১০
এই সস্তা রসিকতাটুকু করেই সে বোধহয় আর একটা খেলার জন্যে তাস গোছাতো, কিন্তু তুমি? নন্দিতা তুমি কি করলে? বেহায়াপনার একটা সুযোগ পেয়ে ‘দেখি তো কেমন যায় না? রক্ত মাংসের বিবিকে না যাক, তাসের বিবিদের নিশ্চয়ই যায়—’ বলে হাসিতে ভ্রুকুটিতে বিশেষ একটি ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে ওর ট্রাউজার্সের পকেট হাতড়াতে গেলে! তোমার শালীনতা সভ্যতায় বাধলো না।… বাধলো না, কারণ তোমার নিয়তি তখন তোমাকে নিয়ে তাসের বিবির মত ম্যাজিক করছে।…
তাই তুমি চমকে শিউরে সেই ভারী—ভারী ঠাণ্ডা—ঠাণ্ডা অস্ত্রটা ওর পকেট থেকে বার করে ফেলে বললে, ‘এর মানে?’
তোমার ওটা হাতে করার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দুটো লোকই ‘হাঁ হাঁ করে উঠেছিল, একথা নিশ্চয়ই মনে আছে নন্দিতা?
রাজেন বলে উঠেছিল, ‘আরে আরে রাখুন রাখুন—’
আর পার্থ বলে উঠেছিল, ‘এই নামাও নামাও, টেবিলে নামিয়ে রাখো।’
যেন তুমি হাতে করে একটা জ্বলন্ত আগুনের টুকরো ধরেছ, যেন তোমার হাতটা পুড়ে যাবার ভয়ে ওরা—
কিন্তু তুমি ওদের কথা শুনলে না।
তুমি জিনিসটাকে বেশ বাগিয়ে ধরে হাতেই রেখে বললে, ‘রাখবার আগে এর মানেটা জানতে চাই।’
রাজেন কিছু বলার আগে পার্থ বলেছিল, ‘মানে আর কি, রাজা রাজড়াই চাল! কেন, তুমি জানো না ওর ওই রাজাই শখটি? কথায় কথায় কোষ থেকে তলওয়ার বার করার রক্ত আর কি। …কিন্তু তুমি ওটা টেবিলে রাখো নন্দিতা, খুব সম্ভব ‘লোড’ করাই আছে।’
এই—এই পর্যন্ত কী মধুর সুন্দর আর কৌতুকময় পারিবারিক আবহাওয়া বইছিল সেখানে, ভেবে দেখো নন্দিতা। … তুমি যদি তখন ওদের কথা শুনতে, যদি ওটা নামিয়ে রাখতে, আবার জিনিসটা রাজেন নামের লোকটার ট্রাউজার্সের পকেটে ঢুকে যেতো।
ব্যস, সব ঠিকঠাক থাকতো।
কিন্তু নন্দিতা, আমরা দেওয়ালেরা তাকিয়ে দেখছিলাম একটা কিছু বেঠিক করে বসবার জন্যেই যেন তোমার রক্তে মাতলামির বান ডেকেছিল। তাই যখন রাজেন বললো, ‘লোড করা নয়তো কি আর ফাঁকা? সঙ্গে রাখবো না? দেখুন না কেন, আমার এই হীরের আংটি, হীরের বোতাম, আর ঘড়িটা মিলিয়ে চার পাঁচ হাজারের কম নয়, আর আপনার বোনের গায়ে তো কথাই নেই। জানি না হাজার দশেক কিনা। হঠাৎ যদি রাত—বিরেতে গুণ্ডাতে গাড়ি ঘেরাও করে?’
‘করলে তুমি তাদের গুলি করবে?’
নন্দিতা ঠিকরে উঠেছিল।
রাজেন অহঙ্কারের তেলালো মুখ নিয়ে বলেছিল, ‘করবো না? গুলি করতে করতে যাব।’
‘বাঃ বাঃ। ঠিক ডিটেকটিভ গল্পের হিরোর মত।’ নন্দিতা, তুমি বলে উঠেছিলে, ‘তুমি তো সাংঘাতিক লোক দেখছি। মানুষ খুন করতে পারো। থাক এটা তাহলে আমার কাছে। কি জানি, মাঝরাত্রে শ্বশুরবাড়ির বিছানায় ছারপোকার কামড় খেয়ে মাথায় খুন চেপে যাবে কিনা তোমার।’
নন্দিতা, এ পর্যন্তও বেশ ছিল, এখন যদিও একটু বাধ্য হতে, হয়তো তুমি চিরটা দিন একটি সৎ মিষ্টি লক্ষ্মী বৌ হয়ে কাটিয়ে দিতে পারতে। কিন্তু তখনও তুমি অবাধ্যতা করলে, রাখলে না। তার কারণ ওই নিষিদ্ধ বস্তুটার স্পর্শস্বাদ তোমায় রোমাঞ্চিত করছিল, তোমায় মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিল। তাই তুমি বললে, ‘থাক আমার কাছে, কাল সকালে যাবার সময় ফেরত দেব।’
রাজেন তখন হঠাৎ আরক্ত হয়ে উঠলো। সেকথাটা বোধহয় ভুলে যাওনি নন্দিতা? রাগ রাগ লাল লাল মুখে সে বললো, ‘আপনি কি আমায় সন্দেহ করছেন?’
পার্থ বললো, ‘কী ছেলেমানুষী সুরু করলে তোমরা দু’জনে? জিনিসটা কাড়াকাড়ি করবার জিনিস নয়, তাই তোমায় অনুরোধ করছি নন্দিতা ওটা হাত থেকে নামিয়ে রাখো।’
তখন? তখন তুমি কী বললে মনে আছে?
তুমিও রাগ রাগ মুখ করে বললে, ‘আমিও তবে ঠাকুর জামাইয়ের কথাটাই বলি—তুমি কি আমায় সন্দেহ করছো?’
‘চমৎকার। ভালো এক জিনিস বার করলে রাজেনের পকেট হাতড়ে—’পার্থ বলে, ‘রাজেন দেখছো—?’
রাজেন গম্ভীর ভাবে বললো, ‘দেখছি।’
তার মানে রাজেনের তখন সন্দেহ হচ্ছে নন্দিতা ওকে সন্দেহ করেছে। নীরেটদের যা হয় আর কি!
তখন বোধকরি আবহাওয়া হালকা করতেই পার্থ হেসে বললো, ‘তোমার বৌদিকে ‘এন. সি. সি.’তে ভর্তি করে দেওয়া হোক এবার, কি বল, রাজেন? বেশ বীরাঙ্গনা বীরাঙ্গনা দেখাচ্ছে, তাই না?’
রাজেন বললো, ‘হুঁ।’
তারপর হঠাৎ বোধকরি পার্থরই ঘাড়ে তার নিয়তির ভূত চাপলো। সে হঠাৎ বলে উঠলো, ‘আচ্ছা রাজেন’ তুমি ‘সরযূ’ বলে কোনো মেয়েকে চেনো? রাজেন চমকে উঠলো, রাজেনের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
রাজেন আগে থেকেই একটু গুম হয়ে গিয়েছিল, তাই সেই ভাবেই বললো, ‘আপনার একথার মানে?’
তোমার স্বামীর মুখে হঠাৎ একটা অজানা মেয়ের নাম শুনে তুমিও চমকে উঠলে নন্দিতা, সেটা হয়তো তুমি টের পাওনি। কিন্তু গিয়েছিলে! উৎকর্ণ হয়ে উঠেছিলে পরবর্তী কথাটা শোনবার জন্যে।
পার্থ বলেছিল, ‘কী আশ্চর্য, তুমি এতে রেগে যাচ্ছো কেন? আমার একজন ডাক্তার বন্ধু বলছিল—’
‘কী বলছিল আপনার বন্ধু? আমি সরযূ টরযূ—কাউকে চিনি না।’
রাজেন চেঁচিয়ে উঠলো।
পার্থ অবাক হলো, বললো, ‘এত উত্তেজিত হবার কী আছে?’
এটা কিন্তু পার্থর একটা ছলনা হয়েছিল। প্রশ্নটায় যে উত্তেজনাকর কিছু ছিল, তা’ সে একেবারে বুঝতে পারেনি তা নয়। পার্থ বিশ্বস্ত ছিল, তাই নিশ্চিন্ত ছিল। অতএব পার্থ একটু সরলতার ভান করে বলেছিল, ‘উত্তেজিত হবার কী আছে? বন্ধু বলছিল, সে নাকি একটা সরযূ নামের রোগিণীকে দেখতে গিয়ে তার ঘরে তোমার ছবি দেখেছিল। আর পাড়াটা নাকি ভালো নয়। আমি তো বিশ্বাস করিনি, কি দেখতে কি দেখেছে কে জানে।… ও অবশ্য খুব জোর দিয়ে বলছিল, ‘তোমার ভগ্নিপতিকে আমি চিনি। কতবার দেখেছি।’
পার্থ হয়তো ভেবেছিল, এই ভাবেই তার ছোট বোনের বরকে একটু সাবধান করে দেবে। তাই পার্থ কৈফিয়ৎ তলবের ভঙ্গীতে না বলে, এই রকম অলসভাবে বলেছিল।
রাজেন কিন্তু আরো উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। কারণ রাজেনের মনে পাপ ছিল। তাই সে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, ‘বাঃ বাঃ চমৎকার দাদা। বেশ বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছেন তো? তা’ বন্ধুটি নিশ্চয় ওসব পাড়ায় একা যান না, আপনাকেও সঙ্গী করেন? প্রাণের বন্ধু যখন।’
বড়লোকের দুর্বিনীত ছেলে, এই রকমই কথাবার্তা ওর। নিজের সহোদর ভাইকেই ও রাতদিন বলে—’শালা হারামজাদা।’
কিন্তু পার্থরা এতে অভ্যস্ত নয়।
আর পার্থ হঠাৎ এ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিল না। তাই পার্থ যেন চাবুক খাওয়ার মত ঠিকরে উঠেছিল চেয়ার থেকে। তার আর একটু পরেই সেই চেয়ারটার উপর ঢলে পড়েছিল সে।
কিন্তু তখন দাঁড়িয়ে উঠেছিল।
আর বলে উঠেছিল, ‘শাট আপ।’
কিন্তু তুমি নন্দিতা, তুমি তো এই আবহাওয়াটা ভাল করে তুলতে পারতে? তুমিও তো বুদ্ধিমতীর মত বলতে পারতে ‘দুজনে মিলে কী ছেলেমানুষী সুরু করলে তোমরা।’
তা’ নয়, তুমি ধিক্কারের গলায় বলে উঠলে,—’বাঃ ঠাকুর জামাই। ডুবে ডুবে জল খাওয়া হয়?’ এখন ধরা পড়ে চোখ রাঙানো। বলে দেব ভারতীকে। ছিঃ ছি। তুমি না একজন বিবাহিত লোক! তোমাতে সমর্পিত প্রাণ সেই স্ত্রীকে লুকিয়ে তুমি অন্য মেয়েকে ছবি উপহার দিতে চাও। তাও খারাপ পাড়ার মেয়ে। ছিঃ।’
হাতের সেই অস্ত্রটা, যেটাকে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে লোফালুফি করছিলে তুমি, সেটার জোরেই কি তোমার এত সাহস বেড়ে উঠেছিল নন্দিতা? তাই রাজেনের মত একটা গোঁয়ার লোককে অমন কথা বলতে সাহস করেছিলে।
রাজেন তোমাকেও কিছু বলতে যাচ্ছিল।
হয়তো খুব অপমানজনক কিছু!
তাই হয়তো তোমার স্বামী তোমার সম্মান বাঁচাতে গেল। তাই হঠাৎ প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে নিয়ে তোমার দিকে ফিরে বসলো।…পার্থর মুখটা তখন কেমন একরকম ব্যঙ্গে যেন বেঁকে গেল। আর সেই বাঁকা মুখে বাঁকা মত হাসি হেসে বলে উঠলো সে, ‘বিবাহিত লোকের একরকম অধঃপতন দেখে তুমিও অবাক হচ্ছো নাকি নন্দিতা কিন্তু তোমার তো অবাক হবার কথা নয়?’
পার্থর মুখে এমন হাসি কি তুমি এর আগে কখনো দেখেছিলে নন্দিতা? দেখনি। তার মানে সে রাত্রে তোমার বাচালতা আর অবাধ্যতা পার্থকে ধৈর্যচ্যুত করে তুলেছিল। তাই পার্থ ওই পোজটা নিয়েছিল।
তুমি তখন ওই রাজেনটার মতই ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বললে ‘তার মানে?’
‘মানে অতি প্রাঞ্জল—’ পার্থ অবহেলার গলায় বললো, ‘তুমিও অবশ্যই একটি বিবাহিত ‘ব্যক্তি’। অথচ তুমিও আর একটি ব্যক্তিকে শুধু ছবিই নয়, রাশি রাশি চিঠিও উপহার দিয়ে থাকো। … ও কি ওটাকে নিয়ে অত নাড়াচাড়া করছো কেন? দাও তো আমায়—দাও দাও আ—আঃ।’
কি হলো নন্দিতা, দু’হাতে কান ঢাকছো কেন? সেই ভয়ঙ্কর শব্দটা শুনতে পেলে বুঝি? কিন্তু কান চোখ দুটো জিনিস ঢাকবে কি করে? ওঃ চোখ বুজছো? কিন্তু চোখ বুজেও কি তুমি সেই ছায়াটা এড়াতে পারবে? সেটা তোমার মাথার মধ্যে, তোমার চেতনার মধ্যে এঁটে বসে নেই? পার্থ নামের সেই নিয়তির শিকারটার চেয়ারে এলিয়ে পড়ার দৃশ্যটা?
জিনিসটা কি ও কেড়ে নিয়েছিল?
না চেয়েছিল বলে তুমিই উপহার দিয়ে বসেছিলে?…
কি? তুমি নিজেই জানো না সেটা?
কিন্তু আমাদের কেন মনে হয় বলো তো, তুমি বুঝি জানো।… কি জানি, আমাদের তো চোখ নেই, শুধু অনুভব আছে। সেই অনুভবের বশেই আমরা বিস্ময়ে আর কুল পাইনি যখন নিজে তুমি ‘খুন খুন, খুন করলো! শেষ করে ফেললো—’ বলে দাপাদাপি করে বেরিয়েছিলে ঘরে থেকে দালানে।…
মনে পড়ছে না তোমার নন্দিতা সেটা?
তোমার শাশুড়ী শ্রীমতী অজিতা দেবী যে তখন সিঁড়ির ওই মাঝখানের জানলা থেকে নেমে ছুটে এসে বৌমা বলে চীৎকার করে উঠে লুটিয়ে পড়েছিলেন সেটা মনে নেই? তবু তুমি আজ তাঁকে শাসাচ্ছিলে! কারণ তুমি বিশ্বাস করো একটা ‘হ্যাঁ’ কে লক্ষবার ‘না’ বললে, সেটা না হয়ে যায়।
কান থেকে হাত খোলো নন্দিতা। নইলে তুমি সেই রাজেনের চীৎকারটাও যে শুনতে পাবে না। একটা বিস্ময়ের চাবুক খাওয়া আর্তস্বর!…
তারপর অনেক চীৎকার, অনেক স্বর হয়তো গুলিয়ে ফেলতে পারো তুমি। কিন্তু তার আগে যখন ঘরে তোমরা তিনজন মাত্র ছিলে, তখনকার ঘটনা তো গুলিয়ে ফেলবার কথা নয়?
যদিও রাজেন হতভাগা গুলিয়ে ফেলছে। সে ভাবছে—সেই ‘শাট আপ’—এর পরই তাহলে ঘটনাটা ঘটে গেছে। তাই সে কপালে করাঘাত করে ফাঁসির দিন গুনছে।
তবু হচ্ছিল তো যাহোক!
জগতের লক্ষ লক্ষ আত্মহতার ঘটনার সঙ্গে পার্থর ঘটনাটাও না হয় যোগ হতো। তুমি আরো নিশ্চিন্ত হতে চাইলে কেন? …তোমার বুঝি ভয় হলো, রাজেনের মাথাটা চিরদিন ঘুলিয়ে থাকবে না। তোমার খেয়াল হলো, রাজেন দেওয়াল নয়, তাই না? তাই তুমি দ্রৌপদীর মত সেদিন থেকে আর চুল বাঁধলে না, ওই রুক্ষ চুলগুলিকে সাপের ফণার মত করে তুলে, আর দু’চোখে আগুনের ঢেলা জ্বেলে ‘পাপীর উচিত শাস্তির’ জন্যে যুদ্ধে নামলে। ভাবলে সেটা ঘটিয়ে তুলতে পারলেই তোমার শান্তি।
কিন্তু আজ টের পেলে তো, দেওয়ালও কখনো কখনো কথা বলে।
আর সেদিনও বুঝেছিলে, কোনো গোপনতাই গোপন থাকে না। একটুকরো চিঠিও একটা মশাল হয়ে উঠে ঘর পোড়াতে পারে। অথচ তার আগে পর্যন্ত তুমি ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলে গোপন জিনিস গোপনই থাকে।
নন্দিতা আমরা তুচ্ছ দেওয়াল, তবু জানি, তারপর তুমি একদিন তোমার স্বামীর ছবিটার কাছে গিয়ে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলে, ‘তা’ হলে তুমিই বা কেমন মহাপুরুষ? জেনে শুনে অসতী স্ত্রীর সঙ্গে ঘর করছিলে? পাকা অভিনেতার মত সুখী সন্তুষ্ট স্বামীর ভূমিকা প্লে করছিলে। আমিও তা’হলে তাই করেছি। অভিনয় করেছি। বেশ করেছি।’
তারপর ছবিখানা তুমি দেওয়ালের দিকে মুখ করে ঘুরিয়ে দিয়েছিলে। তোমার বোন এসেছিল, ভেবেছিল ঝড়ে উল্টে গেছে, ‘আহ’ বলে উল্টে দিচ্ছিল, তুমি বললে, ‘থাক, দেখতে পারি না, কষ্ট হয়।’
আমি জানি কষ্ট নয়, ভয় হয়।
অথচ নামিয়ে দিতেও সাহস হয় না। সর্বদা এই আতঙ্কের মধ্যে থাকতে থাকতেই তুমি ‘পালাই পালাই’ করছো, তুমি তোমার বাল্যবন্ধুর দিকে হাত বাড়াচ্ছো।
আর তোমার যে এত বুকের পাটা, সে ওই ভয় থেকেই। …ভয়ই সাহসের জন্মদাতা এই হচ্ছে সার কথা।
বুঝতে পারছি নন্দিতা, তুমিও নিয়তির শিকার, তুমিও ভাগ্যের হাতের পুতুল। সে রাত্রে যদি ওই ঘটনাগুলো না ঘটতো, এসব কিছুই হতো না। নিশ্চয়ই তোমার এই ঘরে তুমি আগ্নেয়স্ত্র খুঁজে বেড়াতে না, তুমি চায়ের পেয়ালায় বিষ মেশাবার কথাও চিন্তা করতে বসতে না। তুমি হয়তো শুধু দিন দিন আরও অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে, দিন দিন আরো মেজাজি।
এর বেশী কিছু নয়।
ছবি, চিঠি, সবই ক্রমশঃ ছেলেমানুষী হয়ে আসতো তোমার কাছে, কাজেই সাধ্বী স্ত্রীর তালিকা থেকে তোমার নাম খারিজ হয়ে যেতো না।
কিন্তু তুমি নিয়তির শিকার হলে।
কারণ সেই রাত্রে একটা তচনচ করা ঝড় উঠলো।
তবু বলি নন্দিতা, রাজেন নামের ওই হতভাগ্য লোকটাকে তুমি বাঁচাতে পারতে, নিতান্ত অসার হয়েও যে লোকটা দু’ দুটো মেয়ের জপমন্ত্র। কিন্তু তুমি তাকে বাঁচাচ্ছো না, সে চেষ্টাও করছো না, তুমি একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয়ে তাকে মৃত্যুর গহ্বরে ঠেলে দেবার জন্যে তোমার সর্বশক্তি প্রয়োগ করছো।
আগামীকাল এ নাটকের শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্য।
তারপর যবনিকা পড়বে।
আগামীকাল বোঝা যাবে ওই নৃশংস হত্যার নায়ক রাজেন্দ্রভূষণ সেই মৃত্যুর গহ্বরেই তলিয়ে যাবে, না অন্য এক মৃত্যুর অন্ধকার পুরীতে বসে আয়ুর দেনা শুধতে শুধতে ক্রমশঃ মানুষ নাম থেকে খারিজ হয়ে জন্তু হয়ে যাবে।
আগামীকাল জানতে পারা যাবে সে খবর।
‘আগামীকাল জানতে পারা যাবে এ খবর—’ আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন অজিতা দেবী, এ বাড়িতে আরও একটা খুনের ঘটনা ঘটছে এই রাত্রে।’
উচ্চারণ করলেন তাঁর চুড়োবাঁশীধারী ‘মুরলীধরের’ সামনে।
খুব আস্তে আর কঠিন গলায় বললেন, ‘সংসার থেকে পালিয়ে তোমার কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম এই আশ্রয়কেই সত্য করে তুলবো। ভেবেছিলাম তুমি হয়তো দেবে সে আশ্রয়, কিন্তু—তুমি সে বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিয়েছো।
হ্যাঁ, তোমার ওপর থেকে আমার রুচি চলে গেছে, তাই আমার পাপ পুণ্যের হিসেবও হারিয়ে গেছে। তাই আমিও একটা হত্যাকাণ্ডতে আর ভয় পাচ্ছি না।
যদি এটা না করি, তাহলে আমাকে কাল আদালতে দাঁড়িয়ে আমার পার্থর মৃত্যুর ছবি পুঙ্খানুপুঙ্খ করে আঁকতে হবে। কারণ আমার বৌ, যাকে আমি একদিন বরণ করে ঘরে তুলেছিলাম, সে আমাকে শাসিয়ে গেছে ‘সত্যি’ কথা বলতে হবে।
অথচ সত্যিকার সত্যি বলবার উপায় নেই আমার।
অজিতা দেবী উঠে দাঁড়ালেন, ছোট্ট ঘরটা থেকে ছটফটিয়ে বেরিয়ে এলেন খোলা ছাদে। এই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যেন অবাক হয়ে গেলেন। আশ্চর্য, আশ্চর্য বিধিলিপি আমার! আমার জানিত, আমার পরিচিত, আমার সমাজের আর কারুর জীবনে কখনো এমন ঘটনা ঘটেছে?
সুদূর অতীতের দিকে চোখ ফেললেন অজিতা দেবী।
কোথাও কোনোখানে না।
ভয়াবহ মৃত্যুশোক দেখছেন, অকস্মাৎ এ্যাকসিডেণ্টে এক মুহূর্তে ফুরিয়ে যেতে দেখেছেন, দাঙ্গার সময় গুণ্ডার ছুরিতে শেষ হয়ে যাওয়া তাঁর পিসতুতো ভাইকে দেখেছেন, কিন্তু এমন ঘটনা দেখেননি। অজিতা দেবীর জীবনটা তা’হলে একটা বিস্ময়? একটা অদ্ভুত ভয়ঙ্কর নাটক?
অথচ আমি আমার মত আর সকলের মতই, ছেলেবেলায় ‘পুণ্যিপুকুর’ করেছি, ‘হরিরচরণ’ করেছি, কল্যাণী বধূর মূর্তিতে ঠাকুর ঘরে সন্ধ্যাদীপ দিয়েছি, তুলসী গাছে জল দিয়েছি। আমি রেঁধেছি বেড়েছি—স্বামীর ঘর করেছি, স্বামীকে যে ভাল না বাসাও চলে, তা’ জানতাম না বলে ভালও বেসেছি, আমার কেন ‘মৃতবৎসা’ রোগ হয়েছিল, সে কথা চিন্তা করিনি। কেন জানি না সেই রোগের নিষ্ঠুরতার ভিতর থেকে হঠাৎ কবে ঈশ্বরের করুণার মত দুটি সন্তানকে আমি এই পৃথিবীর উপস্বত্ব ভোগ করতে দিতে পেরেছিলাম।
আমার পার্থ আর ভারতী।
ওরা কি করে বাঁচলো, কি করে সুস্থ স্বাস্থ্যে ভরা জীবন পেলো, সে কথা আমি বুঝিনি, ঈশ্বরের দয়া ভেবেই কৃতজ্ঞ হয়েছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেন অমন অলৌকিক ঘটনাটা ঘটেছিল তখন।
ওরা ঘোরালো করে মরবে বলে।
ওদের মৃতবৎসা মার অনেকগুলো সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবার আগে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে বলে তাঁর বড় আক্ষেপ ছিল, ওরা সেই আক্ষেপ ঘোচাবে বলে আলো দেখলো, পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস নিলো, কিছুদিন তার উপস্বত্ব ভোগ করলো, তারপর প্রস্তুত হলো হাজার হাজার লোক জানিয়ে সমারোহ করে মরতে।
তাদের মায়ের আক্ষেপ ঘোচাতেই তাহলে! না হলে এমন অর্থহীন ঘটনার কোনো অর্থ করা যায়?
পার্থ তার কাজ সেরে ফেলেছে, ভারতীও এগোচ্ছে। ভারতী সে কথা লিখেছে—’এমন একটা মেয়েমানুষকে তুমি এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে দেখছো মা, যার স্বামীর ফাঁসি হয়ে গেছে?’
হ্যাঁ, ভারতীর চিঠিটা আমার হাতের মুঠোর মধ্যে রয়েছে। পোষ্টে পাঠায়নি, পাছে মারা যায়। এ বাড়ির লেটারবক্সের চাবি তো তার পরম শত্রুর হাতে।
লোক দিয়ে চুপিচুপি পাঠিয়েছে চিঠিটা।
হ্যাঁ, লোক দিয়েই পাঠিয়েছে ভারতী, চিঠিটা চুপি চুপি। ওর ওই হিতৈষী ভাসুরদেরও জানায়নি। কারণ ভারতী এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না ওঁরা সত্যি হিতৈষী কিনা!
না, শেষ রায় বেরোনোর আগে পর্যন্ত ভারতী কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না।
রাজেনের দাদারা যখন রাজেনের জন্যে ছুটোছুটি করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, আর পায়ের রক্ত মাথায় তুলছে, ভারতী তখন, তাদের সেই মিস্ত্রী ডাকিয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির মাঝখানে পাঁচিল তোলার দৃশ্যটা মনে করছে।
আর নিজের নীচতায় লজ্জিত বোধ করলে নিশ্বাস ফেলে ভাবছে, ও যদি আমার দাদার বুকে গুলি বিঁধে দিতে পারে, তা’হলে ‘বিশ্বাস’ কথাটা আমি রাখবো কি করে? তাই ভারতী কাঁটা হয়ে আছে, কি জানি কোর্টে দাঁড়িয়ে ওরা এতদিনের শত্রুতার শোধ নিয়ে বসবে কিনা। বলে বসবে কিনা, ‘জানি আমরা, আমাদের এই ভাইটি বরাবরই হিংস্র প্রকৃতির। কাজেই তার পক্ষে—’
ভারতী তার মাকেও বিশ্বাস করছে না, তবু ভারতী মার মন গলাতে মাথা খুঁড়ে খুঁড়ে চিঠি লিখেছে। লিখেছে… ‘মা তুমি কি শুধুই তোমার ‘সত্য ধর্মের’ মুখ চাইবে! তোমার দুর্ভাগিনী মেয়েটার মুখ চাইবে না? তোমার সেই মেয়ে, তোমার ভারতী তোমার কাছে তার সিঁথির সিঁদুর আর হাতের লোহাটুকু ভিক্ষে চাইছে। মা গো, মা হয়ে সেটুকু কি তুমি দেবে না? তোমার কথায় তোমার মেয়ের হয়তো সব বজায় থেকে যায়। সেই মিথ্যে কথাটুকুতে কী হবে তোমার? নরকে যাবে? কিন্তু যখন তুমি দেখবে তোমার সেই নরকের ভয়টুকুর জন্যে একটা প্রাণ শেষ হয়ে গেল, (আর একটা প্রাণও থাকবে না! এমন একটাও মেয়েমানুষকে কি তুমি এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছো মা যার স্বামীর ফাঁসি হয়ে গেছে!) তখন? নরক যন্ত্রণার হাত এড়াতে পারবে তুমি? আমার মনে কি হয় জানো মা? আমার কোটি জন্ম নরকবাসের বিনিময়ে যদি ওর প্রাণটা রক্ষা করা যেতো তো, এক মিনিটও ভাবতাম না আমি। সে নরক মাথায় করে নিতাম।…
মা, তবু পৃথিবীর সমস্ত মায়ের দোহাই, আর সমস্ত মেয়ের দোহাই, তুমি তোমার মেয়ের সেই প্রাণটার কথা একবার ভালো করে ভাবো।…
বুঝতে পারছি এ কথা বলাটা আমায় ধৃষ্টতা, তুমি যদি প্রশ্ন করো, ‘কি রে তোর দাদার মুখটা তোর একবারও মনে পড়ছে না?’ তার উত্তুর দেবার মুখ আমার নেই। কিন্তু দাদার মুখকে আমি মনে আসতে দিচ্ছি না মা, আমি স্বার্থে পিশাচী হয়ে গেছি। …মা তবুও বলি—ওর ফাঁসি হলে তো তোমার ছেলেকে তুমি ফিরে পাবে না! শুধু তোমার আর যে একটা সন্তান এখনো রয়েছে পৃথিবীতে, তাকেও হারাবে।… শোকের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে মানুষ, কিন্তু লজ্জা? অপমান? কলঙ্ক?’ আরো কত কথা যেন লিখেছে ভারতী ইনিয়ে বিনিয়ে।
ছেলেবেলায় বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, পড়ে ছিল একটা নিরেট বাড়িতে, লেখাপড়া এগোবার সুযোগ পায়নি, তাই ওর ভাষায় নেই বুদ্ধির ছাপ, ভঙ্গিমায় নেই মার্জিত চেহারা।…
কিন্তু সেই ভঙ্গীতেই তো ও নিজের প্রাণটাকে বিছিয়ে ধরতে পেরেছে। ওর মার নেই সে ক্ষমতা। ওর মা ইহজীবনে কারো কাছে তার মনকে খুলে ধরতে পারেনি।
আজও ওই মেয়ের কাছেও খুলে বলতে পারবে না যে, ‘তোর সিঁথির সিঁদুর আমায় মিথ্যে কথা দিয়ে কিনতে হতো না ভারতী, সত্যের মধ্যেই তার ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকতে পারতো!
কিন্তু সে সত্য বলবার উপায় আমার নেই। পরমতম মিথ্যার চেয়েও অবিশ্বাস্য সেই ‘চরমতম সত্য।’…
হ্যাঁ—
অজিতা দেবী যদি সে সত্য উচ্চারণ করতে যান, উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী হেসে উঠবে। ‘ছি ছি’ করে গায়ে ধুলো দেবে, বলবে কী নির্লজ্জ কী নির্লজ্জ! কী নীচ মিথ্যাবাদী!’
হঠাৎ একটা অদ্ভুত উপলব্ধিতে যেন তাঁর নিজের কথাটা ভুলে গেলেন অজিতা দেবী, ভুলে গেলেন তাঁর মেয়ের চিঠি, মেয়ের আবেদন, সেই নিরন্ধ্র অন্ধকারের মধ্যে বসে হঠাৎ যেন অনুভব করলেন, কী অদ্ভুত মিথ্যা দিয়ে গড়া এই পৃথিবী।
সত্য!
শব্দটা যেন একটুকরো সোনালী রাংতা। সেই রাংতায় মুড়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে সমস্ত মিথ্যার বেসাতি। নেই, কোথাও নেই সত্যকার সত্য।
গলার জোর যার যত প্রবল, সে তত ‘সত্যভাষী’। সেই জোরের জোরে কত কাঁচ ‘হীরে’ হয়ে যাচ্ছে, কত হীরে কাঁচ হচ্ছে!
পৃথিবী জুড়ে চলছে একটা ‘মুখোস অভিনয়।’ প্রত্যেকে সেই মুখোসের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে নিজেকে, তাই যদি কেউ কখনো একবার মুখোস খুলে দাঁড়াতে চায় কৌতূহলী পৃথিবী তাকিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত করে নেবে এ আর একটা নতুন ধরনের মুখোস!
কারণ কোনো মুখই মুখ নয়, কোনো সত্যই সত্য নয়, এটাই হচ্ছে এ পৃথিবীর শেষ কথা! সেই শেষ কথার পর আর কি করে সুরু করা যাবে নতুন কথা?
কি করে অজিতা দেবী জনারণ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গলা তুলে বলবেন, ‘ধর্মাবতার শুনুন, ওই হতভাগ্য আসামীর সত্যিই যদি কোনো দোষ থাকে তো, সে দোষ হচ্ছে—ওই মারণাস্ত্রটা ছিল ওর নিজের। ও সেটা পকেটে করে বেড়াতো। তাছাড়া আর কিছু নয়।
আমি জানি, ধর্মাবতার, আমি সব জানি। আমি ওই দেড়তলা ঘরটার উঁচুতে যে কাঁচের জানলাটা রয়েছে সেটা থেকে সব কিছু দেখেছি আধখানা সিঁড়ি উঠে।’
না, এসব বলা চলবে না।
বলে হাস্যাস্পদ হবেন, অবিশ্বাসী হবেন। মিথ্যায় গড়া পৃথিবী বলে উঠবে, ‘দেখো, মেয়ের স্বার্থে মানুষটা কি নির্লজ্জ মিথ্যা কথাই বানাচ্ছে। ছেলের থেকে বড়ো হলো ওঁর মেয়ে।’
বলুক, বলেও যদি চোখের দৃষ্টি একটু খোলা রাখতো! চোখ খোলে না পৃথিবী। সে পরের চোখে দেখে, পরের কানে শোনে। তাই সে পড়ে আছে মতলববাজদের মুঠোর মধ্যে।
যারা শুধু ভালবাসার মন নিয়ে, শুধু বিশ্বাসের মন নিয়ে এখানে একটু জায়গা পেতে চাও, তারা ‘হটো’, তারা পাগলা—গারদে চলে যাও।
রাত্রের আকাশ অনেক কথা বলে, অনেক তথ্য উদঘাটন করে দেয়।
রাত্রের আকাশের দিকে না তাকানোই ভালো। যারা এই মিথ্যার রঙে রঙিন পৃথিবী থেকেই রং নিতে চাও, রস নিতে চাও, আনন্দ নিতে চাও তারা কেউ কোনোদিন রাত্রের আকাশের দিকে তাকিও না। তারা সকালের সোনালী আলোর আকাশকে দেখো, দুপুরের ঝকঝকে রূপোলী আকাশকে দেখো, গোধূলির লাল আকাশকে দেখো।
কিন্তু যদি সেই রূপ রস রঙের লোভ আর না থাকে তোমার, তবে উঠে এসো ছাদে, নেমে এসো ঘাসের মাঠে। তাকাও ওই সত্যভাষী রাত্রির আকাশের দিকে। সে তোমায় সব জানিয়ে দেবে।
‘আমি জানতাম, তবু এমন করে বুঝি জানিনি কোনোদিন।’
মনে মনে বললেন অজিতা দেবী, ‘এখন বুঝতে পারছি—এই আমাদের ছোট ছোট সংসারের মধ্যেও সেই একই রহস্য।….
আমি তো আশৈশবই ভেবে এসেছি আমি খাঁটি, আমি ঠিক। কিন্তু কী ভুলই সেই ভাবনাটা ছিল। আজকের ওই রাত্রির আকাশ আজকের আমার এই হত্যার সংকল্পে দৃঢ় মন, আমাকেই প্রশ্ন করছে কোথায় তোমার সেই খাঁটিত্ব? শৈশবে তুমি যখন ‘লক্ষ্মীমেয়ে’র মূর্তি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছ, সে কি তুমি সত্যি ‘লক্ষ্মী’ বলে? না তুমি প্রশংসা পাবে বলে? তোমার পরিজনেরা সুখী হবে বলে?
বল সে কথা?
জোর করে বলতে পারবে? আজ উত্তর, স্পষ্ট নির্ভুল?
না নেই। হয়তো বড় জোর বলতে পারবো, ‘কিন্তু খারাপই বা কী এমন ছিলাম?’
ওই। ওইরকম গোঁজামিলের উত্তর।
ও তীক্ষ্ন প্রশ্ন করছে, ‘তুমি কি তোমার স্বামীকে সত্যি ভালবাসতে?’
আমার কাছে উত্তর নেই। আমাকে মাথা হেঁট করে অমনি একটা গোঁজামিলের উত্তর খুঁজতে হবে। …অথচ আমি সেই স্বামীর সঙ্গে সুখে দুঃখে এক হয়ে ছাব্বিশ বছর ঘর করেছি দ্বন্দ্বহীন শান্তিতে।
তার মানে অভিনয় করেছি। নন্দিতা নামের মেয়েটার মতই। অথচ আমি টের পাইনি আমি অভিনয় করছি। অথচ নন্দিতার ওই অভিনয়ের খোলোস আঁটা রূপটাকে চিনে ফেলেছিলাম আমি।
সে যে তার স্বামীকে ভালবাসে না, তার যে প্রাণ পড়ে আছে অন্য এক পুরুষে, অথচ সে নিত্যকারের চাকায় নিজেকে বেঁধে ফেলে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে, এটা দেখেছি, আর ঘৃণায় মন বিষিয়ে গেছে আমার।…
আমি কতদিন ভেবেছি, খুলে দেব ওর অভিনয়ের ওড়না, বলে দেব পার্থকে, ‘দেখ দেখ, কী মেকি মালাটি তুই গলায় পরে বসে আছিস—’বলতে পারিনি। আমার পার্থর ওপর মায়া হয়েছে, আমার এই সাজানো খেলাঘর ভেঙে যাবার ভয় হয়েছে! তাই আমি পার্থর সামনে অবোধ সেজে বেড়িয়েছি। তা’হলে পার্থর সামনে আমি অভিনয় করেছি। অবোধের অভিনয়।
আর পার্থ?
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি সেদিন। স্তব্ধ হয়ে গিয়ে পার্থর মুখটা দেখেছিলাম—সেই তার ঘৃণায় আর ব্যঙ্গে বেঁকে যাওয়া মুখ। যে মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ‘অবাক হয়ে যাচ্ছো তুমি একটি বিবাহিত ব্যক্তির অধঃপতন দেখে? কিন্তু তোমার তো এতে অবাক হওয়া উচিত নয় নন্দিতা—’
বড় বেশী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।
তাই হঠাৎ তখনই টের পাইনি, এতদিন ধরে পার্থ নামের ওই সরল সাধাসিধে চেহারার লোকটাও অভিনয় করেই এসেছে।
যে স্ত্রীকে ও ঘৃণা করেছে, তার সঙ্গে—’ভালবাসার ঘর’, ‘ভালবাসার ঘর’ খেলা করেছে। যাকে অবিশ্বাস করেছে, তাকেই সবচেয়ে বিশ্বাসের ভান করে যথাসর্বস্ব দিয়ে রেখেছে তার হাতে।
ওই ঠোঁটকে এর আগে কোনোদিন বাঁকাতে দেয়নি, শুধু সেদিন—
শুধু সেদিনই হয়তো এই রাত্রির আকাশের কারসাজিতে—
কিন্তু সেদিন আমি ওর ওই বাঁকানো ঠোট দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ‘আমার মমতা’ ওর কোনো কাজে লাগেনি দেখে পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।
তাই সহসা খেয়াল করতে পারিনি—আমার তখুনি ছুটে নেমে আসা উচিত ছিল। আমার ওই সর্বনাশা মেয়েটার হাত চেপে ধরা উচিত ছিল।
কিন্তু শুধুই কি খেয়াল করিনি?
এ আত্ম—অভিমানও কি ছিল না, ছুটে গেলে ওরা বুঝে ফেলবে আমি ওদের জানলায় চোখ ফেলে আড়ি পাতছি।
হ্যাঁ, সেই আড়িপাতার গ্লানিবোধ নিয়েই আমি দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ আমি ভয় পেয়েছিলাম। আমার মেজাজি আর খেয়ালী জামাইটা হঠাৎ বচসা করে কোনো বিচ্ছেদের ব্যাপার ঘটিয়ে না বসে এই ভয় ছিল আমার।
এই—
এই ভয় নিয়েই সংসার করে চলেছি চিরকাল। পাছে কিছু বিকল হয়ে যায়, পাছে সব তছনছ হয়ে যায়। আশ্চর্য! কোথাও নেই নিশ্চিন্ততার শিকড়ও, তবু সেই গাছে জল দিয়ে চলেছি ফুল ফুটবে ভেবে।
অথচ সৃষ্টিকর্তা যে মুহূর্তে ইচ্ছা করলেন সব তছনছ হয়ে যাক, সেই মুহূর্তেই হয়ে গেল সেটা। এক নিমেষও দেরী হল না।
এই জিনিস সামলে চলেছি, ঠুনকো কাঁচের এই জিনিস।
তখনও সামলাচ্ছিলাম, যখন দেখলাম—হ্যাঁ—যখন আর একটা রুক্ষ প্রশ্ন শুনলাম—’তার মানে?’ তখনও।
কিন্তু তখনও যে আমি ওই বাজের শব্দটার কথা ভাবতে পারিনি তাই আমার সেই আধতলার জানলা থেকে ছুটে নেমে যাইনি।
যখন গেলাম, তখন তো তচনচ হয়েই গেছে।
‘তচনচ করে বসাই নাকি শিশু ভোলানাথের পেশা।’ কিন্তু আমার জীবনটা বড় বেশী অদ্ভুত নয় কি?
এও বোধকরি সেই অদৃশ্য শিল্পীর একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা?
কিন্তু আমি ওকে আর শিল্পী বলে মানতে রাজী নই।
আমি বুঝেছি একটা আনাড়ি লোক, হাতে খানিকটা ক্ষমতা পেয়ে যা—তা করছে। এইটাই এই মানেহীন পৃথিবীর মানে।
পার্থকে কি আর কোনোভাবেই নেওয়া চলতো না তার? যাতে শুধু শোক থাকতো—লজ্জা থাকতো না—কলঙ্ক থাকতো না।
আচ্ছা, পার্থকে কি আমি ভুলে যাচ্ছি?
পার্থর ভালো মুখ? পার্থর ভয়ানক মুখ?
কই তেমন স্পষ্ট আর দেখতে পাচ্ছি না কেন? সব কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে কেন? ভয়ানক শোকও তবে এইরকম আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে যায়!
না না, আমি ইচ্ছে করে ঝাপসা করে ফেলেছি। মুঠো মুঠো ধুলো—বালি ছড়িয়ে সেই ধুলোর স্তরের নীচে চাপ দিয়ে দিয়ে চালাচ্ছি।
কারণ তখনও আমি হত্যার সংকল্পে দৃঢ় হইনি। তাই ভেবেছিলাম—আবার তো ওদের নিয়েই থাকতে হবে!
তাই—
আজ সকাল পর্যন্তও আমি জানতাম আবার ওদের নিয়েই থাকতে হবে আমায়। যেমন করে থেকেছি এতদিন, ঠাকুর আঁকড়ে থাকার ভান করে।
কিন্তু আজ তো আমি ওই মিথ্যে পুতুলটাকে মুচড়ে ভেঙে ফেলে দেবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এই ওপর তলায় উঠে এসেছি।
ওকে আর রেখে দিয়ে কি হবে?
অনেকদিন ধরে পূজো পেয়েছে ও, সেই সম্মানটুকু বজায় রাখতেই ফেলে রেখে না দিয়ে ফেলে দেব ছুঁড়ে টান মেরে।
এতদিন ধরে যে নাটক চলছে, আগামী কাল তার শেষ অঙ্কের শেষ দৃশ্য অভিনীত হবার কথা। তারপর যবনিকা।
আমি সেটা পিছিয়ে দিচ্ছি।
আমি সেটার আর একটা নতুন দৃশ্য লিখছি। তাতে আমার ভূমিকাটা বদলে যাবে। সাক্ষীর কাঠগড়া থেকে আসামীর কাঠগড়ায়।…নিশ্চয় একটা চাঞ্চল্য উঠবে, মঞ্চের চেহারা বদলে যাবে, দর্শকরা একটু চমকে উঠবে।…তারপর আবার চলবে সব যথাযথ।
ছাত থেকে নেমে এলেন অজিতা দেবী।