৮
সাধারণ সাংসারিক সুখ দুঃখ তাঁকে স্পর্শ করে না, এমনি একটা মূর্তিতেই তিনতলার ছাতের ওই ঠাকুরঘর আঁকড়ে পড়ে থাকলেন। ছেলের বিয়ের পর সাংসারিক কর্তব্যের দায় থেকেও নিজেকে মুক্ত করে নিয়েছেন।
শুধু মেয়ে জামাই এলে? তখন একটু দেখেন। নন্দিতা পাছে বলে ওঠে, ‘একা আর কত সামলাবো?’ ছেলে পাছে মনে ভাবে, ‘মার এটি অন্যায়—’, তাই হয়তো!
সেদিনও ওদের আটকে ফেলে ওদের শোবার ব্যবস্থা করতে এসেছিলেন ওই ভেবে।
কিন্তু ঘরটা সাফ করিয়ে রাজ্যের লেপ তোষক চাপিয়ে পুরু করে বিছানা পাতিয়ে ফর্সা ওয়াড় পরিয়ে ঘরটার চেহারা ফিরিয়ে ফেলে, হঠাৎ যেন কেমন অনুশোচনা এল অজিতা দেবীর।
সত্যি, এতই বা নির্লিপ্ত থাকি কেন?
এমন করে সব ছেড়ে দিয়েছি কেন?
আমি যে ভারতীর কুটুম নয়, মা। এটা যে ভারতী সব সময় মনে রাখতে পারে না, তার জন্যে আমিই দায়ী!
আমি যদি বলতে পারতাম, ‘হোক আমার গরীবের কুঁড়ে, তা বলে মেয়ে জামাই রাত্রিবাস করবে না কোনদিন? তোদের কষ্ট হবে? হোক। কষ্ট করেই আমার সাধ মেটা।’ তাহলে ওরাও কাছে আসতো। এমন করে উপঢৌকনের পসরা বয়ে এনে কদাচ কোনোদিন কুটুম বাড়ি বেড়াতে আসার মত বেড়িয়ে যেত না।
আমি কি এবার থেকে সহজ হবো।
ভাবলেন অজিতা দেবী।
আমি সেই সহজ হওয়ার মধ্যে ছোট ছোট মিষ্টি সুখ আহরণ করে নেব?
পুরনো রংচটা টেবিলটায় একটা টেবিল—ঢাকা পাতলেন, স্বামীর ব্যবহৃত একটা সৌখিন এ্যাশট্রে ড্রয়ার থেকে বার করে রাখলেন তার ওপর।…
ভাবলেন, আগে থেকে ব্যবস্থা থাকলে একটু ফুল আনিয়ে ফুলদানীতে রাখতাম। যেমন সেই ভারতীর বিয়ের পর প্রথমবার জামাইষষ্ঠীর দিন—সেই একটা রাত এ বাড়িতে ছিল ওরা। আর আজ এই।
কর্তার মারা যাবার সময়ও হয়নি সে ঘটনা। ওরা তখন ভারতদর্শনে বেরিয়েছে।
বৃষ্টির জন্য জানলা—টানলা সব বন্ধ।
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। তার একটা চাপা গর্জন যেন জানালার ওপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
অজিতা দেবী বসলেন একটু।
পাতা বিছানায় নয়, কাছের চেয়ারটায়।
বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়েও নন্দিতার উছলে—পড়া হাসির শব্দ ভেসে এল। তাস নিয়ে হৈ—চৈ করছে! ভারতীর হাসির গলাও পাওয়া যাচেছ।…ভারতীর ধারণার মধ্যেও নেই, তার মার প্রাণে এখন সাধ হচ্ছিল ভারতী তাঁর কাছে এসে বসুক একটু।
ভারতী জানে মায়ের সেই সব ইচ্ছে বাসনার ঊর্ধ্বে। তাই ভারতী বেড়াতে এসে সোজা তিনতলায় উঠে গিয়ে সন্দেশের বাক্স নামিয়ে দিয়ে বলে, ‘এই রাখছি তোমার ঠাকুরের মিষ্টি। ধোওয়া হাতে নিয়ে এসেছি। তোমায় তো আর ঠাকুরঘরে প্রণাম করা চলবে না। নমস্কারই করি।
হয়তো অজিতা দেবী সন্দেশের বাক্সর মাপ দেখে বলে, ‘এত কেন?’
ভারতী বলে, ‘ওমা, ও আবার এত কি! সামান্য।’
তারপর ভারতী নীচে নেমে আসে।
ভাই ভাজের সঙ্গে গল্পে উচ্ছ্বসিত হয়। বরটি অবশ্য থাকে তার মধ্যমণি। অজিতা দেবীর সঙ্গে দেখা হয় বটে খাওয়া—দাওয়ার সময়, তা সে এমনিই গল্পে উন্মত্ত থাকে, চেয়েও দেখে না। আবার সেই চলে যাবার সময়। তখন পায়ের ধুলো নেয়। বলে, ‘এই এলাম, আবার কবে আসা হয়!’
আসা হয় না।
সময়ের অভাব।
তবু তো বাঁজা—মানুষ।
অজিতা কিন্তু কোন মন্তব্য করেন না। শুধু আশীর্বাদ করেন।
আজও যথারীতি ঠাকুর ঘরে মিষ্টি দিয়ে এসে, ভেসে গিয়েছিল এদের মধ্যে। আকাশটা হঠাৎ মাথামুড়ো খুঁড়ে কেঁদে ভাসিয়ে একাকার কাণ্ড করতে সুরু করলো বলেই দিনের চেহারাটা বদলে গেল। রাতটা দেখতে পেলো ভারতী এ বাড়িতে।’
ওর কি আর মনে আছে—অজিতা দেবী ভাবলেন, ও একদা এই ঘরটিতে শুতো। ওই খাটটাতেই দুজনের মাঝখানে।
মনে নেই।
ঐশ্বর্য ওকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে।
কি জানি আজ রাত্রে বিছানায় শুয়ে ওই পুরনো দেওয়ালগুলো দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাবে কি না!
এই সব ভাবতে ভাবতে অনেকক্ষণ সময় কেটে গিয়েছিল। অজিতা দেবী ভাবছিলেন, কী রকম বেআন্দাজী রাত করছে ওরা। এবার তো খেলা বন্ধ করতে হয়।
হ্যাঁ, হঠাৎ এই গভীর অর্থবহ অপয়া কথাটা ভেবে বসেছিলেন অজিতা দেবী! খেলা যেন ফুরোচ্ছে না। এবার তো খেলা বন্ধ করা উচিত। তা নয়, এখনো ঝলকে ঝলকে হাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
পার্থর তো কাল অফিস আছে।
বুঝছে না কেন?
তারপর রাত যখন বারোটা বাজে, ভাবলেন মিঠুটা এত রাত পর্যন্ত ওই কোণের দিকের ঘরে একলা পড়ে আছে। অতএব ওর ঘরে গিয়ে বসলেন। দেওয়ালের ঘড়িতে দেখলেন ঠিক বারোটা।
তারপর—
রাত যখন সাড়ে বারোটা—
ভয়ঙ্কর সেই বাজটা পড়লো। কাগজে যার খবর বেরিয়েছিল। অনেক নাকি ক্ষতি হয়েছিল বাজটা থেকে।
শব্দটা থামলে ভারতী হাই তুলে বললো, ‘আর ভাল লাগছে না বাবা। শুয়ে পড়িগে—’
ভারতীর এমনিও ভাল লাগছিল না। হলেও বাপের বাড়ি, বেড়াতে বেরিয়ে রাত্তিরে আর বাড়িতে না ফিরতে পাওয়া খারাপ লাগছিল তার। তাছাড়া ওর বড়লোক বরের উপযুক্ত আরামের শয্যা তো এ বাড়িতে জুটবে না। হয়তো বর তাই নিয়ে আগামীকাল হাসবে। হয়তো বললে ‘আমার ঘুম হয়নি।’ বলবে ‘উঃ কী মশা!’
পান থেকে চুন খসলে চলে না তো ওদের।
ওদের বাড়ির প্যাটার্ণ—ই এই।
সামান্য ত্রুটিতে রসাতল!
ভারতী তাই এখনো পর্যন্ত ভাবছিল, যদি বৃষ্টি থামে তো চলে যাই। নিজেই তো গাড়ি চালাবে ও। ভয় কি! তাছাড়া বড় লোকদের কায়দামাফিক সন্ধ্যার দিকে তো ‘সুরক্ষিত’ হয়েই বেরোয় রাজেন্দ্রভূষণ!…
লাইসেন্স আছে।
বড়লোকদের সব কিছুরই লাইসেন্স থাকে।
বড়লোকেরা অনেক কিছুই অপ্রয়োজনেও মজুত রাখে।
তাই ভেবেছিল ভারতী, হোক না রাত, ভয় কি?
ভারতীর মা ভারতীদের জন্যে যুগ্মশয্যা পেতে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, আর ভারতীর মনে হচ্ছিল, বৃষ্টি একটু কমলেই কেটে পড়ি বাবা!
ভারতীর একেবারে ভালো লাগছিল না এইখানে এইভাবে থেকে যাওয়াটা।
ভারতীর অদৃষ্ট দেবতা কি ভারতীকে ‘জানান’ দিয়েছিল? তাই ভারতীর প্রাণটা পালাই পালাই করছিল।
যদি বৃষ্টিটা একটু কমতো, তাহলে ভারতীর আজকের পৃথিবীর রং এমন বদলে যেত না। নন্দিতা সর্বহারা হয়েছে। কিন্তু ভারতীরই বা সর্বস্ব বজায় থাকার আশ্বাস কোথায়? ভারতী মরীয়া হয়ে লড়ছে, কিন্তু ভারতীর প্রাণের মধ্যে ভয় বাসা বেঁধে বসে আছে।
ভারতী জানে না রাজেন্দ্রভূষণ ফাঁসিতে ঝুলবে, না বেকসুর খালাস হয়ে ফিরবে! ভারতীর মেজ ভাসুর ভারতীকে ওইটাই বুঝিয়েছেন। বলছেন, ‘লড়ছি আমরা প্রাণপণে, লড়বোও। কিন্তু তুমি শক্ত হও। জেনো এসব কেস হয় একেবারে ফেঁসে যায়, নয় চরমে ওঠে।
ভারতী সন্দেহের চোখে তাকিয়েছিল ওর মেজ ভাসুরের দিকে।
ইনি কি সত্যি হিতৈষী? না বিপক্ষের টাকা খেয়ে কেস খারাপ করে দেবার তালে সব কাগজপত্র হাত করছেন?
কিন্তু ইনিই তো খাটছেন প্রাণপণে।
কি জানি! মেয়েমানুষ, অত বুঝিও না।
বোঝে না, তাই ওর ওপর নজর রাখতে বড় জায়ের ভাইয়ের সঙ্গে চুপিচুপি পরামর্শ চালাচ্ছে।
বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হয়ে, বিষয় বিষের প্রভাবে ‘বিশ্বাস’ শব্দটা যেন ভুলে গেছে ভারতী। ও জানে, সবাইকেই সন্দেহ করতে হয়। তাই ও ওর মাকেও সন্দেহ করে আসছে এই দুর্ঘটনার পর থেকে।
বিশ্বাস কি, পুত্রশোকের জ্বালায় প্রতিহিংসার বশে মা জামাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে বসবে কিনা। বলা যায় না, হয়তো তাই দেবে। পাথর পূজো করে করে মনটাও তো পাথর করে রেখেছেন। ওই ঠাকুরপূজোদের বিশ্বাস নেই। ওঁদের মনের মধ্যে মায়া মমতা স্নেহ দয়া এসব দাঁড়াতেই পায় না। তাছাড়া মার সঙ্গে তো একবার নিভৃতে দেখা করতে পাবারও সুযোগ মিলছে না। দু’দিকে কড়া পাহারা। দেখা করতে পারলেও বা একবার পায়ে পড়ে বলতে পারতাম, ‘মা তোমার ভারতীর মুখ চাইবে না?’
কিন্তু বললেই কি কিছু হবে?
উনি হয়তো বলে বসবেন, ‘আমি সত্যকেই সার জানি। যা সত্য তাই বলবো।’
তার মানে জামাইয়ের ফাঁসি কাঠটি শক্ত করে পুঁতবেন। তাই—ই করবেন। ‘মমতা বস্তুটা তো মন থেকে ধুয়ে বার করে দিয়েছেন।’ ভারতী ভাবে, নইলে এই যে আমি যাই, একবার কি বলেন, ‘আয়, আমার কাছটায় একটু বোস।’
বলেন না।
সে কোমলতা নেই।
ওই দেখে শুধু একটু সৌজন্যের হাসি হাসলেন, ‘ভারতী? এসেছিস? ভাল আছিস তো? জামাই? আচ্ছা বোস’গে।’
ব্যস! হয়ে গেল মাতৃস্নেহ! আমি বেচারী এঘর ওঘর ঘুরে ভাই ভাজের সঙ্গে হল্লা করে, ভাইঝিকে একটু নাচিয়ে সময়টুকু কাটিয়ে দিই। ও যে বলে, ‘বাপের বাড়ি যাব যাব করে নাচা কেন? তোমার মা তো বলতে গেলে তাকিয়ে দেখেন না।’ সেটা মিথ্যে বলে না।…কিন্তু ও বুঝি আর কখনো বলবে না ওসব।
ও রাগের মাথায় একটা কাণ্ড করে বসে নিজের প্রাণটাও—
ভাবতে গেলেই হু হু করে কেঁদে ওঠে ভারতী। এ কথা আর ভাবতে পারে না, ও কখখনো খুন করতে পারে না। কি করে ভাববে? ঘটনা যে পরিষ্কার ছবির মত!
সেটা তো আর দুবার ফিরে উল্টে দেখতে হয় না।
তাছাড়া ও ককখনো এ কাজ করতে পারে না, এ বিশ্বাসের দৃঢ়তা কোথায়? বিশ্বাসের মূলই তো ভারতীর আলগা। ভারতীর বিয়ের পরই ভারতীর এক খুড়শ্বশুর একটা চাকরকে মেরে ‘শেষ’ করে ফেলেননি? মারতে মারতে ঠাকুর দালানের উঁচু সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে?
টাকার জোরে গায়েব হয়ে গেল।
ডাক্তার বলে গেল, ‘উঁচু থেকে পড়ে যাওয়ার ফলেই—’
পুলিশ অতএব সই করে দিয়ে চলে গেল।
তাছাড়া বাহাদুর? রাজেনের মেজদার সেই কুকুরটা?
সে—ও তো টাকার জোরেই—
ভারতীও তাই টাকার জোরের ভরসাই করছে। শুধু ওই একটা গোলমেলে অংশ, মা! ওখানে যে টাকার জোর খাটবে না। ভারতী একেবারে হৈ—চৈ করে কোথায় ড্রাইভারের সঙ্গে ঘুরে আসে, কাকে না কাকে টাকার জোরে মুঠোয় আনবার চেষ্টা করে, তারপর বাড়ি ফিরে কপালে করাঘাত করে, ‘ভগবান, আমি কেন সেদিন ওখানে গিয়াছিলাম!…আমার তো যাবার কোনো দরকার ছিল না, আমার মা ভাই তো বলেনি, ‘ভারতী, তুই অনেকদিন আসিসনি, একবার আয়।’
বলেনি। বলেও না কোনোদিন।
আমি মরতে মরতে যাই এক একদিন। আমার এত ঐশ্বর্য, আমার সংসারের এত বাড়—বাড়ন্ত এ তো ওদের দেখাতে পাই না, তাই যাই।
নেমন্তন্ন করলে দাদা তো সাত জন্মেও আসে না, বৌদিকে গাড়ি পাঠালে আসে, তাও বেশীক্ষণ বসতে চায় না, তাই আমার ঐশ্বর্যের ভাগ নিয়ে যাই।
কিন্তু মরতে কেন সেদিন গেলাম!
ভারতী ভাবে আর হু—হু করে কেঁদে ওঠে, যদি না যেতাম আমার তো সবই ঠিকঠাক বজায় থাকতো।…আমার দাদা…উঃ ভাবতে পারি না।…তবু দাদাকে আমার পরম শত্রু মনে হয় এখন।
দাদা যদি অত জোর না করতো থেকে যাবার জন্যে! দাদা যদি ওকে তাসের নেশায় আটকে না ফেলতো!
তাহলে তো ঝড় বৃষ্টি বজ্রাঘাত সব তুচ্ছ করে চলে আসতো ও।
দাদা আমার মহাশত্রু। দাদা ওকে সেই ভয়ঙ্কর রাত্রে আটকে রেখে শত্রুতা করলো, দাদা মরে আমার চরম শত্রুতা করে গেল।
কিন্তু আমি যদি সেদিন না যেতাম, এ সবের কিছুই হতো না!
সেদিন ওখানে বেরোনোর আগে পর্যন্তও তো আমার পৃথিবী ঠিক ছিল। আমার সোনা রঙের পৃথিবী। সেদিন সকালেও অমূল্য স্যাকরা এসেছিল, আমার বারোমেসে চুড়ি জোড়াটা হাতে ছোট হয়ে গেছে বলে আর একজোড়া চওড়া প্যাটার্ণ করে গড়তে দিলাম।
দুপুর বেলা শশী এসে বললো, ‘হঠাৎ বাজারে গঙ্গার ইলিশ এসেছে ছোট বৌদি, দিন তো টাকা—।’
তখন খাওয়া হয়নি কারুর।
আমি তাড়াতাড়ি টাকা দিলাম।
শশী বললো, ‘এতে হবে না। মাছ কি কখনো আপনারা একা খেয়েছেন? আমরাও খাবো তো—।’
রেগে বললাম, ‘তিরিশ টাকা দিলাম, তাতেও হবে না?’
ও বললো, ‘কি করে হবে? ষোলো টাকা কিলো। অন্ততঃ সের আড়াই না হলে কি করে হবে? ছোট দাদাবাবু তো একাই এক কিলো মেরে দেবে—’
পুরনো লোক, ভালও বাসে, বলেও যা খুশি।
আরো দুখানা নোট ফেলে দিলাম ওর দিকে। ও হাসতে হাসতে চলে গেল। আর চমৎকার টাটকা গঙ্গার ইলিশ নিয়ে এল।
কী খুসিই হলো ও খেতে বসে! গঙ্গার ইলিশ তো পাওয়াই যায় না আজকাল। তা শশী মিথ্যে বলেনি, সেরখানেক মাছ একাই খেয়ে ফেললো ও। আমার তো ভয়ই করছিল পাছে ওর অসুখ করে।
ভগবান, ওর কেন অসুখ করলো না?
খুব অসুখ। ডাক্তার ডাকাডাকি কাণ্ড!
তাহলে তো আমি বাপের বাড়ি যেতে চাইতাম না। তা’হলে তো আমি ওকে এমন করে হারাতে বসতাম না। ওর অসুখ ওষুধ খেয়ে ভাল হয়ে যেতো।…এ যে ভাল হবার নয় গো!
তা তখনও তো আমি যাবার কথা স্পষ্ট করে ভাবিনি। ‘কাল’ করলো মুক্ত তাঁতিনী। মুক্ত যদি সেদিন না আসতো, আমি আমার সেই দু জোড়া হাতীপাড় শাড়ির সঙ্গে বৌদির জন্যেও দু’খানা টাঙাইল শাড়ি নিয়ে ফেলতাম না।
নিয়ে ফেললাম বলেই না তখনই নিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো। তাই তো ওকে বললাম, ‘চল না।’
কী ‘কাল’ শাড়িই দিয়ে গেল মুক্ত! ও কি আর ইহজীবনে আমার অঙ্গে উঠবে? আর বৌদির তো—
ভাবতে পারি না।
ভাবতে গেলে মাথা ঝিম ঝিম করে আসে। আমার উকিলও আমায় পাখি পড়াল—’না আপনার দাদার সেই রক্তাক্ত মৃত দেহটার কথা একবারও চিন্তা করবেন না। ওটা আপনি সম্পূর্ণ ভুলে যাবেন। মনে করতে গেলেই সে দৃশ্য আপনার মন দুর্বল করে দেবে। আপনি নার্ভাস হয়ে পড়বেন। …যতই হোক সহোদর ভাই।
তাছাড়া আপনি স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকদের মন স্বভাবতই কোমল। তাছাড়া আপনি তো আরোই—কিন্তু মনে রাখবেন শ্রীমতী ভারতী দেবী, স্বামীর বড়ো বস্তু পৃথিবীতে আর কিছু নেই, স্বামীর বড়ো আপনজনও জগতে আর কেউ নেই।
আপনি যদি আপনার মৃত ভ্রাতার মুখ মনে করে মন দুর্বল করে বসেন তো—সেটা হবে আপনার নিজের স্বামীর মৃত্যুবাণ রচনা করা।
…মনে ভাবতে চেষ্টা করুন, আপনার কোনোদিন কোনো ভাই ছিল না। ভাবতে চেষ্টা করুন, আপনার আর কেউ নেই পৃথিবীতে শুধু আপনি আছেন আর আপনার স্বামী আছেন।
সেই স্বামী—মনে ভাবতে চেষ্টা করুন ভারতী দেবী, সেই স্বামী হাজতে বসে ফাঁসির দিন গুনছেন।…
তাঁর একমাত্র আশা—ভরসা আপনি। আপনার মুখ চেয়ে বসে আছেন তিনি।
আবার এই পৃথিবীর আলো—বাতাস ভোগ করবার অধিকার একমাত্র আপনিই তাঁকে দিতে পারেন।…
…কি করে? সে কথা তো বলেইছি।
আপনি আপনার হৃদয়ের মধ্যে একেবারে বদ্ধমূল করুন আপনার স্বামী মিথ্যা দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, আপনার ভাই আত্মহত্যা করেছেন। আপনার ভাইয়ের স্ত্রী আপনার প্রতি ঈর্ষাবশতঃ এই কেস সাজিয়েছেন।…
ঈর্ষা শুনে অবাক!
কী আশ্চর্য, এটা তো একটা স্বাভাবিক কথা। আপনার প্রতি তাঁর ঈর্ষা তো একেবারে দুই আর দুইয়ে চার।
আপনি তাঁর স্বামীর সহোদরা, অথচ আপনি কত সুখ ঐশ্বর্যের মধ্যে রয়েছেন, অথচ তিনি? তিনি নিতান্ত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে কাটাচ্ছেন।…তবু যাই হোক তাঁর স্বামী ছিলেন। সাধারণ সুখী জীবন ছিল।
কিন্তু এখন?
এখন তিনি হলেন দুঃখিনী অভাগিনী—বিধবা। পৃথিবীর সর্বসুখ বঞ্চিতা।
আর আপনি?
যা ছিলেন তাই।
অতএব আপনার প্রতি ঈর্ষায় তাঁর প্রাণ ফেটে গেল। আপনিও যাতে তাঁর মত অভাগিনী হয়ে যান, সেই মতলবে একটা খুনের কেস সাজালেন।…এটা সুবিধে হলো—দৈবক্রমে সেই রাত্রে আপনারা ওই বাড়িতে থেকে যাওয়ায়।
আপনার ভাই যে সেদিন অত অনুরোধ করেছিলেন থাকবার জন্যে সেটাও সেই কারণেই। …বুঝতে পারছেন? মৃত্যুর আগে যাতে স্নেহের ছোট বোনটিকে কিছুক্ষণ দেখতে পান। আর… আত্মহত্যার জন্যে প্রয়োজনীয় উপকরণও।…তিনি তো জানেন তাঁর ভগ্নিপতি ওটা সর্বদা কাছে রাখেন।
…এখন বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?
…কিন্তু এ প্রশ্ন উঠবে—আপনার দাদা শিক্ষিত শান্ত একটি ভদ্রলোক তিনি হঠাৎ আত্মহত্যার প্রেরণা অনুভব করলেন কেন?
…এ কারণ—ও আপনাকে জানাতে হবে—স্ত্রীর চরিত্র সম্পর্কে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। সন্তুষ্ট কি, দারুণ অশান্তিতেই ছিলেন।…
আপনার মা সেই কারণেই—অর্থাৎ পুত্রবধূর ওপর ঘৃণায় সংসার থেকে প্রায় নির্লিপ্ত হয়ে আছেন। তার হাতের রান্না পর্যন্ত খান না। নিজে যা পারেন তাই খান।
আহা বৃদ্ধা মহিলা!…এখন তাঁর এই পুত্রশোক! আপনি ভাবুন আপনার ভাইয়ের স্ত্রীই এই সমস্তর মূল।
…না, একথা মনে করবেন না এসব কথা আমি আপনাকে বলেছি। মনে বদ্ধমূল করে রাখুন, এই সবই ঘটেছে। আপনার ভ্রাতৃবধূর চরিত্র দূষিত, সেই ঘৃণায় আপনার ভাই আত্মহত্যা করেছেন। এবং আপনার সেই নীচ চরিত্র ভ্রাতৃবধূ আপনার প্রতি ঈর্ষাবশতঃ আপনার স্বামীকে খুনী সাজিয়ে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেষ্টা করছেন।’
এইভাবে আমাকে পাখি পড়াচ্ছেন উকিলবাবু।
ক্রমশঃই যেন আমিও সত্যিই তাই ভাবতে সুরু করছি।…আমার ভাজ বরাবর আমার প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ, আমার সুখ তার সহ্য হয় না।
…আমার দাদা আত্মহত্যার সংকল্প নিয়েই সেদিন আমাদের ওখানে থাকবার জন্যে অত অনুরোধ জানিয়েছিল।
কারণ ও জানতো রাতের দিকে বেরোলেই রাজেন পকেটে রিভলভার নিয়ে বেরোয়।
অতএব থাকবেই নিশ্চিত পকেটে। ওটা রাখাইতো অনেকখানি আভিজাত্য।
তাই দাদা ভেবেছিল, ওকে বলে কয়ে রাত্রে থাকতে রাজী করে ফেলতে পারলেই অস্ত্রটা বাগাতে পারবো।
এইসব কথা মনের মধ্যে বদ্ধমূল করেছি আমি। এই কথার ওপরই জোর দেবো আমি আদালতে।
কিন্তু আমার ভাজের চরিত্রে কলঙ্ক? সেটা আমি কি করে দেবো?
উকিলবাবু বলছেন, ‘আপনার স্বামীর জীবনের কাছে কি আপনার ভাজের সুনাম দুর্নাম বেশী হলো?
আমাদের কাছে তো জগতের যত ‘ইয়ে’র হিসেব। আপনি যদি দেখতে চান তো এমন ফাইল বস্তা বস্তা দেখিয়ে দেব, যাতে স্বামী তার সতী সাধ্বী স্ত্রীর নামে মিথ্যা কলঙ্ক দিয়ে মামলা সাজিয়ে বিপদ থেকে পার পেয়েছে।
আমিও অতএব মন শক্ত করছি।
আমি পড়াপাখির মত সব মুখস্থ করছি।
তার সঙ্গে দেখে বেড়াচ্ছি টাকা দিয়ে কি কি করা যায়, কাকে কাকে হাত করা যায়।
তবু প্রাণের মধ্যে রাতদিন হাহাকার, কেন আমি সেদিন ওখানে গিয়েছিলাম? গিয়েও যদি ছিলাম, ঝড় উঠছে দেখে তাড়াতাড়ি চলে আসিনি কেন? কেন ঝড় থামার অপেক্ষা করেছিলাম।
সে ঝড় যখন থামল না, আমার জীবনের সব সুখ উড়িয়ে ঝড়িয়ে ভাসিয়ে দেবার জন্যে যখন প্রলয়ের বৃষ্টি নামলো, আমি কেন ওকে নিয়ে শুয়ে পড়লাম না। কেন তাস খেলতে বসলাম।
আর সব শেষ কথা হচ্ছে কেন আমি ওকে ফেলে ‘ঘুমোতে যাই’, বলে চলে এলাম অন্য ঘরে।
আমি যদি থাকতাম, এমন ঘটনা কি ঘটতে পারতো? কত বচসা হতো ওর আমার দাদার সঙ্গে? কতখানি অপমান করতে পারতো দাদা ওকে আমার সামনে?
অপমান তো নিশ্চয়, নইলে হঠাৎ ও শুধু শুধু এত উত্তেজিত হতে পারে কি করে? যাতে ওর খুন চেপে যায় মাথায়?
উকিল আমায় যতই পাখি পড়াক, আমি তো জানি ঘটনাটা কি।
আমি ‘ঘুম পেয়েছে’ বলে এঘরে চলে এসে শুধু বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, তারপর একবার যেন বৌদির বেহায়া হাসির শব্দ শুনতে পেলাম।
পুরুষ দেখলে বড্ড বাচাল হয়ে ওঠে বৌদি। তা আমি অবিশ্যি তাতে দোষ ধরিনি, ননদাই তো! তাছাড়া দাদা রয়েছে সামনে।
তারপর—
তার একটু পর আমি একটা উত্তেজিত কথা কাটাকাটির শব্দ পেলাম, দাদার আর ওর।
আমি ভাবলাম ওরা আবার তাস রেখে পলিটিকস নামিয়েছে। তাতে দাদার সঙ্গে কিছুতেই মতের মিল হয় না ওর!
আজও বোধহয়…উঃ তারপরই আমি সেই দ্বিতীয় বাজের শব্দটা শুনতে পেলাম।
যে বাজটা আমার বুকটা গুঁড়িয়ে দিল, আমার ভবিষ্যৎটা গুঁড়িয়ে দিল আর আমার বৌদির মন প্রাণ জীবন ভবিষ্যৎ…না না, একথা আমি ভাবতে বসছি কেন? আমার বৌদির ওপর মমতা আনলে তো চলবে না আমার।
আমার দাদা আত্মহত্যা করেছে।
করেছে আমার বৌদির চরিত্রে সন্দেহ করে। তা’ সত্ত্বেও বৌদি চীৎকার করে উঠেছিল, আমি ছুটে গিয়ে দেখেছিলাম দাদা গুলি খেয়ে পড়ে আছে, ‘খুন খুন… মেরে ফেললো, শেষ করে ফেললো’—বলে আর্তনাদ করছে।’
আর আমার স্বামী বোকার মত ফ্যালফেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মানে হঠাৎ কাজটা করে ফেলে ওর মাথার নার্ভ বিকল হয়ে গেছল তখন।
আমি পরিস্থিতি দেখে ওকে চাপা গলায় বলে উঠলাম ‘পালাও, শীগগির পালাও।’
ও বোকামি করলো, তক্ষুনি পালাল না।
ও তখন নিজেও চেঁচাতে লাগলো।
অর্থাৎ তখন ওর মাথার মধ্যে চেতনাটা ফিরে এল তাই পরিত্রাহি চেঁচাতে লাগলো, ‘কী হলো? কী বলছেন?….বৌদি… দাদা?’
আমার দাদা মারা গেল, তবু আমি মাথা ঠাণ্ডা করে ওকে আবার বলে ঠেলে পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তখন ‘টু লেট’। তখন পাড়ার লোক এসে গেছে, পুলিশ এসে গেছে। আমার স্বামীর ফাঁসির পথ পরিষ্কার হয়ে গেছে।
কিন্তু সেই পথ আমায় বন্ধ করতে হবে। আমি তাই জলের মত টাকা খরচ করছি।
ভগবান, পুলিশের লোক যদি না দেখতো?
তাহলে আমি আমার স্বামীর লুকোনা পেয়ারের মেয়েমানুষটার বাড়ি গিয়েও টাকা ঢালতাম। তাকে দিয়ে সাক্ষী দেওয়াতাম সেই রাত্রে আমার স্বামী ওর বাড়িতে ছিল।
সে রকম সাক্ষীতে নাকি খুনের কেসও ঘুরে যায়।
আমার উকিলবাবু বলেছে সে কথা।
কিন্তু ও মুখ্যুমি করেছিল, তক্ষুনি ছুটে পালায়নি। পালালে বৃষ্টির মধ্যে কে দেখতো? … আমি তো ওকে বলেওছিলাম, ‘বাড়ি, নয়, অন্য কোথাও পালাও।’
ও ভাবতো আমি কিছু জানি না, ওর সেই আর একজায়গার সংসারের কথা টের পাই না। কিন্তু আমি সবই জানতাম। তার ঠিকানা টিকানা সব। কিন্তু কোনোদিন সে কথা নিয়ে কথা তুলিনি। তুললেই ওর ভয় ভেঙ্গে যেতো, ও বে—হেড হয়ে যেতো। যেমন আমার শ্বশুর ছিলেন শুনতে পাই।…বাড়িতে বসে যা খুশি করতেন। কিন্তু ও লুকোয়, মাঝে মাঝে এটা—ওটা ছুতো করে রাত করে, দু’ একদিন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছি বলে ডুব মারে। তার মানে আমায় ভয় করে। সেইটুকুই আমার লাভ।
আমার বাবার লোভের প্রতিফল আমি পাচ্ছি। তবু সেটাকেই আমার ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছি। সেই ভাগ্যকেই ভালবেসেছি।
ও আমায় ভয় করে বলেই ওকে এত ভালবাসি। ও আমায় অগ্রাহ্য করে না বলেই আমি সুখে আছি।
কিন্তু সেই মেয়েটার কাছে কি আমি যাবো? কিছু টাকা দিয়ে আসবো? মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াতে নয়, তার খরচ চালাতে। আমার স্বামীকে মাঝে মাঝে দেখতে যেতে যাই তো, মনে হয় যেন কী ‘বলি—বলি’ করছে। লজ্জায় ভয়ে বলতে পারে না।
ওর হয়তো দিন শেষ হয়ে আসছে, কেন আর ওকে মনোকষ্টে রাখি। মেয়েটাকে কিছু টাকা দিয়ে এসে জানাবো দিয়ে এসেছি তোমার ‘তাকে’।
রায় বেরোবার দিন এগিয়ে আসছে… আমার হাত পা কাঁপছে।
হ্যাঁ, সেই একটা মেয়ে আছে।
রাজেন্দ্রভূষণের অনুগৃহীতা।
রাজেন্দ্রভূষণের রক্তধারা জানে এরকম এক—আধটা না থাকাটা অগৌরব। রাজেন্দ্রভূষণের রক্তধারা কিছুতেই শুধু স্ত্রী নিয়ে ঘর—সংসার করার মধ্যে উন্মাদনা পায় না। ওদের আরো কিছু চাই। কিন্তু স্ত্রীকে সে ভালোবাসে। তাই লুকোচুরি।
ভারতী সে লুকোচুরির একটা দরজা খুলে দিল। মেয়েটার কাছে নিজে টাকা পৌঁছে দিয়ে গেল। বললো, ‘তা তোমারও তা খেতে পরতে লাগবে। যে জোগাতো, সে তো এখন—’
মেয়েটা বিহ্বল দৃষ্টি মেলে বলে, ‘আপনি এসেছেন এখানে? আপনি নিজে? আমায় টাকা দিচ্ছেন।’
ভারতী বিষণ্ণ হাসি হেসে বলে, ‘কি করবো? না খেয়ে মরবে?’
‘আমার মত তুচ্ছ প্রাণীর মরা—বাঁচায় পৃথিবীর কী এসে যায় দিদি?’
‘পৃথিবীর কী এসে যায় না যায় জানি না, আমার স্বামীর তো এসে যাবে?’
ভারতী আবার ম্লান হাসি হাসে, ‘যদি ভগবান সুদিন দেন, যদি আবার ফিরে আসেন, তখন? এসে দেখবেন খাঁচার পাখি ছাতুর অভাবে মরে পড়ে আছে? আর নয়তো খাঁচা ভেঙে উড়ে পালিয়েছে বনের ফলের চেষ্টায়।’
মেয়েটা ভারতীয় পায়ের ধুলো নিয়ে বলে, ‘দিদি আপনি এত মহৎ।’
ভারতী বলে, ‘মহৎ—টহৎ কিছু নয় বাবা, কিন্তু কর্তব্য বলেও তো একটা কথা আছে।’
ভারতী গাড়িতে উঠে যায়।
মেয়েটা নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকে।
নিজেকে ভারী ছোট মনে হয় তার। ভারী অপরাধিনী রাজেন্দ্রভূষণের মত একটা অসার লোককে এত ভালবাসতে পারেন উনি! আশ্চর্য!
অসার ছাড়া কি?
সে নিজে তো জানে সে কথা।
কিন্তু তাদের আর বাছ—বিচার। একজন যদি খাইয়ে পরিয়ে আশ্রয় দিয়ে রাখে সেটাই শান্তি। সেই শান্তিটুকুই লাভ।…কিন্তু আজ বড় ধিক্কার আসছে ওর।
রাজেন্দ্রভূষণের খবর ও জানে। ও উৎকণ্ঠিত প্রাণ নিয়ে খোঁজ করে, কি হল?…ও কাগজ উলটে দেখে আইন আদালতের কলমে।
কিন্তু ভেবে পায় না সেই বাজে চাল—সর্বস্ব ‘বোকা—চালাক’ লোকটা খুনের দায়ে পড়লো কি করে? তাও যে—সে খুন নয় নিকট আত্মীয়। ও কেন খুন করতে যাবে তাঁকে? ওঁর স্ত্রীর সঙ্গেও কি কোন লুকোনো সম্পর্ক ছিল রাজেনের? ধরা পড়ে গিয়ে মান বাঁচাতে—
যে যার নিজের মত করে ভাবে। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। কেউ কাউকে ঠিক বুঝতে পারে না, কেউ কারুর সঠিক চেহারা জানে না।
রাজেন্দ্রভূষণই কি কোনোদিন কল্পনা করতে পারতো, ভারতী সেই মেছোবাজারে গলির মধ্যে ঢুকে তার স্বামীর অনুগৃহীতাকে টাকা দিয়ে আসতে পারে—পাছে মানুষটা কষ্টে পড়ে ভেবে?
রাজেন্দ্রভূষণ জানতো ভারতী ওই মেছোবাজারের খবর টের পেলে কাঁদবে কাটবে রসাতল করবে, হয়তো গলায় দড়ি দিয়ে বসবে। তাই রাজেন্দ্রভূষণ সযত্নে গোপন রেখেছিল খবরটা। কিন্তু রাজেন্দ্রভূষণ সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তে টের পেলো কোনো খবরই গোপন থাকে না।
কিন্তু শুধুই কি রাজেন্দ্রভূষণ টের পেলো?
সেই কথাই ভাবে রাজেন্দ্র হাজতে বসে। কিন্তু কতকগুলো নোংরা কুৎসিত লোকের সঙ্গে পড়ে থাকতে সে বুঝি সব ভুলে যাচ্ছে। তাই সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্তটার কথা যতবার স্মরণে আনতে চেষ্টা করে, তত বারই যেন গুলিয়ে যায়।
যতক্ষণ তাস খেলা হচ্ছিল, স্পষ্ট পরিষ্কার। এমন কি কে কতবার জিতেছে হেরেছে তাও হয়তো ভাবলে মনে করতে পারবে। এমন কি ভয়ঙ্কর সেই বাজ পড়ার শব্দটা এবং তারপর ভারতীর হাই তুলে শুতে যাওয়া পর্যন্ত।
কিন্তু তার পর কি হলো?
তারপর?
ওঃ! তারপর তো তাসের ম্যাজিক দেখতে চাইলো পার্থর বৌ। আমি দেখালাম। ও খুব হাসাহাসি করলো, তাস নিয়ে কাড়াকাড়ি লাগালো, কিন্তু তারপর?
তারপর সব গুলিয়ে যাচ্ছে কেন?
এতদিন ধরে কতকগুলো নোংরা বদমাইস লোকের সঙ্গে থেকে আমার কি বুদ্ধি—সুদ্ধি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে?
কিন্তু এই নোংরাগুলোর সঙ্গে আমি কেন?
আমি না সুরেন্দ্রভূষণ রায়ের ছেলে রাজেন্দ্রভূষণ রায়। স্প্রীঙের গদিতে ছাড়া কখনো শুইনি আমি, এখন ডানলোপিলো ছাড়া।… আমার বাবা কাকা চন্দ্রকোণার ধুতি ছাড়া পরতেন না, আমি বাজারের সেরা দামী ডেক্রন টেরিলিন। আমার বাড়িতে গুনলে দশটা লোকজন, আমার বাড়ির বাথরুমের মেজেয় মুখ দেখা যায়। …অথচ আমি এদের সঙ্গে পড়ে আছি, নোংরা খাদ্য খাচ্ছি, নোংরা জামা পড়ছি।…কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা কাজ করেছি।
আমি খুন করেছি।
কিন্তু কেন করেছি? কোন পরিস্থিতিতে?
কিছুতেই মনে পড়ছে না সেটা।
পার্থর স্ত্রীর চীৎকারে যেন ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। হঠাৎ যেই ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে দেখেছিলাম, ভারতী ছুটে আসছে, ভারতীর মা ছুটে আসছেন। আর ভারতীর দাদা?
আমি আবার চোখ বুজে ফেলেছিলাম।
আমিও চেঁচিয়েছিলাম।
কী বলে চেঁচিয়েছিলাম? তা মনে নেই।
তারপরই তো কি যেন গোলমাল হয়ে গেল। আমাকে ধরে নিয়ে এল পার্থকে খুন করেছি বলে।
কিন্তু আমার হাতে রক্তের দাগ কই?
আমার হাতে রিভলভারের ঠাণ্ডা—টাণ্ডা স্পর্শটা কই?
যে স্পর্শটা কত দিন পর্যন্ত লেগেছিল আমার মেজদার পোষা কুকুর বাহাদুরকে গুলি করে মেরে ফেলার পর। বাহাদুরকে মেরে ও যে আমার হাতে কতদিন ধরে রক্ত লেগেছিল। আমি হাতে করে ভাত খেতে পারতাম না, চামচে করে খেতাম।
বাহাদুরকে আমি মেরে ফেলেছিলাম। মেজদার সঙ্গে শত্রুতা করে মেরে ফেলেছিলাম। কিন্তু যখন বাহাদুরটা গুলি খেয়ে লটকে পড়লো, তখন তার দিকে তাকাতে পারিনি আমি। আর বাহাদুরের সেই চোখ দুটো ঘুমের মধ্যে তাড়া করে বেড়িয়েছিল আমায়। হঠাৎ এই একটা অভাবিত বিশ্বাসঘাতকতায় যে চোখ দুটো বড়—বড় হয়ে উঠেছিল, তারপর পৃথিবীর আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে বুজে এসেছিল।
আমি তাকাতে পারিনি, তবু চকিতের সেই দৃশ্যটাই আমাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই যেন। কিন্তু পার্থর ব্যাপারটা গুলিয়ে যাচ্ছে কেন?
বাহাদুরকে গুলি করেছিলাম মেজদার ওপর আক্রোশে, কিন্তু পার্থ। আমার স্ত্রীর দাদা। বয়সে ছোট হলেও আমি যাকে দাদা বলে এসেছি বরাবর। তার ওপর কিসের আক্রোশ ছিল আমার?
ভারতীর ওপর আক্রোশে।
কিন্তু কেন?
ভারতী তো কোন দোষ করেনি।
ভারতী তো কোনোদিন আমার জীবনের চোরাকুঠুরিতে উঁকি দিতে যায়নি? ভারতী তো চিরকালের হিন্দু মেয়ের মত স্বামীকেই দেবতা জ্ঞানে—…ও মনে পড়েছে ভারতীর ওই দাদা সেই চোরাকুঠুরীর দরজায় উঁকি দিয়েছিল।
ভারতীর দাদা বলেছিল,—’সরযূকে চেনো?’ কিন্তু তাই বলে আমি ওকে বাহাদুরের মত গুলি করলাম? অত ভালবাসতাম ওকে!
তা বাহাদুরকেও তো ভালোবাসতাম আমি। যখন আমাদের বাড়ির মাঝখানে মাঝখানে পাঁচিল পড়েনি, তখন তো বাহাদুর সব ঘরেই ঘুরে বেড়াতো। তখন আমি ওকে কত আদর করেছি, কত বিস্কিট খাইয়েছি।
পাঁচিল পড়ার পর ক্ষেপে গেলাম আমি। আর আমার ওই মেজদাটাকে ভয়ানক কোনো যন্ত্রণা দেবার বাসনায় বাহাদুরকে হঠাৎ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে গুলি করলাম।
মেজদা আমার নামে থানায় ডায়েরী করে এল। আমার নামে কেস করলো, বাহাদুর ওর পুত্রতুল্য, অতএব বাহাদুর হত্যাকারীকে ওর পুত্রঘাতীর তুল্য শাস্তি দেবার জন্যে আবেদন করলো।
এই মেজদা।
যে আমার শাস্তি মুকুব করবার জন্যে প্রাণপণে লড়ছে, হাজার হাজার টাকা খরচ করছে।
আশ্চর্য মানুষের মন! ওযে কখন কি করে বসে! নইলে আমিই কি কখনো ভেবেছিলাম বাহাদুরকে গুলি করতে পারি?
আমি ‘বাহাদুর হত্যার’ কেস থেকে উদ্ধার পেয়েছিলাম আমাদের দারোয়ানকে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে।
দারোয়ান সাক্ষী দিয়েছিল বাহাদুর আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জামার কলার চেপে ধরেছিল, দারোয়ানও টেনে ছাড়াতে পারেনি। বাধ্য হয়েই তাই আমি অনেক কষ্টে ওকে এক হাতে ঠেকিয়ে এক হাতে রিভলবার বার করেছিলাম।
অতএব আমার ফাইন হলো না। আমার রিভলভারের লাইসেন্স কেড়ে নেওয়া হলো না। বরং আমিই পরে উল্টে ‘চার্জ’ করেছিলাম চিরদিনের বিশ্বস্ত, আর সকলের প্রিয় কুকুরটা যে হঠাৎ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেটা কেন? নিশ্চয় তার প্রভুর প্ররোচনায়।
সেই কেসও চলেছিল কিছুদিন।
তারপর ডিসমিস হয়ে গেল।
কিন্তু তখনও আমি চামচে করে ভাত খাচ্ছি।
আর ভারতী?
ভারতী তখনও থেকে থেকে বলছে, ‘বাহাদুরকে গুলি করলে তুমি? তুমি তো তা হলে মানুষ খুন করতেও পারো।’
আমি অবশ্য নিজের লজ্জা ঢাকতে বলেছিলাম, ‘তুমি তো ছাগল ভেড়ার মাংস খাও, মানুষের মাংসও খেতে পারো তাহলে?’
কিন্তু ওটা যুক্তি নয়।
মনে মনে আমি হেরে গিয়েছিলাম। ভারতীর সামনে চড়াগলায় কথা কইতে পারিনি কতদিন।
আর এখন?
এখন আমি ভারতীর সামনে প্রমাণ করলাম। আমি মানুষ খুন করতেও পারি।
…কিন্তু অবাক হয়ে দেখছি—ভারতী আমায় ধিক্কার দিচ্ছে না, ভারতী বলছে না—’জানতাম, তখনই জানতাম এ কাজ তুমি করতে পারো।’…ভারতী মরমে মরে গিয়ে বলছে না—’তা বলে তুমি দাদাকে—?’
ভারতী আমাকে দেখা হলেই আশ্বাস দিচ্ছে, সান্ত্বনা দিচ্ছে। বলছে ‘মা কালীর কাছে মানত করেছি, কাশীর বিশ্বনাথের কাছে মানত করেছি। তেত্রিশ কোটি দেবতার কাছে মানত করেছি আমার সিঁথের সিঁদুর যেন বজায় থাকে।’
ভারতীর ওই আশ্বাস দিয়েই কি আমার হাতের রক্তের দাগ মুছে গেছে?
তাই আমি টের পাচ্ছি না ওটা কখন লেগেছিল।
আমি আরো অবাক হচ্ছি আমার দাদাদের ব্যবহারে। বড়দা বলে গেছে, ‘তুই কিছু ভাবিস না—সুপ্রীমকোর্ট পর্যন্ত আপীল করবো আমরা।’
মেজদা বলেছে—’সুযোগ করে ওপক্ষের উকিলকে ঘুষ দিয়ে কেস ঘুরিয়ে নেব দেখিস। ওদের কতই বা পয়সা? পুঁটি মাছের প্রাণ! নেহাৎ খুনের কেস বলেই এতদিন পর্যন্ত টানছে।’
কিন্তু কবে করবে ওসব?
না কি করছে ভেতরে ভেতরে? বেশী কিছু ভাবি না আর। আমি শুধু ভাবছি সরযূটার কী হচ্ছে? কি জানি এতদিন অন্য কারো কাছে চলে গেল কি না। তা যদি যায় তো ভালো। নইলে বেচারা কষ্ট পাবে।…পুলিশ বোধহয় ওর সন্ধান পায়নি, নইলে ওকেও কোর্টে এনে হাজির করতো। ভাগ্যিস পায়নি। তা’হলে আর ভারতীর কাছে মুখ দেখানো যেত না।
কিন্তু পুলিশ যার সন্ধান পায়নি, ও তার সন্ধান পেলো কি করে?
ওই হতভাগ্য লোকটা?
বাহাদুরের মত গুলি খেয়ে লটকে পড়লো যে? বাহাদুরের চোখে তাকালো?
কিন্তু ভারতীর কাছে মুখ দেখাবার ভাবনাটা আর ক’দিন? যে যতই আশ্বাস দিক, আমি জানি আমার ফাঁসি হবেই। কারণ আমার সেই শ্যালাজ, নিহতের স্ত্রী নন্দিতা দেবী, সে নাকি প্রতিজ্ঞা করেছে আমায় ফাঁসি দিয়ে ছাড়বেই।
আশ্চর্য!
ও আমায় কত যত্ন করে খাইয়েছে!
কত হাসি গল্প করেছে!
আচ্ছা, আমি ফাঁসিতে ঝুললেই কি পার্থ নামের সেই মানুষটা বেঁচে উঠবে?… কি জানি। সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ জীবটা কি? ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছি না, পার্থকে আমি বাহাদুরের মতন গুলি করলাম কি করে? কিন্তু কখন করলাম? আমার স্মৃতিশক্তি সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।…কোনো কিছুর মানে পাচ্ছি না।
আমি কি তবে সব ছেড়ে দিয়ে শুধু মানুষের মানে খুঁজবো?
রাজেন্দ্রভূষণ নামের লোকটা বোকা, তাই মানুষের মানে খুঁজতে চাইছে। কিন্তু মানুষের কি সত্যিই কোনো মানে আছে?
নন্দিতা নামের ওই মেয়েটা, যে নাকি শ্মশানের ডাকিনী যোগিনীর মত মূর্তি করে রাজেন নামের লোকটাকে ফাঁসিতে ঝোলাবেই, তার কি মানে?
মানে নেই। তাই মানুষেরও মানে নেই।
তাই ও ওর উকিলের কাছে সমানেই বলে চলেছে, ‘তারপর—আমার ননদ উঠে যাবার পর আমি বললাম, ‘খেলা চলুক না আর একটু?’
আমার স্বামী হেসে বললেন, ‘তিনজনে কি খেলা জমে? কে কার পার্টনার হবে?’
নন্দিতার ভিতরটা কাঠ হয়ে গিয়েছিল বলেই বোধহয়, স্বামীর নাম করতে, স্বামীর হাসির কথা উল্লেখ করতেও গলা একটু কেঁপে যাচ্ছে না। সমানে চালিয়ে যাচ্ছে।
‘তারপর আমি বললাম তবে তাসের ম্যাজিক দেখাও।
…আমার ননদাই, ওই হত্যাকারী শয়তান অনেক রকম ছলনা জানতো, মানুষের মন ভোলাবার অনেক কৌশল। তাসের ম্যাজিক তার মধ্যে একটি।