শয়তানের কারসাজি

শয়তানের কারসাজি

সুবর্ণা বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছে মেয়ের ঘর থেকে৷ এত বেলা অবধি ঘুমানো ঋতির অভ্যেস নয়৷ ভোরে উঠে এক্সারসাইজ না করলে ওর দিন শুরু হয় না৷ আজ ছুটির দিন বলে বেলা দশটা অবধি ঘুমাবে এমন নয়৷ কাল ডিনার করল না, বলল, খেতে ইচ্ছে করছে না৷ কী হল মেয়েটার? সুবর্ণা মেয়ের কপালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দেখল জ্বর আছে কি না৷ দেখল গা ঠান্ডা৷ ঋতি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘মা, পুরুষরা কি জন্মগত মিথ্যাবাদী হয়? বাবাও কি তা-ই ছিল?’

আচমকা এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, ধারণা ছিল না সুবর্ণার৷ সত্যজিতের কোনো কথা কোনোদিন এ বাড়িতে উঠতে দেয়নি সুবর্ণা৷ মেয়ের সারনেম অবধি পালটে দিয়েছিল ডিভোর্সের পরেই৷ এ বাড়িতে একটা ছবি, কোনো স্মৃতি অবধি রাখেনি সুবর্ণা৷ মেয়েও একটু বড়ো হবার পরে আর কখনো বাবার কথা জিজ্ঞাসাও করেনি কোনোদিন৷ ইন ফ্যাক্ট, বাবার মুখটা অবধি সঠিক মনে নেই ঋতির৷ তাহলে এখন এত বছর পরে হঠাৎ বাবা শব্দটা উচ্চারণ করল কেন ঋতি?

সুবর্ণার ভ্রূর ভাঁজে বিরক্তিসূচক একটা ভঙ্গিমা নিজের অজান্তেই ফুটে উঠল৷ তবুও অভিজ্ঞতা দিয়ে সেটাকে সামলে নিয়ে বলল, ‘হঠাৎ এ কথা? সব পুরুষ মিথ্যে বলে এমন ভুল ধারণা তোর হল কেন? এই তো আমার ফোটোগ্রাফির গ্রুপের সায়ন্তন, এতটাই ভদ্র ছেলে, ভাবা যায় না৷ মিথ্যে দূরে থাক ও কোনোদিন কারো এক টাকা ঠকিয়ে নেয়নি৷ আর পৃথিবীর সব পুরুষ ওই মানুষটার মতো এমন ভাবার কারণ কী? মিথ্যে কথার সঙ্গে পুরুষ-মহিলার কোনো ব্যাপার নেই৷ এটা মানুষের ওপরে নির্ভর করে৷ আমার কলিগ দ্বিতীয়া জীবনে একটা সত্যি কথা বলেছে কি না সন্দেহ করি আমরা৷’

ঋতি চোখ বন্ধ করে বলল, ‘কে জানে! আমার জীবনের দুজন পুরুষই মিথ্যেবাদী প্রমাণ হল কি না তাই বলে ফেললাম৷’

সুবর্ণা বলল, ‘তোর মনে আছে বাবাকে?’

ঋতি হেসে বলল, ‘না, সেভাবে নেই৷ শুধু খবরের কাগজ পড়ত খুব, আর দ্র&ত পায়চারি করত, রেগে গেলে জিনিস ছুড়ে দিত৷ আর সেভাবে কিছু মনে পড়ে না৷ আমায় বলত, খবরের কাগজ পড়বি, নিজেকে আপডেট রাখবি৷ মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত, ক্ষমা করিস৷ মা, একটা প্রশ্ন করব? বাবা ঠিক কী অন্যায় করেছিল? তুমি কি বাবার সঙ্গে জাস্টিস করেছিলে? না মানে এমন কী অন্যায়, যেটা ক্ষমার অযোগ্য?’

সুবর্ণা বলল, ‘অন্যায়টা না-জানাই ভালো৷ আরেকটা কথা, ওই মানুষটার নাম এ বাড়িতে উচ্চারিত না হলেই খুশি হব৷’

আড়মোড়া ভেঙে ঋতি বলল, ‘সত্যজিৎ রে বিখ্যাত লোক, আরেকজন সত্যজিৎ হলেন কুখ্যাত৷ সুবর্ণা গম্ভীর স্বরে বলল, আর কোন পুরুষের মিথ্যে বলার কথা বলছিলিস তুই? তোর কোনো ফ্রেন্ড? কী যেন নাম ছেলেটার— উৎপল তা-ই না?’

ঋতি ধড়ফড় করে উঠে বলল, ‘মা, তুমি কী করে জানলে? কে বলল?’

সুবর্ণা হেসে বলল, ‘তুই ফোনে রাত অবধি কথা বলিস, পাশের ঘর থেকে একটু-আধটু শুনতে পাই৷ তখনই নামটা কানে এসেছিল৷ তোর ফ্রেন্ড নাকি বিশেষ কেউ?’

ঋতি অপলক তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে৷ আজও মা-কে ও বুঝল না৷ অদ্ভুত নিস্পৃহ মহিলা৷ আবার অসম্ভব যত্নশীল৷ ভোরে রোজ ওর ঘরে ঢুকে এসি-র টেম্পারেচার অ্যাডজাস্ট করে, গায়ে ঢাকা দিয়ে, মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে জলের জাগ চেক করে যায় মা৷ ও কী খাবে, কী পরবে, সেদিকেও যত্নশীল নজর মায়ের৷ অথচ ঋতির দারুণ রেজাল্টেও মায়ের যেমন এক্সপ্রেশন, কোনো সাবজেক্টে কম পেয়ে গেলেও মায়ের এক্সপ্রেশন একই৷ কোনো উত্তেজনা যেন স্পর্শ করতে পারে না মা-কে৷ বন্ধুরা প্রায় বলে, ওরে বাবা, রেজাল্ট খারাপ হলে মা মেরে পিঠের ছাল তুলে দেবে৷ না, ঋতির মা কোনোদিন ওর গায়ে হাত তোলেনি৷ জোরে বকেনি অবধি৷ ঠান্ডা গলায় নিরুত্তাপ স্বরে কিছু কথা বলে মা, সেগুলো মারের থেকেও বেশি আতঙ্কের ঋতির কাছে৷

বাদবাকি মা নিরুত্তাপ৷ ঋতি বলল, বিশেষ বন্ধুই বলতে পারো৷

সুবর্ণা হেসে বলল, ‘তো সে কি তোমায় এখন থেকেই মিথ্যে বলছে? সম্পর্কের শুরুটাই হচ্ছে মিথ্যে দিয়ে?’

ঋতি ভ্রূ কুঁচকে বলল, তা-ই তো মনে হচ্ছে, মা৷ তার বেশ কিছু মিথ্যে আমি ধরতে পারছি৷ আর কিছু সে আড়াল করতে চাইছে৷

সুবর্ণা বলল, ‘যদি বোঝো, ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছ, ওই ট্রেনে তুমি কোনোদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না, তাহলে পরের স্টপেজেই ট্রেন থেকে নেমে পড়বে৷ স্টেশনটা একটু অচেনা ঠেকবে হয়তো৷ কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদ করেও পরের ট্রেন ধরে বাড়ি ফেরার রাস্তা থাকবে৷ ভুল ট্রেনে যত এগোবে, ফিরতে তত সমস্যা হবে৷ তাই পারলে সময় থাকতে সঠিক ট্রেনে উঠে যাত্রা শুরু করো৷ না হলে আর কিছুই না, সময় নষ্ট হবে৷

ঋতি বলল, মা,তুমি কেন আর অন্য ট্রেন ধরোনি? দাদুর ওপরে অভিমান করে?

মা হেসে বলল, অভিমান বড়ো জটিল একটা অনুভূতি৷ এ নিজেই জানে না কার ওপরে করা উচিত আর কার ওপরে নয়৷ তাই অমন জটিল বিষয়ে নাক গলাই না আমি৷ আমি নিজের পায়ে চলছি, ট্রেন-বাস ছাড়াই বেশ চলছে৷ তাই আর অযথা ছুটোছুটি করে ট্রেন ধরতে যাইনি৷

ঋতি দেখল মায়ের চোখে একটা ক্লান্তির ছায়া৷ হয়তো মা একেবারেই চায় না, ঋতি এটা নিয়ে কথা বলুক৷ সুবর্ণা কারো প্রাইভেসিতে ইন্টারফেয়ার করার মানুষ নয়৷ এমনকী মেয়েকেও অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে৷ ঋতি বলল, ‘মা, তুমি উৎপল সম্পর্কে কিছু জানতে চাইলে না তো? ছেলেটা কী করে, কোথায় থাকে? কিছুই তো জানতে চাইলে না৷’

সুবর্ণা জানালার পরদাগুলো সরাতে সরাতে বলল, ‘তোর বয়েস তো মাত্র আঠারো প্লাস৷ তুই তো এখুনি বিয়ে করবি না৷ আমি অন্তত দেব না৷ আমি আটাশ-ত্রিশের আগে বিয়ে দিতে চাই না তোর৷ এখন তুই যদি তার আগেই বিয়ে করিস তাহলে সে জীবনের দায়িত্ব শুধুই তোর৷ সেখানে ছেলে কেমন? কী করে? এসব জেনে আর লাভ নেই৷ আর যদি মিনিমাম আটাশ বছরে গিয়ে নিজে এস্টাবলিশড হয়ে বিয়ে করিস তাহলে অবশ্যই তুই ঠিক সিদ্ধান্ত নিবি বলেই আমার বিশ্বাস৷’

ঋতি বলল, ‘মা, উৎপল আমার ফ্রেন্ড নয়৷ আমি ওকে ভালোবাসি৷’

সুবর্ণা একটু থমকে বলল, ‘তো অসুবিধা কী? তোর জীবন, তুই বুঝবি, কার সঙ্গে তুই ভালো থাকবি৷ যদি বুঝিস, বিয়ের পরে অ্যাডজাস্ট করতে পারছিস না, তখন ভাববি৷ বাইরে থেকে মানুষ চেনা তো সহজ নয়, ঋতি৷ তাই আমি পছন্দ করলে যে সে ছেলে যুধিষ্ঠির হবে আর তুই করলে সে চূড়ান্ত খারাপ— এই মতবাদে আমি বিশ্বাসী নই৷’

ঋতি বলল, ‘মা, আমি সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছি, উৎপল আমায় অনবরত মিথ্যে বলছে৷ একটা মিথ্যে ঢাকতে আরেকটা মিথ্যে বলছে৷’

সুবর্ণা নরম গলায় বলল, ‘তবে বেরিয়ে এসো৷ প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হবে৷ রোজকার কথা বলা বা দেখা করাটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল৷ কিছু একটা নেই নেইয়ের ফিলিংস আসবে৷ ওটাকে ইগনোর করতে হবে একটু কষ্ট করে৷ ওই অনুভূতিটাকে ওভারকাম করে উঠলেই তুমি জয়ী হবে৷ এর মধ্যে হয়তো ছেলেটা আবারও পাঁচটা কথা বলে তোকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করবে৷ তখন তুই আবারও ভাবতে বসবি, ভাববি আরেকটা সুযোগ হয়তো দেওয়া উচিত৷ দ্বিতীয় সুযোগ দেওয়ার পরে তার অপরাধ করার সাহসটা আরেকটু বাড়বে৷ কারণ স্বভাব পরিবর্তন হয় না মানুষের৷ তখন সে আরও মিথ্যে তোকে গুছিয়ে পরিবেশন করবে, তুই আবার ধরতে পারবি৷ তখন তোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এই মিথ্যে নিয়ে বাঁচবি নাকি পরিত্যাগ করার মতো মনের জোর তোর থাকবে তখন৷ এগুলো লাইফের একেকটা পার্ট৷ বাইরের কেউ শেখাতে পারে না৷ নিজেকে ঠেকে এবং ঠকে শিখতে হয়৷ চল আমি এলাম৷ অফিসের পরে একটা ফোটো এগজিবিশনে যাবার ইচ্ছে আছে৷’

ঋতি বলল, ‘মা থ্যাঙ্ক ইউ৷’

সুবর্ণা বেরিয়ে গেল৷ মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কেন ঋতি আজ ওর বাবার কথা জিজ্ঞাসা করল৷ এতগুলো বছর মেয়েটাকে আগলে রেখেছিল, ওই ছায়াই পড়তে দেয়নি কখনো৷ তাহলে এত বছর পরে কেন মনে পড়ল সত্যজিৎকে ওর? তবে কি মেয়ে আঠারো পেরোতেই যোগাযোগ করেছে মেয়ের সঙ্গে? ডিভোর্সের শর্তই ছিল, কোনো অ্যালুমনি লাগবে না, কিন্তু মেয়ের সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করবে না ও৷ সেই শর্তেই থানায় যায়নি সুবর্ণা, এত বড়ো অন্যায়কে চেপে গিয়েছিল ও শুধুমাত্র ঋতিকে ওর নাগাল থেকে সরাবে বলে৷ নিজেও এতগুলো বছরে কোনো খোঁজ নেয়নি লোকটার৷ সত্যজিৎও অবশ্য ওর কথা মেনেই কোনো যোগাযোগ করেনি ওদের সঙ্গে৷ তাহলে ঋতি আজ কেন বাবার কথা তুলল? কেন বলল, সব পুরুষই মিথ্যাবাদী হয়? সত্যজিৎ যে নিজের চারিদিকে মিথ্যের বলয় তৈরি করেছিল— এটা তো ঋতির জানার কথা নয়৷ বুকটা কেঁপে উঠল সুবর্ণার৷ তাহলে কি সত্যজিৎ এসে আবার কোনো নতুন গল্প দিল ওকে? মিথ্যে বলতে আর মানুষকে কনভিন্সড করতে ওর জুড়ি মেলা ভার৷ ঋতি কেন আচমকা বলল, ‘বাবার সঙ্গে যদি আচমকা দেখা হয় কখনো, কী বলবে তুমি?’ তবে সুবর্ণার বিশ্বাস, ঋতি সত্যজিতের মিথ্যে গল্প বিশ্বাস করবে না৷ নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আনমনা হয়ে গিয়েছিল৷ বাবার ডাকে সংবিৎ ফিরে পেতেই শুনতে পেল বাবা বলছে, ‘দিদিভাই কাল রাতে কেন ডিনার করল না রে? শরীর খারাপ?

সুবর্ণা হালকা গলায় বলল, ‘একদিন ডিনার করতে ইচ্ছে হয়নি হয়তো৷ জোর করে খাওয়ানোর দরকার কী? জোর করে কোনো কিছুই করা উচিত নয়৷ ইচ্ছের বিরুদ্ধে খেলে অমৃতও বিষের মতো কাজ করবে৷’

বাবা অপরাধীর মতো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল৷ বাবার এই মুখটা দেখলে কোথায় যেন চিড়চিড়ে জ্বালাটা একটু কমে সুবর্ণার৷ বাবাকে যেদিন বলেছিল, সত্যজিৎকে বিয়েটা করবে না, সেদিন ওর প্রফেসর বাবা মানুষ চেনার অহংকারে ডগমগ করতে করতে বলেছিল, ‘বিয়ে আমি সত্যজিতের সঙ্গেই দেব৷ আমি ওকে কথা দিয়ে দিয়েছি৷’ সুবর্ণার হাতে বসানো শিউলি গাছটা সেদিন এক-উঠোন ফুল দিয়েছিল৷ সেদিকে তাকিয়ে সুবর্ণা বলেছিল, ‘আমার জীবনে আমার সিদ্ধান্তের কোনো মূল্য নেই, বাবা? বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেছিল, না নেই৷ আমি তোমায় মানুষ করেছি, আমি জানি, তুমি কোনটাতে ভালো থাকবে৷ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে৷ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে ঝরে-যাওয়া শিউলিগুলোর দিকে অপলক তাকিয়েছিল সুবর্ণা৷ মাটিতে গড়াগড়ি-খাওয়া শিউলিগুলোর সঙ্গে সেদিন নিজেকে একাত্ম করতে পেরেছিল ও৷ যার নিজের ইচ্ছের মূল্য নেই, গাছে থাকব মনে করলেও আশ্রয়ছিন্ন হয়ে পড়তেই হয় মাটিতে৷ সেদিন থেকে সুযোগ পেলেই বাবাকে একটা-দুটো কথা শুনিয়ে দেয় সুবর্ণা৷ জানে, বাবা নিজেও কষ্ট পায় ভুল মানুষ নির্বাচনের জন্য৷ তবুও কোথায় যেন একটা বিজবিজে রাগ মাঝে মাঝেই মাথাচাড়া দেয়৷ ঋতির সত্যজিৎ সম্পর্কে কৌতূহলই ওই রাগটাকে আরও উসকিয়ে দিল৷ ঋতির ধারেকাছে আসবে না কথা দিয়েও কি কথা রাখল না শয়তানটা?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *