লাল বল
পল্লব অবাক হয়ে দেখল, কুড়ি বছর বাদে লাল বলটা আবার মণিপুকুরের জলে ভেসে উঠেছে।
মাঝের প্রত্যেকটা বছর পল্লব এইভাবেই দুর্গাপুজোর নবমীর দিনে, মণিপুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বলটাকে কোনোবারেই দেখতে পায়নি। আজ সেই হারিয়ে যাওয়া বল নিজে থেকেই চোখের সামনে বেরিয়ে এসেছে।
বলটাকে দেখে প্রথমেই যে চিন্তাটা পল্লবের মাথায় এল, তা হল, সামান্য একটা রবারের বল কি এতদিন আস্ত থাকে। নষ্ট হয়ে যায় না? না কি বলটা প্রাণপণ চেষ্টায় আজকের দিনটার জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
পল্লব অবাক হয়ে ভাবল যে, মধ্যের কুড়ি বছরে সে নিজে দশ থেকে পৌঁছে গেল তিরিশে, তার অনেকগুলো চুলে রুপোলি রং লাগল, তার চোখে চশমা উঠল, সে দৌড়োতে ভুলে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য দ্যাখো— বলটার একটুও বয়েস বাড়েনি!
বহুক্ষণ ধরে দুটো আওয়াজ বাতাসে গড়াগড়ি খাচ্ছিল— হালদারবাড়ির দুর্গাদালান থেকে ভেসে আসা ঢাকের গুমগুমানি আর অর্জুন গাছের ঘন পাতার আড়ালে বসে থাকা একটা ঘুঘু পাখির নরম স্বরের কূজন। যে মুহূর্তে পল্লবের চোখ লাল বলটার ওপর পড়ল, সেই মুহূর্তেই দুটো আওয়াজই একসঙ্গে থেমে গেল। থেমে গেল বলেই পল্লব বুঝতে পারল আওয়াজ দুটো ছিল; বুঝতে পারল এবার কী ভীষণ নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে উঠেছে তার চারদিকে।
আর ওই একই সময়ে একটা জাহাজের মতন বড় মেঘ এসে পল্লবের মাথার ওপরের আকাশটাকে ঢেকে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গে মণিপুকুরের জলের রংটাও নীল থেকে বদলে হয়ে গেল তিমি মাছের মতন পেছল কালো। সেই কালো জলের মধ্যে আগের থেকেও আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল লাল টুকটুকে ক্রিকেট বলটা। যেন ওইখানে তিমিমাছটার পিঠে হারপুন বিঁধেছিল। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে।
পল্লব আস্তে আস্তে পুকুরের পাড়ে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। এখন তাড়াহুড়ো করার সময় নয়। ওই বল আজ এমনি এমনি ভেসে আসেনি। কিছু একটা হবে আজ। হবেই। আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
পড়ন্ত শরতের দুপুরে মাটি থেকে ভাপ উঠছিল। ভেসে আসছিল ঝোপের মধ্যে ফুটে থাকা ভাট ফুলের গন্ধ। পল্লব মাথা তুলে দেখল, সেই মেঘটা একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেখল, একটা নীল ফড়িং বারবার ঘাসের ডাঁটির ওপর এসে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে।
দূরে চোখ মেলে দিয়ে পল্লব দেখল, শহরের শেষপ্রান্তে, তাদের ছোটবেলার মানিকপিরের মাঠে, দুয়েকটা সদ্য তৈরি হওয়া বাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। এদিকে এখনও পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি। ইলেকট্রিকের খুঁটিও পোঁতা হয়নি। নেহাত যাদের উপায় নেই, তারাই বোধহয় এই তেপান্তরে বাড়ি তৈরি করে বসবাস করতে এসেছে। বাড়িগুলো প্রত্যেকটাই ভীষণ একলা। একটার থেকে আরেকটার দূরত্ব অনেক। এতদূর থেকেও বাড়িগুলোর মনখারাপ টের পেল পল্লব।
.
সেটাও ছিল একইরকমই শরতের দুপুর, দুর্গানবমী। নুটু, রানা, বিশু, স্বপন— ওরা সবাই বাঁশের বাখারির উইকেট, প্যাকিং কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি ব্যাট এইসব কাঁধে তুলে নিয়ে হইহই করতে করতে বাড়ি ফিরে গেল। বলল, একটু বাদেই হালদারবাড়ির নবমীর বলি হবে। দেখতে যাবি না?
বিলাস তাই শুনে ওদের পেছনে খোঁড়া পা নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল। পল্লবই ওকে পেছুডাক দিয়ে থামাল। এই, তুই কোথায় যাচ্ছিস? তোর তো পাঁঠাবলি দেখলে গা গুলোয়।
বিলাস বলল, না আমি বাড়ি যাব।
এখন বাড়ি গিয়ে কাউকে দেখতে পাবি না কি?
বিলাসের বয়েস তখন নয়। পল্লবের মাসতুতো ভাই, ওর থেকে ঠিক এক বছরের ছোট। পুজোয় পল্লবদের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। বিলাসের পোলিও বলে একটা অসুখ হয়েছিল। সেই জন্যে ওর ডান পা—টা ছিনে পড়া, বাঁকা। ওই খারাপ পায়ের ওপর হাতের ভর দিয়ে ঝুঁকে, ভালো পাটা টেনে টেনে বিলাস চলাফেরা করে।
খোঁড়া পায়ের জন্যে বিলাসের কিচ্ছু আটকায় না। ডান হাতটা ডানপায়ের হাঁটুতে রেখে কুঁজো হয়ে দুলে দুলে দারুণ জোরে হাঁটে। হাফপ্যাডেল করে সাইকেল চালায় আরও জোরে। সবচেয়ে বড় কথা বিলাস প্রত্যেকবছর ক্লাসে ফার্স্ট হয়।
পল্লবের কথা শুনে বিলাস বলল, কেনরে ছোড়দা? দেখতে পাব না কেন?
মা, বাবা, সেজোমাসি তিনজনে বেলুড়মঠে ঠাকুর দেখতে গেছে। ওদের ফিরতে এখনও অনেক দেরি। আমি জানি। আমিও তো প্রত্যেকবারেই যাই। তোর জন্যেই এবার বাড়িতে রয়ে গেলাম।
বিলাসের মুখটা পল্লবের এই কথায় একটু ম্লান হয়ে গেল। খিদে পেয়েছিল বলেই বাড়ি ফিরতে চাইছিল বোধ হয়। পল্লব ওর কাঁধে হাত রেখে বলল, চল না, আরেকটু ক্যাচ ক্যাচ খেলি।
কথাটা বিলাসের মনোমতো হল। সে এক গাল হেসে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে নতুন ক্যাম্বিস বলটা বার করে হাঁটতে হাঁটতে জমিটার অন্যপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর বলটা আস্তে করে ছুড়ে দিল পল্লবের দিকে।
হিংসে হয় বিলাসকে দেখলে। বোধহয় ওর একটা পা খোঁড়া বলেই, কিংবা হয়তো ক্লাসে ফার্স্ট হয় বলে ওর বাবা মা ওকে কোনো জিনিসে না করে না। এই পুজোয় পল্লব একটা ক্যাপ ফাটানোর বল্টু পেয়েছে, কিন্তু বিলাস পেয়েছে দারুণ একটা রিভলবার। বল্টুর মধ্যে একটা একটা করে ক্যাপের টিপ ঢুকিয়ে আছাড় মেরে ফাটাতে হয়, আর রিভলবারে ক্যাপের ফিতে ঢুকিয়ে দিলেই হল। পল্লব একটা ক্যাপ ফাটাতে না ফাটাতেই বিলাস একদম মেশিনগানের মতন ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই করে দশটা ফাটিয়ে দিচ্ছে।
পল্লবের হাফপ্যান্ট, কিন্তু বিলাসের বেলবটম।
পল্লবের সবুজ রবারের বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধওয়ালা এক টাকার বল, দুবার ওভার বাউন্ডারি মারলেই পেট ফেটে যায়। কিন্তু বিলাসের…
…বিলাসের ছুড়ে দেওয়া লাল ক্যাম্বিস বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখল পল্লব। যেন বল নয়, একটা ছোট্ট পোষা প্রাণী। তুলোর মতন মিহিন লোমে সারা গা ঢাকা। বলটা হাতের মুঠোয় ধরে নিজের গালে একবার বুলিয়ে নিল পল্লব। আঃ! কী আরাম। কী সুন্দর তাজা ঘাসের মতন গন্ধ বলটার শরীরে। এরকম একটা বলের জন্যে সেও বাবার কাছে পাঁচটা টাকা চেয়েছে অনেকবার। পায়নি।
কী রে ছোড়দা! বলটা খেয়ে ফেলছিস না কি? থ্রো কর।
বিলাসের শরীরের অনেকটা দূর দিয়ে বলটা ছুড়ল পল্লব। বেড়ালকে এগিয়ে আসতে দেখলে বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির বাচ্চা যেরকম ডানা ঝাপটে দৌড়োয়, ঠিক সেইভাবে বিলাস হুমড়ি খেয়ে দৌড়ে বলটাকে ধরল। তারপর অভিমান মাখানো গলায় বলল, একটু কাছাকাছি দে ছোড়দা! আমি কি তোদের মতন ব্যালেন্স রাখতে পারি?
পল্লব বলটা হাতে নিয়ে দেখল, মাথার ওপর একটা চিল ছাড়া আর কোনো জীবিত প্রাণীর চিহ্ন নেই কোথাও। বিলাসের পেছনে চড়া রোদ্দুরে ঝলমল করছে মণিপুকুরের জল। সে এবারে বলটা ছুড়ল বিলাসের মাথার ওপর দিয়ে।
বিলাস লাফাল। বলটা হাতের নাগালে পেল না। পাওয়ার কথাও ছিল না। মাটিতে নামবার সময় আগে তার অপুষ্ট ডান পা জমি ছুঁল। সঙ্গে সঙ্গে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল বিলাস।
কিছুটা দূরে ‘টবাং’ করে একটা শব্দ হল। মণিপুকুরের জলে গা ভাসিয়েছে লাল বল।
দু—চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ পল্লবের দিকে চেয়ে রইল বিলাস। তারপর দু—হাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে সোজা করল। হেঁটে গেল মণিপুকুরের পাড়ে। পেছন পেছন পল্লবও গেল।
মণিপুকুরের জল কেউ ব্যবহার করে না, ব্যবহার করার লোকই তো নেই কাছাকাছি। তাই এই পুকুরটায় বাঁধানো কোনো ঘাটও নেই। নানান জংলা গাছ আর ঝোপঝাড়ে ভরতি পুরো পাড়টা। সেই খাড়া পাড় নেমে গেছে নাকফুল আর শালুকে ঢাকা জলের দিকে। এক জায়গায় ছোট ছোট সাদা নাকফুলের লতাগুলো একটু সরে গেছে। সেখানেই স্থির হয়ে ভাসছে লাল বলটা। পাড় থেকে খুব একটা দূরে নয়। হাত বাড়ালেই পাওয়া উচিত, না হলে বড়জোর হাঁটুজলে নামতে হবে।
বিলাস ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে পল্লব। বলল, বলটা তুলে আন না ছোড়দা।
পল্লবের মনে পড়ে গেল কাল রাত্তিরে, সবাই শুয়ে পড়ার পর বাবা আক্ষেপ করে মাকে বলছিল— দ্যাখো, বিলাস তো তোমারই বোনের ছেলে। অথচ ওর মাথা কত শার্প। চোখদুটো দেখেছ? যেন হীরের মতন ঝকমক করছে। আমাদের ছেলেটা এত ডাল হল কী করে? একটা অঙ্ক দশবার বুঝিয়েও ঠিক করাতে পারি না?
বর্তমানে ফিরে এল পল্লব। চিৎকার করে বলল, পারব না। আমি কি তোর চাকর না কি? নিজের বল, নিজে কুড়িয়ে আন। ও পরিষ্কার দেখতে পেল, এই কথায় বাবার প্রশংসিত সেই হীরের মতন চোখদুটোর ওপর একটা আবছা জলের পরদা নেমে এল।
পল্লবকে আর কিছু না বলে বিলাস খুব সাবধানে তার ভালো পা—টা এগিয়ে দিল পাড়ের ঢালু জমিতে। তবুও ওর শরীরটা পিছলে গেল, ও হড়কে গিয়ে পড়ল জলের মধ্যে। ছিটকে ওঠা জলে বিলাসের শার্টের পেটের কাছটা অবধি ভিজে গেল। পল্লব দেখল, বিলাসের জলে আছড়ে পড়ার ধাক্কায় বলটা একটু সরে গেছে, তবুও এখনও ওটা ওর হাতের নাগালের মধ্যেই রয়েছে।
পল্লব পায়ের কাছ থেকে একটা ঢিল তুলে নিল।
একটা বেজি পাড়ের আকন্দ ঝোপের মধ্যে গোলাপি নাকটা বার করে ওদের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। পল্লবকে ঢিল তুলতে দেখেই সুট করে ঝোপের মধ্যে ঢুকে গেল। পল্লব টিপ করে ঢিলটা ছুড়ল— বেজিটার দিকে নয়, বলটার দিকে।
ঢিলের ঘায়ে বলটা অন্তত ছ’ফুট দূরে ভেসে গেল। বিলাস চিৎকার করে উঠল— ছোড়দা—আ—আ—আ। তার গলায় জেদি রাগ। এবং কিচ্ছু না ভেবে জলের ওপর দু—হাত থাবড়ে বলটার দিকে এগিয়ে গেল বিলাস। কিন্তু জলের মধ্যে নেতিয়ে পড়া ডান পাটায় হাতের ভর দিতে পারল না তাই দু—পা গিয়েই বিলাসের শরীরটা টলটল করে উঠল। তার পরেই পল্লব দেখল, কখনও চিৎ হয়ে, কখনও উপুড় হয়ে বিলাস ভেসে যাচ্ছে মাঝপুকুরের দিকে।
পল্লব দেখল, বিলাসের সামনে সামনে, যেন তাকে পথ দেখিয়েই ভেসে যাচ্ছে লাল বল।
একেকবার বিলাসের মাথাটা জলের ওপর ভেসে উঠছে আর তার ঠোঁটের কাছে উঠে আসছে বড় বড় বাতাসের বুড়বুড়ি। ও কি ছোড়দা, ছোড়দা বলে চিৎকার করছে? না কি, বাঁচাও বাঁচাও বলে? কে জানে।
শেষবারের মতন একটা বড়সড় ঢিল তুলে লাল বলটার দিকে ছুড়ল পল্লব। যথেষ্ট। বিলাসের হাতের নাগালের অনেক বাইরে চলে গেছে বলটা।
প্যান্টের পেছনে ভিজে হাতটা মুছতে মুছতে পল্লব দেখল, জলের ওপর বিলাসের চুলে ভরা মাথা আর চোখদুটো একবার ভেসে উঠল। সেই চোখে বিস্ফারিত দৃষ্টি। তার দিকেই তাকিয়ে আছে বিলাস। তার পরেই পুরো মাথাটা ডুবে গেল মণিপুকুরের জলে।
হালদারবাড়ির পুজোমণ্ডপের দিকে তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করল পল্লব। বলি শুরু হয়ে গেছে। ঢাক বাজছে চড়চড় করে।
.
কুড়ি বছর আগের সেই দুপুরে পল্লব বুঝতে পারেনি যে, ওই বিস্ফারিত দুটো চোখের দৃষ্টি তাকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়াবে। সব সময় নয়…ঠিক যখনই সে কোনো কিছু পেতে যাবে, হাত বাড়িয়ে নিতে যাবে, তখনই। তখনই একটা ভিজে চুলে ভরা মাথার নীচ থেকে দুটো ভয়ার্ত চোখ তার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সেই চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে যাবে পল্লব। তার আর কোনো কিছু পাওয়া হবে না। কোনো কাজ শেষ করতে পারবে না সে।
জানা অঙ্কের শেষ ধাপে এসে তার চোখ পড়ে যাবে ওই চোখদুটোর দিকে। তার আর উত্তর মেলানো হবে না। দৌড় প্রতিযোগিতার শেষ ল্যাপে এসে, ফিতে ছোঁয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে সে হঠাৎ শুনতে পাবে মণিপুকুরের জলে লাল বল ছিটকে পড়ার ‘টবাং’ শব্দ। সে সম্মোহিত মানুষের মতন উঠে আসবে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে থেকে। তিরিশ বছর বয়সে পৌঁছেও তার কোনো জীবিকা থাকবে না।
তার জন্যে তার বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে মারা যাবে, তার মায়ের সব চুল অকালে সাদা হয়ে যাবে।
কুড়ি বছর আগের সেই নবমীর দুপুরে পল্লব ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে, সে বিলাসকে নয়, তার নিজেরই সমস্ত আনন্দকে খুন করে চলে এসেছে।
প্রতি বছর নবমীর দুপুরে পল্লব সবার চোখ এড়িয়ে মণিপুকুরের তীরে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে বলে, ক্ষমা কর, ক্ষমা কর বিলাস। মুক্তি দে আমাকে। আমাকে একটু বাঁচতে দে।
কিন্তু আজ অবধি, কোনো বছরেই মণিপুকুরের জলে কোনো চিহ্ন খুঁজে পায়নি পল্লব— না বিলাসের, না লাল বলের। যেন কোনোদিন কোনো শিশু ডুবে মরেনি ওই জলে, এমনই নিষ্পাপ সেই জলের চেহারা। তাই আজ কুড়ি বছরের ব্যবধানে লাল বলটাকে পুকুরের মাঝখানে ভেসে আসতে দেখে পল্লবের বুকের রক্ত চলকে উঠল। সে ধীরে ধীরে ঘাসের ওপর বসে পড়ল। বসে বসে দেখতে লাগল সামান্য হাওয়ায় মণিপুকুরের জলে কেমন অল্প অল্প ঢেউ উঠছে। সেই ঢেউয়ের দোলায় কেমন দুলছে লাল ক্যাম্বিসের বলটা। দেখতে দেখতে ঘোর লেগে গেল পল্লবের চোখে।
হঠাৎই তার বুকের মধ্যে থেকে কে কেন বলল, এই বলটা আমার খুব প্রিয়। সবে কালকেই ওটা মা আমাকে কিনে দিয়েছে। ওটা আমি হারিয়ে যেতে দেব না। বলটা আমার চাই।
চমকে উঠে চারপাশে তাকাল পল্লব। কে বলল কথাগুলো?
বলটা আমার চাই—ই—ই— বাইরে নয়, পল্লবের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ন থেকে তীক্ষ্নতর হয়ে উঠল এক বালকের চিৎকার।
হ্যাঁ, কোনো ভুল নেই। এই আওয়াজ তার নিজের ভেতর থেকেই আসছে। এই আওয়াজ পল্লবের নয়…বলটার জন্যে এই ভয়ঙ্কর আগ্রহও তার নয়। বিলাসের।
পল্লবের শরীরের মধ্যে থেকে বিলাস চিৎকার করছে। বিলাস মাথা কুটছে পল্লবের বুকের মধ্যে। দাও দাও দাও। ফেরত দাও আমার বল। ফেরত দাও, ফেরত দাও।
সেই আর্তনাদ উপেক্ষা করবার ক্ষমতা তার নেই। পল্লব উঠে দাঁড়াল। এক মুহূর্তের জন্যে পল্লব বুঝতে পারল সে এক ন’বছরের বালকে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। এই নির্জন মণিপুকুরের ধারে আজ সে বিলাস হয়ে যাচ্ছে। ওই বলটাকে তার মনে হচ্ছে জীবনসর্বস্ব। ওটা ছাড়া বেঁচে থাকাই মিথ্যে।
এই মনে হওয়াটা তার নয়, বিলাসের। কুড়ি বছর আগে এইরকম মন নিয়েই বিলাস তার বিকলাঙ্গতা ভুলে জলে নেমেছিল।
পল্লব মণিপুকুরের ঢালু পাড়ে পা রাখল।
তার শরীরটা পিছলে গিয়ে পড়ল জলের মধ্যে। তার চশমাটা ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে, কাদার মধ্যে। তবু পল্লব থামল না, কিংবা বলা ভালো থামতে পারল না। তার বুকের ভেতর থেকে দুটো ছোট ছোট হাত তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল জলের দিকে। ঢেউয়ের ধাক্কায় বলটা একটু সরে গিয়েছিল। দু—হাতে পানা সরাতে সরাতে পল্লব গোঁয়াড়ের মতন সেই দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে পল্লব একবার তাকিয়েছিল জলের মধ্যে ডুবে থাকা নিজের পায়ের দিকে। দেখেছিল ডান পা—টা কেমন যেন সরু আর বাঁকা লাগছে। কেন? তা মাথায় ঢুকল না পল্লবের। তখন তার ওসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়ই ছিল না। বুকের মধ্যে বিলাস ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছে— সময় নেই, সময় নেই, দেখছ না বলটা ভাসতে ভাসতে মাঝপুকুরে চলে যাচ্ছে?
আর দু—পা এগোতেই পল্লবের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। তবুও সে প্রাণপণে হাতটা বাড়িয়ে দিল ভেসে থাকা বলটার দিকে। ঠিক তখনই আঁশটে জলের প্রথম ঝলকটা তার নাক—মুখ দিয়ে মসৃণভাবে ঢুকে গেল ফুসফুসের মধ্যে।
পাখির ডাক আর দূরগত বলির বাজনার শব্দ যখন তার কানে ফিরে এল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
.
কাকু!
ভেসে ওঠা মৃতদেহটাকে মণিপুকুরের জল থেকে তুলে, অপেক্ষারত পুলিশের হাতে জিম্মা করে দিয়ে, জেলে দুজন তাদের জাল গুটিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎই পেছন থেকে একটা বাচ্চার ডাক শুনে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। মুখ ফিরিয়ে দেখল, তিন চারটে কমবয়েসি ছেলে ভিতু ভিতু মুখ করে তাকিয়ে আছে। ওদের মধ্যেই একটা বাচ্চা আবার বলল, কাকু, ওটা আমাদের দাও না।
ছেলেটা আঙুল তুলে দেখাল জালের ভাঁজে আটকে থাকা লাল ক্যাম্বিসের বলটার দিকে।
না বাবা, ও জিনিস ছুঁতে নেই।
ওটা আমাদেরই বল। বিশ্বাস করো। কাল ওই মাঠে খেলতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তা হোক বাবা। মড়া মানুষের মুঠোর মধ্যে ছিল তো। এ জিনিস নিয়ে খেলতে নেই। বাড়িতে বোলো, নতুন বল কিনে দিতে।
চমৎকার একটা জার্নি শেষ করলাম এই বইটার সাদে। সবগুলো গল্পই খুব ভালো লেগেছে ।