৯
কিছুক্ষণ তাসের ম্যাজিক দেখিয়েছিল ও। বেশ হাসাহাসি হচ্ছিল। তারপর আমার স্বামীর দুর্মতি হলো, তিনি ওকে প্রশ্ন করলে—হ্যাঁ দুর্মতি ছাড়া আর কী? তাঁর তো ভাবা উচিত ছিল সাপের ল্যাজে পা দিলে কী হয়, শয়তানের মুখোশ খুলে দিলে কী হয়।…তা’ ভাবেননি, প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা রাজেন সরযূ নামের একটি মেয়েকে তুমি জানো?’
নন্দিতা যেন গ্রামোফোনের রেকর্ড।
একই কথা অজস্রবার অজস্রলোকের কাছে বলে চলেছে, একেবারে নির্ভুল। কমা সেমিকোলনের এদিক ওদিক হচ্ছে না। তার মানে সেই গোড়ার দিন থেকে বলতে শুরু করেছে, আর এই চার মাস ধরে বলেই চলেছে। যে আসছে, যে যেখানে আছে সবাইকে বলছে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সরযূ নামের একটি মেয়েকে জানো?’
হত্যাকারী উত্তেজিত গলায় বলে উঠলো, ‘সরযূ? কে সরযূ? আপনার—একথা বলার মানে?’…
আমার স্বামী অবাক হয়ে বললেন, ‘তা’ তুমি অত রাগ করছো কেন? জানো কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি।’
রাজেন বললো, ‘না সরষূ—টরযূ কাউকে চিনি না আমি। আর কখনো এভাবে কথা বলবেন না।’
আমার স্বামী আরো অবাক হলেন।
বললেন, ‘কথাটায় দোষের কি আছে? আমার এক ডাক্তার বন্ধু বলেছিল, সে নাকি মেছোবাজারের কোন একটা গলিতে সরযূ নামের একটা মেয়েকে চিকিৎসা করতে গিয়েছিল, তার ঘরে তোমার আর তার একত্রে ছবি দেখেছে। আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি, বললাম কাকে দেখতে কাকে দেখেছো। সে জোর দিয়ে বললো, তোমার ভগ্নিপতিকে আমি অনেকবার দেখেছি। পাড়াটা কিন্তু খারাপ মতো—
তখন ওই শয়তান লজ্জায় মাথা হেঁট না করে বলে উঠলো কি, ‘বাঃ দাদা বেড়ে। খাশা বন্ধু জুটিয়েছেন তো। তা’ সে সব পাড়ায় কি আর বন্ধু একা যায়? আপনাকেও নিশ্চয় সঙ্গে নিয়ে যায়। প্রাণের বন্ধু যখন।’
আমার স্বামী বলে উঠলেন, ‘শাট আপ।’
সঙ্গে সঙ্গে ওই শয়তান ট্রাউজার্সের পকেট থেকে রিভলবার বার করে—ওঃ আর আমি বলতে পারবো না। আমার মাথার শিরা ছিঁড়ে যাচ্ছে।’—
কিছুক্ষণ চুপ করে মাথার শিরাকে শান্ত করে নন্দিতা আবার বলে, ‘ওই শয়তানের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি নেই। আমি মরেও স্বস্তি পাবো না। ওর শাস্তিই আমার স্বামীর পারলৌকিক কাজ।’
বলে বলে এ কথাগুলোও মুখস্থ হয়ে গেছে নন্দিতার।…
তাছাড়া আরো মুখস্থ করাচ্ছেন তার দাদা, তার উকিল।
‘মহামান্য জজ বাহাদুর, আপনি ভেবে দেখুন, আমি একটি সাধারণ হিন্দুঘরের বৌ, আমার স্বামী আর কন্যা নিয়ে সুখে সংসার করছিলাম। আমাদের ঐশ্বর্য না থাক, সুখ ছিল। যেমন সুখে পাখিরা থাকে ছোট্ট বাসায়।… কিন্তু ওই লোকটা ঐশ্বর্যের অহংকারে মদমত্ত। মুহূর্তের রাগে নিষ্ঠুর ব্যাধের মতো আমার সেই বাসাটুকু ভেঙে দিল। আমি এখন রাস্তার ভিখারিণীরও অধম।… আমার সংসারে বৃদ্ধা শাশুড়ি, শিশুকন্যা, অথচ কোনো উপার্জনশীল লোক নেই।
আরো কত যেন কথা।
মন ভেজাবার মতো, প্রাণ গলাবার মতো, যত কথা মজুত থাকে ওই সব আইনজীবীদের কণ্ঠে, তারা সে সব কণ্ঠান্তরিত করছে দিনে দিনে, তিলে তিলে।
স্বামীশোকে উন্মাদিনী নন্দিতা পাছে ভুল—ভাল কিছু বলে বসে কোর্টে।
এইবার শেষের দিন ঘনিয়ে আসছে। বাইরের লোকের, পাড়াপ্রতিবেশীর চাকরের, কচি বাচ্চাটার, ডাক্তারের, সব সাক্ষ্য শেষ হয়েছে, এইবার মায়ের, বোনের, স্ত্রীর।
প্রথম নম্বর একবার হয়ে গেছে হয়ে গেছে পুলিশ অফিসারের কাছে, এখন, কোর্টে। দেখা যাক, একটি লাইনেরও এদিক—ওদিক হয় কিনা।
নন্দিতার দাদা আসে। একজন পাড়ার দাদাও আসে, তার নাকি এক উকিল বন্ধু আছে, সে আইনের মার—প্যাঁচ অনেক জানে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে সে, শোকে সান্ত্বনা দেয় হতাশায় আশা।
নন্দিতার চোখ দুটো তখনই শুধু একটু শান্ত দেখায়, তখনই যেন মনে হয় ভিতরের আগুনে আর কয়লা দেওয়া হচ্ছে না এখন।
নন্দিতা তাকেই শুধু বলে, ‘এতক্ষণ বসে রইলে মুকুলদা, একটু চা—ও খাবে না?’
মুকুল মৃদু হাসে, ‘এখন না। এখন খাবো না। এরপরে যখন তোমার সব ঝঞ্ঝাট মিটে যাবে, তখন খাবো।’
‘তখন? তখন হয়তো আমি আর বেঁচেও থাকবো না মুকুলদা।
‘বেঁচে? বলা বড়ো শক্ত নন্দিতা। হয়তো তখনই ভালো করে বেঁচে উঠবে, নতুন করে জ্বলে উঠবে।’
‘আমার মনে হয় আমি ফুরিয়ে গেছি।’
‘মানুষ কখনোই ফুরিয়ে যায় না নন্দিতা। একমাত্র মৃত্যুই পারে মানুষকে ফুরিয়ে দিতে, আর কেউ নয়—রোগ নয়, শোক নয়, দুঃখ, দৈন্য কিছুই নয়। মানুষ হল ‘অমর বৃক্ষ।’
নন্দিতা নিশ্বাস ফেলে।
নন্দিতা রুক্ষ চুলের গোছা পিছনে ঠেলে দেয়। পার্থর মৃত্যুর পর থেকে নন্দিতা আর চুল বাঁধেনি, চুলে তেল দেয়নি। ওর যেন দ্রৌপদীর প্রতিজ্ঞা।
নন্দিতা সেই রুক্ষ গোছা পিছনে ফেলে বলে, ‘ভাবলে তোমার অবাক লাগে না মুকুলদা? কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল?’
মুকুল সাবধানে বলে, ‘লাগে।’ তখন ভাবি, মানুষের ‘ভাগ্যবিধাতাই তো চিরদিন কোনো দিকে ‘ভাঙন’ দেন, কোনো দিকে ‘পলি’ পড়ান! কিন্তু তোমার ওই ননদের বরের ব্যাপারটা অদ্ভুত। বরাবর তোমার কাছে শুনে এসেছি লোকটা বোকা অহঙ্কারী বাজে চালিয়াৎ। এমন ভয়ঙ্কর নৃশংস চরিত্র, তা’ তো জানতাম না।’
‘জানা যায় না।’ নন্দিতা গম্ভীরভাবে বলে, ‘মানুষ যে কি, তাকে যথার্থ সময় ভিন্ন বোঝা যায় না। ওই বোকা চালিয়াতের খোলস এঁটে সংসারে ঘুরে বেড়াতো সে তার ভয়ঙ্করত্ব ঢেকে।…এক মিনিটে খুলে গেল খোলস, বেরিয়ে এল নৃশংস রাক্ষস।’
মুকুল একটু চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, ‘আমাকেও হয়তো তুমি নৃশংস পাষণ্ড ভাববে, যদি এখন থেকে ‘আমার আবেদন জানিয়ে রাখতে চাই। তবু সে আবেদন আমি রাখবো নন্দিতা।…মাঝখানে এই পাঁচটা বছর ভুলে যেতে হবে তোমাকে। যে জীবনের ছক একদা কেটেছিলাম আমরা—’
নন্দিতা ক্লান্ত গলায় বলে, ‘মুকুলদা, এখন থাক।’
নন্দিতার মা বলেন, ‘মুকুল এত আসে কেন রে?’
নন্দিতা বলে, ‘আর বোলো না! ওর উকিল বন্ধুর বুদ্ধিমন্ত পরামর্শ শুনতে শুনতে পাগল হয়ে গেলাম আমি।’
নন্দিতার মা বিরক্ত গলায় বলেন, ‘বারণ করতে পারিস না? বলতে পারিস না, উকিল ব্যারিষ্টার কি নেই আমার?’
‘বলতে যাই মা, মুখে বাধে। যতই হোক একটা সদিচ্ছা নিয়েই তো আসে!
‘তা আসুক—’ মা ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, ‘এ সময় পরের ছেলের অত না আসাই ভালো! লোকে নিন্দে করতে পারে।’
নন্দিতা মুহূর্তে কঠিন হয়। বলে, নিন্দে করলে তোমরাই করবে মা! আর কে আসে?’
মা অগত্যা চুপ করে যান।
কিন্তু মার যেন ক্রমশঃই মেজাজ বদলাচ্ছে। মা এখন মাঝে মাঝে বেয়ানের ঘরে গিয়েও বসেন, আর হঠাৎ বলে বসেন, ‘ওঁর জামাইয়ের প্রাণের বদলে কি আমার জামাইয়ের প্রাণটা ফিরে পাবো?’
এই মামলায়, এ চেষ্টায়, ওঁর যেন আর তেমন সায় নেই।
তার মানে অভাগিনী নন্দিতার পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু মা—ও ক্রমশ বিমুখ হয়ে পড়ছে।
তাই হয়।
অভাগা যদ্যপি চায়, সাগর শুকায়ে যায়। নন্দিতা যখন সুখী সৌভাগ্যবতী ছিল, তখন মার স্নেহ ছিল, সহানুভূতি ছিল। এখন আর থাকছে না।
তখন বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে মা নিজে যেচে বলেছেন ‘ওরে, নন্দিতা, একবার মুকুলদের বাড়ি ঘুরে যাস। মুকুলের মা বড্ড ‘ইয়ে’ করে।’ আর এখন মা মুকুলের ছায়ায় ‘লোকনিন্দে’ দেখছেন।
তখনও দেখছিলেন। সেই আগে।
যখন মার বাড়িতে একটা সদ্য তরুণী মেয়ে ছিল, যখন সে তার প্রাণের পাপড়িগুলি মেলে দিয়ে ফুটে উঠতে চেয়েছিল। তখন মা লোকনিন্দে দেখছিলেন, তাই নিজের মেয়ের প্রাণটাকে মুঠোয় চেপে পিষে ফেলে ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিয়েছিলেন।
তবু—সেটাই তো আমি মেনে নিয়েছিলাম। ‘ভাগ্যের পরিহাস বলে সুখী হবারও চেষ্টা করছিলাম। হয়তো আস্তে আস্তে সুখী হয়েও যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমার জীবনের উপর সেই ঝড়ের রাতটা কেন এল!…কেন এল তচনচ করে দেওয়া একটা সর্বনাশা প্রলয়!…
আমি তবে এখন আর কি করবো?
আমি কি চিরদিন ওই নিহত নায়কের বিধবার ভূমিকা নিয়ে ওই ভিটেয় পড়ে থেকে ওর মেয়েকে মানুষ করবো, আর ওর ওই কঠোর কঠিন মায়ের সেবা করবো? আমার আর কিছু থাকবে না? সুখ নয়, আশা নয়, ভবিষ্যৎ নয়, জীবন নয়?
তবে আমার এত যুদ্ধে কী দরকার?
তবে ওই রাজেন নামের লোকটাকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করবার কি দরকার? ‘ভাগ্যে যা ঘটেছে তাই নিয়েই থাকি’ বলে চুপ করে বসে থাকলেই হয়।
না।
এত সহজে হার মানবো না আমি। আমি যে যুদ্ধে মেনেছি, সেই যুদ্ধ শেষ করবো। তারপর দেখবো আর কি যুদ্ধ আছে।
মা চলে গেলে এই রকম অনেক কথা ভাবে নন্দিতা!
ক্রমশঃই লোকের ভীড় পাতলা হয়ে আসছে, এখন যেন নাটকের ‘ইনটারভ্যাল!’ দর্শকেরা এদিকে ওদিকে সরে গেছে, আলোচনা করছে, গল্প করছে,…পর্দা উঠলে আবার এসে বসবে। শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করবে।
এখন তাই প্রেক্ষাগৃহ হালকা।
এখন নন্দিতা জানলায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে সময় পায় মাঝে মাঝে। তাই ভাবে, মুকুলের কথাই কী ঠিক? মরে গেলেই ফুরিয়ে যায় মানুষ!
আর তারা কিছু দেখতে পায় না, কিছু শুনতে পায় না, কিছু বুঝতে পারে না! তাদের সুখ দুঃখ, ক্রোধ বিস্ময়, কোনো কিছুরই অনুভূতি থাকে না আর!
তাই, তাছাড়া আবার কি!
তা যদি না হতো, তাহ’লে এই পৃথিবী এই আকাশ কি টিকে থাকতে পারতো? অফুরন্ত অনুভূতির ভারে ভারাক্রান্ত আকাশ ভেঙে পড়তো না পৃথিবীর ওপর?
কিছু থাকে না।
মৃত্যুর পর আর কিছু থাকে না। বিধাতার গড়া যন্ত্রটা একবার ফেল করলেই সব শেষ।”
থাকে বরং মানুষের হাতে গড়া যন্ত্রের কারসাজি। মরে গেলেও কিছু রেখে দেয় সে।
ওর গাওয়া কোনো গান যদি রেকর্ড করা থাকতো, সেটা থাকতো, থাকতো ওর বলা কথা।
…নন্দিতা ভাবতে ভাবতে চমকে ওঠে।
সেদিন, সেই ঝড়ের রাতে তেমন একটা যন্ত্র যদি বসানো থাকতো ওঘরে? সে তাহলে সব কথা গড়গড়িয়ে বলে যেতো?
নন্দিতা যেমন করে বলে।
তারপর?
তারপর সেই শেষ আর্তনাদটা লেগে থাকতো যন্ত্রটায়।…
নন্দিতা জানলাটা বন্ধ করে দেয়।
নন্দিতা বিছানায় পড়ে নিজের কান দুটো চেপে ধরে!
না! নন্দিতার এখন আর কিছু করার নেই। আর ফেরার পথ নেই। নন্দিতা যদি নরকের দিকে পা বাড়িয়ে থাকে তো তার শেষটা দেখবে।
নন্দিতা কাল বলবে, ‘মুকুলদা তোমার আবেদন পত্রটা রাখলাম, মঞ্জুরী স্বাক্ষরটা বসিয়ে দেব।’
কিন্তু সত্যিই যদি তেমন একটা যন্ত্র বসানো থাকতো সেদিন সেই ঘরটায়, সেই শুধু পারতো নির্ভুল সাক্ষ্য দিতে। ভগবানও নাকি ঘুষ খেয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে বসতে পারেন। মানুষ তো ছার কথা। কিন্তু যন্ত্র কখনো ঘুষ খায় না!
সেই যন্ত্রের সাক্ষ্যে একটা খণ্ড বিচ্ছিন্ন কাহিনী সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারতো!
কিন্তু সে ঘরে কোন যন্ত্র ছিল না, ছিল শুধু দেওয়াল। যাদের কান আছে, কিন্তু মুখ নেই।
আচ্ছা, দেওয়ালের ভাষা বুঝবার ক্ষমতা কি থাকে কারুর কারুর?
তারা তাই সেই অদৃশ্য অক্ষরে ছাপ পড়ে যাওয়া দেওয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে? যেমন থাকছেন অজিতা দেবী।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।
লোকে বলে উনি নাকি দেওয়ালের গায়ে রক্তের ছিটে খোঁজেন।
…হয়তো তা নয়, হয়তো উনি আস্তে আস্তে সেই লেখার পাঠোদ্ধার করেন।…
‘মানুষটা বোধহয় আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছে—’
অজিতা দেবীর আত্মীয়েরা আড়ালে বলে।
বলে, পাগল হয়ে ‘যাবেই তো! চেঁচিয়ে কাঁদলে বুক হালকা হয়। অতবড় শোক বুকে চেপে—তার ওপর আরো একটা শোক মজুত রয়েছে।’
আর নন্দিতার আত্মীয়রা বলে, ‘কই, ওঁর ঠাকুর আর কাজে লাগছে না কেন? ঠাকুর ঘর ছেড়ে আজকাল এ ঘরে বসে থাকেন কেন উনি?’—
অথচ কথাটি ঠিক আছে।
কেউ যদি এসে বলে, ‘কেমন আছেন?’
উনি বেশ সহজেই বলেন, ‘ভালই আছি। রাঁধছি খাচ্ছি, হজমও করছি।’
কেউ যদি বলে, ‘মেয়ের সঙ্গে একবার দেখা করতে দিচ্ছে না আপনাকে?’
উনি বলেন ‘আমি তো যাইনি দেখা করতে!’
ঈশ্বর জানেন কী দিয়ে গড়েছেন ওঁকে। এমন নিঃসঙ্গ হয়ে বসে থাকতে ভালোও লাগে?
কিন্তু আজ হঠাৎ ইনি এঘরে এলেন। নন্দিতার ঘরে। সেই ঝড়ের দিন থেকে যে ঘরে আর ঢোকেননি।
যখন সেই প্রথম বাজটা পড়েছিল, ভয়ঙ্কর শব্দ করে? তখন অজিতা দেবী মিঠু একা ঘুমোচ্ছে ভেবে এঘরে চলে এসেছিলেন।…তারপর একটা উঁচু গলার হাসি শুনলেন, তারপর একটা উত্তেজিত আলোচনা শুনে উঠে গিয়েছিলেন। একে জামাই অভিমানী, তায় আবার কখনো থাকে না, তাই ভয় হয়েছিল তাঁর, কী হল হঠাৎ চড়া চড়া কথা বলছে কেন?…উঠে গিয়ে শার্সির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।…
সেই এঘর থেকে উঠে যাওয়া!
এতদিন পরে এঘরে এলেন।
নন্দিতা একা ছিল।
নন্দিতা বিছানায় শুয়েছিল। সে বিছানায় অজিতা দেবীর ছেলেও শুতো একদা। মিঠুর ছোটো খাটটা তার পাশে জোড়া। মিঠু দিদিমার কাছে আছে বলে সেটাও শূন্য।
অজিতা দেবীকে ঘরে ঢুকতে দেখে নন্দিতা অবাক হলো, উঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে মনকে শক্ত করে নিলো।…
জানে অজিতা দেবীকে বসতে বললেও এ ঘরে বসবেন না। আগেও বসতেন না। এঘরের বিছানাপত্র ছোঁয়া যাবার ভয়ে মা ঘরে ঢুকলে পার্থ চাদর পর্দা গুটিয়ে দিতো।
আজও বসলেন না।
নন্দিতা তাই দাঁড়িয়ে রইল।
নন্দিতা মনকে খুব শক্ত রাখতে চেষ্টা করলো।
আর কিছুই নয়, বৌয়ের কাছে মেয়ের সিঁদুরটা ভিক্ষে করতে এসেছেন। যে বৌয়ের সিঁথিটা ধুয়ে মুছে ফর্সা হয়ে গেছে। নন্দিতা মনে মনে জপ করতে লাগল, ‘আর ফর্সাটা করেছে তোমারই ওই মেয়ের বর। অতএব আমি তোমার শত মিনতিতেও টলবো না।’
কিন্তু অজিতা দেবী কী মিনতি করতে এসেছেন?
অজিতা দেবী তো প্রথমে একটা সম্পূর্ণ অবান্তর কথা বললেন। ‘মিঠু কী ওখানেই থাকবে?’
নন্দিতা শক্ত আছে, শক্তই থাকলো।
বললো, ‘এখানে আনলে ওকে কে দেখবে?’
‘তা বটে।’ বললেন অজিতা দেবী।
কারণ নন্দিতার কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন অভিযোগের সুর। যে সুর নন্দিতার চির অভ্যাসগত।
তারপর অজিতা দেবী শান্ত গলায় বললেন, ‘আমাদের কোর্টে যেতে হবে শুনেছো বোধহয়?’
নন্দিতা তো শান্ত কণ্ঠই শুনতে অভ্যস্ত, তবু নন্দিতা চমকে উঠলে কেন? তারপর নন্দিতা সামলে নিল। জ্বালাভরা গলায় বললো ‘শুনেছি।’
‘সেই কথাই বলতে এসেছিলাম।’
অজিতা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
নন্দিতা বিস্ময়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু এই কথাটুকু বলতে এসেছিলেন উনি? আর কিছু নয়? আমাদেরও যে কোর্টে যেতে হবে এটা কি একটা নতুন কথা? যেতে হবার প্রস্তুতিই তো চলছে এতদিন ধরে।
নাঃ, অন্য মতলবেই এসেছিলেন, শুধু নন্দিতার কঠোর ভাব দেখেই সেটা বলতে পারলেন না।
কিন্তু ওঁর দৃষ্টি অমন তীক্ষ্ন আর অন্তর্ভেদী দেখালো কেন? উনি কী নন্দিতার ভিতরটা পর্যন্ত পড়ে ফেলতে চান?..নন্দিতা যে একটু আগে মুকুল নামের একটা লোককে বিনা সম্বোধনে আর বিনা নামসইয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে, সেটা কি উনি টের পেয়ে গেছেন? উনি কি বুঝতে পারছেন আমি আর ওঁর বাড়ির বৌয়ের পরিচয়ে এ বাড়িতে থাকবো না?…
আর একবার কেমন বুকটা কেঁপে উঠলো নন্দিতার।
তারপর নন্দিতা ভাবলো, আর ওঁকে আমার কিসের ভয়? ওঁর ছেলের মুখ চেয়ে একটু সমীহ করতাম, আর এখন একপাশে পড়ে আছেন—আমাকে ঘাঁটাতে আসেন না বলেই সয়ে আছি। কিন্তু ভয় করতে যাবো না কেন?
দাঁড়িয়ে ভাবছিল, ওর দাদা এলো।
বললো, ‘বুড়ি এঘর থেকে চলে গেল মনে হল। এসেছিল নাকি?’
‘হুঁ।’
‘হঠাৎ? ‘মতলব কি?
নন্দিতা খাটের উপর বসে পড়ল। নন্দিতার রুক্ষ চুলগুলো সাপিনীর মতো দুলে উঠলো। নন্দিতার চোখ দুটি ধ্বক ধ্বক করে উঠলো। বললো, মতলব ভালো বলে মনে হলো না।’
‘কেন? কেন?’
নন্দিতা তার দাদাকে বললো, ‘ভেবেছিলাম বুঝি কাকুতি—মিনতি করতে এসেছেন, ঠিক তার উল্টো। যেন শাসিয়ে গেলেন।’
‘শাসিয়ে গেলেন?’
‘মানে ভঙ্গীটা তাই। বললেন, আমাদের কোর্টে যেতে হবে সেটা মনে করিয়ে দিতে এলাম।’
‘তাই নাকি?’ ওর দাদা চিন্তিতভাবে বলে, ‘আজ পর্যন্ত বুড়ির ভাব বোঝা গেল না। আমার মন নিচ্ছে ও পক্ষ যা বলছে, উনি সেই কথাতেই সায় দেবেন। বলবেন—আত্মহত্যা।
নন্দিতা জ্বলে উঠলো।
‘তার মানে ওঁর জামাই দিব্যি বেরিয়ে আসবে হাজত থেকে?’
‘মানেটা তাই দাঁড়ায়। মায়ের সাক্ষী বড়ো জবর জিনিস।
ছেলের খুনীকে মা বাঁচাতে চেষ্টা করছে, এমন ঘটনা তো বড় ঘটে না। ঘটলে সমস্ত পৃথিবী ছি ছি করবে।’
‘উনি পৃথিবীর ছি ছি—কারে ভয় করেন না!’
‘আমার মনে হয়—’ নন্দিতার দাদা বলে, ‘তোর একবার এ বিষয়ে ফয়সালা করে নেওয়া উচিত। তুইও শাসিয়ে আয়, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার চেষ্টাটি যেন না করেন।’
নন্দিতাও তাই ভাবছিল!
ওঁর ভঙ্গী দেখে মনে হল যেন শাসিয়ে গেলেন। তার মানে আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিলেন।
ঠিক আছে আমিও যাচ্ছি।
ঘরে পার্থর একটা ফটো ছিল, নন্দিতা সে ছবিটার মুখ উল্টে রেখেছিল।
নন্দিতা বলতো, ‘আমার দেখতে কষ্ট হয়।’
আজ নন্দিতা হঠাৎ ছবিটার মুখ ঘুরিয়ে দিল। যেন কড়া গলায় বলে উঠলো, ‘আমিও মানুষ, বুঝলে?!
তারপর এঘরে এলো।
সে ঘরের এককোণে একটা বেতের মোড়ায় চুপ করে বসেছিলেন অজিতা দেবী দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে।
নন্দিতা ঘরে ঢুকেই উদ্ধত গলায় বলে উঠলো, ‘আপনি তখন হঠাৎ ওভাবে চলে এলেন যে?’
অজিতা দেবী এই অকারণ ঔদ্ধত্যের দিকে তাকালেন। অজিতা দেবী আজকাল নন্দিতার এযাবৎকালের সমস্ত অকারণ ঔদ্ধত্য, সমস্ত অভিযোগ, আর সমস্ত আচরণ অসন্তোষের মানে বুঝতে পারেন।
কারণ অজিতা দেবী মুকুলকে দেখেছেন।
অজিতা দেবী স্থির গলায় বললেন, ‘তোমার ঘরে তো আমি বসতে যাইনি বৌমা। শুধু ওই কথাটুকুই মনে করিয়ে দিতে গিয়েছিলাম।’
মনে করিয়ে দিতে?
নন্দিতা ব্যঙ্গে তীক্ষ্ন হয়, ‘ওটা বোধহয় ভুলে যাবার কথা নয়!’
‘না কথাটা ভুলে যাবার নয়—’ অজিতা দেবী চুপ করে যান।
নন্দিতা এ ঘরটায় সহজে আসে না।
মিঠুকেও এ বাড়ি থেকে ভাগিয়েছে, আরো এই ঘরটার জন্যেই।
নন্দিতা দেয়ালটার দিকে তাকায় না।
নন্দিতা তীব্র রুক্ষ গলায় প্রশ্ন করে, ‘আপনি কোর্টে কী বলবেন শুনি?’
অজিতা দেবী শান্ত গলায় বলেন, ‘তুমি কী বলতে বলো?’
‘আমি? আমি যা বলতে বলবো, তাই আপনি বলবেন?’
অজিতা ঠিক তেমনি স্থির গলায় বলেন, ‘তা সত্যি কথাটা যখন বলা যাবে না, তখন যা হোক একটা কিছু তো বানিয়ে বলতেই হবে।’
‘ও বানিয়ে?’ নন্দিতা যেন চণ্ডীমূর্তি ধরে, ‘সত্যি কথাটা বলা যাবে না? চমৎকার! এই আপনার সাধন—ভজন, গুরু ইষ্ট? এই আপনার চিরদিনের সত্য ধর্ম? সত্যি কথাটা বলা যাবে না?’
অজিতা নিষ্পলক ওর ওই সাপের ফণার মতো রুক্ষ চুলের জটায় ঘেরা মুখটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমি কী বলো? বলা সম্ভব?’
‘তা’ আপনার পক্ষে অসম্ভব বৈকি!’ নন্দিতা ওর দৃষ্টি দেখেনি, নন্দিতা ওই রক্তের ছিটে লাগা দেওয়ালটায় চোখ পড়বার ভয়ে জানলার দিকে তাকিয়েছিল, এবার ওর চোখের দিকে তাকালো। ভয়ানক একটা অস্বস্তি অনুভব করলো।
অমন করে তাকাচ্ছেন কেন উনি? ভয়ের ভাব নেই, লজ্জার ভাব নেই, যেন ঘৃণা ধিক্কার আর ব্যঙ্গের ভাব।
…কেন? কেন?
ওঁর মেয়ে একবার সিঁথি শাদা হয়ে গেলে দ্বিতীয়বার তাতে রঙের প্রলেপ দেবে না, এ বিশ্বাস আছে বলে…ইস এত বিশ্বাস!
বড়লোকের বাড়িতেই তো বড় বড় কেলেঙ্কারি ঘটে। লোহার গরাদের মধ্যে আটকা পড়ে থাকে তারা বলে সেই কেলেঙ্কারীর শিকড় পাতালের নীচে আশ্রয় নেয়।
নন্দিতা আবার শক্ত হল, রূঢ় হলো।
‘অসম্ভব হবে না? তা’তে যে আপনার নিজের মেয়ের স্বার্থহানির ভয়। সেই স্নেহে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় আপনার সত্য ধর্ম আর কাজে লাগছে না, কেমন?…আপনার ছেলের মুখটাও কি মনে পড়ছে না, আপনার ছেলের বৌয়ের শাদা সিঁথিটা ভুলে যাচ্ছেন। আপনার এতদিনের ন্যায়ধর্ম সত্যধর্ম সব বিসর্জন দিয়ে আপনার মেয়ের সিঁদুরটি কিনবেন, তাই না?’
নন্দিতা ঠোঁটটা কামড়ায়, ‘আর তারপরে হয়তো আবার এই বাড়িতেই এই ঘরেই আপনার সেই আদরের জামাইকে ডেকে এনে জামাইষষ্ঠীর নেমন্তন্ন খাওয়াবেন!
‘…অথচ—’ নন্দিতা আরও একবার ঠোঁটটা কামড়ায়।
‘অথচ আমাদের বাড়ির সবাই বলছে, ‘ওঁকে আর উকিলে তৈরী করতে পারবে না। যে যাই বলুক, উনি ওঁর সত্যকেই আঁকড়ে বসে থাকবেন। উনি ছেলে হারিয়েছেন, আবার জামাইকে হারাবেন।’ আর আপনি?’
ব্যঙ্গে ঠোঁটটা বেঁকে যায় নন্দিতার, ‘আর আপনি স্বচ্ছন্দে বলছেন’ সত্যি কথাটা তো বলা যাবে না। বানিয়ে কিছু বলতে হবে। চমৎকার! কিন্তু মনে জানবেন আপনার বানানো কথা কোনো কাজে লাগবে না, যা সত্য তা প্রকাশ হয়ে পড়বেই।’
‘তা প্রকাশ হয়ে পড়বেই?’ অজিতা দেবীর দৃষ্টি যেন তীব্র একটা সার্চলাইটের মত জ্বলে ওঠে, ‘সেটাই তোমার ধারণা?’
নন্দিতার চুলগুলো আর এখন দুলে ওঠে না, নন্দিতার বুকটাই যেন দুলে ওঠে। তবু নন্দিতা হার মানে না। বলে, ‘ধারণা বলে কিছু নেই, যা ঘটেছে সেটাই প্রমাণিত হবে।’
অজিতা দেবী গম্ভীরভাবে বলেন, ‘তোমার অনেক বাচালতা সহ্য করেছি বৌমা, আর পারছি না। এবার থামো।’
‘থামবো? ঠিক আছে থামছি—’
নন্দিতা ঠিকরে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হচ্ছিল, অজিতা দেবী ডাকলেন, বললেন, ‘বৌমা শোনো, আমি তোমায় উপদেশ দিচ্ছি, বেশী হৈ চৈ করতে যেও না। ওরা যা বলছে, সেটাই মেনে নাও। আমিও জানবো সে আত্মহত্যাই করেছে।’
নন্দিতা থমকে দাঁড়ায়।
নন্দিতা যেন ঢাল হাতে করে নতুন করে যুদ্ধক্ষেত্রে নামে, ‘ওঃ,! উপদেশ! বলতে হবে আত্মহত্যা! তার মানে তখন আমায় নিয়ে টানাটানি পড়বে! একটা সহজ সাধারণ লোক যদি আত্মহত্যা করে, তার মাকে কেউ কিছু বলতে আসে না, স্ত্রীকে নিয়ে দায়ী করতে বসে জানেন বলেই, এই উপদেশ কেমন? তার মানে আপনার মেয়ে জামাই, মান সম্মান, সবই বজায় থাকলো, শুধু আমারই—’
অজিতা দেবী হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
তীব্র গলায় বললেন, ‘বৌমা একবার বলছি, আবারও বলেছি তোমার অনেক বাচালতা সহ্য করেছি, আর নয়। ঠিক আছে তুমি যখন হঠাৎ এত ‘সত্যের ভক্ত’ হয়ে উঠেছো তো আদালতে দাঁড়িয়ে আমি সত্যি কথাই বলবো…আর সেই সত্যিটা কি তা’ তুমিও জানো, আমিও জানি। জ্ঞান হারাবার আগে, আমার জ্ঞান চেতনা সবই ছিল।’
অজিতা দেবী চলে গেলেন।
কিন্তু নন্দিতা? নন্দিতা যে চলে যেতে পারছে না। নন্দিতাকে কে এখানে পুঁতে রেখে গেল? অজিতা দেবী? তাঁর সাধন শক্তির বলে।
না কী ওই দেওয়ালগুলো!
ওরা কি হঠাৎ বাকশক্তি অর্জন করে ফেলেছে। তাই নন্দিতাকে চেপে ধরে বসিয়ে শোনাতে চাইছে ওদের রেকর্ড করে নেওয়া কথা আর শব্দ।
ওরা তাহলে বলছে—’আরে শোনো নন্দিতা, শোনো! তাহলে সেই প্রথম বাজের শব্দটা থেকেই শোনো।…শুনতে পেলে? আহা ও কি এখনি কান চেপো না, তা হলে বাকিগুলো শুনবে কি করে।
বাজের শব্দের পর ভারতী নামের সেই মেয়েটা বললো না, আমার ভালো লাগছে না, শুতে যাই বাবা।’ বললো—চলে গেল। ওর বরেরও ইচ্ছে করছিলো ওর পিছু পিছু যেতে। তার চোখে সে বাসনা ফুটে উঠেছিল, কিন্তু তুমিই তাতে বাদী হলে। তুমি বাচাল হাসি হেসে বলে উঠলে, ‘থাক মশাই, এখুনি আর গিন্নির পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে না। আর একটু খেলা চলুক।’
তার মানে সে রাত্রির সেই ঝোড়ো হাওয়ার আর গভীর রাত্রির স্বাদ তোমাকে উত্তাল করে তুলেছিল, তোমাকে মাতাল করে তুলেছিল। সেই উত্তাল মাতাল মন নিয়ে তোমার ইচ্ছে করছিল না সেই তোমার আকর্ষণহীন, আর অভ্যাস—মলিন নিত্যশয্যায় গিয়ে গোয়ালার দুধের মত বিস্বাদ আর জোলো একটা বাহুপাশে ধরা দিতে।…ওই জোলো বিস্বাদের স্বাদ তোমার মনকে ক্রমশঃই বুঝি ভিতরে ভিতরে অসহিষ্ণু করে তুলছিল। তাই সে রাত্রের সেই বৈচিত্র্যের মাদকতা তোমাকে বিহ্বল করেছিল।
হোক বোকা, হোক বাজে, তবু তো একটা অন্য পুরুষ, যার সামনে নিজেকে বিকশিত করতে পারছে নন্দিতা, নিজেকে আকর্ষণীয় রূপ দিতে পারছে। ওই তো মোটা—গোটা পান গালে দেওয়া বৌ ওর। ও অন্ততঃ দেখুক নন্দিতাও কম নয়। নন্দিতা শুধু রান্না আর ঘরকন্নার মধ্যেই বিক্রীত নয়। নন্দিতার শ্বাশুড়ীর উপস্থিতিতেই তোমরা নন্দিতাকে দেখো, এমন উল্লাসময়ী রূপটা তো দেখতেই পাও না।…
এই রকমই একটা ভাবনা তোমাকে তখনও সেখানে আটকে রেখেছিল, তাই নয় কি!
তাই তুমি বললে, ‘আর একটু খেলা চলুক।’
কিন্তু তোমার সেই জোলো দুধের মত স্বামী? সে তোমার ওই উল্লাসময়ী রূপকে গ্রহণ করতে পারলো না! মুগ্ধ হলো না— পুলকিত হলো না, চেয়ারের পিঠে পিঠ হেলিয়ে আলগা গলায় বললো; ‘তিনজনে কি খেলা হয়? কে কার পার্টনার হবে? খেললে গোলাম চোর—’
‘ঠিক আছে, তুমিও তোমার বোনের মত ঘুমোওগে—।’—নন্দিতা তুমি ঝলসে উঠেছিলে ওই দুঃসাহসিক কথাটা বলে, ‘আমরা তাসের ম্যাজিক করি।’
কিন্তু তোমার বর শুতে যায়নি।
তোমার বর সেই চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসেছিল অলস ভঙ্গীতে। তার মানে তোমার বর তোমায় বিশ্বাস করতো না। অথবা তার সেই জমিদারের রক্তধারাবাহী ভগ্নিপতিকে।…বলা শক্ত কার প্রতি অবিশ্বাসের বশে সে বসেই থাকলো। নইলে তুমি তো আরও একবার বলেছিলে, ‘বসে বসে হাই তুলে আর কি হবে? যাও না, নাক ডাকাও গে না?’
তারপর?
তোমার নিশ্চয়ই মনে পড়ছে নন্দিতা, রাজেন নামের লোকটা দিব্যি ম্যাজিক করতে লাগলো তাস নিয়ে।… মনে ভাবা তাস বলে দিল, তুলে নেওয়া তাস না দেখে বলে দিল, তারপর আরও একটা অদ্ভুতকাণ্ড করলো, তোমার হাতের একখানা তাস দু’খানা করে দিল।
তুমি তখন বেহায়া হলে, বাচ্চা মেয়েদের মত হেসে গড়িয়ে পড়ে হৈ চৈ করে বললে, ‘নিশ্চয় তুমি আর একখানা হরতনের বিবি পকেটে লুকিয়ে রেখেছিলে, এখন হাত সাফাই করে—’
রাজেন পান খাওয়া মুখে ছ্যাবলা হাসি হেসে বললো, ‘বিবিকে কি আর পকেটে পূরে রাখা যায় বৌদি? তাও আবার ‘হার্ট’ এর! …কী বলেন দাদা? আপনার কী মত? যায় রাখা?’