২
উশ্রী নদীর কিনারায় একটা ফাঁকা শালবনের কাছাকাছি সুশ্রী একটি বাড়ি। চারু ঘোষের বাড়ি—উদাসীন।
বেশ টাকা-পয়সা আছে উকীল চারু ঘোষের, এবং বাড়িটার চেহারাও বেশ রং-চঙে। বাড়িতে যখন তখন গ্রামোফোনের রেকর্ড বাজে, এবং বারান্দার উপর মক্কেলের ভিড়ও লেগে আছে। তাই একটু ভাবতে হয়, এমন বাড়ির নাম উদাসীন রাখা হলো কেন?
চারু ঘোষের জীবনটা মোটেই উদাসীন নয়। অত্যন্ত কর্মব্যস্ত ও চিন্তারত জীবন। চারু ঘোষের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের চেহারাও উদাসীন নয়। সব সময়েই হাসছে আর খেলছে, বেশ দুরন্ত খুশির জীবন। তারপর, বড় মেয়ে যূথিকা ঘোষের জীবন। ঝকঝক করে চোখ, ঝিকঝিক করে মুখের হাসি আর ঝলমল করে সাজ, যূথিকা ঘোষের জীবনটাকে একটা উচ্ছল আশার জীবন বলেই মনে করতে হয়। উদাসীনতার সামান্য ছায়াও নেই যূথিকা ঘোষের মুখের ভাষায় ও চোখের চাহনিতে।
পৃথিবীতে কারও কাছ থেকে এক পয়সার উপকার নেব না, এবং কাউকে একটা পয়সার উপকার দেবও না। এরকম একটা আদর্শ বাস্তবতার সংসারে সত্যিই সম্ভব কিনা, এ প্রশ্ন আর যারই মনে যত গোলমাল বাধাক না কেন, চারু ঘোষের মনে কোন গোলমাল বাধাতে পারে না। এবিষয়ে চারু ঘোষের মনটা একেবারে পরিষ্কার। বিশ্বাস করেন চারু ঘোষ, এই রকম জীবনই হলো আদর্শ জীবন। কারও উপকার নেব না, কারও উপকার করবো না। কারও অপকার করবো না, কারও কাছ থেকে অপকার নিতেও পারবো না। অর্থাৎ সরে থাকবো, যেন কেউ অপকার করবার সুযোগ না পায়। চারু ঘোষকে যারা ভালমত জানে, তারা বিশ্বাসও করে। হ্যাঁ, বাস্তবিক, চারু ঘোষ সত্যিই মানুষের উপকার-অপকারের নাগাল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অদ্ভুত একটা দার্শনিক অস্তিত্ব সত্য করে তুলতে পেরেছেন। চারু ঘোষের বাড়িতে কোন ক্রিয়া-কর্মে, কোন উৎসবে কারো নিমন্ত্রণ হয় না। চারু ঘোষও কোন বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান না। ছেলে-মেয়েদের জন্মদিনে যে উৎসবটা হয়, সে উৎসব নিতান্ত একটা পারিবারিক উৎসব। চিঁড়ের পোলাও রান্না করা হয়, এবং বাড়িতেই দুধ ফাটিয়ে ছানা করে আমসন্দেশ তৈরি করেন যূথিকার মা। স্বয়ং চারু ঘোষ, দুই ছেলে বীর নীরু, মেয়ে যূথিকা এবং যূথিকার মা; এই পাঁচটি মানুষ ছাড়া বাড়ির আর কোন মানুষ চিঁড়ের পোলাও ও আমসন্দেশের স্বাদ গ্রহণ করে না। নিয়মই নেই।
বাড়ির আর মানুষ বলতে শুধু ঠাকুর চাকর ঝি মালী আর ড্রাইভার। উদাসীনের উৎসবের দিনেও তারা তাই খায়, যা রোজই খেয়ে আসছে। ডাল ভাত আর একটা তরকারি। চিঁড়ের পোলাও আর আমসন্দেশ একেবারে স্ট্রিক্টলি শুধু উদাসীনের বাপ-মা আর ছেলে-মেয়েদের খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হয়।
হ্যাঁ, পরের দাবীর দিকটাও দেখতে ভুল করেন না চারু ঘোষ। সেদিকে তাঁর চোখ অন্ধ নয়, বরং খুবই সজাগ। ড্রাইভারকে যদি একবার ডাকঘরে পাঠাতে হয়, তবে চারু ঘোষ তাঁর পাল্টা, কর্তব্যও স্মরণ করেন। একটা এক্সট্রা কাজ করেছে ড্রাইভার, এটা ড্রাইভারের নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে না। সুতরাং, সেদিন ড্রাইভারের এই সামান্য এক্সট্রা কাজের জন্য ড্রাইভারকে এক পেয়ালা চা ও একটা বিস্কুট খেতে দেন যূথিকার মা। চারু ঘোষ বলেন—পয়সা দিয়ে কাজ নেব; কারও উপকার চাই না। ঠকবো না, কাউকে ঠকাবোও না।
মালী মাসে একদিন বাড়ি যাবার ছুটি পায়। এদিকেও নজর আছে চারু ঘোষের, যেন সত্যিই ছুটিটা অস্বীকার না করে মালী। মাসে একটা দিন ছুটি দেওয়া হবে বলে যখন নিয়ম করা হয়েছে, তখন সে নিয়মের এক চুল এদিক-ওদিক করা চলবে না, ছুটির দিনে মালীকে বাড়ি যেতেই হবে। যদি না যায়, তবে কাজ করতে দেওয়া হবে না। এবং সারাটা দিন মালীটা উদাসীনের বাগানের এক কোণের সেই ছোট টিনের ঘরটার মধ্যে পড়ে থাকলেই বা কি? সেদিন উদাসীনের ভাত ডাল তরকারি খাবার অধিকার থাকে না মালীর। খায়ও না মালীটা। মালী নিজেই বাজার থেকে নিজের পয়সায় ছাতু কিনে এনে খায়।
যূথিকার মা পাটনা থেকে একটা চিঠি পেয়েছেন, তাইতেই সমস্যাটা দেখা দিয়েছে। যূথিকার পাটনা যাওয়া চাই। আর একটি দিনও দেরি করা চলে না। কিন্তু কে নিয়ে যাবে?
পাটনা থেকে চিঠি দিয়েছেন যূথিকার মামী; জানিয়েছেন, নরেন এখন পাটনায় আছে। আর তিন-চার দিন মাত্র থাকবে। তারপরেই বোম্বাই চলে যাবে নরেন। সুতরাং…বুঝতেই পারছো,এই চিঠি পাওয়া মাত্র যূথিকা যেন পাটনা চলে আসে। তা ছাড়া, যূথিকার কলেজ খুলতেই বা আর কটা দিন বাকি আছে? বোধহয় আর পাঁচ-সাত দিন হবে। পাটনা তো আসতেই হবে। না হয় পাঁচ-সাত দিন আগেই এল।
যূথিকাও এরকম একটা সংবাদ শুনতে পাবে বলে তৈরি ছিল না। পাটনার কলেজ খুলতে আর সাতটা দিন বাকি আছে। যূথিকা জানে, আর ছ’দিন পরে ঠিক সময় মত মধুপুর থেকে বলাইবাবু চলে আসবেন, এবং যূথিকাকে পাটনা পৌঁছে দিয়ে আসবেন; প্রত্যেকবার কলেজ ছুটির সময় পাটনা থেকে যূথিকাকে নিয়ে আসেন, ছুটি ফুরিয়ে যাবার পর পাটনাতে পৌঁছে দিয়ে আসেন বলাইবাবু। চারুবাবুর মধুপুরের যত বাড়ির ভাড়া আদায়ের সরকার মশাই, সেই বলাইবাবু, যিনি চারুবাবুর বাবার বয়সী, এবং আগে চারুবাবুর বাবার অফিসেই চাকরি করতেন।
এবারও বলাইবাবু সময়মত আসবেন এবং তাঁরই সঙ্গে পাটনা চলে যাবে যূথিকা, এই ব্যবস্থার মধ্যে একটা ওলট-পালট ঘটাবার দরকার হবে, এমন সম্ভাবনা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। চারুবাবু না, যূথিকার মা না, যূথিকাও না। কিন্তু পাটনার মামীর চিঠিটা হঠাৎ চলে আসতেই ফাঁপরে পড়লেন সবাই। সরকার মশাই, অর্থাৎ বলাইবাবু তো এখন মধুপুরে নেই। তিনি ধর্ম-কর্ম করতে পুরী গিয়েছেন, এবং পুরী থেকে ফিরবেন ঠিক সেই দিনের আগের দিনটিতে, যেদিন যূথিকার কলেজ খোলবার কথা। বলাইবাবুর পুরীর ঠিকানাও জানা নেই যে, একটা টেলিগ্রাম করে বলাইবাবুকে অবিলম্বে চলে আসতে বলা যেতে পারে। কিন্তু জানা থাকলে আর টেলিগ্রাম করলেই বা কি? বলাইবাবুর আসতেও তো দুটো দিন সময় লাগবে। তারপর যূথিকাকে নিয়ে পাটনায় পৌঁছতে আর একটা দিন লাগবে। ততদিনে নরেন আর পাটনায় থাকবে না। তাহলে…নরেন যদি যূথিকাকে চোখে না দেখেই চলে যায়, তবে কেমন করে জানতে পারা যাবে যে, যূথিকাকে বিয়ে করবার জন্য এতদিনে সত্যিই তৈরি হয়েছে নরেন? যূথিকার মামী জানেন, যূথিকা আজও নরেনের কাছ থেকে স্পষ্ট করে ও কথাটা শুনতে পায়নি।
নরেনের সঙ্গে যূথিকার বিয়ে হবে বলেই আশা করেন চারুবাবু, যূথিকার মা এবং যূথিকার পাটনার মামী। কিন্তু বিয়ে না’ও হতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে। তিন বছর ধরে প্রত্যেক ছুটিতে বোম্বাই থেকে যখন পাটনাতে আসে নরেন, তখন গর্দানিবাগে যূথিকার মামার বাড়িতে নরেনের নিমন্ত্রণ হয়, এবং নরেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসে যাকে দেখতে পাবে বলে আশা করে, সেই যূথিকাকে দেখতেও পায়। কোন সন্দেহ নেই, যূথিকাকে ভালবাসে নরেন। কিন্তু ভালবেসেও আর কতকাল অপেক্ষা করতে চায় নরেন?
করুক না অপেক্ষা, চারুবাবুর কোন আপত্তি নেই। যূথিকার এই তো সেকেণ্ড ইআর চলেছে। যূথিকা ছাত্রী ভাল। যতদিন নরেন অপেক্ষা করবে, ততদিন যূথিকার কলেজের পড়ার জীবনও চলতে থাকবে। সেটাও একরকমের ভালই বলতে হবে। বরং এই সময় বিয়ে হয়ে গেলেই যূথিকার পড়া বন্ধ হয়ে যাবার ভয় আছে। যূথিকাকে কি বোম্বাই নিয়ে না গিয়ে আরও কটা বছর পাটনা কলেজের ছাত্রী হয়ে থাকতে দিতে রাজি হবে নরেন?
ঠিক ওসব প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হলো, নরেন আবার অর্থাৎ নরেনের মনটা আবার যদি উদাস হয়ে যায়? সত্যিই মাঝে একবার উদাস হয়ে গিয়েছিল। বছরের মধ্যে বার তিনেক পাটনাতে আসে নরেন; যূথিকার সঙ্গে প্রত্যেকবারই দেখা হয়। এবং ওদের দু’জনের মেলামেশার আনন্দও বছরে তিনবার উৎসবের মত উতলা হয়ে ওঠে। এই দেখা-শোনা ও মেলামেশার মধ্যে যদি হঠাৎ কোন ছেদ পড়ে; যদি একবার, কিংবা পর পর কয়েক বার দুজনের মেলামেশার উৎসব বাদ পড়ে যায়, তবে যে নরেনের মনে অপেক্ষার আগ্রহও উদাসীন হয়ে যেতে পারে। এমন অনর্থ অনেক ভালবাসার জীবনে ঘটতে দেখা গিয়েছে। শুধু একটানা একবছরের অদেখাতেই ভালবাসা ভেঙ্গে গেল এবং কেউ কারও খোঁজও নিল না, এমন ঘটনা চারুবাবু তাঁর নিজেরই শ্যালিকা সুমতির জীবনে দেখেছিলেন। তাই একটা ভয় আছে তাঁর মনে। যূথিকার মা এবং মামীর মনেও ভয় আছে। যেন হাতছাড়া না হয় নরেনের মত ছেলে। ভারত সরকারের টেক্সটাইল উন্নয়নের কাজে এক হাজার টাকা মাইনের একটা পদ এই ত্রিশ বছর বয়সেই দখল করেছে যে ছেলে, সেই ছেলে যূথিকার মত একটা সাএন্স পড়া সেকেণ্ড ইআরের মেয়েকে ভালবেসেছে; যূথিকার ভাগ্যের জোর আছে। যূথিকা দেখতে সুন্দর বটে, কিন্তু ওরকম সুন্দর মেয়ে কতই তো আছে।
যূথিকারও জানতে বাকি নেই, পাটনার মামী চিঠিতে কি লিখেছেন। নরেন এসেছে। যূথিকা ঘোষের পক্ষে মনের চঞ্চলতা নিরোধ করে রেখে উদাস হয়ে থাকা অসম্ভব। নরেন পাটনায় পাবে না, নরেনের চোখের বেদনাকে যেন চোখে দেখতে পায় যূথিকা। ইস, মাত্র আর তিনটি দিন পাটনায় থাকবে নরেন। তার পরেই, পাটনার ছেলে হতাশ হয়ে তার বোম্বেই -এর কাজের জীবনে চলে যাবে।এসময় গিরিডিতে পড়ে থাকা যে যূথিকার জীবনের একটা ভয়ঙ্কর অপরাধ। ভুল করবে না নরেন, যদি অভিমানে ক্ষুব্ধ হয়ে যূথিকাকে বিশ্বাসঘাতিকা বলে সন্দেহ করে ফেলে।
একাই পাটনা চলে যেতে পারা যায় না কি? পারা যায়, কিন্তু চারুবাবুই যেতে দিতে রাজি হবেন না। তা ছাড়া, যূথিকাও মনে মনে স্বীকার করে, যূথিকার নিঃশ্বাসের আড়ালেও একটা ভয় আছে। একা যেতে আর সাহস হয় না। মনে পড়ে, সেবার বড়দিনের ছুটির সময় পাটনা থেকে একাই গিরিডি রওনা হয়েছিল যূথিকা। এবং ট্রেন বদল করবার জন্য গয়াতে নেমেই দেখতে পেয়েছিল চামড়ার বড় বাক্সটা নেই আর গলার হারটাও নেই। মেয়ে কামরার ভিতরেই ছিল যূথিকা, এবং ভুলের মধ্যে এই যে, মাত্র পনর-বিশ মিনিট, বড় জোর আধ ঘণ্টা হবে, জানালার কাঠের উপর মাথা হেলিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে একটু ঘুমিয়েছিল। তাতেই এই কাণ্ড! না, একা একা ট্রেনে যাওয়া-আসা করবার ইচ্ছাটাও আর সাহস পায় না।
আদালত থেকে বাড়ি ফিরে এসে চারুবাবু বললেন—নবলকিশোরবাবু বললেন, হিমু নামে একটা লোক আছে, যার ওপর এরকম একটা কাজের দায় অনায়াসে ছেড়ে দেওয়া যায়। বেশ ডিপেণ্ডেবল। আর, একটা ডাক দিলেই ছুটে চলে আসে।
বীরু আর নীরু এক সঙ্গে হেসে চেঁচিয়ে ওঠে— হোমিও হিমু, হোমিও হিমু।
চারুবাবু আশ্চর্য হন—তার মানে?
যূথিকাও হাসে—লোকটার পুরো নাম হিমাদ্রিশেখর দত্ত। লোকটা নাকি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারী করে।
চারুবাবু—কই, এ শহরে এরকম কোন ডাক্তারের নাম তো কখনও শুনিনি।
যূথিকা—লোকটা সত্যিই ডাক্তারী করে না। মাস্টারী করে। গণেশবাবুর ছেলে-মেয়েদের পড়ায়।
চারুবাবু—লোকটাকে তুই চিনিস নাকি?
যূথিকা—দেখেছি। ওর নামে মজার মজার অনেক গল্পও শোনা যায়।
চারুবাবু—দেখে কি-রকম মনে হয়? ছ্যাচোর-ট্যাচোর নয় তো?
যূথিকা—না। তবে একটু ইডিঅটিক মনে হয়।
চারুবাবু—তা হলে মন্দ নয়। তাহলে লোকটাকে ডাকতে হয়।
যূথিকার মা ব্যস্ত হয়ে বলেন—ডাকতে হয় আবার কি? ডেকে ফেল। আর একটুও দেরি করা উচিত নয়।
ডাকতে দেরি হয়নি। হিমু দত্তকে ডেকে আনবার জন্য ব্যস্তভাবে চলে গেল ড্রাইভার, এবং মাত্র আধঘণ্টা পরে ড্রাইভারের সঙ্গে ব্যস্তভাবে চলে এল হিমু দত্ত।
চারুবাবু বলেন—তুমি ড্রাইভারের কাছ থেকেই সব শুনেছ বোধহয়?
হিমু —হ্যাঁ।
চারুবাবু—আজই, এই সন্ধ্যার ট্রেনেই রওনা হতে হবে।
হিমু—যে আজ্ঞে।
চারুবাবু—শুনেছি তুমি খুব ডিপেণ্ডেবল আর ডিউটি সম্বন্ধে খুব সজাগ।
হিমু বিনীতভাবে হাসে— আপনাদের সামান্য একটু উপকার করবো, এর জন্য মিছিমিছি কেন এত প্রশংসা করছেন?
চমকে ওঠেন চারুবাবু — উপকার? উপকার করতে বলছে কে তোমাকে?
হিমু দত্তও অপ্রস্তুত হয়; আর চুপ ক’রে তাকিয়ে থাকে। চারুবাবু বলেন—আমার ধারণা, তোমার দৈনিক রোজগার দু’টাকার বেশি হয় না। কি বল?
হিমু বলে—তা বটে। মাসে ষাট টাকার মত হলে দিন দু’টাকাই তো দাঁড়ায়।
চারুবাবু—পাটনা যেতে আর ফিরে আসতে তোমার তিনটি দিন লাগবে।
হিমু—আজ্ঞে হ্যাঁ।
চারুবাবু—সুতরাং, তোমার তিন দিনের কাজের কামাই হিসাব করে ধরলে, তোমার রোজগারের ছ’টা টাকার ক্ষতি হয়।
হিমু হাসে— হিসেব করলে তাই হয়, কিন্তু সত্যিই ক্ষতি হয় না।
চারুবাবু—তার মানে?
হিমু—ছেলে পড়াবার কাজে দু’তিন দিন কামাই করলে কেউ আমার মাইনে কাটে না!
চারুবাবু—ওসব কথা বলে আমাকে লাভ নেই। পরে কি করে বা না করে, সে সব নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। আমার কথা হলো….
দেয়ালের ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চারুবাবু বলেন—এই ছ’টাকা তুমি পাবে। তা ছাড়া, তোমার খোরাকী বাদ দিন আরও দু’টাকা। অর্থাৎ ছ’টাকা ছ’টাকা বার টাকা।
হিমু বলে—না।
যূথিকার মা বলেন—বেশ তো, না হয় হয় আরও দুটো টাকা পাবে।
হিমু—না।
চারুবাবু তাঁর চশমার ফাঁক দিয়ে কঠোরভাবে হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন—আমার কাজের দরকারটাকে তুমি ব্ল্যাকমার্কেট মনে করলে না কি হে?
এতক্ষণ স্থির হয়ে দাড়িয়ে চারুবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল হিমু। এইবার মুখ ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকায়। এবং তাকিয়েই দেখতে পায়, এই মুহূর্তে পাটনা রওনা হবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে যে মেয়ের জীবন, সেই মেয়েই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দরাদরির ভাষাগুলি শুনছে।
ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে যূথিকা ঘোষ। হিমু দত্তের চতুর অবাধ্যতার উপর বিরক্তি আর ঘৃণার আক্রোশ যেন কোন মতে চেপে রেখেছে যূথিকা। লোকটা একটুও ইডিঅট নয়; মানুষের বিপদের উপর দর হেঁকে টাকা আদায়ের কায়দা খুব ভাল করেই রপ্ত করেছে লোকটা।
কিন্তু সত্যিই কি চলে যেতে চাইছে লোকটা? দরজার দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে কেন?
যূথিকা ডাক দেয়—বাবা?
ডাকটা আর্তনাদের মত শোনায়। যূথিকা ঘোষের জীবনের আশার অভিসার ব্যর্থ ক’রে দেবার ক্ষমতা পেয়ে গিয়েছে হিমু দত্ত নামে চতুর পয়সালোভী এই লোকটা। ওকে এই মুহূর্তে সন্তুষ্ট না করতে পারলে, ওকে রাজি করাতে না পারলে, যূথিকা ঘোষের জীবনও যে আশার পথে এগিয়ে যেতে পারবে না।
যূথিকা ঘোষের ডাকের অর্থ বুঝতে দেরি করেন না চারুবাবু। হিমু দত্তের দিকে তাকিয়ে ডাক দেন।—শোন তবে।
ডাক শুনে মুখ ফেরায় হিমু। এবং শোনবার জন্যই প্রস্তুত হয়।
চারুবাবু বলেন—তোমাকে মোট ত্রিশটা টাকা পারিশ্রমিক দিচ্ছি।
হাঁপ ছেড়ে এবং নিশ্চিন্ত হয়ে হিমু দত্তের দিকে তাকান চারুবাবু। এবং সেই মুহূর্তেই চমকে ওঠেন। কোন কথা না বলে আস্তে আস্তে হেঁটে দরজার দিকে চলে যাচ্ছে হিমু দত্ত।
চেঁচিয়ে ওঠেন চারুবাবু—এ কি? তুমি একটা কথাও না বলে …এ কি রকমের অভদ্রতা!
হিমু দত্ত থমকে দাড়ায়; এবং শান্তভাবে হাসে—আমি টাকা নিই না স্যার।
চারুবাবু—তার মানে…এমনি শুধু…একটা বাতিকের জন্য…
হিমু—লোকের দরকারে আমি এমনিতেই একটু আধটু খেটে উপকার করি স্যার।
চারুবাবু জীবনের একটা অহঙ্কারের স্তম্ভকেই যেন একটা ভয়ানক ঠাট্টার আঘাতে কাঁপিয়ে আর নাড়িয়ে দিয়েছে হিমু দত্ত।— ছটফট ক’রে বার-বার এদিক-ওদিক তাকাতে থাকেন চারুবাবু। কোথা থেকে পৃথিবীর সব চেয়ে বাজে একটা লোক এসে চারুবাবুর মত শুদ্ধ অহঙ্কারের গৌরবে গরীয়ান এক মানুষের একটা দরকারের সুযোগ পেয়ে যেন তাঁর চুল ধরে মাথাটাকে টেনে নীচু ক’রে দিচ্ছে। কারও উপকারের পরোয়া করেন না, কারও ধার ধারেন না যে মানুষ, সে মানুষকে আজ হিমু দত্তের মত একটা ইডিঅটের অহঙ্কারের বাতিকের কাছে হাত পেতে ঋণ চাইতে হবে?
গলার ভিতর যেন ধুলো ঢুকেছে; জোরে একবার কেশে নিয়ে এবং মাথাটাকে একটু হেঁট ক’রে বিড়বিড় করেন চারুবাবু। বেশ, তবে তাই হোক, টাকা নিও না।
হোমিও হিমুর জীবনের একটা মূর্খ বাতিকের কাছে মাথা হেঁট করতে বাধ্য হয়েছেন চারুবাবু। কিন্তু চারুবাবুর এই আহ্বানের মধ্যে হৃদয়ের অভিনন্দন নেই। যেন একটা আক্রোশ অনিচ্ছাসত্ত্বেও, শুধু দায়ে পড়ে বাধ্য হয়ে হিমু দত্তের উপকার সহ্য করতে রাজি হয়েছে। মানুষকে অপমান করবার আগে অহঙ্কারের মানুষ নিজের পায়ের জুতোর দিকে তাকাতে গিয়ে ঠিক এইরকম মাথা হেঁট করে।
হিমু দত্ত বলে–যা-ই হোক, আমার আর কিছু বলবার নেই।
চারুবাবু—তাহলে তৈরি হও, এই সন্ধ্যার ট্রেনেই…
হিমু হাসে—না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
জীবনে এই প্রথম, অন্তত হিমু দত্তের গিরিডির জীবনে এই প্রথম স্পষ্ট স্বরে ‘না’ করতে পেরেছে হিমু, ‘না’ বলবার ইচ্ছে হিমুর। হিমু দত্তের জীবনের মূর্খ বাতিকটা হঠাৎ চালাক হয়ে গিয়েছে কিংবা হিমু দত্তের জীবনের গোবেচারা সম্মানটাই হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।
যূথিকা ঘোষের ছায়ার পাশ দিয়েই ব্যস্তভাবে হেঁটে চলে গেল হিমু দত্ত। মস্ত বড় বারান্দা, তাড়াতাড়ি হেঁটে পার হতেও এক মিনিট লাগে। হন হন করে হেঁটে চলে যেতে থাকে হিমু, এবং ফুলের টবের সারি পার হয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াতেই পিছনের ডাক শুনে থমকে দাড়ায়।
– হিমাদ্রিবাবু! পিছন থেকে ডাক দিয়েছে যূথিকা ঘোষ।
ডাকতে ডাকতে একেবারে কাছে চলে এসেছে।
হিমাদ্রিবাবু? ডাকটা যে একটা কপট স্তুতি। এই ডাকের পিছনে চারু ঘোষের মেয়ে যূথিকা ঘোষের জীবনের একটা দরকারের তাগিদ মুখ টিপে হাসছে। সত্যি তাই কি?
যূথিকা ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা যায় না। বুঝতে পারে না হিমু। শুধু বোঝা যায়, হিমু দত্তের এই বিদ্রোহকে যেন কোন মতে শান্ত করবার জন্য যূথিকা ঘোষের উদ্বিগ্ন চোখের মধ্যে একটা চেষ্টা ছটফট করছে।
যূথিকা বলে—আপনি রাজি না হলে আমার আজ পাটনা রওনা হবার কোন উপায় নেই। আর, আজই রওনা না হতে পারলে ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে হিমাদ্রিবাবু।
—বেশ তো। বেশ তো। ঠিক আছে, কিছু ভাববেন না। আপনি তৈরি হয়ে নিন।
বলতে বলতে, এবং বোধহয় মনের মধ্যে একটা নতুন বাতিকের তাড়নায় বিচলিত হয়ে, ফুলের টবের কাছে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াতে থাকে হিমু দত্ত। যূথিকা ঘোষের মুখে করুণ অনুরোধ; একটা নকল করুণতা নিশ্চয়। কিন্তু তবু তো হিমাদ্রিবাবু বলে ডেকেছে। ইচ্ছে নেই, তবু তো সম্মান দেখিয়েছে।
যূথিকা ঘোষের তৈরি হতে পাঁচ মিনিট লাগে। ড্রাইভারের গাড়ি বের করতে এক মিনিট লাগে। এবং সন্ধ্যার ট্রেন ধরবার জন্য স্টেশনে পৌঁছে যেতে পাঁচ মিনিট।
জগদীশপুর পার হয়ে গেল ট্রেন। মাঝে মাঝে ফুলের নার্সারি আর রাঙামাটির মাঠের এদিকে-ওদিকে ছোট ছোট শালের কুঞ্জ। ট্রেনে বসে ফুলের নার্সারি আর শালকুঞ্জের দিকে চোখ পড়লেও যূথিকা ঘোষের মনের মধ্যে পাটনার ছবি ফুর-ফুর করে। ট্রেনটা ছুটতে ছুটতে দু’পাশের ফুলের নার্সারির বাতাসকে বুকের ভিতরে টানছে। গোলাপের গন্ধে মাঝে মাঝে ভরে যাচ্ছে ট্রেনের কামরা। কিন্তু যূথিকা ঘোষের কল্পনাকে নিকটের ঐ গোলাপের গন্ধ বোধহয় স্পর্শ করতে পারে না। হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকায়নি যূথিকা ঘোষ, শালকুঞ্জগুলিকে দেখেও দেখতে পায়নি।
মধুপুরে পৌঁছতে ট্রেনটার বেশ দেরি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। পথের মাঝে হঠাৎ থেমে গিয়েছে ট্রেনটা। একজন যাত্রী নেমে গিয়ে খবর নিয়ে ফিরেও আসে, এক ভদ্রলোক অ্যালার্ম শিকল টেনেছেন। দুটো চোর তাঁর সুটকেস নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পালিয়ে গিয়েছে।
—এই জন্যেই একা একা আর ট্রেনে ঘুরতে সাহস পাই না হিমাদ্রিবাবু।
এতক্ষণে এই প্রথম যূথিকা ঘোষ পাটনার ভাবনা ছেড়ে দিয়ে যেন কাছের জগতের একটা সমস্যার সঙ্গে আলাপ করলো। এতক্ষণ কামরার ভিতরে হিমু দত্ত নামে মানুষটা যূথিকার চোখের খুব কাছে বসে থাকলেও তাকে দেখতেই পায়নি যূথিকা, এবং কোন কথা বলবার দরকারও বোধ করেনি।
ট্রেন আবার আবার চলতে শুরু করতেই যূথিকা বলে—আমি একাই পাটনা চলে যেতে পারতাম। কিন্তু শুধু ঐ একটি কারণে আপনাকে সঙ্গে নিতে হলো। চোরেরা মেয়েছেলেকে তো একটুও ভয় করে না। তাই, অন্তত, নামে-মাত্র একটা পুরুষ মানুষ সঙ্গে থাকলেও চোরের উপদ্রব থেকে একটু নিরাপদ থাকা যায়৷
হিমাদ্রিবাবু নামে ডাক শুনে যে মেয়ের মুখের দিকে একবার খুবই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিল হিমু দত্ত, সেই মেয়েরই মুখের দিকে আর একবার আশ্চর্য হয়ে তাকায়। এটা প্রথম আশ্চর্য ভেঙ্গে যাবার আশ্চর্য। হিমাদ্রিবাবু কথাটার মধ্যে সম্ভ্রম আছে নিশ্চয়, কিন্তু যূথিকা ঘোষ যাকে হিমাদ্রিবাবু বলে ডেকেছে, তার মধ্যে কোন সম্ভ্রমের বস্তু দেখতে পেয়েছে কি? হিমু দত্তকেও কি শুধু নামে-মাত্র একটা পুরুষ বলে মনে করেছে যূথিকা ঘোষ?
বেশিক্ষণ নয়; কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র, আর বেশি সময় লাগেনি, এই প্রশ্নেরও একটি পরিষ্কার উত্তর পেয়ে যায় হিমু দত্ত।
যূথিকা তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে।—তাই আপনাকে সঙ্গে নিতে হলো।
চারু-ঘোষের মেয়ের জীবনে একটা কাজের দরকারে, শুধু পাটনা পৌঁছে দেবার জন্য তার পিছনে একটা নামে মাত্র পুরুষ হয়ে একটি বা দুটি দিনের জন্য একটা অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে যাকে, তাকেই হিমাদ্রিবাবু বলে ডেকেছে যূথিকা। কিন্তু এমন ডাক ডাকবার কি প্রয়োজন ছিল? নিভা আর সরযূদের মত হিমুদা বলে ডাকাই তো উচিত ছিল। না, হিমুদা ডাকটা যূথিকা ঘোষের মুখে ভাল শোনাবে না। হিমুর চেয়ে যে বয়সে এমন কিছু ছোট নয় যূথিকা, সেটা যূথিকার চেহারা আর হিমুর চেহারা দেখেই বুঝতে পারা যায়৷ প্রায় সমবয়সী কোন অনাত্মীয় পুরুষকে দাদা বলে ডাকতে কোন মেয়ের ইচ্ছে হয় না বোধহয়, এবং ডাকটা মুখেও বেধে যায়। কিন্তু নামে মাত্র পুরুষকে একটা নামে-মাত্র দাদা বলে মনে করে ফেললেই তো হয়। তা যদি না পারে, তবে সোজা হিমু বলে ডেকে ফেললেই বা দোষ কি? একটা নামে-মাত্র পুরুষকে অনায়াসে শুধু নাম ধরে ডাকতে পারবে না কেন কোন মেয়ে? তা ছাড়া, যূথিকা ঘোষের জীবন ও হিমু দত্তের জীবনের পার্থক্যটাও তো দেখতে হয়! কোথায় আভিজাত্যে সম্পদে শিক্ষায় কালচারে রুচিতে আর আকাঙ্ক্ষায় এত বড় হয়ে গড়ে ওঠা যূথিকা ঘোষ নামে এই মেয়ের জীবন, আর কোথায় হোমিও হিমুর জীবন, যে-জীবন বলতে গেলে কাঠের উপর লেখা একটা নাম মাত্র!
মস্ত বড় বাড়ি ঐ উদাসীনের মেয়ে অনায়াসে হিমু দত্তকে হিমু বলেই ডাকতে পারতো। ডাকলে অন্যায় বা অমানান কিছু হতো না। এবং তাহলে হিমু দত্তের মনটাও অকারণে কয়েক ঘণ্টা ধরে একটা মিথ্যা প্রশ্ন দিয়ে মনের ভিতরে কোন ভাবনার দ্বন্দ্ব বাধাতো না।
হিমু দত্ত কি ভাবছে, যূথিকার কথাগুলি হিমু দত্তের মনের ভিতরে গিয়ে কোন আঘাত দিল কি না দিল সেটুকু চিন্তা করবার কথাও যূথিকা ঘোষের মনে দেখা দিতে পারে না। হিমু দত্তের মুখের উপর কোন নতুন ছায়া পড়েছে কি না পড়েছে, সেটা হিমু দত্তের মুখের দিকে তাকালেও বুঝতে পারবে না যূথিকা। হিমু দত্তের মুখ তেমনই শান্ত, তেমনই একটি জড়-পদার্থ। বই-এর রঙীন ছবিকেও একটু নাড়া-চাড়া করলে ছবিটা যেন রং বদলায়। কিন্তু হিমু দত্তের ঐ নিরেট ও নির্বিকার মুখের উপর রং ছিটিয়ে দিলেও বোধহয় মুখটা রঙীন হয়ে উঠবে না।
এবং কালি ছিটিয়ে দিলেও বোধহয় কালো হয়ে যাবে না হিমু দত্তের শান্ত মুখ। হিমু দত্তের মনের ভিতর থেকে কয়েক ঘণ্টার ছোট একটা বিস্ময় হঠাৎ ভেঙ্গে গেল, বেশ হলো। কিন্তু সেজন্য হিমু দত্তের মুখের উপর কোন ভাঙ্গনের বেদনা কালো হয়ে ওঠে না।
ছোট হাত ব্যাগটাকে আস্তে আস্তে খোলে যূথিকা। ব্যাগের ভেতরে ছোট একটি আয়না। সেই আয়নার বুকে নিজেরই মুখের ছবিকে প্রায় আধ-মিনিট ধরে অপলক চোখে দেখতে থাকে। হাত তুলে কপালের দু’পাশের চুলের ফুরফুরে ছুটি ছোট স্তবক নেড়ে-চেড়ে একটু ভেঙ্গে দিয়ে এবং আরও ফুরফুরে ক’রে দিয়ে ব্যাগ বন্ধ করে যূথিকা। যূথিকার চোখের কাছে, সামনের বেঞ্চিতেই প্রায় মুখোমুখি বসে আছে যে নামেমাত্র একটা অস্তিত্ব, সেটা আছে বলেও যেন মনে করতে পারে না যূথিকা।
উঠে দাড়ায় যূথিকা। উপরে রাখা ছোট বাক্সটাকে খুলে একটা বই বের করে। ঝকঝকে ও রঙীন মলাটের একটি উপন্যাস। মধুপুর পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। উপন্যাসের পাতার উপরে চোখ রেখে মনের সব আগ্রহ জমাট করে নিয়ে, চুপ করে বসে থাকে যূথিকা।
মধুপুর পৌঁছবার পর একটু বিরক্ত হয়ে এবং বাধ্য হয়ে হিমু দত্তের সঙ্গে যূথিকাকে কয়েকটা কথা বলতে হলো। কারণ ট্রেনটা মাত্র থেমেছে, সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো হিমু দত্ত—কুলি! কুলি।
গিরিডি টু মধুপুর, ট্রেন প্রায় ফাঁকা, নামবার যাত্রীর সংখ্যাও খুব কম। তা ছাড়া, প্ল্যাটফর্মের উপর গিজ গিজ করছে কুলি। লাগেজ নামাবার জন্য হুড়োহুড়ি ক’রে কুলিগুলো তো এখুনি ছুটে আসবে। অনর্থক অকারণ কুলি কুলি বলে চেঁচিয়ে একটা কাজ দেখাবার দরকার কি?
যূথিকা বলে—আঃ, কেন মিছিমিছি হাঁক ডাক করছেন? কোন দরকার নেই। আপনাকে এত ব্যস্ত হতে হবে না।
হিমু দত্ত একটু অপ্রস্তুত হয়ে, তার পরেই হঠাৎ একমুখ হাসি হেসে প্রশ্ন করে—আপনি বোধহয় হাঁকডাক চেঁচামিচি পছন্দ করেন না?
যূথিকা শুধু বলে—অবান্তর প্রশ্ন।