২
‘এবার রংচঙানি ধুয়ে ফেলে—
বাড়ি যাও হে বটু—
হাটে হাঁড়ি ভাঙবোনা আর—
শুনতে হবে কটু।
সাঙ্গ হলো এবার তবে
উজিরপুরের পালা
যা বটেশ্বর গলায় পরে
টাটকা ঘুঁটের মালা।’
বটেশ্বরের যখন ঘুঁটের মালার বরাদ্দ, তখন ধরে নিতে হবে বটেশ্বরই পরাজিত।
হাততালিতে ফেটে পড়ল অক্লান্ত শ্রোতাদের আসর। সারারাত জেগে তাদেরও উৎসাহে ঘাটতি নেই।
আসর যদি ফাঁকা হয়ে যেতো, গায়েনদেরও অবশ্যই উৎসাহে ভাঁটা পড়তো। কিন্তু শ্রোতার দলই অফুরন্ত উৎসাহে ‘আরো হোক, আরো চলুক’। করে জিনিসটাকে থাকতে দিচ্ছিল না।
কুচোকাঁচারা ঘুমিয়ে কাদা হয়ে অভিভাবকদের কোলের গোড়ায় পায়ের তলায় হাঁটুর নীচে চটকে পড়ে আছে, সেদিকে অভিভাবকদের দৃষ্টি নেই। জানেন সকালে উঠে বাড়ি যাবার সময় খুঁজে পেতে কুড়িয়ে নিয়ে যাবো।
স্টেশনের ধারে সম্প্রতি একটা ‘সিনেমা হল’ হলেও এটা একটা আলাদা আকর্ষণ।
সারা বছরের প্রতীক্ষার বস্তু।
আবার আগামীকাল যাত্রা শুনবে রাত জেগে। গতকাল পর্যন্ত তো এই কাহিনী হয়েছে।
পুরুষরা দিনেরবেলা ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেবে, মেয়েদের সে সুবিধে নেই, তারা সারাদিন হাই তুলবে আর কাজ সারবে।
মল্লিকরা বরাবর এখানে থাকে না বটে তবে দেশের সঙ্গে যোগ ছিন্ন করেনি। ছেলেবুড়ো সকলেরই উজিরপুরের ওপর খুব টান।
আর এই পূজোর ব্যাপারে মহোৎসাহ ওদের। কলকাতার অনেক কুটুম কাটুমও ‘বাড়ির পূজো’ দেখবে বলে সঙ্গে আসে। কলকাতায় তো বারোয়ারি ছাড়া পূজা বলতে কিছু চোখে পড়ে না। আর পড়লেও সেখানে কে নাক গলাতে দিচ্ছে?
এ আলাদা সুখ।
তাই এই পূজোর সময়টা উজিরপুরের পথঘাট, বাগান পুকুর গ্রামের এবং শহরের কলকণ্ঠে আর আনন্দ ধ্বনিতে ঝনঝনিয়ে ওঠে।
সুধো বাগানে এসে দাঁতন করছিল।
ফুলবাগান নয়, আম কাঁঠালের বাগান। এখন ফল নেই কিন্তু নিবিড় ছায়া আছে।
সুধো সেই ছায়ায় একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসে দাঁতন করছিল।
সুধোর মন অন্যমনস্ক, মুখ শুকনো বিষণ্ণ।
সারারাত লড়ালড়ির পর সকালে অবশ্যই মুখ তাজা থাকবার কথা নয়, কিন্তু এ সে শুকনো নয়। এ আর কিছু।
গত রাত্রের বাকযুদ্ধে সুধোই শেষপর্যন্ত জিতেছে, কিন্তু এ জেতায় আত্মপ্রসাদ নেই। সুধোর বিবেক সুধোকে কাঁটা বিঁধোচ্ছে।
‘কথার কারচুপিতে আমি জিতেছি ওকে হারিয়ে দিয়েছি—।’ সুধো ভাবে, কিন্তু এই জেতা ন্যায্য জেতা নয়।
অনেকবারই শ্রোতাদের ধাঁধাঁয় ফেলে আসল উত্তর এড়িয়ে গিয়ে ওকে হতভম্ব করে দিয়েছি, জব্দ করে দিয়েছি। ফলে ও খেইহারা হয়ে অন্য খেই ধরতে গেছে। অবশ্যি মাঝে মাঝে ও খুব কাঁচামিও করেছে। তখন মজা লেগেছে।
তখন ওকে ঠিকই পেড়ে ফেলেছি।
ঘাম ছুটে গেছে ওর।
কিন্তু ঐ এক একবার?
সুধো বিবেককে ঘুম পাড়াতে পারছে না।
তাই সুধোর জিতেও পরাজিতের মুখ।
সেই গভীর সন্দেহটাই সুধোকে এতো পীড়া দিচ্ছে নচেৎ ছলে বলে কৌশলে প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করাই তো খেলা।
ওই সন্দেহটা যদি না জাগতো, সুধো এত ধিক্কার বোধ করতো না। সমানে সমানে লড়াই হলে যে ভাবেই হোক পাঁচজনের সামনে দলের মান বজায় থাকে। নিজের মুখ বজায় রাখাটাই গৌরবের। কিন্তু এ যে তখন কেবলই মনে হয়েছে একটা মেয়ের কাছে হারবো?
আর এখন মনে হচ্ছে, একটা মেয়ের সঙ্গে অন্যায় যুদ্ধে জিতলাম?
কিন্তু ওই ‘মেয়ে’ শব্দটা এমন করে পেয়ে বসেছে কেন সুধোকে?
রাখালদাস তো বারবার বলেছিল, ‘বাজে চিন্তাটা ছাড় সুধো! শ্রোতার মনহরণ করবার জন্যে ছোঁড়াকে অমন নটবর করে সাজিয়েছে। দেখতে রসালো আছে কিনা।’
তবু সুধো ভাবছে সত্যিই কি তাই?
ওই মুখটা সুধোর কোন গভীর অতলে একখানা ছায়া ফেলেছিল নাকি? অনেক অনেক দিন আগে? ঢেউয়ের তোলপাড়ে ভেসে উঠলো, অতল থেকে উপরে এলো। অথচ নামগন্ধ কিছুই মনে পড়ছে না। একটা গানের সুর।
যেন কতোকাল আগে পাওয়া একটা সুরভি পুষ্পের সৌরভ স্পর্শ।
দাঁতনটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল সুধো। আর সেই সময়ই সংকল্প করলো সুধো, আমি ওর সঙ্গে দেখা করবো।
হ্যাঁ দেখা করবো।
দেখা করে ক্ষমা চাইবো।
স্পষ্টাস্পষ্টিই বলবো, ‘আমি তোমায় ফাঁকি দিয়ে হারিয়েছি।’
লোকসমাজে তো আর ও মেয়ে নয়?
দেখা করতে চাইলে লজ্জা কী?
তারপর সুধো চান করে নিতে জলে পড়লো।
তাই করে এরা।
সারারাত জেগে সকালে একেবারে চান করে উঠে বড়ো এক গ্লাস চিনির শরবৎ অথবা এক গ্লাস ডাবের জল খেয়ে টেনে লম্বা হয়।
সুধো ভাবলো এখন দেখা করতে গিয়ে লাভ নেই। বটেশ্বর নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে।
তবু ব্যাকুলতার জয় হলো।
সুধো স্নান করে ভাল ধুতি পাঞ্জাবী পরে জিতেনবাবুর বৈঠকখানা বাড়ির কাছে গিয়ে হাজির হলো। এইখানেই মান্না কোম্পানীর থাকবার জায়গা হয়েছে।
সুধো গিয়ে দরজার কাছে কাকে একটা বললো, ‘মান্না মশাইকে একবার ডেকে দাও তো ভাই।’
‘মান্না মশাই?’
ছেলেটা অগ্রাহ্য ভরে বলে, ‘তেনার এখন মাঝরাত্তির। ওখান থেকে ফিরেই তো লম্বা দিয়েছে।’
সুধো বলে, ‘আচ্ছা দলের আর কে আছে?’
‘আছে তো সবাই। চলে গেলে তো এই নটা দশের গাড়িতে চলে যাওয়া যেতো, কিন্তু সবাইতো ঘুমে ঘুমে কুমড়ো গড়াগড়ি।’
সুধো মৃদু হেসে বলে, ‘কেউ জেগে নেই?
‘আছে।’
ছেলেটা ঘাড় দুলিয়ে বলে ‘বটেশ্বরদা আছে। তিনি তো চান করে এসে চা বানিয়ে খাচ্ছে।’
‘আচ্ছা বটেশ্বর বাবুকেই একবার গিয়ে বল, তোমায় ডাকছে—।’
‘আচ্ছা—’
ছেলেটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, ‘আপনিই কালকের গায়েন না? বসন্তবাহার কোম্পানীর?
সুধো হেসে বলে, ‘হুঁ। তুমি তো দেখছি চিনে ফেলেছ?’
‘আগে পারিনি, এখন পেরেছি। তা’ কালকের লড়ালড়িতে কে জিতলো কে হারলো?
সুধো হাসিমুখে বলে, ‘কেন, তুমি ছিলে না?’
‘একটুক্ষণ ছিলাম। আমার আবার ঘুম বাতিক, তাই চলে এসেছিলাম।’
‘ওঃ! লড়াইতে তিনি জিতলেন আমি হারলাম।’
‘সত্যি?’
‘সত্যিই তো।’
‘তা এখন আবার বটেশ্বরদার সঙ্গে কী কাজ?’
সুধো গম্ভীরমুখ করে বলে, ‘ওনার কাছে একটু শিক্ষা নিতে এসেছি। কিসে জেতা যায়।’
ছেলেটা দৃঢ়ভাবে বলে, ‘উনি দেবে না। কেন দেবে? নিজের গুণ বিদ্যে কেউ অপরকে শিখিয়ে দেয়?’
‘দেয় না? মাষ্টার মশাইদের কাজই তো তাই।’
‘বটেশ্বরদা তো আর মাষ্টার মশাই নয়।’
‘তা নয় বটে। তবে অপর দলের কেউ খোসামোদ করে শিখতে চাইছে শুনলে, ‘না’ করতে পারবে না।’
‘আচ্ছা দিচ্ছি ডেকে।’
বলে চলে যায় ছেলেটা।
একটু পরে এসে দাঁড়ায় বটেশ্বর।
কালকের সেই সাজের সমারোহ এখন অন্তর্হিত। পেণ্টের কোটিং ধুয়ে ফেলা হয়েছে। শুধু ফর্সামতো একটি ছেলে বলে মনে হচ্ছে।
সুধো একটু থমকে যায়।
যে দুদিনই দেখেছে বটেশ্বরকে, ওই রংচঙে চেহারা। তাতে যেন মোহিনীমূর্তির আভাস।
সুধো একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলে, ‘আপনার কাছে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
‘ক্ষমা?’
বটেশ্বর রীতিমতো অবাক হয়।
‘হঠাৎ ক্ষমা চাইতে?’
‘দেখুন একটু বসতে পেলে ভালো হতো।’
বটেশ্বর বলে, ‘বসুন।’
‘আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম।’
বললো সুধো।
আর পরমুহূর্তেই বটেশ্বর তীক্ষ্ন গলায় বলে ওঠে, ‘কেন, ঘুঁটের মালা একগাছা নিয়ে এসেছেন বুঝি?’
সুধো মাথা নীচু করে বলে, ‘দেখুন, ওসব তো বাইরের ব্যাপার। বলতে গেলে, এ তো খেলাই।’
বটেশ্বর গম্ভীরভাবে বলে, ‘তা এখন আবার আপনার বক্তব্য কী?’
সুধো মাথা নীচু করে বলে, ‘বললামতো ‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।’
‘ক্ষমা? সেটা আবার কী?
বটেশ্বর হেসে ওঠে।
যে হাসি একমাত্র মেয়ে মানুষেই হাসতে পারে, ব্যঙ্গ আর তিক্ততায় ভরা।
সুধো কি তাহলে নিঃসন্দেহ হবে?
সুধো কি এখনই বলে বসবে, ‘আচ্ছা আপনি কখনো ‘কানসোনাপুরে ছিলেন? কানসোনাপুর? যেখানে তিন চুড়ো মদনমোহনের মন্দির আছে?’
কিন্তু না এখুনি ও কথা বলে বসা যায় না।
সুধো আস্তে আস্তে বলে, ‘আমি কাল আপনাকে অন্যায় করে পরাজিত করেছি। তাই সেই পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না।’
বটেশ্বর ভুরু কুঁচকে বলে ‘অন্যায় কিসের? ছলে বলে কৌশলে শত্রু নিধনই তো যুদ্ধের নীতি।’
‘নাঃ।’ সুধো বলে, ‘দুর্যোধনের উরুভঙ্গ ভীমসেনের চিরকলঙ্ক। হাজার হাজার বছর পার হয়ে গেল, ভীমের সে কলঙ্ক ধুয়ে মুছে গেল না।’
বটেশ্বর মৃদু হেসে বলে, ‘সেটা সে যুগের বলে। এ যুগে ওসব নীতি ফিতি অচল।’
‘তা নয়। নীতি সব যুগেই সমান।’
সুধো বলে, ‘আমি নিজে তো টের পাচ্ছি, আমি অন্যায় করে জিতেছি। যে চাপানের উত্তর দিতে পারিনি, সেটা জগাখিচুড়ি করে জিতেছি।’
বটেশ্বর এবার একটু কৌতুকের হাসি হাসে, ‘তাই সকাল বেলাই বিবেকের দংশনে ছুটে এসেছেন?’
সুধো বলে, ‘তাই।’
‘তা বেশ, তাহলে একটু চা খেয়ে যান।’ বলে একটু হাসির হিল্লোল তুলে ভিতরে ঢুকে যায় বটেশ্বর, এবং একটু পরেই একটা কাঁচের গ্লাসে এক গ্লাস চা নিয়ে এসে বলে, ‘শুধু চা কিন্তু—’
‘তাতে কি? তাতে কি?’
সুধো চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামের শব্দ করে বলে, ‘আচ্ছা আপনাকে একটা কথা শুধোই। এই বয়সে এমন শিক্ষাটা করলেন কবে? গুরু কে? কোথায় শিক্ষা?’
বটেশ্বর আস্তে আস্তে বলে, ‘একে একে বলতে হয় তা’হলে। এই বয়সে? আমার বয়সটা আপনি জানেন?’
‘নাই বা জানলাম। দেখে তো মালুম হচ্ছে।’
বটেশ্বর আবার তেমনি একটু হেসে বলে, ‘আপনাকে দেখেও তো নেহাৎ বড়ো বলে মনে হচ্ছে না? আপনাকেও তো ওকথা জিজ্ঞেস করা যায়?’
‘তা আমারটার আগে উত্তর দিন, তারপর ওটা হবে।’
বটেশ্বর বলে, যাক দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে ‘এমন শিক্ষা।’ তা’ সেটাই বা কী এমন? হেরে ভূত হলাম তো।’
‘দেখুন ওকথা বলবেন না। ভূত আপনি হননি।’
‘ঠিক আছে, ভূত হইনি। বটেশ্বর বলে ওঠে, ‘তবে আমি জানি আমি ভূত হয়ে গেছি।’
সুধো সাবধানে বলে, ‘তাহলে তো আর না জিগ্যেস করে পারছি না। কানসোনাপুরে গেছেন কখনো?’
‘কানসোনাপুর?’
বটেশ্বর হঠাৎ দারুণ থমকে যায়।
বলে, ‘কানসোনাপুর?’ সে আবার পৃথিবীর কোনখানে? বিলেতে না আমেরিকায়?’
সুধো হঠাৎ গাঢ় স্বরে বলে, ‘আমি যদি বলি সেটা কোথায় তুমি ভালই জানো। আর সেখানে তুমি বটেশ্বরে নামে ঘুরে বেড়াতে না। ঘুরে বেড়াতে পুতুল নামের ছোট্ট একটি মেয়ে হয়ে। ভোর না হতেই শিউলি ফুল তুলতে ছুটতে—’
‘কী আবোল তাবোল বকছেন?’
বটেশ্বরের সুরেলা গলা হঠাৎ কড়া হয়ে ওঠে। ‘সকাল বেলাই নেশাভাঙ করে এসেছেন না কি? যান বাড়ি যান।’
সুধো মৃদু হেসে বলে, ‘আমার উত্তর পেয়ে গেছি। চলি—’
বটেশ্বরের মুখটা লাল দেখায়। সে কড়া অথচ চাপা গলায় বলে, ‘কাল অতো অপমান করেও আশা মেটেনি? আরো করতে চান?’
‘কালকে?’ সুধো বলে ‘আমি যদি ইচ্ছে করে হেরে যেতাম তাহলেই কি তোমার মানটা বাড়তো পুতুল? তাতে তোমার—’
বটেশ্বর ক্রুদ্ধ গলায় বলে, ‘আবার আবোল তাবোল বকতে শুরু করেছেন? মনে রাখবেন, এখানে খেলনা পুতুল বলে কিছু নেই। আপনি নীলমণি মান্নার দলের কবিয়াল বটেশ্বর সরকারের সঙ্গে কথা বলছেন?
‘পুতুল’ আমার চোখকে তুমি ফাঁকি দিতে পারোনি। তোমার ওই রাগের মুখই তোমায় ধরিয়ে দিয়েছে—’
‘তাহলে যান, সবাইকে বলে বেড়ানগে—’ বটেশ্বর রুদ্ধ গলায় বলে, ‘অনেক দুঃখের স্রোতে ভাসতে ভাসতে অনেক ঘাটের জল খেতে খেতে একটা কূল পেয়েছি, সেটা ঘুচিয়ে দিন। মহৎ ব্যক্তি, মহত্ত্বের পরিচয় দিন আরো একবার।’
সুধো হাতের চায়ের গেলাশটা নামিয়ে রেখে বলে, ‘কোনমতেই মাপ করা যায় না?’
‘না?’ বটেশ্বর এবার অগ্নিমূর্তি হয়।
বলে, ‘দেখুন এবার কিন্তু আমি এদের ডেকে বলে দিতে বাধ্য হবো, ওই বসন্তবাহারের গায়েন সকাল বেলা নেশা করে এসে মাতলামি শুরু করেছে।’
সুধো উঠে দাঁড়ায়।
বলে, ‘আচ্ছা চলে যাচ্ছি। কিন্তু, মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে বলে, ‘আর আমি যদি ছদ্মবেশের কথাটা প্রকাশ করে দিই?’
বটেশ্বর কয়েক সেকেণ্ড স্থির চোখে তাকিয়ে বলে, ‘শুধু প্রকাশ করলেই তো চলবে না, তাহলে দুঃশাসনের পার্টটাও আপনাকেই নিতে হবে।
‘ছি ছি! তোমার মুখে কিছু বাধেনা দেখছি।’
‘মুখে বাধবে?’
বটেশ্বর তীক্ষ্ন গলায় বলে, ‘পেশা তো তের্জা লড়া, তাতে মুখ কি বাবু ভাইয়ের মতো সভ্য থাকে সুধাংশুবাবু?’
‘তা বটে! আমাদের দেবদেবী বন্দনা, কি দেহতত্ত্বের গান, ওগুলো লোকের আপদ বালাই লাগে। দেখি তো? সভার মধ্যে যতো গালাগালের স্রোত বওয়াবো, যতো ছোটলোকের মতো ইতর ভাষা বিষ্টি করবো, ততোই বাবু ভাইয়েদের মনোরঞ্জন হবে।’
‘আপনি বুঝতে পারছেন না অনেক চোখ এদিকে সেদিক থেকে দেখছে, আপনি যান।’
‘যাচ্ছি পুতুল, যাচ্ছি। কিন্তু একটা কথা বলি, তোমায় তো কেউ ”মেয়েছেলে” বলে জানেনা, দেখলই বা?’
‘ওঃ! আপনার পায়ে পড়ি, আপনি থামবেন? আপনি কি আমার সর্বনাশ করতে চান?’
সুধো আস্তে আস্তে দাওয়া থেকে নেমে যায়, আর কিছু বলে না।
সুধোর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে বটেশ্বর।
ভগবান একী খেলা তোমার!
যে সম্পদের জন্যে হাহাকার করে বেড়ায় মানুষ, হয়তো সেই সম্পদটুকুই এমন সময় দাও যে তাকে বিপদ বলে মনে হয়।
যে ছেলেটা সুধোকে বসিয়েছিল, সে বলে, ‘ও তোমার চেনা না কি বটেশ্বর দা?
বটেশ্বর সংক্ষেপে বলে, ‘হ্যাঁ আমার মাসির মায়ের কুটুম’।
ওখানে ওদিকে—’সুধো সুধো’ রবে হৈ চৈ উঠে গেছে।
কে দেখেছে ওকে শেষ?
কে আবার দেখেছে? কেউই দেখেনি। নাইতে গিয়েছিল সেইটাই দেখেছে সবাই।
ও এসে দাঁড়াতেই রাখাল দাস প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে ওঠে ”কোথায় ছিলে যাদু? সবাই বলছে নাইতে গিয়ে আর ফেরেনি।”
সুধো বসে পড়ে বলে, ‘তাই বুঝি? তা’ কান্নাকাটি পড়ে যায়নি কেন?’
‘পড়বো পড়বো করছিলো’ গুপী বলে ওঠে। ভাবছি এই মিছরির সরবৎটুকু গালে দিয়েই—’ওরে আমার ভাগ্নে রে!’ বলে মড়া কান্না কাঁদতে বসবো।’
এই ওদের রসিকতা।
রাখাল বলে, ‘নে শরবৎটা খা।’
‘নাঃ আর শরবৎ খাবো না, ‘এই মাত্তর চা খেয়ে এলাম।’
‘চা?’ গুপী শোবার জোগাড় করছিলো—
ছিটকে উঠে বলে, ‘চা? সক্কাল বেলা আবার চা তোমায় কোন কোম্পানী দিলো ভাগ্নে?’
সুধো গম্ভীরভাবে বলে, ‘মান্না কোম্পানী।’
‘মান্না কোম্পানী? তোকে চা খাওয়ালো?’
গুপী আবার শুয়ে পড়ে বলে, ‘মনিব! যা বলেছি তাই।’
রাখালের আগেই সুধো বলে ওঠে, ‘কী বলেছো শুনি’?
‘বলছিলাম নাইতে নেমে জলে পড়ে গেছলো সুধো, কেউ জাল ফেলে তুলে নিয়ে গেছে। ওই ওরাই নিয়ে গেছলো—’
রাখাল দাস ধমক দিয়ে ওঠে, ‘তুই থামতো গুপী। আমি প্রকিত কথাটা শুনি। মান্না কোম্পানী তোকে সকালবেলা ডেকে নিয়ে চা খাওয়ালো? আর তুই তাই খেলি?’
‘তা খাবোনা কেন?
রাখাল আতঙ্কের গলায় বলে, ‘তোর একবার সন্দেহ হলোনা এর কারণটা কী?’
‘এই দেখো রাখালদা, এক গেলাস চা দিচ্ছে, তাতে সন্দেহের কী থাকবে? বিষ মিশিয়ে দেবে?’
রাখাল ব্যাকুলভাবে বলে, ‘তাতেই বা ঠাট্টার কী আছে সুধো? এই পৃথিবীতে ঘটে না এসব? বলি তুই ওদের দলের শত্রু কি না? কালকের পরাজয়ে মরীয়া হয়ে বদমতলব আঁটতে পারে না? প্রাণে না মারুক, তুকতাক করে গলাটা খারাপ করে দিতে পারে, মাথাটা খারাপ করে দিতে পারে।’
‘আমি তো দেখছি রাখালদা, তার আগে তোমার মাথাটাই কেউ খারাপ করে দিয়েছে।’
‘ওরা ডেকেও নিয়ে যায়নি। আর একা আমায় মন্ত্রপূত চাও খাওয়ায় নি। স্বেচ্ছায় গিয়েছিলাম।’ সুধো অবহেলায় বলে,
‘ওরা খাচ্ছিলো, সেই থেকে—’
‘স্বেচ্ছায় গিয়েছিলি? তা এমন স্বেচ্ছাটা হলো কেন?’
‘দেখো রাখালদা’, সুধো গাঢ় স্বরে বলে, ‘সকাল থেকে মনের মধ্যে কাঁটা ফুটছিলো, মনে হচ্ছিল আমি সত্যি জিততে পারিনি, ছলে কৌশলে জিতেছি। তাই মাপ চাইতে গিয়েছিলাম।’
‘মাপ চাইতে গিয়েছিলি? কার কাছে?’
‘আর কার কাছে? স্বয়ং বটেশ্বরের কাছে?’
‘ওরে আমার যাদুরে, ওরে আমার মানিকরে—বটেশ্বরের কাছে মাপ চাইতে গিয়েছিলি তুই!’
রাখাল কখনো যা না করে, তাই করে। প্রায় ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এতো বিবেকবান পুরুষ তুমি? শুনে যে আমি হাঁ হয়ে যাচ্ছি।’
গুপী আবার ওর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলে ‘মালিক, ব্যাপার মনে হচ্ছে গুরুচরণ! ওই বটেশ্বরটা আসলে বটেশ্বরী কিনা সেই খবরটা নেবার জন্যে ভাগ্নে আমাদের সকলের অগোচরে—খি খি খি খি!’
‘ভালো হবে না বলছি মামা!’
‘এ দেখো ফোঁস করেছে!’
গুপী একটা চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে রাখাল দাসের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করে দুই হাত উল্টে হতাশার ভান করে।
সুধোও একখানা শতরঞ্চ পেতে, চাদর চাপা দিয়ে পাশ ফিরে শোয়।
মাথার মধ্যে ইঞ্জিন চলছে, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। তবু সারা রাত্তিরের জাগরণ ক্লিষ্ট চোখদুটো বুজে আসে।
শরীর হচ্ছে সবচেয়ে বড়ো কালেক্টর। যেখানে যা বাকিবকেয়া পাওনা থাকে, আদায় করে ছাড়ে সে।
* * * *