৫
সুধো কি ওই বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়ে আবার বলবে, ‘পুতুল, তুমি আমায় অবিশ্বাস কোরো না। আমি তোমার ক্ষতি করতে চাইবো কেন? একদা যদি কোনো ক্ষতি করে থাকি, তা সে অবোধে করেছি। অবোধ হনুমান স্বর্ণলঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করেছিল জানো তো?’
ভাবলো, সাহস হলো না।
পুতুলের ভাব অনমনীয়।
হতেই পারে।
কী ব্যবহার করে এসেছিল সুধো?
দুটো মেয়েমানুষের প্রাণভরা ভালবাসা মাটিতে ফেলে দিয়ে পায়ে মাড়িয়ে চলে গিয়েছিল না?
তা’ দুটো মেয়েমানুষই তো?
পরে সুধো দিনে দিনে তিলে তিলে ভেবে ভেবে অনুভব করেছে সেই ছোট্ট মেয়েটার মধ্যেও সুধোর জন্যে অনেক ভালবাসা ছিলো বলেই তার অতো দাপট ছিলো সুধোর ওপর।
যেখানে নিশ্চিন্ত দাপট, নিশ্চিত দাবি, সেখানে হঠাৎ অবহেলা তাচ্ছিল্য দেখলে, মনের অবস্থা কী হয়? কী হওয়া সম্ভব? সেও তো দিনে দিনে তিলে তিলে ভেবেছে? ভেবে ভেবে বড়ো হয়েছে!
পুতুল যদি এই সুধো নামের হতচ্ছাড়া হতভাগাটাকে ঘৃণা করে তো বেশ করে।
কিন্তু তাই বলে ওই পুতুলকে আবার এই পৃথিবীর লোকারণ্যে হারিয়ে ফেলবে সুধো?
সুধো কর্তব্য স্থির করতে করতে সেই বন্ধ দরজাটার সামনে থেকে সরে এলো।
সুধো পথ হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে মান্নাবাবুর সঙ্গে কথোপকথন চালিয়ে বললো—
‘মান্নাবাবু আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিলো—’
‘কেন? আমার সঙ্গে আবার আপনার কী কথা?’
‘আপনার ওই বটেশ্বর সম্পর্কে আমি কিছু খবর জানি, সেটাই আপনাকে জানাতাম।’
‘আমার লোকের সম্পর্কে আপনার এতো মাথা ব্যথা কেন শুনতে পারি?’
‘আমি ওকে অনেকদিন থেকে’—থামলো সুধো।
ওটা ঠিক হবে না।
ঠিক আছে—’আমি ওকে আগে জানতাম!’
‘শুনে ধন্য হ’লাম। আপনার জানা নিয়ে আপনি থাকেন গে মশাই, আমার আপনার কাছ থেকে কিছু জানার দরকার নেই।’
‘কিন্তু সেটা বিশেষ দরকারী কথা—’
‘বাজে বকবকানি রাখুন মশাই! আপনার বাহারি কথাগুলো ওই আপনার ‘বসন্তবাহারের’ রাখাল দাসকে বলুন গে।’
‘ঠিক আছে তাই বলবো। বলবো মান্নাবাবুর বটেশ্বর সরকার আসলে বটেশ্বরও নয়, সরকারও নয়। আদৌ বেটাছেলেই নয়—’
‘অ্যাঁ! অ্যাঁ?’
‘হ্যাঁ। ও মেয়েছেলে। ওর আসল নাম পুতুল দাস। এতোটুকুন বেলা থেকে ওকে দেখেছি আমি—’
‘সুধাংশুবাবু, একথা ফাঁস করে দেবেন না দোহাই আপনার—’
‘কিন্তু আমি তো আর এখন ওকে এইভাবে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে দেব না।’
‘ও আপনার আত্মীয়?’
‘আমার পরমাত্মীয়।’
ভাবতে ভাবতে নিজেদের আস্তানায় এসে গেলো।
পড়বি তো পড় রাখাল দাসেরই সামনে!
‘সুধা? এই রোদে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস? মুখ চোখ বসে গেছে, চেহারায় কালি মেড়ে দিয়েছে—’
‘কবে আর সুধোর চেহারায় গোলাপ ফুল মাড়া থাকে রাখালদা?’
‘আয়নার সামনে দাঁড়াগে যা, নিজের কথার উত্তুর পাবি। শরীর ভালো আছে?’
‘কেন থাকবে না?’
‘ঠিক আছে, ভালো থাকলেই ভালো।’
সকালবেলা অতো বেলা অবধি ঘুমোলি, কিছু না খেয়ে বেরিয়ে গেলি—এখন কেমন ভূতে পাওয়ার মতন কী যেন বিড়বিড় করতে করতে এলি!
সকালে ওই মান্নাদের ওখানে যাওয়াটা বাপু আমি পছন্দ করিনি। বলি পেটের মধ্যে পাকটাক দিচ্ছে না তো?’
‘না বাবা, না।’
‘তবু বলছিলাম কি, ক’ফোঁটা যোয়ানের আরক খেয়ে নিলে ভালো হতো না?’
‘আঃ কী মুস্কিল, বলছি কিছু হয়নি, তবু ওষুধ খেতে হবে? সেই চা—টা দেখছি তোমার পেটের মধ্যেই পাক দিচ্ছে।’
‘তা দিচ্ছে।’
রাখাল দাস গম্ভীরভাবে বলে, ‘মিথ্যে বলবো না, সেই সকাল থেকে মনে সুখ নেই।
তার ওপর আবার কেমন করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। ঘরে এসে বরং একটু শুলে পারতিস সুধো!’
‘যখন রান্নাবান্না হবে তখন—’
সুধো রাখাল দাসের ওই উদ্বেগকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে,
‘পেটে বিষ পড়লে শোওয়াই খারাপ রাখালদা! ঘুরে বেড়ানোই ভালো।’
‘কে, কে বলেছে একথা? কে বলেছে বিষ পড়েছে? …’থাক ওসব কথা বেশী বলতে হবে না।’
বলে রাখাল দাস সুধোকে একটু দেখে নিয়ে চলে যায়।
বারে বারে সুধোর কপালে কি এই দুঃখই দিয়েছিলে ঠাকুর!
ভালোবাসার লোকের প্রাণেই আঘাত দিতে হবে সুধোকে?
সুধো অনেক বড়ো হয়ে ওঠার পর বুঝতে পেরেছিল সে তার বাপকেও মনে কম আঘাত দেয়নি।
গোঁয়ার স্বভাবের লোকেরা ছেলে ঠেঙিয়েই থাকে, তাছাড়া তার বাবার আবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর রক্তচক্ষু, তাই বাবা স্ত্রী ওপর রাগ করেই ছেলেকে অমন মার—ধোর করেছে।
কিন্তু সুধো চলে আসার পর নিশ্চয়ই অনুতাপে জ্বলেপুড়ে মরেছে বাবা।
আর তার পরের ঘটনার তো কথাই নেই। বুঝি সে আঘাতের সীমা পরিসীমা নেই।
আবার এই রাখাল দাসের স্নেহবন্ধন কেটে বেরিয়ে যেতে হবে।
হবেই।
উপায় নেই।
পুতুলকে আর ছেড়ে দিতে পারবে না সে।
পুতুল যদি কিছুতেই তার নিজের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে না দেয় সুধোকে, সুধোকেই মান্নাবাবুর কাছে ধর্ণা দিয়ে ওদের দলে গিয়ে জুটতে হবে।
মান্না যদি বলে, ‘দুটো গায়েন পোষবার মতো পয়সা আমার নেই’
—সুধোকে বলতে হবে, ‘মাইনের দরকার নেই আমার।’
রাখাল দাস বলবে, ‘নেমকহারাম বিশ্বাসঘাতক বেইমান, ইতর ছোটলোক!’
বলবে।
হয়তো রাখাল দাস তার এই সন্দেহটাতেই নিশ্চিত হবে, মান্না চায়ের সঙ্গে তুকতাকের ওষুধ খাইয়ে তুক করেছে সুধোকে।
মান্নার আজ বটেশ্বরের ওপর মেজাজ প্রসন্ন ছিল না।
‘বসন্তবাহারের’ লোক তার দলের লোকের জন্যে ঘুঁটের মালার অর্ডার দিয়ে গেল!
অথচ ওই বটনা সর্বত্রই রূপোর মেডেল নিয়ে আসে। রূপোর গায়ে সোনার কাজ করা মেডেলও আছে ক’খানা, কিন্তু এখানে প্রথম দিনের সভা থেকেই যেন ছোঁড়ার আলগা ভঙ্গী।
সভায় ঢুকে যেন উদাস উদাস মনমরা ভাব।
কেন রে বাবা!
কোনো সুন্দরী মেয়েফেয়ে চোখে পড়েছিলো নাকি? কই মান্নার তো পড়েনি।
তবু প্রথম দিনটা ভালোয় মন্দে গেছে।
শেষটা ওই সুধাংশু ছোঁড়া একহাত নিলেও প্রথম দিকে খুব হাততালি কুড়িয়েছে বটেশ্বর। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে বটেশ্বর যতোই তোড়জোড় করে লম্ফ দিয়ে আসরে নামুক, ভেতর থেকে জোর ছিল না বোঝা যাচ্ছিল।
অথচ অসুখ বিসুখও করেনি।
অকারণ এতোবড়ো একটা নামকরা জায়গায় বাবুদের সামনে, কী অপমান!
মান্না মুখখানা বেজার করে বাক্স গোছাতে গোছাতে হেঁকে বলে, ‘মেডেলগুলো দে বটা, রাখি।’
বটেশ্বর পাশের ঘরে ছিলো, নিঃশব্দে এসে দিয়ে গেল সবগুলো।
এটাও আশ্চর্য! সাধারণতঃ দু’একটা সর্বদা বুকে ঝুলিয়ে রাখতে চায় বটেশ্বর, খুব সৌখিন আছে তো! বলে, ‘থাক না আমার কাছে।’
আজ সবগুলোই দিয়ে দিলো।
মান্না গম্ভীর বেজার মুখে বললো, ‘এ যাত্রায় তো ভাগ্যে জুটলো ঘুঁটের মালা।’
‘হুঁ।’
বটেশ্বর সোজা দাঁড়িয়ে, যাকে বলে নিজস্ব গলায় বলে, ‘তাই ভাবছি রিজাইন দেবো।’
‘কী দিবি? কী দিবি বললি?’
‘রিজাইন। নাম যখন ভেস্তে গেল, তখন আর—’
মান্না প্রমাদ গণে।
মান্না বোঝে তার এই বেজার ভাবটা দেখানো ঠিক হয়নি। যতোই হোক গুণী শিল্পী, তাদের অভিমান বেশী! দৈবাৎ এক আধবারও হারবে না, এই কি হয়? হারজিত নিয়েই জগৎ।
মান্নারই বরং ওকে কাছে ডেকে সহানুভূতি দেখিয়ে ওই কথাগুলো বলা উচিত ছিলো। তা নয় মান্না মেজাজ দেখাতে গেল।
ছোঁড়া বিগড়ে বসে আছে।
এমনিতেই তো মেজাজি।
কারুর সঙ্গে মেলামেশা নেই, সর্বদা অহংকারে মটমট। চেহারাখানি অমন সরেস, সাজসজ্জাতেও বেশ আছে। কিন্তু কথাবার্তায় যদি এক ফোঁটা রস আছে। একেবারে কাঠখোট্টা। একটু তোয়াজ করে কথা বলতে গেলেও বলবে, ‘ওসব কথা রাখুন, আসলে কী বলবেন বলুন।’ মনে হয় বড়ো ঘরের ছেলে। খেয়ালের মাথায় চলে এসেছে। সেই ঘরের অহঙ্কার আছে। দলের আর সবাইকে তো মশামাছি সমান জ্ঞান করে, কারুর সঙ্গে ভাব নেই।…
অবিশ্যি মান্নাবাবুকে সমীহ ভাব দেখায়, তবে সুবিধেও কম আদায় করে নেয় না। উনি বাবু কারুর সঙ্গে একঘরে শুতে পারেন না, কারুর তেল গামছা সাবান ব্যবহার করতে পারেন না, কারো সঙ্গে এক থালায় খেতে পারেন না। বায়নাক্কা ঢের।
নচেৎ তবলী, দোয়ার, হারমোনিয়াম বাজিয়ে, ফুলুট বাঁশী বাজিয়ে—এরাও তো কম দরকারি নয়? তবু ওরা সবাই ঘরের মেঝেয় ঢালাও শতরঞ্চি বিছিয়ে গড়া—গড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে, একখানা থালায় ভাত ঢেলে তিন চার জনে ঘিরে বসে সাঁটে।
সে যাক, হীরোকে হীরোর মর্যাদা দিতেই হবে।
মান্না তাড়াতাড়ি বলে, ‘ছেলেমানুষী করিস না। তুই ঠাট্টা করে বলছিস, পাঁচজনে তাই নিয়ে গুলতানি করবে।’
‘ঠাট্টা করে তো বলছি না।’
‘তবে কি সত্যি করে বলছিস?’
‘হুঁ।’
‘দেখ বটা জগতে হারজিত আছেই। একদিন একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে বলেই দল ছাড়বি?’
‘শুধু দল ছাড়ব না, এই কাজই ছেড়ে দেবো।’
‘এই কাজই ছেড়ে দিবি? এই কবিগান?’
‘হ্যাঁ মান্নাবাবু! এ থেকে আমার মন চলে গেছে, আমি আজই চলে যাবো। এই দিনের বেলাই।’
মান্না আগুন হয়ে ওঠে।
‘আজই এক্ষুণি!
এ কী ছেলের হাতের মোয়া?
না কি মামদোবাজি?
চলে যাবো বললেই চলে যাবো?
মান্না তবু কষ্ট করে আগুন চেপে রেখে বলে ‘তা যাবো বললেই তো যাওয়া হয় না বটেশ্বর! চাকরীর কিছু আইন কানুন থাকে—’
‘আমার ব্যাপারে নেই—’
‘তোমার ব্যাপারে নেই? কেন? তুমি কি নবাব সিরাজউদ্দৌলা?’
মান্না ধাপে ধাপে চড়ে, ‘আমিও যেমন তোমায় এককথায় ছাড়াতে পারি না, তুমিও তেমনি অসময়ে—’
বটেশ্বর দৃঢ় গলায় বলে, ‘আপনিও আমায় এককথায় ছাড়াতে পারেন, আমিও আপনাকে এককথায় ছাড়তে পারি। আমাদের সেইভাবেই কনট্রাক্ট করা আছে।’
‘সেইভাবেই কনট্রাক্ট করা আছে?’
মান্নাবাবুর বুকটা ধড়াস করে ওঠে।
মনে পড়ে যায়, এই রকমই কী একটা ব্যাপার আছে।
বটেশ্বর বলছিল, ‘আমার একটি শর্ত রাখতে হবে আপনাকে, তবেই আমি আপনার দলে ঢুকবো।’
‘শর্তটা কী?’
‘শর্তটা হচ্ছে কোনো পক্ষেই বাধ্য বাধকতা থাকবে না।’
বটেশ্বরের না পোষালে তৎক্ষণাৎ ছেড়ে যেতে পারবে। মান্না কোম্পানীর না পোষালে তৎক্ষণাৎ ছাড়িয়ে দিতে পারবে।
শর্তটায় আপত্তির জোর ছিলো না, কারণ দু দিকেরই দরজা খোলা রাখা হচ্ছে।
তাছাড়া—
তখন মান্না বটেশ্বরকে নেবার জন্য পাগল।
কোন এক অখ্যাত গ্রামের থেকে আসা এই ছোঁড়াটা চাকরীর জন্য দরবার করেছিল। সত্যি বলতে গ্রাহ্য করার কথা না, নেহাৎ মান্না ওর লাবণ্যযুক্ত চেহারাখানা দেখেই এতটা গ্রাহ্য দিয়ে বলেছিল, ‘আচ্ছা গা দিকিনি একখানা গান।’
ব্যস!
গলা শুনে মান্না নেই।
আর গানের তাল লয় মানও।
গলা না হয় ভগবানদত্ত, কিন্তু তাল লয় মান? গুরু কে?
‘গুরু আমার মা!’
‘মা! কী নাম? কোথায় থাকেন?’
স্বর্গে গেছেন, নাম নিয়ে লাভ নেই।…বলুন এই শর্তে যদি রাজী থাকেন…’
কাটখোট্টা ভঙ্গী!
অমন লাবণ্যময় চেহারা, অমন বাঁশীর মতো গলা, কিন্তু কথা যেন ছুঁড়ে মারে।
তা’ মারুক। শুধু গলা নয়, কবির গান বাঁধে, একাই দু’পক্ষ হয়ে লড়াই চালায়। এ এক আশ্চর্য্য প্রতিভা! একে কি আবার মানুষ তুচ্ছ একটু শর্তের কচকচি নিয়ে ছাড়ে? শর্তে রাজী হয়ে গিয়েছিল মান্না।
নিজস্ব একটা ঘর চাই ওর।
তা নিক।
একখানা মাত্র ঘর থাকলে সেইখানাই ও নেবে, আর সবাই উঠোনে শোবে।
অতএব শর্ত মঞ্জুর।
দলের লোকেরা বলাবলি করে, ‘নির্ঘাৎ ওই গোলাপী আভা রংটা ওর নিজের নয়। পেণ্ট করা। তাই নির্জনের দরকার। ওই ভুরু—টুরু সবই মেকআপ! বড়মানুষের ঘরের ছেলে মনে হয় পালিয়ে এসেছে বোধহয়। পরণ পরিচ্ছেদ দেখেছিস?”
তা ওই পরণ পরিচ্ছেদই।
খাওয়া দাওয়ায় বড়মানুষী নেই বটেশ্বরের। নুনভাত দাও, নুনভাত খাবে। দলের অন্যদের মতো কখনো বলবে না—’আজ খাওয়া খারাপ হলো।’
থাকতে থাকতে ওর নিজস্ব ধরন সকলের সহ্য হয়ে গেছে। আর ওর সেই শর্তও ভুলে গেছে মান্না। আজ মনে পড়িয়ে দিলো বটেশ্বর।
বললো, ‘আছে কিনা আপনিই মনে করুন।’
মান্না বললো, ‘তা হলেও, এই দণ্ডে যাবো মানে কী? কারুর সঙ্গে অসরস হয় নি, বিরোধ হয় নি…’
‘না কারুর সঙ্গে হয়নি। নিজের সঙ্গেই হয়েছে।’
‘নিজের সঙ্গে? এটা আবার কেমন কথা বটু?’
‘মানে আর কাজে মন লাগছে না।’
‘ছি ছি এ তোমার নেহাৎ ছেলেমানুষী বটেশ্বর! একদিন একটু এদিক ওদিক হয়ে গেছে বলে নিজের এমন গৌরবের জীবনটা ত্যাগ করবে? বরং মনের জোর করে আরো ইয়ে হ’, যাতে ভবিষ্যতে ওই বসন্তবাহারের সুধাংশুর গলায় ছেঁড়াচটির মালা ঝোলাতে পারিস।’
‘না আমার আর মন নেই।’
ব্যস!
ওই এক কথা, ‘আমার আর মন নেই!’
সবাই মিলে মাথা খুঁড়লো, তবু সেই এক কথা।
‘রাতে খাওয়াটা—অন্তত হোক? নচেৎ মানিকবাবুরা মনে করবেন কী?’
‘বলবেন ও খাবে না, শরীর খারাপ।’
‘বটু, তুই আমায় এইভাবে জব্দ করবি? তোর সঙ্গে আমার পূর্বজন্মের কোনো শত্রুতা ছিল কী?’
‘থাকতে পারে।’
‘ওঃ বটে!’ এবার মান্না নিজমূর্তি ধরে। ‘আসল কথা বসন্তবাহার ভাঙচি দিয়েছে। অধিক মাইনের লোভ দেখিয়েছে।
ওদের ওই ছোঁড়াটা সকালে এসেছিল শুনেই আমার মনে হয়েছিল এরকম কিছু ঘটবে। সকাল বেলা ছোঁড়া কোন মতলবে?
এখন বুঝিছি কোন মতলবে।
আচ্ছা আমিও নীলমণি মান্না, দেখি বসন্তবাহার কেমন করে আমার লোক ভাঙিয়ে নিয়ে যায়। আমি যদি তোর ঠ্যাঙ ভেঙে এখানে শুইয়ে রেখে দিই, পারবি যেতে?’
‘মেলা বাজে কথা বলবেন না মান্নাবাবু! মাইনে দিতে ইচ্ছে হয় দেন, না দেন ঝগড়া করবো না। মোটকথা আমি এক্ষুণি চলে যাবো!’
‘বুঝেছি। আর বলতে হবে না।’
রাখাল কোম্পানী সবে খেয়ে উঠেছে, হঠাৎ অগ্নিমূর্তি নীলমণি মান্নার নাটকীয় প্রবেশ।
‘রাখালবাবু, অতি দর্পে হতা লঙ্কা, তা জানেন তো?’
‘কী ব্যাপার? হয়েছে কী?
‘হয়েছে কী? জানেন না? পয়সা কিছু বেশী হয়েছে বলে অহংকারে ধরাকে সরা দেখছেন। কিন্তু আমার লোককে ভাঙিয়ে নিলে আপনার ললাটে দুঃখ আছে তা বলে দিচ্ছি।’
রাখাল দাস মাথা গরম করে না।
বোঝে কোথাও কিছু ভুল হয়েছে।
সে আস্তে আস্তে বলে, ‘অন্যের লোক ভাঙিয়ে নিলে ললাটে দুঃখু থাকে বৈকি। তার ল্যাজ মোটা হয়। মনে করে আমার মতন গুণী বুঝি আর ত্রিভুবনে নেই। কিন্তু কথা হচ্ছে তেমন কোনো দুষ্কর্ম তো আমি করিনি মান্নামশাই!’
‘করেন নি? করেননি কিছু? ভাজামাছটি উল্টে খেতে জানেন না যে দেখছি। শাক দিয়ে আর মাছ ঢাকবেন না রাখালবাবু! আমার বটেশ্বরকে আপনি অধিক টাকার লোভ দেখান নি? বলি কতো বেশী দেবেন তাকে যা নীলমণি মান্না দিতে পারে না?’
গোলমালের মতন আকর্ষণীয় ব্যাপার জগতে আর কী আছে? আকৃষ্ট হয়ে সবাই এসে দাঁড়িয়েছিল, সুধোও ছিল।
বটেশ্বর শব্দটায় সচকিত হলো সে এবং যা শুনলো তাতে ধারণা হওয়া উচিত এরা ওদের বটেশ্বরকে অর্থাৎ আসল হীরোকে বেশী মাইনের লোভ দেখিয়ে টেনে আনছে। এই দুষ্কর্মের শাস্তি দিতে মান্না যতদূর যেতে হয় যাবে।
সুধো যেন বুঝতে পারে আসলে কী ঘটেছে।
সুধো শান্তভাবে বলে। ‘বটেশ্বরবাবু বলেছেন আমরা তাঁকে বেশী মাইনের অফার দিয়েছি?’
‘আহা রে আমার নাবালক এলেন। এ সব কথা বুঝি লোকে নিজমুখে বলে বেড়ায়? ব্যবহারেই মালুম হয়। আপনি সকালবেলা দালাল হয়ে গেলেন, দু’ঘণ্টা পরেই বাছাধন আমার শিঙ বাঁকালেন—এক্ষুনি চলে যাবো…এর স্বরূপ কচি ছেলেটাও বুঝতে পারে।’
রাখালদাস বিপন্ন বিব্রত হয়ে বলে, ‘কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন মান্নামশাই, আমি এর বিন্দু বিসর্গও জানিনা। এ নিশ্চয় অন্য চক্রান্ত।’
‘অন্য চক্রান্ত তো, আপনার ওই সুধাংশু সকালে গিয়েছিল কেন?’
‘আপনি বিশ্বাস করুন মান্নামশাই, আমি জানতামও না। ও নিজেই গিয়েছিল নাকি!’
‘ইস! এই ভোর রাত্রে যাকে ঘুঁটের মালা পরিয়ে এসেছে, তার সঙ্গে অকারণ গলাগলি করতে গেলেন উনি, এই কথা মানবো আমি?’
‘আচ্ছা আমি ওকে জিজ্ঞেস করছি, এই সুধো?…আরে কোথায় সুধো? এই তো ছিল। সুধো সুধো!’
কিন্তু কোথায় সুধো?
সুধো যেন হাওয়া হয়ে গেল।