১১
নিজের শোবার ঘরটায় ঢুকলেন। ভারী গড়নের সেকেলে একটা দেরাজ আছে, সেটা খুললেন।
এটা ওটা ছোটখাটো কাগজ—পত্র, চিঠি, হিসেব, ক্যাশমেমো, মুঠো করে চেপে সব টেনে বার করলেন, ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে আস্তে একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে দিলেন।
সেই আগুনে ভারতীর চিঠিখানা।
বেচারী ভারতী!
সে হয়তো চিঠিখানা পাঠিয়ে পর্যন্ত ঘণ্টা গুনছে। ওকি স্বপ্নেও ভাবছে না তার চিঠিটা দেশলাই জ্বেলে পুড়িয়ে ফেলেছে! কিন্তু পুড়িয়ে ফেলাই ভালো। ও চিঠিতে ভারতী তার মাকে অনুরোধ করেছে মিথ্যা সাক্ষী দেবার। আস্তে আস্তে সেটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক।
‘নন্দিতা সেটা বুঝে ফেলেছে—’
ভাবলেন অজিতা দেবী। একবার নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারলে আর ভয় নেই, আর দুশ্চিন্তা করবার কিছু নেই। তাই নন্দিতা এমন উঠে পড়ে লেগে—। কিন্তু তবু অজিতা দেবীর ভুল হয়েছিল।
উনি ভেবেছিলেন মাঝ রাত্রে সবাই ঘুমোয়।
কিন্তু উনি যখন ভাবছিলেন, ‘আজ আবার এ বাড়িতে একটা খুনের ঘটনা ঘটবে—’ তখন নন্দিতা নামের মানুষটা জেগে উঠলো।
হয়তো কাগজ পোড়া গন্ধে।
হয়তো বা দুঃস্বপ্নে।
পার্থর ফটোটা দেয়ালমুখো করে রেখেছে বলেই কি দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে সে?
প্রথম প্রথম অনেকে ঘিরে থাকতো তাকে। এই ঘরটায় মানুষ ধরতো না। নন্দিতার মা, দিদিরা, পিসি। ঘরের বাইরে দালানে ক্যাম্পখাট পেতে কতদিন যেন দাদাও।
কিন্তু কতদিন আর মানুষ একটা এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনের জন্যে নিজেদের জীবনযাত্রাকে এলোমেলো করতে থাকবে?
দিদিরা কতদিন পারবে তাদের স্বামী পুত্র ছেড়ে সদ্য বিধবা বোনকে সান্ত্বনা জোগাতে আসতে?
পিসির নিজেরই শরীর খারাপ, বাতের শরীর, যেমন তেমন করে শুলে গায়ে ব্যথা হয়।
…নন্দিতার বাবার ব্লাডপ্রেসার বেড়েছে, নন্দিতার মা কতদিন তাঁকে একা রেখে অন্যত্র রাত কাটাবেন? তাছাড়া মিঠু! তাকে তো দেখছেন তিনি? তাকে সকালবেলা স্কুলে পাঠাতে হয়, তার আয়োজন আছে।
নন্দিতার দাদাকে অফিস যেতে হয়, খাওয়া শোওয়ার এত অনিয়ম দীর্ঘদিন বরদাস্ত হবে কেন?
নন্দিতা অতএব একলা থাকতে শিখুক!
ভগবান যখন চির—নিঃসঙ্গ করেই দিলেন।
ওরা এই রকমই ভেবেছে।
ওদের সাধারণ চিন্তাধারায়।…
তবু ওরা সারা সন্ধ্যা থাকে বৈ কি! কেউ না কেউ অন্ততঃ।… আজও যখন সেই রক্তের ছিটে লাগা দেওয়াল দেড়তলার ঘরটায় কানে হাত চাপা দিয়ে বসেছিল নন্দিতা, তখন ওর মেজদি এসেছিল।
দিদি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।
বললো, ‘অনবরত এই ঘরে একা বসে থেকে থেকে তুই কি মাথাটা খারাপ করে ফেলবি?’
মেজদি জানতো না, নন্দিতা সেই রাতের পর এঘরে আর একা বসে থাকেনি কোনো দিন। এসেছে পুলিশের লোকের সঙ্গে।
সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার সময় ঠিক কে কোনখানে বসেছিল অথবা দাঁড়িয়েছিল, আর কোনখানে দাঁড়িয়ে কোন ভঙ্গীতে রিভলভারটা চালিয়েছিল নৃশংস রাজেন সেটা পুলিশের লোককে দেখাবার জন্যে।
মেজদি তা জানতো না।
মেজদি দূরে থাকে, কম আসে।
আজ এসেছিল।
আগামী কালকের জন্যে সাহস জোগাতে, শক্তি যোগাতে। বলেছিল, ‘হেলিস দুলিস না, এক বলতে আর এক বলিস না।’
অথচ ওরাই নন্দিতার আড়ালে, নন্দিতার দুই দিদি আর মা, নন্দিতার সমালোচনা করেছে।
বলেছে, ‘মেয়েমানুষ হয়ে এত প্রতিহিংসাপরায়ণ কেন বাবা! কাঠ কবুল প্রতিজ্ঞা ওকে ফাঁসিতে ঝোলাবোই!…ছিঃ নিজের যে অবস্থা ঘটেছে, যে জ্বালায় জ্বলছিস, আর একটা মেয়েমানুষ সেই জ্বালায় জ্বলুক, এই চাইছিস তুই?…তোর নিজের ননদ! শাশুড়ীর মেয়ে! বুড়ির অবস্থা ভাবছিস না একবার? মেয়েমানুষ না তুই?’
তবে যা বলে আড়ালে।
ওকে উপদেশ দিতে আসবার সাহস কারো নেই।
দিতে এলেই ফোঁস করে উঠবে। বলবে ‘পরের কথা কেউ বোঝে না! চির সুখীজন ভ্রমে কি কখন ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে?’
তাই ওর মেজদি ওর হাত ধরে টেনে আনতে আনতে দরদী গলায় বলে—’এ ঘরে একা বসে থেকে থেকে কি পাগল হয়ে যাবি?’
মেজদি অনেক সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাবার পর দাদা এসেছিল উকিল নিয়ে। শেষ পালিশ দিয়ে গিয়েছিল।
আর তারপর—
ওরা চলে যাবার পর মুকুল। অনেকদিন পর।
নন্দিতা বলেছিল, ‘আবার তুমি এলে যে? বারণ করেছিলাম না?’
মুকুল বললো ‘অনেকদিন তো মানলাম বারণ!’
‘তা হোক আরো কিছুদিন মানো। চারিদিকে শত্রু, হঠাৎ কে কোন দিক থেকে নিহতের স্ত্রীর চরিত্রের বদনাম দিয়ে কেস ঘুরিয়ে দিয়ে বসতে পারে। ওরা তো বলেছেই সুইসাইড। এমন কি ওরা নাকি একটা মনস্তত্ত্ববিদকে ধরে এনে সাক্ষী দিইয়েছে।
তিনি নাকি বলেছেন, ‘এরকম হয়। কোন পূর্ব সংকল্প না থাকলেও হঠাৎ একটা ধারালো ছুরি কি একটা বন্দুক দেখলে মানুষের অকস্মাৎ খুন চাপতে পারে, আত্মহত্যার বাসনা জেগে উঠতে পারে।’
…নন্দিতা অন্যদিকে মুখ করে বলে, ‘আমার চরিত্রে দোষ দিতে পারলে, সে বাসনায় একটা অবচেতন কারণও আবিষ্কার করতে পারে তাদের সাইকোলোজিষ্ট।’
মুকুল কিন্তু এমন একটা অভাবিত কথা শুনেও তার সম্পর্কে কোনো ব্যঙ্গ মন্তব্য না করে বলেছিল একটা সম্পূর্ণ অন্য কথা। যে কথা নন্দিতার অনুকূলও নয়।
খপ করে বলে উঠেছিল, ‘আচ্ছা নন্দিতা, তোমার কি মনে হয় না লোকটার ফাঁসির হুকুমের বদলে যাবজ্জীবন জেল বা দ্বীপান্তর—টিপান্তর গোছের কিছু হলে ভাল হয়?’
নন্দিতা ওর কথার ঠিক মানেটা চট করে ধরতে পারেনি। নন্দিতা ওর দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।
দেখে নিয়ে বলেছিল, ‘হঠাৎ এ রকম মনে হল কেন তোমার?’
‘না অন্য কিছু নয়!’ মুকুল কেমন যেন উদাস ভাবে বলেছিল, ‘ভাবছি—একটা খুন, আর একটা ফাঁসির উপর ভিত গেড়ে আমাদের নতুন জীবন সুরু হবে?’
নন্দিতা কেঁপে উঠেছিল।
নন্দিতার মনে হয়েছিল ওর সেই নতুন জীবনের ভিতটাও বোধহয় কেঁপে গেছে। হয়তো কোথাও ফাটল ধরেছে, আস্তে আস্তে সেখান থেকে চোরা জল উঠবে। বাড়ি বানানো হবে না।
তাই নন্দিতার সামলে নিতে সময় লেগেছিল।
তারপর নন্দিতা ভারী মুখে বলেছিল, ‘তা’ আমাদের পছন্দ অনুযায়ী তো আর ‘হুকুম’ বেরোবে না?’
মুকুল অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, ‘না তা নয়।’ তবে মনে হচ্ছিল।
মুকুলের মনে হচ্ছিল।
কিন্তু নন্দিতার কি সত্যিই ‘মন’ বলে একটা বস্তু নেই? নন্দিতা কি ভারতীর ভাবী চেহারাটা কল্পনা করে শিউরে উঠছে না?
কিন্তু নন্দিতার উপায় নেই সেই মনকে প্রশ্রয় দেবার। কারণ নন্দিতা নরকের পথে অনেকদূর এগিয়েছে, এখন আর সে পথ থেকে ফেরা যাবে না।
তাই নন্দিতার সেই মন স্বপ্নের মধ্যে নন্দিতার উপর প্রতিশোধ নেয়। নন্দিতা জেগে ওঠে, ঘেমে যায়, বাকি রাতটা বসে থেকে সকালের প্রতীক্ষা করে।
আজও নন্দিতা জেগে উঠেছিল।
নন্দিতা জেগে উঠে কাগজ পোড়া গন্ধ পেয়েছিল।
নন্দিতার ভয় হয়েছিল। উঠে যেতে সাহস হয়নি।
ওর মনে হয়েছিল ঘর থেকে বেরোলেই বুঝি দেখতে পাবে একটা দীর্ঘছায়া প্রেত, রাত্রির অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে সব কিছুতে আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছে!
সে আগুন চিঠি কাগজ ছবি থেকে ছড়াতে ছড়াতে নন্দিতার নতুন জীবনকে গ্রাস করবে।
নন্দিতার হাত—পা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল।
তারপর আস্তে আস্তে সাহস সঞ্চয় করেছিল নন্দিতা, ছোট চাকরটা রান্না ঘরের উনুনটা নিভোতে ভুলে যায়নি তো? সেখানে কোনো কিছু ছিল না তো?
নন্দিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
দালানের সুইচে হাত দেবার আগেই অজিতার ঘরের দরজার ফাটল থেকে একটা আগুনের আভা দেখতে পেলো।
নন্দিতা স্তব্ধ হয়ে ভাবলো এক মিনিট।
ঘটনাটা কী ঘটছে!
কিন্তু না, কাপড় পোড়া গন্ধ নয়, চুল পোড়া, চামড়া পোড়া কিচ্ছু নয়, স্রেফ কাগজ পোড়া।
তার মানে কোনো গোপন কাগজ—পত্র।
কী হতে পারে সেটা? যেটা টিকে থাকলে নন্দিতার অনুকূল, ভস্ম হলে অজিতার অনুকূল?
সবসময় এখন নন্দিতা অজিতাকে প্রতিপক্ষের দৃষ্টিতেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
নন্দিতা ভাবলো, এই গোপন কাজের সাক্ষী থাকা আবশ্যক। কখন কোনটা দরকার হয় বলা যায় না।
এখন নন্দিতার দু’চোখ খোলা, তাই সেই দুঃস্বপ্নের ছায়াগুলো সরে সরে যাচ্ছে।
নন্দিতা ভেজানো দরজাটা ঠেলে ঋজু হয়ে দাঁড়ালো।
বললো, ‘মাঝ রাত্রে এসব কী হচ্ছে?’
অজিতা দেবী চমকে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘সে কৈফিয়ৎ কি তোমাকে দিতেই হবে?’
নন্দিতা ক্রুদ্ধ গলায় বললো, ‘কৈফিয়ৎ দেওয়া না দেওয়া আপনার ইচ্ছে। তবে মনে রাখবেন, যেটা আপনি লুকিয়ে করছিলেন, তার একজন সাক্ষী রইল।
অজিতা নির্লিপ্ত গলায় বললেন, ‘কোনো কাজই লুকোনো থাকে না। কোথাও কোথাও তার সাক্ষী থাকে।’
‘ওঃ ভগবানের কথা বলছেন?’ নন্দিতা বুঝি পায়ের তলার মাটি খুঁজতে তাড়াতাড়ি ভগবানের নাম টেনে আনে, ‘এখনো আপনি আপনার ভগবানকে ভক্তি করেন?’
অজিতা দেবী একথার উত্তর দিলেন না।
অজিতা দেবী কি নন্দিতাকে হঠাৎ জেগে উঠতে দেখে ভয় পেলেন? ভাবলেন, যেটা নিঃশব্দে আর সহজে হতে পারবে ভেবেছিলাম, সেটা বুঝি আর হল না?
কি জানি!
অজিতা দেবী শুধু সেই ঘুমন্ত আগুনটায় একটা জ্বালানি ঠেলে দিলেন। একখানা আবাঁধা ফটো। অজিতা দেবীর নিজের বিয়ের আগের ফটো, যেটা দেখিয়ে বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছিল ওঁর! ঝাপসা হয়ে গেছে, ঘোলাটে হয়ে গেছে। তবু যত্ন করে তোলা ছিল কুমারীবেলার সেই ফটো।
সেই ছবিখানাকে পুড়িয়ে ফেলছেন কেন অজিতা দেবী?
সমস্ত ভালবাসার আর সমস্ত সেণ্টিমেণ্টের জিনিসগুলি কি তা’হলে নিজের হাতে পোড়াতে সাধ তাঁর? তাঁর ভগবানের ওপর আক্রোশে?
নাও নাও, সব নাও।
নিজের হাতে যে আগুন জ্বেলেছো, তাতে আহুতি নাও।
আর ভাবতে দাও আমায়, আমার এই অতি সাধারণ জীবনের ছক—এর ওপর তোমার ওই অদ্ভুত সর্বনাশা খেলার ঘুঁটিগুলো সাজাতে বসলে কেন?
নন্দিতা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিক তাকিয়ে দেখলো। মতলবটা কি মানুষটার? নন্দিতাকে কি খুন করে ফেলবে? আগে থেকে তাই তার প্রমাণ পত্র—টত্র সরিয়ে ফেলছে? কিন্তু এঘরের সঙ্গে কবে কোনদিন যোগ ছিল নন্দিতার? তবে কি বিষ—টিষ?
ওই আগুনের ধারে বসে থাকা মানুষটার চোখের মধ্যে যেন কী এক সংকল্পের আগুন। নন্দিতা তো ওর হাতে খায় না, বিষ—টিষ কোনো কাজে লাগবে না!
তবে? আগুনে পুড়িয়ে মারবেন নাকি নন্দিতাকে?
নন্দিতার সর্বাঙ্গ শিথিল হয়ে আসে! নন্দিতা কি চেঁচিয়ে উঠবে? চেঁচিয়ে পাড়ার লোক জড়ো করবে?…তারপর বলবে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে—
কিন্তু মাঝরাতে চীৎকার শুনে আর কি কেউ ছুটে আসবে? অনেক শিক্ষা হয়েছে তাদের। অনেক হয়রানি হয়েছে পুলিশের হাতে।
আর তখনই—গলার জোর ফিরে পায় নন্দিতা।
বলে, ‘তখন তো খুব শাসিয়ে গেলেন। কোন সত্যি কথাটা বলবেন শুনি?’
অজিতা দেবী ওর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকালেন। বললেন, তুমি একটা ভদ্র ঘরের মেয়ে ছিলে নন্দিতা, একটা ভদ্র ঘরের বৌ হয়েছিলে। কুগ্রহের ফেরে—’ একটু থামলেন অজিতা দেবী, তারপর বললেন, কিন্তু এমন করে নিজেকে ধ্বংস কোরো না তুমি।’
নন্দিতার ভিতরটা যখনই কেঁপে ওঠে, নন্দিতা তখনই বাইরের খোলসটাকে শক্ত করে নেয়।
তাই নন্দিতা বিদ্রূপের গলায় বলে, ‘ওঃ! আবার উপদেশ! কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, এখন এতদিন পরে আপনার কোনো নতুন সত্যি কথা কাজে লাগবে না। লোকে অবিশ্বাসের হাসি হেসে উঠবে। লোকে আপনাকে পাগল বলবে। নয়তো বলবে—স্বার্থের জন্যে কতদূর নামতে পারে মানুষ। বুঝলেন? আপনার সত্যি কথা কোনো কাজে লাগবে না। নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছি বললেও না।’
অজিতা দেবী খুব শান্তভাবে একটু হাসলেন। বললেন, ‘জানি।’
‘জানলেই ভালো। আর শুনুন, আপনাকে আগেই জানিয়ে রাখছি, মিঠু আর এ বাড়িতে আসবে না। আমি আর এ বাড়িতে থাকবো না।’
‘তাও জানি।’
সেই হাসিটাই আবার দেখা গেল অজিতার মুখে।
‘ওঃ সবই জানেন! তা ভালো। শুধু আমি জানতে পারলাম না মাঝরাতে উঠে অগ্নিকাণ্ড করছেন কেন?’
অজিতা বললেন, ‘পাগলের খেয়াল আর কি! না করলেও ক্ষতি ছিল না।’
‘আচ্ছা জানা যাবেই—’
নন্দিতা ঠিকরে চলে যায়।
কারণ নন্দিতা কিছুতেই নিজেকে তার নিজের হাতে বাঁধা চড়া তার থেকে নামাতে চায় না।
নন্দিতার ভয় হচ্ছে, নন্দিতার আর নিজের ওপর বিশ্বাস থাকছে না। ওর মনে হচ্ছে ও হয়তো শেষ রক্ষা করতে পারবে না।
ওর কাছে যে সত্যকথা লুকোনো আছে, যেটা লুকিয়ে রাখবার জন্যে সহস্র জাল ফেলে চলেছে সে এতদিন ধরে, সেটা বুঝি আর লুকিয়ে রাখতে পারবে না। বুঝি হঠাৎ ফেটে বেরিয়ে পড়বে।
তাই নিজেকে অবিরত শক্তির মন্ত্র জপাচ্ছে।
তাই সে ‘আচ্ছা জানা যাবে’ বলে ঠিকরে চলে যায়।
তারপর জানা যায় সেই খবর। পরদিন সকালে।
কেন অজিতা দেবী নিশাচরের মত মাঝরাত্রে উঠে অগ্নিযজ্ঞ করছিলেন, কেন তাঁর ক্ষুদ্রতম ভালবাসার জিনিসগুলি সেই আগুনে আহুতি দিয়েছিলেন।
মাঝরাত্রে একটা হত্যাকাণ্ডের আয়োজন করতে এই অগ্নিযজ্ঞ অজিতা দেবীর। এটা বোধহয় বোধন।
নন্দিতা উঠেছিল, জেগেছিল, তবু নন্দিতা মুহূর্তের জন্যেও এ সন্দেহ করেনি।
নন্দিতা তখন নিশ্চিন্ত হয়ে শুতে গিয়েছিল। চিরদিনের একটা ‘ধর্মপুণ্যি’ মানুষ যে এমন একটা কাজের জন্য মতলব ভাঁজছিলেন, তা তার ধারণার মধ্যে আসবে কি করে?
নিঃশঙ্ক মানুষটা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল, তারপর অনেক দুঃস্বপ্নের ছায়া পার হয়ে শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
কেমন করে জানবে সে, সেই ঘুমের অবকাশে আর একটা মৃত্যু নামছে এ বাড়িতে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে।
সকাল বেলা একা নন্দিতাই নয়, সকলেই জানলো।
আর, আরও একবার এই নিতান্ত সাধারণ বাড়িটা অসাধারণ হয়ে উঠলো। লোকে বাড়ি ভরে গেল। আর ধর্মাধিকরণের পাইকরাও এল। এজাহার নিলো যাদের যাদের নেওয়া সম্ভব।
ঝি, চাকর, গোয়ালা। যারা প্রথম সকালের সাক্ষী।
তারপর নন্দিতার।
নন্দিতা সেই একই কথা বলে চললো, আমি কি করে জানবো? উনি অত ধর্মবিশ্বাসী পাপপুণ্য বিলাসী মানুষ, উনি এমন কাজ করবেন—’
প্রথমটা কে দেখলো?
ওঃ সে ওই বাচ্চা চাকরটা।
সে বলেছিল, ‘ঠাকুমা এখনো উঠলো না কেন মা?’
নন্দিতা বলেছিল, ‘আমি কি জানি?’
নন্দিতা ভেবেছিল, অনেক রাত পর্যন্ত কি সব করে এখন ঘুমোচ্ছেন আর কি!
তারপর সন্দেহজনক বেলা হলো। ছেলেটা বহুবার দুম দুম করে জোরে দরজা ঠেলে বিফল হয়ে, বারান্দা ঘুরে কার্নিশে নেমে দেখতে গিয়ে পরিত্রাহি চেঁচাতে চেঁচাতে এসে আছড়ে পড়লো। তারপর তো পুলিশ।
পাড়ার লোক বলাবলি করতে লাগলো, ‘বাড়িটা কার পাপে কোন কুগ্রহের অভিশাপে পড়ে গেছে! আশ্চর্য! অথচ এই সেদিনও কী সুন্দর সুখের সংসারই ছিল!
এই ভাবেই তো মানুষের সুখের হিসেব।
বইয়ের মলাট দেখে সমালোচনা।
তবু একথা মানতেই হবে বৈকি, কোনো কোনো অভিশপ্ত মুহূর্ত হঠাৎ যদি সে মলাট ছিঁড়ে না ফেলে, হয়তো চিরদিনই সেই সমালোচনা থেকে যায়।
ঝড় বড় ভয়ঙ্কর জিনিস, বড় ভয়ঙ্কর রাত্রির আকাশ!—
নন্দিতার পিসি বললেন, ‘আশ্চয্যি দেখালো বুড়ি। তখন করলি না টাটকা টাটকি, এখন এতদিন পরে—
নন্দিতার মা মেয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টি হেনে বললেন, ‘তিলে তিলেই অভাব ধরা পড়ে। একদিনে শূন্যতা বোঝা যায় না।’
নন্দিতার দাদা বললে, কেসটা সম্পূর্ণ গুছিয়ে আনা হয়েছিল, একেবারে খারাপ হয়ে গেল।’
নন্দিতার দিদিরাও এক একবার এলো, কিন্তু নন্দিতা যেন সকলের সহানুভূতি হারাচ্ছে। যেন সকলে ভাবতে সুরু করেছে, এটা তোমার করলেই বেশী মানাতো।
বলছে না, কিন্তু ওদের অব্যক্ত ভঙ্গীটাই বলে ফেলছে।
হয়তো এই নিয়ম পৃথিবীর। সমস্ত সহানুভূতি গিয়ে জমে মৃতের উপর। যেন সে একটা উচ্চাসন পেয়ে গেছে, যেন সংসারের সকলের কাছে জিতে গেছে।
জীবিতরা পরাজিতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই বিজয়ীর দিকে।
জনে জনে সবাই এলো, এলো না কেবল নন্দিতার বাল্যবন্ধু।
নন্দিতা জানে ও আর আসবে না।
এতগুলো ভয়ঙ্করের ওপর ভিত গড়ে নতুন জীবন গড়বার সাধ ওর নেই।
কিন্তু নন্দিতারই কি আর?
যারা নিয়তির শিকার হয়েছিল, তারা মরলো। নন্দিতা তার জন্য দায়ী নয়, তবু নন্দিতা হঠাৎ তাকিয়ে দেখছে তার সামনের সেই লক্ষ্যটা, তীব্র চেষ্টায় সার্চ লাইট জ্বেলে চারিদিকে অগ্রসর হচ্ছিল নন্দিতা, সেই লক্ষ্যটা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে।
নন্দিতা ভাবতে চেষ্টা করছে, তার মনের ওপরকার খোলসটাকে শক্ত করে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে, ‘এতো ভালই হলো।—কোথাও আর কোনো দুশ্চিন্তা রইল না। একজোড়া চোখ অহরহ আমার জীবনের উপর তীক্ষ্নদৃষ্টি হেনে নিঃশব্দে আর চেয়ে থাকবে না।
কিন্তু ভাবতে পারছে না।
অনবরতই মনে হচ্ছে বরাবরের মত এই শেষবারেও অজিতা দেবীই জিতে গেলেন। সংসারের গণ্ডী ছাড়িয়ে তিনতলার উঁচুতে ঠাকুর ঘরে উঠে গিয়ে যেমন চিরদিন জিতে এসেছেন আজও তেমনি।
অজিতা দেবীর উপর ভয়ানক একটা হিংসে হতে থাকে নন্দিতার। যেন যে টিকিটটার জোরে নন্দিতাই অনেক উঁচুতে উঠে যেতে পারতো নন্দিতার অন্যমনস্কতায় সেই টিকিটটা অজিতা দেবীই হস্তগত করে ফেলে উঁচুতে উঠে গেলেন।
—