্রীভাবে কেটেছিল, তারই কাছে আজ উপকার চাইতে ইচ্ছা করছে। হিমু দত্তকে খাটাতে ইচ্ছে করছে। এক গেলাস জল দিক, ব্যাগটা হাতে তুলে দিক। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলেই যেন নিজে নেমে গিয়ে আর নিজের হাতে চা-এর কাপ এনে যূথিকার হাতের কাছে এগিয়ে দেয় হিমু।
বোধহয় প্রায়শ্চিত্ত করছে যূথিকা ঘোষের সেদিনের অকারণ ক্ষোভে রাগে আর সন্দেহে অভিভূত মনটা। ভদ্রলোক একটু বেশি ভালমানুষ হয়েই বোধহয় জীবনের সব চেয়ে বড় অপরাধ করেছে।
যূথিকা হঠাৎ বলে—আপনি তো সবারই উপকার করেন হিমাদ্রিবাবু।
হিমু হাসে—যদি কেউ ডাকে এবং যদি আমার সাধ্যি থাকে, তবে তাকে একটু সাহায্য করি, এই মাত্র।
যূথিকা হাসে—এই জন্যেই আপনার উপকারের দাম কেউ দিল না।
হিমু—দামই যদি পেলাম, তবে উপকার করা আর হলো কোথায়?
যূথিকা—আপনার এই বাতিকের কোন অর্থ হয় না।
হিমু—হ্যাঁ, আপনার বাবা তাই বলেছিলেন বটে।
চমকে ওঠে যূথিকা, এবং যূথিকার চোখে একটা বেদনার ছায়াও দেখা যায়।
—বাবার কথা শুনে আপনি সেদিন বোধহয় খুব দুঃখিত হয়েছিলেন?
হিমু—হয়েছিলাম; কিন্তু তাতে কি আসে যায়?
যূথিকা উঠে দাড়ায়।—না, আপনার সঙ্গে তর্ক ক’রে কোন লাভ নেই। মোট কথা…
হিমু—বলুন।
যূথিকা—আমি চা খেয়েই শুয়ে পড়বো। আর, আপনি… সাবধান…
হিমুর চোখের দৃষ্টিও একটু কঠোর হয়ে ওঠে—কিসের সাবধান করছেন?
যূথিকা—আপনি আবার ঐ দরজার পাশের কোণটিতে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে, কাঠের উপর মাথা ঠুকে ঠুকে ঘুমোতে পারবেন না।
হিমুর চোখের কঠোর দৃষ্টিটা যেন হঠাৎ বিস্ময় আর লজ্জায় সব উত্তাপ হারিয়ে শান্ত হয়ে যায়। যূথিকা ঘোষের কাছ থেকে সমবেদনার মত অদ্ভুত একটা কোমল অনুভবের ধমক খেতে হবে, কল্পনা করতে পারেনি হিমু। নিজেরই রুক্ষ মেজাজের উপর রাগ হয়; এবং হাসতে চেষ্টা করে হিমু—সেদিন গাড়িতে একটুও জায়গা ছিলনা, তাই বাধ্য হয়ে…
যূথিকা—জায়গা থাকলেই বা কি? আপনি আমার কাছে থাকবেন। এখানেই বসে থাকবেন। নইলে…সত্যিই আমার ভয় করবে হিমাদ্রিবাবু।
হিমু—না না, ভয় কিসের? আপনি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ুন।
কামরার আর এক প্রান্তের সীটের উপর বসে আছেন যে প্রৌঢ়া বাঙ্গালী মহিলা, তিনি অনেকক্ষণ ধরে যূথিকা আর হিমুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বাঙ্গালী যখন, তখন যূথিকা ও হিমুর ভাষাও নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। সুতরাং, তাঁর চোখে একটা সন্দেহের দৃষ্টি জ্বলজ্বল করবে, তাতে আর আশ্চর্য কি?
যূথিকার চোখ প্রৌঢ়া বাঙ্গালী মহিলার চোখের দিকে পড়তেই হিমুর গায়ে আস্তে একটা ঠেলা দিয়ে আর মুখের হাসি চাপা দিতে চেষ্টা ক’রে যূথিকা চাপা স্বরে ডাকে—হিমাদ্রিবাবু।
—কি?
—দেখছেন তো।
—কি দেখতে বলছেন?
—আস্তে কথা বলুন। সব শুনতে পাচ্ছেন ঐ মহিলা।
—কি শুনতে পেয়েছেন?
—আমাদের কথা।
—তাতে ক্ষতি কি?
—তাতে ভয় আছে।
—কিসের ভয়?
—উনি সন্দেহ করছেন।
—কি সন্দেহ?
—আপনি কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন না?
—না।
—উনি সন্দেহ করেছেন, আমরা বোধহয় স্বামী-স্ত্রী নই।
—বাজে সন্দেহ। লজ্জিত হয়ে মাথা হেঁট করে হিমু, আর হাসতে থাকে।
যূথিকা হেসে হেসে ফিসফিস করে।—আঃ, আপনি অকারণে বেচারার ওপর রাগ করছেন। আপনার ব্যবহার দেখে আপনাকে আমার দাদা বলে কেউ মনে করবে না।
হিমু—সে তো সত্যি কথা।
যূথিকা—কোন আত্মীয় বলেও মনে করবে না।
হিমু—হ্যাঁ, তাই বা মনে করবে কেন?
যূথিকা—স্বামী বলেও মনে করবে না।
হিমু—আপনিও বড় বাজে কথা বলতে পারেন।
যূথিকা—আমি বলতে চাই, আমাকে দেখে তো কেউ আমাকে বিবাহিতা মেয়ে বলে মনে করতে পারে না।
হিমু—তা তো নিশ্চয়।
যূথিকা হাসে—তাই উনি বোধ হয় ভাবছেন যে, একটা বেহায়া মেয়ে তার ছেলেবন্ধুর সাথে কোথায় যেন সরে পড়ছে।
হিমু হাসে—আপনি মিছিমিছি মহিলাকে সন্দেহ করছেন, উনি এসব কিছুই ভাবছেন না।
যূথিকা—আপনাকে ও আমাকে যদি দুই বন্ধু বলে উনি মনে করেন, তবে কি ভুল হবে?
হিমু—না, সেটা মনে করা ভুল হবে কেন?
একটা স্টেশনে ট্রেন থেমেছে। যূথিকা ব্যস্তভাবে বলে—চা, আমার চা কই হিমাদ্রি, হিমাদ্রিবাবু।
—দেখি, অন্তত চেষ্টা করে তো দেখি। বলতে বলতে কামরা থেকে নেমে যায় হিমু। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে থাকে যূথিকা। এবং মনে মনে একটা বিক্ষোভ আগে থেকেই তৈরি করে রাখে; যদি শুধু এক পেয়ালা চা নিয়ে আসে হিমু, তবে বেশ অভদ্রভাবে দুটো কড়া কথা হিমুকে শুনিয়ে দিতে হবে। এই তোমার আক্কেল? তোমার চা কই? বন্ধুত্বের সাধারণ একটা নিয়মও জান না?
নিজের মনের এই কল্পনা নিয়ে মনে মনে হেসে রেগে কতক্ষণ নিজেকে মাতিয়ে রেখেছিল, বুঝতে পারেনি যূথিকা। ট্রেনের ইঞ্জিনটা তীব্র একটা শিস দিয়ে রাত্রির বাতাস কাঁপিয়ে দিতেই চমকে ওঠে যূথিকা। আঃ, এক কাপ চা নিয়ে আসতে এত দেরী করছে কেন হিমাদ্রি? সত্যিই তো নিজের হাতে চা-এর পেয়ালা বয়ে নিয়ে আসবার জন্য ওকে বলা হয়নি! একটা চা-ওয়ালাকে ডেকে আনলেই হয়। আর, তারপর হিমাদ্রি যদি এখানে জানালার কাছে, প্লাটফর্মের ঠিক এই জায়গাটিতে আলো-ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে চা-ওয়ালার হাত থেকে পেয়ালাটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে যূথিকার হাতের কাছে তুলে দেয়, এবং তারপর যদি নিজে এক পেয়ালা চা নিয়ে খেতে খেতে যূথিকার সঙ্গে গল্প করে, তা হলেই তো ওকে আর নিছক একটা বাতিকের মানুষ বলে অভিযোগ করতে হয় না। তাহলে মেনে নিতে হবে, বন্ধুত্ব বুঝবার মত মন ওর আছে। এবং বুঝতেও পারা যাবে যে, খুব বোকাটি নয় হিমাদ্রি, বন্ধুত্ব করবার রীতি-নীতি বেশ ভালই জানে।
দুলে উঠলো ট্রেনটা, তারপরেই চলতে শুরু করলো।
কিন্তু হিমাদ্রি? কোথায় হিমাদ্রি? জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে সারা স্টেশনের এদিকে আর ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে যূথিকা, হিমাদ্রি কোথাও নেই। লাফ ঝাঁপ দিয়ে কত যাত্রী কত কামরার দরজায় উঠে পড়লো, কিন্তু প্লাটফর্মের কোন প্রান্ত থেকে হিমাদ্রির মত দেখতে কোন ছায়ামূর্তি চলন্ত ট্রেনের এই কামরার দিকে ছুটে আসছে না।
—হিমাদ্রি! চেঁচিয়ে ডাক দেয় যূথিকা। যূথিকার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের আহ্বান চলন্ত ট্রেনের চাকার শব্দে ছিন্নভিন্ন হয়ে মিলিয়ে যায়। প্লাটফর্মের ল্যাম্পপোস্টগুলি চকিত ছবির মত যূথিকার চোখের উপরে একটা আতঙ্কের ধাঁধা রেখে দিয়ে তরতর ক’রে পার হয়ে যাচ্ছে। বেশ জোরে ছুটতে আরম্ভ করেছে ট্রেন।
—হিমাদ্রি! হিমাদ্রি! কামরার জানালা দিয়ে বাতাসে আর্তনাদ ছুঁড়তে ছুঁড়তে যূথিকার গলা ধরে যায়। নেতিয়ে পড়ে মাথাটা। আর চোখের কোণ দুটো তপ্ত হয়েই ভিজে যায়।
একি হলো? একটা তামাসা করতে গিয়ে, কে জানে কোন বিপদের মধ্যে হিমাদ্রিকে ফেলে দিয়ে চলন্ত ট্রেনটার সঙ্গে হুহু ক’রে ছুটে পালিয়ে যাচ্ছে যূথিকা ঘোষের জীবনটা!
বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, নিশ্চয় কোন না কোন কামরায় উঠে পড়েছে হিমাদ্রি। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না যূথিকা। নিশ্চয় মানুষটা স্টেশনেই কোথাও পড়ে আছে। কিন্তু পড়ে রইল কেন?
একসঙ্গে মনের ভিতরে অনেক ভয় আর অনেক সন্দেহ ছটফট করতে থাকে। এবং জানালা দিয়ে আবার বাইরের দিকে তাকিয়ে, যেন কামরার আলোর চোখটাকে আড়াল ক’রে নিজের চোখ দুটোকে অন্ধকারের গায়ে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছে যূথিকা; কি-ভয়ানক ঠাট্টা করে মানুষকে জব্দ করতে পারে হিমাদ্রি।
কতক্ষণে আর একটা স্টেশন আসবে, আর ট্রেনটা থামবে? এবং তারপরেও যদি দেখা যায় যে হিমাদ্রি এল না, তবে? সত্যিই যদি অন্য কোন কামরাতে না উঠে থাকে হিমাদ্রি, তবে?
তবে আর কি? গিরিডি পর্যন্ত ট্রেনের ভিতরে সঙ্গীহীন কয়েকটা ঘণ্টার জীবন চুপ ক’রে সহ্য করতে হবে, এই মাত্ৰ।
ধমক দিয়ে আর রাগ ক’রে নিজেকে বুঝিয়ে দিয়েও বুঝতে পারে যূথিকা, এই কয়েকটা ঘণ্টার জীবনই যে অসহ হয়ে উঠবে। পাঁচটা মিনিটও মনের শান্তি নিয়ে বসে থাকা যাবে না। টান হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়া আর স্বপ্ন দেখা তো দূরের কথা।
বাবা যখন প্রশ্ন করবেন, একলা এসেছিস মনে হচ্ছে, তখন বাবার মুখের উপর দু’কথা ভাল করে শুনিয়ে দেওয়া যাবে। হিমাদ্রিকে তোমাদের বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। এবং ভবিষ্যতে যেদিন হিমাদ্রিকে ধরতে পারা যাবে, সেদিন কৈফিয়ৎ চাইতেও অসুবিধা হবে না, এরকম একটা কাণ্ড করলে কেন? চা আনতে গিয়ে পালিয়ে গেলে কেন?
কিন্তু হিমাদ্রির জন্য কেউ যদি এসে কৈফিয়ৎ দাবি করে, কই আমাদের হিমাদ্রিকে কোথায় ফেলে রেখে তুমি একলা হেসে হেসে গিরিডিতে ফিরে এলে মেয়ে, তবে? তবে কি উত্তর দেবে যূথিকা? যদি সিঁদুর দিয়ে রাঙানো সিঁথি নিয়ে, মাথায় কাপড়টা একটু সরিয়ে দিয়ে, কুড়ি বছর বয়সের ঢলঢলে মুখটি তুলে কোন মেয়ে এসে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে—কি গো চারু ঘোষের মেয়ে, ওকে কোথায় ফেলে রেখে এলে? তুমি কি মনে করেছো ওর কেউ নেই?
সত্যিই হিমাদ্রির এরকম কেউ আছে কি? যদি থেকে থাকে, তবে সে যে তার চেখের দৃষ্টিকে জ্বলন্ত শিখার মত কাঁপিয়ে আর কেঁদে কেঁদে যূথিকা ঘোষকে অভিশাপ দেবে।—তুমি একটা খেয়ালের তামাসা করে যে সর্বনাশ করলে, সে সর্বনাশ যেন তোমারও হয়।
জানালার উপর মাথা রেখে আর বদ্ধ নিঃশ্বাসের একটা গুমোট বুকের মধ্যে নিয়ে বৃথা ঘুমোবার চেষ্টা করতে গিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনার মধ্যে ছটফট করতে থাকে যূথিকা। না, মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে বলেই বোধহয় যত অদ্ভুত কল্পনা আর চিন্তা মাথা জুড়ে লাফালাফি করছে।
সোঁ সোঁ ক’রে হাওয়া কেটে যেন উড়ে যাচ্ছে ট্রেনটা। ভয়ানক শব্দ। বোধহয় একটা নদীর পুল পার হয়ে চলে যাচ্ছে ট্রেন। যূথিকার মাথার উপর যেন ঠাণ্ডা হাওয়ার ফোয়ারা ছুটে এসে পড়ছে। ঘুম আসছে ঠিকই, ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।
তারপর আর চেষ্টা করতে বা ইচ্ছে করতে হয় না। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে যূথিকা।
যূথিকার ঘুম কেউ ভাঙ্গায়নি। ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় আরাম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়া যূথিকার কান দুটোর বধিরতার ঘোর তবু হঠাৎ ভেঙ্গে যায়। শুনতে পায় যূথিকা, ট্রেনের কামরাটা যেন কথা বলছে।
—তুমি ছিলে কোথায়? মেয়েটি এতক্ষণ কি ভয়ানক ছটফট করেছে। শেষে ঘুমিয়ে পড়েছে বেচারা।
—চা তৈরী করাতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। তা ছাড়া চা-এর দোকানটাও তো প্লাটফর্মের উপরে নয়, বেশ একটু ভেতরের দিকে। হঠাৎ ট্রেনটা ছেড়ে দিতেই দৌড়ে এসে শেষের দিকে একটা কামরায় উঠে পড়লাম।
—কি দরকার ছিল, সামান্য চা-এর জন্য এত দূরে যাবার?
—ভেবেছিলাম, তাড়াতাড়ি চা-টা পেয়ে যাব। কিন্তু…।
—তোমরা যাচ্ছ কোথায়?
—গিরিডি।
—তোমার বাড়ি গিরিডি?
—না; ঠিক আমার বাড়ি গিরিডি নয়।
—শ্বশুরবাড়ি?
—না না, সে-সব কিছু নয়।
—তোমাদের বিয়ে বোধহয় বেশি দিন হয়নি।
—না না, সে-সব কিছু নয়। আপনি খুব ভুল বুঝেছেন।
চমকে চোখ মেলে তাকায় যূথিকা, এবং বুঝতে পারে ঐ প্রৌঢ়া বাঙ্গালী মহিলা হিমাদ্রির সঙ্গে এতক্ষণ ধরে যে-কথা বলছিলেন, সেকথাই ঘুমন্ত যূথিকার স্বপ্নের ভাষা হয়ে কানের মধ্যে বেজেছে। যূথিকার পাশেই বসে আছে হিমাদ্রি। ট্রেনটা থেমে রয়েছে।
যূথিকা—ভ্রুকুটি ক’রে গম্ভীর হয়ে বলে—তুমি এরকম একটা কাণ্ড করলে কেন হিমাদ্রি?
হিমু—আপনি বিশ্বাস করুন যে…।
যূথিকা—বেশি আপনি আপনি করবে না। শুনতে বিশ্রী লাগে। তোমার বয়সের চেয়ে আমার বয়স কিছু কমই হবে।
হিমু—বেশ তো। বিশ্বাস কর; চা-ওয়ালা লোকটা সামান্য এক পেয়ালা চা তৈরী করতে এত দেরি ক’রে দিল যে ট্রেনই ছেড়ে দিল।
যূথিকা—যদি ট্রেনে উঠতে না পারতে, তবে?
হিমু বিব্রতভাবে বলে—হ্যাঁ, তাহলে তোমাকে খুবই বিপদে পড়তে হতো। তোমার বাবার কাছে আমাকে একটা কৈফিয়ৎ দিতে হতো।
যূথিকা—তোমার কেউ একজন এসে যদি আমার কাছে কৈফিয়ৎ দাবি করে বলতো, হিমাদ্রি কোথায়? তবে কি হতো? কি বলে তাকে আমি বোঝাতাম যে, আমার বিশেষ কিছু দোষ নেই?
—আমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইতে আসবে কে? কি বলছো তুমি? হাসালে তুমি।
—কেউ নেই?
—কেউ নেই; তুমি কি জান না?
—আমি জানবো কেমন করে?
—গিরিডির সকলেই তো জানে।
—তা জানুক, আমি গিরিডির সকলের মত নই। আমি কারও হাঁড়ির খবর জেনে বেড়াই না।
—যাই হোক; বলতে গিয়ে হেসে ফেলে হিমু।—আমার কৈফিয়ৎ তো শুনলে এবার বিছানাটা পেতে দিই, কেমন?
—না, থাক।
—কতক্ষণ জেগে বসে থাকবে?
—যতক্ষণ পারি।
—না না, রাত জেগে কোন লাভ নেই।
—লাভ আছে।
—কি?
—গল্প করতে পারা যাবে।
হিমু হাসে—আমার সঙ্গে গল্প করলে তোমার লাভ হবে না যূথিকা।
যূথিকার চোখ আবার গম্ভীর হয়।—তার মানে?
হিমু হাসে—আমি সত্যিই গল্প-টল্প জানি না, বলতেও পারি না যূথিকা। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা, যাদের আমি পড়াই, তারাও আমার উপর ভয়ানক রাগ করে, গল্প বলতে পারি না বলে। ভুলু একদিন বলেই ফেললো, মাস্টার মশাইটা কিচ্ছু জানে না।
যূথিকা—এই তো বেশ গল্প করতে পারছো।
প্রৌঢ়া বাঙ্গালী মহিলা উপরের আলোটার দিকে তাকিয়ে যেন রাগের সুরে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন—কি যে কাণ্ড, ছিঃ; ভগবান জানেন কি ব্যাপার!
মাথা হেঁট ক’রে মুখের হাসি লুকিয়ে এবং হাতটাকেও লুকিয়ে লুকিয়ে এগিয়ে দিয়ে হিমুর কামিজের পকেটটা ধরে টান দেয় যূথিকা। ফিস ফিস ক’রে বলে—শুনলে তো হিমাদ্রি, মহিলা কি বলছেন?
হিমু—না, ঠিক শুনতে পাইনি।
যূথিকা—মহিলা একটা সমস্যায় পড়েছেন।
হিমু—কিসের সমস্যা?
যূথিকা—উনি বুঝতে পারছেন না, কে কার সঙ্গে চলেছে। তোমার সঙ্গে আমি যাচ্ছি, না আমার সঙ্গে তুমি যাচ্ছ।
হিমু হাসে—তোমার কাণ্ড দেখে মনে হতে পারে, তোমার সঙ্গেই আমি যাচ্ছি।
যূথিকা—তার মানে, মহিলা তোমাকে একটা অপদার্থ বলে মনে করেছেন।
হিমু—অনেকেই তো তাই মনে করে, মহিলাও তাই মনে করবেন, তার আর আশ্চর্য কি?
যূথিকা—অনেকে মানে কে কে?
হিমু—তা কি আর মনে ক’রে রেখেছি? দেখেছি, অনেকেই তাই মনে করে।
যূথিকা—সেই অনেকের মধ্যে আমিও আছি বোধহয়?
হিমু—থাকলে দোষ কি?
যূথিকা কটমট ক’রে হিমাদ্রির মুখের দিকে তাকায়—ওভাবে বেঁকিয়ে কথা বলো না। ঠিক ক’রে, স্পষ্ট ক’রে বল, তোমার কি ধারণা? আমিও তোমাকে অপদার্থ বলে মনে করি?
হিমু—বললাম তো, তাতে দোষের কি আছে? মনে করলে অন্যায় কিছু হবে না।
কে বলে মাটির মানুষ? বেশ তো ক্ষোভ অভিমান আর অভিযোগের টাটকা রক্তমাংস দিয়ে তৈরী বেশ গভীর বুদ্ধির মানুষ! খুব বুঝতে পারে, খুব দেখতে পায়, আর কিছুই ভুলে যায় না; কি ভয়ানক নিখুঁত হিমাদ্রির মাটির মানুষের ছদ্মবেশটা! ইচ্ছে করলে, ওর মুখের ঐ বোকা-বোকা হাসিটাকেই ঝিক করে কটা বিদ্যুতের জ্বালায় জ্বালিয়ে দিয়ে মানুষের মুখের দিকে বেশ তো তাকাতে পারে হিমাদ্রি। মানুষের মনের কোমলতার উপর বেশ আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারে। যূথিকা ঘোষের মনের সব কৌতুক আর কৌতূহলের দুঃসাহস চমৎকার একটি নিষ্ঠুর বিদ্রূপের খোঁচা দিয়ে রক্তাক্ত ক’রে দিয়ে এখন কেমন নির্বিকার মনে নস্যির ডিবে ঠুকছে হিমাদ্রি।
যূথিকা বলে—আমিও তোমাকে এরকম একটা শক্ত কথা বলতে পারি।
হিমু হাসে—একটা কেন, অনেক বলতে পার।
যূথিকা—মিথ্যে অভিযোগের কথা নয়। সত্যি অভিযোগ।
হিমু হাসে—তোমাকে সময়মত এক পেয়ালা চা এনে দিতে পারিনি, এছাড়া আমার বিরুদ্ধে বোধহয় আর কোন অভিযোগ খুঁজে পাবে না।
যূথিকা—খুঁজে পেয়েছি।
হিমু—কি?
যূথিকা—তুমি আমাকে একটা অহঙ্কেরে মেয়ে বলে মনে কর।
হিমু হাসে—তা মনে করি, কিন্তু সেজন্য রাগ করি না নিশ্চয়।
যূথিকা—রাগ করবে কেন? তুমি যে ভয়ানক চালাক। মানুষকে ছোট ভাবতে তোমার বেশ মজা লাগে। আর।…
আনমনার মত কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থাকে যূথিকা। তারপরে গলার স্বরের একটা রুক্ষ তীব্রতাকে যেন কোনমতে চেপে রেখে আস্তে আস্তে বলে—তাই পরের উপকার ক’রে বেড়াও। ওটা মোটেই তোমার বাতিক নয়। ওটা তোমার ভয়ানক একটা অহঙ্কার। মানুষ নিজেকে কত ছোট ক’রে ফেলতে পারে, তাই দেখে মনে মনে মজা করবার জন্য অকারণ পরের উপকার করে বেড়াচ্ছ। গিরিডির কেউ তোমাকে বুঝতে পারেনি, কিন্তু আমি বুঝেছি।
হিমু—তুমি যে আমাকে আমার চেয়েও বেশি বুঝে ফেলেছো মনে হচ্ছে।
যূথিকা—আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি নিজেই জাননা যে তুমি…
হিমু—বলেই ফেল।
যূথিকা—তুমি কি ভয়ানক চালাক আর অহঙ্কারী!
এক টিপ নস্যি নিয়ে হিমু আবার হেসে উঠে—বেশ, অনেক গল্প তো হলো।
যূথিকা হাসে—এবার ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছে।
হিমু—তোমার সঙ্গে খাবার আছে নিশ্চয়?
যূথিকা—আছে। কিন্তু সে খাবার খাব না।
হিমু—কেন?
যূথিকা—কোন স্টেশনে ট্রেনটা থামুক। খাবারওয়ালার কাছ থেকে পুরি তরকারী কিনে খাবো।
হিমু—না! খবরদার না।
যূথিকা—তুমি বাধা দেবার কে?
হিমু—আমার বাধা না শুনলে কোন লাভ হবে না।
যূথিকা—তার মানে?
হিমু—আমি তোমার সঙ্গের লুচি-সন্দেশ খেতে রাজি হব না।
চমকে ওঠে যূথিকা। এবং মনে মনে সারা গিরিডির একটা অসার ধারণার আনন্দকে ধিক্কার দেয়। হিমু দত্তকে চিনতে বুঝতে আর ধরতে পারে না কেউ। ওর বুকের প্রত্যেকটা নিঃশ্বাস, ওর উদাস আনমনা ভালমানুষী চোখের প্রত্যেকটা দৃষ্টি যে চরম চালাকির লীলাখেলা। যূথিকা ঘোষের মনের গভীরের এত গোপন ইচ্ছা-টাকেও কত সহজে দেখে ফেলেছে হিমাদ্রি।
সত্যি কথা; হিমাদ্রিকে লুচি-সন্দেশ খাওয়াবার একটা ছুতো খুঁজছিল যূথিকা। কিন্তু সন্দেহ ছিল যূথিকার মনে, বাতিকের মানুষ হিমাদ্রি যূথিকার খাবারের ঝুড়ির লুচি-সন্দেশ স্পর্শ করতে রাজি হবে না। হিমুর সেই অনিচ্ছাকে জয় করবার জন্য কি কথা বলতে হবে, তা’ও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল যূথিকা। কিন্তু, তুমি না খেলে আমিও লুচি-সন্দেশ ছোঁব না, একথা বলবার সুযোগও পেল না যূথিকা। ধূর্ত হিমু দত্ত মানুষের মনের একটা সদিচ্ছাকে, একটা সৌজন্যের আগ্রহকেও কি ভয়ানক আঘাত দিয়ে ব্যথা দিতে জানে।
কিন্তু হিমাদ্রির বুদ্ধির কাছে কি হার মানবে চারু ঘোষের মেয়ে যূথিকা ঘোষ?
যূথিকা বলে—তুমি যদি সত্যিই বাধা দিয়ে আমাকে পুরি-তরকারী খেতে না দাও, তবে মনে রেখ, আমার খাওয়াই হবে না।
হিমু—কেন? তোমার সঙ্গেই তো ভাল খাবার আছে।
যূথিকা—হ্যাঁ আছে। তেমনই থাকবে।
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—তার মানে, তুমি যদি সেবারের জার্নির সময় আমার একটা ভুলের কথা ভুলতে না পেরে, শুধু একটা প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছায়…
হিমু হাসে—তুমিও তো মানুষের ভুলের খুঁটিনাটি ধরতে কম যাও না! যাও, আমি তর্ক করতে চাই না।
তর্ক ছেড়ে দিয়ে যূথিকাও হাসে, এবং সে হাসির মধ্যে বোধহয় বিজয়িনীর মনের মত একটা সুখী মনের গর্বও হাসে।—খাবার খাওয়ার পালা একটু পরে শুরু হলেই ভাল হয়; এখন গল্পের পালা থামিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কি বল হিমাদ্রি?
হেসে হেসে গল্প করবার আনন্দও অবান্তর কোন প্রশ্নের আঘাতে এলোমেলো হয়ে যায় না। কথায় কথায় শুধু একটি প্রশ্নকে কয়েকবার টেনে নিয়ে এসে শেষে শান্ত হয়ে যায় যূথিকা।
—তোমার কেউ নেই, এটা কি একটা কথা হলো? একথার কোন মানে হয় না হিমাদ্রি।
হিমু—মানে হোক বা না হোক, কথাটা সত্যি।
যূথিকা—তুমি আমার কথাটাই বুঝতে পারনি।
আশ্চর্য হয় হিমু। না বোঝবার কি আছে? অনেক কথাই তো জিজ্ঞাসা করেছে যূথিকা, যে-কথা হিমুর গিরিডি-জীবনের এক বছরের মধ্যে কোন মানুষ হিমুকে জিজ্ঞাসা করেনি। যূথিকায় ছোট ছোট এক একটা সরল প্রশ্নের উত্তরে হিমুও সরল ভাষায় উত্তর দিয়ে দিতে পেরেছে; হ্যাঁ, বাবা-মা দুজনের কেউ এখন আর বেঁচে নেই। দেশের বাড়ি অনেকদিন আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ভাই-বোন কেউ নেই; চাকরির চেষ্টা করতে করতে সেই ডিব্ৰুগড় থেকে হঠাৎ এই গিরিডিতে এসে পড়া, এই তো ব্যাপার। দেখা যাক, আবার কোনদিকে ভেসে পড়তে হয়।
যূথিকা হেসে ফেলে—সব বলেও একটি কথা বোধহয় বলতে পারলে না হিমাদ্রি। বোধহয় বলতে তোমার লজ্জা করছে।
হিমু—আর কি বলবো বুঝতে পারছি না।
যূথিকা—এমন কেউ একজন তো থাকতে পারে, যে তোমাকে ভেসে পড়তে দিতে চায় না; ধরে রাখতে চায়।
হিমু—তার মানে?
যূথিকা—বিয়ে করনি?
হিমু হো হো ক’রে হেসে ওঠে।—এত কথা শোনার পর তোমার মনে এরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন দেখা দিল, কি আশ্চর্য?
যূথিকা — বুঝলাম, বিয়ে করনি। কিন্তু…কিন্তু তাতেও প্রমাণ হয় না যে, তোমার কেউ নেই।
হিমু বিরক্ত হয়ে বলে—না নেই। আমি পাগল নই, আমার ওসব অদ্ভুত শখ থাকতে পারে না।
যূথিকাও যেন অদ্ভুত এক জেদের আবেগে আরও জোর দিয়ে বলে—তুমি পাগল নাই বা হলে, কিন্তু গিরিডিতে অন্তত একটা পাগল মেয়ে তো থাকতে পারে; তোমার অদ্ভুত শখ না থাক, অন্য কারও তো থাকতে পারে। সে তোমাকে ভেসে পড়তে দিতে রাজি হবে কেন?
হিমু—না, এরকমও কেউ নেই।
যূথিকা—কেন নেই?
হেসে ফেলে হিমু—ঠাট্টা করবার আর গল্প করবার কিছু না থাকলেও এসব কথা বলতে হয় না।
যূথিকা—তোমাকে যদি ভয় করতাম, তবে নিশ্চয়ই এসব কথা জিজ্ঞাসা করতাম না।
যূথিকার মুখের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে যায় হিমু। ভয় করে না যূথিকা, কিন্তু ভয় করে না বলেই কি এত ঠাট্টা করতে হয়? চারু ঘোষের মেয়ের মাথার মধ্যে একরকমের পাগলামির পোকা আছে বোধহয়।
কিন্তু, মনটাকে এত গম্ভীর করে রেখেও বুঝতে পারে হিমু দত্ত, যূথিকার প্রশ্নগুলি যেন হিমু দত্তের জীবনের উপর মানুষের মায়ার প্রথম অভিনন্দন। যেকথা কেউ জিজ্ঞাসা করেনি, সে-কথা জিজ্ঞাসা করেছে চারু ঘোষেরই অহঙ্কারী মেয়ে; আপন বলতে কেউ আছে কিনা হিমু দত্তের। আর কটা কথা মনে পড়ে, এই তো সেই যূথিকা ঘোষ; যে মেয়ে হিমাদ্রিবাবু বলে প্রথম ডেকেছিল। সে ডাকের পিছনেও একটা ঠাট্টা ছিল নিশ্চয়; কিন্তু তবু তো ডেকেছিল। এবং শুনতে খারাপও লাগেনি।
কি-যেন বলেছে যূথিকা। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে হিমু—কি বললে?
যূথিকা—তোমাকে বন্ধু বলে ভাবতে সত্যিই আর ভয় করে না।
হিমুর গম্ভীর মুখ যেন হঠাৎ ভয়ের চমক লেগে কেঁপে ওঠে। —বন্ধু?
যূথিকা—হ্যাঁ। তোমাকে কি একটা পূজনীয় গুরুজন বলে মনে করবো ভেবেছ?
হিমু হেসে ফেলে—কিন্তু ভয় করবার কথা বলছো কেন?
যূথিকা—ভয় করে না বলেছি।
হিমু—কেন?
যূথিকা খিল খিল করে হেসে ওঠে—তোমার মত একটা একলা অপদার্থ মানুষকে ভয় করবো কেন?
আস্তে একবার চমকে ওঠে হিমু, তারপরেই অন্যদিকে মুখ ফেরায়।
অনেক রাত হয়েছে। আর বেশি গল্প করলে রাতটা যে চোখের উপরেই ভোর হয়ে যাবে।
হিমু বলে—তুমি এবার শুয়ে পড় যূথিকা।
যূথিকা ক্লান্তভাবে বলে—হ্যাঁ।
বাঙ্কের উপর থেকে বেডিং-টা টেনে নামিয়ে সীটের উপর পেতে দেয় হিমু।
যূথিকা বলে—তুমি এই সতরঞ্চিটা ঐ সীটের উপর পেতে ঘুমিয়ে পড় লক্ষ্মীটি। সেবারের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাটা পথ কষ্ট ক’রে…
হিমু বলে—না না, কষ্ট করবো কেন? সেবার কামরাতে জায়গাই ছিল না; তাই বাধ্য হয়ে…
যূথিকা—আর একটা কথা।
হিমু—কি?
যূথিকা আস্তে আস্তে বলে—তুমি আমার গায়ের উপর চাদর-টাদর মেলে দিতে চেষ্টা করো না। কেমন?
হিমু—আচ্ছা।
যূথিকা—কিছু মনে করলে না তো?
হিমু—না।
যূথিকা—মহিলা হয়তো একটা বাজে সন্দেহ করে বসবেন সেই জন্যেই বলছি।
হিমু—হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।