লেখক হবার পিছনে…
১
ছিন্নপাতার ভেলা সমুদ্রে যায় না। ”যায়” বলাটা নেহাৎ কবিকল্পনা। ছোটবেলা বর্ষাকালে ঝমঝমে বৃষ্টিতে বাগানে দৌড়তাম। বর্ষার দুপুরে ঝমাঝম বৃষ্টি। স্মৃতিটা মেদিনীপুরের। চওড়া ড্রেন দিয়ে রাঙা জল ছুটছে। তাতে পাতা ভাসাতে ভালো লাগত। আবার এটাও জানতাম এই ”মহাবরষার রাঙা জল” সমুদ্র কেন, কোনো বড় নদীতেও পৌঁছবে না।
তারপর বাড়ি ফিরতাম। গরমের ছুটির দুপুর কাটাবার তো এটাই উপায়। কোনো বই নিয়ে গড়িয়ে পড়া। যখনকার কথা বলছি, তখন বয়স হয়তো দশ। তবে বই পড়ার বিষয়ে আশ্চর্য আকর্ষণ তার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।
পড়ার নেশাই অত্যধিক ছিল, যা অনেকেরই থাকে। অত্যধিক পড়তাম বলে খুব ”পাকা” হয়েছি বলে শুনতাম। একদা লেখকও হলাম। পড়তে পড়তে লিখতে এসেছি বলেই মনে করি।
শুধুই ছোটদের বই পড়ি নি সেই সময়ে। ছোটদের বই কি অনেক ছিল? তাও মনে নেই। যতটা সুসংবদ্ধভাবে মনে পড়ে বলে যাই। সে এমন আহামরি কিছু হবে না। প্রায় সব লেখকই বই পড়ার নেশায় ডুবে থেকেছেন কোনো না কোনো সময়ে। যা যা নিয়ে বড় হয়েছি, সে সব কথাই কিছু বলি।
২
আমাদের বড় হবার সময়ে সিনেমা—থিয়েটার ছিল না তা নয়। খুব একটা দেখার চল ছিল না বলাই সঠিক হবে। যদিও একেবারে দেখতাম না বললেও মিথ্যে বলা হবে। জন্মেছি ১৯২৬ সালে। ঢাকায় মামাবাড়িতে যাওয়ার চল ছিল। সেটা আমার কাছে ছিল মস্ত পাওনা। আমার দিদিমার বাংলা বইয়ের সংগ্রহ ছিল খুব ঋদ্ধ।
দিদিমার কাছে বসে বই পড়ার কথা পরে বলব। শুরু করি সিনেমা থিয়েটার দেখা নিয়ে। সে সময়ে থাকতাম আর্মানীটোলায় মামাবাড়িতে।
আর্মানীটোলায় সিনেমা হল ছিল। যার নাম সম্ভবত ‘পিকচার প্যালেস’। সে হলে ছবি দেখানো হত। আমার মাতামহ সিনেমাহলে ঢুকলেই ঘুমিয়ে পড়তেন। দিদিমা সিনেমা দেখতে খুব ভালবাসতেন।
মা—মাসিদের যেতে দেখি নি, কিন্তু দিদিমা আমাকে নিয়ে মাঝেমাঝেই সিনেমা দেখতে যেতেন। ঘোড়ার গাড়ি আসত। দিদিমা আর তাঁর আদুরে নাতনি গাড়ি চড়তেন। হলে পৌঁছে আমার জন্যে এক পয়সার চিনেবাদাম কেনা হত। চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা তখন। এক পয়সার ক্রয়মূল্য বা ক্ষমতা অনেক। আমারে ফ্রকের কোঁচড় বোঝাই বাদাম হত।
আমরা গিয়ে সিধা বক্সে বসতাম। এই খাতিরটা করতেন হলের ম্যানেজার। কেন করতেন? সে কথা বলেই ফেলি। দিদিমার বাবা একদা কুচবিহারের রাজার স্টেটে কর্মী ছিলেন। জজ বলেই মনে হচ্ছে। এঁর নাম শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখায় পাওয়া যায়। নাম ছিল যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী। এঁর উৎসাহে কেশবচন্দ্র সেনের মেয়ের সঙ্গে কুচবিহারের রাজকুমারের বিয়ে হয়। দিদিমার ভাইপো কবি অমিয় চক্রবর্তী। যাদব চক্রবর্তী আমার মায়ের মাতামহ আর অমিয় মার পিতামহ। যা হোক, ওই ম্যানেজার শৈশবে দিদিমার খেলুড়ী ছিলেন এবং দিদিমাকে ”কিরণ দিদি” বলতেন। দিদিমার নাম ”কিরণময়ী”। সেই খাতিরেই বক্সে বসে সিনেমা দেখতাম। কি দেখেছি? খুব মনে পড়ে দেবিকারাণী ও অশোককুমারের ”অছুৎকন্যা”। এ ছবিটা দুবার দেখা হয়। একটা নির্বাক সিরিয়াল দেখেছিলাম, হলিউডের—”গ্যালপিং ঘোস্ট”। চ্যাপলিনের ”কিড” দেখেছিলাম, এমনই মনে হচ্ছে।
একটা বাংলা ছবি দেখা হয়েছিল ”তরুণী” ও ”মণিকাঞ্চন”, দুটো ছবির প্যাকেজ। এই ছবিটা দেখার সময়ে আমার ঠাকুরদা (এঁকে আমি ”দাদা” বলতাম) সঙ্গে ছিলেন। ওই বাংলা ছবিতে নায়িকা ঘুমোচ্ছেন। খলনায়ক ঢুকছেন। দাদা উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে শাসাতে থাকতেন, ”আর এক পা—ও আগাবি না, বুঝলি?” দিদিমা আর দাদা সিনেমার উপযুক্ত দর্শক ছিলেন।
”অছুৎকন্যা”—র বিখ্যাত প্রেমসংগীত ছিল, ”ম্যায় বন কি চিড়িয়াঁ”। সে সময়ের সুপারডুপার হিট গান যাকে বলে!
দাদা এবং দিদিমা, দুই বেয়াই—বেয়ানের বন্ধুদের মূলে ছিল সাহিত্যপ্রেম। দাদা তিনবার এম.এ.পাশ করেন (ইংরেজি, ইতিহাস ও সংস্কৃত) দুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হন। দিদিমা এগারো বছরে বিবাহিতা। কুড়ি বছর বয়সে জননী। বাংলার ভিত্তি খুব পোক্ত ছিল। চল্লিশ বছর বয়সে ইংরেজি শিখে সাহিত্য পড়তে শুরু করেন। ১৯৩৫ সাল থেকে ওঁদের সাহিত্য আর সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি। আমার বড় হবার সময়ে, বোধহয় ১৯৪০/৪১ সালে বাড়িতে রেডিও কেনা হয়। গান শুনতে হলে আমরা কলের গানই শুনতাম। ”হিজ মাস্টার্স ভয়েস” কোম্পানির দম দেওয়া গ্রামোফোন।
রেডিও এলে কি হবে, যথেষ্ট শুনতে পেতাম না। মা বেশ কড়াকড়ি করতেন।
কিন্তু ভালো ইংরেজি ছবি দেখাতেন। বলতেন, ভালো ছবি দেখে অনেক শেখা যায়।
বাড়িতেও ”হাওয়া” ছিল। মেজকাকা নিউ থিয়েটার্সের ক্যামেরাম্যান। আমাকে চ্যাপলিনের ”মডার্ন টাইমস” দেখিয়েছিলেন। আরো দেখেছি গ্রেটা গার্বোর ”মাটা হারি”, ”কুইন ক্রিশ্চিনা”, ”ক্যামিল” এইসব। নর্মা শিয়ারারের ”মারি আঁতোয়ানেৎ” আজও মনে পড়ে। সে সময়ে ”গন উইথ দি উইণ্ড”, বা পরে ”হ্যামলেট” দেখার অভিজ্ঞতাও দারুণ। সেদিন বিখ্যাত সব ছবি তৈরি হোত হলিউডে। অন্তত আমরা তাই জানতাম।
পরে অবশ্য ব্রিটেনে তৈরি ছবিও আসতে থাকে। আমি তো অতটুকুই মনে করতে পারি, যা যা তখন দেখেছি।
বরঞ্চ বাংলা ছবি তুলনায় কম দেখেছি। ”মুক্তি” দেখেছিলাম প্রমথেশ বড়ুয়া এবং কাননদেবীর। দেখেছিলাম ”দেবদাস”, সে স্মৃতি খুব ক্ষীণ। যেমন ক্ষীণ হিন্দী ”কপালকুণ্ডলা” দেখার স্মৃতি।
”দেশের মাটি” ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের ”শেষ হোল তোর অভিযান” খুব কানে লেগে ছিল দীর্ঘকাল। ”জীবনমরণ” ছবির পরিচালক নীতিন বসু বলেছিলেন, ”যক্ষ্মা একটি সামাজিক ব্যাধি”। এটার মর্মবাণী প্রচার করতেই ছবিটি করা হয়। ওই ছবিতে লীলা দেশাইয়ের ঠোঁটে ”কভু ফোটে ফুল” গান, সায়গলের গলায় ”শুনি ডাকে মোরে ডাকে” গানগুলি আমার ১৩/১৪ বছর বয়সের অতি মধুর স্মৃতি। যে ছবিই দেখতাম, সে ছবিই ভালো লাগত।
হিন্দি ছবি তুলনায় সংখ্যায় খুব কম দেখেছি। শান্তারামের ”দুনিয়া না মানে” সমাজবাস্তবতার ছবি ছিল। তার অনেক পরে অনেক ছবি দেখেছি। দেখতে ভালো লাগত। গানও ভালো লাগত।
এ সবই সেই সময়ের কথা। যখন আমি ক্রমে বড় হচ্ছি, অর্থাৎ বয়সে বাড়ছি। শুনতাম, বিশ্বাসও করি, বেজায় পাকা ছিলাম।
বড় হবার সময়ে যত যা দেখেছি, তার সব নিশ্চয় নিখুঁত মনে নেই। বাবা মাঝেমাঝেই কলকাতা বদলি হয়েছেন, টানা থেকেছেন ১৯৩৯—১৯৪৪। ওই সময়ের মধ্যে উদয়শঙ্কর, বালা সরস্বতী, রুক্মিনী আরুড্লে, এঁদের নাচ দেখেছি।
এতদ্দ্বারা ”সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ” হয়েছি, এমন পাকা কথা বলা যাবে না। তবে এটাই বলার চেষ্টা করছি, সে সময়কালে বাইরের জানলা খুলে একটা মুক্ত জগৎ দেখার সুযোগ কমই ছিল। বইপড়ার কথাটা এর পরে বলব। তবে বই ছিল সেই জানলা, যার মাধ্যমে দেশ, মানুষ ইতিহাস, সাহিত্য, সব কিছুর সঙ্গে পরিচয় হোত। আর, বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিনেমা—থিয়েটার, যাই দেখি, সে তো মাঝেমাঝে হোত।
বই তো তেমন নয়। পড়ো আর পড়ো।
সিনেমা—থিয়েটার, ইত্যাদির অভিজ্ঞতা আরেকটু বলি। দেখেছি ”কিং কং”, ”ট্রেডার হর্ন”। বিয়ের পর অনেক ছবিই দেখেছি, নবারুণও দেখেছে। ও তখন বেশ ছোট। ওয়ালট ডিসনের ”ফ্যান্টাসিয়া” দেখতে দেখতে বলেছিল, সব আমি ভালো দেখতে পাই নি। এর কিছুদিন বাদেই আমার পরের বোন বম্বে থেকে এল কলকাতা। প্লেনে আসছে। উড়ে আসছে। আমরা খুব উত্তেজিত। আমরা তো আকাশপথে ভ্রমণ কাকে বলে তা জানতাম না। আমার বাবা আমাদের নিয়ে দমদম গেলেন।
বাড়ি ফেরার পর নবারুণ বলল, মা। আমি মিতুল মাসিকে আগে দেখতে পাই নি। প্লেন থেকে নামার পর দেখতে পাব ভেবেছিলাম, হঠাৎ দেখি সামনে চলে এসেছে।
চিন্তা, চিন্তা, জিগ্যেস করে জানলাম ইস্কুলেও ওর বোর্ডের লেখা দেখতে অসুবিধে হয়।
পরদিনই নিয়ে গেলাম চোখের ডাক্তারের কাছে। সেই জানা গেল, ওর চোখে পাওয়ার এসেছে। নবারুণ খুব ছোট বয়সেই চশমা পরে। আমার চোখে চশমা ওঠে ১৯৭৫ সালে। ওর চোখ খারাপ হওয়াতে মনে খুব লেগেছিল।
নবারুণও খুব বই পড়ত। কত ছোট বয়সে ”পথের পাঁচালী” পড়ে যে জায়গা ওকে স্পর্শ করত, সেখানে পেনসিলে দাগ দিত। মন্তব্য লিখত। সে কথা মনে রেখেই ছোট্ট তথাগতকে বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমগ্র রচনাবলী উপহার দিয়েছিলাম।
তথাগতর ছেলে স্বয়ম যদি বাংলা পড়ে, ওকেও কিনে দেব। ওর জন্যেই তো একশো বছর বাঁচতে চাই।
সিনেমা দেখার কথা কিছু বলেছি। যাত্রা বলতে একেবারে গ্রামের যাত্রা দেখেছি দুবার। মুকুন্দ দাসের যাত্রা একটু দেখেছি একবার। নিজেদের গ্রামেও কেষ্টযাত্রা দেখি। যশোদা দুরন্ত বালক কৃষ্ণকে শাস্তি দিচ্ছেন আর বালক কৃষ্ণ কাঁদছেন—
”যাব না গো, আর যাব না
ওদের বাড়ি আর যাব না
ক্ষীর ছানা সর নবনী আমি
চুরি করে আর খাব না
কেঁদে কেঁদে ডাকে আমায়
তাই তো আমি খেলাতে যাই
না ডাকলে গো এমনি করে
আমি কারো বাড়ি যাই না।।”
সে গান আজও গেয়ে শোনাতে পারি। তেমন যাত্রা দেখা ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। মাটির অঙ্গন, খড়ের চাল, কার্বাইডের আলো। দর্শকরা মাটিতে বসে।
ঢাকায় যে যাত্রা দেখি, সে রাধা—কৃষ্ণের পালা। দলটি কিন্তু বীরভূমের। মনে আছে, রাধিকার ননদ তর্জনী নেড়ে নেড়ে গাইছে—
”কালার সঙ্গে পীরিতি করা
ঘুচিয়ে দুব।”
মুকুন্দ দাসের যাত্রা দেখি ৫/৬ বছর বয়সে। ছিলাম ফরিদপুরে। হচ্ছিল স্বদেশী মেলা। এদিকে ইংরেজের পুলিশ। মুকুন্দ দাসের কালো, বলিষ্ঠ চেহারা। তাঁর গলায় কালীর ছবি থাকত। হাতে ত্রিশুল।
সবে কি যেন গান ধরেছেন আকাশ ফাটিয়ে, হঠাৎ বেজায় চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। কি হোল তা আমরা বুঝব কি! কোনোমতে হেঁচড়ে পেঁচড়ে আমাদের বাইরে আনা হোল।
সত্যিই আগুন লেগেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবধি যুক্তবঙ্গে বাঙালীর ব্যবসাক্ষেত্রে বিশাল প্রতিষ্ঠা ছিল। যশোরের ”কিরণ” ফ্যাকটারির চিরুনি, সোপকেস, সারা ভারতে বিক্রি হোত। ওই মেলাতে ”কিরণ” স্টলেই আগুন লেগেছিল। তখন সোপকেস, বা ডলপুতুল তৈরি হোত গাটাপার্চার নামক উপাদানে। তাতেই সব ধু ধু করে জ্বলে যায়। গোদাকথা, মুকুন্দ দাসের যাত্রা আর দেখা হোল না।
থিয়েটার প্রসঙ্গে বলি। ডাক্তার রামচন্দ্র অধিকারী টি.বি. রোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ”যক্ষ্মা একটি সমাজিক ব্যাধি” এ বিষয়ে জনচেতনা তৈরি করাতে ওঁর বিশাল অবদান। এমন এক সময়ের কথা বলছি যখন ”প্রবাসী”, ”বিচিত্রা”, ”ভারতবর্ষ” এ সব সাহিত্যপত্রে অনেক রোমান্টিক গল্প পড়া যেত। সেখানে নায়ক ও নায়িকারা দেওঘর বা শিমুলতলা, বা হাজারিবাগ, কিংবা মধুপুরে টি.বি.—র কারণে হাওয়া বদলাতে যেতেন। সেখানে প্রেম হোত এবং হয় নায়ক, নয় নায়িকার মৃত্যু হোত বলে মনে পড়ছে।
রামবাবু থিয়েটার পাগল ছিলেন। ওঁর উদ্যোগেই আমরা উত্তর কলকাতায় ”সাজাহান” নাটক দেখেছিলাম।
এসব কথা কেন বলছি? লেখালেখির পেছনে সবচেয়ে মনে পড়ে আশৈশব বইপড়ার অবদান। হ্যাঁ, বই পড়েছি সব সময়। যতদূর মনে পড়ে সেই সঙ্গে ছবি দেখেছি, গান শুনেছি, সে সব স্মৃতিও তো কোথাও তার অবদান রেখে গেছে। তাই এত কথা বললাম। লেখার কাজটাই করে গেলাম। তার পিছনের কথাগুলোও না বললে নয়। তাই বলছি।
”ভাষাবন্ধন”—এর জন্য এ লেখাগুলো লেখা হয়ে যাচ্ছে। তাও ভালো লাগছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেখার অভ্যেস চলেই গিয়েছিল। চলে যাচ্ছিল, আবার কালিকলমের, অথবা ডটপেনের ও কাগজের কাছে ফিরে আসা বড় শান্তি দিচ্ছে।
বলেছি, বাংলা ছবি অনেক দেখি নি। তবে প্রমথেশ বড়ুয়া, কাননবালা (তখনো ”দেবী” নাম) ওঁদের অভিনীত ”মুক্তি” দেখেছি। ওই ছবিতেই পঙ্কজ মল্লিকের গলায় এবং সুরসংযোগে গাওয়া ”দিনের শেষে ঘুমের দেশে ঘোমটা পরা ওই ছায়া, ভুলালো রে ভুলালো মোর প্রাণ”—গানটি ছিল। পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া রবীন্দ্রনাথের ”এমন দিনে তারে বলা যায়” গানটিও সুখ্যাতি পায়।
দেখেছি প্রমথেশ বড়ুয়া ও যমুনার ”অধিকার”। আগেই বলেছি সায়গল ও লীলা দেশাই অভিনীত ”জীবন মরণ”—এর কথা। নায়িকা লীলা দেশাই—এর মুখে
”কভু ফোটে ফুল
ভাবি সে কি ভুল”—গানটি এখনো মনে পড়ে। আজকের মানুষদের কেমন করে বোঝাব, সে সময়ে বাংলা গান বাঙালীকে কী ভাবে মাতিয়ে রাখত! ১৯৪০/৪১ সালেই শচীন দেববর্মণের
”প্রেমের সমাধিতীরে নেমে এল
শুভ্র মেঘের দল
তাজমহলের মর্মরে গাঁথা
কবির অশ্রুজল, তাজমহল! তাজমহল!”
শচীন দেববর্মনের গানগুলি আমাদের হৃদয়—মন জয় করেছিল। এ সব গান সুযোগ পেলেই গাইতাম। মা অবশ্য রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া অন্য গান গাওয়ার বিরোধী ছিলেন।
শচীন দেববর্মণের ”তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে”, অথবা ”চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে”, অথবা ”স্বপন না ভাঙে যদি শিয়রে জাগিয়া রব” এ সব গান আজও শুনতে ইচ্ছে করে।
ছিলেন উমা বসু। ইনি হিমাংশু দত্ত সুরসাগরের দেওয়া সুরে গান গেয়েছেন। এক সময়ে দিলীপ কুমার রায় প্রদত্ত সুরে গেয়েছেন। লিখতে বসে মনে আসছে জসীমউদ্দীনের লেখা ”রাধা বলে ভাইরে সুবল” গানটির কথা। মনে পড়ছে ”কেন তারে মন রে দিলাম” গান। মনে পড়ছে, ”প্রাণের বাঁশি আয় রে—মনের বাঁশি আয় রে—জল ফেলিতে যমুনাতে যাই” গানটি। দিলীপকুমারের সুরে ওঁর গান ”মুরলী মধু সুরে নীলিমার পুরে বন্ধন যায় দূরে” গানটি।
এই অসামান্য গায়িকা অতি অল্প বয়সে মারা যান। যক্ষ্মা হয়েছিল। আজকের দিনে হলে হয়তো মরতেন না।
দমদেওয়া গ্রামোফোনেই সংস্কৃতিতৃষ্ণা (তখন জানতাম না ”সংস্কৃতিতৃষ্ণা” বলে কোনো ব্যাপার আছে) তৃপ্ত হোত। যূথিকা রায়ের ”আমি ভোরের যূথিকা” অথবা ”পথিক আমি ফিরি একাকী” অথবা সুপ্রভা সরকারের গাওয়া নজরুলের ”কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা—আনমনে গাঁথ চম্পা শেফালিকা” এমন কত গান রেকর্ড বাজিয়ে শুনেছি। ভাগ্যে বাবার মন খুব খোলামেলা ছিল। হীরাবাই থেকে যূথিকা রায়, সবই কিনতেন।
এ সময়ের অনেক পরে হয় ”মীরা” ছবি, যাতে দিলীপকুমার রায় সুর দেন ও শুভলক্ষ্মী অভিনয় ও গান করেন। সেই ”বৃন্দাবন কুঞ্জ ভবনে নাচত গিরিধারী”, অথবা ”ইয়াদ আয়ে ইয়াদ আয়ে বৃন্দাবন কী মঙ্গললীলা”, এবং আরো কত গান—সেও শুনতাম খুব।
দিলীপকুমার রায়ের স্বকণ্ঠে গাওয়া বেশ কিছু রেকর্ড ছিল। অনেক আগে গাওয়া ”মুঠোমুঠো রাঙা জবা কে দিল তো পায়ে” গানটির সুর কি তাঁর নিজের? ভুলে গেছি। তবে ”সেই বৃন্দাবনে লীলা অভিরাম সবই আজো পড়ে মনে মোর, পড়ে যে কেবলি মনে”, কথা ও সুর তাঁরই। মনে করি এ সব পুরনো গানের ঠিকুজিকুষ্ঠি আজও যদি কেউ জানেন ও মনে রাখেন আমার পরিচিতদের মধ্যে, তিনি ”আজকাল” কাগজের অলোক চট্টোপাধ্যায়। যাক গে, আমার লেখা একান্তই স্মৃতিনির্ভর।
১৯৪০ (?) নাগাদ পঙ্কজ মল্লিকের গান ”দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কি রে” মনে পড়ে । মনে পড়ে সায়গলের গান—
”বাঁধিনু মিছে ঘর
ভুলের বালুচরে”—
”মীরা” ছবির কথা বলেছি। ওই ছবির কিছু পরে, অথবা কিছু আগে উদয়শংকরের ”কল্পনা” ছবিও একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা উপহার দিল বাংলা ও বাঙালিকে। এই ছবিতে অমলাশংকর ও উদয়শংকর ছিলেন। ছিল অনেক গান। খুবই অন্যরকম ছবি। বাংলা গান, যেমন
”আজ কেন ওরে মন
চঞ্চল অকারণ
নিজ হাতে দ্বার খুলি
প্রিয় দিল কি রে দরশন।”
ছিল হিন্দি গান। মনে হচ্ছে থীম ছিল ভারতচেতনা। কৃষিভারত বিষয়ে ”হিন্দুস্তান কা বল হ্যায় হল (?)” আজও মনে পড়ে।
সকলের কথা তো লেখা হোল না। যেমন মনে আসছে, তেমন লিখে যাচ্ছি। হিন্দী ছবিও দেখেছি কিছু। নিউ থিয়েটার্স সে সময়ে ভারতে ফিলমের রাজা। মেট্রো গোলডুইন মেয়ার্সের ছবি শুরুর আগে সিংহ দেখানো হোত। নিউ থিয়েটার্সের শুরুতে থাকত হাতি। নিউ থিয়েটার্সের ব্র্যানড হল ছিল ”চিত্রা”। আরো হল থাকতে পারে। কিন্তু ”চিত্রা” ছিল সবার চেনা।
ওই ১৯৩৯—৪৪ এর মধ্যে দেখি লীলা দেশাই অভিনীত ”কপালকুণ্ডলা”। কে পরিচালক, আজ মনে নেই। মনে পড়ে দেবকী বসু পরিচালিত বাংলা ”সাপুড়ে” ও হিন্দি ”সপেরা”। দেখেছি রকসি সিনেমায় বম্বে টকিজের ”বসন্ত ও ”কিসমৎ”। এ সব ছবির সব গান মনে নেই। বাঙালী সেদিন বাংলা গানই শুনত বেশি। আর সব গান সবসময়ে ছবির গান নয়।
কিন্তু সায়গল বাংলা ছেড়ে বম্বে চলে যান। সেখানে গায়িকা, গায়ক অনেকেই সর্বভারতীয় খ্যাতি পান। নূরজাহান, বেগম শামসদ অনেক পরে পাকিস্তান চলে যান, দেশভাগ হয়ে যাবার পর।
দুজনেই ছিলেন অসামান্য গায়িকা। নূরজাহান ”জীনৎ” ছবিতে গেয়েছিলেন ”তু কোন সি বাদল মেঁ হায় মেরি চাঁদ হায় আ জা”। ”রতন” ছবিতে শামসদের ”আঁখিয়া মিলাকে জিরা ভরমাকে চলে নহী� জানা” কলকাতাকে মাতিয়ে দেয় এক সময়ে। তবে সায়গল ও খুরশিদের ”তানসেন” ছবির গান আমাদের সে সময়ে, কৈশোরের শেষ, যৌবনের উন্মেষ দুইয়ের সন্ধিক্ষণে একেবারে ভাসিয়ে নিয়েছিল। সায়গলের ”দিয়া জ্বালাও”, খুরশিদের সঙ্গে ”মোরি বালাপনকে সাথী ছৈলা ভুল জাইও না”, খুরশিদ কণ্ঠে ”বরসো রে” সেদিনের তরুণ শ্রোতাদের খুব ভাসিয়ে নিয়েছিল। আজও মনে আছে।
বাড়িতে বিশেষ কেউ মাথা ঘামাত না। যার যা ইচ্ছে তাই শুনছে। কি আর করা যাবে। আমার সেজকাকা ছিলেন ভালোমানুষ, স্বল্পভাষী। গান শুনতে ভালোবাসতেন। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, শচীন দেববর্মণ, এঁদের গান সেজকাকা রেকর্ড কিনে শোনাতেন। গ্রামোফোনটি যত্ন করে রাখাও ছিল তাঁরই কাজ। ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময়ে হঠাৎ বাবা বললেন, ”ইংরিজি পড়ো”। সে সময়েই আমাকে কিনে দিলেন তুর্গেনিভের ”অন দি ইভ” আর ”ফাদার্স অ্যান্ড সান্স”। আর সেজকাকা আনল ”ল্যামস টেলস ফ্রম শেকসপীয়ার”। বলল, এই বইটা নিয়ে শুরু করবি।
সেজকাকা সবসময় ইংরেজি ছবি দেখাতে নিয়ে যেত। হ্যাঁ, ছবি দেখেছি। সিনেমার গান শুনেছি। রেকর্ডে হিন্দি ধ্রুপদী গানও শুনেছি। এই গোত্রের গান শোনার ব্যাপারে সেজকাকার নিজস্ব রুচিবোধ ছিল। বলত, আবদুল করিম খাঁর ”যমুনা কী তীর” শোন। ভালো গান শোনার কান তৈরি হবে। কেশর বাই, হীরাবাই বরোবদকরা, এঁদের রেকর্ডও বাজাত। বলত, সব সময় হালকা গান আর সিনেমার গান শুনলে হবে?
শুনেছি, সবই শুনেছি, কিন্তু সংগীত বিষয়ে রুচিবোধ জন্মাবার প্রবণতা তো ছিল না। অনেক কিছু হয় নি। মিতুল খুব সুকণ্ঠী ছিল, ওর গলায় সুরবোধও ছিল। ওকে মাঝে মাঝে গান শেখাবার চেষ্টা করা হোত, তেমন লাভ হয় নি। তবে সিনেমার গান গলায় তুলে নিত অনায়াসে, গাইতও গলা ছেড়ে।
সেজকাকা বলত, খুকু! তোর হবে না। মিতুলের হবে।—আর শেকসপীয়ারের নাটকের গল্পগুলো বই ধরে পড়া ধরত। এতে খারাপ মানসিক ব্যায়াম হয় নি। ওই বইটি পড়েই শেকসপীয়ারের নাটকগুলির গল্পাংশ পড়ে ফেলি। মনে হয় সেটা ভালোই হয়েছিল। তারপর থেকে একটু একটু করে ইংরেজি বই পড়াও অভ্যেস হয়ে যায়।
মিতুল খুবই পাগল ছিল। ইস্কুলে বারবার ভর্তি হয়েছে মেদিনীপুরে, কলকাতায়, রংপুরে, কিন্তু স্কুলে যায় নি। প্রথম স্কুলে গেল বহরমপুরে। নাইন আর টেন—এ পড়ল। ম্যাট্রিক পাশ করল। তারপর কলকাতায় এসে সেজমামার বাড়ি থেকে সরকারী আর্ট কলেজে ভর্তি হোল।
প্রথম ইংরেজি বই পড়ল ”গন উইথ দি উইণ্ড” বিশাল মোটা বই। সিনেমাটা দেখে খুব ভালোলেগেছিল, তা বলতেই হবে। কিন্তু বই তো বিশালকায়।
আবার এ কথাও সত্যি, ও অমন বয়সেই পড়া যায়। পাঠকই ছিলাম, লেখক হলাম। কিন্তু পড়তে পড়তেই তো লেখক হওয়া। পড়ি তো আজও। কিন্তু তেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়া তো এখন আর পারি না।
সব কিছুরই সময় থাকে।
৩
পড়তেও শিখতে হয়। তা ছোটবেলাই জেনেছিলাম। শেখাতে চেষ্টা করেছিলেন দিদিমা। আমি বই পড়তাম না, গিলতাম। ধরতাম আর শেষ করতে চেষ্টা করতাম। এ একটা অভ্যাস। যা স্বভাবে ঢুকে গিয়েছিল। অভ্যাসটা যে খুব ভালো, তা বলতে পারি না। যত বই পড়েছি তার কতটুকু বা মনে আছে। অবশ্য থাকলেও বা কি হোত।
দিদিমার পাঠানুরাগ এমন ছিল যে এখন ভাবলে অবাকই লাগে। শুধু গল্প উপন্যাস পড়তেন না, সবরকমের বইই পড়তেন। আমি মূলত গল্প—উপন্যাসই পড়েছি। সাহিত্য, নারীজগৎ, দেশের কথা, এ সব বিষয়ে প্রবন্ধও পড়তেন। বাড়িতে মাসিক প্রবাসী, বিচিত্রা ও ভারতবর্ষ রাখতেন। সন—তারিখ সব মিলিয়ে সেগুলি বাঁধাতেন, আলমারিতে সাজানো থাকত। দোতলায় চারটি ঘর ছিল। তিনটিতেই বইয়ের আলমারি থাকত। বের করি আর পড়ি। সেভাবেই আবিষ্কার করা গেল যে সামনে এক থাক বই আছে যেমন, পিছনেও আরেক থাক বই আছে।—লিখতে লিখতে ভাবছি, অত বই গেল কোথায়, কার কাছে গেল।
পড়তে শেখাতেন বলতে সামান্য কিছু মনে পড়ছে। ”দুর্গেশনন্দিনী” থেকে একটি অংশ (আমার সঠিক মনে ছিল না। ”ভাষাবন্ধন”—এর রাজীব চৌধুরীর সাহায্য নিয়ে সঠিক গদ্যাংশটি টুকে নিয়েছি।) তা এইরকম :—”নিশা অন্ধকার, তাহা অনিবিড় মেঘাবৃত; নক্ষত্রাবলী দেখা যাইতেছে না, কদাচিৎ সচল মেঘখণ্ডের আবরণাভ্যন্তরে কোনো ক্ষীণ তারা দেখা যাইতেছে…” দিদিমা পড়তে পড়তে বললেন, ”রাত্রির কি চমৎকার বর্ণনা দেখেছিস? পড়বি বুঝে বুঝে। নিজেও ভাববি।”
সব কি আর পেরেছি?
গোবিন্দ চন্দ্র রায়ের ”ভারতবিলাপ” মুখস্থ করছি তো দিদিমা বললেন, ”পড়তে শেখো, পড়তে শেখো। ওটি ”তোটক” ছন্দে লেখা। এইভাবে পড়বে।
কত কা—ল পরে
বলো ভা—রত রে
দুখ সা—গর সাঁতারি
পা—র হবে।”
অত মনেযোগী ছাত্রী ছিলাম না। সব শেখা হয় নি। বলতেন, ”রাজর্ষি” পড়ো। ওই যে রাতের বর্ণনাটা? জয়সিংহ ছুরিতে শাণ দিচ্ছেন?”
সত্যিই অসামান্য বর্ণনা। কবে ”রাজর্ষি” পড়েছি। ২০০৫—এর আগস্ট মাসে জীবনে প্রথম ত্রিপুরা গেলাম। প্রাচীন রাজধানী উদয়পুরে গিয়ে নদীর ওপারে সেই প্রতিমাহীন শূন্য মন্দির দেখে এলাম। খুব নির্জন জায়গাটি। ”রাজর্ষি”—র কথাই মনে পড়ছিল।
দিদিমার বই থেকে যত বই পড়েছি, সব মনে নেই। দামোদর মুখোপাধ্যায় গ্রন্থাবলী ওখানেই পড়ি। এই লেখক বঙ্কিমের বৈবাহিক। বঙ্কিমের ছেলে ছিল না, সবাই মেয়ে। ”বেয়াই যদি লিখতে পারেন, তিনিও পারবেন। তিনিও বি.এ. পাশ। তিনিও ডেপুটি।”—দিদিমা হেসে হেসে বললেন। বঙ্কিম ”কপালকুণ্ডলা” লিখলেন, দামোদর আরেকটি উপসংহার লিখলেন ”মৃন্ময়ী।” বঙ্কিমের ”দুর্গেশনন্দিনী”র পর ইনি লিখলেন ”নবাবনন্দিনী”।
রমেশচন্দ্র দত্তের ”মাধবীকঙ্কন”, ”রাজপুত জীবনসন্ধ্যা” এবং ”মহারাষ্ট্র জীবনপ্রভাত” দিদিমার পাঠক তৈরির পাঠশালেই পড়েছি। কিন্তু তাঁর লেখা ”সংসার” ও ”সমাজ” পড়ার ইচ্ছে পূর্ণ হোল ১৯৩৬—৩৮ শান্তিনিকেতনে এসে। শান্তিনিকেতনের অতি ঋদ্ধ গ্রন্থাগার রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত অজস্র বইয়ে পরিপূর্ণ। সেখানেও বই পড়ার শিক্ষা চলত। কোনো বিধিনিষেধ নেই। নির্বাচন করো, বই নাও। পড়ে ফেরৎ দেবে। তবে হ্যাঁ, একবারও যদি দেখি বই অযত্নে ব্যবহার করেছ, আর বই পাবে না।
সীতা দেবী, শান্তা দেবী এঁদের গল্প—উপন্যাস বিষয়ে দিদিমার অত ঝোঁক ছিল না। তা বলে কি আমি পড়তে ছাড়তাম? ”বিচিত্রা”—তে (ঠিক বললাম?) ”পথের পাঁচালী” পড়ার আশ্চর্য অভিজ্ঞতা যে জানে, সে জানে। মনে হয় ”বিচিত্রা”—তেই ”পথের পাঁচালী” সম্পূর্ণ বেরোয়। সেখান থেকেই প্রথম উপন্যাসটি পড়ি।
ইতিহাসে দিদিমার গভীর অনুরাগ ছিল। বুঝি না বুঝি। পড়ে যেতাম। সেভাবেই পড়েছি সখারাম গণেশ দেউস্করের ”দেশের কথা”। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ”সিরাজদ্দৌলা” ও ”ফিরিঙ্গি বণিক”। তাঁর লেখা ”ঝাঁসির রানী” বইটি আমাকে পড়তে দেন বিনয় ঘোষ। সে অনে—ক বছর বাদে। দিদিমার বইটি কপাতা পড়েই রেখে দিতে হয়। বইটি জরাজীর্ণ হয়েছিল। তখন বই বুড়ো হলে সকালের নরম রোদে সেঁকে, তামাকপাতা বইয়ের ভাঁজে রেখে যত্নে তুলতে হোত।
দিদিমার একটি আলমারি তৈরি করানো হয় নিমকাঠে। ওটি ছিল দামী অথচ জীর্ণ বইদের হাসপাতাল। নগেন্দ্রনাথ বসুর ”বিশ্বকোষ” রাখবার জন্য এক স্বতন্ত্র বুককেস ছিল। একা আমারই দুর্লভ অধিকার ছিল সব আলমারি ও শেলফের সব বই দেখবার, নেবার, পড়বার। সেইজন্যেই ”টমকাকার কুটীর” বইটিও পড়া হয়ে যায়।
পড়তাম, খুব পড়তাম। বিপিনবিহারী গুপ্তের ”পুরাতন প্রসঙ্গ” জীবনে তিনবার পড়েছি। দিদিমার কাছে তো বটেই, শান্তিনিকেতনে বি.এ পড়তে গিয়ে আরেকবার। আর তৃতীয়বার পড়লাম ”বসুমতী সাহিত্য মন্দির” থেকে কিনে ও এনে। বই কিনতে পারি, আনতে পারি, কিন্তু ধরে রাখতে পারি না।
চলে যায়। নিয়ে যায়। এ পর্যন্ত কত বই এ ভাবে ঘর ছেড়েছে হিসেব নেই। আমার প্রথম বই ছিল ”ঝাঁসীর রানী”। ঠিক তার আগে রাসসুন্দরী দেবীর ”আমার জীবন” বইটি পুনর্মুদ্রিত হয়ে বেরিয়েছে বাংলা লিখছেন এমন মেয়েরা ওই বইটি জোগাড় করে পড়বেন কি? আমি তো বিমুগ্ধ বিস্ময়ে পড়েছিলাম।
যে জন্যে এ বইয়ের কথা লিখছি, তা হোল আমার জীবনে প্রথম সাহিত্য পুরস্কার পাই ”চৈতন্য লাইব্রেরি” থেকে। সেই অভিজ্ঞতা আজও ভুলি নি। ওঁরা রাসসুন্দরী দেবী এবং ”আমার জীবন” বইয়ের কথা ওঁদের লিখিত ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন।
উপহার যা যা দেন, তাতে দুই খণ্ডে ”বঙ্কিম রচনাবলী” এবং ”কুলায় ও কালপুরুষ” (সুধীন্দ্রনাথ দত্ত) ছিল! কোথায় সে সব বই? আরেকবার কেউ ”বঙ্কিম রচনাবলী” উপহার দিক, এবার স্টীলের আলমারিতে রেখে দেব।
দিদিমার কাছে নয় বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা মাথা খাটিয়ে বুঝে নিয়ে পড়ার প্রথম শিক্ষা হয়েছিল। কিন্তু গদ্য লেখকরা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা বারবার পড়তে পারেন। কি অসামান্য গদ্য না লিখতেন। কত কম শব্দ ব্যবহার করে কত বেশি বলতে পারতেন! সেই লেখক তো আচার্যসদৃশ। যিনি পাঠককেও ভাবিয়ে তোলেন। লেখক ও পাঠকের এ ভাবে একাত্ম হওয়াটা এমন একটা পাঠাভ্যাস, যাতে পাঠকেরই লাভ হয়।
আমি সবসময়ে বলি, আমি ইতিহাস সন্ধান করি। নিরন্তর ইতিহাস থেকেই পাঠ নিই। কিন্তু যা পড়ি, তা বইয়ে ছাপা ইতিহাস নয়। দুটো ছাপা লাইনের মাঝে যে সাদা জায়গাটা থাকে, সেখানে, আমার মতে, থাকে লোকবৃত্তের ইতিহাস।
লোকবৃত্তের ইতিহাস খুঁজতে হয়, খুঁজলে পাওয়া যায়। ছেলেকে ঘুমপাড়ানোর ছড়া, ”বর্গী এল দেশে” কোনো মুদ্রিত ইতিহাস নয়। তবে ”বর্গী” বা মারাঠা ঘোড়সওয়ার বর্গীরা সত্যিই এসেছিল। ৯—১০ বছর ধরে বাংলাকে ছারখার করেছিল।
এটা বলাই দরকার, বইপড়া বিষয়ে ছিলাম সর্বভুক। গল্প—উপন্যাস পড়েছি। আর ভালোবেসেছি। আজও ভালোবাসি আত্মচরিত, জীবনী, ইতিহাস এবং তথ্য (Data, Statistics, Information) সম্বলিত বই পড়তে। এ সব বইও আজীবন পড়ে গিয়েছি।
বলতেই হবে ছোটবেলা গল্পের টানেই বই পড়তাম। যা পাচ্ছি তাই পড়ছি, ছোটরা যেমন হয়। বই পড়ার যথেষ্ট অভ্যাস ভাইবোনদেরও ক্রমে ক্রমে হয়েছিল। ছোট ছেলেমেয়েদের বই পড়ার অভ্যাস থাকলে মায়েদের জীবন শান্তিপূর্ণ হয়, তা জানা কথা। এখনো অনেক বাংলা বই বিষয়ে ”যা মনে করতে পারছি না” তেমন তথ্য আমি আমার চতুর্থ বোন সোমা মুখোপাধ্যায়ের কাছেই জেনে নিই। আর শব্দ, শব্দের ব্যবহার ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে জানতে হলে সোমার স্বামী + অভিধানবিশারদ অশোক মুখোপাধ্যায়কে জিগ্যেস করি। বই বিষয়ে নবারুণের স্মৃতিশক্তিও খুব ভালো। ও সবসময়ে ঠিকঠাক তথ্য দিতে পারে।
ছোটবেলা থেকে মাসিকপত্র (ছোটদের) কি কি পড়তাম সব মনে নেই। ”সন্দেশ” তখন, অর্থাৎ ১৯৩০…বেরোয় না বলেই মনে করি। আমি লিখেছি সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত ”সন্দেশ” কাগজে।
ছোটবেলা সকলের লেখাই পড়েছি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সুখলতা রাও, লীলা মজুমদার, সকলের লেখা পড়েছি। লীলা মজুমদারের লেখায় ধার, কৌতুকবোধ, উজ্জ্বলতা ও নিজেকে নিয়েও হাসার ক্ষমতা অসামান্যই ছিল।
তাঁর বিষয়ে ”ছিল” লিখতে হচ্ছে, এটাই দুঃখের। লীলাদি আছেন। আজও আছেন, শুনি,—দেহে বেঁচে আছেন, ওই পর্যন্ত। সে লীলাদি আর নেই, ইচ্ছে হলেই যাঁর কাছে চলে যেতে পারতাম।
”মৌচাক”, ”রামধনু”, ”রংমশাল” ক্রমে ক্রমে পড়ি। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ”আরব্যোপন্যাস” ছোটদের মন কেড়ে নিতেই এসেছিল। সীতা দেবী, শান্তা দেবী সহ কতজন না অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজি থেকে,—মনীষী দে ছবি এঁকেছিলেন। ”আরব্যোপন্যাস” একটি মহাভোজের ব্যাপার ছিল।
এখনো ”হাতের নাগালে বাংলা বই পেলে ছোটরা বই পড়ে না” এ আমি বিশ্বাস করি না। যারা মা—বাবাকে বই পড়তে দেখে নি, তারা পড়বে না। অন্যরা পড়বে, পড়েও। না যদি পড়ে, তার পিছনের কারণগুলি অনুসন্ধান করা দরকার।
বাঙালী পরিবারে যারা এখনো অনাবাসী নন, দেশে থেকেই ইংরেজিমাধ্যমে শিক্ষা কেনেন সন্তানদের জন্য, তারা যথেষ্ট বাংলা পড়ে না, বাংলা বই কেনেন না। এ মতো আচরণ করে আমরা নিজেদের পায়েই কুড়োল মেরে চলেছি। এটা যদি সমস্যা না হয়, সমস্যা কি? ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ছবিটা উচ্চবিত্ত সমাজে একই রকম। কিন্তু বাঙালীর তো ”বাংলা ও বাঙালী” নিয়ে অনেক গর্ব। এখনকার গর্ব দেখা গেল বাঙালী ক্রিকেটার সৌরভকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের নাম নিয়ে বাঙালীর বিশেষ চিন্তা নেই। শান্তিনিকেতনের জমিজমা দীর্ঘকাল প্রোমোটারদের দখলে, এই লেখা লিখতে লিখতেই টি.ভি—তে দেখলাম, শান্তিনিকেতনের খোয়াই ও অন্যত্র চা—বাগিচা হবে।
বই চাই, বাংলা বই চাই। বাংলামাধ্যমে পড়েছি আমরা, আজকের জীবিত প্রবীণ থেকে নবীন, প্রায় সব লেখকরা। ”লেখক” শব্দটি আমি মহিলা ও পুরুষ সকলের বেলাই ব্যবহার করি। মেয়ে—কেরানী, মেয়ে—ডাক্তার, ইত্যাদি যখন বলি না, তখন ”যিনি লেখেন, তিনিই লেখক” বলতে অসুবিধে কোথায়? ইংরেজিতে তো সবাই ”রাইটার”। যাক গে, এটা আমার নিজস্ব মত মাত্র।
ফিরে যাই বইয়ের কথায়। কিছু লেখকের বই আজ তো বাজারে থাকা খুব দরকার। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ”ভোম্বল সর্দার” আমাদের হাতে হাতে ফিরত। ধীরেন্দ্রলাল ধরের ”আবিসিনিয়ার ফ্রন্টে” অথবা ”কামানের মুখে নানকিং” বড় আনন্দে পড়েছি। ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য ”রামধনু” পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ”রামধনু” পড়তাম। সম্ভবত ওঁর দাদা মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের লেখা খুব ভালো ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়েছি ”ঘোষচৌধুরীর ঘড়ি”।
যখন ছোটদের বই—ই পড়ার কথা, তখনি তো বাংলায় যা পাচ্ছি, তাই পড়ছি। কত না বই মনের অতলে আজও ঘুরে বেড়ায়। সময়টা ১৯৩৬—৩৮। মেদিনীপুরে আছি। পড়ি শান্তিনিকেতনে। ছুটিতে আসি বাড়িতে। মা খুব বড় বড় চিঠি লেখেন। তুতুল লেখেন মাঝে মধ্যে। সে সময়ে তুতুল ”বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষৎ”—এর সভ্য হয়েছিলেন বলে মনে হয়। সাহিত্য পরিষৎ প্রকাশিত বই বাড়িতে প্রচুর দেখতাম। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের ”দুরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ”, রামরাম বসুর ”রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র” এ সব বই শুধু পড়ার তীব্র ক্ষুধা থেকেই পড়ে ফেলি। অনেক পরে পড়লাম ”পুরাতন প্রসঙ্গ”। বিপিনবিহারী গুপ্তের বই। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাভিত্তিক লেখা। এ বইটি বহুকাল বারবার(৪/৫ বার তো হবেই) পড়েছি। কৃষ্ণকমল খুবই নিয়মভাঙা মুক্তমনা সাহসী মানুষ ছিলেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গেও তর্ক করতেন।
ওঁর নাম লিখতে বসে মনে পড়ল চিন্মোহন সেহানবীশের সঙ্গে এক আলাপচারিতার কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে কোনো বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সন—তারিখ মনে নেই। চিন্মোহনবাবু তখন ছাত্র; উপস্থিত শ্রোতাদের কাছ থেকে কাগজে সই নিচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখেন একটি নামের স্বাক্ষর,—”কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য”। চিন্মোহনবাবু তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য নিজের ঠিকানাও লিখে দেন। কি সে ঠিকানা সে আর বলব না। কৃষ্ণকমল ৯২ বছর বয়সে মারা যান। চিন্মোহনবাবু বলেছিলেন, শেষ জীবন অবধি চিরবিদ্রোহী সাহসিক মানুষই ছিলেন।
এত পুরনো সব বই পড়তে পেয়েছি। সেও তো সৌভাগ্য। যতীন্দ্রমোহন সিংহের ”উড়িষ্যার চিত্র” কবে পড়েছি, তা খুব বলতাম। অজয় গুপ্ত সে বইটি জোগাড় করেও দেন, এবং যথারীতি সেটি আর খুঁজে পাই নি।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ”সংবাদপত্রে সেকালের কথা” মাঝে মাঝেই পড়েছি। তথ্যকোষ বললেও চলে, এমন আশ্চর্য সংকলন। বিজনের ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু বিনয় ঘোষ আমার বইয়ের অযৌক্তিক ক্ষিদে মেটাতে বই দিতেন। বিনয়বাবুকে জিগ্যেস করেছিলাম,”পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি বইয়ে শ্রীচৈতন্য ও নবদ্বীপ, দুইয়ের কোনো উল্লেখ নেই কেন?” বিনয়বাবুকে এ প্রশ্ন সম্ভবত অন্য কেউও করে থাকবেন।
নীহাররঞ্জনের রায়ের সঙ্গে বেশি দেখা হোত ডক্টর প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের বাড়িতে। প্রতুলবাবু মহারাষ্ট্রের ইতিহাসের অধ্যাপক। ”ঝাঁসীর রানী” লেখার সময়ে অনেক সাহায্য করেন। ওঁর বইয়ের সংগ্রহ ভালোই ছিল। ওঁর কাছ থেকে এনে একসময়ে ”পেংগুইন নিউ রাইটিং” অনেক খণ্ড পড়েছি।
বাংলা পড়তে শুরু করেছি অনেক আগে। ইংরেজি পড়ার শুরু অবশ্যই গল্প—উপন্যাস দিয়ে। ক্রমে অলৌকিক জগৎ—অপরাধ সাহিত্য—ডিটেকটিভ গল্প এ সব কিছু আবশ্যিক পাঠ্যসূচি হয়ে গেল। গোড়ার দিকে গল্প—উপন্যাস, এমনকি তুর্গেনিভ, ডস্টয়ভস্কি, তলস্তয়, চেকভ, মপাসাঁ, প্রুস্ত—যা পেয়েছি—সব পড়েছি। মনে পড়ে, সব পড়তাম ইংরেজি অনুবাদে। আমি যে সব রুশ বই পড়ি, তার অধিকাংশেরই অনুবাদক ছিলেন কনসট্যানস গার্নেট। ডিকেনস থেকে গলসোয়ার্দি, যা পেয়েছি তাই পড়েছি। সে এক সময় ছিল।
সময় যাচ্ছে, যাচ্ছিল, চলে গেল, এমন কতই হোল। মানের বই পড়াপড়ির সময়টিতে অনেক দশক ধরে অনেক বই পড়লাম। সর্বভুক পাঠক ছিলাম বলে মিছে বলা হবে না।
ডিটেকটিভ বই, একদিনের কোনান ডয়েল বা এডগার অ্যালান পো হোক, আগাথা ক্রিস্টি বা ডোরোথি সেআর্স হোক। এই সেদিনের (অর্থাৎ বিশ বছর আগেকার) লেখকরা হোক, গভীর নিষ্ঠায় সবই পড়েছি। অপরাধসাহিত্য গিলে চলার অভ্যাস পিতাসূত্রে পাওয়া।
একই উৎসাহে ভূত, জাদুময় অতিপ্রাকৃত জগৎ (আয়ার্ল্যাণ্ড ও প্রাচীন জার্মানিতে এমন কাহিনীর ছড়াছড়ি) যা পেতাম তাই পড়তাম। স্টীফেন কিংয়ের ”ডেড জোন” বা ”গ্রীনটানেল” আবার পেলেই পড়তে পারি, আবার,—জোগাড় করার উৎসাহ চলে গেছে।
প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক গাছপালা জীবজন্তু বিষয়ে আগ্রহ তো আজও। পৃথিবীতে আজ অরণ্য প্রাণী জগৎ বিলোপ পেতে বসেছে। তবু আজও দূরদর্শনে দেখি ”জীবজন্তুকে বাঁচিয়ে রাখা” যে দরকার, সে কথার ওপর জোর দেন না চ্যানেল স্রষ্টারা।
বিপন্ন, খুব বিপন্ন পৃথিবী, প্রকৃতি, প্রকৃতির জীবন ও উদ্ভিদ সংসার। ভারতে শকুনের চাষ করতে হচ্ছে।
অরণ্য এবং আরণ্য নিয়ে আমার আগ্রহ ছিল অন্তহীন। জিম করবেটের বইগুলি যে জন্যই বারবার পড়েছি।
অন্তহীন আগ্রহ ছিল সবকিছুতে। অনুবাদেও আগ্রহ ছিল, মানতেই হবে। রুশ, জার্মান, ইটালীয়, ফরাসী, ভারতের মালয়ালম, মারাঠী, তেলগু সাহিত্য সবই তো পড়েছি অনুবাদে।
ইংরেজি অনুবাদে।
শেখার ক্ষেত্রে ওই আগ্রহেই, শ্রদ্ধেয় লেখক ও ভারতের জনজাতির প্রকৃত বন্ধু ভেরিয়ার এল্যুইনের আত্মজীবনী অনুবাদ করি পৃথ্বীশ সাহার সঙ্গে। জিম করবেটের বইগুলি বেশ অনেকজনকে নিয়ে অনুবাদ করি। ”জিম করবেট অমনিবাস” দুই খণ্ডে বেরোয়। একসময় ”ভারতের লোককথা” অনেকজন মিলে বহু খণ্ডে অনুবাদ করি। আমার এতাবধি কাজকর্মের যা হিসেব দিলাম, তা খুবই অসম্পূর্ণ থাকছে। কেন না ছোটদের জন্য ভারতের নানা জায়গার লোককথা আর জাতকের গল্পগুলির এক নির্বাচিত সংকলন তৈরি করার ইচ্ছে রাখি। ঈশানচন্দ্র ঘোষ অনূদিত সমগ্র জাতক—এর যে করুণা প্রকাশনী—সংস্করণ আছে, সেই পুনর্মুদ্রণের অনুমতি পাওয়ার জন্য আমিও গিয়েছিলাম ঈশানচন্দ্র ঘোষের পুত্রের কাছে।
ইচ্ছা, নিদারুণ ইচ্ছা, আরো পড়ি, আরো লিখি। ”বয়স হয়েছে” জানি, মন মানতে চায় না।
২০০৬ সালে, ভারতের লোককথা আর জাতকের গল্প, এই দুটি নিয়ে দুটি সংকলন করে ফেলার ইচ্ছা। এখনকার তরুণদেরই ডাকব। তাদের সহযোগিতা পেতেই হবে, নইলে হবে না। ২০০৬ সালেই ২০২৬ অবধি কী লিখব, কী কাজ করব, সেটা ছকেও ফেলব। কাজও শুরু করব।
এ পর্যন্ত রইল। নিশ্চয় আবারও দেখা হবে।
***