শুন বরনারী – ১

ছোট এক টুকরো কাঠের উপর বাংলা হরফে লেখা একটা নাম—ডাক্তার হিমাদ্রিশেখর দত্ত (হোমিও)। গিরিডির লোহাপুলের পূর্বদিকের সরু রাস্তাটার ধারে কোন বাড়ির দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে ঐ নামটা আজও আঁটা আছে কিনা জানি না। থাকলেও, এতদিনে নামটা নিশ্চয় পচা কাঠের ছাতা লেগে পচে গিয়েছে কিংবা পুরানো কাঠের ঘুনের কামড়ে ঝিরঝিরে হয়ে গিয়েছে। যাই হোক, আজ থেকে দশ বছর আগে ঐ নামের ফলক স্মরণ করিয়ে দিতো যে, ঐ নামের আড়ালে একটা মানুষ আছে। কে না চেনে তাকে?

নামটা শব্দের ভারে বেশ ভারিক্কি বটে, কিন্তু মানুষটা একেবারে হাল্‌কা! লোকেও এত বড় একটা নাম উচ্চারণ করবার কষ্ট স্বীকার করে না। লোকের মুখে নামটাও কাটছাঁট হয়ে বেশ হাল্‌কা হয়ে গিয়েছে। লোকে বলে, হিমু দত্ত হোমিও। কেউ কেউ আরও সংক্ষেপে সেরে দেয়, হোমিও হিমু! প্রবীণেরা অবশ্য শুধু হিমু বলেই ডাকেন। কারণ, হোমিও হিমুর বয়সটাও হাল্কা। প্রবীণদের কলেজে-পড়া ছেলেদের চেয়ে বয়সে বড় জোর পাঁচ বছর বেশি হতে পারে হিমু। তার বেশি কখনই নয়। কম বয়সের ছেলেরা আর মেয়েরা নিজেদের মধ্যে আলাপের সময় হোমিও হিমু বললেও হিমাদ্রিশেখর দত্তকে কোন কথা বলবার সময় হিমুদা বলেই ডাক দেয়।

সব শহরের মত এই গিরিডিতেও লোকের ঘরে বিশেষ এক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। অমুকের অমুক জায়গা যাবার দরকার হয়েছে। তাকে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে, কারণ তার পক্ষে একা যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পৌঁছে দেবে কে? সঙ্গে যাবে কে?

এ ধরণের সমস্যার সমাধানে সহায় হতে হিমু দত্তের মনে কোন আপত্তি নেই। আপত্তি দূরে থাকুক, বরং অদ্ভুত একটা আগ্রহের বাড়াবাড়ি আছে বলতে হবে। যে কোন পরিবারের এধরনের কাজের দরকারে হিমু দত্তকে একবার ডাক দিলেই হয়, আর অনুরোধটা একবার করে ফেললেই হয়। তখনি রাজি হয়ে যায় হিমু দত্ত।

গত বছরে পৌষ সংক্রান্তির সময় সমস্যায় পড়েছিলেন পরেশবাবু। পিসিমা গঙ্গাসাগর যাবার জন্য প্রতিজ্ঞা ক’রে বসে আছেন। থুড়থুড়ে বুড়ো মানুষ, এই পিসিমাকে নিরাপদে গঙ্গাসাগর নিয়ে যাওয়া আর নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কি সহজ কাজ? যে-সে মানুষের পক্ষে একাজ সাধ্যই নয়। চারটিখানি দায়িত্বের কথাও নয়। পরেশবাবুর নিজেরই সাহস হয় না, এমন কি অমন হট্টাকট্টা ভাগ্নে বাবাজী বড়-খোকনের উপরেও এমন কাজে নির্ভর করবার সাহস নয় না। খায় দায় ও কসরৎ করে, আর যখন তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়; এরকম আয়েসী কুঁড়ে আর ঘুমকাতুরে ছেলে বড়-খোকন কি পিসিমাকে গঙ্গাসাগর দেখিয়ে আনবার ঝুঁকি নিতে পারে, না ওকে ঝুঁকি নিতে দেওয়া যায়?

তবে পিসিমাকে নিয়ে যাবে কে? এ-পাড়া আর ও-পাড়ার অনেক ছেলের কথাই মনে পড়ে, যাদের জীবনে কোন কাজের তাড়াই নেই। তাস খেলে, থিয়েটার করে আর খবরের কাগজের খেলার রিপোর্ট পড়ে সকাল-সন্ধ্যা তর্ক করে। এহেন কোন ছেলের হাতে পিসিমাকে গঙ্গাসাগর দেখিয়ে আনবার দায় সঁপে দিতে সাহস হয় না। প্রথম কারণ, ওদের কেউ রাজিই হবে না। দ্বিতীয় কারণ, ওদের বুদ্ধিসুদ্ধিকে ভরসা করাও যায় না। কে জানে, হয়তো পিসিমাকে কলকাতার কোন হোটেলে ফেলে রেখে দিয়ে ময়দানের দিকে কিংবা সিনেমা হাউসের দিকে দৌড় দেবে। অভয়, ভুলু, নীহার বা রমেশ, কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। অগত্যা হিমু দত্তকেই ডাকতে হয়েছিল। এবং হিমু দত্তও পিসিমাকে নিরাপদে গঙ্গাসাগরে নিয়ে গিয়ে, নিজে হাতে ধরে স্নান করিয়ে, এমনকি পিসিমাকে দিয়ে কপিলমুনির পুজো পর্যন্ত করিয়ে, গিরিডিতে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। পিসিমার থুড়থুড়ে শরীরটা একটু হাঁপায়নি, একটুও ক্লান্ত হয়নি। পিসিমা নিজেই একগাল হেসে বলে ফেললেন, আহা! হিমুর মত এমন ভাল ছেলে আমি জীবনে দেখিনি পরেশ। আমাকে কোলে ক’রে গাড়িতে তুলেছে, গাড়ি থেকে নামিয়েছে। আমার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি পরেশ।

শুধু তাই নয়। গঙ্গাসাগর যাওয়া আর আসার খরচের যে হিসাব দিল হিমু দত্ত, সে হিসাব দেখে পরেশবাবুও আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ছি—ছি, তুমি একি কাণ্ড করেছ হিমু? তোমাকে এতটা কষ্ট সহ্য করতে আমি বলিনি।

অনুযোগ করলেন পরেশবাবু। কারণ পাই-পয়সা পর্যন্ত মিল ক’রে পথের খরচের যে হিসাব দিল হিমু দত্ত, তাতে দেখা গেল যে, সাতদিনের মধ্যে হিমু দত্তের নিজের খাওয়া বাবদ মাত্র তিন টাকা খরচ হয়েছে।

হিমু দত্ত নিজেও এক গাল হেসে বলতে থাকে।— আমি হেলথ, সম্পর্কে খুব সাবধান থাকি বড়দা। কলকাতা থেকে দু’সের চিনি আর তিন সের চিঁড়ে কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। বাস, তাতেই আমার খোরাক হয়ে গিয়েছে। আমি মেলার কোন খাবারই ছুইনি। পিসিমা বরং দই-টই খেয়েছেন। আমার বেশ ভয়ই হয়েছিল বড়দা, দই-এর লোভে পিসিমা শেষে একটা কাণ্ড না করে বসেন। ভাগ্যি ভাল, দইটা ভাল ছিল, পিসিমার শরীরে সয়ে গিয়েছিল।

পরেশবাবুর পিসিমাকে গঙ্গাসাগর দেখিয়ে আনবার পর হিমু দত্তকে যেন নতুন ক’রে চিনতে পারলেন পরেশবাবু। শুধু পরেশবাবু কেন, অনেকেই; তারপর প্রায় সবাই।

একেবারে মাটির মানুষ, অত্যন্ত সৎ প্রকৃতির ছেলে হিমু দত্ত। পরেশবাবু একদিন ক্লাবে বসে ননীবাবুর সঙ্গে গল্প করতে করতে বলেই ফেললেন— হিমুর মত গুড-নেচার্ড ছেলের হাতে যে-কোন দায়িত্ব অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারা যায়। ওর হাতে ক্যাশবাক্সের চাবি ছেড়ে দেওয়া যায়। পাই-পয়সার এদিক-ওদিক হবে না।

ননীবাবু বলেন— তাহ’লে হিমুকেই ডেকে কাজের ভারটা চাপিয়ে দিই, কি বলেন না?

—নিশ্চয় নিশ্চয়। মাথা নেড়ে প্রস্তাবটা সমর্থন করেন পরেশবাবু।

এবং আর দুদিন পরেই দেখা গেল, ননীবাবুর মেয়ের বিয়ের জন্য জিনিস কিনতে কলকাতায় চলে গেল হিমু দত্ত। বাসনপত্র, অলঙ্কার, কাপড়-চোপড় আর শয্যা দ্রব্য, সবসুদ্ধ প্রায় তিন হাজার টাকার বাজার করবার দায়িত্ব অনায়াসে হিমু দত্তের উপর ছেড়ে দিলেন ননীবাবু। সবসামগ্রী নিয়ে দু’দিন পরে যখন ফিরে এল হিমু দত্ত, তখন সব চেয়ে আগে খুশি হয়ে আর আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ননীবাবুর স্ত্রী-হিমুর পছন্দ আছে বলতে হবে! কী সুন্দর ডিজাইনের গয়না! তোমার চোখ আছে, রুচি আছে হিমু। আমি নিজে কলকাতা গেলেও এরকম পছন্দ করে সুন্দর জিনিস কিনতে পারতাম না।

পাই পয়সা মিলিয়ে হিসাবও দিয়ে দিল হিমু। ননীবাবু আশ্চর্য হয়ে বলেন—একি হিমু, তোমার খাওয়া দাওয়ার কোন খরচ নেই কেন?

হিমু হাসে—খরচ হয়নি। আমার ছেলেবেলার বন্ধু কানাই-এর সঙ্গে ট্রেনে দেখা হয়ে গেল। কলকাতাতে কানাইদের বাড়িতেই ছিলাম। কাজেই…

ননীবাবু বলেন—যাই হোক, তোমার হাতখরচ বাবদ যদি দশটা টাকা তুমি রাখতে, তাহলে ভালই হতো হিমু।

হিমু আরও লজ্জিত হয়ে হাসে—কি যে বলেন মেসোমশাই!

ননীবাবুর স্ত্রী এবার ননীবাবুরই মুখের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন—ছি, ছি। তুমি হিমুকে কি পেয়েছ; কি বলছো তুমি?

ননীবাবু—কেন? অন্যায় কিছু বলছি কি?

ননীবাবুর স্ত্রী বলেন—হিমু কি তোমার মত ইন্‌সপেক্টর যে টুরে বের হয়ে ব্রাঞ্চ অফিসের বাবুদের বাড়ীতেই দুবেলা চব্য-চোষ্য গিলবে, আর কোম্পানির কাছে খোরাকী বাবদ বিশটাকা বিল দাখিল করবে? ননীবাবু ভ্রূকুটি করেন—তুমি আবার হঠাৎ এসব আবোল তাবোল কথা তুলে …

হিমু দত্তই এইবার ননীবাবুর স্ত্রীর মুখের দিকে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে অনুযোগ করে—ছিঃ, আপনি এসব কি বলছেন মাসিমা!

শহর থেকে দূরে যাবার কাজ পড়লেই, একদিন বা দুদিনের জন্য বাইরে যাবার দরকার পড়লেই হিমু দত্তের কথা সবারই মনে পড়ে।

ননীবাবুর এই মেয়ের বিয়েতে জামালপুরে গিয়ে বরের বাড়ীতে অধিবাসের তত্ত্ব পৌঁছে দেবার দায়িত্ব হিমু দত্তকেই বহন করতে হয়েছিল। অধিবাসের জিনিস দেখে বরের বাড়ীর মেয়েরা নাক কুঁচকেছিল, অনেক কটু কথাও শুনিয়েছিল। সবই শুনেছিল হিমু দত্ত, কিন্তু এই সামান্য কথাটাও বলতে পারেনি যে, আমাকে এসব কথা শুনিয়ে লাভ কি? আমি মেয়ের বাড়ীর কেউ নই।

এই অপমান সহ্য করবার দায়িত্বটাও অনায়াসে পালন করতে পেরেছিল হিমু দত্ত। বরের বাড়ির মন্তব্যগুলিকে তুচ্ছ করতে পারেনি হিমু দত্ত। ননীবাবুর অপমানকে পরের অপমান বলেও মনে করতে পারেনি। অদ্ভুত এই হিমু দত্তের মন; বরং সেই অপমানকে যেন ভাল করে গায়ে মেখে, যেন ননীবাবুর মেয়ের দাদাটির মত ভীরু হয়ে কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে বরের মায়ের কাছে হাতজোড় করে দাড়িয়ে ক্ষমা চেয়েছিল হিমু দত্ত।—ত্রুটি হয়েছে, স্বীকার করছি, নিজগুণে মার্জনা করুন।

ননীবাবুর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর, অনেকদিন পরে এই ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন ননীবাবু ও তাঁর স্ত্রী। হিমু দত্ত বলেনি। বরং বরের বাড়ির চাল-চলন আচার-ব্যবহারের অনেক প্রশংসা করেছিল হিমু—চমৎকার ভদ্রলোক ওঁরা।

ননীবাবুর মেয়ে নিজেই যেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে প্রথম বাপের বাড়ি এল, সেদিন মেয়ের মুখ থেকেই ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলেন ননীবাবু ও তাঁর স্ত্রী। খুব বেশী আশ্চর্য হয়েছিলেন দুজনেই, হিমু দত্তের মনটা কি মানুষের মন? মানুষ এত ভালও হয়? পরের জন্য মানুষ এতটা সহ্যও করে?

হিমুকে ডেকে ননীবাবু হিমুর উপর বেশ রাগ করে বলেছিলেন —ওসব কথা সহ্য করা তোমার খুবই ভুল হয়েছে হিমু। ওদের মুখের উপর শক্ত করে দু’চারটে কথা তোমারও বলে দেওয়া উচিত ছিল। তাতে যদি বিয়ে ভেঙে যেত, তবে যেত। আমি কোন পরোয়া করতাম না।

চোখের ছানি অপারেশন করবার জন্য পাটনা যাবার কথা ভেবে যেদিন দুশ্চিন্তা করেছিলেন অনাথবাবু, সেদিন অনাথবাবুর ছেলে মন্টু ই অনাথবাবুকে মনে পড়িয়ে দিল—ভাবছো কেন বাবা?

অনাথবাবু—ভাবতে হচ্ছে রে মন্টু। আসানসোলে হারুকে লিখেছিলাম: কিন্তু হারু জানিয়েছে, এখন ছুটি পাবে না। আসতেই পারবে না। হারুর এখন ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষা।

মন্টু বলে— হিমুদাকে একবার বললেই তো…

—হ্যাঁ হ্যাঁ! মন্টুর মা’ও খুশি হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন!—হিমু থাকতে ভাবনা করছো কেন?

অনাথবাবুরও মনে পড়ে যায়, ঐ হিমুই যে এই গত মাসে নিত্যানন্দবাবুর ছেলেটার কার্বঙ্কল অপারেশন করাবার জন্য ছেলেটাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল। নিত্যানন্দবাবু নিজে বাতের ব্যথায় অনড় হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। বাড়িতে দ্বিতীয় একটা মানুষ নেই যে ছেলেটাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে পারে। একটা কার্বঙ্কল রুগীকে ভালভাবে নিয়ে যাওয়াও তো যা-তা কাজ নয়। তা ছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যে-জন্য নিত্যানন্দবাবুর মেজ শ্যালক মশাই এত কাছে, ঐ জগদীশপুরে থাকতেও এই দায়িত্বটি নিতে রাজি হলেন না। নিজের শরীরের অসুখের ছুতো করে কাজের দায় এড়িয়ে গেলেন। কে জানে, অপারেশনের পর কি হবে পরিণাম? ছেলেটা যদি মরে যায়? যদি নিয়ে যাবার পথেই ছেলেটার মরণ-টরন হয়ে যায়, তবে? তবে ছেলের বাপ-মা’র সন্দেহ অভিশাপ আর খোঁটা যে সারা জীবন সহ্য করতে হবে। এ ধরণের ভয়ানক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে না যাওয়াই ভাল।

নিত্যানন্দবাবুর কাছেই শুনেছিলেন অনাথবাবু — হিমু না থাকলে আমার ছেলেটা মরেই যেত অনাথবাবু। আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি যে, হিমু এই ভয়ানক দায়িত্ব নিতে রাজি হবে। কিন্তু, কি আশ্চর্য, একবার অনুরোধ করা মাত্র হিমু রাজি হয়ে গেল। আরও কি কাণ্ড করেছিল হিমু, জানেন?

—কি কাণ্ড?

—অদ্ভুত রেসপন্সিবিলিটি বোধ! হাসপাতালের ডাক্তারদের ধরাধরি করে স্পেশ্যাল পারমিশন নিয়ে দশটা দিন হাসপাতালেরই ওআর্ডের বারান্দায় কম্বল পেতে একটা ঠাঁই করে নিয়েছিল হিমু। ছেলেটার কাছ থেকে একঘণ্টার জন্যেও দূরে সরে থাকতে পারেনি।

অনাথবাবুর আহ্বান, একটা অন্ধ মানুষকে পাটনা পর্যন্ত নিয়ে যাবার আহ্বান! তার মানে সব সময় অনাথবাবুকে হাত ধরে ওঠাতে বসাতে আর চলাতে হবে। মন্টুর মা কেঁদেই ফেলেছিলেন —তুমি পারবে তো হিমু?

হিমু বলে—পারি কিনা দেখতেই পাবেন।

মন্টুর মা’ও সঙ্গে ছিলেন, এবং গিরিডি থেকে পাটনা পর্যন্ত সারাটা পথ যেতে যেতে স্বচক্ষেই দেখতে পেয়েছিলেন, হিমু নামে এই ছেলেটা পরের জন্য, অকারণ এবং কোন উপকার আশা না করে, একটা পয়সা না ছুঁয়েও কি করতে পারে।

ঘন ঘন সিগারেট খাওয়া অভ্যাস আছে অনাথবাবুর। মন্টুর মা নিজেই দেখলেন, যতবার সিগারেট খেলেন অনাথবাবু, ততবার হিমুই দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাতে সাহায্য করলো। হিমুই অনাথবাবুকে সাবধান করে দেয়—খবরদার জেঠামশাই, নিজে দেশলাই জ্বেলে সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করবেন না। মুখে ছেকা লেগে যাবে। যখনই দরকার হবে, আমাকে বলবেন।

হিমু দত্তেরই-বা এত সময় হয় কি করে? ওর জীবনটা কি একটা অফুরান অবসরের, কিংবা খাওয়া-পরার ভাবনা থেকে মুক্ত একটা নিরুদ্বিগ্ন কর্মহীন জীবন? দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে ছোট কাঠের ফলকে ওর নামের সঙ্গে ওর একটা কাজের পরিচয়ও যে লেখা আছে। ডাক্তার, ডাক্তার হিমাদ্রিশেখর দত্ত। কিন্তু ডাক্তারী করে কখন? কেউ কি আজ পর্যন্ত হিমু দত্তকে কোনদিন ডাক্তারী করতে দেখেছে? হিমু দত্তের ঘরের ভিতর একটা তক্তাপোষের উপর হোমিওপ্যাথি ওষুধের একটা বাক্স অবশ্য আছে, চিকিৎসার একটা বইও আছে। এই দুই জিনিস অনেকেরই চোখে পড়েছে। কিন্তু রোগী দেখছে হিমু দত্ত, কিংবা রোগীকে ওষুধ দিচ্ছে হিমু দত্ত, এমন দৃশ্য আজ পর্যন্ত কারও চোখে পড়েনি।

কে না জানে, চার বাড়িতে ছেলে পড়ায় হিমু দত্ত। সকাল বেলা দু’বাড়ি, সন্ধ্যাবেলা দু’বাড়ি। হিমু দত্তের বিদ্যের জোর কত আর কেমন, এ প্রশ্নও কেউ করেনি। হিমু দত্ত যাদের পড়ায়, তাদের বয়স চার-পাঁচ বছরের বেশি নয়, বিদ্যে নামে কোন বস্তুই যাদের মনে মাথায় বা চোখের চাহনিতে নেই। ছেলে-মেয়েদের বয়স যখন সাত-আট হয়, এবং ছেলে-মেয়েদের বিদ্যে শেখাবার জন্য বাপ-মায়েরা যখন সত্যিই সিরিআস হন, তখন শুধু হিমু দত্তকে ছাড়িয়ে দিয়ে একটু ভাল শিক্ষিত মাস্টার রাখবার কথা মনে পড়ে। হিমু দত্তকে তখন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেজন্য হিমু দত্তের মনে কোন দুঃখ নেই। কারণ, সেইদিনই অন্য এক বাড়িতে একেবারে বিদ্যাশূন্য এবং শুধু হাতে-খড়িতে অভিজ্ঞ চার-পাঁচ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েকে পড়াবার নতুন একটা কাজ পেয়ে যায় হিমু দত্ত!

তাছাড়া, হিমু দত্ত সত্যিই পড়ায় কিনা, সেটুকু খোঁজ রাখার দরকারও যেন কোন বাপ-মা অনুভব করেন না। ছেলে-মেয়ে কটা নতুন বানান শিখলো, এবং দু-এর ঘর নামতাটুকু আয়ত্ত করলো কিনা, মাস্টার হিমু দত্তের কাছে এই সামান্যতম দাবীর প্রশ্নও যে কারও নেই। ছেলে-মেয়েগুলো দুটো ঘণ্টা হিমু দত্ত নামে মাস্টারের কাছে চুপ করে বসে থাকে, তাই যথেষ্ট। পড়ার অভ্যাসটা গড়ে উঠছে, এখন এর চেয়ে বেশি আর দরকারই বা কি?

কাঠের ফলকে ডাক্তার কথাটা এত স্পষ্ট করে লেখা থাকলেও হিমুকে কোনদিন ডাক্তার বলে ভাবতেই পারেনি শহরের মানুষ, বিশেষ করে ভদ্রলোকেরা। বরং হিমু মাস্টার বললে সকলেই বুঝতে পারে, ঐ সেই ছেলেটি, দেখতে মন্দ নয়, স্বভাবটি বড় শাস্ত, বড় কর্মঠ, আর কেমন একটু, অর্থাৎ ঠিক বোকা নয়, একটু বোকা-বোকা। অর্থাৎ খুব বেশি ভালমানুষ হলে যা হয়, তাই।

হিমু দত্তের ডাক্তারীটা কি সত্যিই একেবারে অস্তিত্বহীন একটা কথা মাত্র? ভদ্রলোকেরা জানেন না, কিন্তু বস্তির কেউ-কেউ, মুচিপাড়ার অনেকেই, এবং শহর থেকে বেশ দূরে কয়েকটা গাঁয়ের তুরী আর দোসাদদের মধ্যে কেউ-কেউ জানে, একটা টাকা হাতে তুলে দিলে কোন আপত্তি না করে হিমদারিবাবু ডাগদারি ক’রে চলে যাবে। হেঁটেই চলে আসবে; টাঙ্গা ভাড়া চাইবে না। ওষুধ দিলে বড় জোর ছয় আনা দাম চাইবে, তার বেশি নয়।

কিন্তু হোমিও হিমু কোন রোগীকে সত্যিই ওষুধ খাওয়াবার সুযোগ পেয়েছে কিনা সন্দেহ। যারা ডাগদারির নামে ভয় পায়, ডাগদারিকে ভয়ানক সন্দেহ করে, যাদের ডাগদারিতে কোন বিশ্বাস নেই, তারাই শুধু হোমিও হিমুকে ডাক দেয়। ভুগে ভুগে মরণদশার শেষ অধ্যায়ে পৌঁছে রোগী যখন থেমে থেমে শ্বাস টানে, তখন ডাক পড়ে হোমিও হিমুর। আর, হিমু দত্ত একেবারে তৈরি হয়েই রওনা হয়। পকেটে ওষুধের শিশি থাক বা না থাক, একটি লুঙ্গি আর একটি গামছা সঙ্গে নিয়ে যেতে কখনও ভুলে যায় না হিমু দত্ত। জানে হিমু দত্ত, রোগীর মরা মুখ দেখতে হবে; মৃতের শ্মশানযাত্রা এবং দাহকার্যে একটু আধটু সাহায্য করে এবং একে-বারে স্নান সেরে আসতে হবে।

এক বছর আগেও এই গিরিডির কোন পাড়াতে হিমু দত্তকে ঘুরে বেড়াতে কেউ দেখেনি। কবে হিমু দত্ত এখানে এল, আর লোহার পুলের পূর্বদিকের ঐ সরু রাস্তার ধারে একটা ঘরে ঠাঁই নিল, তাও কেউ মনে করতে পারেনা। কোথা থেকে এসেছে হিমু দত্ত, তাও কেউ জানে না।

হিমু দত্ত একটা হঠাৎ আবির্ভাব। দরজার পাশে ঐ প্রকাণ্ড নামের ফলক দেখে প্রথম প্রথম যারা আশ্চর্য হয়ে খোঁজ নিয়েছিল, তারাও আজকাল আর আশ্চর্য হয় না। মানুষটা নামেই প্রকাণ্ড, কিন্তু জীবনে একেবারে সামান্য। ডাক পিয়নও আশ্চর্য হয়ে যায়। পাড়ার সব মানুষের নামে মাসে অন্তত একটা না একটা চিঠি আসে, কিন্তু হোমিও হিমুর নামে একটাও না। আপন জন বলতে পৃথিবীতে ওর কি কেউ নেই?

আরও আশ্চর্যের কথা, এক বছরের মধ্যে শহরের এতগুলি মানুষের ঘরোয়া জীবনের সঙ্গে এত পরিচিত হয়ে উঠলেও হিমু যেন একটা একঘরে প্রাণীর মত পড়ে আছে। কেউ একবার জানতেও চেষ্টা করেনি, একটা প্রশ্নও করেনি, তুমি এর আগে কোথায় ছিলে হে হিমু? তোমার দেশ কোথায়? বাপ-মা কোথায় আছেন? সত্যিই আছেন কি? না, বিগত হয়েছেন? ছোট ভাই-বোন আছে কি? বিয়ে-টিয়ে করে ফেলেছ কি?

কেউ না, এই এক বছরের মধ্যে হিমু দত্ত কোন মানুষের কাছ থেকে এতটুকু কৌতূহলও আকর্ষণ করতে পারেনি। হিমু দত্ত শুধু হিমু দত্ত। ভাড়া ঘরে থাকে, আপন ঘর নেই। কিন্তু এপাড়া আর ওপাড়ার সব ঘরই যেন ওর ঘর। কেউ একবার ডেকে একটা কথা বললেই হিমুর মুখের ভাষায় সেই ব্যক্তি সেই মুহূর্তে একটা না একটা আপনজন গোছের মানুষ হয়ে যায়। হয় কাকাবাবু, মেসোমশাই, জেঠামশাই আর পিসেমশাই, কিংবা মামাবাবু। নয়, বড়দা মেজদা সেজদা ও ছোড়দা। ঠাকুমা ও দিদিমা পাতিয়ে ফেলতেও একটুও দেরি হয় না হিমু দত্তের।

ওভার্সিআর বাবুর মা হিমু দত্তকে চিনতেন না। পথে দেখা হতে তিনিই একদিন ভুল করে ডাক দিয়ে বলেছিলেন— তুমি তো আমাদের টুনকির ভাসুরপো?

সেই মুহূর্তে উত্তর দিয়েছিল হিমু দত্ত—না দিদিমা, আমি হিমাদ্রি।

—তুমি বারগণ্ডায় থাক?

—না। আমি ওদিকের ঐ লোহার পুলের দিকে থাকি।

— বলি, তুমি কি গিরিডির ছেলে?

—হ্যাঁ, এখন তো তাই।

—কি আশ্চর্য, হিমাদ্রি টিমাদ্রি নাম তো কখনো শুনিনি।

হিমু দত্ত হাসে—আমি হিমু।

চোখ বড় ক’রে হেসে ওঠেন দিদিমা— তাই বল। তুমিই হিমু?

—হ্যাঁ দিদিমা।

—তা হলে আমার একটু কাজ করে দে না ভাই।

—বলুন!

—আজ সন্ধ্যায় একবারটি এসে আমাকে মকতপুরে সান্যালদের বাড়িতে কীর্তন শুনিয়ে নিয়ে আসবি। রাত্রিবেলা আমি চোখে বড় ঝাপসা দেখি রে ভাই, একা পথ চিনে বাড়ি ফিরতে পারি না।

—বেশ, কিন্তু আপনি কোথায় থাকেন দিদিমা?

—ওরে আমি যে হাবুল ওভার্সিআরের মা।

—ঠিক আছে।

হ্যাঁ, ঠিক যেমন স্পষ্ট করে কথা দিয়েছিল হিমু, তেমনি একেবারে ঠিক সময়ে এসে প্রতিশ্রুতি পালন করে চলে গিয়েছিল।

মকতপুরের সান্যালদের বাড়ি থেকে কীর্তন শুনে বাড়ি ফেরবার পথে দিদিমা অনেক গল্প করলেন। —হাবুলের বাবা বেঁচে থাকলে আজ আর আমাকে হেঁটে পথ চলতে হতো না ভাই। তিনি ছিলেন ঝুমরা রাজ এস্টেটের ম্যানেজার। কত টাকা রোজগার করলেন, আর দান ক’রে ক’রে ফতুর হলেন। মোটর গাড়িটাকে পর্যন্ত বেচে দিয়ে বাংলাদেশের বন্যার চাঁদা পাঠিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, তবে, এমন কিছু দুঃখের মধ্যে রেখে যাননি। মেয়েদের বড় বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়েরা আমাকে সাহায্য করে। সুষমা আছে কলকাতায়, ধীরা কানপুরে আর অনিলা জামসেদপুরে। অনিলা এখন পোয়াতি; এদিকে জামাই-এর বদলির অর্ডার হয়েছে। বল দেখি, কি বিপত্তি!

দিদিমা তাঁর ঘরোয়া জীবনের কাহিনী শেষ করলেন, যখন ঘরের দরজার কাছে পৌঁছলেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে ভুলেই গেলেন; হিমু নামে এই মানুষটার ঘরোয়া সুখ দুঃখের কোন সংবাদ, কোন পরিচয়। মনেই পড়ে না কারও, হিমু দত্তেরও কোন দুঃখ থাকতে পারে, কিংবা হিমু দত্তেরও জীবনের হয়তো একটা সুখের ইতিহাস আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, হিমু দত্তকে কি সত্যিই একেবারে সুখ-দুঃখের অতীত একটা স্বয়ম্ভূ সত্তা বলে মনে করে সবাই?

শহরের জীবনে সারা বছরের মধ্যে অনেক উৎসবও দেখা দেয়। পারিবারিক উৎসব। অমুকের মেয়ের বিয়ে। অমুকের ছেলের বৌ-ভাত। কিংবা অমুকের বাবার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে ভোজের নিমন্ত্রণ। কিন্তু হিমু দত্ত সবারই এত পরিচিত হয়েও কি সব উৎসবে নিমন্ত্রণ পায়? না। ননীবাবুর মেয়ের বিয়েতে অবশ্যই নিমন্ত্রিত হয়েছিল হিমু দত্ত। এবং মন্টুর পৈতের সময় অনাথবাবু নিজে হিমু দত্তের ঘরে এসে নিমন্ত্রণ করে গিয়েছিলেন। যাদের কাজের দরকারে হিমু দত্ত খেটেছে, তাদের কোন উৎসবের দিনে তারা হিমু দত্তকে স্মরণ করতে ভুলে যায় না। কিন্তু তা ছাড়া আর কেউ না। এই তো গত ফাল্গুন মাসে মাইক মার্চেন্ট রামসদয়বাবু তাঁর মা-এর শ্রাদ্ধের ঘটা দেখাতে গিয়ে গর্ব করেই বলেছিলেন, গিরিডির একটি বাঙ্গালীও নিমন্ত্রণে বাদ পড়বে না। আর এক প্রকাণ্ড লিস্ট ক’রে রামসদয়বাবুর চার ছেলে গিরিডির সব পাড়া ঘুরে প্রত্যেক বাঙ্গালীকে, বাড়িসুদ্ধ সবাইকে নিমন্ত্রণ ক’রে এসেছিল। এমন কি ডাক বাংলাতে, ধর্মশালাতে, আর হোটেলগুলিতেও খোঁজ নেওয়া হয়েছিল, কোন বাঙ্গালী সেখানে আছে কিনা। যারা ছিল, তারা সবাই নিমন্ত্রিত হয়েছিল। পোস্ট মাস্টার নাগেশ্বরবাবু, যিনি বিহারী কায়স্থ, কিন্তু গৃহিণী হলেন বাঙ্গালী মহিলা, তিনিও নিমন্ত্রিত হলেন। অথচ লোহাপুলের পূর্বদিকের সরু সড়কের ধারে একটি ক্ষুদ্র ঘরের দরজার পাশে দেওয়ালের গায়ে কাঠের ফলকের উপর লেখা এত বড় একটা বাঙ্গালী নাম কারও চোখেই পড়লো না। বাদ পড়লো শুধু হোমিও হিমু।

রাগ করেনি হিমু দত্ত। এর জন্য কোন ক্ষোভ আর কোন অভিমানে বিচলিত হয়নি হিমু দত্তের মন। সন্দেহ হতে পারে, হিমু দত্ত নিজেকে বাঙ্গালী বলে মনে করে কিনা।

যাই মনে করুক হিমু, কিন্তু হিমু দত্তের স্বভাব আর আচরণ যে বাঙ্গালী অবাঙ্গালী প্রভেদটুকুর ধার ধারে না, তার প্রমাণও একদিন পাওয়া গেল।

নবলকিশোরবাবু ওকালতী করেন। গোঁড়া সনাতনী মানুষ। অনেকদিন আগে সরদা আইনের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ করবেন বলে তৈরি হয়েছিলেন। এ হেন মানুষও এমন এক সমস্যায় পড়লেন, যে-সমস্যার সমাধানে তিনি শেষ পর্যন্ত হিমু দত্তকেই স্মরণ করতে বাধ্য হলেন।

নবলকিশোরবাবুর মেয়ে কৃষ্ণা। কৃষ্ণাকে বার বছর বয়সেই বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন নবলকিশোরবাবু, কিন্তু কৃষ্ণার মা’র কঠোর আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত উৎসাহ হারিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কৃষ্ণার লেখাপড়া শেখার চেষ্টাকেও বাধা দিতে পারেননি, কৃষ্ণার মা’র জেদের জন্যই। কৃষ্ণার মা’র আর একটা শখ, মেয়েকে শান্তিনিকেতনে পড়াবেন। কৃষ্ণার মা’র এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করে শেষে শাস্ত হয়ে গেলেন নবলকিশোরবাবু।

কৃষ্ণার বয়স সতর-আঠার, দেখতে বেশ বড়-সড়, এবং সেটা ভাল স্বাস্থ্যের জন্যই। এই মেয়েকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দিয়ে আসবে কে?

নবলকিশোরবাবু নিজে যেতে পারবেন না। ট্রেনে চড়লেই তিনি বমি করে ফেলেন। শরীর ভয়ানক অসুস্থ হয়ে যায়। কৃষ্ণার কাকা বা দাদা কেউ গিরিডিতে নেই, নিকটেও নেই। দু’জনেই আর্মড ফোর্সের সার্ভিসে পুনাতে আছে। অতএব?

এক্ষেত্রে কৃষ্ণার মা’র উদারতাও ভয়ানক সাবধান। জুনিঅর উকিল আউধবিহারী নিজেই যেচে নবলকিশোরবাবুর কাছে প্রস্তাব করেছিল, যদি দরকার মনে হয়, তবে আমিই কৃষ্ণাকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। কৃষ্ণার মা বললেন — না।

সম্পর্কে আত্মীয় হয়, ব্রিজমোহনবাবুর ছেলে দেবকীছলালের কথাও মনে পড়েছিল। না, কৃষ্ণার মা বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে আপত্তি করলেন। এবং কৃষ্ণার মা নিজেই একদিন মন্দির থেকে ফিরে এসে নবলকিশোরবাবুর কাছে বললেন—মন্টুকা মা কহতি হ্যায় কি…

—কি? কেয়া কহতি হ্যায়? প্রশ্ন করেন নবল কিশোরবাবু।

কৃষ্ণার মা বলেন—কহতি হ্যায় কি হিমুকো বোলো। বস্, আউর কুছ সোচনে কা বাত নেহি।

কৃষ্ণাকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিয়ে আসুক হিমু। হিমুকে ডাকা হোক। হিমু নামে ছেলেটির মতিগতি সম্বন্ধে কৃষ্ণার মা’র এই অদ্ভুত নির্ভয় নির্ভরতা আর বিশ্বাসের রকম দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন নবলকিশোরবাবু। কিন্তু রাজি হলেন।

কৃষ্ণাকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছে দিয়ে হিমু যেদিন ফিরে এসে নবল কিশোরবাবুর সঙ্গে দেখা করলো আর যাওয়া-আসার খরচের হিসাব দাখিল করলো, সেদিন একেবারে অবাক হয়ে হিমুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন নবলকিশোরবাবু। তারপর বললেন—এ বেটা, তু নে এ কেয়া কিয়া?

হিমু বলে—কি করেছি চাচাজী?

হিসাব দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন নবলকিশোরবাবু। কৃষ্ণা ট্রেনের ডাইনিং কারে গিয়ে দু’বার খাবার খেয়েছে। খরচ পড়েছে ছ’টাকা দশ আনা। আর, হিমু যেতে আসতে শুধু চারবার পুরি-তরকারী খেয়েছে, খরচ হয়েছে দেড় টাকা।

নবলকিশোরবাবু—তু বেটা এক পিয়ালি চা ভি নেহি পিয়া?

—আমি চা খাই না চাচাজী।

শান্তিনিকেতন থেকে কৃষ্ণার প্রথম চিঠি পাওয়ার পর নবলকিশোরবাবুর সনাতনী চোখের শেষ সন্দেহের লেশটুকুও যেন প্রচণ্ড খুশির চমক লেগে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কৃষ্ণার মা বলেন—অব্ বোলো, অ্যায়সা লেড়কা দেখা কভি?

কৃষ্ণা লিখেছে, হিমু ভাইজীকে আমার বহুৎ বহুৎ নমস্কার জানাবে। পথে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। হিমু ভাইজী আমাকে একটুও কষ্ট পেতে দেয়নি। যতবার আমার জল তেষ্টা পেয়েছে, ততবার নিজে ব্যস্তভাবে ছুটে গিয়ে গার্ডের কামরা থেকে ভাল জল নিয়ে এসেছে; আমাকে পানিপাড়ের হাতের ময়লা জল খেতে দেয়নি।

হিমু দত্ত নামে মানুষটার আত্মা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা বোধহয় একটা আত্মা মাত্র। না বাঙ্গালী, না বিহারী, না অন্য কিছু। নবলকিশোরবাবু না, কৃষ্ণার মা’ও না, দু’জনের কেউ মনে করতেই পারেন না যে, হিমু দত্ত বিহারী নয়, বাঙ্গালী।— হিমু তো বিলকুল হিমুহি হ্যায়।নবলকিশোরবাবু আশ্চর্য হয়ে যে অর্থহীন কথাটা বলেন, সেটাই বোধহয় হিমুর সব চেয়ে সার্থক পরিচয়।

কৃষ্ণার মা’র কাছ থেকেই গল্পটা, অর্থাৎ কৃষ্ণার চিঠির কথাগুলি শুনতে পেলেন মন্টুর মা। তারপর আরও অনেকে শুনলেন। হিমুর কাছে বিশ্বাস করে কিনা ছেড়ে দেওয়া যায়? নইলে নবলকিশোরবাবুর মত গোঁড়া মানুষ তাঁর মেয়েকে, কৃষ্ণার মত একটি সুন্দর আঠার বছর বয়সের মেয়েকে নিশ্চিন্ত মনে হিমুর কাছে ছেড়ে দিতে পারতেন না।

হিমু দত্তের একটা নতুন সুখ্যাতি অনেকেরই মুখের কথায় গুনগুন করে। বড় ভাল ছেলে। একেবারে নির্দোষ স্বভাব। এবং পূজোর ছুটির পরে হিমুর এই সুখ্যাতির গল্পটা অনেকেই স্মরণ করতে বাধ্য হয়। কারণ, সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক বাড়ির সমস্যা নয়, এপাড়া আর ওপাড়া নিয়ে পাঁচ বাড়ির সমস্যা। নিভার বাবা ভাবেন, প্রমীলার মা ভাবেন, সরযূর দাদা ভাবেন, কল্যাণীর মামা ভাবেন, এবং অতসীর কাকিমা ভাবেন। মেয়েগুলিকে কলকাতায় পৌঁছে দেবার সেই সমস্যাটা আবার কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে।

কলেজের ছুটির আগে এবং পরে, এই সমস্যাটা দেখা দেয়। এবং উপায় চিন্তা করতে করতে হয়রাণ হতে হয়। কোন বাড়ির বাপ-মা বা অভিভাবক, কেউই পছন্দ করেন না যে, মেয়েটা একা একা যাওয়া-আসা করুক। মেয়েরাও চায় না। ট্রেন যাত্রার হয়রানিকে ওরা ভয় করে। এবং একা একা যাওয়া-আসা করতেও ভয় করে। কে পৌঁছে দিয়ে আসবে? কে নিয়ে আসবে? কার এত সময় আছে? প্রত্যেকবার এই অসুবিধার প্রকোপে পড়ে মেয়েগুলির যাওয়া-আসার তারিখ পিছিয়ে দিতে হয়। ছুটি শেষ হয়, তবু নিভা কলকাতা রওনা হতে পারে না। কখনো ছুটি আরম্ভ হয়ে যায়, ছুটির চারটে দিন পার হয়ে যায়, কলকাতার ছাত্রী হোস্টেল থেকে প্রমীলার দুটো রাগন্ত চিঠি এসেও যায়, তবুও প্রমীলার মা মেয়েকে কলকাতা থেকে আনাবার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেন না।

কিন্তু এবছর পূজার ছুটি ফুরিয়ে যাবার দিনটাকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখেও চিন্তা করতে ভুলে গেলেন সবাই। কারণ, সবারই মনে পড়েছে, হিমু আছে। হিমু থাকতে চিন্তা করবার কি আছে?

সব মেয়ে এক কলেজে পড়ে না, এবং সবারই কলেজের ছুটি একই দিনে ফুরোয় না। কাউকে দুদিন আগে রওনা হতে হয়, কাউকে ছদিন পরে! সরযু যায় সবার শেষে।

এটাও একটা সমস্যা। হিমু কি দফায় দফায় কলকাতা দৌড়বে আর আসবে? পাঁচটি ছাত্রীই কি একত্র হয়ে হিমুর সঙ্গে যেতে পারে না?

ব্যবস্থা হয়, সবাই একই দিনে একই সঙ্গে যাবে। নিভাকে আর প্রমীলাকে সোজা হোস্টেলে তুলে দিয়ে হিমু অতসীকে মির্জাপুর স্ট্রীটের মাসিমার বাড়িতে, কল্যাণীকে বালিগঞ্জে বড়দির বাড়িতে, আর সরযূকে আলিপুরে ছোটমামার বাড়িত পৌঁছে দিয়ে আসবে।

তা তো হলো। কিন্তু হিমু কি সেদিনই কলকাতা থেকে গিরিডি ফিরে আসবে?

না। কল্যাণীর মামা বলেন—না! অতসীর কাকিমা বলেন—না। সরযূর দাদা বলেন—না। ‘তোমাকে আরও কয়েকটা দিন কলকাতায় থাকতে হবে হিমু। তুমি নিজে মেয়েটাকে একেবারে হোস্টেলে তুলে দিয়ে তারপর গিরিডি রওনা হবে।’

মেয়ে পৌঁছবার এই বিচিত্র জটিল দায় এক কথায় স্বীকার করে নিতে একটুও আপত্তি করে না হিমু।

হিমুদা! হিমুদা! হিমুদা! শহরের পাঁচ মেয়ের কলকাতা রওনা হবার দিন স্টেশনে বিচিত্র কলরবে মুখর একটা দৃশ্যও দেখা দিল।—হিমুদা আমার ব্যাগটা কোথায়? হিমুদা আমার ছাতাটা কোথায়? এক প্যাকেট লজেন্স নিতে ভুলবেন না হিমুদা।

ডাকটা হিমুদা বটে, এবং একটা আপনত্বের ডাকও বটে; কিন্তু সত্যিই দাদা বলে কেউ কি হিমুকে সম্ভ্রম করছে? হিমুর গায়ে ঠেলা দিয়ে কথা বলতেও প্রমীলার হাতে একটুও বাধে না। পাঁচটি ছাত্রীর কলকাতা যাত্রার উল্লাসের মধ্যে একমনে অবাধ নিষ্ঠার সঙ্গে শুধু ফাই-ফরমাস খাটতে থাকে হিমু। কেউ কারও জিনিস-পত্রের দিকে ভুলেও একটা পাহারার দৃষ্টি তুলে তাকায় না। এমনকি বাপ-মা কাকা মামা যাঁরা স্টেশনে এসেছেন, তাঁরাও না। তাঁরা মেয়েদের কানের কাছে উপদেশ বর্ষণ করতেই ব্যস্ত।—পৌঁছেই চিঠি দিবি। সাবধান, শীতটা পড়লেই গরম জলে স্নান করতে যেন ভুল না হয়।

বাক্স গোনে হিমু। খাবারের ঝুড়িগুলিকে গুনে একদিকে সরিয়ে রাখে হিমু। সরযূর ওভারকোট আর কল্যাণীর মাফলার হিমু দত্তেরই হাতে ঝুলছে। হাতের দিকে অতসী তার হাতের ছোট ব্যাগটাকেও এগিয়ে দেয়। ব্যাগ হাতে তুলে নেয় হিমু। অতসীও এইভাবে হাত খালি করে নিয়ে খোঁপাটাকে নাড়াচাড়া ক’রে একটু গুছিয়ে নেয়।

স্টেশনেই, এবং ট্রেন ছাড়বার আগেই পাঁচ মেয়ের দাবীর এই ব্যাপার! বাকি পথে তাহলে কি কাণ্ডই যে হবে অনুমান করতে পারেন বাপ-মা আর কাকা মামারা। ভাবতে গিয়ে হেসেও ফেলেন। আলোচনাও করেন, সত্যিই এরা হিমুকে পেয়েছে কি? ভাল মানুষ বলে একেবারে ওকে দিয়ে পান পর্যন্ত সাজিয়ে নেবে?

হিমু দত্ত যে একটা পুরুষ মানুষ, হিমু দত্তের জীবনের এই সহজ ও সামান্য সত্যটুকুও কি ওরা মনে রাখতে পারে না? কোন হিমিদির প্রতি ওদের মনে যেটুকু সমীহ আর ভয় থাকে, তার দশভাগের এক ভাগও যদি হিমুদা নামে এই পুরুষ মানুষটার প্রতি থাকতো! কিন্তু হিমু দত্তের সম্পর্কে কারও চিন্তায় এরকম কোন প্রশ্নেরই বালাই যেন নেই।

হিমু দত্তের বয়সটাও যে পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়, এই সত্যও যে এতগুলি মেয়ের মধ্যে কোন মেয়ে মনে রাখতে পারে না। প্রমীলার ওভারকোটের পকেটের মধ্যে একটা রুমাল রয়েছে, সেণ্ট মাখানো রুমাল। একটি মুহূর্তের মতও সাবধান হয়ে ভাবতে পারেনি প্রমীলা, ঐ রুমালের সৌরভ হিমু দত্তের নিঃশ্বাসের বাতাস স্পর্শ করতে পারে। সরযূ তার হাতের যে ছোট ব্যাগটা হিমু দত্তের হাতে তুলে দিয়েছে, সেই ব্যাগের গায়ের উপরেই খাঁজকাটা খাপের মধ্যে সরযূর মুখের ছোট একটা সুশ্রী ফটো বসান আছে। ভুলেও একবার ভেবে দেখতে পেরেছে কি সরযূ, হিমু দত্তের চোখের উপর ঐ ফটোর ছায়া হঠাৎ ঝিক করে ফুটে উঠতে পারে? কি মনে করে ওরা? হিমু দত্তও কি একটা মেয়ে? কিংবা, হিমু দত্ত একটা ব্যক্তি মাত্র, এবং ঐ ব্যক্তিত্বের কোন পৌরুষেয়তা নেই?

গিরিডি থেকে কলকাতা পর্যন্ত যেতে ট্রেনের সারাটা পথ হিমুদাকে দিয়ে ওরা কি সব কাণ্ড করিয়েছিল, সে গল্প আর তিন মাস পরেই বাড়ির সকলে শুনতে পেল; বড়দিনের ছুটিতে হিমুই আবার কলকাতায় গিয়ে ওদের যখন নিয়ে এল।

হিমুদা কমলালেবু ছুলে দিয়েছে, ওরা খেয়েছে। হিমুদা চীনাবাদামের খোসা ভেঙ্গে দিয়েছে, ওরা খেয়েছে। কাণ্ডগুলি করতে ওদের একটুও বাধেনি এবং হিমুরও একটুও আপত্তি হয়নি।

—হিমুদা বেচারা সত্যিই মাটির মানুষ। কি ভয়ানক উপদ্রৰই না আমরা করলাম, কিন্তু হিমুদা শুধু হেসে হেসেই সারা হয়ে গেল।

বড়দিনের ছুটিতে বাড়িতে এসে যে-ভাষায় যে-ভাবে হেসে হিমুদার নামে গল্প করে প্রমীলা, প্রায় সেই ভাষাতেই সে-ভাবে হেসে নিজের নিজের বাড়িতে গল্প করে সরযু, অতসী, নিভা আর কল্যাণী।

এ হেন হোমিও হিমুই একদিন চমকে উঠলো, যে নামে তাকে কেউ ডাকে না, সেই নামেই একজন তাকে ডেকে ফেলেছে। হিমাদ্রিবাবু! কি আশ্চর্য, হোমিও হিমু নিজেই যে নিজেকে হিমাদ্রিবাবু বলে মনে করতে ভুলে গিয়েছিল। কল্পনাও করতে পারেনি যে, এরকম একটা সম্ভ্রম মিশিয়ে তার নামটাকে ডাকা যায়, এবং কেউ ডাকতে পারে। তা ছাড়া, হিমাদ্রিবাবু বলে ডাকলো যে, তার বয়সও যে হোমিও হিমুর বয়সটার তুলনায় খুব কম নয়। হোমিও হিমুর বয়স বড় জোর পঁচিশ-ছাব্বিশ। হিমাদ্রিবাবু বলে ডাকলো যে, তার বয়স বড় জোর একুশ-বাইশ। হিমুদা নয়; এমন কি হিমুবাবুও নয়, একেবারে হিমাদ্রিবাবু। একটু বেশি আশ্চর্য হবারই কথা। কারণ, গিরিডিতে এই এক বছরের জীবনে, সব মানুষের সঙ্গে এত মেলামেশা জানাজানি ও চেনাচেনির ইতিহাসে, নিজেকে যে-নামে কোনদিন শুনতে পায়নি হোমিও হিমু, সেই নাম ধরে ডেকে ফেললো যে, সে একটি মেয়ে। বেশ বড়লোকের মেয়ে; বেশ সুন্দরী মেয়ে। বেশ শিক্ষিতা মেয়েও বলতে পারা যায়, কারণ সে এখন কলেজে সাএন্স পড়ছে; সেকেণ্ড ইআরে পৌঁছেছে।

সেই মেয়ের বাবা একটা সমস্যায় পড়েছেন বলেই হোমিও হিমুর জীবনে এই নতুন নামে ডাক শোনবার ঘটনাটা দেখা দিয়েছে, নইলে এরকম একটা ডাক বোধহয় জীবনে না-শোনাই থেকে যেত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *