৩
মধুপুরে ট্রেন থামবার পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে কামরার ভিতরেই বসে থাকতে হয়, কারণ কুলিগুলো ছুটে আসে না। আসতে দেরি করছে। সেই ফাঁকে কিছুক্ষণের জন্য গণেশবাবুর স্ত্রীর কথা, সেই সঙ্গে গণেশবাবুর বাড়ির আরও অনেক কথা ভাবতে হয়। কারণ হিমু দত্তেরই ঐ গায়ে-পড়ে প্রশ্ন করবার রকম দেখে যূথিকার মনে পড়ে যায়, ঠিক এই রকমই গায়ে-পড়ে কথা বলবার আর প্রশ্ন করবার একটা বিশ্রী অভ্যাস আছে গণেশবাবুর স্ত্রীর, অর্থাৎ রমা মাসিমার।
উদাসীনের মেয়ে কারও উপকার নেয় না, নিতে চায় না। চারু-বাবুর জীবনের সেই দার্শনিক আদর্শটা তাঁর মেয়ের জীবনেও কম সত্য হয়ে ওঠেনি। গায়ে-পড়ে কারও সঙ্গে কথা বলে না যূথিকা; কেউ গায়ে-পড়ে কথা বলতে এলে বিরক্ত হয়। গণেশবাবুর স্ত্রী একদিন একরকম গায়ে পড়েই, অর্থাৎ নিজের ম্যালেরিয়ার গল্প বলতে বলতে হঠাৎ যূথিকাকে প্রশ্ন করেছিলেন—তোমার বয়স কত হলো যূথি?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে যূথিকা প্রশ্ন করেছিল—রোজ দশ গ্রেণ ক’রে কুইনিন খাবার পর কি হলো বলুন। সারলো কি আপনার ম্যালেরিয়া?
উদাসীনের কোন মানুষ ভুলেও গণেশবাবুর বাড়িতে যায় না। কিন্তু ওরা আসে উদাসীনে; গণেশবাবু, রমা মাসিমা ও লতিকা। এবং এসেই গায়ে-পড়ে যত গল্প আর প্রশ্ন ক’রে চলে যাওয়া ওদের একটা ধর্ম যেন।
রমা মাসিমা’র উপর রাগ করতে করতে যূথিকা ঘোষের মনটা আর একজনের উপর রাগান্বিত হয়ে ওঠে। রমা মাসিমার মেয়ে লতিকার উপর। সত্যিই, কেমন যেন ওরা! যেমন গণেশবাবু, তেমনি রমা মাসিমা, আর তেমনি লতিকা—বাপ মা আর মেয়ে।
গণেশবাবুর বাড়িটা উদাসীন থেকে বেশি দূরে নয়। উশ্রী থেকে বেড়িয়ে উদাসীনে ফিরতে হলে পথের উপরেই পড়ে গণেশবাবুর বাড়ি। বাড়িটার ফটকের কাছে প্রকাণ্ড একটা কাঁঠাল গাছ। একটুও রুচি নেই বাড়িটার। শিউলি নয়, করবী নয়, হাসুনাহানা নয়—কাঁঠাল। তা ছাড়া বাড়িটাও যেন কাঁঠালের কড়া গন্ধে মাখানো। ঝাঁকে ঝাঁকে লোক আসছেই আর আসছেই, আর ভনভন ক’রে চলে যাচ্ছে। ফটকটা কখনও বন্ধ থাকে না। একটা গায়ে-পড়া বাড়ি; পথের লোককে যেন ঘরের ভিতরে ঢোকাতে পারলেই ধন্য হয়ে যায়।
বারান্দার উপর চেয়ার পেতে আর খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সকাল দুপুর বিকেল সন্ধ্যা সব সময় বসে থাকেন গণেশবাবু। পথ দিয়ে কাউকে যেতে দেখলেই হাঁক দিয়ে একটা কথা না বলে ছাড়েন না।
—কোথায় চললে হে চিন্তাহরণ? ছেলের পরীক্ষার ফল কি হলো? পাশ করেছে?
—এই মালতী, তোর জেঠিমাকে আজ সন্ধ্যায় একবার আসতে বলবি তো। বলবি, কটক থেকে চিঠি এসেছে।
—কেয়া সর্দারজী, কাহাঁ চলে? মামলা ডিসমিস হো গিয়া কেয়া?
—এই ঝুরিভাজা? খবরদার যদি এদিকে আবার এসেছ। কলেরা ছড়াবার জায়গা পাওনি?
—কত দাম পড়লো ক্ষিতীশবাবু? পেঁপেগুলি পরেশনাথের নাকি?
গণেশবাবুর এইসব প্রশ্ন তবু একরকম পদে আছে। তাঁর গায়ে-পড়া প্রশ্নগুলির মধ্যে কোন মতলব নেই। কিন্তু রমা মাসিমার গায়ে-পড়া প্রশ্নগুলি যে ভয়ানক একটা মতলবের ব্যাপার; একটা তদন্ত বলা যায়। নইলে যূথিকার বয়সের খোঁজ নেবার দরকার কি? লতিকার চেয়ে যূথিকার বয়স একটু বেশি কিনা, এই তো জানতে চান রমা মাসিমা। কেন জানতে চান, তা’ও জানে যূথিকা। এবং জানে বলেই মনটা মাঝে মাঝে বড় বিশ্রী অস্বস্তিতে ভরে ওঠে। তখন রাগ হয় আর একজনের উপর, যার চোখের সামনে দাঁড়াবার জন্য গিরিডি থেকে পাটনা ছুটে চলেছে যূথিকা। নরেনও যে লতিকাকে চেনে, এবং লতিকার সঙ্গে কয়েকবার দেখা হয়েছে আলাপও হয়েছে নরেনের।
পাটনাতে থাকবার কোন দরকার হয় না লতিকার। কারণ পড়া ছেড়েই দিয়েছে লতিকা। তবু বছরের মধ্যে প্রায় ছ’মাস পাটনাতেই থাকে লতিকা। বছরে প্রায় আট-দশবার পাটনা থেকে গিরিডি আর গিরিডি থেকে পাটনা করছে। লতিকার বড়দা পাটনাতেই থাকে আর ডাক্তারী করে।
কোন দরকার নেই তবু বারবার গিরিডি থেকে পাটনা যাওয়া আর পাটনাতে থাকা যেন দরকার হয়েছে লতিকার জীবনে, সন্দেহ করতে আর বুঝতে কি কোন অসুবিধা আছে যূথিকার? একটুও না। যূথিকার মা বুঝেছেন, চারুবাবুও বুঝেছেন এবং পাটনার মামীও বুঝেছেন।
পাটনার মামীই অনেকবার স্পষ্ট করে যূথিকার মাকে লিখেছেন—কোন সন্দেহ নেই কুসুমদি, আপনাদের পড়শী গণেশবাবু আপনাদের শত্রু হয়ে উঠেছে। গণেশবাবুর স্ত্রীটি আরও সাংঘাতিক বলে মনে হচ্ছে। সে বস্তুটি নিজে পাটনাতে এসে গর্দানিবাগে নরেনের বাড়ি গিয়ে নরেনের সঙ্গে আলাপ করে এসেছে। লতিকার সঙ্গে নরেনের বিয়ে দেবার জন্য ওরা কি-ভয়ানক উঠে পড়ে লেগেছে, আপনি ধারণা করতে পারবেন না।
সাধ্যি কি লতিকার? সব খবর জেনেও মনে মনে হাসে যূথিকা। যেমন নরেনকে, তেমনি নরেনের মনের ইচ্ছাকেও চেনে যূথিকা! সেখানে ঘেঁষবার সাধ্যি কারও নেই। লতিকার ডাক্তার দাদা নরেনকে তোষামোদ করে যত নিমন্ত্রণই করুক না কেন, আর লতিকা যতই স্টাইল করে সেজে নরেনের চোখের সামনে এসে হেসে হেসে কথা বলুক না কেন?
তবু একটা অস্বস্তি। লতিকা যে এখন পাটনাতেই আছে। নরেনও পাটনাতে আছে। ভাবতে গিয়ে যূথিকা ঘোষের মনের সঙ্গে শরীরটাও যেন ছটফট ক’রে ওঠে।
—অ্যা, কি ব্যাপার? সামনের পৃথিবীটাকে এতক্ষণে চোখে পড়েছে, তাই প্রশ্ন করতে পেরেছে যূথিকা।
—কি বলছেন? প্রশ্ন করে হিমু।
—কুলি আসেনি এখনো?
—না।
—কেন?
—কুলিরা আজ ষ্ট্রাইক করেছে।
চমকে ওঠে যূথিকা—তাহলে, কি উপায় হবে?
—আজ্ঞে?
—জিনিসপত্র নামাবে কে, আর পাটনার গাড়িতে তুলে দেবেই বা কে? এ তো আচ্ছা বিপদ দেখছি।
স্টেশনের বাতাস একটা আগন্তুক ট্রেনের ইঞ্জিনের তীব্র চিৎকারের শব্দে চমকে ওঠে। যাত্রীর হুড়াহুড়ি শুরু হয়। পাটনা যাবার ট্রেন ইন করেছে।
চেঁচিয়ে ওঠে যূথিকা। —কি উপায় হবে হিমাদ্রিবাবু? এই ট্রেনে যদি উঠতে না পারি, তবে পাটনা গিয়ে আর লাভই বা কি৷
যূথিকা ঘোষের হতাশার বেদনা ওর উদ্বিগ্ন চোখ দুটোকে বোধহয় এখনি জলে ভরিয়ে দেবে। বড় বেশি ছলছল করে চোখ দুটো।
বাঙ্কের উপর থেকে যূথিকার বেডিং আর বাক্সটাকে হিড়হিড় করে টেনে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে হিমু দত্ত বলে— চলুন।
রাতও হয়েছে, ট্রেনে ভিড়ও খুব। ফার্স্ট ক্লাশের কামরাও যাত্রীর ভিড়ে ঠাসা।
ভিড় একটু কম, এমন কামরা খুঁজতে খুঁজতে সময়ও পার হয়ে গেল। গার্ডের আলোর সঙ্কেত জ্বলে উঠতেই তাড়াতাড়ি একটা ভিড়ে-ঠাসা কামরার ভিতরেই উঠবার চেষ্টা করতে হলো।
দুলে উঠেছে ট্রেন। জানালা দিয়ে বাক্স আর বেডিং কামরার ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে দিল হিমু; যাত্রীর ধমক খেলো হিমু দরজার হাতল ধরে কামরার ভিতরে পা এগিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো যূথিকা। তারপর পিছন থেকে হিমু দত্ত। সঙ্গে সঙ্গে চমকে ওঠে যূথিকা ঘোষ—সর্বনাশ।
—কি হলো? শান্ত হিমু দত্তও যেন চমকে উঠে প্রশ্ন করে।
নিজের একটা পা-এর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে যূথিকা ঘোষ—একটা স্যাণ্ডেল নীচে পড়ে গেল।
যূথিকা ঘোষের এক পায়ের এক পার্টি স্যাণ্ডেলের দিকে তাকায় হিমু দত্ত। সোনালী জরির কাজ করা লাল মখমলের স্যাণ্ডেল। তার পরেই মুখ ফিরিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকায় এবং সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে ওঠে হিমু—ঐ যে!
তারপর হিমু দত্তকে আর দেখতে পায় না যূথিকা। বুক দুরদুর করে যূথিকার। লোকটা সত্যিই যে জুতোটাকে আনবার জন্য নেমে পড়েছে, আর ট্রেন যে এখন বেশ গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করেছে।
কামরার ভিতরে বসবার জায়গা ছিল না। স্তব্ধ হয়ে, এক ঠায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের দোলানির সঙ্গে কাঁপতে থাকে যূথিকা। লোকটা সত্যিই আবার গাড়িতে উঠতে পারবে তো? জুতোটাকে কুড়িয়ে আনবার জন্য লোকটাকে কোন হুকুম, কোন অনুরোধ করেনি, এমন কি চোখের ইঙ্গিতেও কোন নির্দেশ দেয়নি যূথিকা। আশ্চর্য, একটু ভয়-ডরের বোধও নেই লোকটার। যূথিকার একটা খালি পায়ের দিকে তাকালো, তারপরেই একটা লাফ দিয়ে নীচে নেমে গেল।
যূথিকা ঘোষের আতঙ্কিত শরীরের কাঁপুনি, আর বুকের দুরুদুরু হঠাৎ থেমে যায়। কামরার দরজার বাইরে পা-দানির উপর একটা মূর্তি। আবার লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠতে পেরেছে লোকটা। দরজা ঠেলে কামরার ভিতরে ঢুকেই যূথিকা ঘোষের পা-এর কাছে জুতোটাকে ফেলে দিয়ে কামরার চারদিকে তাকায় হিমু দত্ত।
সত্যিই ন স্থানং তিলধারণং। হিমু চিন্তিতভাবে কামরার এদিকে আর সেদিকে তাকাতে থাকে। তাই দেখতে পায় না, চারু ঘোষের মেয়ে যূথিকা ঘোষ একটা হাঁপ ছেড়ে কি-রকম ক’রে হাসছে, আর হিমু দত্তকেই কি-একটা কথা বলতে চেষ্টা করছে।
ধন্যবাদ জানাবার চেষ্টা করছিল যূথিকা। কিন্তু লোকটা যে একবারও মুখের দিকে তাকাচ্ছেই না। ধন্যবাদ জানাবার সুযোগই পায় না যূথিকা, এবং আবার চুপ ক’রে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দোলানির সঙ্গে দুলতে থাকে৷
ফার্স্ট ক্লাসের কামরার ভিতরে জীবনে কোনদিন ঢোকেনি হিমু দত্ত। ফার্স্ট ক্লাসের মানুষগুলিকে দেখতেও বোধ হয় একটু ভয়-ভয় করে।
গাড়ির মধ্যে মহিলা ও শিশুর সংখ্যাই বেশি। সশিশু মহিলারা টান হয়ে শুয়ে আছেন, ওদের কাছে গিয়ে কোন অনুরোধ করবার সাহস পায় না হিমু দত্ত। পুরুষেরা সবাই কামরার মেজের উপর রাখা বাক্স আর বেডিং-এর উপর বসে আছেন। এঁদের অনুরোধ করবার কোন অর্থ হয় না। শুধু ঐ ট্রাউজার পরা ভদ্রলোক যদি…
অনুরোধ করলে শুনবে কি? একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, এই অবস্থাটা চোখে দেখিয়ে দিয়ে ছোট হয়ে বসতে অনুরোধ করা হয়, হয়ে বসতে এবং একটু জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি হবে কি? ভদ্রলোকের পরনে ট্রাউজার, তাই আরও হতাশ হয়ে যায় হিমু দত্ত।
দেখতে পায় যূথিকা, ট্রাউজার পরা ভদ্রলোকের কাছে গিয়ে কি-যেন বলছে হিমু দত্ত। বুঝতে পারে যূথিকা, একটু আরাম করে বসবার জন্য জায়গা খুঁজছে হিমু দত্ত।
—নো নো, সঙ্গে সঙ্গে খেঁকিয়ে ওঠেন ট্রাউজার পরা ভদ্রলোক।
হিমু বলে আমি না, আমার জন্য বলছি না।
যূথিকার দিকে চোখ পড়ে ভদ্রলোকের, এবং সেই মুহূর্তে ব্যস্ত হয়ে আধ-শোয়ানো শরীরটাকে গুটিয়ে আর পা নামিয়ে পাশে আধ-হাত পরিমাণের একটা জায়গা তৈরি করেন। তারপর সাগ্রহ স্বরে হিমুকে বলেন—আসতে বলুন এঁকে। যথেষ্ট জায়গা আছে।
যূথিকাকে এগিয়ে আসবার জন্য, এবং ট্রাউজার পরা ভদ্রলোকের পাশে খালি জায়গাটিতে বসবার জন্য হাত তুলে ইঙ্গিত করে হিমু দত্ত। যূথিকা ঘোষ একটু আশ্চর্য হয়। তারপরেই ছোট্ট একটা ভ্রুকুটি করে যূথিকা মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে আবার সেই রকমই এক ঠায় দাড়িয়ে ট্রেনের দোলানির সঙ্গে দুলতে থাকে।
মাথা নেড়ে আপত্তি করতে গিয়ে যূথিকা ঘোষের মনের ভিতরে অদ্ভুত রকমের একটা রাগের ঝাঁজও যেন তপ্ত হয়ে উঠেছে। ভুরু কুঁচকে চোখ দুটো ছোট ক’রে হিমু দত্তের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আবার মুখ ফেরায় যূথিকা। মুখটাও লালচে হয়ে ওঠে।
ট্রাউজার পরা ভদ্রলোকের এই বেহায়া উদারতার রকম দেখে রাগ করেছে কি যূথিকা? কত ব্যস্ত হয়ে, যূথিকাকে পাশে বসাবার আশায় কত খুশি হয়ে সরে বসেছেন আর জায়গা করে দিয়েছেন ভদ্রলোক। কিন্তু পরের উপকার নেওয়া পছন্দ করে না যে মেয়ে, তার পক্ষে রাগ হবারই কথা। কিন্তু, রাগ ক’রে হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকায় কেন যূথিকা? চারু ঘোষের মেয়ের মনে এ আবার কোন্ রকমের ভুল? একজন অচেনা ভদ্রলোকের গা ঘেঁষে বসবার জন্য যূথিকা ঘোষকে ইশারা করেছে হিমু দত্ত; এমন ইশারা করতে পারলো হিমু দত্ত? একটুও বাধলো না? তাই কি রাগ করেছে যূথিকা?
যূথিকা ঘোষের ধারণা আর জল্পনাগুলিকে যেন ক্ষণে ক্ষণে চমকে দিয়ে যূথিকার মনে আরও অস্বস্তি ভরে দিচ্ছে হিমু দত্ত। ধারণা করেছিল যূথিকা, ট্রাউজার পরা ভদ্রলোকের পাশে নিজের জন্য জায়গা করেছে হিমু দত্ত। সে ধারণা মিথ্যে হয়ে গেল। ধারণা করেছিল যূথিকা, ট্রাউজার পরা ভদ্রলোকের পাশে ঐ জায়গাতে যূথিকা যখন বসলোই না, তখন হিমু দত্ত নিজেই বসে পড়বে, আর মনের সুখে হাঁপ ছাড়বে। যূথিকার এই ধারণাকেও মিথ্যে করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল হিমু দত্ত।
কিন্তু কতক্ষণই বা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে হিমু দত্ত? হিমু দত্তের হাত-পা আর চোখ দুটো যেন একটুও সুস্থির হতে আর শান্ত হতে জানে না। কামরার এদিকে ওদিকে চোখ ঘুরিয়ে আবার কি-যেন দেখতে থাকে, এবং এক একজন নীরব ও গম্ভীর ভদ্রলোকের কানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে কত রকমের ভঙ্গীতে মিনতি ক’রে কি-যেন বলতে থাকে। বোধহয় হিমু দত্তের মিনতি ব্যর্থ হয়, সাড়া না পেয়ে আবার এগিয়ে এসে যূথিকা ঘোষের বাক্সটাকেই একটা টান দেয়।
যেন কামরার ভিতরে এই মানুষ ও মালপত্রের ভিড়টাকে একটু এলোমেলো ক’রে দিয়ে বাক্সটারই জন্য একটু জায়গা করতে চায় হিমু দত্ত। যাত্রী ভদ্রলোকেরা বিরক্ত হয়ে ভ্রুকুটি করেন; কেউ কেউ সতর্ক করেও দেন—একটু ভদ্রভাবে ধাক্কাধাক্কি করুন মশাই৷
হিমু বলে—কিছ্ছু না, কাউকে একটু ছোঁবও না মশাই। শুধু এই বাক্সটাকে একটু সোজা করে রাখতে দিন।
বাক্সটাকে সোজা করে পেতে বেডিংটাকে তার পাশে কাত ক’রে দাঁড় করিয়ে দেয় হিমু দত্ত। এবং তার পরেই হেসে হেসে, যেন এতক্ষণের চেষ্টার একটা সাফল্যের গৌরবে ধন্য হয়ে যূথিকার দিকে তাকিয়ে বলে—এইবার বসুন।
—কি? ভ্রুকুটি করে যূথিকা।
—বসুন।
—আমার জন্য জায়গা করলেন নাকি?
—তবে কার জন্য?
আনমনার মত কি-যেন ভাবে যূথিকা; পরের কাছ থেকে এরকমের অদ্ভুত উপকার স্বীকার করে নিতে একটা লজ্জা আছে। তা ছাড়া, সত্যি কথা, যূথিকা ঘোষের মনটাও বিশ্বাস করতে পারে না, হিমু দত্তের এই চেষ্টাগুলি কি সত্যিই বিশুদ্ধ উপকার? এর পিছনে অন্য কোন ইচ্ছা নেই? হিমু দত্তকে প্রথমে দেখে যতটা বোকা-বোকা মনে হয়েছিল, এবং এখনও দেখে যতটা সরল মনের মানুষ বলে মনে হচ্ছে, ততটা বোকা-বোকা আর ততটা সরল মনের মানুষ নয় বোধহয় হিমু দত্ত। ট্রাউজার-পরা ঐ ভদ্রলোকের মত স্পর্শলোভী না হলেও হিমু দত্তের মনটা একটু ছায়ালোভীও কি নয়? ধারণা করতে পারে যূথিকা, হিমু দত্তের অনুরোধ বিশ্বাস করে এই বাক্সের উপরে বসে পড়লে ভুল হবে। সন্দেহ হয়, হিমু দত্তও বাক্সের একদিকে একটুখানি জায়গা নিয়ে যূথিকা ঘোষের ছায়া ঘেঁষে বসে পড়বে। তখন কি আর হিমু দত্তের অভদ্রতাকে ধমকে শাসন করতে পারা যাবে? কিন্তু সহ্যই বা করা যাবে কি করে?
যূথিকা ঘোষের সতর্ক মন, হিসেবী মন, আর উদাসীনের আভিজাত্যে তৈরি কঠিন অহঙ্কেরে মনও যেন একটা চতুর কৌশল খুঁজে পায়। বাক্সটার সারা পিঠটা জুড়ে একেবারে পা ছড়িয়ে বসে, আর বেডিং-এর গায়ে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়ে যূথিকা। যূথিকার গায়ের ছায়া ঘেঁষে বসবার আর একটুও জায়গা নেই। জব্দ হোক হিমু দত্তের গোপন ইচ্ছাটা।
অনেকক্ষণ ধরে একমনে উপন্যাস পড়ে যূথিকা। কতক্ষণ পার হয়ে গেল, সেই হুঁসও বোধহয় নেই যূথিকার। কারণ সত্যিই তো উপন্যাস পড়ছে না যূথিকা। উপন্যাসের পাতার দিকে তাকিয়ে নিজেরই জীবনের এক আশার অভিসারের আনন্দ তৃপ্তি আর উল্লাসগুলিকে মনে মনে পড়ছে। এই রাত্রিটা পার হয়ে যাবার পর আর মাত্র পাঁচ-ছয় ঘণ্টা, কিংবা একটু বেশি, তার পরেই নরেনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। স্টেশনে আসবে কি নরেন? মামী তো আসবেনই, কারণ বাবা নিশ্চয় একটা জরুরী টেলিগ্ৰাম ক’রে দিয়েছেন। কিন্তু মামী কি বুদ্ধি ক’রে নরেনকে একটা খবর না দিয়ে ছাড়বেন? কাল সকালেই পাটনা পৌঁছে যাবে যূথিকা, খবর নিয়ে টেলিগ্রামটা কি এখনো পাটনায় পৌঁছে যায়নি?
জব্দ হয়েছে হিমু দত্ত। হঠাৎ দু’চোখ তুলে একেবারে স্পষ্ট ক’রে দেখতে পায় যূথিকা, বাঙ্কের একটা শেকল ধরে এক ধারে দাঁড়িয়ে আছে হিমু দত্ত। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে; আর ঘুমন্ত মাথাটা বার বার ঝুঁকে বাঙ্কের ফ্রেমের উপর পড়ে ঠুক ক’রে বেজে উঠছে।
খোলা উপন্যাস, মিথ্যা উপন্যাসটাকে বন্ধ ক’রে হাতের ঘড়ির দিকে তাকায় যূথিকা ঘোষ। রাত মন্দ হয়নি। আর ঘুম-হারানো চোখ দুটোর মধ্যেও বিশ্রী রকমের একটা অস্বস্তি যেন ছটফট করছে।
হিমু দত্তকে একটা ধমক দিতে ইচ্ছে করে। কেন? ইচ্ছেটারই উপর যেন রাগ করে যূথিকা। লোকটার একটা ডিসেন্সি বোধও নেই? কি-রকম অভদ্রভাবে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত মাথাটাকে বাঙ্কের কাঠের উপর ঠুকছে। লোকটার শরীরে কি একটু অস্বস্তিরও বোধ নেই?
তবু ভাল; এই কামরার এতগুলি ভদ্রলোক আর মহিলা তবু বুঝতে পারবে যে, যূথিকা ঘোষের সঙ্গে একটা বাজে লোক শুধু সঙ্গী হয়ে চলেছে। কোন আপনজন নয়। কোন নিকট আত্মীয়তারও সম্পর্ক নেই। হিমু দত্ত যদি যূথিকা ঘোষের পাশে বসে পড়তো, তবে এই কামরার সব মানুষের চোখ কে-জানে কেমন করে তাকাতো, আর কি বুঝতো? ঐ যে শিখ মহিলা বার বার কেমন সন্দেহভরা চোখ নিয়ে একবার যূথিকার মুখের দিকে আর একবার হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, উনিই বোধহয় কোন সন্দেহ না ক’রে একেবারে বিশ্বাস করে ফেলতেন যে, এক বাঙালী ছোকরা তার…ছিঃ, যা নয়, তাই বিশ্বাস করে ফেলতেন ঐ শিখ মহিলা।
ট্রেন থেমেছে। এটা জসিডি। বেশ কিছুক্ষণ ট্রেনটা থেমে থাকবে।। মা বলে দিয়েছেন, রাত বেশি করিস না; জসিডি পৌঁছেই খাবার খেয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিবি।
খাবারের বাক্সটাকে পাশেই দেখতে পায় যূথিকা, এবং হাত বাড়িয়ে খাবারের বাক্সটাকে কাছেও টেনে নেয়। কতগুলি লুচি আর সন্দেশ, এই তো খাবার। কিন্তু এতগুলি লুচি আর এতগুলি সন্দেশ কি জীবনে কোনদিন একসঙ্গে খেয়েছে যূথিকা? জিনিসগুলি নষ্ট হবে। অনর্থক, আদরের বেশি বাড়াবাড়ি ক’রে এত বেশি খাবার সঙ্গে দিয়েছেন মা। আশ্চর্য, মা যেন যূথিকাকে একটা ক্ষিদের রাক্ষুসী বলে মনে করেন!
না, পাটনা পৌঁছতে পৌঁছতে খাবারগুলি নিশ্চয় নষ্ট হবে না। মামীর ছেলে অরুণ আছে, মামীর মেয়ে ধীরা আছে; বাসি লুচিসন্দেশ খুশি হয়ে খাওয়ার মানুষ মামীর বাড়ীতে আরও আছে।
খাবারের বাক্সের ভিতর থেকে অয়েল পেপারের একটা ছোট করো বের করে নিয়ে তার উপর গুনে গুনে চারটে সন্দেশ আর চারটে লুচি রাখে যূথিকা। খাবারের বাক্স বন্ধ করে আবার পাশে রেখে দেয়।
ক্ষিদেও পেয়েছে বেশ। একটা সন্দেশ মুখের ভিতর ফেলতেই চমকে ওঠে যূথিকা।
—চা চাই নিশ্চয়? চেঁচিয়ে উঠেছে হিমু দত্ত।
যূথিকা ঘোষের খাওয়ার আনন্দটাকেও যেন চমকে দিয়ে, যূথিকার মনের ভিতর আবার কতগুলি বিরক্তি আর অস্বস্তি ভরে দিল হিমু দত্ত। চা চাই নিশ্চয়, কিন্তু এত চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করবার কি আছে?
কথা বলবার জন্য মুখ তুলেই দেখতে পায় যূথিকা, হিমু দত্ত নেই, প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়েছে, এবং শোনাও যায়, চেঁচিয়ে হাঁক দিচ্ছে হিমু দত্ত—এই চা-ওয়ালা ইধার আও।
চা-এর পেয়ালা নিজেই হাতে নিয়ে দরজা ঠেলে কামরার ভিতরে ঢুকলো হিমু দত্ত, এবং যূথিকা ঘোষের হাতের কাছে চা-এর পেয়ালা এগিয়ে দিল।
কোন কথা না বলে, আর হিমু দত্তের মুখের দিকেও না তাকিয়ে চা-এর পেয়ালা হাতে তুলে নেয় যূথিকা ঘোষ। চা-এর পেয়ালায় চুমুক দেয়, এবং তারপরেই কেমন যেন সন্দেহ হয়। হ্যাঁ, চোখ তুলতেই খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পায় যূথিকা, দরজার কাছেই প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে আছে হিমু দত্ত, আর, এক হাতে একটা শাল পাতার ঠোঙ্গা ধরে পুরি-তরকারি খাচ্ছে।
তিন চুমুকে চা শেষ ক’রে দিয়ে পেয়ালাটাকে পাশে রেখে দেয় যূথিকা, অয়েল পেপারের উপর এখনও চারটে লুচি আর তিনটা সন্দেশ পড়ে আছে, কিন্তু খাওয়া আর হলো না। যূথিকা ঘোষের হাতটা যেন রাগ ক’রে একেবারে ক্ষিপ্ত হয়ে খাবার শুদ্ধ অয়েল পেপারের টুকরোটাকে দলা পাকিয়ে একটা আবর্জনার মত একপাশে ফেলে রেখে দেয়। তার পরেই উপন্যাসের পাতা খুলে মনে মনে বুঝতে চেষ্টা করে, অনেক রাত হয়েছে, খাবার না খাওয়াই ভাল; কিন্তু মিছিমিছি কিসের জন্য আর কার ওপর এত রাগ হলো? চা-ওয়ালা আসে। পেয়ালা তুলে নিয়ে চলে যায়। চা-এর দামটা দিয়ে দেয় যূথিকা।
হিমু দত্ত আবার কামরার ভিতর ঢোকে। যূথিকা ঘোষ প্রশ্ন করে— আপনার পুরি-তরকারির দাম কত? ক’ আনা দিতে হয়েছে?
হিমু বলে—ছ’ আনা।
ছ’আনা পয়সা হিমুর হাতের দিকে এগিয়ে দেয় যূথিকা ঘোষ। হাত এগিয়ে দিয়ে হিমু দত্তও বেশ আগ্রহের সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে ছ’আনা পয়সা নিয়ে পকেটের ভিতর রাখে।
যূথিকা বলে—পয়সা গুনে নিন।
পকেট থেকে পয়সা বের করে আর গুনে নিয়ে হিমু বলে –ঠিক আছে।
সামান্য কয়েকটা কথা, এবং খুব অল্প কয়েকটা কথা কিন্তু এটুকু কথা বলতেই যেন হাঁপিয়ে পড়েছে যূথিকা ঘোষ, আর চোখ দুটোও জ্বলছে। এখন মনে হয়, এত অস্বস্তি ভোগ ক’রে পাটনা যাবার কোন দরকারই ছিল না। না হয়, নরেন রাগ করে বোম্বাই চলে যেত। কিন্তু হিমু দত্ত নামে এধরনের অদ্ভুত লোকের সঙ্গে একটা ঘণ্টা এক জায়গায় বসে থাকাও যে একটা শাস্তি। বড় নীচ মনের লোক। এর কাছে কোন সৌজন্য আর কোন লজ্জা আশা করা বৃথা। লোকটা একটা প্রশ্ন করতেও জানে না। লোকটা যে যূথিকা ঘোষকেই নামে-মাত্র একটা মেয়ে বলে মনে করেছে।
জসিডিতেই যাত্রীদের অনেকে নেমে গিয়েছে। একদিকের সীট একেবারে খালি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বুঝতে পারেনি যূথিকা, এরই মধ্যে কখন বেডিংটাকে টেনে নিয়ে গিয়ে লম্বা সীটের উপর পেতে ফেলেছে হিমু দত্ত।
হিমু হাসে—আঃ, এবার আর কোন অসুবিধা নেই। অনেক জায়গা। আপনি এবার টান হয়ে শুয়ে পড়ুন।
কি বিশ্রী ভাষা! যূথিকা ঘোষের মত বয়সের মেয়েকে অনায়াসে টান হয়ে শুয়ে পড়তে বলে, বলতে মুখে একটু সঙ্কোচও নেই; হিমু দত্তের ভাষা সহ্য করতে আর ইচ্ছা হয় না।
কিন্তু খোলা বেডিং-এর দিকে এগিয়ে না যেয়েও পারে না যূথিকা। সত্যিই যে টান হয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছে। এতক্ষণ কামরার ভিতরে ভিড়ের চাপের মধ্যে বাক্সটার উপর বসে ধুঁকতে ধুঁকতে শরীরে ব্যথাও ধরে গিয়েছে।
যূথিকা বলে—আমার ব্যাপার নিয়ে বেশি ব্যস্ত হবেন না। আপনি এবার একটু নিজের সুবিধা ক’রে নিন।
হিমু বলে— আমার ব্যাপার নিয়ে আপনি মিথ্যে ব্যস্ত হবেন না। আমার সুবিধা তো আমি ক’রে নিচ্ছিই।
বাস্তবিক, লোকটা একেবারে নিরেট। একটা ভাল কথারও সম্মান দিতে জানে না।
হিমু দত্তের কথা শুনলে রাগ হয়, এটাও যে যূথিকা ঘোষের মনের একটা দুর্বলতা। হিমুর মুখের একটা কথার অর্থ নিয়ে এত চিন্তা করাই ভুল। হিমুর কথার মধ্যে এক ফোটাও ঘষা-মাজা ভদ্রতা থাকবে, এটা আশা করাও ভুল। হিমুর চোখের সামনে টান হয়ে শুয়ে পড়লেই বা কি আসে যায়? যূথিকা ঘোষ রাগ করে ওর নিজেরই মনের রাগটার উপর।
কিন্তু হিমু দত্ত বসবে কোথায়? লোকটা কি এখনও দাঁড়িয়ে থাকবে বলে মনে করেছে? সন্দেহ হয় যূথিকার, আর বোধহয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দোলানির সঙ্গে দুলতে দুলতে বাঙ্কের কাঠের উপর ঘুমন্ত মাথাটাকে ঠুকে ঠুকে কষ্ট পাওয়ার ইচ্ছা নেই হিমু দত্তের; হিমু দত্তও ক্লান্ত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে সন্দেহ করতে হয়, এই সীটেরই একদিকে বসে পড়বে না তো হিমু দত্ত?
কী বিপদ! বিছানার উপর টান হয়ে শুয়ে পড়তে গিয়েও চুপ করে বসে থাকে যূথিকা। হিমু দত্তের কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভরসা করা যায় না। হয়তো যূথিকা ঘোষের পা-এর কাছেই বসে পড়বে। মাথার কাছে বসে পড়লেই বা কি? অস্বস্তির জ্বালায় যূথিকা ঘোষের শরীরটা জ্বলবে, আর ঘুমের দফা রফা হয়ে যাবে।
যূথিকা ঘোষের মন যেন শক্ত হয়ে এই সন্দেহগুলিকে একেবারে তুচ্ছ ক’রে আর মিথ্যে ক’রে দিতে চায়। বসুক না হিমু দত্ত, মাথার কাছে কিংবা পা-এর কাছে; চোরা চাউনি তুলে কিংবা হাঁ ক’রে যূথিকা ঘোষের ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে যত খুশি তাকিয়ে যা ইচ্ছা হয় ভাবুক না কেন লোকটা। রাত জেগে কাহিল হতে পারবে না যূথিকা। শুয়ে পড়তেই হবে। হিমু দত্ত এমন মানুষ নয় যে, ওর চোখের দু-একটা চোরা চাহনিকে ভয় করতে হবে। টান হয়ে শুয়ে পড়ে যূথিকা ঘোষ। হাত তুলে চোখ দুটোকে ঢাকে, যেন উপরের কড়া আলোটার ঝলক চোখে না লাগে।
এইবার যেন মনে-প্রাণে একটা ঘুম প্রার্থনা করে যূথিকা। রাতটা স্বপ্নের মধ্যে দুলতে দুলতে পার হয়ে যাক।
নরেনের সঙ্গে লতিকার কি সত্যিই দেখা হয়েছে এবার? অসম্ভব নয়। লতিকা কি নরেনকে কোনদিন চিঠি লিখেছে? অসম্ভব নয়। নরেন কি লতিকার চিঠির কোন উত্তর দিয়েছে? অসম্ভব! কিন্তু উত্তর দিলেই বা কি? লতিকাকে কি লিখতে পারে নরেন, সেটা কল্পনা করতে পারে যূথিকা। এবং নরেনের চিঠির সেই ভাষা আর সেই কথা পড়ে লতিকা ঘোষের মনে আর যে-কোন ভাবনা দেখা দিক না কেন, কোন আশা দেখা দেবে না।
শেষ যে-দিন নরেনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যূথিকার, কি কথা বলেছিল নরেন? হাতের ছায়ায় ঢাকা-পড়া যূথিকা ঘোষের চোখ-বোজা মুখটাই হেসে ওঠে। — আর বড় জোর একটা বছর দেখবো যূথিকা, দেখি কলকাতায় বদলি হতে পারি কিনা। যদি দেখি যে, কলকাতায় বদলি হবার কোন আশা নেই, তবে অগত্যা তোমাকে বোম্বাই প্রবাসিনী হতে হবে যূথিকা।
প্রশ্ন করেছিল যূথিকা — লতিকার ডাক্তার দাদা তোমাদের বাড়ি গিয়ে কিসের গল্প করে এলেন?
কোন উত্তর না দিয়ে শুধু একটু মৃদু হেসে যূথিকা ঘোষের প্রশ্নের সূক্ষ্ম সন্দেহটাকে একেবারে মিথ্যে ক’রে দিয়েছিল নরেন। সেদিনের পাটনার যত আশ্বাস, যত হাসি, যত আলো আর শব্দগুলি যেন এখানেই এসে রিমঝিম ক’রে বেজে বেজে যূথিকার মনটাকেই ঘুম পাড়াতে থাকে।
একটা ছোট স্টেশনে, কে জানে কেন, হঠাৎ থেমে গেল ট্রেনটা, এবং থামতে গিয়ে জোরে একটা ঝাঁকানি খেয়ে যাত্রীদের ক্লান্ত শরীরগুলিকে চমকেও দিলো। ঘুম ভেঙে যায় যূথিকার; ভয় পেয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসে। চোখ দুটো চমকে ওঠে।— অ্যা? একি? কোথায় গেলেন আপনি?
কিন্তু কই হিমু দত্ত? যূথিকা ঘোষের পা-এর কাছেও না, মাথার কাছেও না। দেখতে পায় যূথিকা, কামরার দরজার পাশে সেই কোণটি ঘেঁষে, কাত হয়ে দাঁড়িয়ে, কামরার কাঠের দেয়ালে হেলান দিয়ে অঘোর ঘুমের সুখে মজে আছে হিমু দত্ত।
এমন লোককে সঙ্গে রাখা আর না রাখা সমান। যদি কোন চোর জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে যূথিকার গলার হার ছিঁড়ে নিয়ে চলে যেত, তবে? হিমু দত্তের দায়িত্ববোধ তো এই, যূথিকা ঘোষকে অসহায় ক’রে কামরার একদিকে ফেলে রেখে দিয়ে, নিজে আর একদিকে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর ঘুমোচ্ছে।
কিন্তু এসব আবার কি কাণ্ড? উপরের আলোটাকে কালো কাগজে ঠোঙা দিয়ে ঢেকে দিল কে? যূথিকার গা-এর উপরের আলোয়ানটা মেলে দিল কে? তাহলে অনেকবার কাছে এসেছে, দেখেছে আর চলে গিয়েছে হিমু দত্ত। যূথিকার ঘুমের আরামটাকে বেশ ভাল ক’রে সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছে। তবু… ইচ্ছে ক’রে, বোধ হয় জোর ক’রে দূরে সরে গিয়ে একটা জেদের ভান করছে। কিন্তু কি মনে ক’রে হিমু দত্ত, যূথিকা ঘোষ একেবারে খাঁটি ভদ্রতার কায়দা অনুযায়ী ওকে কাছে বসে থাকতে অনুরোধ করবে? এবং সে অনুরোধ না করলেই একেবারে ওদিকে গিয়ে, যেন কোন সম্পর্কই নেই এইরকম একটা পোজ নিয়ে, আর শুধু নিজেকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে একটা কাণ্ড…হিমু দত্তের কাণ্ডগুলি সত্যিই অদ্ভুত। বেশ সূক্ষ্ম একটা একরোখা জেদ আছে মানুষটার।
চোখ মেলে তাকায় হিমু। ব্যস্তভাবে যূথিকার কাছে এগিয়ে আসে। আর, পকেট থেকে সোনার একটা হার বের ক’রে যূথিকার হাতের কাছে এগিয়ে দেয়—আপনার হারটা গলা থেকে খুলে পড়ে গিয়েছিল। আপনি ঘুমের ঘোরে টের পাননি।
খালি গলাটার উপর হাত বুলিয়ে, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আর হাত কাঁপিয়ে হারটাকে হিমুর হাত থেকে তুলে নিয়েই গম্ভীর হয়ে যায় যূথিকা।
ছোট একটা ধন্যবাদ জানিয়ে হিমু দত্তকে এইবার সরে যেতে বললেই তো হয়। কিন্তু ধন্যবাদের ভাষা যেন যূথিকার গলার ভিতরে আটকে গিয়েছে। তার কারণও মনের একটা অস্বস্তি, এবং যে অস্বস্তির মধ্যে একটা রাগের উত্তাপও আছে। ধন্যবাদ শুনতে চায় না, ধন্যবাদের জন্য কোন লোভই নেই, পুরস্কার দাবি করে না, শুধু উপকার করবার জন্য একটা বাতিকের ঘোরে লোকের উপকার করে, এহেন লোকের সঙ্গে কথা বলাও যে একটা সমস্যা। কি বলবে বুঝতে পারে না যূথিকা ঘোষ।
সত্যিই হারটা নিজের থেকেই গলা থেকে খুলে নীচে পড়ে গিয়েছিল তো? চারু ঘোষের মেয়ের মন মানুষকে সহজে বিশ্বাস করবার মত মনই নয়। বিনা স্বার্থে মানুষের উপকার করবার বাতিকটাও নিঃস্বার্থ বাতিক নয়। পৃথিবীর ভয়ানক চালাকেরা ভয়ানক বোকা সেজে থাকে, এ সত্যও জানা আছে যূথিকা ঘোষের। উদাসীনের খুব বিশ্বস্ত একটা চাকর ছিল, রামটহল। মনে পড়ে, রামটহলের সেই অতিসূক্ষ্ম ভালমানুষী ছলনার ঘটনাটা। হঠাৎ একদিন একটা দশ টাকার নোট হাতে নিয়ে চারুবাবুর কাছে গিয়ে বলেছিল রামটহল—এটা কিসের কাগজ, দেখুন তো বাবা, আপনার দরকারী কোন কাগজ নয় তো?
চারুবাবু আশ্চর্য হলেন, এবং ছোঁ মেরে নোটটাকে রামটহলের হাত থেকে তুলে নিয়ে বললেন – না, না, এটা একটা বাজে কাগজ; কোথায় ছিল এটা?
রামটহল—খাটের নীচে ঝাড়ু দিতে গিয়ে পেয়েছি।
হিসাবে দশটা টাকার গরমিল কোনদিন হয়নি; কোনদিন দশটাকার একটা নোট হারিয়েছে বলে মনেও পড়েনা চারুবাবুর। তবু বুঝলেন, সত্যিই ভুল হয়েছিল নিশ্চয়; ভুলক্রমে দশ টাকার একটা নোট নিশ্চয় কদিন আগে পকেটের ভিতর থেকে পড়ে গিয়ে থাকবে। যাই হোক, কিন্তু চাকরটা কী চমৎকার বেকুব; একেবারে প্রস্তর যুগের বুনো মানুষের মত নিরেট একটা মূর্খ; দশ টাকার নোট পর্যন্ত চেনে না।
তার পর থেকে চারুবাবু আদালত থেকে ফিরে এসে রোজই গায়ের কালো কোটটা খুলে রামটহলের হাতে দিতেন। রামটহলই কোটটাকে আলনার হুকে টানিয়ে রাখতো। কোটের পকেটে তাড়া তাড়া নোট থাকতো; কিন্তু কোন আশঙ্কা নেই; নিশ্চিন্ত ছিলেন চারুবাবু। ঐ নোট রামটহলের কাছে অর্থহীন কতগুলি কাগজ মাত্র।
সেই রামটহল একদিন উধাও হয়ে গেল। এবং দেখা গেল, চারুবাবুর কালো কোটটা ঠিকই আছে; কিন্তু কোটের পকেটের ভিতর দু’হাজার টাকার নোটের দুটি বাণ্ডিল নেই।
যূথিকা ঘোষের গলার সোনার হার ফিরিয়ে দেওয়া রামটহলী কৌশলের মত একটা মতলবের ব্যাপার নয় তো? ঘুমন্ত যূথিকার গলা থেকে হারটাকে নিজেই খুলে নিয়ে, তারপর এইভাবে ফিরিয়ে দিয়ে চমৎকার সাধুতার একটা কীর্তি দেখিয়ে… হিমু দত্তের এই বোকা-বোকা চোখের মধ্যে ভয়ানক চালাক কিছু লুকিয়ে নেই তো? যূথিকা ঘোষ বলে—কিন্তু ভাবতে আশ্চর্য লাগছে, হারটা খুলে পড়ে যাবে কেন?
হিমু বলে—জানি না কেন খুলে পড়ে গেল। তবে ঐ মহিলাকে জিজ্ঞাসা ক’রে দেখতে পারেন।
হিমু দত্ত সেই শিখ মহিলাকে দেখিয়ে দেয়।
যূথিকা বিরক্ত হয়ে বলে—ঐ মহিলাকে কি জিজ্ঞাসা করতে বলছেন?
হিমু—উনি দেখেছেন, আপনার গলার হারটা খুলে নীচে পড়ে গেল; উনিই আমাকে ডাক দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, হারটা নীচে পড়ে আছে।
কথা শেষ ক’রে এবং যূথিকা ঘোষের কোন কথা শোনবার আশায় না থেকে সরে যায় হিমু দত্ত। এবং সরে গিয়ে দরজার কাছে সেই কোণটিতে, সেই ভঙ্গীতে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোবার জন্য চোখ বন্ধ করে।
অনেকক্ষণ নিথর হয়ে বিছানার উপর বসে থাকে যূথিকা। সোনার হারটাকে আবার গলায় পরানো হয়নি। হাতের মুঠোর মধ্যে কুঁকড়ে পড়ে আছে ঝকঝকে সোনার হার। হারটাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সাহস হয় না। মা’র কাছে অনেক মিথ্যে কথা বলে হার হারাবার অপরাধ ঢাকতে হবে, সেই ভয়ে বোধহয় যূথিকা ঘোষের হাতটা স্তব্ধ হয়ে থাকে; নইলে হিমু দত্তের মত একটা লোকের সততার ছোঁয়ায় একেবারে নির্লজ্জ হয়েছে যে হারটা, সেটার স্পর্শ এখন যূথিকা ঘোষের শুধু হাতটাকে নয়, মনটাকেও কামড়াচ্ছে; সে হার ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারলেই ভাল ছিল।
গিরিডি থেকে রওনা হবার পর কম সময় তো পার হয়ে গেল না। কিন্তু এই ন’ঘণ্টার মধ্যে একটা মিনিটও বোধহয় মনের আরাম নিয়ে জেগে থাকবার সৌভাগ্য হয়নি যূথিকার। বিরক্ত করেছে হিমু দত্ত। বারবার জব্দ করেছে হিমু দত্ত। ভয় পাইয়ে দিয়েছে হিমু দত্ত। বারবার লোকটাকে সন্দেহ করতে হয়েছে, আর সন্দেহ করেই ঠকতে হয়েছে। ইচ্ছে করেনি তবু ওর উপকার সহ্য করতে হয়েছে।
হিমু দত্তের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল যূথিকা ঘোষ, এবং নিজেরই বোধহয় হুঁস ছিল না যে, হিমু দত্ত হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে ফেলতে পারে, এবং দেখেও ফেলতে পারে যে, চারু ঘোষের মত মানুষের মেয়ে হিমু দত্তের মত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু হিমু দত্তের চেহারাটাকে যে একটা ভয়ানক গর্বের চেহারা বলে মনে হয়। ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করবার ক্ষমতা সংসারের সব চেয়ে সাংঘাতিক নিন্দুকেরও নেই, বোধহয় এই গর্বেই মজে আছে হিমু দত্তের মন। এটাই বোধহয় ওর বাতিকের একমাত্র আনন্দ।
হিমু দত্তের এই গর্ব কি ভেঙ্গে দেওয়া যায় না? ওর কোন ভুল ধরে দেওয়া যায় না? যূথিকা ঘোষের মনের মধ্যে যে অস্বস্তি ছটফট করে, সেটা হলো একটা জেদ। হিমু দত্তকে জব্দ করবার জন্য একটা জেদ। হিমু দত্তের ব্যবহারের খুঁত ধরবার একটা প্রতিজ্ঞা।
ট্রেনটা থেমেছে। কে জানে কোন্ স্টেশন? হিমু দত্তের ঘুমন্ত চোখ সেই মুহূর্তে দপ ক’রে সতর্ক পাহারাদারের চোখের মত জেগে উঠে।
—শুনছেন। ডাক দেয় যূথিকা।
এগিয়ে আসে হিমু দত্ত।
যূথিকা বলে – আপনার তো সব দিকেই নজর আছে, খুব সাবধান আপনি। আমার কোন অসুবিধাই হতে দিচ্ছেন না। কিন্তু…
হিমু —বলুন।
যূথিকা — কিন্তু …
বলতে গিয়ে একটা শুকনো হাসি হেসে ফেলে যূথিকা, —কিন্তু আপনি জানেন না যে, আমার এখনও খাবারটুকু খাওয়ারও সুযোগ হয়নি।
—কেন? বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে হিমু।
—আপনি দেখেননি, দেখতে পাননি, দেখতে ভুলে গিয়েছেন। যূথিকার অভিযোগের ভঙ্গীটাই হঠাৎ যেন রুষ্ট হয়ে ওঠে। হেসে হেসে ঠাট্টা করতে গিয়ে অদ্ভুত একটা আক্রোশ প্রকাশ ক’রে ফেলেছে যূথিকা।
হিমু বলে—দেখেছি।
যূথিকা আশ্চর্য হয়—কি?
হিমু—আমি দেখেছি, আপনি শুধু একটা সন্দেশ খেয়ে বাকি সব খাবার কাগজে মুড়ে ফেলে রেখে দিলেন।
–কি আশ্চর্য! চমকে ওঠে যূথিকা; তারপরেই একেবারে বোবা হয়ে হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
না, হিমু দত্তের ভুল হয় না। হিমু দত্তের চোখ ভয়ানক সাবধান ও সজাগ চোখ। হিমু দত্তের একটা ত্রুটি ধরে অভিযোগ করবার আনন্দটুকুও যূথিকা ঘোষের কপালে জুটলো না। কিন্তু একটা প্রশ্ন তো করা যায়। বেশ রুক্ষস্বরে এবং প্রায় চেঁচিয়ে উঠে প্রশ্ন করে যূথিকা—চোখে দেখেও তো কিছু বললেন না।
হিমু দত্ত হাসে— বলা কি উচিত হতো?
—তার মানে? ভ্রূকুটি করে যূথিকা ঘোষ।
হিমু দত্ত আবার হাসে— বললে আপনি হয়তো ভাৰতেন যে, আমি একটা অবান্তর কথা বলে মিছিমিছি আপনাকে…
—বুঝেছি। থাক, আর বলতে হবে না। যূথিকা ঘোষ আস্তে আস্তে, ক্লান্ত ও অলস স্বরে কথাগুলি বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়, আর জানালার বাইরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকার দেখতে থাকে।
বুঝতে আর অসুবিধা নেই, একেবারে মর্মে মর্মে এইবার বুঝতে পারা গিয়েছে, হিমু দত্তের মন জড়-পদার্থ ছাড়া আর কিছু নয়। যা বলা হয় তাই শোনে, যা শোনে তাই বোঝে, যা চোখে পড়ে তাই দেখে হিমু দত্ত। নিজের থেকে কিছু শোনবার বুঝবার আর দেখবার চেষ্টা ওর মনের মধ্যেই নেই। মধুপুর স্টেশনে সেই যে শাসানি দিয়ে অবান্তর কথা বলতে নিষেধ ক’রে দিয়েছিল যূথিকা, সে শাসানি স্মরণ করে রেখেছে হিমু দত্ত। কেমন যেন চাকর-চাকর মনের একটা লোক মাত্ৰ। এহেন মানুষকে সন্দেহ ক’রে যূথিকা ঘোষ যে নিজেকেই ছোট ক’রে ফেলেছে। মনে মনে এই লজ্জা স্বীকার করে যূথিকা।
তবে ভাগ্যি ভাল, যূথিকা ঘোষের মনের এই লজ্জা পৃথিবীর কারও চোখে ধরা পড়ে যাবে না। সে ভয় নেই। এই হিমু দত্তও কল্পনা করতে পারে না যে, ওর মত মানুষকে জব্দ করবার জন্য চারু ঘোষের মেয়ের মনে একটা জেদ চেপে বসেছিল। যূথিকা ঘোষেরও এই লজ্জা ভুলে যেতে কতক্ষণ লাগবে? আর একবার টান হয়ে শুয়ে মনের সুখে একটা ঘুম দিয়ে ভোর করে দিতে পারলেই হলো।
লজ্জাই বা কিসের? একটা লোক পরের উপকার করবার বাতিকে ভুগছে; সে লোকটার উপর রাগ হওয়াই তো উচিত। তাকে সন্দেহ করাই উচিত।
আকাশে তারা নেই। তবে কি ভোর হয়ে আসছে? অন্ধকারটা ফিকে হয়েছে? তাই তো!
পাটনা পৌঁছতে এখনও বেশ দেরি আছে। এখন ঘুমিয়ে পড়লেই ভাল।
কি গভীর ঘুম! আশা করেনি, ভারতেও পারেনি যূথিকা; ট্রেনের · কামরায় একটা সীটের উপরে এলোমেলো একটা বিছানার উপর শুয়ে আর এত দোলানির মধ্যে এত ভাল ঘুম হতে পারে। ভোর হয়ে গিয়েছে কখন, জানতে পারেনি যূথিকা। সূর্য উঠেছে, সকাল হয়েছে, কামরার জানালা দিয়ে ভিতরে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে, আর প্রত্যেকটা স্টেশনে এত হাঁকডাক হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারেনি যূথিকা। ঘুম ভাঙ্গলো তখন, যখন হিমু দত্তের ডাক কানের ভিতরে গিয়ে বেজে উঠলো।—শুনছেন, পাটনা এসে পড়েছে।
পাটনা? চমকে জেগে উঠেই প্রশ্ন করে যূথিকা।
হিমু দত্ত বলে—হ্যাঁ।
যূথিকা ঘোষ তাড়াতাড়ি হাত-ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে। হিমু দত্ত যূথিকা ঘোষের বিছানা গুটিয়ে বাঁধা-ছাঁদা করে।
ট্রেনের গতি মৃদু হয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করেই প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকায় যূথিকা। হেসে ওঠে যূথিকার চোখ। ট্রেনটা থেমে আসছে। কিন্তু এরই মধ্যে দেখে ফেলেছে যূথিকা, প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মধ্যে দু-তিনটে চেনা মুখও হাসছে। মামী এসেছেন, মামীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে অরুণ। যূথিকাকে দেখতে পেয়ে হাত দোলাচ্ছে অরুণ। আর, ফরফর ক’রে উড়ছে নরেনের গলার লাল-রঙা টাই। নরেনের মুখে হাসি, সেই সঙ্গে নরেনের হাতের রুমালও সুম্মিত অভ্যর্থনার মত দুলে উঠেছে।
ট্রেন থেকে নেমে, প্রায় ছুটে গিয়ে মামীর কাছে দাঁড়ায় যূথিকা। অরুণের গাল টিপে আদর করে; এবং তার পরেই নরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে।
একটা কুলি যূথিকা ঘোষের বাক্স আর বিছানা মাথায় তুলে নিয়ে হাঁক দেয়—চলিয়ে।
যূথিকা বলে—চল।
চলতে গিয়েই হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় যূথিকা।—ও হ্যাঁ…
মনে পড়েছে, হিমু দত্তকে গিরিডি ফেরবার খরচটা দিতে হবে। হাত-ব্যাগ থেকে টাকা বের ক’রে হিমুর দিকে তাকায় যূথিকা ঘোষ। এগিয়ে আসে হিমু। হিমুর হাতে টাকা ফেলে দিয়েই যূথিকা মামীর দিকে তাকায়।—চল এবার।
মামী বলেন—ছেলেটি?…
যূথিকা বলে—ও এখন গিরিডি ফিরে যাবে। মামী—কে ছেলেটি?
যূথিকা ব্যস্তভাবে বলে—ও কেউ নয়; সঙ্গে এসেছে, এই মাত্র।