৭
পার্থর মত নির্মল পবিত্র আর ভদ্র সভ্য ছেলের সঙ্গে কোনো সন্দেহই জোড়া চলে না। বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারও এখানে অনুপস্থিত। যে বিষে আচ্ছন্ন হলে কাকা ভাইপোকে খুন করে, ছেলে বাপকে খুন করে।
হত্যাকাণ্ডের রীতি পদ্ধতিও যেমন অশেষ অনন্ত, তার কারণও তেমনি সংখ্যাতীত। আবার তার ‘চরিত্রের’ও ঠিক ঠিকানা নেই। জগতে যে কত অস্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড ঘটে, তার কিছুটা সাক্ষী হয়তো বিচারশালার দপ্তর।
তবু সরকারী দপ্তরের সেই পার্থসারথি সেন নামের মাঝারি কেরাণীটির হত্যাকাণ্ডটা যেন লোককে বিস্ময়ের চরম সীমায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
তাই তার স্ত্রী নন্দিতা সেনকে ঘিরে দিন—রাত্তির মানুষের জটলা। দিন—রাত্রির জটিলতা সৃষ্টির আকিঞ্চন।
নন্দিতা যেন ক্রমশঃ ভুলে যাচ্ছে, সে একদা একটা শান্তছন্দ সংসারের ‘লক্ষ্মী প্রতিমা’ বৌ ছিল। ভুলে যাচ্ছে, সভ্যতা আর শালীনতার জন্যে তার খ্যাতি ছিল। ভুলে যাচ্ছে একদা স্নেহময় প্রেমময় শান্তিময় একটি স্বামী নিয়ে সুখে সংসার করেছে সে।
নন্দিতার শুধু মনে রয়েছে, তার হৃৎপিণ্ডটা যেমন একজন নখে করে ছিঁড়ে উপড়ে নিয়েছে, আর একজনের হৃৎপিণ্ডটাও তেমনিভাবে ছিঁড়ে নিতে হবে তাকে। সেইটাই নন্দিতার কাছে এখন পরম পবিত্র কর্তব্য।
‘অপঘাত মৃত্যু’র অপরাধে যে প্রেতটার যথোচিত শ্রাদ্ধ হল না, তার তৃষিত আত্মাকে তৃপ্তি দিতে হবে বৈকি! আর সে কর্তব্য তো নন্দিতারই। নিজেই তাই নন্দিতা শ্মশানের প্রেতিনীর মত দুই চোখে ধকধক করা নারকীয় আগুন জ্বেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে—
তাছাড়া বড় একটা জটলায় যে রাতদিন ঘিরে আছে তাকে। কখন সে নিঃসঙ্গ চিত্তের ভয়ঙ্কর শূন্যতাকে বুকে নিয়ে স্মৃতির পাথারে ডুবে যাবে? কখন সে ভাবতে চেষ্টা করবে প্রথম শুভদৃষ্টির সময় পার্থ কেমন করে তাকিয়েছিল তার দিকে? প্রথম ভালবাসার মালাখানি কেমন করে দুলিয়ে দিয়েছিল তার বুকে? আর নিজে সে দিনে দিনে তিলে তিলে কেমন করে উন্মীলিত হয়েছিল সেই আলোয় ভরা মুখটার দিকে তাকিয়ে?
না! কেউ নন্দিতাকে একবারও সেই পাথারে ডুবতে দিতে চায় না। কেউ একবারও ওকে একলা থাকতে দেয় না।
ডাক্তারে নাকি বারণ করেছে।
একা থাকলেই ও নাকি সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির ঘটনা স্মরণ করবে, আর তাতে শিউরে উঠবে, চেঁচিয়ে উঠবে, পাগল হয়ে যাবে।
অজিতা দেবীর বিষয় কিছু বলেনি ডাক্তার।
বলবার প্রয়োজনও অনুভব করেনি।
যিনি অতবড় ‘দুর্ঘটনার পরও লোকসঙ্গ’র জন্যে আকুল না হয়ে যথারীতি তাঁর সেই তিনতলার পূজোর ঘরে আসন স্থাপন করে একা বসে থাকছেন, বসে থাকতে পারছেন, ছুটে বেরিয়ে আসছেন না, বেরিয়ে এসে মাথায় ঘটি ঘটি জল থাবড়াচ্ছেন না, এমন কি তীক্ষ্ন করুণ কান্নায় আকাশ বিদীর্ণ করে ফেলছেন না। তাঁর জন্যে ভাবনার কি থাকতে পারে?
তিনি শক্ত। তিনি পাথর। তিনি ভয়ঙ্কর একটা সন্দেহের বস্তুও।
কে জানে কেমন করে হঠাৎ তাঁর পরিচয়টা যেন নন্দিতার শত্রুপক্ষের দলে পড়ে গেছে। নতুন কোনো ঘটনাই ঘটেনি, তবু যেন মনে করা যাচ্ছে, নন্দিতার সুখ দুঃখ সম্পর্কে তিনি উদাসীন, নন্দিতার ভয়ঙ্কর দাহর সম্পর্কে তিনি নির্বিকার, তাঁর সেই আদরের মেয়ের সিঁথির শূন্যতা পূর্ণতা নিয়েই ভাবছেন তিনি।
অন্ততঃ নন্দিতার পিতৃগোষ্ঠীর এই ধারণা। সংক্রামক ব্যাধির মত নন্দিতারও বুঝি ক্রমশঃ সেই ধারণাই বদ্ধমূল হচ্ছে।
অজিতা দেবী পূজোর ঘরে বাসা বেঁধেছেন, এ বদনামটা বোধকরি কতকটা সত্যি, কতকটা মিথ্যে। অজিতা দেবীর প্রাণটা হয়তো সেখানেই বাসা বেঁধে রেখেছে, কিন্তু অজিতা দেবীর দেহটাকে নীচের তলায় নামিয়ে আনা হচ্ছে।
কারণ অজিতারও পিতৃকূল আছে।
আছে শ্বশুরকুলের আত্মীয়।
দ্যাওরপো ভাসুরপো ভাগ্নে ননদাই। তারা কি চিরদিনের আত্মমগ্ন অজিতা দেবীকে হাতে পাবার এত সুযোগ পেয়ে ছেড়ে দেবে? তারা তাঁর পিঠে হাত বুলোতে আসবে না? বুদ্ধি দিতে আসবে না? উকিল ব্যারিস্টার নিয়ে আসবে না?
তাছাড়া তারা তো সত্যিই মর্মান্তিক কষ্ট পেয়েছে। পার্থকে ভালবাসতো না এমন কে আছে তার পরিচিত সমাজে?…
বরং অহঙ্কারী রাজেন্দ্রভূষণ সম্পর্কে সকলের মনোভাব সমান অনুকূল ছিল না, সে শুধু অহঙ্কারী বলেই নয়, বড়লোক বলেও।
তাই সকলে মিলে অজিতা দেবীকে সতর্ক করে দিচ্ছে—’মায়ায় পড়ে যেন সত্যভ্রষ্ট হয়ো না। আদালতে দাঁড়িয়ে যেন নার্ভাস হয়ে গিয়ে উল্টোপাল্টা বলে বসো না।…তোমার ওই পাজী মেয়ে ভারতীর মুখটা চিন্তা করে ফেলো না তখন। তুমি শুধু তোমার পার্থর সেই মৃত্যু—মলিন মুখ মনে কোরো, সেই অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিস্ফারিত হয়ে ওঠা চোখ দুটো মনে কোরো।’
হ্যাঁ, অজিতা দেবীকে ধরে ধরে উপদেশ দিচ্ছে সবাই, ‘সেটা মনে কোরো।’
অথচ অজিতা দেবী চীৎকার করে উঠেছেন না। বলছেন না, ‘বেরিয়ে যাও তোমরা, বেরিয়ে যাও ঘর থেকে।’
অজিতা দেবী তখন হঠাৎ হয়তো তাঁর দ্যাওরপোকে জিগ্যেস করে বসছেন, ‘তোর ছেলে—মেয়ে কেমন আছে?’…হয়তো তাঁর ভাগ্নেকে জিগ্যেস করে বসছেন, ‘মেয়ের বিয়ের কিছু করছিস নাকি? বেশ তো বড় হল।’…হয়তো তাঁর ননদাইকে জিগ্যেস করে বসছেন, ‘আপনার নূতন চিকিৎসায় কিছু ফল পেলেন?’…হয়তো বা নিজের কাকা—কি মামাকে বলছেন, ‘রোদে এসেছো, একটু শরবৎ দিতে বলি।’
আর উকিলকে?
তাকে তো হরদম অর্থহীন অবান্তর আর অপ্রয়োজনীয় সব প্রশ্ন করছেন।
ভাড়াটেরা যদি দুর্ব্যবহার করে, বাড়িওলার কেন তাকে উঠিয়ে দেবার ক্ষমতা থাকে না, বিবাহ বিচ্ছেদ আইন পাশ হবার পর সত্যিই দলে দলে মেয়ে বিচ্ছেদ করতে ছুটেছে কিনা, কাউকে টাকা ধার দিয়ে শোধ দিতে না পারলে যে ‘তামাদি’ হয়ে যাওয়া বলে সেটার মেয়াদ ক’বছর, এইসব জরুরী তথ্যগুলো যেন তদ্দণ্ডেই না পেলে নয় অজিতা দেবীর।
উকিল পর্যন্ত অবাক হয়ে যাচ্ছে।
আড়ালে এসে নাকি আর সবাইকে প্রশ্ন করছে, ‘উনি প্রকৃত মা তো? না বিমাতা?…উনি কি ছেলেকে দেখতে পারতেন না? ছেলের সঙ্গে কি ওঁর মুখ দেখাদেখি ছিল না? উনি কি বরাবরই এরকম অপ্রকৃতিস্থ বা অস্বাভাবিক ধরনের?’
প্রশ্নের সীমা নেই।
নন্দিতাকে ঘিরে এক ঝাঁক মৃদু মৌমাছি।
অজিতাকে ঘিরে এক ঝাঁক ভীমরুল।
কারণ নন্দিতার ওপর সকলেরই সহানুভূতি। নন্দিতার দীর্ঘ জীবনটা পড়ে আছে, আর নন্দিতার সেই জীবনটা—একটা মানুষের নৃশংসতায় ধ্বংস হয়ে গেছে। নন্দিতা রিক্ত সর্বস্বান্ত।
অজিতার কি?
অজিতার কতটুকুই বা গেছে?
অজিতার তো ছেলের সঙ্গে যোগাযোগই ছিল না। দিনান্তে একবার দেখা হতো কি না হতো। যেদিন সকালবেলা তাঁর পূজোর প্রথম পর্ব সেরে একটু তাড়াতাড়ি নীচে নামতেন, হয়তো দেখতেন ছেলে খেতে বসেছে, হয়তো দেখতেন জামা জুতো পরে বেরিয়ে যাচ্ছে। কথার বিনিময় হতো কি না হতো।
ছেলের জন্যে অস্থির হয়ে বা ত্রুটির লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে পরদিন যে তাড়াতাড়ি কথা বলবেন নেমে এসে, সেটুকু সৌজন্যও তো দেখা যেত না।
তবে? তবে কি করে বলা যায় ছেলে তাঁর ‘প্রাণ’ ছিল?
তবে কি করে বলা যায় নন্দিতার মতন হাহাকারে গুঁড়ো গুঁড়ো হচ্ছেন তিনি?
হচ্ছেন না। তাঁর প্রাণ ওই ঠাকুরঘরের পাথরের পুতুলে বিভোর।
অজিতা দেবীর নিজের বোনই তো আড়ালে এসে বলেছে, ‘কি জানি বাবা ওঁর ঠাকুর ওঁকে কী শক্তি দিয়েছেন! ঠাকুর ভজে যদি মানুষ পাথরের পুতুল বনে যায়, হৃদয়বৃত্তি বলে কিছু না থাকে, তা’হলে ঠাকুর না ভজাই ভাল। ঠাকুর! ঠাকুর! এখনো চন্দন ঘষছেন, তুলসী দিচ্ছেন। আশ্চর্য, ঠাকুর ওঁর কত ভাল করলেন? …ইচ্ছে হচ্ছিল ওঁর ঠাকুরকে তাঁর সিংহাসন সুদ্ধু টান মেরে ছাত ডিঙিয়ে ফেলে দিই!’
বলছে, সকলেই প্রায় ওই ধরনের কথা বলছে। আর শেষ পর্যন্ত অজিতার ঠাকুরকেই দোষী বানিয়ে ছাড়ছে। মানুষের কোর্টে বিচার হচ্ছে তাঁর।
বলা হচ্ছে, ‘যে মানুষটা এতদিন ধরে তোমায় ভজলো, তুমি তার দিকে একবার ফিরেও তাকালে না। তার এই সর্বনাশটা করেও দিব্যি চুড়ো বাঁশী নিয়ে বসে আছো।’
কিন্তু শুধু কি ওরাই বলছে?
অজিতা দেবী নিজে বলছেন না?
ধিক্কারে ধিক্কারে জরাজীর্ণ করে ফেলছেন না তাঁর ঠাকুরকে। বলেছেন না, কী নির্লজ্জ তুমি, কী নির্লজ্জ! নিজের হাতে খেলাঘর সাজিয়ে দিয়ে, নিজের পায়ে ভেঙে দাও তুমি সে ঘর!…মানুষের থেকেও হৃদয়হীন তুমি, মানুষের থেকেও পাষণ্ড!
বলছেন।
তবু হয়তো বা কেবলমাত্র অভ্যাসের বশেই চন্দন ঘষছেন, তুলসী দিচ্ছেন। অভ্যাসের বশেও নয়, ধিক্কার দিতেই। যেন, দেখো তুমি যত নির্লজ্জই হও, যত দুর্ব্যবহারই করো, আমি তোমার সঙ্গে ভদ্র ব্যবহারই করে চলবো। আমি তোমায় বুঝিয়ে ছাড়বো তোমার থেকে মানুষ ভালো।
কিন্তু এসব ঘরে বসে।
যখন নীচের তলায় নেমে আসেন?
তখনও কি মানুষ সম্পর্কে ধারণা একই থাকে অজিতা দেবীর? যখন তাঁরা অজিতা দেবীকে পাখীপড়া করতে থাকে, ‘তোমার ছেলের সেই অব্যক্ত যন্ত্রণায় বিস্ফারিত চোখ দুটো খুব করে মনে রাখবে।’
যখন তারা বলতে বসে, ‘দয়া মায়া স্নেহ মমতা, সব একদিকে আর একদিকে হচ্ছে ধর্ম! সত্য ধর্ম। সেই সত্য ধর্মের মুখ চেয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট করে বলতে হবে, ‘হ্যাঁ আমি নিজের চক্ষে দেখেছি! দেখেছি সেই ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড! আমার চোখের সামনেই মুহূর্তে ঘটে গেছে সে ঘটনা! কারণ তখন আমি—।’
হ্যাঁ তখন যে অজিতা দেবী উপস্থিত ছিলেন, অজিতা দেবীর চোখের সামনেই ঘটে গিয়েছিল ঘটনাটা তার প্রমাণ আছে। কারণ তখনই অজিতা দেবী তীব্র একটা চীৎকার করে উঠে সেইখানেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। পাড়ার লোকেরা যখন নন্দিতার চীৎকারে, নন্দিতার চার বছরের মেয়েটার চীৎকারে, ভারতীর চীৎকারে আর বছর বারোর বাচ্চা চাকরটার চীৎকারে বিহ্বল হয়ে নিজেদের বিপদের চিন্তা না করেই ছুটে এসেছিল, তখন দেখছেন ঘরের মধ্যে রক্তাক্ত কলেবর ছেলের পায়ের কাছে অজিতা দেবী পড়ে রয়েছেন জ্ঞান হারিয়ে।
আর অজিতা দেবীর জামাই গাড়ি হাঁকিয়ে পালাবার তাল করছে।
অবশ্য সে তাল তার সফল হয়নি।
ভগবানের বিচার।
অনেকক্ষণ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থাকার জন্যে গাড়িটা স্টার্ট নিতে দেরী করছিল, ততক্ষণে পুলিশ এসে পড়েছিল। অতএব রাজেন্দ্রভূষণের আর নিজের গাড়ি চড়ে বাড়ি ফেরা হয়নি, পুলিশের গাড়ি চড়ে হাজতে যেতে হয়েছিল, আজও সেখানে আছে।
পাড়ার লোকেরা অবশ্য ভাবেনি, যুগপৎ যে ওই চীৎকারটা উঠেছে ওদের বাড়ি থেকে, তার কারণটা এমন একটা অদ্ভুত হতে পারে।
ওরা ভেবেছিল ‘ভগবানের মার।’
অকস্মাৎ কেউ ভগবানের শিকার হয়েছে।
বিনা আয়োজনে, বিনা নোটিশে এমন শিকার তো করেই থাকেন তিনি হরদম!
তাই ভেবেই এসেছিল। এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হতে হবে, সে সন্দেহ থাকলে কিছুতেই আসতো না। কানে তুলো দিয়ে বসে থেকে রাত কাটিয়ে, পরদিন সকালে শিশুর সারল্য নিয়ে বলতো, ‘কী আশ্চর্য! কিচ্ছু টের পাইনি তো!’
কিন্তু সে সারল্য দেখাবার সুযোগ তাদের হয়নি। তাই পুলিশকে খবর দিতে বাধ্য হয় তারা।
অতএব পুলিশ এসেও দেখেছে অজিতা দেবীকে ঘটনাস্থলে।
তবে?
‘দেখিনি জানিনা’ বললে তো ছাড়ান নেই তাঁর। তিনিই সবচেয়ে বেশী জানেন, তিনিই সব আগে দেখেছেন।
কিন্তু তিনি সত্য ধর্মের মুখ চাইবেন কিনা, সেটাই হচ্ছে ভাবনার কথা!
হতে পারে ‘ঠাকুর ঠাকুর’ করেন, কিন্তু সে করা কি এতখানি আছাড়ের ধোপে টিঁকবে? তিনি তো ভাবতেই পারেন, ছেলে তো গেছেই, আবার মেয়েটার কেন সর্বস্ব ঘোচাই। কোন মতে বানিয়ে—টানিয়ে কিছু বলতে পারলেই যদি জামাইটা উদ্ধার পায়।
এই সন্দেহ সকলের।
সন্দেহ আরো ঘনীভূত হচেছ, ওঁর নীরবতায়। একবারও উনি বলছেন না ঠিক কী দেখেছিলেন, ঠিক কোন মুহূর্তে ঘরে ঢুকছিলেন, ঘরের মানুষগুলো কে কোথায় কোন পজিশনে বসেছিল। এইগুলোর সঠিক নির্ভুল হিসেব পেয়ে গেলে উকিল—টুকিলরা তো দৃশ্যটাকে ছবির মত সাজিয়ে ফেলতে পারে।
তা’ নয় অজিতা দেবী শুধু কেবল বলছেন, ‘কিছু মনে করতে পারছি না। মাথার মধ্যেটা সমস্ত গুলিয়ে গেছে।’
তা মানছি—গেছে গুলিয়ে। এমন অবস্থায় যেতেই পারে। কিন্তু তুমি যখন পাগল হয়ে যাওনি, তুমি যখন নিয়মমাফিক স্নান করছো, পূজো করছো, কথা বলছো, খাচ্ছ—দাচ্ছও, তখন সেই গুলিয়ে যাওয়া মাথাটাকে ঠিক করে নিতে হবে বৈ কি! ভেবে ভেবে বলতে হবে বৈ কি!
সেটা না নিলেই বলতে হবে, তুমি ইচ্ছে করে সুযোগ নিচ্ছো।
এঘরে, নন্দিতার ঘরেও সেই আলোচনাই চলছে।
উনি ইচ্ছে করে সুযোগ নিচ্ছেন।
নন্দিতা এখানেই আছে। নন্দিতার মা বুঝি একবার নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু উকিলরা নাকি বারণ করেছে। বলেছে সেই অনুপস্থিতির সুযোগে মেয়ে এসে ওঁকে ‘হাত’ করে ফেলতে পারে।
অতএব অজিতার বাড়িতে বসেই অজিতার সমালোচনা চলছে।
‘উনি ইচ্ছে করে সুযোগ নিচ্ছেন।’
‘তাছাড়া দেখছো না’ নন্দিতার মা বলেন, ‘বৌয়ের প্রতি কী ভাব? একবার এ মুখো হচ্ছেন? একবার ‘বৌমা’ বলে ডেকে এক গেলাস শরবৎ হাতে ধরে দিচ্ছেন? ওর ভেতরটা কী খাক হয়ে যাচ্ছে, তা অনুভব করতে চেষ্টা করছেন? এমন উদাসীন হয়ে আছেন, যেন নন্দিতাই কোন পাপের পাপী! মিঠুকে আমি নিয়ে চলে গেছি, তাই মেয়েটা বেঁচে গেছে। কই উনি একবার হাঁ হাঁ করে বলেছেন, ‘ও আমার পার্থর স্মৃতি, আমার কাছে থাকুক। বলেন নি। কঠোর কঠিন কাঠ প্রাণ!’
নন্দিতার মায়ের কথায় সায় দিচ্ছে অজিতা দেবীর পক্ষের লোকও। অজিতা দেবীর ভাগ্নে ভাসুরপো ননদ ননদাই। তাঁরা তো দুঘরেই ঢুকছেন কিনা। তাঁরা এ ঘরের তথ্য সংগ্রহ করে ও ঘরে পরিবেশন করছেন। আর বলছেন, ‘আশ্চয্যি শক্ত প্রাণ! কোথায় ওই অভাগা বৌটাকে বুকে নিয়ে পড়ে থাকবেন, তা না বৌটার ঘরেই ঢুকছেন না। বলতে গেলাম, ‘তোমার তো তবু ইহকালের পালা চুকে এসেছে, আর পরকালের চিন্তা তো আজীবনই করছে, বৌমার দিকে চাওয়া যায় না। বলা হলো কি না ‘তোমার শান্তি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছে? কবে বাচ্চা হবে ওর?’…অবাক বাবা অবাক! বললাম বৌমাকে তোমার একটু দেখা উচিত, বললো কিনা, ‘সবাই তো দেখছে। বৌমার মা রোজ আসছেন।’
অথচ পার্থ থাকতে, কী ‘বৌমা’ বৌমাই ছিল। যেন বৌমায় বিগলিত। যেন বৌমা সর্বেসর্বা মাথার মণি! আর কিছুই নয়, ছেলেকে দেখানো! ছেলের সুয়ো হওয়া! আর সংসারটি বৌয়ের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্দি হওয়া। …ঠাকুর—ভজা লোকরা ওইরকম ধূর্তই হয়। সুবিধেবাদীর রাজা। জামাইয়ের শাস্তি হবার ভয়ে অতবড় যে পুত্রশোক তা পর্যন্ত গিলে ফেললো।
তা ঠাকুর ভজা অজিতা দেবী অন্য এক স্বার্থের খাতিরে শোক গিলে ফেলতে পারলেও, নন্দিতার মা বাপ তো মেয়ের বৈধব্যশোক ভুলতে পারেন না, তাঁরাই লড়ছেন জোর তলবে। গহনা বেচেও চালাবেন। দোষীকে শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি কোথায়! তাছাড়া খুনের কেস তো তুলে নেওয়া যায় না। তোমার ক্ষমতা না থাকলে সরকার পক্ষই চালাবে।
তবে কথা হচ্ছে—ঘুষের কথা।
কে জানে ও পক্ষ ঘুষ দিয়ে পার পেয়ে যাবে কিনা। ঘুষেরই রাজত্ব, ঘুষেরই পৃথিবী। ভগবান পর্যন্ত ঘুষে নরম, তো মানুষ কোন ছার। হয়তো ওই গালফুলো রাজেন্দ্রভূষণ, হাজতের ভাত খেয়ে গালটা অবশ্য শুকিয়ে গেছে এখন, ওটা প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে। হয়তো পার্থসারথির মৃত্যুটা আত্মহত্যা বলে গোঁজামিল করে চালিয়ে দেওয়া হবে। বিচারের প্রহসনে কী হয় আর কী না হয়।
হয়তো তাই।
জগতে এমন সব ঘটনা ঘটে, যা লিখতে গেলে পাঠক বলবে ‘অসম্ভব, অসম্ভব, অতি নাটকীয়।’
অথচ তা ঘটে।
তবু এরকম ঘটনা বুঝি আর কখনো ঘটেনি। এই পটভূমিকায়, আর একরকম পাত্র—পাত্রীর পরিবেশে।
সেদিন সকালেও তো ওদের পৃথিবী নিত্যছন্দে আবর্তিত হচ্ছিল। রাত্রিশেষের স্নিগ্ধ চেতনার উপর নিত্যকার মতই অজিতা দেবীর ঠাকুরঘরে ‘মঙ্গলারতি’র মৃদু ঘণ্টাধ্বনি ধ্বনিত হয়েছিল।… সকাল—বেলা মিঠু ঠিক প্রতিদিনের মতই বাবাকে ঠেলা দিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ও বাবা আর কত ঘুমোবে। তুমি কি কুম্ভকর্ণ?’
এটি মিঠুর মায়ের শিক্ষা।
এই ভাব, ভাষা, তাড়না।
পার্থ বলেছিলো, ‘চমৎকার শিক্ষা। এই তো চাই। ঘরে ঘরে মায়েরা যদি ছেলেমেয়েদের এইভাবে সুশিক্ষিত করে তুলতে পারে, কিছু দিনের মধ্যেই দেশ মাতৃতান্ত্রিক হয়ে যাবে।…বাবারা ওই কুম্ভকর্ণ বনেই পড়ে থাকবে।’
নন্দিতা হেসে বলেছিল, ‘তা তাইতো চাও তোমরা! কী দেখো আজকাল তোমরা সংসারের?’
পার্থ বলেছিলো, ‘সংসারের সারাৎসারকে দেখি।’
নন্দিতা ‘আহা!’ বলে মুখের একটা ভঙ্গী করে মেয়েটাকে নিয়ে স্কুলের জন্যে তৈরি করাতে নিয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, সেদিন সকালেও মিঠুকে তার সেই ‘শিশু মন্দির বিদ্যায়তনে’ নিয়ে গিয়েছিল নন্দিতা, আলনার ওপর ওই যে নীল শাড়িখানা এখনো ঝুলছে, ওইটা পরে। শাড়িটা যেমন তেমনই রয়েছে। ওকে যে নন্দিতা আর পরলো না, আর কখনো পরবে না, সে নিয়ে ওর কোনো দুঃখ নেই।
মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই ঝিকে প্রশ্ন করেছিল নন্দিতা, ‘হারুর মা, উনুন ধরিয়েছিস?’
স্কুল থেকে ফিরেই তাড়াতাড়ি রান্না চাপানো কাজ নন্দিতার। চায়ের জল গরম করে নিয়ে ভাত চড়িয়ে দিয়ে চা ছাঁকে, বরকে দেয়, নিজে খায়।
অজিতা দেবীকে দেবার প্রশ্ন নেই।
অজিতা দেবী তো সেই ছেলের ভাত খাবার সময় পূজোর ঘর থেকে নামেন। নন্দিতা হুটোপাটি করে রান্না করে, কুটনো কোটে, মাছ কোটে।
হয়তো অজিতা দেবীর এটা অমানবিকতা, হয়তো তাঁর উচিত বৌকে কিছুটা সাহায্য করা, কিন্তু তিনি সেই উচিত কাজটি করেন না।
এ ধরনের প্রশ্ন কেউ ওঠালে উনি নির্লিপ্ত গলায় বলেন, ‘বৌমা তো খুব পটু। সবই পারে, আমি বুড়ি গিয়ে পড়ে আর ঝঞ্ঝাট বাড়াই কেন? কাজের বদলে অকাজই করে বসবো হয়তো।’
‘আশ্চর্য! ছেলেকে একদিন নিজের হাতে করে রেঁধে খাওয়াতেও ইচ্ছে করে না?’ একথা বলেন নন্দিতার মা।
আর নন্দিতা হেসে হেসে বলে, ‘অথচ জামাই মেয়ে আসুক দিব্যি খাটবেন। বলবেন, এলাম বৌমা তোমার একটু সাহায্য করতে।’
তার মানে ছেলের চেয়ে জামাইয়ের ওপর টান বেশী।
হবেই তো, ছেলে গরীব, জামাই বড়লোক।
এসব সমালোচনা চলতো। জোর তলবেই চলতো।
তবে সিঁড়ি বেয়ে অজিতা দেবীর ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঢুকতো কি না, তা জানা যেত না।
অজিতা দেবী নীচে নামতেন প্রসন্ন প্রশান্ত মুখে।
সেদিনও তাই নেমেছিলেন।
ছেলের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল তখন।
অজিতা দেবী তার যাত্রাকালে যথারীতি ‘গোবিন্দ’ নাম স্মরণ করেছিলেন।
কিন্তু ‘গোবিন্দ’ নাম তো বিফল হয়নি?
পার্থ তো নিরাপদে ফিরে এসেছিল বাড়িতে সন্ধ্যায় অফিসের পর। তারপর—
হ্যাঁ, তারপর!
ঠিক তারপর এসে হাজির হয়েছিল ভারতী। স্বামীকে নিয়ে, গাড়ি—ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে। আর গল্প করে, খাওয়া—দাওয়া করে, যখন উঠি—উঠি করছে তখন উঠেছিল সেই ঝড়।
ভয়ঙ্কর এলোমেলো ঝড়।
তারপর উদ্দাম বৃষ্টি।
পার্থ তার বোন ভগ্নিপতিকে বলেছিল, ‘পাগল হয়েছো, এই আবহাওয়ায় বেরোবে কি? থেকে যাও রাতটা।’
ওরা বলেছিল, ‘বাড়িতে ভাববে।’
‘কে ভাববে? বাড়িতে তোমার আছে কে? শুধু চাকর—বাকর ছাড়া?’ নন্দিতাও সায় দিয়েছিল সে কথায়।
কথাটা সত্যি, তখন তো আর রাজেন্দ্রভূষণ হাজতে যায়নি, অতএব তার দুই দাদা তার জন্যে সহানুভূতিতে বিগলিত হয়নি। তারা বাড়ির মাঝখানে মাঝখানে দেয়াল তুলে যে ব্যবধান রচনা করে নিয়েছিল তার অন্তরালেই ছিল তখন।
তাই পার্থ বলেছিল ‘কে ভাববে শুনি? বাড়িতে কে আছে?’
ওরা তখন বলেছিল, ‘তোমাদের তো আর গ্যারেজ নেই, গাড়িটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজবে।’
পার্থরা বলেছিল, ‘তোমাদের ভেজার থেকে গাড়ি ভেজাটা কম লোকসান।’
তবু ওরা বেরোতে চেষ্টা করছিল, পার্থ তখন বলেছিল। বলেছিল, ‘তার মানে গরীবের ঘরে একটা রাতও কাটাতে পারবে না তোমরা, এই তো?’
তার মানে নিজের মৃত্যুর পথ প্রশস্ত করেছিল পার্থসারথি। নিজের হাতে নিজের মৃত্যুবাণ গড়েছিল।…
আর সে কাজে সাহায্য করেছিল তার মা বৌ!
অজিতা দেবী বলেছিলেন, ‘এই দুর্যোগে মানুষ রাস্তা থেকে দরজা ঠেলে অচেনা বাড়িতে ঢুকেও আশ্রয় নেয়, আর তুই বাড়ির মেয়ে, চলে যাবি?’
ভারতী বলেছিল, ‘আমি তো বলিনি, ও বলছে।’
‘ও’ বলেছিল, ‘আপনাদের অসুবিধের জন্যেই, হঠাৎ আমরা দু—দুটো মানুষ শুতে চাইবো, ছোট্ট বাড়ি—’
‘তা’ সেটাই কথা।’ নন্দিতা বলে উঠেছিল, ‘ছোট বাড়ি বলেই থাকা সম্ভব হবে না আপনাদের।’
রাজেন্দ্রভূষণ বলেছিল, ‘তবে নাচার! রয়েই গেলাম।’
অর্থাৎ অদৃশ্যলোকের অন্ধকার থেকে যে জাল ফেলা হচ্ছিল, সে জালে সবাই পড়েছিল।
আর বেশ আনন্দ চিত্তেই পড়েছিল।
বৃষ্টিতে যখন পৃথিবী ভেসে যাচ্ছিল, ওরা চারজনে তখন তাস খেলছিল।
অনেক রাত পর্যন্ত খেলেছিল।
অজিতা দেবী সেই সময়টায় মেয়ে জামাইয়ের জন্যে বিছানা প্রস্তুতের ব্যবস্থা করছিলেন, ছোট চাকরটাকে সঙ্গে নিয়ে।
তাঁর নিজের ঘরেই শুতে দেবেন ওদের।
একদা যে সেকেলে ধরণের ভারী পায়া, জোড়া খাটটায় তাঁর নিজের জীবনের যুগল—শয্যা রচিত হতো, আর এখন সারা বাড়ির বাড়তি বিছানা লেপ কম্বলের আশ্রয় হয়েছে, সেইটাকেই ভারমুক্ত করে ওদের জন্য বিছানা বানালেন।
না, স্বামী মারা যাবার পর তিনি আর কোনদিন খাটে শোননি। তাই হঠাৎ এই খাটটায় ফরসা বিছানা পেতে ঘরটাকে কেমন অদ্ভুত দেখতে লাগলো অজিতা দেবীর। জঞ্জালের স্তূপ হয়েই পড়ে থাকে ঘরটা, তিনি অধিক রাত্রে এসে মাটিতে একটা বিছানা পেতে শুয়ে পড়েন।
বড়লোকের বাড়ি মেয়ের বিয়ে দিয়ে এমনই অধিকারচ্যুত হয়ে আছেন যে সাহস করে একদিন বলতে পারতেন না ‘তোরা একদিন থাক না। একটা রাত এ বাড়িতে রাত্রিবাস কর না।’
বলতে পারেন না।
অধিকারচ্যুত বলে।
বলতে পারেন না, তাঁর কোনো সাধ প্রকাশ করবেন না বলে।
তাঁর সম্পূর্ণ আপত্তির ওপর জোর করে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কাল থেকেই তীব্র একটা অভিমানে যেন পাথর হয়ে গিয়েছিলেন অজিতা দেবী, তারপর সেই মেয়ের তিলে তিলে রূপ পরিবর্তনে যেন ক্রমশঃই সে কাঠিন্য অচল—অনড় হয়ে উঠেছে।
স্বামীর সঙ্গে হৃদয়ের যোগও ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।
তারপর স্বামী মারা গেলেন।
সেই অভিমান কেমন একটা অপরাধবোধের অনুভূতিতে নির্লিপ্ত করে দিল অজিতা দেবীকে।