কবিতা
উপন্যাস
গল্প
প্রবন্ধ

শমনের রঙ শাদা • প্রেমেন্দ্র মিত্র

শমনের রঙ শাদা – প্রেমেন্দ্র মিত্র

ডাঃ ওয়েব আসেন নি?

নিরঞ্জন মানে ডাঃ নিরঞ্জন হালদার বেশ একটু অবাক হলেন। কিন্তু তিনি ত আমাকে ছ মাস আগে থেকে জানিয়ে রেখে দিয়েছিলেন যে এবার তিনি আসবেনই। ডাঃ হালদার বেশ একটু বিস্মিত হয়ে বক্তার দিকে তাকালেন।

বক্তা নেভিল সেমুর। ডাঃ ওয়েবেরই একজন শিষ্য ও প্রাচীন সহকারী।

ডাঃ হালদারের কথায় নেভিল অত্যন্ত গম্ভীর ও কেমন একটু বিরক্তভাবে মাথা নাড়লেন—না, তিনি এবারে আসছেন না।

কথা হচ্ছিল হায়দ্রাবাদের প্যালেস হোটেলের লাউঞ্জে বসে।

হায়দ্রাবাদে এবার জীবতাত্ত্বিকদের বিশ্ব-সম্মেলন হচ্ছে। তাতে বাইরে থেকে যাঁরা এসেছেন তাঁদের বেশীর ভাগকেই এ হোটেলে রাখা হয়েছে।

ডাঃ নিরঞ্জন হালদার এসেছেন সাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনিও জীবতত্ত্ব বিজ্ঞানী। বৃটিশ গায়নার ডাঃ ওয়েবের বিশেষ বন্ধু। এক সময়ে দুজনে একসঙ্গে প্রিন্সটনে পড়েছিলেন। দুজনে এখনো একই বিষয় নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। একজন ভারতে, আর অন্য জন বৃটিশ হন্ডুরাস সরকারের বিশেষ নিমন্ত্রণে সেখানে একটি গবেষণাগারের ভার নিয়েছেন।

আসছেন না! আশ্চর্য!—ডাঃ হালদার তাঁর বিমূঢ়তাটা গোপন করলেন না—তিনি ত কথার খেলাপ করবার লোক নন। বিশেষ করে এই সম্মেলন সম্বন্ধে তাঁর আসার একটু বিশেষ আগ্রহ ছিল। ডিএনএ, আরএনএ নিয়ে গবেষণায় তাঁর সম্পূর্ণ নতুন একটা পরীক্ষা ফল তিনি এই সম্মেলনেই জানাবেন ঠিক করেছিলেন।

তাঁর গবেষণার সে নতুন থিওরীর কথা আমিই এখানে বলতে এসেছি।—একটু অধৈর্যের সঙ্গে বললেন নেভিল সেমুর।

আপনি বলবেন!—এবার গলার অপ্রসন্নতাটা অস্পষ্ট না রেখে বললেন ডাঃ হালদার—মাপ করবেন মিঃ সেমুর, কিন্তু আপনি তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য আর সহকারী হলেও আপনার বলা আর তাঁর বলা কি এক হয়!

কিন্তু তিনি বলতে পারছেন না বলেই আমাকে তাঁর কথা বলতে হচ্ছে—এ আলাপ শেষ করবার জন্যে নেভিল সেমুর যে ব্যস্ত তা তাঁর বলার ধরনেই বোঝা

গেল।

ডাঃ হালদার কিন্তু সে বিরক্তি আর অধৈর্য গ্রাহ্য না করেই বললেন—কিন্তু তিনি আসতে পারছেন না কেন, সেইটেই বুঝতে পারছি না।

ছ’মাস আগে তাঁর নতুন গবেষণার একটু আভাস দিয়ে তিনি নিশ্চিত এ সম্মেলনে আসবেন বলে আমায় জানিয়েছেন। তারপর এই ছ’মাসে আসার পক্ষে কোনো বাধা যদি হয়ে থাকে তাহলে আমায় তা কি তিনি জানাতেন না?

তিনি কেন আপনাকে কিছু জানান নি তা ত আপনাকে বলতে পারব না ডাঃ হালদার! তাঁর মনের খবর বা আপনাদের বন্ধুত্বের গভীরতা আমাদের জানবার বিষয় নয়।—অত্যন্ত অভদ্রভাবে কথাগুলো বলতে বলতে দাঁড়িয়ে উঠে মিঃ সেমুর নিজের কামরার দিকে পা বাড়িয়ে বেশ রূঢ়ভাবেই বলে গেলেন—অত্যন্ত দুঃখিত ডাঃ হালদার। কালকের ভাষণটা সম্বন্ধে আমার কিছু জরুরী কাজ এখন করবার আছে।

ডাঃ হালদারের মুখ চোখ তখন অপমানে রাগে লাল হয়ে উঠেছে। খানিক গুম হয়ে বসে থেকে তিনি উঠে চলে এলেন।

.

ব্যাপারটার ওইখানেই সমাপ্তি কিন্তু হল না।

সেইদিনই রাত তখন প্রায় নটা। ডাইনিং হল থেকে ডিনার খেয়ে এসে নেভিল সেমুর চাবি দিয়ে নিজের কামরায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে একটা আলো সবে তখন জ্বালতে যাচ্ছেন। আলোটা জ্বেলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেবেন এই ছিল তাঁর ইচ্ছে।

কিন্তু আলো জ্বালবার আগেই তাঁকে চমকে উঠতে হল। দরজাটা বন্ধ হওয়ার শব্দে চমকে ফিরে দাঁড়িয়ে দেখলেন তাঁর বদলে আর কেউ সেটা বন্ধ করে ভেতরে এসে দাঁড়িয়েছে।

অন্ধকারে বেশ লম্বা চওড়া গোছের চেহারাটা দেখে আপনা থেকেই মুখ দিয়ে উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসাটা বেরিয়ে এল—কে?

আলোটা জ্বাললেই দেখতে পাবেন, কে।

গলাটা যেন সামান্য চেনা মনে হল সেমুরের। আলোটা জ্বালবার পরে চিনতে দেরী হল না।

গলার স্বর তাঁর তখন অত্যন্ত কঠিন আর ক্রুদ্ধ। বললেন—আপনি! কিন্তু এ ভাবে চোরের মতো আমার কামরায় ঢোকার মানে?

চোর নয়, বলুন ডাকাতের মতো; ডাঃ হালদার রূঢ় ভাবে কথাগুলো বলে পাশের সোফাটার দিকে আঙ্গুল দেখালেন—ওখানে বসবেন চলুন। বসে আমি যা

যা জানতে চাই সব প্রশ্নের জবাব দেবেন।

এতবড় আপনার স্পর্ধা! সেমুরের গলাটাই তখন নানা তীব্র আবেগ মিশে প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে—আপনি গায়ের জোরে জুলুম করে আমাকে দিয়ে কথা বলাবেন!

হ্যাঁ, দরকার হলে সে ভাবেও বলাব।—ডাঃ হালদার এক রকম বজ্রস্বরেই বললেন—আমার বন্ধু ডাঃ ওয়েব কেন হঠাৎ এ সম্মেলনে আসতে পারলেন না তার সঠিক কারণ আমি জানতে চাই।

সঠিক কারণ জানতে চান?—এবার নেভিল সেমুরের গলাটা শুধু রাগে বিদ্রূপেই যেন তীক্ষ হয়ে উঠল না—শুনুন তাহলে আসল কারণটা। আপনার বন্ধু ডাঃ ওয়েব বেলিজ ছেড়ে চলে গেছেন। কোথায় গেছেন কেউ তা জানে না।

মিথ্যা কথা!—চিৎকার করে উঠলেন ডাঃ হালদার—ডাঃ ওয়েব এ রকম কিছু করলে সমস্ত বৈজ্ঞানিক জগতে সাড়া পড়ে যেত। এ খবর এমন করে চাপা থাকত না।

খবরটা ডাঃ ওয়েব সম্বন্ধে বলেই এমন করে চাপা দেওয়া হয়েছে মনে করুন না।—নেভিল সেমুরের গলায় বিদ্রূপ না অবজ্ঞা, না একটা যন্ত্রণা, এখন বোঝা শক্ত।

নিজে থেকেই এবার কাছের সোফাটায় গিয়ে বসে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে সেমুর ধীরে ধীরে বললেন—ডাঃ ওয়েবের এভাবে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া নানা দিক দিয়ে সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেই বেলিজের সরকারী রিসার্চ সেন্টারের কর্তারা এই ভাবে আরো কিছুদিন গোপনে তাঁর জন্যে সন্ধান চালিয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুসংবাদই প্রচার করবেন বলে ঠিক করেছেন।

ডাঃ ওয়েব হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন, তাঁর এ রকম অন্তর্ধান নানা কারণে সন্দেহজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে—ডাঃ হালদার ক্ষুব্ধ অথচ বিমূঢ় গলায় সেমুরের কাছে শোনা অবিশ্বাস্য খবরগুলো পর পর উচ্চারণ করে বললেন,—আর তাই চাপা দেবার জন্যে ব্রিটিশ হণ্ডুরাসের বিশ্ববিখ্যাত সরকারী রিসার্চ সেন্টার ডাঃ ওয়েবের সম্মান বাঁচাতে তাঁর মৃত্যু সংবাদ রটাবে বলে ঠিক করেছে? কি অসম্ভব কথা আপনি বলছেন মিঃ সেমুর! কিসের জোরে বেলিজ-এর রিসার্চ সেন্টার ডাঃ ওয়েবের মৃত্যু হয়েছে বলে রটাবে? উঃ ওয়েব সত্যি মারা গেছেন তার প্রমাণ কি! ডাঃ ওয়েব যদি তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর ফিরে আসেন?

তা তিনি আসবেন না।—তাড়াতাড়ি এ প্রসঙ্গ শেষ করবার জন্যে, বোধহয় কেমন একটু অস্বাভাবিক গলায় মুখটা ফিরিয়ে রেখেই সেমুরের বললেন,—যে কলঙ্ক তাঁর নামে জমা হয়েছে তাতে বেঁচে থাকলেও ফিরে আসার সম্ভাবনা তাঁর

নেই। তাই…

কথাটা শেষ করা আর সেমুর-এর হল না। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে সেমুরের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর দু কাঁধে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ডাঃ হালদার গলা দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বার করে বললেন,—সমস্ত মিথ্যা কথা! সমস্ত তোমার শয়তানী বুদ্ধির প্যাঁচ। ডাঃ ওয়েব আর ফিরে আসবেন না, এ বিষয়ে তোমার কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ফিরে না এলে তোমার অনেক সুবিধে। তাঁর আশ্চর্য গবেষণায় তুমিই ছিলে একমাত্র সহকারী। তাঁর সমস্ত কাজের সুনাম এখন তুমি পেতে পারবে। তিনি যে ফিরবেন না সেকথা তাই তুমি নিশ্চিত করে জানো। জানো এই জন্যে যে তুমি,—তুমিই তাঁকে হত্যা করেছ।

ডাঃ হালদার প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে সেমুরকে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর তিনি সোফার গায়ে যেন নেতিয়ে পড়লেন।

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! এতক্ষণ ঝাঁকানি দেওয়ার মধ্যে বা তারপর এখন সেমুরের কোনো প্রতিরোধের চেষ্টা বা ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ নেই কেন?

তার বদলে তাঁর মুখটা, শরীরের নয়, ভেতরের কোনো মানসিক যন্ত্রণায় যেন অত্যন্ত করুণ কাতর, চোখ দুটোও যেন সজল।

সেই পীড়িত কাতর মুখটাই নিচু করে রেখে ধীরে ধীরে সেমুর বললেন,—আপনি ঠিকই বলেছেন ডাঃ হালদার। ডাঃ ওয়েবকে আমিই মেরেছি। আমিই তাঁর মৃত্যুর জন্যে দায়ী! কিন্তু যে দিকে চাই সেই অবিশ্বাস্য শ্বেত বিভীষিকার বাহিনী,—সেই রেশমের তালের মতো কোমল সাগরের ফেনার মতো শুভ্র অথচ বীভৎস অগুণতি মৃত্যু-দূত…

শিউরে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেছেন সেমুর।

নেভিল সেমুরের কাছে সমস্ত বিবরণ তারপর শুনেছেন ডাঃ হালদার। শুনেছেন সেই রাত্রেই সেই অবিশ্বাস্য কাহিনী।

ডাঃ হালদার ছ’মাস আগে ডাঃ ওয়েবের চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু ডাঃ ওয়েবের কয়েকটা অদ্ভুত ব্যাপার তাঁর শিষ্য ও সহকারী নেভিল সেমুর লক্ষ্য করতে শুরু করেছেন তারও অনেক আগে থেকে।

প্রায় দু বছর আগে থেকে ডাঃ ওয়েবকে কেমন একটু অতিমাত্রায় অস্থির মনে হত। তিনি আশ্চর্য এক গবেষণার ক্ষেত্রে একেবারে নতুন কিছু আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে গেছেন বলে সেই উত্তেজনাতেই ওরকম অস্থির হয়েছে এই কথাই নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন সেমুর। কিন্তু মনে ঠিক শান্তি পান নি।

ডাঃ ওয়েবের গবেষণা অবশ্য যাকে বলে যুগান্তকারী। নোবেল পুরস্কার পাওয়া

ডাঃ খোরানার আবিষ্কারের রাস্তা ধরেই তিনি সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে আণবিক জীববিজ্ঞানের জগতে অসাধ্য সাধন করতে চলেছেন। প্রাণীদেহের জনন কোষে কিছু ‘জীন’-এর কৃত্রিম ‘মিউটেশনে’ বা পরিব্যাপ্তি-সাধন-কৌশল তিনি প্রায় আয়ত্ত করে ফেলেছেন বলা যায়।

এ ধরনের কাজে তন্ময়তার বদলে অস্থিরতার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া একটু যে অস্বাভাবিক নিজের কাছে তা অস্বীকার করতে পারেননি সেমুর।

ডাঃ ওয়েব-এর অস্থিরতাটাও একটু অদ্ভুত। এত বড় কাজের মধ্যেও মাঝে মাঝে তিনি হঠাৎ কয়েক দিনের জন্যে একেবারে ডুব দিতে শুরু করেছিলেন। ল্যারেটরিতে তাঁকে পাওয়া যেত না।বাড়িতেও নয়। কোথায় যে যেতেন কেউ জানতে পারত না।

এই ল্যাবরেটরি পালানো শুধু নয় তার সঙ্গে আরো এমন দু একটা ঘটনা ঘটতে লাগল যাতে সেমুর ডাঃ ওয়েবের মানসিক সুস্থতা সম্বন্ধে একটু চিন্তিত না হয়ে পারলেন না।

ডাঃ ওয়েবের নিজের স্বতন্ত্র পরীক্ষাগারের কয়েকটা অত্যন্ত মূল্যবান দুর্লভ যন্ত্রপাতি পরপর আশ্চর্যভাবে চুরি হয়ে গেল। এসব সূক্ষ্ম বিশেষ যন্ত্রপাতি ডাঃ ওয়েব নিজেই অনেক যত্নে তৈরি করিয়েছিলেন। ডাঃ ওয়েব আর নেভিল সেমুর ছাড়া আর কেউ সেগুলির খবরই রাখত না।

যন্ত্রগুলি উধাও হয়ে যাবার পর নেভিল সেমুর অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ডাঃ ওয়েবকে সে কথা জানান।

ডাঃ ওয়েব প্রথমটা চমকে ওঠেন। ওসব যন্ত্র ল্যাবরেটরি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার বলে রীতিমত উদ্বেগও দেখান। কিন্তু তার পরেই যেন সমস্ত ব্যাপারটা ভুলেই যান।

সবকিছু এমনি ভুলে যাওয়া তাঁর একটা রোগই হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন। ডাঃ ওয়েবের মর্যাদার খাতিরে নেভিল সেমুরকে তখনকার মতো এ যন্ত্র চুরির ঘটনাটা চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক কমিটির কাছ থেকে। চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে আরো একটা ব্যাপারও।

ডাঃ ওয়েবের নিজস্ব গবেষণা বিভাগের সাধারণ খরচাপাতির জন্যে একটা আলাদা তহবিলের ব্যবস্থা আছে। ডাঃ ওয়েব নিজেই দরকার মতো তা ব্যবহার করেন। সেমুরকে শুধু তার হিসেবটা রাখতে হয় মাত্র। বেশ কিছুদিন ধরে ডাঃ ওয়েব সেমুরকে কোনো হিসেব কিন্তু দেন নি।

বাৎসরিক হিসেবপত্র দেখার সময় হয়ে এসেছে বলে সেমুর ওই তহবিলের খাতাপত্র ঠিক করে রাখার জন্য একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেও ডাঃ ওয়েবের মানসিক

অবস্থার কথা ভেবে যতদিন সম্ভব তাঁকে কিছু বলাটা মুলতুবিই রেখেছিলেন।

ডাঃ ওয়েবের মানসিক অবস্থা যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, তার বেশ স্পষ্ট আভাসই তখন সেমুর পেতে আরম্ভ করেছেন।

একদিন তিনি হঠাৎ অত্যন্ত ফ্যাকাশে মুখে সেমুরকে তাঁর ঘরে ডেকে বললেন,—জানো, আমার গবেষণা ওরা বন্ধ করে দেবে।

বন্ধ করে দেবে? সেমুর অবাক হয়ে বলেছিলেন,—বন্ধ করবে কেন? সেরকম কোনো নির্দেশ ওদের কাছ থেকে কি এসেছে?

আসে নি। তবে আসবে আমি জানি।—হাতের কাজটা তাঁর টেবিলের ড্রয়ারে ভরে রেখে ডাঃ ওয়েব কেমন একটু অপ্রকৃতিস্থের মতো তীব্র গলায় তারপর বলেছিলেন—আমার গবেষণা কিন্তু আমি চালাবই। পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই—তা বন্ধ করে।

এর পরই হঠাৎ হেসে উঠে প্রসঙ্গটা বদলে ডাঃ ওয়েব তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছেন,—আচ্ছা নেভিল, খুব লম্বা ছুটি যদি পাও, কিরকম জায়গায় সে ছুটি কাটাতে তোমার ইচ্ছে করে বলো ত?

সেমুর যা হোক একটা উত্তর দিয়ে তখন ডাঃ ওয়েবের কাছে বিদায় নিয়েছিলেন কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা গভীর অস্বস্তিই তিনি তখন বোধ করছেন।

ডাঃ ওয়েব যে কাগজটা পড়তে পড়তে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন ও খানিক বাদে নিজের ড্রয়ারে সেটা তুলে রেখেছিলেন, সে কাগজটার নাম সেমুর তখন লক্ষ্য করতে ভোলেননি। পরে কাগজটার সেই সংখ্যা কিনে পড়ে ডাঃ ওয়েবের অস্থিরতার একটা কারণ অন্ততঃ তিনি বার করতে পেরেছিলেন।

কাগজটায় ডাঃ ওয়েব যে গবেষণা চালাচ্ছিলেন সেই জাতীয় আর একটি গবেষণার বিষয়ে একটা খবর ছিল। খবরটা এক দিক দিয়ে বিচলিত করবার মতো। যে বৈজ্ঞানিক সম্বন্ধে খবরটা বেরিয়েছিল তাঁর নাকি এক ‘ভাইরাস্‌’-এর ভেতরকার ডিএনএ বদলাবার প্রক্রিয়াসার্থক করে তোলার আর খুব দেরী নেই।

তাঁর এ চেষ্টা সফল হলে হয়ত পৃথিবীর সমস্ত মানুষের পক্ষে সর্বনাশা কোনো ‘ভাইরাস’-এর উদ্ভব হতে পারে ভয় করে বৈজ্ঞানিক মহল আর সরকারী তরফ থেকে তাঁকে এ গবেষণা বন্ধ করতে বলার প্রস্তাব হচ্ছে—এইটেই ছিল পত্রিকাটির খবর।

এই খবরটিতেই ডাঃ ওয়েব অত বিচলিত হয়েছেন বুঝে এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একটু আলাপ করার ইচ্ছে সেমুরের ছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর তাঁর মেলেনি।

এই ঘটনার পর দিনই হঠাৎ ডাঃ ওয়েব একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।

সে প্রায় মাস পাঁচেক আগের কথা।

তাঁর মানসিক অবস্থা ঠিক স্বাভাবিক না হলেও ডাঃ ওয়েব হঠাৎ এমন একটা কাণ্ড করে বসতে পারেন আর কেউ ত নয়ই নেভিল সেমুরও তা ভাবতে পারেননি।

প্রথমে তাই তিনি কোনো দুর্বৃত্তদলের খর্পরে পড়েছেন এই কথাই ভেবেছে সবাই। কিন্তু পুলিশ আর পেশাদারী গোয়েন্দারা সে রকম কোনো হদিসই পায়নি।

ল্যাবরেটরির খরচাপত্রের হিসেবে গরমিল, সেখানকার দামী যন্ত্রপাতি চুরি যাওয়া, এসব ব্যাপার রিসার্চ সেন্টারের কর্তাদের কাছে আর চাপা থাকেনি এরপর।

ডাঃ ওয়েবের আগেকার সুনামের খাতিরে আর নেভিল সেমুরের অনুরোধে পরিচালক কমিটি শুধু এ খবরগুলো চাউর হতে দেননি। নেভিল সেমুরকে তাঁর গুরুর সন্ধান করবার সময় দিয়ে ফলাফলের জন্যে অপেক্ষা করেছেন।

সেমুর কিন্তু গোড়ায় সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে সব দিকেই সম্পূর্ণ বিফল হয়েছেন। সত্যি সত্যিই মানুষটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছে তাঁর।

এমনি ভাবে ছমাস কাটবার পর কমিটি যখন নেভিল সেমুরের সঙ্গেই পরামর্শ করে, আর কিছুদিন নীরব থেকে সব দিক বাঁচাবার জন্যে ডাঃ ওয়েবের যে কোনো রকম অপঘাত-মৃত্যু ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত করেছেন তখনই ক্ষীণ দুর্বোধ সেই একটু হদিস যেন মিলল।

সখের রেডিও যন্ত্র বানিয়ে অজানা বেতার তরঙ্গ ধরা আর পাঠানো যাদের খেলা, তেমনি ক’জন ‘হ্যাম’ রেডিও-যন্ত্ৰী কয়েকদিন ধরে একটা অদ্ভুত বার্তা তাদের যন্ত্রে পাবার পর কয়েকটি খবরের কাগজে তার একটু বিবরণ বার করেছিলেন।

নেভিল সেমুরের নিজের মুখে তার পরের কাহিনীটুকু এই—

হ্যাম রেডিও-যন্ত্রীদের একজনের সেই একটা বিবরণ দৈবাৎ আমার চোখে পড়ে যায়। তার ভেতর ডাঃ ওয়েবের কোনো হদিস আছে এ কথা বিশ্বাস করা অবশ্য আমার পক্ষে খুবই শক্ত।

রেডিও-সংবাদটা এই—এনএএস, এনএএস, পিআর চৌত্রিশ, শীগগির এসো, সতেরো পয়েন্ট আঠারো এন, ছিয়াশি পয়েন্ট চল্লিশ ডব্লিউ। পিআর চৌত্রিশ, পিআর চৌত্রিশ।

এ সংবাদের দুটো টুকরো অংশ কিন্তু আমার খুব অদ্ভুত লাগে। একটা হ’ল, পিআর চৌত্রিশ, আর অন্যটা এনএএস, এনএএস বলে ডাক।

এই দুটির মধ্যে কোনো মূল্যবান ইঙ্গিত কি থাকতে পারে না?

পিআর চৌত্রিশ ইঙ্গিতটা বিশেষ করে আমায় ভাবিয়েছে। পিআর চৌত্রিশ মানে কি প্রোজেক্ট চৌত্রিশ? সেটা ডাঃ ওয়েবের এবারের গবেষণার ক্রমিক সংখ্যা। তাহলে এনএএস ডাকের মানে কি? এনএএস কি তাহলে আমি?

নিশ্চয়, নিশ্চয় তাই। আমি যে শুধু নেভিল সেমুর নয়, নেভিল আর্থার সেমুর যে আমার পুরো নাম, আর সংক্ষেপ করবার জন্যে মাঝখানের আর্থার অংশটা যে আমি বাদ দিয়েছি, একথা ডাঃ ওয়েব ছাড়া খুব কম লোকই জানে।

নিজের গবেষণা পরীক্ষায় সংখ্যা দিয়ে আমাকেই তাহলে ডাঃ ওয়েব যে ডাকছেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ আমার আর রইল না।

কিন্তু ডাকছেন কোথায়? বোঝাই ত যাচ্ছে যে সতেরো পয়েন্ট আঠারো এন আর ছিয়াশি পয়েন্ট চল্লিশ ডব্লিউ-এ। ওগুলো হল অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমার নির্দেশ। অক্ষাংশ হ’ল সতেরো পয়েন্ট আঠারো এন মানে নর্থ অর্থাৎ উত্তর আর দ্রাঘিমা হল ছিয়াশি পয়েন্ট চল্লিশ ডব্লিউ মানে ওয়েস্ট অর্থাৎ পশ্চিম।

জায়গাটার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাবার পর একমুহূর্ত আর দেরী করিনি।

বাইরের কাউকে কোনো কথা বলবার নয়। তা না হলে সরকারী ভৌগোলিক দপ্তর থেকে ওই অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমার নির্ভুল অবস্থানটা জেনে নিতে পারতাম।

তার বদলে সেটা নিজেই কষ্ট করে কষে নিয়ে একলা একটা হেলিকপ্টার ভাড়া করে সেইদিন বিকেলেই রওনা হয়ে গেছি। সঙ্গী হিসেবে নিয়েছি কোনো মানুষ নয়, আমার নিজের অ্যালসেশিয়ান কুকুরটিকে শুধু।

কি রকম বিপদে পড়ে ডাঃ ওয়েব ডাক দিয়েছেন তা’ত জানি না। তবে সে রকম দরকার হলে প্রাণ দিয়ে যোঝবার জন্যে আমার অ্যাসেশিয়ান ববের চেয়ে প্রভুভক্ত ও বিশ্বাসী আর কাউকে যে পাব না সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সমুদ্রের ধারের শহর বেলিজ। সেখান থেকে ঠিকানাটা বেশী দূরে নয়। অক্ষাংশ দ্রাঘিমা কষেই আমি বুঝেছিলাম জায়গাটা বেলিজের একটু দক্ষিণপূর্বে টার্ণেফ দ্বীপটা ছাড়িয়ে লং কে নামে ছোট ছোট দ্বীপবিন্দুর একটা।

দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে ডাঃ ওয়েব কেন যে এই যমের অরুচি দ্বীপের বিন্দুতে গিয়ে উঠেছেন তা বোঝাই শক্ত।

দ্বীপ-বিন্দুতে নামতে গিয়েই তা অবশ্য বুঝলাম।

হেলিকপ্টারটা নামবার সময়েই দেখতে পেলাম জনমানবহীন দ্বীপটা সমুদ্রের বুকে কটা ঢিবি তোলা এক বিন্দু মরুভূমি বললেই হয়। এক দিকে একটা বড় টিনের চালা গোছের দেখে সেটা ডাঃ ওয়েবের বাসস্থান আর ল্যাবরেটরি বলে বুঝলাম। হেলি থেকে নেমে সেদিকে ববকে সঙ্গে নিয়ে যেতে যেতে ডাঃ ওয়েবের

এ রকম একটা দ্বীপে এসে ওঠবার কারণটা একেবারেই অস্পষ্ট রইল না।

ডাঃ ওয়েবের ভয় ছিল তাঁর গবেষণা হয়ত ওপরওয়ালাদের চাপে আর খবরের কাগজের আন্দোলনে তাঁকে বন্ধ করতে হবে। তাই তিনি একেবারে গোপন নিরিবিলি এমন একটি জায়গা খুঁজেছিলেন যেখানে কেউ তাঁর কাজে বাধা দিতে পারবে না। সেদিক দিয়ে এই দ্বীপের বিন্দুটি যে আদর্শ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

বেলিজ-এ যখন থেকে তাঁর অস্থিরতা আমার চোখে পড়েছে সেই সময় থেকেই এই দ্বীপের গোপন আস্তানার তিনি ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই জন্যেই মাঝে মাঝে তিনি হঠাৎ কাজে কামাই করে উধাও হয়ে যেতেন। সেই জন্যেই ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি সরানো থেকে আরো অনেক অন্যায় করতেও তিনি পেছপা হননি।

কিন্তু এত সব করে উদ্দেশ্য সফল হবার পর এখন হঠাৎ এমন কি বিপদ তাঁর হল যাতে সাঙ্কেতিক ভাষায় হলেও রেডিও তরঙ্গে প্রায় আর্তনাদ করে আমায় ডেকে পাঠাতে হয়েছে?

দ্বীপটির চারিদিকে চেয়ে সে রকম কোন চিহ্নই পাচ্ছি না। চারদিকের শান্তিময় নিস্তব্ধতার মধ্যে দ্বীপ-ঘেরা সমুদ্রের ঢেউ-এর শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

আমার হেলিকপ্টারে দ্বীপে পৌঁছোবার পর ডাঃ ওয়েব আমাকে অভ্যর্থনা করতে আসেন নি এইটিই একমাত্র একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তাতে ত তিনি অসুস্থ বা কোন রকমে আহত বলেই আসতে পারেন নি বলে বোঝা উচিত। এমন করে আমায় ডেকে পাঠাবার কারণও হয়ত তাই ছাড়া আর কিছু নয়।

টিনের চালাটার সামনের কামরায় ঢোকার পরই কিন্তু থমকে দাঁড়াতে হল। এইটেই ডাঃ ওয়েব গবেষণা করবার ল্যাবরেটরি ঘর বলে বোঝা গেল। কিন্তু সমস্ত ঘরের ভেতরে যেন একটা ভূমিকম্প হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি জিনিসপত্র সব ভাঙাচোরা ওল্টানো। মেঝের ওপরে যেন কোনো উন্মাদের হাতের কুড়ুলে করাতে কাটা-চেরা কিছু কাঠের চিবোনো গোছের টুকরো।

কামরাটার ত’ এই অবস্থা। ডঃ ওয়েব তাহলে কোথায়!

তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। কামরার ভেতরটা বেশ অন্ধকার। পকেট টর্চটা জ্বালিয়ে একটু ঘোরাতেই কামরায় একমাত্র অক্ষত ও খাড়া হয়ে থাকা স্টীলের ছোট টেবিলটার ওপর কালো কালিতে যেন আঙ্গুল দিয়েই ধ্যাবড়া করে লেখা নির্দেশটা পড়তে পারলাম!

নেভিল, এ লেখা পড়ছ মানে এসেছ। এখুনি কামরায় কোণের ছোটো সিন্দুকটা খুলে আমার গবেষণা আর আবিষ্কারের পুরো বিবরণের ফাইলটা বার করে নিয়ে পালাও। এক মুহূর্ত দেরী কোরো না—তারা এতক্ষণে না এসে থাকলে এল বলে।

আমার জন্যে ভেবো না। আমি লুকিয়ে থাকবার বৃথা চেষ্টা করলেও সব সাহায্যের বাইরে সব আশার অতীত হয়ে ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছি। যাও!

সিন্দুক খোলার নম্বর এল, এল, শূন্য সাত শূন্য এক শূন্য তিন।

এক মুহূর্ত আমি আর দেরী করিনি। কিন্তু সিন্দুকটা খোলায় গোলমাল হয়েছে। ডাঃ ওয়েবের লিখে রাখা নম্বর অনুসারে চাকতি ঘোরাতেও সিন্দুকের দরজা খোলে নি। আমি অস্থির হয়ে বারবার নম্বর ঘুরিয়েছি। কিছু হয়নি তাতেও।

তারপর মনে হয়েছে টেবিলের ওপরে লেখা নম্বর পড়তে কি আমার কোনো ভুল হয়েছে। ধ্যাবড়া কালিতে লেখা একটা সাত আসলে এক।

আবার নতুন করে নম্বরের চাকতি ঘোরাতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠেছি।

পাহারায় থাকবার জন্যে আমার অ্যালসেশিয়ান ববকে কামরার বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিলাম।

হঠাৎ তার এ কি অদ্ভুত চিৎকার!

চিৎকারটা যেন রাগের গর্জন আর ভয়ের আর্তনাদে মেশানো!

উঠতে গিয়েও উঠলাম না। সিন্দুক খুলে ডাঃ ওয়েবের কাগজগুলো উদ্ধার না করলেই নয়! নম্বর ঘোরাতে আমার তখন ভুল হয়ে গেছে। জোর করে একাগ্র হয়ে আবার সিন্দুক খোলায় মন দিলাম।

আর তখনই সেই বীভৎস ভয়ঙ্কর বন্যা গায়ের ওপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কামরার ভেতরটা তখন রীতিমত অন্ধকার হয়ে গেছে। তারই ভেতর সমস্ত শরীরে কেমন কোমল রেশমী স্পর্শ আর অসংখ্য দংশনের তীব্র জ্বালা মেশানো অবিশ্বাস্য অনুভূতির সঙ্গে একটা অদ্ভুত ধবলতার আভাসই চোখে পড়ল।

বাইরে আবার ববের চিৎকারটা তখন আর গর্জন নয়, শুধু আর্তনাদ বলেই মনে হচ্ছে।

কেমন করে জানি না, কোন রকমে সিন্দুকটা খুলতে পেরে ভেতরের ছোট চামড়ায় ফোলিওটা বার করে নিয়ে সিন্দুক বন্ধ না করেই ছুটে বাইরে বার হলাম।

যেমন করে হোক হেলিকপ্টারে গিয়ে পৌঁছোনো ছাড়া আর রক্ষা পাবার কোনো উপায় নেই!

কিন্তু হেলি পর্যন্ত কি পৌঁছোতে পারব? ঢেউ-এর পরে ঢেউ হিংস্র বীভৎস ভয়ঙ্কর এক ধবলতার বন্যা আমার গায়ে আছড়ে পড়ছে। আত্মরক্ষা করে সে বন্যা ঠেলে অগ্রসর হওয়া প্রায় অসম্ভব। প্রাণপণে যুঝেও আমার বব তখন হার মেনেছে। রক্তাক্ত শরীরে হেলিকপ্টারটায় কোন রকমে পৌঁছোবার সময়েই এক লহমার দৃষ্টিতে দেখতে পেলাম শেষ করুণ একটা আর্তনাদের সঙ্গে সেই বন্যার মধ্যে বব একেবারে তলিয়ে গেল।

কোন রকমে হেলিতে উঠে আমি তখন সেটা চালাতে পেরেছি। আর কিছুই তখন আমার করার সাধ্য নেই।

হেলিকপ্টার নিয়ে বেলিজ-এ নির্বিঘ্নেই তারপর পৌঁছোলাম। ডাঃ ওয়েবের আশ্চর্য গবেষণার সমস্ত বিবরণও তখন আমার হাতে। যেমন করে হোক শেষ পর্যন্ত তা আমি উদ্ধার করেছি।

কিন্তু সেই জন্যেই তীব্র অনুশোচনায় তখন আমায় আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে হয়েছে।

তাঁর কাগজ-পত্র উদ্ধারের আগে স্বয়ং ডাঃ ওয়েবকে খুঁজে ফিরিয়ে আনবার কেন আমি চেষ্টা করিনি। সিন্দুক খুলে তাঁর গবেষণার বিবরণ বার করতে যা সময় লেগেছে তার মধ্যে ডাঃ ওয়েবকে হয়ত খুঁজে বার করে আমার হেলিতে তুলে আনতেপারতাম।

পারি না পারি সেই চেষ্টাই আমার করা উচিত ছিল। তার বদলে ক্ষমাহীন নিবুর্দ্ধিতায় আমি আগে তাঁর গবেষণার বিবরণ উদ্ধার করতেই ব্যস্ত হয়েছি।

পরের দিন সকালেই ডাঃ ওয়েবের দ্বীপবিন্দুর ধবল বিভীষিকার সঙ্গে যোঝবার মতো অস্ত্র-শস্ত্র ও রাসায়নিক উপকরণ নিয়ে অন্য একটি হেলি ভাড়া করে সেই দ্বীপে আবার গিয়ে নেমেছি। দিনের আলোয় চারিদিক নিতান্ত শান্তিময়।

কিন্তু তখন বড় বেশ দেরী হয়ে গেছে।

আগের দিন বিকেলে হেলিকপ্টার যেখানে নামিয়েছিলাম তার কাছেই আমার ববের কঙ্কালটা শুধু পড়ে আছে। সে কঙ্কালটাও আস্ত নয়। তার মাংসটাংস সব ত বটেই তার হাড়গুলোও যেন কিসে চিবিয়ে খাবার চেষ্টা করছে।

ডাঃ ওয়েবের মৃতদেহ কিন্তু অক্ষত না হলেও সম্পূর্ণ আকারে পেয়েছি টিনের চালগুলির শেষপ্রান্তের একটি কুঠুরিতে স্টীলের এক টেবিলের ওপর।

কেন যে তাঁর শবদেহের আমার ববের দশা হয়নি তা সেই কুঠুরিতে ঢোকার পরই বোঝা গেছে।

কুঠুরিতে তীব্র এক রাসায়নিক গন্ধ। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ডাঃ ওয়েব অতি উগ্র কোনো রাসায়নিক ওষুধ তাঁর সর্বাঙ্গে মেখে নিয়েছিলেন। হিংস্র-বিভীষিকায় ধবল বন্যা তাই তাঁর দেহকে স্পর্শ করতে পারে নি।

দ্বীপটির ওপর সর্বত্র ছোটবড় অসংখ্য ফাটল। তারই একটা ফাটল চওড়া করে খুঁড়ে নিয়ে মিঃ ওয়েবের শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করেছি।

দ্বীপের ফাটলগুলি দেখতে দেখতে আর একটা সন্দেহ যা মাথায় এসেছে, বেলিজে ফিরে যাবার পর তা সত্য বলে প্রমাণ করেছি।

প্রথম হেলিকপ্টার যে কোম্পানী থেকে ভাড়া করেছিলাম তাদের সম্পূর্ণ ভাড়া চুকিয়ে দিতে যাবার পর তারা ভাড়ার অতিরিক্ত কিছু ক্ষতিপূরণ চেয়েছে।

হেলিকপ্টারের চালকের সীটের তলায় নাকি বেশ কিছু রক্তের দাগ ছিল।

আর তা ছাড়া এটি কোথা থেকে জোটালেন?—বলে তাদের কর্মচারী যা আমাকে তুলে ধরে দেখিয়েছে, তা দেখবার পর উপরি ক্ষতিপূরণ দিতে আমি কিছুমাত্র আপত্তি করিনি।

যে জিনিসটি কর্মচারী আমায় দেখিয়েছিল তা একটি বিরাট আকারের মরা সাদা ইঁদুর। যে মোটা ব্লু জীন-এর প্যান্ট আমায় খানিকটা রক্ষা করেছে তারই ভেতর কেমন করে ঢুকে পড়ে আমার পা কামড়ে ধরেছিল। তারপর ওই অবস্থায় মারা গিয়ে ‘হেলি’র মধ্যে পড়ে গিয়েছে।

হ্যাঁ ওই সাদা ইঁদুরই ডাঃ ওয়েবের গবেষণার উপাদান আর অভিশাপ।

ডঃ ওয়েব এক সম্পূর্ণ নতুন কৌশলে প্রাণীদেহের জননকোষের কিছু জীন-এর পরিব্যাপ্তি বা মিউটেশন ঘটাবার পদ্ধতি আবিষ্কার করে এই সাদা ইঁদুরদের ওপরেই তা প্রয়োগ করেছিলেন। তাঁর গবেষণা বাইরের চাপে বন্ধ হয়ে যেতে পারে ভয় করে তিনি লং কে-র এই দ্বীপবিন্দুতে গোপনে তাঁর পরীক্ষা চালানোর আয়োজন করেন। কিন্তু খোদায় ওপর খোদকারীর এ চেষ্টা সর্বনাশা হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে যায়।

এমনিতেই ইঁদুরদের বংশবৃদ্ধি অত্যন্ত বেশী। ডাঃ ওয়েবের পরীক্ষায় তাদের সে বংশবৃদ্ধি বহুগুণ ত হয়ে যায়ই, তারা হিংস্র ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে কিছুদিনের মধ্যেই।

তার ল্যাবরেটরির খাঁচা কেটে ভেঙে বেরিয়ে তারা দ্বীপের ফাটলগুলির মধ্যে আশ্রয় নেয়। তারপর কোন রহস্যময় কারণে নিশাচর হয়ে উঠে দিনের পর দিন ক্রমেই অগণন হয়ে উঠে দ্বীপের অন্য প্রাণীকে শেষ করে ল্যাবরেটরিতে পর্যন্ত হানা দিতে শুরু করে।

ডাঃ ওয়েব প্রথমে তাদের সামলাবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন, তারপর উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে বেতার ট্রান্সমিটারে তিনি আমাকে সাহায্যের জন্যে ডাকেন।

তাঁর গবেষণার কাগজগুলি উদ্ধার করা ছাড়া আমি তাঁকে কোন সাহায্যই কিন্তু করতে পারিনি। দ্বিতীয়বারের পরও আমি অবশ্য আরো কয়েকবার হেলিকপ্টারে ও দ্বীপবিন্দুতে গিয়েছি ও তীব্র তরল বিষ ঢেলে দ্বীপের ফাটলগুলির মূষিকবংশ নির্মূল করবার ব্যবস্থা করেছি। আমি কিছু না করলেও অবশ্য কিছুদিনের মধ্যে খাদ্যের অভাবে নিজেদের মধ্যে মারামারি করেও মৃত্যুদূতেরা ধ্বংস হয়ে যেত।

শেষবার চলে আসবার সময়ে যে মোটর-বোটে ডাঃ ওয়েব ও দ্বীপে তাঁর

গবেষণার সাজ-সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে গিয়ে উঠেছিলেন সেটিও আমি ডুবিয়ে দিয়ে এসেছি। তিনি জলে ডুবে মারা গেছেন রটনা করবার জন্যই এ কাজটা করতে হয়েছে।

ডাঃ ওয়েবের কাছে ঋণ আমার অনেক। আমি এ সম্মেলনে তাঁর নাম জানিয়েই তাঁর গবেষণার বিবরণ পড়ব বলে ঠিক করে এসেছি।

.

নেভিল সেমুর বিষন্ন মুখে তার কথা শেষ করবার পর ডাঃ হালদার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেছেন।

তারপর ধীরে ধীরে তিনি বলেছেন,—আপনাকে একটা অনুরোধ আমি করতে চাই মিঃ সেমুর!

কি অনুরোধ?—বলে সেমুর একটু বিস্মিতভাবে ডাঃ হালদারের দিকে তাকিয়েছেন।

আমার অনুরোধ এই যে ডাঃ ওয়েবের গবেষণার এ বিবরণ এখানে পড়বেন না। এখানে নয় অন্য কোথাও নয়। এসব কাগজ আপনি নষ্ট করে ফেলুন। সৃষ্টি আর জীবনের কিছু রহস্য এখনো আমাদের জানবার বুঝি সময় আসেনি। তা জানতে গিয়ে কল্যাণের বদলে মানুষের সর্বনাশই আমরা ডেকে আনতে পারি।

কথাগুলো বলে ডাঃ হালদার মিনতির দৃষ্টিতে সেমুরের দিকে তাকিয়েছেন। সেমুর তাঁর অনুরোধ রেখেছেন। পরের দিন সম্মেলনে তাঁকে আর দেখা যায়নি। আকস্মিক এক পারিবারিক বিপদের অজুহাতে তিনি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে গেছেন।

.

প্রথম প্রকাশ: ফ্যান্টাসটিক, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *