শকুন্তলার উৎস সন্ধানে
কালিদাস যে ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ নাটকখানি লিখেছেন, তার বিষয়বস্তু যদি দুষ্যন্ত-শকুন্তলার প্রেমকাহিনি না হয়ে অন্য কিছু হত, তাহলেও অসুবিধে ছিল না, কেননা যে শিল্পবোধে মেঘদূতের মতো অসাধারণ কাব্যের জন্ম হয়েছে, যে শিল্পবোধে রঘুবংশ মহাকাব্যের জন্ম হয়েছে, সেই শিল্পবোধের ছোঁয়ায় যে-কোনো বিষয়ের কাব্য-নাটক—উগ্রং প্রসাদিগহনং বিকৃতঞ্চ বস্তু—রসসিক্ত হয়ে উঠতে পারত। দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনি আকরিক অবস্থায় কালিদাস যেমনটি পেয়েছিলেন, তাকে অবিকৃত রেখে একখানা নাটক তৈরি হলে—কী আর এমন হত—সাধারণ, বর্ণহীন, গতানুগতিক! সবচেয়ে বড় কথা, নাটকের মুখ্য চরিত্রগুলির মানসিক গঠন যদি সেই আকরিক অবস্থার মতোই হত, তাহলে সারা অভিজ্ঞানশকুন্তল জুড়ে আমরা নায়ক-নায়িকার তুমুল ঝগড়াঝাঁটি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেতাম না।
আপনারা হয়তো জানেন—রবীন্দ্রনাথ যে ‘শ্যামা’ নামে নৃত্যনাটিকাটি লিখেছেন, সেই নৃত্যনাটিকার শ্যামা নায়িকা কিন্তু আদতে এক খুনি মহিলা, যে গণিকাও বটে। আপন সুখ এবং সুবিধের জন্য তার ঘরে-আসা পুরুষকে খুন করতে তার বাধে না। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাকে কীই না বানিয়েছেন—নাটিকার শেষে আত্মসমর্পিতা শ্যামার জন্য আমাদের মায়া হয়। একইভাবে কালিদাসও তাঁর শকুন্তলাকে তার মৌল আকরিক অবস্থা থেকে একেবারে যথার্থ নায়িকাটি করে তুলেছেন। মণিকার যেমন অঙ্গার-কলুষিত প্রস্তরখণ্ডটিকে অতি যত্নে আলোকবিচ্ছুরণক্ষম উজ্জ্বল হীরকখণ্ডে পরিণত করেন, কালিদাসও তেমনি পুরাণ-ইতিহাসের আকর থেকে গ্রাম্যতাদোষদুষ্ট শকুন্তলাকে তুলে এনে বৈদগ্ধে, ব্যঞ্জনায়, রসে, ভাবে উদ্ভাসিত করে তাঁকে একেবারে নাটক-রচনার প্রোজ্জ্বল কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বস্তুত, দুষ্যন্ত এবং শকুন্তলার কাহিনিটি এতই প্রাচীন যে, প্রায় সবগুলি মুখ্য পুরাণেই তাঁদের প্রণয়কাহিনি পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে তাঁদের আপাতিক দুর্ভাগ্যের পর পুনর্মিলন কাহিনিও। কালিদাস অবশ্য পঞ্চলক্ষণ পুরাণের রাজবংশ বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার থেকে তাঁর নাটকের কাহিনি সংগ্রহ করেননি। নাটক-রচনায় তাঁর প্রধান উপজীব্য ছিল মহাভারতের অন্তর্গত শকুন্তলা-দুষ্যন্তের কাহিনি। কিন্তু পুরাণগুলির আলাপ এবং ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে, দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনি মহাভারতের থেকেও প্রাচীন। বিশেষত দুষ্যন্ত যে শকুন্তলাকে বিয়ে করার পর একসময় সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছিলেন—এই ঘটনার প্রসঙ্গে পুরাণগুলিই এমন দু-একটি প্রাচীন শ্লোক উদ্ধার করেছে যে, সেই শ্লোক বা শ্লোকগুলি সমস্ত পুরাণগুলিতেই একরকম। পুরাণকারেরা বলেছেন যে, এই শ্লোকগুলি নাকি দেবতারা গান করেন—দেবৈঃ শ্লোকো গীয়তে। লক্ষণীয় বিষয় হল—’পুরাণগুলির মধ্যে যখনই এমন উল্লেখ থাকে অর্থাৎ যেমন—’দেবতারা এই শ্লোকটি গান করেন’ অথবা ‘গানটি শোনা যায়’—ইতি শ্রূয়তে, অথবা ‘এখানে গাথা আছে’—তখনই বুঝতে হবে যে, ওগুলি হল ‘‘Allusions to matters that are handed down from very ancient times, long before the original purana was compiled.’’ (F. E. Pargiter).
রাজবংশের পরম্পরার মধ্যে, যেখানে একের পর এক রাজনাম কীর্তন করা হচ্ছে, সেখানে যেই দুষ্যন্তের পুত্র ভরতের নাম এল, সঙ্গে-সঙ্গে পুরাণকারেরা বলে উঠলেন—ভরতের নাম ভরত কেন হল, সে সম্বন্ধে দৈববাণী শোনা যায়। দুষ্যন্ত যখন শকুন্তলার সঙ্গে আপন বিবাহের কথা অস্বীকার করেন, তখনই নাকি আকাশ থেকে এই দৈববাণী শোনা গিয়েছিল। দেবতারা দুষ্যন্তের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন—মাতৃগর্ভ—সে তো চর্মপাত্রের আধারমাত্র, পুত্রের ওপর পিতারই অধিকার। পুত্র যার ঔরসজাত, সে তার স্বরূপ। দুষ্যন্ত! তুমি পুত্রের ভরণ কর, শকুন্তলাকে শুধু শুধু অপমান কোরো না—ভরস্ব পুত্রং দুষ্যন্তে মাবমংস্থাঃ শকুন্তলাম। দেবতারা আরও বললেন—হে নরদেব! ঔরসজাত পুত্র পিতাকে যমগৃহ থেকে উদ্ধার করে। তুমিই এই পুত্রের কারণ, তুমিই শকুন্তলার গর্ভাধান করেছ—শকুন্তলা ঠিক বলেছে—তঞ্চাস্য ধাতা গর্ভস্য সত্যমাহ শকুন্তলা।
মাত্র এই দুটি শ্লোক থেকেই শকুন্তলা-দুষ্যন্তের কাহিনির পূর্বাপর বৃত্তান্ত একঝলকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এই শ্লোকদুটি প্রমাণ করে যে, শকুন্তলা-দুষ্যন্তের কাহিনি রীতিমতো লোকস্তরে প্রচলিত ছিল। দুষ্যন্তের দ্বারা বিবাহিতা শকুন্তলার প্রত্যাখ্যানের ঘটনা—এই শ্লোক দুটিতে যেমন পরিষ্কার, তেমনি পরিষ্কার যে, রাজা দুষ্যন্ত কোনো কারণে তাঁর আপন শিশুপুত্রকে অস্বীকার করছেন এবং অন্যেরা তাঁকে এ-ব্যাপারে সাবধান হতে বলছে। একেবারে লোকস্তরে প্রচলিত এই শ্লোকদুটিকে পুরাণে কথকঠাকুর সূত-মাগধেরা প্রত্যেকটি মুখ্য পুরাণের মধ্যে সন্নিবেশ করেছেন—আনুপূর্বিক ঘটনা কিচ্ছুটি না বলে। মৎস্যপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বায়ুপুরাণ, হরিবংশ—প্রত্যেকটি জায়গায় এই শ্লোকদুটি অবিকৃত এবং প্রসঙ্গও সেই এক—ভরতের নাম ভরত কেন হল? দেবতারা আকাশ থেকে বলেছিলেন—’ভরস্ব পুত্রং দুষ্যন্ত’—এই ‘ভরস্বের’ প্রথমদুটি বর্ণ ‘ভর’ এবং দুষ্যন্তের শেষ বর্ণ ‘ত’—এই তিনটি বর্ণ নিয়েই ভরত।
আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই শ্লোকদুটিই দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনি এবং তাঁদের পুত্রনামের বীজরূপ। স্বয়ং মহাভারতকারও এই শ্লোকদুটিই মাথায় রেখেছিলেন, কেননা, তিনিও এই শ্লোকদুটি উদ্ধৃত করতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তাঁর বিশেষত্ব হল—তিনি এই শ্লোকদুটির সমস্ত ইঙ্গিতগুলি কাজে লাগিয়ে, পূর্বাপর বৃত্তান্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে নিখুঁত গৃহিণীপনায় পাঠকের কাছে একেবারে উপাখ্যানের আকারে উপস্থিত করেছেন এবং তা থেকে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছেন কবি কালিদাস।
তবে হ্যাঁ, মহাভারতের কাছে কালিদাস যত ঋণীই হোন, মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে কালিদাসের নাট্যকল্পনার আকাশ-পাতাল তফাত আছে। নাটকের নায়ক-নায়িকার স্বভাব এবং কথাবার্তার ভঙ্গিও মহাভারতের জগৎ থেকে আলাদা। ‘উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে কাননঘেরা বাড়ি’তে বসে কালিদাস যে কথা, যে ভাব, যে স্ত্রী-আচার কল্পনাও করতে পারেন না, মহাভারতের কবি কিন্তু তা অনায়াসে পারেন। কারণ ব্যাসের হৃদয় যে সর্বাশ্লেষী—সেখানে সবাই স্ব-স্বরূপে দাঁড়িয়ে আছে—লজ্জাহীন আবরণহীন।
কালিদাস নাটকীয় মুহূর্তে—ধনুকবাণ হাতে, রথে-চড়া দুষ্যন্তের প্রবেশ সূচনা করে নাটক আরম্ভ করলেন, আর মৃগয়াবিহারী দুষ্যন্ত একা-একা হরিণের পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে কণ্বমুনির আশ্রমের সীমানায় এসে পড়লেন। কিন্তু মজা হল, এই বনপথে রথ নিয়ে ছোটার জন্য মহাভারতের কবিকে জমি তৈরি করতে হয়েছে প্রায় দুই অধ্যায় ধরে। মহাভারতের দুষ্যন্ত যেভাবে হাজারো সেনাবাহিনী নিয়ে মৃগয়ার তোড়জোড় করেছেন, তার একটা উদ্যোগপর্ব আছে এবং তাকে বাদ দিলে চলে না। কালিদাস তো দুষ্যন্তকে একাকী শকুন্তলার কাছে পাঠানোর জন্য নাটকের প্রথম থেকেই একটি হরিণকে একেবারে প্রাণভয়ে ভীত করে ছুটিয়ে দিয়েছেন। ফলত দুষ্যন্তও সৈন্যসামন্ত ছেড়ে একা হরিণের পিছু-পিছু ধাওয়া করার সুযোগ পেয়েছেন এবং এর শেষ পদক্ষেপ ছিল আশ্রমের মধ্যে নিভৃত রহস্যালাপে মেতে ওঠা শকুন্তলার দেখা পাওয়া।
কিন্তু যে ব্যাসদেব ভারতবর্ষের বিশাল রঙ্গমঞ্চে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘটিয়েছেন, তাঁর ভাবটা সবসময়ই এক বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ঠাকুরদাদার মতো। শূন্যতা, নির্জনতা, দুঁহু-দোঁহা, কানাকানি, চোখ চাওয়া—এসব তাঁর পোষায় না। তাঁর ভাবটা—ওরে কে আছিস? রাজা বেরোচ্ছেন, পাত্র-মিত্র সব কোথায় গেল—এমনিধারা এক হাঁক-ডাকের ব্যাপার। ফলে মহাভারতের দুষ্যন্ত যখন মৃগয়ায় বেরোচ্ছেন, তখন অস্ত্র, যোদ্ধা, হস্তী, অশ্ব, পদাতি, রথী, শঙ্খনাদ এবং সৈন্যদের ‘লেফট-রাইট’ করার কিলকিলা শব্দ যেন রাজপুরী মুখর করে তুলল। কি-না, রাজা মৃগয়ায় বেরোচ্ছেন। ‘আশ্রম-ললামভূতা’ শকুন্তলার সঙ্গে মহারাজের দেখা হবে—এই প্রস্তুতিতে মহাভারতের কবির কোনো দায় নেই, তাঁর কাছে বড় কথা হল—মহারাজ মৃগয়ায় বেরোচ্ছেন। দুষ্যন্তকে মৃগয়া-বিদায় দেবার জন্য পুরনারীরা সব বাড়ির ছাদে ভিড় করেছিল। মহারাজকে দেখে তাদের মনে হয়েছিল বজ্রহাতে পুরন্দর যেন। সপ্রেমে তারা কানাকানি করছিল মহারাজের বীরত্বের কথা—ইতি বাচং ব্রুবন্ত্যস্তাঃ স্ত্রিয়ঃ প্রেমণা নরাধিপম। রাজদর্শনের সন্তোষে তাদের সপ্রেম ফুল ছোড়াছুড়ি রাজার মাথা ছুঁয়েছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছিল মাটিতে।
প্রশস্ত রাজপথের মধ্যে দুষ্যন্তকে দেখার জন্য পুরনারীদের এই মন-মথ ভাব আর আকৃতিকেই মহাভারতের কবি কাজে লাগিয়েছেন। দেখিয়েছেন—দুষ্যন্ত কত কাম্য, রমণীর কাছে কতখানি কাম্য বর-পুরুষ তিনি। এরপরই আরম্ভ হল মৃগয়ার দৃশ্য। তাতে কত যে বাঘ, সিংহ, হাতিঘোড়া মারা পড়ল—তার ইয়ত্তা নেই। দুষ্যন্ত যেন সারা বনকে একেবারে ঘাঁটিয়ে তুললেন—লোড্যমানং মহারণ্যম। বনচরদের খাওয়াদাওয়াও জুটল প্রচুর। সুচতুর কালিদাস মৃগয়ার এই সমস্ত পরিবেশটুকু দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথমে ফুটিয়ে তুলেছেন। অর্থাৎ তিনি এক বনে শিকার শেষ করে আরেক বনে যাচ্ছেন। কিন্তু বেলা যত বাড়ছে রাজার ক্ষুধা-পিপাসাও তত বাড়ছে। দু-এক জায়গায় রাজা বিফলও হলেন। অবশ্য যে বনে রাজা কণ্বমুনির আশ্রম দেখতে পাবেন, যে আশ্রমে তিনি শকুন্তলাকে দেখতে পাবেন, সেখানে প্রবেশের পূর্বেই কিন্তু আবহ পালটে গেল। মহাকাব্যের ‘ফর্মুলা’ মেনে সে বনে শীতল ছায়া, শীতল হাওয়া পাওয়া গেল। ফুলের বাহারে সে বন দৃষ্টিরম্য, সুরভিতে ম-ম। যাঁরা ভট্টিকাব্যের শরদবর্ণনায়—এমন কোনো জলাধার ছিল না যেখানে পদ্ম ফোটেনি, এমন পদ্মই ছিল না যাতে ভ্রমর ছিল না লীন, এমন কোনো ভ্রমর ছিল না যে নাকি গুনগুন করছিল না—এমনি ধারা বর্ণনায় মুগ্ধ হন, তাঁরা জানবেন—ভট্টি মহাশয় তার রসদ পেয়েছেন মহাভারতে। এইমাত্র যেখানে দুষ্যন্ত এসে পৌঁছলেন, সে বনে এমন কোনো গাছই ছিল না যাতে ফুল ফোটেনি—নাপুষ্পঃ পাদপঃ কশ্চিৎ, এমন ফুল-ফলও ছিল না, যেখানে অনুপস্থিত মধুকরের গুনগুন—ষটপদৈ র্নাপ্যপাকীর্ণং ন তস্মিন কাননে বনম।
মহাকাব্যের নায়কের সঙ্গে মহাকাব্যের নায়িকার দেখা হবে, অথচ তার সমারোহভার কিছুই থাকবে না—তা তো হয় না। কাজেই মনোহর প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্যরাশি অনুভব করতে রাজা পৌঁছলেন মালিনীর তীর-ঘেঁষা শান্ত আশ্রমপদে। রাজার পাত্রমিত্র, ধনুকের টংকার সব থেমে গেল, শোনা গেল বিরামহীন ওংকার। কালিদাসের অপূর্ব নাটকীয়তায় কোনো হরিণ এখানে প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে পেছনে তাড়া-করা রাজাকে আশ্রমে প্রবেশ করায়নি। আপন গতিপথেই রাজা আশ্রমে প্রবেশ করেছেন। কালিদাস তো নিজের নায়কটিকে তিন যুবতী রমণীর সামনে একা ফেলে দেবার জন্য তাঁকে পরম আশ্রম-ভক্ত করে তুলেছেন। সেই নাগর-নায়ক জানে যে, অতি বিনীত বেশে তপোবনে প্রবেশ করতে হয়। এমনকী তার জন্য রাজার ধরা-চূড়া, অস্ত্রশস্ত্র সব যেমন ত্যাগ করতে হয়, তেমনি শেষসাথী সারথিটিকেও ত্যাগ করে আশ্রমের পথে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু মহাভারতের দুষ্যন্ত অত কৃপণ নন। তাঁর অমাত্য, পারিষদবর্গ এমনকী পুরোহিতটি পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আছে। মালিনী নদীর তীরভূমিতে কণ্বের আশ্রম—সে যেন ছবিতে আঁকা। বিমোহিত রাজা সবাইকে নিয়ে প্রবেশ করলেন শান্ত আশ্রমপদে। শুধু তাঁর চতুরঙ্গ বাহিনী বাঁধা রইল বনদ্বারে। বাস, এইটুকু তাঁর বিনয়। মহাভারতের তপোবনে ঢুকবার সঙ্গে-সঙ্গেই যে, কণ্বমুনির আশ্রম দেখা যাবে—তা মোটেই নয়। কালিদাসের তপস্বী মানুষটির মতো কেউ বিত্রস্ত হরিণটিকে বাঁচিয়েই রাজাকে বিশ্বস্তভাবে পাঠিয়ে দেয়নি শকুন্তলার কাছে। এখানে কণ্বমুনির আশ্রমের অনেক আগেই কেবল শোনা যাচ্ছে ঋকবেদের দেবতাহ্বান ধ্বনি, সামবেদের গান, যজুর্বেদীদের যজ্ঞক্রিয়া—অগ্নয়ে স্বাহা, ইন্দ্রায় বৌষট, অথর্ববেদীদের শান্তিমন্ত্র আভিচারিক মন্ত্র, সমবেত মুনিঋষিদের ‘শব্দ-ছন্দোনিরুক্তি’তে সমস্ত বন একেবারে মুখরিত। রাজা দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে পৌঁছলেন। এইবার এতক্ষণে তিনি অমাত্যপারিষদবর্গকেও ছেড়ে দিলেন ঋষির সঙ্গে দেখা করার জন্য। একথা তো অবশ্যই ঠিক যে, শকুন্তলার সঙ্গে প্রেম করতে হলে তাঁকে একা ছেড়ে দিতেই হবে দুষ্যন্তের হাতে। তবে কালিদাস এ কাজ যত তাড়াতাড়ি আরম্ভ করেছিলেন, মহাভারতের কবি তা করেননি।
সবাইকে ছেড়ে আশ্রমে ঢুকে মহাভারতের দুষ্যন্ত কণ্বকে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তাই বলে তিনি কালিদাসের দুষ্যন্তের মতো দুষ্টুমি করেননি। লতাজালে অন্তরিত হয়ে যুবতী কন্যার বিশ্রম্ভালাপ শুনতে শুনতে তারিয়ে তারিয়ে শকুন্তলার রূপ উপভোগ করা—কালিদাসের দেওয়া এই সুযোগ ব্যাসের দুষ্যন্তের হয়নি। ব্যাপারটা এখানে অনেক সরল এবং সহজ। কণ্বমুনির আশ্রমে ঢুকে কাউকে না দেখে দুষ্যন্ত একেবারে বন মাতিয়ে তুললেন। হেঁকে বললেন—কে কোথা আছ গো, সাড়া দাও। তাঁর গলা শুনে শান্ত আশ্রমপদ যেমন সচকিত হয়ে উঠল—উবাচ ক ইহেত্যুচ্চৈচর্বনং সন্নাদয়ন্নিব।
কণ্বমুনির অনুপস্থিতি পূরণ করতে পর্ণকুটির থেকে বেরিয়ে এল লক্ষ্মীর মতো সুন্দরী এক মেয়ে। তাপসীর বেশ তার পরিধানে। শক্তিধর রাজার চেহারায় এবং ঐশ্বর্যের যে ছায়া পড়েছিল, সেটা তার মনে দ্রুত এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করল। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা তো আর কালিদাসের শকুন্তলার মতো সারা প্রথম অঙ্ক জুড়ে কথা-না-কওয়া শৃঙ্গার-লজ্জায়-নাটানো সব্রীড়া যুবতীটি নন। বিশেষত উত্তম নাট্যকারের বদান্যতায় পাওয়া দুটি সপ্রতিভ সখীও তাঁর নেই। আকাশে উড়িয়ে দেওয়া দুষ্যন্তের শূন্য শব্দ শুনেই ব্যাসের শকুন্তলা সহজভাবে বেরিয়ে এসে দুষ্যন্তকে বসার আসন দিলেন, পা ধোয়ার জল দিলেন। তারপর জড়তাহীন গলায়—স্বাগত, কুশল প্রশ্ন—হে বন্ধু আছ তো ভালো—পপ্রচ্ছানাময়ং রাজন কুশলঞ্চ নরাধিপম। সহজ বেশে, মধুর হেসে—ঠিক হেসে নয়, যেন হাসছেন এমনিভাবে—স্ময়মানেব—শকুন্তুলা প্রশ্ন করলেন—তা রাজার কাজটা কি, বলুন কি আমাদের করতে হবে?
কালিদাসের দুষ্যন্ত আগেই জানেন যে, শকুন্তলার পিতা কণ্ব আশ্রমে নেই। আগেই তিনি আশ্রম-তপস্বীদের কাছে খবর পেয়ে গেছেন যে, শকুন্তলার প্রতিকূল ভাগ্য প্রশমনের জন্য মহর্ষি কণ্ব সোমতীর্থে গেছেন। কালিদাস তাঁর নায়ক-নায়িকাকে শূন্য আশ্রমপদে মিলিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন অনেকক্ষণ, পিতা কণ্বকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন অনেক দূরে-সোমতীর্থে। কিন্তু যুবতী নায়িকার প্রতি ব্যাসের এই প্রশ্রয় নেই। তাঁর কণ্বমুনিও আশ্রম ছেড়ে বড়ো বেশি নড়াচড়া করেন না। সেই অনুপস্থিতির মুহূর্তে শুধু তিনি ফল কুড়োতে গিয়েছিলেন—ফলান্যাহর্তুম আশ্রমাৎ। ব্যাসের শকুন্তলাকে তাই অবস্থা বুঝে অনেক বেশি ‘স্মার্ট’ হতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, এই তিনি এলেন বলে।
ব্যাসের শকুন্তলার কোনো সখী নেই, পিতা কণ্বও দূরে যান না। অতএব চমৎকার আরণ্য পরিবেশে খ্যাপা হাওয়ার মধ্যে বরারোহা আগুনাপানা সুন্দরীর কাছে রাজাকে প্রণয় নিবেদন করতে হয়েছে তাড়াতাড়ি। অবশ্য তার আরও কারণ ছিল এবং প্রথম কারণ বোধহয় তাপসী শকুন্তলার সপ্রতিভতা। যে মুহূর্তে রাজা শকুন্তলাকে কণ্বমুনির কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেই মুহূর্তে শকুন্তলার দুটি গুণ তাঁকে স্পর্শ করেছে রীতিমতো—কী মধুর কথা বলে মেয়েটা। আর কথা যেমন বলে, দেখতেও তেমনি একেবারে নিখুঁত—’অনবদ্যাঙ্গী’। দুষ্যন্ত তাঁকে দেখলেন যেন ‘বিভ্রাজমানাং বপুষা তপসা চ দমেন চ’—শকুন্তলার রূপ একেবারে ফেটে পড়ছিল, নিরন্তর ব্রহ্মচর্যে, কঠোর দমনে সে রূপে মৃদুতা আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কোনো লাভ হয়নি। কালিদাস যে শকুন্তলার বল্কলোদভেদী যৌবন নিয়ে প্রিয়সখী প্রিয়ংবদার মুখে চটুলতা প্রকাশ করেছেন—তার মূল উপাদান বোধহয় এইখানেই। কিন্তু দমিত যৌবনের অপার রূপরাশি দেখে যথেষ্ট আলোড়িত হলেও রাজাকে একবার লৌকিকতার খাতিরে জানতে হল—শকুন্তলা কে, কার মেয়ে, কেনই-বা এই নির্জন বনে তাঁর বাস? অবশ্য এ প্রশ্নের সঙ্গে রাজা প্রাসঙ্গিক কথাটি স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দিয়েছেন—তোমাকে দেখেই ভুলেছি আমি, আমার মন বাঁধা পড়েছে তোমার কাছে—দর্শনাদেব হি শুভে ত্বয়া মে’পহৃতং মনঃ।
আগেই বলেছি—ব্যাসের শকুন্তলা সখীসহায়হীন বলেই বেশি স্মার্ট’ অতএব একটুও লজ্জা না করে সোজাসুজি আপন পিতা-মাতা বিশ্বামিত্র-মেনকার বিলাস-রহস্য, কেলি-কলা বৃত্তান্ত রাজাকে সবিস্তারে জানিয়েছেন। কালিদাসের বিদগ্ধা সখী প্রিয়ংবদা এই প্রসঙ্গ একটু তুলেই অর্ধোক্তে লজ্জায় মাথা নিচু করেছিলেন, অভিজাতবৃত্তি রাজাও সসংকোচে বলেছিলেন—থাক, থাক, সব বুঝেছি, আর বলতে হবে না। মালিনীর তীরে শিশু শকুন্তলার জন্মের পর শকুন্তপক্ষীরা যে তাকে রক্ষা করেছিল—সে প্রসঙ্গ কালিদাস তোলেননি। কিংবা সবিস্তারে তোলেননি সেইসব কথাও, যেখানে মেনকার বিলোভনে ধরা পড়েছেন ঋষি বিশ্বামিত্র। কালিদাস কলমের এক আঁচড়ে শুধু প্রিয়ংবদার মুখে মেনকার ‘উন্মাদয়িতৃ’ রূপের কথা তুলতেই ব্যঞ্জনা-বুদ্ধ রাজা তাঁকে থামিয়ে দিয়েছেন। আর শকুন্তলা! তিনি তখন কাছে ভিতে কোথাও নেই। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলার কোনো জড়তা নেই। বসন্তের হাওয়ায় এলোথেলো চুলে, উতলা আঁচলে মেনকা কেমন করে ভুলিয়েছিলেন বিশ্বামিত্রকে—সে-কথা বলতে ব্যাসের নায়িকার একটুও বাধে না। শকুন্তলা বললেন—শুনুন তাহলে আমি কেমন করে মহর্ষি কণ্বের মেয়ে হয়ে গেলাম।
শকুন্তলা বলে চললেন—তপস্যায় বসেছিলেন বিশ্বামিত্র। তাঁর তীব্র তপস্যায় ভয় পেলেন ইন্দ্র—এই বুঝি তাঁর ইন্দ্রত্ব চলে যায়, গুটোতে হয় স্বর্গের রাজ্যপাট। ইন্দ্র ভয় পেয়ে ধরলেন স্বর্গবেশ্যা মেনকাকে। বললেন—অপ্সরাদের মধ্যে তোমার সমান আর কে আছে। তা তুমি বাপু তোমার রূপ-যৌবন দিয়ে, মধুর ব্যবহার, স্মিত হাসি আর কথা দিয়ে বিশ্বামিত্রকে ভুলাও। মেনকা বললেন—সে কি সোজা কথা! ওই কোপনস্বভাব মুনি, যাকে কিনা তুমি পর্যন্ত ভয় পাচ্ছ, তাঁর মুখোমুখি হব আমি! না বাপু, সে হবে না। ওই মুনির কাছে যাওয়া, আর আগুনে হাত দেওয়া একই ব্যাপার। তুমি আমাকে রক্ষা করার ভার নাও, আমি যাচ্ছি। হ্যাঁ, এক যদি এলোমেলো হাওয়া আর ভালোবাসার দেবতা পুরুষ মানুষের মন-মথন-করা মন্মথ আমার সহায় হয়, তবেই তাঁকে একবার ভুলানোর চেষ্টা করতে পারি। বলা বাহুল্য, দেবরাজ রাজি হলেন এবং সদাগতি সমীরণকে পাঠিয়ে দিলেন মেনকার সঙ্গে। আর রইলেন কামদেব—বিশ্বামিত্রের মনে বাসনা তৈরি করবেন তিনি। কালিদাসের কুমারসম্ভবে অকালবসন্তের সূত্র কি এইখানে?
ব্যাসের শকুন্তলা এখানেও থামেননি। তিনি বলতে থাকলেন—কেমন করে মেনকা বিশ্বামিত্রের সামনে খেলা করতে লাগলেন। নাচতে লাগলেন। এমন সময় বন থেকে উদোম হাওয়া এল আর মেনকার পরিধেয় বসনখানি উড়ে গেল। চাঁদনী রঙের বসনখানি আঁকড়ে ধরতে গিয়েই যেন মেনকা প্রায় শুয়ে পড়লেন মাটিতে। কিন্তু সেই অবস্থাতেও মেনকার মুখের হাসিটি গেল না, লোক-দেখানো লজ্জার আভাসটুকুও সজীব রাখলেন মুখে—স্ময়মানেব সব্রীড়ম। উতলা বাতাস মেনকার গায়ের আবরণ এতটাই ভেদ করেছিল যে, বিশ্বামিত্র তাঁকে দেখলেন একেবারে অনাবৃতা—দদর্শ বিবৃতাং তদা। মেনকার রূপে-গুণে বিশ্বামিত্রের মনে চঞ্চল হয়ে উঠল। তার ফল হল এই যে, মুনিও তাঁকে সরস আমন্ত্রণ জানালেন, মেনকাও সানন্দে রাজি হলেন। জন্মালেন শকুন্তলা। ব্যাসের শকুন্তলা পিতা-মাতার কেলিকলার সংবাদ দিতে এতটাই নিঃসংকোচ যে, তিনি জানালেন—মেনকার সঙ্গে অনেককাল রঙ্গরসে কাটানোর পরেও মহর্ষির মনে হয়েছিল যেন একদিন কাটল।
আসলে এসব গল্প শকুন্তলা তাঁর পালক পিতা কণ্বের কাছে শুনেছেন। কণ্বই তাঁকে বলেছেন—কেমন করে মালিনীর তীরে পাখিরা শকুন্তলাকে ঘিরে ছিল—শকুন্তৈঃ পরিবারিতাম, কেমন করে আহ্নিক স্নানের পথে যেতে যেতে নির্জনবনের মাঝখানে নিষ্পাপ শিশুটিকে তিনি দেখতে পান। ব্যাসের শকুন্তলা মহর্ষি কণ্বের বদান্যতার কথা সগৌরবে ঘোষণা করে বললেন—তিনিই আমার নাম দিয়েছেন শকুন্তলা। আমি তাঁকেই পিতা বলে জানি—কণ্বং হি পিতরং মন্যে।
কিন্তু শকুন্তলা কণ্বকে পিতা মনে করলে কী হবে, রাজা দুষ্যন্ত যে বিশ্বামিত্রকেই শকুন্তলার পিতা হিসেবে চান। এতক্ষণ তিনি একটি মেয়ের মুখে স্বর্গবেশ্যা মেনকা এবং মহর্ষি বিশ্বামিত্রের কেলি-কলার উত্তেজক গল্প শুনছিলেন, কিন্তু তাঁর মন পড়েছিল শকুন্তলার কাছে। দৃষ্টি তো বটেই। দেখামাত্রই যিনি অজ্ঞাতকুলশীল স্ত্রীলোকের রূপে মোহিত হয়ে—নিতম্বিনী কন্যে! তুমি কার মেয়ে—এমন প্রশ্ন করেছেন, এতক্ষণ তিনি শুধু তাঁর জাতবিচার করে যাচ্ছিলেন—অর্থাৎ একে বিয়ে করা যাবে কি যাবে না—শুধু এই চিন্তা ছিল রাজার। বিশেষত দুষ্যন্ত তাঁর পূর্বপুরুষ যযাতি রাজার ব্রাহ্মণী-বিবাহের ফল মাথায় রেখে থাকবেন। তাই রাজা সন্দেহমুক্ত হলেন যে, শকুন্তলা মূলত ক্ষত্রিয় রাজার মেয়ে। বিশ্বামিত্র তপস্যা করে যতই ঋষি হোন না কেন, তাঁর জন্মসূত্রই রাজার কাছে বড়ো হয়ে উঠল। যেই না রাজা জাতবিচারে নিজের দিকে সায় পেলেন, ওমনি তিনি বায়না ধরলেন—তুমি আমার বউ হও—ভার্যা মে ভব সুশ্রোণি ব্রূহি কিং করবাণি তে। শুধু তাই নয়, পাছে সুন্দরী শকুন্তলা রাজার প্রস্তাব মেনে না নেন, তার জন্য রাজা টোপ ফেলতে আরম্ভ করলেন—তোমাকে সোনার হার গড়িয়ে দেব, সোনার দুল দেব দুই কানে, দামী শাড়ি দেব—সুবর্ণমালাং বাসাংসি কুণ্ডলে পরিহাটকে। দুষ্যন্ত নানা দেশের মণিরত্ন উপহার দিতে চেয়ে শেষে বলেছেন—চাই কি আমার গোটা রাজ্যটাই দিয়ে দেব—তুমি শুধু আমার বউ হও—সর্বং রাজ্যং তবাদ্যাস্তু ভার্যা মে ভব শোভনে।
সত্যিকথা বলতে কি, দুষ্যন্তের দিক থেকে শকুন্তলার জাতবিচারের চিন্তাটি বড়োই হাস্যকর। দুষ্যন্ত নিজে পৌরব, তার মানে তাঁর জন্ম হয়েছিল মহারাজ যযাতির ঔরসে দানবনন্দিনী শর্মিষ্ঠার ধারায়। তার ওপরে তিনি তাঁর নিজের বাড়িতে মানুষ হননি, মানুষ হয়েছিলেন যযাতির অন্য বংশ তুর্বসুদের ধারায়। মহাভারতের মতে তুর্বসুবংশের রাজারা হলেন সব যবন—তুর্বসোর্যবনাঃ স্মৃতাঃ। এই তুর্বসু বংশের মরুত্ত রাজার ঘরেই দুষ্যন্ত মানুষ হয়েছিলেন বলে পুরাণকারেরা বলেছেন। এহেন দুষ্যন্ত যখন কণ্বমুনির পালিতা কন্যার জাতবিচার করেন তখন হাস্যকর লাগে বইকি! স্বয়ং ব্যাস এ বিচার পরিষ্কার করেই দেখিয়েছেন, কিন্তু কালিদাসের মতো কবিও, বোধকরি তিনি বেদ-ব্রাহ্মণ্য রক্ষাকারী গুপ্ত রাজবংশের বহুমত কবি বলেই, দুষ্যন্তের এই জাতবিচারের কথাটা দেখাতে ভোলেননি।
যাই হোক, শকুন্তলার রূপে-মজা রাজা যখন তাঁর জাতি-বর্ণেও সন্তুষ্ট হলেন, তখন আর তাঁর মনের বাঁধ মানে না, কেবলই বিয়ের জন্য তাড়না আরম্ভ করলেন। ব্যাসের শকুন্তলা দেখলেন—এ তো উঠল বাই তো কটক যাই। বাস্তবিক সারাজীবন বামুনমুনির ঘরে থেকে শকুন্তলা ব্রাহ্মবিবাহের কায়দা-কানুন ছাড়া আর কিছুই জানেন না। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্ষ কি প্রাজাপত্য বিবাহ অত তড়িঘড়ি হয় না, সময় লাগে। কিন্তু রাজা শকুন্তলাকে বোঝালেন—দেখ বাপু! যতরকম বিয়ে আছে তার মধ্যে ভালোবাসার বিয়েই সবচেয়ে ভালো—বিবাহানাং হি রম্ভোরু গান্ধর্বঃ শ্রেষ্ঠ উচ্যতে।
কালিদাসের শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্যন্তের কথা কখনোই এত খোলাখুলি পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সারা প্রথম অঙ্ক জুড়ে সেখানে শকুন্তলার কথাটি নেই। লজ্জায়, আনন্দে তাঁর বাক্য সরে না। দুষ্যন্তের যা কথা সবই সখীদের সঙ্গে। আর তৃতীয় অঙ্কের মিলনপর্বে যাও-বা শকুন্তলার মুখ ফুটিফুটি ফুটল, তাও লজ্জায়, আশঙ্কায় প্রকাশের পথ পায় না। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা ভালোরকম কথা বলা না জানলেও সে ভীরু নয়। রাজার খোলাখুলি প্রস্তাব শুনে তিনি ভাবলেন—পাগল রাজা বলে কি? গান্ধর্ব বিবাহ আবার কি? দুষ্যন্ত তখন আট কিসিমের বিয়ের নিয়মকানুন শুনিয়ে বললেন—গান্ধর্ব বিবাহ বুঝলে না—এই যেমন, আমি তোমায় মনটি দিলুম, তুমিও আমায় মন দিলে—আমি তোমায় চাই, তুমিও আমায় চাও—সা ত্বং মম সকামস্য সকামা বরবর্ণিনী—এই হল গান্ধর্ব বিবাহ। তাই করব। শকুন্তলা দেখলেন মহা বিপদ! এই পাগল এবং একাধারে পাগল-করা রাজাকে আটকানো তো একেবারেই দায়। ভবিষ্যতের কিছুই না বুঝে যখন রাজাকে এখনই মন দিতে হবে, তখন ভবিষ্যতের একটা ব্যাপার অন্তত গুছিয়ে রাখা ভালো। রাজার অত্যাগ্রহ বুঝে শকুন্তলা বললেন—আপনি যখন এত করে বলছেন, তাহলে গান্ধর্ব বিবাহই বুঝি-বা ধর্ম হবে! সে হোক, আপনি যদি একান্তই আমাতে আসক্ত হন, তবে একটা শর্ত আছে, সেটা আগে শুনুন—শৃণু মে সময়ং প্রভো। আমার শর্ত হল—আমার গর্ভে আপনার যে ছেলে হবে তাকে যুবরাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে সেই হবে রাজা। এতে যদি আপনি রাজি থাকেন—যদ্যেতদেবং দুষ্যন্ত অস্তু মে সঙ্গমস্ত্বয়া—তবেই আমি মিলিত হতে পারি আপনার সঙ্গে।
সোজাসুজি কথা। ফেল কড়ি মাখ তেল। দুষ্যন্তও নির্বিচারে রাজি হলেন শকুন্তলার শর্তে। মিলিত হলেন দুজনে—দুষ্যন্ত-শকুন্তলা। দুদিন বাদেই চতুরঙ্গ সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে শকুন্তলাকে রাজধানীতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজা চলে গেলেন। কালিদাসের বৈদগ্ধ্যে লজ্জাবতী শকুন্তলার তরফ থেকে এসব শর্ত আরোপের কথা আসেনি। সে ভীরু আশ্রমবালিকা, রাজাকে সে নিজের অজান্তেই মন দিয়েছে—অকারণের আনন্দে। এখানে মিলন নিঃশর্ত, আবেগে মধুর। রাজা যাওয়ার সময় শুধু তাঁকে নিজের নাম-লেখা একটি আংটি দিয়ে গেছেন। কালিদাসের শকুন্তলা প্রতিদিন সেটি দেখেন আর একটি করে পুজার পুষ্পে রাজার আসার দিন গোনেন। কালিদাসের শকুন্তলার যত ভাবনা সখীদের। প্রিয়সখীর বিয়ে হয়েছে, এখন তার বিবাহ-বৃত্তান্ত শুনে পিতা কণ্ব কী বলেন, খুশি হন, না, অখুশি হন—এইসব ভাবনাই তিন কন্যার নিস্তরঙ্গ আশ্রম-জীবনে ঢেউ তোলে।
মহাভারতে কিন্তু চিত্রটা অন্যরকম। সেখানে ক্ষণিকের মিলন সেরে দুষ্যন্ত পালিয়ে যান নগরে এবং পালিয়ে যান এই ভেবে যে, মুনি তপঃপ্রভাবে সব জেনে দুষ্যন্তকে কী করবেন কে জানে—ভগবাংস্তপসা যুক্তঃ শ্রুত্বা কিং নু করিষ্যতি? আমি দুষ্যন্তের এই ভাব দেখে বলতে চাই—কালিদাসের দুষ্যন্ত দুষ্টু, কিন্তু মহাভারতের দুষ্যন্ত একেবারে দুষ্ট, দুষ্টচরিত্র। মৃগয়াবিহারী দুষ্যন্ত তপস্বিনী বালিকাকে মৃগয়া করে বাড়ি পালিয়েছেন। তাঁর দুষ্টুমির এই শেষ নয়। এখানে শকুন্তলাকে স্মরণচিহ্ন হিসেবে আংটিফাংটি কিছুই দেননি। রাজধানীতে ফিরে শতেক রমণী-বিলাসে শকুন্তলার কথা স্রেফ ভুলে গেছেন তিনি এবং আমরা জানি, ইচ্ছে করেই ভুলে গেছেন। কালিদাসের চতুর্থ অঙ্কে সেই আংটি পাওয়ার শুরু থেকেই শকুন্তলার মনে বিরহের সুর বেজে উঠেছে। তার মধ্যে দুর্বাসার শাপ এসে দুষ্টু দুষ্যন্তের চরিত্রও অনেক সাধু করে তুলেছে, তাঁকে সুনাগরিক হওয়ারও সুযোগ করে দিয়েছে। কবি হিসেবে এ দোষ পুরুষতান্ত্রিকতার কিনা জানি না, তবে কালিদাসের আবিষ্কার দুর্বাসার শাপে মধুকরবৃত্তি রাজার দোষ তো অনেক ঢাকা পড়ে গেছে। অর্থাৎ রাজা যে শকুন্তলাকে ভুলে গেছেন, তার ওপর রাজার কোনো হাত নেই, সবই দুর্বাসার শাপের দোষ, তাঁর কোনো দোষ নেই। তবু কালিদাসের এই চতুর্থ অঙ্ক থেকে একেবারে ষষ্ঠ অঙ্ক কবিপ্রতিভার চরম বিচ্ছুরণ। দুষ্যন্তের চারিত্রিক দোষ যেমন এতে চাপা পড়েছে, তেমনি দুর্বাসার শাপের ফলে শকুন্তলার দিক থেকে প্রতিমুহূর্তে নাটকীয় ‘টেনশন’ তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে কিন্তু মহাভারতের কবি যতখানি বিদগ্ধ, তার থেকে অনেক বেশি সরলহৃদয় ঋষি। ঠিক এই কারণেই শকুন্তলা-দুষ্যন্তের অনুরাগ যেমন ক্রমিক পর্যায়ে উন্নীত, ব্যাসে তা নয়। ব্যাসে এই দেখা, এই পরিচয়-জিজ্ঞাসা এবং পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব, অপিচ মিলনও। আবার কালিদাসে যেমন চতুর্থ অঙ্ক থেকেই শকুন্তলার মানসিক প্রতীক্ষা আরম্ভ হল, আরম্ভ হল ভাবনা—রাজার কুমার আর আসে না ঘোড়ায় চড়ে, মহাভারতে তা নয়। মহাভারতের কবি সরলহৃদয় বলে শকুন্তলার বিদায়ের আয়োজনে করুণরসের কোনো আবেদন রাখেননি। অন্যদিকে গর্ভবতী অবস্থায় দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে প্রত্যাখ্যান করার ফলে কালিদাসের পাঠক-দর্শক যেমন সমবেদনায় আকুল হয়ে ওঠেন, মহাভারতের কবির এসব ঝামেলা নেই এবং ঠিক সেই কারণেই কালিদাসের সপ্তম অঙ্কের ঘটনা ব্যাসকে সন্নিবেশ করতে হয়েছে দুষ্যন্ত বন থেকে চলে যাবার পরপরই।
মহাভারতের দুষ্যন্ত শকুন্তলাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েও আর যে কণ্বাশ্রমে ফিরে এলেন না কিংবা লোকও পাঠালেন না, তার কারণ বুঝি একমাত্র কণ্বমুনির ভয়। কিন্তু কণ্বমুনি লোক ভালো—মহাভারতেও ভালো, কালিদাসেও ভালো। কালিদাসে কিন্তু দৈববাণীর ফলে কণ্বমুনি সব বৃত্তান্ত জেনেছেন, কালিদাসের শকুন্তলা লজ্জাবতী নায়িকা, সে গূঢ় মিলনের কথা পিতা কণ্বকে জানাবে কী করে? কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা, যে নাকি পরবাসী নায়কের কাছে আপন পিতা-মাতা বিশ্বামিত্র-মেনকার বিলাস-রহস্য নিজমুখে জানিয়েছেন, নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানিয়েছেন, তাঁর পক্ষে পিতার কাছেও নিজমুখে আগন্তুক নায়কের সঙ্গে সহবাসের কথা জানাতে দ্বিধাবোধ করার কথা নয়। কিন্তু না, ব্যাসের কণ্ব দৈববাণী না শুনলেও তপোবলে সব জানতে পেরেছেন এবং জানার পর কালিদাসের কণ্বের মতোই তিনি খুশি। আনন্দে উদবেল হয়ে শকুন্তলাকে চক্রবর্তী পুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ জানিয়েছেন কণ্বমুনি, তদুপরি বরও দিতে চেয়েছেন খুশি হয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে শকুন্তলা কিন্তু বাস্তবতার বুদ্ধিতে ততটা পীড়িত নন। পূর্বে যেমন তিনি শর্তসাপেক্ষ মিলনের কথা রাজাকে বলেছিলেন তেমনি এখনও সেইরকম কিছু বর চাইতে পারতেন পিতা কণ্বের কাছে। অন্তত এই মুহূর্তে শকুন্তলা পিতার কাছে লুকোতে পারতেন না যে, আগন্তুক রাজাকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছেন। এখন তিনি রাজার হিতবুদ্ধিতে তাঁর ধর্মিষ্ঠতা এবং রাজ্যে চিরপ্রতিষ্ঠার আশীর্বাদ ভিক্ষা করলেন মহর্ষি কণ্বের কাছে।
হয়তো রাজার চরিত্রে ধর্মিষ্ঠতা থাকলে আগামী দিনে শকুন্তলার বাস্তব সুবিধে হবে, তাই অমন আশীর্বাদ চাওয়া, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি রাজা নিজে যে একেবারেই ধর্মিষ্ঠ নন। তবু কণ্বমুনি বললেন—আমার কথা মনে না রেখে তুমি পুরুষ মানুষের সঙ্গে নির্জনে যা সব করেছ, মায় মিলন পর্যন্ত পুংসসহ সমাযোগঃ—তা ধর্মের দিক থেকে কিছু অন্যায় নয়। সকাম পুরুষ আর সকামা রমণী—দুয়ের গান্ধর্ব-মিলনে ক্ষত্রিয়ের কোনো বাধাই নেই। তাছাড়া দুষ্যন্ত ধর্মাত্মা বটে, মহাত্মাও বটে। শকুন্তলা বললেন—পিতা! তুমি তাঁকে আশীর্বাদ কর। কণ্ব বললেন—তুমি যখন তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছ, তখন তাঁর প্রতি আমার অপ্রসন্নতার কারণ নেই কোনো—প্রসন্ন এব তস্যাহং ত্বৎকৃতে—বরবর্ণিনি।
এ তো ঠিক বাস্তব-বোধী পিতার কথা। কন্যার অভীপ্সিত মিলনে বাধা দিলেন না কণ্ব, সব মেনে নিলেন। দুষ্যন্তের ঔরসজাত শকুন্তলার পুত্র মহর্ষি কণ্বের আশ্রমেই জন্মাল। কালিদাসে পুত্র জন্ম এত শীঘ্র নয়, কারণ অভিজ্ঞান-শকুন্তলা নাটকের সর্বস্বসার চতুর্থ অঙ্কের রসসৃষ্টি এখনও বাকি। শকুন্তলা বনস্থলী থেকে বিদায় নেবেন। তাঁর আসন্ন-বিরহে আকুল বৃক্ষ-লতা পশুপক্ষী থেকে আরম্ভ সম্পূর্ণ বনস্থলীর আকুলতা। পিতা কণ্বের সগদগদ উপদেশ, সখীদের চোখের জল—এসব কিছু কালিদাসের কবিত্বের মূর্ছনায় এমন এক রসভূমিতে পৌঁছেছে যে, সাময়িকভাবে রাজা দুষ্যন্তের কথা আমাদের মনেই থাকে না। আবার যখন আমরা শকুন্তলাকে নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হই, তখন অসহায় শকুন্তলাকে দেখে আমরা বিমূঢ় বোধ করি, অন্যদিকে শাপগ্রস্ত দুষ্যন্তকে দেখেও আমাদের মায়া লাগে। কেননা তিনি যেন পাগলের মতো হয়ে গেছেন, শকুন্তলাকে বলা কথা তাঁর একটুও মনে নেই, মনে নেই কণ্বাশ্রমের সামান্যতম স্মৃতি। মনের যন্ত্রণা আরও বাড়ে যখন দেখি—শকুন্তলা কাপড়ের খুঁটে রাজার দেওয়া আংটি খুঁজে পাচ্ছেন না। পাঠক-দর্শনকে কালিদাস একেবারে শকুন্তলার একান্ত পক্ষপাতী করে তোলেন যখন গর্ভবতী শকুন্তলা রাজার দ্বারা তিরস্কৃত এবং আপন আশ্রম-বন্ধুদের দ্বারাও অপমানিত হয়ে সভাস্থল ত্যাগ করেন—একেবারে একা, গর্ভবতী।
মহাভারতের শকুন্তলার ধাত কিন্তু এমন নয়। তিনি নিজের ভার নিজেই বইতে জানেন। কণ্বমুনির কাছে তিনি রাজার ধর্মিষ্ঠতার আশীর্বাদ ভিক্ষা করেছেন, কিন্তু রাজা ধর্মিষ্ঠ না হলে কী করতে হবে তা তিনি জানেন। তার ওপরে তাঁর ছেলে হয়ে গেছে। তার দুর্দান্ত ক্রীড়াপ্রকৃতি, যা কালিদাস ব্যাসের আদলেই একেবারে সপ্তম অঙ্কে বর্ণনা করেছেন, সেই ক্রীড়াপ্রকৃতি দেখেই বনবাসীরা তার নাম রাখল সর্বদমন—সবাইকে এ ছেলে দমিয়ে রাখে তাই সর্বদমন—অস্তু অয়ং সর্বদমনঃ সর্বং হি দময়ত্যসৌ। সর্বদমনের কৌমার কাল উপস্থিত হল। কণ্বমুনি ভাবলেন—এবার ছেলের যুবরাজ পদবি ধারণ করার সময় হয়েছে। তার এবার বাবার কাছে যাওয়া উচিত। শকুন্তলাকে ডেকে কণ্ব বললেন—দেখ মা! বিয়ে হওয়া মেয়েদের বহুকাল ধরে বাপের বাড়িতে থাকাটা ভালো দেখায় না—নারীণাং চিরবাসো হি বান্ধবেষু ন রোচতে। তুমি এবার ছেলে নিয়ে মহারাজের কাছে যাও। কণ্বমুনি তাঁর একপাল শিষ্যের সঙ্গে সপুত্র শকুন্তলাকে পাঠিয়ে দিলেন রাজা দুষ্যন্তের কাছে। শিষ্যেরা রাজধানীতে শকুন্তলাকে পৌঁছে দিয়েই ফিরে চলে এলেন আশ্রমে। কালিদাসে কিন্তু শার্ঙ্গরব, শারদ্বত এবং আর্যা গৌতমী শকুন্তলার সঙ্গে ছিলেন অনেকক্ষণ। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলা নিজের ভার নিজে বইতে জানে। অতএব তিনি একাই ছেলেকে নিয়ে রাজার কাছে এসে যথাবিধি সম্মান জানিয়ে বললেন—এই নাও তোমার ছেলে, আমার গর্ভে তোমার কেমন দেবশিশুর মতো পুত্র হয়েছে দেখ। এবার একে তোমার পূর্বশর্তমতো যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করো। মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে আমার সঙ্গে মিলনের পূর্বেই তুমি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে সে কথা এখন স্মরণ করার সময় এসেছে।
আগেই বলেছি—ব্যাসের দুষ্যন্ত দুষ্ট, একেবারে দুষ্টচরিত্র। শকুন্তলার ব্যাপারে সব কথাই তাঁর মনে ছিল। কিন্তু মনে থাকা সত্ত্বেও—তস্যা রাজা স্মরন্নপি—রাজা বললেন, ”দুষ্ট তাপসি! এসব কি বলছ, কিছুই তো আমি মনে করতে পারছি না। ধর্ম বল, অর্থ বল, কাম বল—কোনো ব্যাপারেই তো তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছি না। কাজেই তুমি এখানে থাকবে, না চলে যাবে কিংবা কী করবে না করবে, তাতে আমার কি! তোমার যা ইচ্ছে তাই কর—গচ্ছ বা তিষ্ঠ বা কামং যদ্বাপীচ্ছসি তৎ কুরু। বস্তুত, কালিদাসের শকুন্তলাকে প্রথমেই রাজার মুখোমুখি হতে হয়নি। শার্ঙ্গরব, শারদ্বত—এঁরা দুজনে প্রাথমিক কথাবার্তা আরম্ভ করার ফলে নানা উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে রাজার ইচ্ছে-অনিচ্ছে এবং শকুন্তলার সম্বন্ধে রাজার ধারণা ক্রমেই পরিষ্কার হতে থাকে। এতে শকুন্তলার পক্ষে অনেক সুবিধে হয়। কালিদাসে সমস্ত গণ্ডগোল বাধে—যখন শকুন্তলা বুঝতে পারেন—তিনি রাজদত্ত অভিজ্ঞান আংটিটি হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ব্যাসের শকুন্তলার বিপদ আরম্ভ হয়েছে আরও আগে, অনেক আগে।
একেবারে প্রথম প্রস্তাবেই সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ব্যাসের শকুন্তলা বুঝে ফেলেছেন—রাজা জেগে ঘুমোচ্ছেন। সব জানা সত্ত্বেও, সব মনে পড়ে গেলেও রাজা তাঁর পূর্বকৃত অপরাধ—অবশ্য যদি এটাকে কেউ অপরাধ বলে—সে অপরাধ জনসমক্ষে স্বীকার করতে চাইছেন না। এখানে তাই শকুন্তলা প্রথম থেকেই ফুঁসে উঠেছেন। রাগে তাঁর চোখ লাল হয়ে গেছে—অমর্ষতাম্রাক্ষী, ঠোঁটদুটি স্ফুরমাণ—স্ফুরমাণৌষ্ঠসম্পুটা এবং কটাক্ষে তিনি যেন রাজাকে দগ্ধ করে ফেলতে চাইছিলেন। মহর্ষি কণ্বের শান্ত আশ্রমে বেড়ে-ওঠা প্রত্যেকটি মানুষের যে শমদমাদির শিক্ষা থাকে, সেই শিক্ষায় শকুন্তলা তাঁর ক্রুদ্ধভাবটি চাপা দিতে চাইছিলেন বটে। কিন্তু তাঁর কটাক্ষ-দাহন ছিল অপ্রতিরোধ্য এবং রাগে দুঃখে শেষপর্যন্ত তিনি প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করলেন। কণ্বাশ্রমের শিক্ষায় তাঁর প্রথম দিকের কথাবার্তায় যথেষ্ট ভদ্রতা ছিল, কিন্তু রাজার অভদ্রতায় শকুন্তলাও শেষে অভদ্র হয়ে উঠলেন এবং তা এতটাই যে ভাবা যায় না।
শকুন্তলা বললেন—মহারাজ! তুমি সব জেনেশুনে এসব কি বলছ? ইতর লোকের মতো একেবারে দ্বিধাহীনভাবে সমস্ত ঘটনা যে তুমি অস্বীকার করছ, তাতে কি তোমার হৃদয়কে ফাঁকি দিতে পারবে? কোনটা সত্যি আর কোনটা সত্যি নয়—তোমার মন যে সব জানে। এভাবে তোমার অন্তরপুরুষকে ছোটো কোর না। নির্জনে একটা পাপ কাজ করে তুমি যে ভাবছ—কেউ বুঝি জানতে পারল না—সেটা ভেবো না, তোমার কীর্তিকলাপ সব জানেন তোমার অন্তরপুরুষ, সব জানেন দেবতারা।
শকুন্তলা এর পরে প্রায় দার্শনিকের ভঙ্গিতে হৃদিস্থিত অন্তরপুরুষ সম্বন্ধে রাজাকে উপদেশ দিলেন। শেষে বললেন—পতিব্রতা নারী স্বয়ংই তোমার কাছে উপস্থিত হয়েছে—তাকে অপমান করা তোমার শোভা পায় না। যে মেয়েকে সসম্মানে তোমার ঘরে তোলা উচিত—তাকে তুমি যদি উন্মুক্ত সভায় অসভ্য লোকের মতো কলঙ্কিত কর, সেটা কি ভালো হয়! শকুন্তলা অধৈর্য হয়ে উঠলেন। বললেন—আমি কি অরণ্যে রোদন করছি দুষ্যন্ত! তুমি কি আমার কোনো কথা শুনতে পাচ্ছ না? আমি এত কথা বলা সত্ত্বেও যদি আমার কথা অনুসারে তুমি একটুও না চল, তাহলে অন্যায়-অনীতিতে তোমার মাথাটা যে চৌচির হয়ে ফেটে যাবে—দুষ্যন্ত শতধা মূর্ধা ততস্তে’দ্য স্ফুটিষ্যতি।
শকুন্তলা এরপর পুরুষমানুষের জীবনে পত্নী এবং পুত্রের মাহাত্ম্য কীর্তন করতে থাকলেন। পতিব্রতা নারীর কত মূল্য এবং পুত্র কিভাবে পিতৃ-পিতামহকুলকে পুংনাম নরক থেকে উদ্ধার করে—তার সম্বন্ধে একটি সবিস্তারে আলোচনা করলেন। তারপর আসলেন নিজের কথায়। বললেন—ছেলের মাকে মায়ের মতো সম্মান করতে হয়, মায়ের মতো দেখতে হয়—মাতৃবৎ পুত্রমাতরম। আর সেই মায়ের পেটে যে ছেলে জন্মায় সে যেন পিতার পক্ষে আয়নায় নিজের মুখ দেখা। পিতার দায়িত্ব সম্বন্ধে শকুন্তলা এবার উদাহরণ টানলেন—দেখো, প্রাণিজগতে পিঁপড়েগুলো পর্যন্ত নিজের ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা পর্যন্ত ডিমের ক্ষতি করে না, সেখানে তুমি ধর্মজ্ঞ হয়ে নিজের পুত্রের ভরণপোষণ করবে না—এ কেমন কথা! তাছাড়া পুত্র-স্পর্শের আনন্দ তুমি জানো না রাজা! ভালো জামাকাপড় পরা, কি স্ত্রীলোকের স্পর্শসুখ, কি শীতল জলে গা জুড়োনো—এইসব কিছুর থেকেও শিশুপুত্রের স্পর্শসুখ অনেক অনেক বেশি, তোমার পুত্র আজ তোমার সামনেই উপস্থিত। আমার জীবন এবং আমার ছেলে—দুই-ই তোমার, কাজেই শত শরৎ বেঁচে থাক তুমি, শতায়ু হোক আমার ছেলে। তোমার শরীর থেকে আরও একটি পুরুষের শরীর তৈরি হয়েছে। শকুন্তলার গর্ভ-সরোবরের শান্ত জলে আজ তুমি নিজের ছায়া নিজেকেই দেখ—সরসীবামলে’ত্মানং দ্বিতীয়ং পশ্য বৈ সুতম!
এই চরম আত্মনিবেদনের পরেও শকুন্তলা দেখলেন রাজা টলছেন না কিংবা তাঁর ভাবগতিক একটুও বদলালো না। এত কথার পরেও রাজার ভাবলেশহীন অপরিবর্তিত মুখের অবস্থা দেখে শকুন্তলা ভাবলেন—সত্যি-সত্যিই ভুলে গেল নাকি লোকটা। কণ্বমুনির আশ্রমের কথা, শকুন্তলার কথা সবই কি ভুলে গেলেন দুষ্যন্ত। যদি পুরোনো কথায় মনে পড়ে, শকুন্তলা তাই বললেন—সেই যে সেই হরিণের পিছনে ধাওয়া করতে করতে মৃগয়ায় ক্লান্ত হয়ে তুমি পিতা কণ্বের আশ্রমে এসে পৌঁছলে। আমাকে দেখতে পেলে—দেখতে পেলে কুমারী শকুন্তলাকে। তুমি জিজ্ঞেস করলে আমার কথা। আমি তোমাকে শোনালাম—কেমন করে অপ্সরা-সুন্দরী মেনকা ঋষি বিশ্বামিত্রের ঔরসে আমার জন্ম দিলেন। তারপর সেই অসতী স্বর্গসুন্দরী আমাকে যে ত্যাগ করে গেলেন, একেবারে পরের ঘরের সন্তানের মতো ত্যাগ করে গেলেন—সে কথাও তোমাকে বলেছি। হায়! বাল্যকালে পিতা-মাতা আমাকে অসহায় অবস্থায় ত্যাগ করে চলে গেলেন আর এখন যৌবনে তুমি আমায় ত্যাগ করছ। পূর্বজন্মে কি এমন পাপ করেছি, যার ফল পাচ্ছি আমি। তুমি আমায় ত্যাগ করছ—সেও না হয় আমি সইব, আমি না হয় আবার সেই আশ্রমেই ফিরে যাব, কিন্তু তোমার এই ছেলেকে তুমি কোনোমতেই অস্বীকার করতে পারো না—ইমন্তু বালং সন্ত্যক্তুং নার্হসি-আত্মজম আত্মনঃ।
শকুন্তলা ভাবলেন—আপন জননীর অন্যায় ব্যবহারের কথা বলে অন্তত স্বামীর অনুকম্পা আকর্ষণ করা যাবে। এক জায়গায় অবিচার হয়েছে বলে স্বামীর কাছে বিচার পাবেন না—শকুন্তলা এটা ভাবতেই পারেন না। কিন্তু রাজা যে জেগে ঘুমোচ্ছেন। তিনি শকুন্তলার কথার সূত্রে আরও সুযোগ পেয়ে গেলেন। আরও এক কাঠি এগিয়ে গিয়ে দুষ্যন্ত বললেন—তোমার পেটে জন্মানো এইসব ছেলেফেলের কথা আমি বুঝি না শকুন্তলা। মেয়েরা ভীষণ মিথ্যে কথা বলে—অসত্যবচনা নার্য্যঃ—অতএব কে তোমায় বিশ্বাস করবে? তার মধ্যে তুমিই তো তোমার জন্মকথা শোনালে। যার মা হল স্বর্গবেশ্যা মেনকা এবং যে নাকি দেবতার নিঃশেষ নির্মাল্যের মতো তোমাকে ফেলে দিয়ে গেছে হিমালয়ের কোলে—তার কথায় আবার বিশ্বাস? তোমার পিতা হলেন বিশ্বামিত্র, যে নাকি আগে ছিল রাজা, পরে ব্রাহ্মণত্বে লুব্ধ—তাও কিনা তপস্যার ফাঁকে এইরকম কামাচার—সেই বিশ্বমিত্রের মেয়ে হলে তুমি। যদি বল—মেনকা অপ্সরাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আর পিতা বিশ্বামিত্রও মহর্ষিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাহলে তাঁদের মেয়ে হয়েও তুমি এরকম বেশ্যার মতো পুরুষ-মজানো ভাষা শিখেছ কোত্থেকে—কস্মাৎ ত্বং পুংশ্চলীব প্রভাষসে। এসব কথা বলতে তোমার লজ্জা করছে না একটু, বিশেষ করে আমার সামনে? তুষ্টা তপস্বিনী কোথাকার, বেরোও এখান থেকে—দুষ্টতাপসি গম্যতাম।
দুষ্যন্ত এতক্ষণ শকুন্তলাকে গালাগালি দিচ্ছিলেন, কিন্তু ছেলের ব্যাপারে দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যদি আবার সভ্যজনেরা অন্যরকম সন্দেহ করে—তাই তিনি এবার ছেলেকে জড়িয়ে নিয়ে শকুন্তলাকে যা-তা বলতে আরম্ভ করলেন। ছেলের দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে দুষ্যন্ত বললেন—কোথায় তোমার ঋষিশ্রেষ্ঠ পিতা, আর কোথায় তোমার মা, আর কোথায় বেচারা তুমি সাধুর বেশে দাঁড়িয়ে আছ। আর এই ছেলের কথা বলছ? তোমার ছেলে তো বেশ বড়োসড়ো বাপু, দেখলে মনে হয় গায়ে বেশ জোরও আছে। এত অল্পসময়ের মধ্যে—এই চেহারা! কোত্থেকে একটা শালখুঁটির মতো দশাসই ছেলে নিয়ে এসে বলছ কিনা—এ বালক তোমার ছেলে। যেমন খারাপ তোমার জন্ম, তেমনি বেশ্যার মতো তোমার কথাবার্তা, মেনকাও তেমনি শুধু নিজের কাম চরিতার্থ করার জন্যই তোমার জন্ম দিয়েছে। তুমি যাই বল বাপু, সবই যা ঘটেছে বলে তুমি বলছ—তা সবই ঘটেছে আমার চোখের বাইরে, অতএব তুমি এখন এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ো, আমি তোমাকে চিনি না—নাহং ত্বাম অভিজানামি যথেষ্টং গম্যতাং ত্বয়া।
মহাভারতের শকুন্তলা কালিদাসের মতো অত বিদগ্ধা, পরিশীলিতবুদ্ধি নন যে, রাজাকে শুধু—অনার্য! নিজের মতো করে, নিজের অনুমান মতো আমাকে দেখছ—শুধু এইটুকু বলেই ছেড়ে দেবেন। মহাভারতের শকুন্তলা রাজার উলটো-পালটা কথা শুনে এবার সত্যিই খেপে উঠলেন। ঝংকার দিয়ে তিনি বললেন—রাজা! পরের খুঁত এইটুকু ছোট্ট হলেও খুঁজে বার করতে খুব ভালো লাগে, তাই না? আর নিজের খুঁতটা যে একটা বেলফলের মতো এতবড়ো তার বেলা! আমার মা মেনকা দেবতাদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করেন, আর দেবতারাও আমার মা-র পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায়—ত্রিদশাশ্চানু মেনকাম। অতএব তাঁর গর্ভে আমার জন্ম, তোর জন্মের থেকে অনেক ভালো—মমৈব উৎকৃষ্যতে জন্ম দুষ্যন্তস্তব জন্মনঃ।
আগে ভাবতাম—শকুন্তলা হঠাৎ এই কথাটা বললেন কেন? আমাদের আধুনিক চোখে স্বর্গবেশ্যার গর্ভে শকুন্তলার জন্মের কথাটাই বরং খারাপ লাগতে পারে, যেমন রাজার নাগরকবৃত্তিতে তাই লেগেছিল। উলটো দিক দিয়ে রাজা দুষ্যন্তের জন্মে কি এমন দেখলেন শকুন্তলা যে, এমন কথাটা তাঁর রাগের মুখে বেরোল। অবশ্য রাগের মুখে অনেক সময় সত্য কথাটা বেরোয়, তাই আমরাও ব্যাপারটা একটু অনুসন্ধান করেছি।
আপনাদের নিশ্চয়ই সেই যযাতি রাজার কথা মনে আছে। সেই যযাতি যিনি ব্রাহ্মণকন্যা দেবযানীর উপরোধে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য হলেন অথচ শেষ পর্যন্ত বাঁধা পড়লেন দানবনন্দিনী শর্মিষ্ঠার প্রেমে। এই প্রেমের ফলে তাঁর ওপরে নেমে আসল শুক্রাচার্যের দেওয়া জরার অভিশাপ। শেষে যযাতির অনেক অনুরোধে বিধান পাওয়া গেল যে, যযাতির পাঁচ পুত্রের মধ্যে কেউ যদি পিতার জরা গ্রহণ করেন, তবে রাজা আপাতত মুক্ত হবেন। পাঁচ পুত্রের মধ্যে যিনি জরা নেবেন, যযাতির রাজ্য পাবেন তিনিই। দেবযানীর দুই পুত্রই এই জরা নিতে অস্বীকার করলেন। শর্মিষ্ঠার প্রথম দুই পুত্রও তাই, কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্র পুরু সানন্দে জরা গ্রহণ করলেন এবং তিনিই রাজা হলেন যযাতির রাজ্যে। সেই থেকে বিখ্যাত পুরু কিংবা পৌরব বংশ চালু হল। দুষ্যন্ত সেই বংশেরই ছেলে বলে পরিচিত। দেবযানীর গর্ভে যযাতির প্রথম দুই ছেলে হলেন যদু এবং তুর্বসু। এঁরা দুজনেই পিতার অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। যদুর কথা আমাদের প্রয়োজন নেই আপাতত, কিন্তু দ্বিতীয় পুত্র তুর্বসু যযাতির জরা নিতে অস্বীকার করলে যযাতি বলেন—তুই রাজা হবি সেই দেশে, যেখানে সাধারণ প্রজাদের নিয়মকানুন, সত্য আচারের বালাই থাকবে না। সে দেশে যৌন সম্বন্ধের কোনো বিচার থাকবে না, যে যা পারে তাই করবে। এই রকম একটা ম্লেচ্ছ দেশ, যা নাকি সভ্য সমাজের বাইরে—সেইখানে রাজা হবি তুই।
পরবর্তীকালে মহাভারত বলেছে এই তুর্বসু থেকেই যবন কিংবা ম্লেচ্ছদের সৃষ্টি—যদোন্তু যাদবা জাতান্তুর্বসোর্যবনা স্মৃতাঃ। আমরা তুর্বসুর কথা বলছি এইজন্য যে শকুন্তলার নায়ক দুষ্যন্ত মানুষ হয়েছিলেন এই তুর্বসুদের ঘরে। যযাতির মূল ভূখণ্ডে দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী পুরু মহারাজ রাজত্ব করে গেলেও তাঁর বংশধরেরা সে রাজ্য চালাতে পারছিলেন না। পণ্ডিতেরা মনে করেন—ইক্ষ্বাকুবংশীয় মান্ধাতা এবং যদুবংশীয় শশবিন্দু—যাঁরা দুজনে ছিলেন জামাই-শ্বশুর—এঁরা দুজনেই এমনভাবে পৌরবদের রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন যে, মহারাজ দুষ্যন্তের আগে অন্তত দশ-এগারো পুরুষের মধ্যে কোনো রাজার নাম প্রায় উল্লেখই করা যায় না। দুষ্যন্ত জন্মানোর সময় তুর্বসু বংশে রাজত্ব করছিলেন মরুত্ত নামে এক নামী রাজা। তাঁর পুত্রসন্তান ছিল না, ছিল শুধু এক মেয়ে সম্মতা। সে মেয়েকেও তিনি দান করেন তাঁর পুরোহিত সংবর্তের কাছে। হরিবংশ পুরাণ বলেছে—এই সম্মতাই দুষ্যন্তকে পুত্র হিসেবে লাভ করেন। এখন, সম্মতা সংবর্ত ঋষির ঔরসেই দুষ্যন্তকে লাভ করেন, নাকি অন্য কোনো উপায়ে—সে-কথা পুরাণগুলিতে অস্পষ্ট, কিন্তু দুষ্যন্তের খ্যাতি ছিল পুরুবংশীয় বলেই। এমনও হতে পারে যে, ক্ষীণবীর্য পুরুদের কোনো অখ্যাত পুরুষের হাতে সম্মতাকে দান করেন সংবর্ত এবং তাই হয়তো দুষ্যন্ত পৌরব। কিন্তু মরুত্ত যেহেতু নামী রাজা ছিলেন এবং অপুত্রক, তাই দুষ্যন্তকে তিনি পুত্র-নির্বিশেষে পালন করেন—দুষ্যন্তং পৌরবঞ্চাপি লেভে পুত্রম অকল্মষম। ফল হল এই যে, যযাতিপুত্র তুর্বসুর বংশধারাই লুপ্ত হয়ে গেল এবং তুর্বসুর বংশ মিশে গেল পৌরব বংশে—কারণ ততদিনে দুষ্যন্ত রাজা হিসেবে বিরাট নাম কিনে ফেলছেন—পৌরবং তুর্বসোর্বংশঃ প্রবিবেশ নৃপোত্তম।
আমাদের কথা হল—যে দুষ্যন্তের জন্মকথা পুরাণে-পুরাণে এত রহস্যাবৃত হয়ে আমাদের কাছে নেমে এসেছে, সেই দুষ্যন্তের আপন কালে তাঁর এক জায়গায় জন্ম, এক জায়গায় মানুষ হওয়া—তাও আবার যৌন বিষয়ে আচার-শিথিল যবনদের রাজ্যে—এ সবকিছুই সাধারণের মধ্যে রস-আলোচনার বিষয় হয়েছিল নিশ্চয়ই। এসব রহস্যকথা সাধারণ্যে ছড়িয়ে যাওয়া কণ্বাশ্রমের নায়িকার পক্ষে দুষ্যন্তের জন্ম-সংবাদ জোগাড় করা কিছুই কঠিন হয়নি। আমরা মনে করি, শকুন্তলা যে বললেন—তোর জন্মের থেকে আমার জন্ম অনেক ভালো—তা আমাদের এই উক্ত কাহিনির কথা মনে রেখেই। ভাবটা এই—যার নিজের জন্মের ঘটনাই পরিষ্কার নয়, সে আবার অন্যের জন্ম নিয়ে কেচ্ছা করে কী করে—ছুঁচ বলে চালুনিকে। অতএব এবার শকুন্তলার সুযোগ, তিনি কোমরে কাপড় জড়িয়ে বলতে আরম্ভ করলেন—তোর জন্মের থেকে আমার জন্ম ঢের ঢের ভালো। তুই ঘুরিস-ফিরিস এই পৃথিবীতে, আর আমি ঘুরি অন্তরীক্ষে—পাহাড়ে আর সরষেতে যে-তফাত, আমার সঙ্গে তোরও সেই তফাত। কুৎসিত লোকে যতক্ষণ আয়নায় মুখে না দেখে, ততক্ষণ সে নিজেকে অন্যের থেকে রূপবান মনে করে, তোর অবস্থাও তাই। আয়নায় নিজের মুখ দেখলে পরে নিজের সঙ্গে অন্যের তফাতটা বুঝবি।
এ কিন্তু সেই জন্মের খোঁচাই চলছে। শকুন্তলা বললেন—যে আসলে ভদ্রলোক, সে কোনো কিছুই খারাপ দেখে না, তোর মতো ‘বিহেঠক’ নিন্দুকেরা শুধু খারাপই দেখে, খারাপই বলে। আমি কতকগুলো কথা বললাম, তার মধ্যে ধরলেন শুধু আমার জন্মকথাটা—আর মূর্খেরাই এইরকম করে—ভালো-মন্দ পাঁচটা কথা শুনে মন্দটাই ধরে, ঠিক যেমন ভালো-মন্দের মিশালে শুয়োর গু খায়, তেমনি—অশুভং বাক্যম আদত্তে পুরীষমিব শূকরঃ। ভদ্রলোকেরা দুটো কটু কথা বলে ফেললে পরে অনুশোচনা করে, আর তোর মতো দুর্জন যারা, তারা অন্যকে কটু কথা বলেই সুখ পায়। তোর মতো যারা সত্য ঘটনাটাকে অস্বীকার করে, তারা তো সাপের মতো। বিশেষ করে যে পুরুষমানুষ নিজের মতো দেখতে ছেলেটাকে পর্যন্ত স্বীকার করল না, ভগবান তার ভালো করবে না—তস্য দেবাঃ শ্রিয়ং ঘ্নন্তি—এই আমি বলে দিলাম।
মূর্খ, শুয়োর, সাপ—আরও বহুতর গালাগালি দিয়ে মহাভারতের শকুন্তলা এবারে ধাতে ফিরলেন। আবারও তিনি ধর্মশাস্ত্রের দোহাই দিয়ে পুত্রজন্মের সহস্র উপকারিতা স্মরণ করিয়ে দিলেন রাজাকে। কালিদাসের শকুন্তলাকে দু-পাঁচ কথা বলার পরেই লজ্জায়, দুঃখে, অভিমানে সভাগৃহ ত্যাগ করতে হয়েছিল। কিন্তু মহাভারতের শকুন্তলা নরমে-গরমে শত কথা বলেও যখন দেখলেন রাজা খুব-একটা ঘাড় পাতছেন না, তখন তিনিই রাজাকে ত্যাগ করেছেন—দুষ্যন্তের ত্যাগের সাধ্য কি? শকুন্তলা বললেন—এত কথার পরেও মিথ্যাচারেই যখন তোমার আসক্তি, তখন আমি নিজেই যাচ্ছি, তোমার মতো লোকের সঙ্গে আর একমুহূর্তও নয়—আত্মনা হন্ত গচ্ছামি তাদৃশে নাস্তি সঙ্গতম। আর আমার ছেলের কথা! সে তোমার তোয়াক্কা করে না, কপালে থাকলে সে নিজেই এই হিমালয়ের মুকুট-পরা সাগরের আঁচলা-দেওয়া পৃথিবী-নায়িকাকে ভোগ করবে—দরকার নেই তোমার রাজ্যে—ত্বামতে’ দুষ্যন্ত শৈলরাজাবতংসকাম। চতুরন্তামিমাম উর্বীং পুত্রো মে পালয়িষ্যতি।।
ঠিক এই কথাটি বলেই মহাভারতের শকুন্তলা ফিরে চললেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই দৈববাণী হল, যে দৈববাণীর কথা আমরা আগে বলেছি। দৈববাণী বলল—ভরস্ব পুত্রং দুষ্যন্ত মাবমংস্থাঃ শকুন্তলাম—পুত্রকে তুমি ভরণ করো দুষ্যন্ত, শকুন্তলাকে অপমান কোরো না। শকুন্তলা ঠিক সত্য কথাটি বলেছে, তুমিই এই পুত্রের জন্মদাতা—ত্বঞ্চাস্য ধাতা গর্ভস্য সত্যমাহ শকুন্তলা। এই দৈববাণী ভারতবর্ষের সমস্ত মুখ্য পুরাণগুলিতে আছে, যেখানেই আছে ভরতের জন্ম-প্রসঙ্গ। মহাভারতকারের প্রধান তাৎপর্য, প্রসিদ্ধ ভরত বংশের মূল ভরতের ভরণ কীভাবে সম্ভব হয়েছিল পিতা দুষ্যন্তের দ্বারা, সেইটাই। যে ভরত থেকে ‘ভারত’ নামের সৃষ্টি, যে ভরত থেকে ভারতবর্ষের সমস্ত কীর্তি—ভরতাদ ভারতী কীর্ত্তিঃ—সেই ভরত কীভাবে পিতার দ্বারা বিপ্রলব্ধ হয়েও আবার নিজের জায়গা খুঁজে পেলেন পিতার ঘরে—এইখানেই মহাভারতের কবির তাৎপর্য অন্য কিছু নয়। কিন্তু কালিদাসের তাৎপর্য কামনার শান্তিতে, প্রেমের পরিণতিতে। পুত্রজন্মের আনন্দ সেখানে অনেক পরে এবং সে আনন্দ সেখানে শৃঙ্গার রসের মহত্তর তাৎপর্যে বিশ্রান্তি লাভ করে। অভিজ্ঞানশকুন্তলের চতুর্থ অঙ্ক থেকে সপ্তম পর্যন্ত কালিদাসের বৈদগ্ধ্যে, কবি-চেতনায়, ভাবে, রসে, ব্যঞ্জনায় নতুনতর মাত্রা লাভ করেছে, কিন্তু যে আকর থেকে তিনি তাঁর উপাদান সংগ্রহ করেছেন, সেখানেও তাঁর ঋণ কম নয়।
ওপরে যে দুষ্যন্ত-শকুন্তলার তুমুল ঝগড়াঝাঁটি দেখালাম, সেখানেও শুধু পুত্রপ্রসঙ্গ ছাড়া মূল প্রত্যাখ্যান এবং অবিশ্বাসের রসটি কালিদাসেও ঠিক আছে, যদিও কালিদাসের প্রত্যাখ্যান, অবিশ্বাস এবং শকুন্তলার দিক থেকে নিজেকে স্থাপনা করার প্রসঙ্গটি অতিবৈদগ্ধ্যে পরিশীলিত হওয়ার ফলেই পাঠক-দর্শক শকুন্তলার প্রতি মায়াগ্রস্ত হয়ে পড়েন। অথচ দুষ্যন্তকেও তাঁরা সেরকম করে দূষতে পারেন না, কারণ দুর্বাসার শাপের কারণটি পাঠক এবং দর্শকের জানা আছে। মহাভারতের দুষ্যন্ত দৈববাণী শোনার পর সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছেন—আমি যে সব জেনেও এই পুত্রের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছি, তার কারণ—শুধুমাত্র তোমার কথায় যদি এই অজানা, অচেনা ছেলেটিকে আমি পুত্র বলে স্বীকার করে নিতাম, তাহলে লোকে আমাকে সন্দেহ করত। কাজেই সর্বসমক্ষে সন্তানের শুদ্ধির জন্যই আমি এই অন্যায় অপব্যবহার করেছি। শকুন্তলার কাছেও তিনি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। বলেছেন, তোমার সঙ্গে আমার মিলন হয়েছিল লোকচক্ষুর অন্তরালে। আমি যদি শুধু তোমার কথায় তোমাকে মেনে নিতাম এবং ছেলেকে সিংহাসনে বসিয়ে দিতাম, তাহলে পাঁচজনে বলত—তুমি মেয়েছেলের ছলাকলায় ভুলিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলে এবং এখন ছেলেটাকে চাপিয়ে দিলে রাজার সিংহাসনে। কাজেই লোকের চোখে তোমার এবং আমাদের দু’জনের সন্তানের শুদ্ধি প্রমাণ করার জন্যই আমি এতসব অপব্যবহার করেছি।
মহাভারতের দুষ্যন্তের কথা শুনে মনে হয় যেন ভবিষ্যদ-দৈববাণী নেমে আসা কিংবা প্রজাসাধারণের বিচার সম্বন্ধে দুষ্যন্তের খানিকটা চিন্তা মহাভারতের দুষ্যন্তকে শেষপর্যন্ত কিছুটা মহানই করে তোলে। বিশেষত, দৈববাণীর সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি পুত্রের মস্তক আঘ্রাণ করে তাঁকে কোলে তুলে নেন। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পড়তে থাকেন, বন্দিরা বন্দনা করতে থাকে, রাজা দুষ্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে পুত্র ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। রাজ্যাভিষেক সম্পূর্ণ হবার পর রাজা দুষ্যন্ত নিজেকে নিয়োগ করেন মহিষী শকুন্তলার তোষণে। ভালো খাবারদাবার, নতুন নতুন শাড়ি-কাপড় আর গয়নাগাঁটি—এই ছিল রাজার কাছে শকুন্তলাকে তোষামোদ করার প্রধান উপায়।
কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলে পুত্র-পিতার মিলন-প্রসঙ্গ একেবারে শেষ অঙ্কে, যদিও পুত্রের থেকে শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্যন্তের পুনর্মিলনই এখানে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, পুনর্মিলন সম্ভব হয়েছে রাজা দুষ্যন্তের অনুতাপ-দহন সম্পূর্ণ হওয়ার পরে, যদিও এই অনুতাপের রাস্তা পরিষ্কার করেছে ধীবরের কাছে রাজার নামাঙ্কিত আংটিটি ফিরে পাবার ফলে। কালিদাসের নাটকের চতুর্থ অঙ্ক থেকে ষষ্ঠ অঙ্ক পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে, তার নিয়ন্ত্রণ কিন্তু মূলত সেই অভিজ্ঞান আভরণটির, যেটি দুষ্যন্ত শকুন্তলার হাতে পরিয়ে দিয়েছিলেন রাজধানীযাত্রার প্রাক্কালে। তারপর থেকে শকুন্তলা-দুষ্যন্তের পারস্পরিক সম্পর্ক যে খারাপ হয়েছে, তা যেমন ওই আংটির কারণে, আবার সম্পর্ক যে ভালো হয়েছে, তাও ওই আংটির কারণেই। বস্তুত কালিদাসের নাটকের চতুর্থ অঙ্ক থেকে ষষ্ঠ অঙ্ক পর্যন্ত ওই আংটিটিই হল আসল নায়ক—যে নায়কটি ঋষি দুর্বাসার ক্রোধের ধাতুতে গড়া—নিয়তি, ‘নেমেসিস’। দুর্বাসার শাপের ব্যাপারটা একেবারেই কালিদাসের নব নব উন্মেষশালিনী প্রজ্ঞার ব্যাপার। নর-নারীর যুগল সম্পর্কের মধ্যে যদি শুধুমাত্র কামনার অন্যায় থাকে, সেখানেই কালিদাসের মতো চিরন্তন কবির হাতে ‘নেমেসিস’ নেমে আসে দুর্বাসার শাপের আকারে। তবে আংটির ব্যাপারটা কালিদাস কোথাও ইঙ্গিত হিসেবে পেয়ে থাকলেও থাকতে পারেন। পদ্মপুরাণের স্বর্গ খণ্ডে এই আংটির কথা পাওয়া যায়। সেখানে স্বামীর ঘর যাবার রাস্তায় শকুন্তলা নাকি আংটিটি প্রিয়ংবদার হাতে দেন এবং প্রিয়ংবদা সেটি আঁচলে রাখতে গেলে আংটিটি জলে পড়ে যায়—প্রিয়ংবদা তু তদগৃহ্য বসনাঞ্চলমধ্যত।/যাবন্ন্যন্তবতী তাবৎ পপাত সলিলে দ্বিজ।
প্রিয়ংবদা ভয়ে এ ঘটনা প্রকাশ করেননি এবং শকুন্তলাও সখীপ্রেমে এ ঘটনার জের টানেননি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পদ্মপুরাণের অনেক অংশই এত বিপুল পরিমাণে প্রক্ষিপ্ত যে কালিদাস তাঁর আংটির বৃত্তান্ত এখান থেকে ধার করেছেন—তা মনে হয় না। বরঞ্চ বৌদ্ধ গ্রন্থের একাংশ কটহহরি জাতক এ-ব্যাপারে কালিদাসকে কোনো ইঙ্গিত দিয়ে থাকতে পারে। কটহহরি জাতকে বারাণসীর রাজা ব্রহ্মদত্ত দুষ্যন্তের মতো একইভাবে এক রমণীকে দেখে মোহিত হন এবং তাঁকে স্ত্রীত্বে বরণ করেন। যাবার সময় রাজা নিজের নামাঙ্কিত একটি আংটি সেই স্ত্রীকে দিয়ে বলেন—তোমার মেয়ে হলে এই আংটি দিয়ে তার ভরণপোষণ করবে, আর ছেলে হলে আংটি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে। এদিকে স্বয়ং বোধিসত্ত্ব সেই রমণীর ছেলে হয়ে জন্মালেন। পরবর্তী সময়ে বোধিসত্ত্বকে সঙ্গে নিয়ে সেই রমণী যখন রাজার কাছে গেলেন, তখন ব্রহ্মদত্ত লোকলজ্জায় তাঁর পূর্ববিবাহের কথা অস্বীকার করলেন। রমণী এবার রাজার দেওয়া আংটিটি দেখাল। রাজা তাও অস্বীকার করে বললেন যে, ও আংটি তাঁর দেওয়াই নয়। এরপরে খানিকটা অলৌকিকতার মাধ্যমে বোধিসত্ত্বের পুত্রত্ব এবং রাজার পিতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল।
ঘটনা যাই হোক, আংটির ব্যাপারটি এই জাতকের গল্প থেকে কালিদাসের মাথায় ঢুকে থাকতে পারে। কিন্তু ওই আংটির সঙ্গে দুর্বাসার শাপ, আংটি জলে পড়ে যাওয়া, তাকে মাছের পেটে ঢোকানো এবং পরিশেষে মাছের পেট কেটে আবার সেই আংটি বার করা—এ সবকিছুই এতই অভিনব এবং এতই নাটকীয়তার সুরে বাঁধা যে, এগুলি কালিদাসের প্রতিভা-প্রসূত নয়—এটা ভাবাই যায় না। তবে, এই কটহহরি জাতক, পদ্মপুরাণ এবং অন্য পুরাণগুলির মধ্যে কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তলের উপাদান যতই লুকিয়ে থাকুক না কেন, কালিদাস যে মহাভারতের কবির কাছেই সবচেয়ে বেশি ঋণী, সে-কথা বোধকরি জলের মতো পরিষ্কার। যেসমস্ত ঘটনা প্রধান এবং যে পরিমণ্ডলে দুষ্যন্ত-শকুন্তলার কাহিনি জমে উঠতে পারে, তা কালিদাসের বিলক্ষণ জানা বলেই মহাভারতের মূলস্রোত থেকে তিনি সরে যাননি। তবে এ-কথা তো ঠিকই যে, যিনি মহাভারতের মতো মহাকাব্যের কবি, তাঁর লক্ষ্য অনেক বড়ো, তাঁর প্যানোরামা’-এ অনেক বড়ো। এই যে বিরাট ভরত বংশ, যার শেষ পরিণতি ওই বিরাট ভারতযুদ্ধ, যে ভরত বংশের এক-একটি কীর্তিমান পুরুষ এক-একটি স্মরণীয় কাজ করে রেখেছেন এবং সবচেয়ে বড়ো কথা যে-ভরতের নামে আজকেও আমরা দেশকে চিহ্নিত করি একতাসূত্রে আবদ্ধ হই, সেই ভরতের প্রথম জীবন এবং তাঁর জনক-জননীর ইতিহাস কেমন ছিল—এটাই মহাকাব্যের কবির কাছে অনেক জরুরি। কিন্তু এই বিরাটের মাঝখান থেকে মধুকরবৃত্তিতে উপাদান সংগ্রহ করে কালিদাস আমাদের যা দিয়েছেন, তা হল মধুর রসের পরিসর, বিদগ্ধজনের আকুল হৃদয়ের পরিসর, প্রেমিক-প্রেমিকার অন্তরে নানা রঙের টান-পড়া ছবি। কালিদাসের নাটকে ভরত শুধু নায়ক-নায়িকার বিশুদ্ধির প্রতীক, কুমারসম্ভবমাত্র, আর সবই নায়ক-নায়িকাকেন্দ্রিক। আর মহাভারতে ভরতই সব বাকিটা তাঁর জন্ম-জননীর পরিচয়।