শিকলি কাটা পাখি – ৪

কিন্তু পুতুল বলতো, ‘মা, বড় হলে তুমি আমি আর সুধা তোমার চাকরীর মতন ‘কবিগান’ করবো, তাই না?’

মেয়ে মহলে ‘কবিগান’ গাইবার চাকরী ছিল পুতুলের মার। দলের মালিকও মেয়েমানুষ।

জমিদার গিন্নীরা আব্রুর মধ্যে শুনবেন।

যেদিন বাইরে গানের আসর না থাকতো, পুতুলের মা বাড়িতে আসর বসাতো। পাড়ায় মহিলারা শুনতে আসতেন, দু’চারটি পয়সাও দিয়ে যেতেন।

পুতুলের মা বলতো, ‘দেখ সুধা, তোর সাধ আমার ওপর মিটছে। আমি অন্ধভিখিরি হয়ে গান গাইছি।’

মা বলতো সুধা, মেয়েটাও বলতো ‘সুধা’।

কিছুতেই দাদা বলতে চাইতো না।

সুধার রং কালো, পুতুল ডলি পুতুলের মতো।

পাড়ার লোকে বলতো, ‘তোমার ঘরে রাধাকৃষ্ণ বিরাজিত পুতুলের মা! দেখো ভগবান নিজে মিলিয়ে দিয়েছেন। যত্ন করে পালন করো, সময় পেলেই শুভ কাজটি করে নিও। তোমাদের বোষ্টমের ঘরে তো সকাল সকাল বে হয়।’

পুতুলের মা আস্তে বলতো, ‘আমি যে ভাই ওকে ‘দাদা’ বলতে শেখাচ্ছি।’

শেখাচ্ছিল সত্যিই, কিন্তু বেয়াড়া মেয়েটা মায়ের দেখাদেখি ‘সুধা’—ই বলবে শুধু। সুধাদাও নয়।

ক্রমশ মাও আর তেমন জোর করে না।

পড়শীনীরাও জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দেয়, ‘ও তুমি যতোই দাদা শেখাও ভাই, সত্যি তো আর সহোদর না? ডাগরটি হলেই বয়েসের ধর্ম দেখা দেবে। তখন তুমি ওই পাতানো ভাই বোন সামলাবে কী করে? বলে সদ্য মামাতো পিসতুতো খুড়তুতো জ্যাঠতুতো নিয়েই লোকে আতঙ্কে দিন কাটায়। যে দিনকাল পড়েছে!’

অতএব পুতুলের মা মনে মনে পুতুল খেলার স্বপ্ন দেখতো।

নিজের সব খেলাই তো স্বপ্নের মতো মিলিয়ে গেছে।

কতোবড়ো বয়েস পর্যন্ত কোলে একটা সন্তান আসেনি। ঠাকুর দেবতার মানত করে ওই মেয়ে। পুতুলের মতো মেয়ে। ভাল নাম ব্রজবালা, ডাক নাম পুতুল।

পুতুল জন্মালো আর বছর যেতে না যেতেই সেই মানুষটা চলে গেলো।

ভাগ্যিস সে মানুষটা নিজে কাছে বসিয়ে গান শিখিয়েছিলো তাকে! কীর্তন গান, পালা গান। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে গিয়ে এক একটা ‘ঘর’ করে দিয়েছিল।

বলতো, ‘ধর্মপথে থেকে রোজগার করায় দোষ নেই রাসু, দুজনে না খাটলে একালের এই মাগগিগণ্ডার বাজারে সংসার চালানো দায়।’

তা যাই ভাগ্যিস এ পথ চিনিয়ে দিয়েছিল তাই না রাসুকে মেয়েটার হাত ধরে ভিক্ষেয় বেরোতে হয়নি। বরং ভালই চলে যাচ্ছে। তবু তো ওর মধ্যেই আবার একটা পথ থেকে ছেলে কুড়িয়ে এনে পুষতে লেগেছে।

রাসু বা রাসেশ্বরীর এক প্রিয় সখী বলেছিল, ‘সই, আর একটা পেট বাড়ালি?’

রাসু বলেছিল, ‘আমি কি খাওয়াবার মালিক সই? যাঁর ব্যবস্থা তিনিই করবেন।’

‘রাসু’ বলবার লোক সই ছাড়া আর নেই। সবাই বলে ‘পুতুলের মা।’

‘পুতুলের মা, পূর্ণিমার দিন ‘রাইরাজা’টা শোনাবে গিয়ে।’….’পুতুলের মা তোমার ‘দূতী সংবাদ’টা অনেকদিন শোনা হয়নি।’

পুতুলের মা ‘আমার মা এসেছেন, তোমার ‘অত্রূ«র সংবাদ’টি একবার শোনাতে হবে আমার মাকে।’

পুতুলের মার প্রতি সকলেই সদয়।

যাঁরা ডাকতেন তাঁরা তো টাকাটা সিধেটা গামছাটা কাপড়টা দিতেনই, যাঁরা তাঁদের কুটুম কাটুম তাঁরাও দিতেন এটা সেটা।

পুতুলের মার স্বভাবেই সকলে সন্তুষ্ট। যেমন শান্ত তেমনি সভ্য, নরম সরম।

কিন্তু পুতুলটি মার বিপরীত।

পুতুল রাগলে কুরুক্ষেত্র করে, পুতুল জেদের রাজা, পুতুল প্রখরা এবং ওই বয়েসেই মুখরা।

পাকামীতেও কম যেতো না পুতুল।

যদিও যা বলতো, বুঝে বলতো না, শোনাবুলি বলতো, তবু বলতো, ‘আমরা যেন রাধাকেষ্ট না রে সুধা? তুই কেষ্ট আমি রাধা। তুই কালো আমি শাদা! দেখলি তো কেমন মিলিয়ে দিলাম!’

সুধা বলতো, ‘সত্যি, তুই তো তাহলে চেষ্টা করলেই ছড়া বানাতে পারিস।’

‘পারিই তো। শুনবি?’

পুতুল মহোৎসাহে তার তারের বাজনার মতো গলায় বলে উঠলো—

‘জলে মাছ গাছে ফুল

মাঠে ঘাস মাথায় চুল।’

পুতুলের তখন কতো বয়েস?

বছর ছয়।

তার থেকে বছর তিনেকের সিনিয়ার সুধা বললো, ‘এমা ভগবানের জিনিসের সঙ্গে মানুষের জিনিস মিলোলি?’

তার হয়তো মনের ধারণায় ছিলো ‘প্রকৃতির জিনিসের সঙ্গে’ কিন্তু বললো ভগবান।

পুতুল অতএব সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো, ‘কোনটা ভগবানের, কোনটা মানুষের রে?’

‘কেন জলের মাছ, গাছের ফুল, মাঠের ঘাস, তিনটেই ভগবানের তৈরী। তা’র সঙ্গে তুই মানুষের মাথার চুলকে—’

ছ’বছরের পুতুল সুধার দিব্যদৃষ্টি খুলে দিয়ে বলে উঠলো, ‘আর মানুষ বুঝি ভগবানের তৈরী নয়? চুলগুলো তোর নিজের তৈরী?’

‘অকাট্য যুক্তি।

সুধা বললো ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ‘তুই ওই পাখিটা নিয়ে ছড়া করতে পারিস?’

‘কোন পাখিটা?’

‘ওই যে উড়ে গেল—’

‘ওতো উড়েই গেল।’

‘তাতে কি? উড়ে যাওয়া নিয়েই কর—’

পুতুল একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকিয়ে কতোই যেন ভাবছে। এই ভাবে বললো,

 ‘পাখি গেল উড়ে,

 বাড়ি গেল পুড়ে।’

‘এমা শুধু এইটুকু?’ সুধা বলে।

‘পুতুল বললো, বলছিরে বাবা আরো বলছি—’

 ‘মা করেনি রান্না

 আমরা করি কান্না।’

সুধা চমৎকৃত হচ্ছে। অথচ সুধা মনে মনে নিজেকে খাটো ভেবে ফেলেছে। অতএব সুধা ছল চায়, ‘পাখি উড়ে গেছে তা’ বাড়ি পুড়ে যাবে কেন?’

‘আচ্ছা বাড়িটাই আগে পুড়ে গেছে—’ খুব রাগের গলায় বলে পুতুল, ‘সেইজন্যেই পাখিটা উড়ে গেল। বাড়ির ছাতে বসেছিল তো? গরম লাগলে উড়ে যাবে না? বোকা কোথাকার! কিছু বোঝে না।’

সুধা অপমানে খান খান হয়ে চলে যেতো। বলতো, ‘যা যা আমার সঙ্গে খেলতে আসিসনে। আমি বোকা, আমি বুদ্ধু, আমি আবার চলে যাবো দেখিস।’

আবার চলে যাবো!

জোঁকের মুখে নুন।

পুতুল শুকিয়ে কালো হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি খোসামোদ করতে বসে।

পুতুল কোনোদিন মায়ের স্নেহের ভাগীদার বলে সুধাকে হিংসে করেনি, চলে যাবার নামে ভয় পেতো।

সে তুলনায় সুধা নিষ্ঠুর ছিলো।

পুতুলের ওই দুর্বলতাটুকু বুঝে ফেলে সুধা যেন ব্রহ্মাস্ত্র পেয়েছিল।

পুতুলকে দাবিয়ে রাখবার ওই একমাত্র দাওয়াই। ‘চলে যাবো।’

এই আশ্বিন মাসে শিউলি ফুলের ঘটা।

অন্ধকার ভোর থেকে পুতুল এসে সুধাকে ডাকাডাকি করতো, ‘এই সুধা ওঠ না। ফুল তুলতে যাবি না?’

সুধা একটু ঘুমকাতুরে। সুধা বলতো, ‘এক্ষুণি কি যাবো?’

‘না গেলে সব ফুল তো, বাসু, পরমেশ, বিমলি, সরস্বতী নিয়ে নেবে।’

‘তারা এখনো ঘুমোচ্ছে—’

‘ইস। তারা তোর মতন ঘুমবুড়ো কিনা। তারা কখন বেরিয়েছে!’

‘সাপে কামড়ে দেবে, দেখবে মজা।’

‘বাঃ ওরা তো হারিকেন নিয়ে বেরিয়েছে।’

‘বাবা বাবাঃ। একটু ঘুমোতে দেবে না। শিউলী ফুল দিয়ে তো তোর কাপড় ছোপানো হবে, আমার কী?’

ব্যস হয়ে যেতো।

পুতুল সদর্পে বলতো, ‘বেশ যাসনি তুই। আমি একলাই যাবো।’

সুধা চীৎকার করে উঠতো, ‘মা, পুতুল একলা শিউলি ফুল তুলতে যাচ্ছে।’

পুতুলের মা রাসু তখন হয়তো বিছানায় শুয়ে শুয়েই অষ্টোত্তর শতনাম, কি অপরাধ—ভঞ্জন স্তোত্র আওড়াচ্ছে।

তাড়াতাড়ি বলতো, ‘ওই এক গোঁয়ার মেয়ে। তুই একটু যা বাবা সঙ্গে।’

যেতেই হতো।

প্রথমটা পুতুল দৃকপাত করতো না, গটগট করে এগোতো। তারপর কখন যেন সন্ধি হয়ে যেতো। শুধু মাটিতে পড়ে থাকা শিউলী ফুলই নয়, গাছে ফুটে থাকা অন্য ফুলও নিতে ছাড়তো না পুতুল লোকের বাড়ি থেকে। সেই নেওয়ার সাহায্যকারী অবশ্যই সুধা।

ফুল সম্পর্কে পুতুলের মন পরিষ্কার, কিন্তু পরের গাছের ফলের ব্যাপারে পুতুলের বিবেক টনটনে।

‘এমা তুই ওদের বাগানের পেয়ারা নিয়ে এলি? তাহলে তুই চোর হলি।’

‘আর তুই যে ফুল নিস?’

‘আহা ফুল কি আমরা খাই? ঠাকুরকে দেওয়া হয় তো।’

‘ঠাকুরকে দেবার জন্যে তাহলে ফল চুরিতেও দোষ নেই?’

পুতুল প্রথমটা বিপন্ন বোধ করতো, তারপরেই বলে উঠতো, ‘ফুল তো আর ঠাকুর খায় না। শেষ অবধি তো আমরাই খাই। ফুল কি তাই?’

সব সময় পুতুলের যুক্তি প্রখর পরিষ্কার অকাট্য।

ওই বয়সে পুতুল জানতো অনেক।

‘তুলসীগাছের ডাল ভাঙিসনে সুধা, তাহলে কেষ্ট ঠাকুরের আঙুল মচকে যায়। …জবা ফুল নিয়ে কী হবে রে বোকা? জবা ফুল দিয়ে কি গোপাল পূজো হয়?’ …ছি ছি সুধা, তুই গোপালের ভোগের আগে মুড়কি খেয়ে ফেললি? তোর নরকেও ঠাঁই হবে না।’

আস্তে আস্তে বয়েস বাড়ছে, আর কথার চটকও বাড়ছে।

পাড়ার লোক বলে, ‘কী মিষ্টি মেয়ে। কথা কয়না তো, যেন ময়না পাখি বোল কাটে।’

কিন্তু ওই বোল কাটার মধ্যেই কাটাকাটি।

যতো ভাব ততো আড়ি।

সেই একদিনের কথা—

আর একটু বড়ো হয়েছে তখন।

পাড়ার কাদের বাড়িতে যেন বিয়ে। নেমন্তন্নে যাচ্ছে সুধা আর পুতুল। পুতুল বায়না ধরে বসলো, ‘আমি সুধার মতন ধুতি কোট পরবো।’

‘পরবো! পরবো! কোট পরবো! ধুতি পরবো!’

সুর চড়তে থাকে।

মা ভোলাতে পারে না কিছুতেই।

ওর সেই এক কথা।

‘সুধা কেন পরবে?’

‘ও তো বেটাছেলে।’

পুতুল ঘোষণা করে বসলো, ‘আমিও বেটাছেলে হবো।’

পুতুলের ধারণা ওই পোষাকটাই বেটাছেলের পরিচয়পত্র।

পুতুল কি ছেলেবেলার সেই প্রতিজ্ঞা রাখবার জন্যই বটেশ্বর হয়েছে?

রাসু অনেক চেষ্টা করলো বোঝাতে, ‘ভগবান যাকে যা করে পাঠিয়েছেন সে তাই থাকে।’

পুতুল বুঝ মানে না।

তার সেই এক বুলি, ‘আমি ফ্রক পরবো না, সুধার মতন জামা পরবো। আমি বেটাছেলে হবো।’

ওদিকে নেমন্তন্ন বাড়ির লুচি ভাজার গন্ধ বাতাসে ভেসে আসছে, এদিকে কিনা এই বিঘ্ন।

সুধা হঠাৎ খিঁচিয়ে ওঠে, ‘সাতজন্ম ধূতি পরলেও তুই মেয়েই থাকবি, বুঝলি? বেটাছেলে হওয়া এতো সোজা? ভগবান যাদের ভালোবাসে তাদের বেটাছেলে করে পাঠায়, যাদের দেখতে পারে না তাদের মেয়ে করে পাঠায়।’

ব্যস।

হয়ে গেল।

পুতুল ফ্রকটাকে উঠোনে ধূলোয় ফেলে দিয়ে বলে উঠলো, ‘আমি নেমন্তন্নে যাবো না।’

সুধার তো মাথায় হাত।

পুতুলেরই বন্ধুর দিদির বিয়ে, সেখানে একা সুধা যায় কোন সুবাদে?

কতো খোসামোদ করতে হয়েছিল সেদিন সুধার পুতুলকে।

রাসু বলেছিল, ‘বাবা, রাতদিন গলাগলি রাতদিন চুলোচুলি। সারাজীবন যে কী করবি তোরা!’

তখন পুতুলের মা ওদের ‘সারাজীবনে’র সম্পর্কের স্বপ্ন দেখছে।

অথচ সুধা নামের ছেলেটা?

অকৃতজ্ঞ বেইমান, নেমকহারাম।

সে বড় হয়ে চাকরি করার প্রতিশ্রুতি পালন করলো না। পুতুলকে দেখার অঙ্গীকার পালন করলো না। আবার একদিন সেই আধমরা মানুষটার বুকে হাতুড়ি মেরে কেটে পড়লো।

লোভ দুর্দমনীয় হয়ে উঠলো তার।

একদিন একটা যাত্রার দলের সঙ্গে পালালো।

কোথায় মাঠে বসে গলা ছেড়ে গান গাইছিলো, যাত্রার দলের কর্তা শুনে ছুটে এসে বললো, ‘যাবি আমার সঙ্গে? আসরে গান গাইতে পাবি, খেতে পরতে পাবি, আর মাইনে পাবি।’

এতোগুলো পাওয়ার লোভ সামলানো বড়ো শক্ত হলো ছেলেটার পক্ষে।

কিন্তু শুধুই কি তাই?

কান সোনাপুরের ওই স্তিমিত জীবনের শান্ত ছন্দ তাকে যেন ধরে রাখতে পারছিল না, বাইরের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।

মা বলতো, ‘আমি মরে গেলে তুই আমার গোপালের সেবার ভার নিবি তো সুধা?’

সুধা স্বচ্ছন্দে বলতো, ‘আমি কী করে নেব? আমি তো বেটাছেলে! পুতুল পারে না!’

‘বেটাছেলে পূজো করে না?’

‘করে না।’ এমন কথা বলা যায় না।

কিন্তু তার জন্যে অন্য মানুষ আছে, সুধা কেন? সুধার ওসব শুনলেই ভয় করে।

শেকড় ছেঁড়া একটা উদোমাদা ছেলেকে এতো বাকদত্ত করিয়ে নেবার চেষ্টাটা ঠিক হয়নি হয়তো রাসুর। যেটা অজান্তে হতো, সেটা জেনে ফেলে ভয় ঢুকলো।

রাসুর ঘরবাড়ি, গোপাল, ফুলগাছ, তুলসীমঞ্চ, আর সবের ওপর পুতুল, এতোগুলো ভার নিতে হবে সুধাকে? বাববা!

সুধার মন পালাই পালাই করছিলো, ওই লোভের আকর্ষণ তাকে কার্যকরী করে তুললো।

সুধা চলে এলো।

কিন্তু সুধার পিছু পিছু যেন পুতুলের মার গানের সুরটা ধাওয়া করতে লাগলো।

‘আমার গোপাল কেন মথুরা গেলো—

আমার কেঁদে কেঁদে চক্ষু অন্ধ হলো।

 সেখানে কি ওর মা—যশোদা আছে?

 খিদে পেলে গোপাল খাবে কার কাছে?

সে যে আমার শুধু ননী খেয়ে থাকে,

একথা সেখানে কে জানে বলো?’

এসব গান পুতুলের বাবার বাঁধা।

পুতুলের মা গাইতো যখন তখন। তখন থেকেই কি সন্দেহ হয়েছিল তার গোপাল নিষ্ঠুর হবে, বেইমান হবে?

সুধার আরো একটা কথা সারাক্ষণ মনে পড়ে পড়ে বুক ফেটে যেতো।

পুতুল বলেছিল, ‘কাঁঠাল তলায় আমরা একটা পুকুর কাটি আয় সুধা! তুই খুঁড়ে দে, আমি মাটি দিয়ে ঘাট বাঁধিয়ে নেবো। তারপর জল ঢেলে ভরে আমার কচি পুতুলগুলোকে চান করাবো, চুল ঝাড়াবো।’

বার বার বলেছে, ‘চল নারে সুধা এখন তো রোদ পড়ে গেছে।’

যদি সেই পুকুরটাও অন্তত কেটে দিয়ে আসতো সুধাংশু নামের হৃদয়হীন ছেলেটা!

তা হয়তো পুকুর একটা কেটে দিয়ে এসেছিল সুধা অন্য কোনো ভূমিতে। তাতে জল ঢেলে জল ভরবার কাজটা নিয়েছিল পুতুল আর পুতুলের মা।

কতোবার ভেবেছে সুধা, কতোদিন পর্যন্ত, একবার চলে গিয়ে দেখে আসি। কিন্তু হয়ে ওঠেনি।

তখন তো ছোট একটা ছেলে, এগারো কি বারো বছর বয়েস, কেমন করে রেলগাড়ি করে যেতে হয়, কোন দিকেই বা সেই দেশটা কিছু জানে না।

যখন বাবার কাছে মার খেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল, তখন তো কোনো লক্ষ্য না নিয়ে পায়ে হেঁটে ঘুরছিল। কিন্তু এটা আলাদা।

তাছাড়া পয়সাই বা কোথায়?

একদিন বলেছিল বলরাম আঢ্যকে। ‘তুমি যে বলেছিলে মাইনে দেবে।’

বলরাম বলেছিল, ‘ও বাবা! বিষের সঙ্গে খোঁজ নেই, কুলোপানা চক্কর। এক্ষুণি মাইনে? আগে গোঁফ গজাক দিকি ছোড়া, তারপর মাইনের কথা মুখে আনিস।’

তা’ গোঁফ গজাবার আগেই বলরাম আঢ্যির কবল মুক্ত হয়ে সরে পড়েছিল সুধা, অথবা সুধো। আর কে কবে তাকে সুধা নামে ডাকলো?

‘সুধা’ শব্দটা নিয়ে হাসাহাসি করেছে সবাই। অতএব সুধোই স্থায়ী নাম।

কিন্তু পরে তো মাইনে হয়েছিল সুধোর।

কেমন করে রেলগাড়ি চড়তে হয়, সে জ্ঞানও জন্মেছিল।

তবে?

তখন আর এক বাধা!

লজ্জার বাধা!

দারুন লজ্জা! কতোখানি স্নেহ ভালবাসার কী অপমান করেছিল সেই সুধা নামের অবোধ ছেলেটা, বোধ সম্পন্ন সুধোর তো সেটা ধারণায় এসেছিল?

অতোবড়ো অপরাধীর মুখ নিয়ে কেমন করে সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে?

ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে গেছে সে দিকটা।

ক্রমশঃই তারা এখনো ঠিক সেইখানেই আছে, বেঁচে আছে, এ বিশ্বাস ভেঙ্গে গিয়েছিল। কাজের ভীড়ে মনে থাকতো না। শুধু নিঃসঙ্গ কোনো মুহূর্তে প্রাণটা ছটফটিয়ে উঠতো।

হঠাৎ ওই বটেশ্বর নামের তরুণ কবিয়ালকে দেখে কোথা থেকে এলো ঢেউ। ধুয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল বিস্মৃতির ধূলো।

ও আর কেউ নয়।

ও পুতুল। নির্ঘাৎ পুতুল। যতোই উড়িয়ে দিতে চাক।

মুখের ঢাকা চাদরটা খুলে ফেলে উঠে বসলো সুধো।

দেখলো কেউ নেই।

কে কখন ঘুম ভেঙে উঠে চলে গেছে।

সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে সুধো গ্রামের প্রান্তে একটা ভাঙা শিব মন্দিরের চাতালে এসে বসলো।

আশ্বিনের চড়া রোদ। কিন্তু এখানটায় মন্দিরের ছায়া।

আজই চলে যাবার কথা।

মল্লিক বাড়ি থেকে হুকুম হয়েছে বিসর্জনের পর মিষ্টি মুখ হিসেবে রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে যেতে হবে।

‘রামকৃষ্ণ অপেরা’ আর এক বায়নায় গত রাত্রেই চলে গেছে, এরা থাকবে।

অতএব আজকের দিনটা ছুটির দিন।

আজকের দিনটা হাতে পেয়ে গেছে সুধো।

যদি মান্না কোম্পানী অন্য বায়নায় আজ সক্কাল থেকে চলে যেতো! ভগবান!

ভগবান তুমি সুধোর সহায়।

সুধো সকালের কথাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবতে থাকে।

উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেও, ধরা দিয়ে ফেলেছে পুতুল।

কিন্তু সুধো কি ওই ‘ধরা দেওয়া’কে আবার হারিয়ে ফেলবে।

‘মান্না কোম্পানী’ তাদের তরুণ কবিয়াল বটেশ্বরকে নিয়ে পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে চলে যাবে তাদের আরো সব আজে বাজে লোকের জঞ্জালের সঙ্গে?

আচ্ছা ওরা কি সত্যিই ধরতে পারেনি?

না কি এটা ওদের সমবেত ষড়যন্ত্র?

মেয়ে গায়েনকে সভায় আনতে লজ্জা আছে, তাই এই ভেক?

পুতুলের মুখে যে সেই তেজ, সেই দর্প, সেই ঔজ্বল্য! যে তেজে একদিন জেদ ধরেছিল—’হ্যাঁ আমি বেটাছেলে হবো। হবো হবো হবো।’

কিন্তু এতোদিন পুতুল কোথায় কাটালো? কীভাবে কাটালো? মা কি বেঁচে আছেন এখনো? মেয়েকে একদল পুরুষের সঙ্গে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন?

না কি পুতুলের জীবনে যা অধঃপতন হবার তা হয়ে গেছে?

সুধো শিউরে উঠলো।

সুধোর মনটা হঠাৎ একবার বিরূপ হয়ে গেল। সুধোর মান্না কোম্পানীর দলের লোকগুলোর চেহারার কথা মনে পড়ে গেল।

ওই বিচ্ছিরি লোকগুলোর সঙ্গে দিন—রাত্রি বাস করে একটা রূপসী মেয়ে ভালো থাকতে পারে? ছেলে সেজে ক’দিন চোখে ধূলো দেওয়া যায়?

সুধো হতাশ অবসন্ন হয়ে বসে থাকলো।

ও মেয়ের বারোটা বেজে গেছে।

কিন্তু যেই মনে হচ্ছে এতোক্ষণে মান্না কোম্পানীর গোছগাছ হয়ে গেল, আর ঘণ্টা কয়েক পরেই পুতুলকে নিয়ে চলে যাবে ওরা, সেই ‘আর আমার কিছু করার নেই’ বলে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।

ঘরছাড়া সুধো এমনিতে বড়ো সুখেই ছিল, যেন হঠাৎ অতীতের এক খাতক এসে দু’হাত মেলে তার প্রাপ্য পাওনা চাইলে সুধো বলতে পারছে না, সরে পড়ো হে, আমি তোমার কিছু ধারিটারি না।

সুধোর কানসোনাপুরের দীঘীর পারের সেই বটগাছটা মনে পড়ছে, সেই ছোট্ট একতলা বাড়িটি মনে পড়ছে, আর মনে পড়ছে একখানি ব্যাকুল মাতৃকণ্ঠ, ‘সুধা, আমি মরে গেলে তুই আমার এই ঘরবাড়ি, এই রাধাগোবিন্দ, এই ফুল তুলসী সবকিছুর ভার নিবি তো বাবা? আর আমার পুতুল। ওকে তো তোর হাতেই তুলে দেব।…দশ বছরে পা দিলেই—’

ছ সাত বছরের মেয়ের দশ বছরে পা দেবার অপেক্ষায় দিন গুণছিল পুতুলের মা।

বেইমান ছেলেটা ওই দিন—গোণার মধ্যেই পিটটান দিলো। হয়তো জ্ঞানবুদ্ধির বালাই জন্মায়নি বলেই—

কিন্তু এখন?

এখন আর কোনো বোধ না জন্মাক, কর্তব্যবোধটা কিছু কিঞ্চিৎ জন্মেছে?

এখনও পিটটান দেবে ও কর্তব্যের সামনে থেকে?

সুধো এই ‘বসন্তবাহারের’ চাটিবাটির সঙ্গে নিজেকে গুটিয়ে নিতে নিতে দেখবে মান্না কোম্পানী গরুর গাড়িতে জান্তে অজান্তে সব মালমোট চাপিয়ে ষ্টেশনের দিকে এগোলো, গরুর গাড়ির চাকার চাপে ধূলো উড়ে দৃশ্যটা ঢেকে দিলো।

ঠিক এমন করে পরিষ্কার ভাবতে না পারলেও ওই ছবিগুলো চোখের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।

ওই ধূলোটা যেন শুধু গরুর গাড়ির দৃশ্যটাই নয়, সুধোর ভবিষ্যতের সব রং সব ছবি ঢেকে দিচ্ছে—

সুধো ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো।

সুধো মান্না কোম্পানীর আড্ডার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দু’তিনটে ঘরে তালা ঝুলছে, দু’একটা ঘরে তালা নেই বটে, তবে ভিতর থেকে বন্ধ।

আজ আর কাজ নেই, তাই আহ্লাদের মেজাজে ঘুরছে সবাই। বাড়ির পিছনে কাঁচা উঠোনে দুটো গর্ত কাটা উনুনের পাশে দু’ বোঝা কাঠ রাখা হয়েছে, বোধহয় ভারপ্রাপ্তরা বেড়িয়ে ফিরে এসে দাউ দাউ করে কাঠ জ্বেলে দিয়ে চালেডালে রেঁধে সেরে নেবে। এরাও তাই করে। বসন্তবাহারের দল। বাবুদের বাড়ি থেকে যা সিধে আসে, তাতে বড়িটি থেকে পোস্তটি পর্যন্ত না এলে এরা অভিযোগ করে। কিন্তু রান্নার বেলায় ওই এক পাকে।

যাদের ওপর রান্নার ভার নেই, তারা সারাদিন ইচ্ছেমত বেড়াবে, হাটে যাবে। হয়তো বা এখন থেকেই কেউ কেউ নদীর ধারের জায়গা রিজার্ভ করে রেখে আসতে গেছে, যাতে প্রতিমা বিসর্জন দেখবার সুবিধাটা বেশী হয়।

সুধো কখনো প্রতিমা বিসর্জন দেখতে পারে না।

সুধো ভেবে পায় না কোন প্রাণে মানুষ প্রতিমা বিসর্জন দেখবার জন্যে এমন উৎসাহিত হয়। যাকে নিয়ে তিন চার দিন ধরে এতো উৎসব, এতো আহ্লাদ, তার জ্বলজ্বলাট মূর্তিখানা অমন করে জলে ফেলে দেওয়া, এটাই তো একটা অদ্ভুত প্রথা।

তা, সেই প্রথাটা না হয় অনেক ভেবে চিন্তে।

কিন্তু দেখতে যাওয়াটা?

চিতা জ্বালা দেখতে যেতে উৎসাহ বোধ করো তুমি? শ্মশানের চিতা?

তবে?

এতে এতো উৎসাহ কেন?

সুধোর মনে হয়, এই উৎসাহটা মানুষের সহজাত হিংস্রতা, মজ্জাগত বর্বরতা।

সুধো প্রতিমা বিসর্জন দেখতে যাবে না।

কিন্তু সুধোর মনের জগতের সেই প্রতিমাটির?

তার বিসর্জনের ভার তো সুধোর নিজেরই হাতে। রাখো, ফেলো, যা ইচ্ছে।

সুধো গলা ঝাড়া দিলো।

কেউ সাড়া দিলো না।

সুধোর গলা দিয়ে উচ্চ ডাক বেরোচ্ছে না তাই সুধো দরজার কড়া নাড়া দিলো।

এবার ভিতর থেকে সাড়া এলো, ‘কে?’

এবং তারপরই একটা ঘরের দরজা খুলে যে বেরিয়ে এলো তার জন্যেই সুধোর এই আকুলতা। আবার তার সম্পর্কেই সুধোর মন আশা ছাড়া ছিলো।

বটেশ্বর দরজা খুলতে আসবে, এ ভাবেনি সুধো।

দরজা খুলেই সে ভুরু কুঁচকে বললো, ‘আবার কী মনে করে?’

সুধো বললো, ‘বসতে দেবে না?’

‘কী দরকার বসবার?’

‘দুটো কথা বলতাম!’

‘আমার সঙ্গে কারুর কোনো কথা নেই।’

‘পুতুল, তোমায় শুনতেই হবে।’

‘আর এতো এক ভালো জ্বালা হলো!’ বটেশ্বর বললো, ‘এমন হ্যাংলা লোকও তো দেখিনি কখনো। দেখছে কেউ আমল দিচ্ছে না, তবু—’

‘হ্যাঁ পুতুল, তবু এসেছি আমি। আবারও আসবো। তুমি যতোক্ষণ না আমার কথাটা শুনবে, ততোক্ষণ আসবো।’

‘ও! তাই বুঝি? তা এই উজিরপুরে বুঝি শেকড় গাড়া হচ্ছে? মানে—দু’পক্ষেরই? নইলে তো বারবার আসা যাওয়া হচ্ছে কী করে?’

‘পুতুল, তোমাদের কর্তা ঠিক জানে তুমি কী?’

বটেশ্বর গভীরভাবে বলে, ‘আমি কী, সে সন্ধান না নিয়ে আপনি নিজে কী, তাই ভাবুনগে বসে বসে সুধাংশুবাবু! তবে আমি বুঝে নিয়েছি আপনি কী।’

‘কী বুঝে নিলে?’

‘সে যা বোঝবার বুঝেছি।’

‘অবশ্যই খুব মন্দ খুব পাজী বদমাইস? কেমন?’ সুধো দৃঢ়ভাবে বলে, ‘তা তাই যখন ভেবে নিয়েছো, তো তেমনি ব্যবহারই করবো! মান্নাবাবুকে জানিয়ে দেব তুমি ‘কী’।’

‘জানিয়ে দেবে?’

বটেশ্বর জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড স্থির দৃষ্টিতে সুধোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বটেশ্বরের বোধকরি খেয়াল হয় না এর আগে পর্যন্ত লোকটাকে ‘আপনি’ করে কথা বলেছে সে।

সেকেণ্ড কয়েক পরে কথাটা আবার উচ্চারণ করে সে, ‘জানিয়ে দেবে? ঠিক আছে, দিও। দেখো আমার কতোটা ক্ষতি করতে পারো।’

বটেশ্বর তার গায়ে জড়ানো জরিপাড় বাহারি উড়ুনির কোণটা উড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

এতোক্ষণে লক্ষ্য পড়লো সুধোর ‘বটেশ্বর’ সাজা পুতুলের গায়ে একখানা উড়ুনি ছিলো।

অবশ্য এতে সন্দেহ উদ্রেকের কিছু নেই। ওর সাজের সবটাই তো সৌখিন। মিহি শান্তিপুরী ধূতির ফুল কোঁচা আগা, চুড়িদার আদ্দির পাঞ্জাবীর গিলে করা হাতা, থাক দেওয়া বাবরি চুলের মাঝখানে টেরী সিঁথি সবটাই মিলিয়ে বেশ যে একখানা নটবর ভাব, এরসঙ্গে উড়ুনি বেমানান নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *