৩
সুধো আস্তে আস্তে ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একটা বটগাছ, একটা ডিঙ্গিনৌকো আর একটা ছোট ছেলে।
ছেলেটা সেই বটগাছের তলায় বসে কোঁচার খুঁটে মুড়ি মুড়কি নিয়ে খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে দুটো চারটে করে মুড়ি নিয়ে দীঘির জলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে।
ছেলেটার দৃষ্টি উদাস উদাস।
ওই ডিঙি নৌকোটা চড়ে যদি অনেক অনেক দূরে চলে যাওয়া যেতো! তাহলে ও সেই অনেক ‘দূরের দেশে’ গিয়ে বসবাস করতো। যা ইচ্ছে করবে, যা জুটবে খাবে, আর গান গেয়ে গেয়ে বেড়াবে। যেমন অন্ধ ভিখিরীরা গায়।
সেই ঘাটের ধারে একটি মহিলা এলেন ছোট্ট একটা মেয়ে সঙ্গে নিয়ে।
মহিলাটি নিজে চান করবার আগে সেই বছর চারেকের ছোট্ট শিশুমেয়েটাকে বেশ পরিপাটি করে চান করিয়ে ছেলেটার কাছে এনে একটু মিষ্টি হেসে হেসে বললেন, ‘মেয়েটাকে একটু দেখবে বাবা, যেন জলের ধারে না যায়। আমি চানটা করে নেব।’
ছেলেটা আড়ষ্ট হয়ে তাকালো।
মেয়েটাও মহিলাটির আঁচল চেপে ধরলো।
মহিলাটি হেসে বললেন, ‘ভয় কি? দাদা হয়। বোসো দাদার কাছে বোসো। তোমার নামটি কী বাবা?’
নাম শুনে বলেন, ‘তা’ এখানে একা যে?’
ছেলেটা কোনো উত্তর দেয় না। শুধু মেয়েটার হাত ধরে সামলাবার চেষ্টা করে।
মহিলাটি আবার বলেন, ‘তোমার সঙ্গে কেউ নেই?’
‘না।’
‘কেন বলতো? বাড়ি কোথায়?’
ছেলেটা হঠাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘বাড়ি নেই।’
‘বাড়ি নেই! ওমা সে কী? রাগ করে পালিয়ে আসোনি তো বাবা?’
ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘হ্যাঁ এসেছি। কী করবে তুমি? আবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে? ঠিকানা বলবোই না।’
মহিলাটি একটু হেসে ওর হাত ধরে বলেন, ‘তা কেন? আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো। আমার কাছে রাখবো। এর একটিও দাদা দিদি নেই, তুমি ওর দাদা হবে। ওকে নিয়ে খেলা দেবে, একসঙ্গে খাবে।’
একসঙ্গে খাবে!
কথাটা কী অদ্ভুত সুন্দর!
ছেলেটার চোখে জল আসে।
কতোদিন ওই ‘খাওয়া’ শব্দটা ভুলে গেছে সে।
ঘুরতে ঘুরতে একটা মুড়ি বাতাসার দোকানের কাছে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো, তারা চারটি মুড়ি মুড়কি দিয়েছে।
এই একটা ধুতি আর কোট, এই পরে কতোদিন যেন রয়েছে।
‘যাবে তো আমার সঙ্গে?’
ছেলেটা ঘাড় কাৎ করে।
এমন স্নেহময়ী মাতৃমূর্তি সে বুঝি কখনো দেখেনি।
মহিলাটি বলেন, ‘তবে বোনটিকে ধরো? আমি চান করে নিই কেমন?’
ছেলেটা সেই ফুটফুটে মেয়েটাকে ধরে রাখবার জন্যে আত্মনিয়োগ করে।
তারপর?
তারপর একখানি ছোট্ট সুন্দর একতলা বাড়ি। মেটে উঠোন, উঠোনে ফুল গাছ। তুলসী মঞ্চ, ঘরের মধ্যে চৌকিতে ধবধবে বিছানা পাতা। রান্নাঘরে ঝকঝকে কাঁসার বাসন সাজানো।
এই বাড়িতে আশ্রয় পেলো ছেলেটা।
ঝকঝকে কাঁসার থালায় পরিপাটি করে বাড়া ভাত, ছোট ছোট বাটিতে ডাল তরকারি।
দেখে চোখে জল আসতো তার।
এতো আদর কবে পেয়েছে সে?
এমন যত্ন?
দুদিনে হৃদয় উজাড় হয়ে যায়।
বুঝি দু’ পক্ষেরই।
‘বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলি কেন রে?’
‘এমনি।’
‘এমনি? এমনি কেউ বাড়ি ছাড়ে? মা নেই বুঝি?’
‘আছে।’
‘মা আছে, তবু তুই বাড়ি থেকে পালিয়ে এলি? কী নিষ্ঠুর রে তুই?’
‘বাঃ! ও কি আমার নিজের মা? ও তো টুনুর মা।’
‘টুনু কে?’
‘আমার বোন।’
‘বুঝেছি! সৎমা। তা’ তোকে খুব মারতো বুঝি?’
‘মারতো না বেশী। ভয় দেখাতো।’
‘ভয় দেখাতো? কিসের ভয়?’
‘ভূতের, একানড়ের, বেম্মদত্যির।’
‘তা’ তোর বাবা ভালবাসতো না?’
‘বাবা তো কেবল মারতো। শুধু শুধু মারতো। একদিন না এমন মারলো আমার ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ে গেল।’
‘ষাট ষাট! বাছারে! শুধু শুধু এমন করে মারলো?’
ছেলেটা একটু ইতস্ততঃ করে বলে, ‘সেদিন শুধু শুধু নয়—’
‘সেদিন বুঝি দুষ্টুমি করেছিলি?’
‘হুঁ। বলেছিলাম, আমি অন্ধ ভিখিরি হবো, তাই চোখে মায়ের মাথার কাঁটা ফোটাচ্ছিলাম!’
‘ওরে বাবারে! কী সর্বনেশে ছেলেরে তুই!’
ছেলেটা অনুভব করলো তিনি যেন কেঁপে উঠলেন। তারপর ওর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘এতো দেশ থাকতে অন্ধভিখিরি হবার ইচ্ছে হলো কেন রে তোর?’
‘অন্ধ ভিখিরিরা যে ভালো গান গাইতে পারে।’
‘কে বলেছে তোকে একথা?’
‘নন্দকাকা।’
‘নন্দকাকা কে?’
‘ও এমনি! মাছ ধরে।’
‘হুঁঃ। তা’ শুধু অন্ধরাই গান গাইতে পারে?’
‘কি জানি।’
‘আচ্ছা জানাই তোকে আয়।’
বলে তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।
আস্তে আস্তে একটু সুর ভেঁজে গান ধরলেন। তারপর? গানের পর গান। পর্দার পর পর্দা, বাঁশীর মতো গলা।
ছেলেটা যেন পাথর হয়ে গেছে।
চেতনা নেই। চেতনা হতে হতে ভাবতে শুরু করলো এ যে তার ঠিক ধ্রুবর মতো হলো।
ধ্রুবকে ধ্রুবর বাবা কোল থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলো, আর সৎমা বকেছিল বলেই না ধ্রুব তারপর ভগবান পেয়েছিল, স্বর্গ পেয়েছিল!
এই গানের মানুষের কাছে থাকতে পাচ্ছে ছেলেটা, তাঁর হাতের রান্না খাচ্ছে, তাঁর কাছে শুচ্ছে। এ স্বর্গ ছাড়া আর কী?
‘গান তুই খুব ভালবাসিস নারে সুধা?’
‘হু।’
‘পুতুলও গান বলে লাগল। যখন এতোটুকু বাচ্চা, কেঁদে আকুল হচ্ছে, গান শুনে চুপ।’
‘তুমি এতো ভাল গান কী করে শিখলে?’
‘গুরু শিখিয়েছেন।’
‘কোথায় গুরু।’
‘নেই! মারা গেছেন।’
‘তোমার সবাই মরে যায় কেন? পুতুলের বাবা মরে গেলো, গুরু মরে গেলো—’
‘আমার কপাল রে—’
‘যদি আমরাও মরে যাই? পুতুল আর আমি?’
‘ষাট ষাট! জয় গুরু! এমন কথা বলতে নেই বাবা! বরং আমি মরে যাবো, তুমি পুতুলকে দেখবে।’
‘না তুমি কক্ষণো মরে যাবে না।’
‘আচ্ছা মরে যাবো না।’
‘তুমি আমায় গান শিখিয়ে দেবে মা?’
হ্যাঁ, পুতুলের দেখাদেখি ‘মা’।
‘শিখতে চাস। আচ্ছা।’
তারপর থেকে দুটো শিশু ছাত্রকে নিয়ে বসলো গানের ক্লাশ।
পুতুলের গলা মিষ্টত্বে ওর মাকে ছাড়ায়।
ছেলেটাও চেষ্টা করে শেখে। ভালই শেখে।
‘মা, রোজ তুমি ফর্সা কাপড় পড়ে চাদর গায়ে দিয়ে কোথায় যাও!’
‘চাকরী করতে যাই বাবা!’
‘ধ্যেৎ মেয়েমানুষে বুঝি চাকরী করে?’
‘যাদের বাড়িতে পুরুষমানুষ নেই, তাদের টাকা আসবে কোথা থেকে তাই বল? তুই যখন বড়ো হবি, চাকরী করবি, তখন আর আমি চাকরী করবো না। শুধু বাড়ি বসে গান গাইবো।’
* * *