লাল খাম
১
সোমেন ঘরটার চারপাশ ভালো করে দেখছিল৷ সতর্কতা অবলম্বন করা সবসময় ভালো৷ ঘরটা মনে হয় ভদ্রলোকের স্টাডি রুম৷ দেওয়ালের চারপাশ জুড়ে সারসার আলমারী৷ তাতে রাশিকৃত বই৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে বেশ বড়ো একটা টেবিল৷ তার একপাশে প্রফেসরের রিভলরিং চেয়ার৷ অন্যপাশের তিনটে চেয়ারে পাশাপাশি সোমেন, মাধব, আর কৈলাশ৷ মাথার ওপর ঘড়ঘড় সিলিং ফ্যানের শব্দ ছাপিয়ে বাইরে থেকে জানলা দিয়ে অন্য একটা শব্দ ভেসে আসছে৷ জলোচ্ছাসের শব্দ সম্ভবত৷ পাহাড়টা জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে৷ জববলপুর৷ মার্বেল রকের কাছেই এ জায়গাটা৷ কৈশাল ছাড়া সোমেন বা মাধব দেখেনি জায়গাটা৷ আগে একবার কী কারণে কৈশাল এ জায়গাতে এসেছিল৷ এখানে আসার প্ল্যানটা তারই৷ আজ সকালেই তারা তিনজন এখানে এসে পৌঁছেছে৷
কৈলাশ এক সময় সন্ধিগ্ধভাবে বলল, ‘কীরে সোমেন, চাকরটা তো বলল, ‘বাবু এখনই আসছেন৷ দশ মিনিট তো হয়ে গেল! কেন যে তুই ভরদুপুরে লোকটার সাথে দেখা করতে এলি কে জানে? তিনরাত ঘুমাইনি৷ ঘুমালে কাজ দিত৷’ সোমেন চাপা স্বরে বলল, ‘যে বাড়িতে উঠলাম, তার মালিককে একটু বাজিয়ে নেওয়া ভালো৷ তেমন হলে ডেরা পাল্টাতে হবে৷’
‘লোকটা কী করে বল তো? নেমপ্লেটে কী যেন ইংরাজিতে লেখা ছিল৷ ইংরাজিটা পড়তে পারলাম না’,— মাধব বলল৷
সোমেন জবাব দিল, ‘ওঁর নেমপ্লেটে দেখলাম এ লোকটা ‘প্যারাসাইকোলজিস্ট!’ বাংলায় যাকে বলে ‘পরামনোবীদ৷’ এরা শুনেছি টেলিপ্যাথি, থট রিডিং— এসবের মাধ্যমে মানুষের মনের খবর জানতে পারে৷ ভূত-ভবিষ্যৎ বলতে পারে৷ আমি একটা ইংরাজি বইতে পড়েছি এদের কথা৷ যদিও ব্যাপারটা ঠিক আমার বিশ্বাস হয় না৷ বিজ্ঞানও ব্যাপারটা মান্যতা দেয় না৷’
কথাটা শুনে কৈলাশ বলল, ‘যাক আর পান্ডিত্ব ফলাতে হবে না তোকে৷ আমি নয় তেমন পড়াশোনা করিনি৷ কিন্তু তুইতো এম. এ. পাশ করেও শেষ পর্য্যন্ত…৷’
কথাটা শেষ করতে পারল না কৈলাশ৷ তার অগেই ঘরে ঢুকলেন একজন ভদ্রলোক৷ ছিপছিপে চেহারা, পাজমা-পাঞ্জাবীর ওপর একটা জহরকোট৷ চোখে সোনালি চশমা৷ ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি৷ বয়স মনে হয় ষাটের কোঠায় হবে৷
ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন৷ সোমেনরাও প্রতিনমস্কার জানাল৷ ভদ্রলোক নিজের চেয়ারে বসে তিনজনকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, ‘আমিই প্রফেসর কাঞ্জিলাল৷ আপনারা?’
সোমেন সঙ্গেসঙ্গে জবাব দিল, ‘আমরা আজ সকালেই এখানে এসেছি৷ আপনার বাড়ির একতলার একটা ঘর দুদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছি৷ আমি তপেশ প্রামাণিক, আর এরা দুজন প্রাঞ্জল আর রাধাবিনোদ৷’
প্রফেসর কাঞ্জিলাল বললেন, ‘ভাড়ার বাপারটা সাধারণ আমার কাজের লোক শিউসরণই দেখে৷’
সোমেন শুনে বলল, ‘না ভাড়ার বাপার নয়, আমরা আপনার সাথে পরিচিত হতে এসেছি৷ আপনি বাঙালি, সম্ভবত, দীর্ঘদিন এখানে আছেন৷ এখানে কী কী দেখার জায়গা অঅছে আমাদের বলে দিলে সুবিধা হয়৷’
ভদ্রলোক বললেন, ‘হ্যাঁ, এখানে বেশ কিছু দেখার জায়গা আছে৷ মার্বেল রক, বেদঘাটতো এ জায়গাতেই এ বাড়ির হাতার মধ্যে৷ নর্মদার উৎসস্থলটাও দেখে আসতে পারেন৷ সেটাও দুরে নয়৷ একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে যেতে পারেন চৌষট্টি যোগীনীর মন্দির, বান্ধবগড় ন্য্যাশানাল পার্ক এ সব৷ তা আপনারা নিশ্চই বন্ধু৷ কী করেন আপনারা?’
মাধব সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল, ‘ব্যবসা৷ পড়াশোনা শেখার পর চাকরি-বাকরি তেমন হল না৷ তাই ব্যবসা করি৷ কনস্ট্রাকশন বিজনেস৷ তাছাড়া একটু আধটু জমিটমি কেনাবেচা৷ তা আপনি কী করেন? কলেজে পড়ান?’
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘এক সময় পড়াতাম, সাইকোলজির প্রফেসর ছিলাম, এখন প্যারাসাইকোলজির র্চ্চা করি৷ প্যারাসাইকোলজি ব্যাপারটা বেঝেন?’
সোমেন মাধবকে জবাব দিতে না দিয়ে বলে উঠল, ‘আমি একটু আধটু শুনেছি ব্যাপারটা সম্বন্ধে৷ প্যারাসাইকোলজিস্ট হিপ্নটিজম, টেলিপ্যাথি, থটরিডিং- এ সবের মাধ্যমে মানুষের মনে খবর জানতে পারে, এবং তা বিশ্লেষণ করে ভূতভবিষ্যতও বলতে পারে৷’
প্রফেসর কাঞ্জিলাল বললেন, ‘বাঃ, আপনি কিছুটা জানেন দেখছি৷ আসলে প্যারাসাইকোলজি একটা বিরাট বিষয়৷ আপনিও যা বললেন তা প্যারাসাইকোলজির বিভিন্ন অংশ মাত্র৷ প্যারাসাইকোলজির মূল বিষয় কোনো মানুষের মনের সাথে কোনো বাহ্যিক বিষয় ছাড়াই সম্পর্ক স্থাপন৷ তার মনের খবর নেওয়া, তার মনের ওপর প্রভাব ফেলে আপনার ইচ্ছা শক্তি দ্বারা তার ইচ্ছাকে প্রভাবিত করা৷ এক্ষেত্রে অবশ্য টেলিপ্যাথির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে৷’
সোমনে আড়চোখে দেখল কৈলাশের চোখমুখে ধীরে ধীরে বিরক্তি ফুটে উঠতে শুরু করেছে৷ এসব অলোচনা ভালো লাগছে না৷ সোমেন প্রফেসরের উদ্দেশ্যে বলল, ‘কিন্তু বিজ্ঞান তো এসব বিষয় স্বীকার করে না শুনেছি?’
তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন সোমেনের দিকে৷ সোমেনও তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷ মুহূর্তখানেকের মধ্যেই সোমেনের হঠাৎ মনে হল তার কপালের শিরা দুটো কেমন জানি দপদপ করতে শুরু করেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে নিল সে৷
প্রফেসর কাঞ্জিলাল এবার ধীর কণ্ঠে বললেন, ‘মুর্খ-পণ্ডিতরা অনেক কিছুই দেরি করে স্বীকার করেন৷ এক সময় তো তাঁরা হোমিওপ্যাথি, আকুপাংচার এসবকেও চিকিৎসাবিদ্যা বলে স্বীকার করতেন না৷ আপনাদের এ প্রসঙ্গে একটা গল্প বলি৷ গল্প নয় সত্যি ঘটনা৷ আপনারা যে টেলিপ্যাথির কথা বলছিলেন তা নিয়েই ঘটনাটা৷ আপটন সিঙ্কোলেয়ার ছিলেন একজন বিখ্যাত প্যারাসাইকোলজিস্ট৷ ১৯২০ সালে তিনি একটা পরীক্ষা করেন৷ যার পরীক্ষক ছিলেন স্বয়ং ভূবনজয়ী বিজ্ঞানী আইনস্টাইন৷ দূরবর্তী শহরে থাকা তাঁর স্ত্রী মেরীর সাথে সিঙ্কোলেয়ার টেলিপ্যাথির মাধ্যমে মানসিক সম্পর্ক স্থাপন করেন৷ সিঙ্কোলেয়ারকে তাঁর সাথে সম্পর্কহীন অপরিচিত একজন পরপর একশটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছবি আকার নির্দেশ দেন৷ সিঙ্কোলেয়ারের ইচ্ছায় নয়৷ সেই ভদ্রলোকের নির্দেশ মতো৷ সিঙ্কোলেয়ার যে ছবি গুলো আঁকেন টেলিপ্যাথির প্রভাবে সেই ছবিগুলো প্রায় সঙ্গেসঙ্গে আঁকেন দূরবর্তী শহরে বসা তার স্ত্রী মেরী! হুবহু একই ছবি! আইনস্টাইন সিঙ্কোলেয়ারের সততাকে সন্দেহাতীত বলে মত প্রকাশ করেন, এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে৷ ১৯২১ সালে বিখ্যাত মনোবীদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে তিনি যদি দ্বিতীয়বার এ পৃথিবীতে জন্ম নেন ও মনবিজ্ঞানী হন তবে সে ক্ষেত্রে মানুষের মনের গোপন রহস্য জানার জন্য প্যারাসাইকোলজির সাহায্য নেবেন৷ ফ্রয়েড ও আইনস্টাইন নিশ্চই খুব ছোটো মাপের মানুষ ছিলেন না?’
তাঁর কথা শুনে মাধব বলে উঠল, ‘তার মানে আপনারা মানুষের চিন্তা ভাবনা বুঝতে পারেন? ইচ্ছা শক্তির দ্বারা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? ঐ সিঙ্কোলেয়ার বলে লোকটা দূর থেকে যেমন তার স্ত্রী ভাবনাকে তাঁর ইচ্ছায় পরিচালিত করেছিলেন তেমন করতে পারেন?’
প্রফেসর কাঞ্জিলাল দৃঢ় ভাবে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, পারি৷’
কৈলাশ এতক্ষণ সবার কথা শুনছিল৷ এ সব ভারী ভারী বিষয়, নাম ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা তার ভালো লাগছিল না৷ প্রফেসর কাঞ্জিলালের কথা শুনে বেশ ক্ষিপ্ত ভাবে সে বলে উঠল, ‘বললেই হল? আপনারা মানুষের মনের কথা পড়তে পারেন? বলতে পারবেন আমার মনের ভিতর এখন কী আছে?’
সোমেন নিজেও বিশ্বাসর করে না ব্যাপারটা৷ কিন্তু পাছে লোকটা চটে যায় তাই সে কৈলাশকে বলল, ‘আঃ, উনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই পারেন৷’
কৈলাশ তার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, ‘পারেন যখন তখন বলুন না৷ অসুবিধা কী আছে?’
সোমেন কিছু একটা বলে ব্যাপারটা চাপা দেবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রফেসর কাঞ্জিলাল বলে উঠলেন, ‘উনি যখন বলছেন তখন চেষ্টা করে দেখি৷ আপনি তাকান আমার দিকে৷ আপনাদের দুজনের কাছে অনুরোধ পাঁচ মিনিট কেউ কোনো কথা বলবেন না৷ এই বলে চশমাটা কপালে তুলে তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন কৈলাশের দিকে৷ কৈশালও তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে৷
মুহূর্তের পর মুহূর্ত কেটে যেতে লাগল৷ সোমেন আর মাধব চুপচাপ তাকিয়ে দেখতে লাগল তাদের দুজনকে৷ সারা ঘরে ফ্যানের শব্দ আর বাইরে থেকে ভেসে আসা জলস্রোতের আবছা শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই৷
মিনিট চারেক পর ধীরে ধীরে একটা আবছা হাসি ফুটে উঠল প্রফেসর কাঞ্জিলালের ঠোঁটে৷ চশমাটা কপাল থেকে চোখে নামিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘ঠিক আছে, হয়ে গেছে৷’
কৈশাল তার ডানপাশের রগে হাত বোলাতে বলল, ‘কী বুঝলেন বলুন?’
কাঞ্জিলাল তার কথার প্রথমে কোনো জবাব দিলেন না৷ টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা লাল খাম আর একটা কাগজ বার করে সেই কাগজে খসখস করে প্রথমে দু-চার কলম কী লিখে সেটা আবার খামে ভরে আঠা দিয়ে মুখবন্ধ করে খাম আর কলমটা সোমেনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খামের মুখে আড়াআড়ি সই করুন৷ আজ রাত বারোটায় আপনারা কেউ খামটা দেখে যাবেন৷ খুলে দেখবেন আমরা টেলিপ্যাথি মেলে কিনা? খামে লিখে রাখি কারণ, ভবিষ্যতে মিলিয়ে দেখি কটা ক্ষেত্রে আমার রিডিং সত্যি হয়েছে৷ এটা আমার একটা অভ্যাস৷ নিজের কাজের হিসাব রাখি আমি৷’
কৈশাল বলল, ‘তা রাখুন, কিন্তু এখন মুখে বলতে কী অসুবিধা?’ প্রফেসর কাঞ্জিলাল বললেন, ‘ভাবনাটা আপনার হলেও এখন বলা একটু অসুবিধা আছে৷ তবে আপনার মাথায় নর্মদার উৎস দেখতে যাবার ইচ্ছা ঘুরছে এটুকু এখন বলতে পারি৷ এবার আমাকে উঠতে হবে৷’ এই বলে সোমেনের দিকে তাকালেন তিনি৷ সোমেন একটু ইতস্তত করে খামের জোড়ের মুখে একটা উদ্ভট সই করে দিল৷ ভদ্রলোক খামটা ড্রয়ারে রেখে চাবি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনারা তবে এখন যান৷ রাতে নিশ্চই আপনাদের কারো সাথে দেখা হবে৷’
২
ঘরে ফিরে আসার পর কৈলাশ গজগজ করে বলল, ‘যত সব বুজরুকি ব্যাপার৷ আমি তোদের মতো শিক্ষিত নই, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারি কেউ কারো মনের খবর জানতে পারে না৷ তবে লোকটার চোখের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে কপালের রগগুলো কেমন দপদপ করছিল৷ এতক্ষণ কারও চোখের দিকে তাকিয়ে থাকিনি৷’
মাধব বলল, ‘লোকটা যে বলল, ‘তোর অমরকণ্টক, মানে, যেখানে থেকে নর্মদা বেড়িযেছে সে জায়গা দেখার ইচ্ছা আছে৷ তখন তাই ভাবিছিলি নাকি?’
কৈলাশ বলল, ‘অনেক চিন্তাই তো ঘুরছিল মাথায়৷ লোকটা আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়ল৷ যে সব ট্যুরিস্ট এখানে আসে তারা সবাই ও জায়গা দেখতে যায়৷ ও জায়গার কথা মাথার মধ্যে সবারই ঘুরপাক খায়, আমাদেরতো লোকটা সাধারণ টুরিস্টই মনে করেছে৷’
সোমেন বলল, ‘যাক লোকটাকে তো দেখে আসা গেল৷ ওর দিক থেকে তেমন কোনো বিপদের আশঙ্কা নেই বলেই মনে হয়৷ লোকটা ওসব টেলিপ্যাথিট্যাথি নিয়েই তাকে৷ এরা সাধারণত নিজেদের পড়াশোনার বাইরে অন্যদের ব্যাপারে খুব একটা মাথা ঘামায় না৷ ব্যাপারটা আমিও বিশ্বাস করি না৷ তবে ওকে অবিশ্বাস করছি বললেও চটে যেতে পারে৷ কৈলাশ বলল, ‘না, ঘামালেই ভালো’৷ এই বলে সে তাকাল টেবিলের নীচে রাখা সেই চামড়ার ব্যাগটার দিকে৷ ওর মধ্যেই তো সোনার বাঁটগুলো আছে৷
মাধবও সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁরে, কত টাকার মাল হবে রে?’
কৈলাশ জবাব দিল, শেঠ সুরজমল তো বলেছিল দু-কোটি টাকার মাল৷ অবশ্য সে তখন জানতো না যে আমরা চোরের ওপর বাটপারি করব৷’ এই বলে হাসল কৈলাশ৷
মাধব এরপর প্রশ্ন করল, ‘ব্যাপারটা জানার পর সে কী করতে পারে মনে হয়? আমাদের পিছনে অন্য কোনো লোক লাগাবে, নাকি পুলিশে যাবে?’
সোমেন বলল, ‘সে নিজে পুলিশে যাবেনা কারণ, সোনাটা তো চোরই সোনা৷ পুলিশের কাছে গেলে ও নিজেই ফেঁসে যাবে৷ ও যেটা করবে তা হল অন্য কোনোভাবে আমাদের তিনজনের বিবরণ দিয়ে পুলিশকে জানিয়ে দেবে আমরা প্রচুর চোরাই সোনা নিয়ে কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যাচ্ছি৷ এতক্ষণে নিশ্চই সে তা পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে৷ পুলিশও খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে৷
মাধব আবার বলল, ‘কী মনে হয় সুরজমলের মুন্সি কী আমাদের চিনতে পেরেছে? সোমেন তো দূরে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ লোকটা ব্যাগ নিয়ে গলির মুখ আসতেই রিভলবারের বাঁট দিয়ে মাথার পিছনে মারতেই সে ফুটপাতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল৷ আমাদের মুখে কাপড়ও বাঁধা ছিল৷ রাত একটাতে লোকও ছিল না রাস্তায়৷’
সোমেন বলল, ‘লোকটা আমাদের চিনেছে কিনা তাতে কোনো যায় আসে না৷ সুরজমল আমাদের ভালো ভাবে চেনে৷ সে নিজেই আমাদের দিয়ে বার কয়েক অন্যের চোরাই সোনা ছিনতাই করিয়াছে৷ আমাদের খুঁজে না পেয়ে ঠিক সে বুঝে যাবে কাজটা আমরাই করেছি৷’
কৈলাশ বলল, ‘এখানে আপাতত ক-দিন গা ঢাকা দিয়ে থাকি৷ তারপর এখান থেকে মুম্বাই যাব৷ সেখানে আবার একজন শেঠ পরিচিত আছে৷ যে এসব মাল কেনে৷ তবে আমরা যদি তিনজন না হয়ে দুজন হতাম তবে ভাগবাটোয়ারা সুবিধা হত৷ দুজনে এককোটি করে পেতাম৷
মাধব বলল, ‘তার মানে? আমরা তিনজন, দুজন হব কেন?’
কৈলাশ দাঁত বার করে উত্তর দিল, ‘ওই যে বললাম ভাগের সুবিধা হত৷’
মাধব এর জবাবে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাইরে একটা গাড়ির শব্দ হল৷ জানলার পাখি তুলে কৈলাশ বাইরে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘পুলিশ!’
ঘরের একটাই দরজা৷ বেরোতে হলে পুলিশের সামনে দিয়েই বেরোতে হবে৷ পালাবার কেনো উপায় নেই৷ পুলিশ যে এত তাড়াতাড়ি তাদের কাছে পৌঁছে যাবে তা ধারণা ছিল না তাদের৷ জানলার ফাঁক দিয়ে তারা দেখতে লাগল পুলিশদের৷ পুলিশ অফিসার প্রথমে কেয়ারটেকার শিউরসণের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল, তারপর সোজা এগিয়ে আসতে লাগল সোমেনদের ঘরের দিকে৷ খাটের তলায় সোনার বাট ভরা ব্যাগটা রয়েছে৷ সোমেন আর কৈলাশের কোমড়ে রিভলবারও রযেছে৷ আর হয় তো পালাবার কোনো পথ নেই৷ তবুও নার্ভ হারালে চলবে না৷ সোমেনের ইশারায় ব্যাগটার ওপর একটা চাদর ফেলে দিয়ে মাধব আর কৈলাশ খাটে শুয়ে পড়ল৷
দরজায় পুলিশের রুল ঠোকার শব্দ হতেই সোমেন বলল, ‘কে?’
‘পুলিশ৷ দরজা খুলুন৷’ ওপাশ থেকে জবাব এল৷
সোমেন দরজা খুলে একটা বিরাট হাই তুলে চোখ কচলে তাকাল পুলিশ অফিসারের দিকে৷ যেন এতক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমছিল সে৷ সোমেনের মুখে উত্তেজনার কোনো চিহ্ন নেই৷ সে বলল, ‘কী ব্যাপার শিউসরণ, পুলিশ কেন?’
পুলিশ অফিসার সোমেনকে ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কলকাতা?’
সোমেন হেসে বলল, ‘আপনারা বাংলার লোক দেখেলেই কলকাতা ভাবেন৷ পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড়ো জায়গা৷ আমরা থাকি বারাকপুরে৷
অফিসার বললেন, ‘কোনো প্রমাণ আছে? কোনো পরিচয়পত্র?’
সোমেন তার পার্টস থেকে একটা ড্রাইভিং লাইসেসেন্স বার করে এগিয়ে দিল অফিসারের দিকে৷ বলা বাহুল্য তাতে সোমেনের ছবি থাকল্যে নাম-পরিচয় ভুয়ো৷ পুলিশ অফিসার লাইসেন্সটা হাতে নিয়ে দেখে ছবির সাথে তার চেহারা মেলালেন৷ তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, তবে আপনাদের ঘরটা আমি একটু তল্লাসী করে দেখতে চাই৷’
ইতিমধ্যে মাধব আর কৈলাশও বিছানা ছেড়ে উঠে এসে দাঁড়িয়েছে৷ সোমেন একটা শেষ চেষ্টা করার জন্য বলে উঠল, ‘তা তল্লাসী করবেন কেন? কি শিউসরণ, এ বাড়িতে তোমরা চোর-ডাকাতকে ঘর ভাড়া দাও নাকি? আগে জানলে এ বাড়িতে উঠতাম না৷ পুলিশ খানা-তল্লাসী করে চলে গেলে ভাড়ার টাকা ফেরত দেবে৷ আমরা অন্য জায়গাতে চলে যাব৷’ সোমেন হিন্দিতেই কথাগুলো বলল যাতে পুলিশ অফিসার কথাগুলো বুঝতে পারে৷
তার কথা শুনে মুহূর্তের জন্য একবার থমকে দাঁড়ালেন অফিসার৷ তারপর বললেন, ‘সরে দাঁড়ান৷ আমরা ঘরে ঢুকব৷’
আর কিছু করার নেই৷ পুলিশ যে ভাবে সামনেটা ঘিরে রেখেছে তাতে পালাবার পথ বন্ধ৷ ঠিক এই সময় একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আপনার কী ধারণা আমি ক্রিমিনালদের ঘর ভাড়া দেই? পুলিশের চাকরীতে কত বছর হল?’ কখনো যেন ওপর থেকে নেমে এসেছেন প্রফেসর কাঞ্জিলাল৷
ইন্সপেক্টর তাঁর গলা শুনে ফিরে তাকিয়ে বিস্মিত ভাবে বললেন, ‘প্রফেসর, এটা আপনার বাড়ি!’
কাঞ্জিলাল বেশ রুষ্ট ভাবে বললেন, ‘আমার বাড়ি বলেই তো জানি৷ নেম প্লেটটা খেয়াল করলেই বুঝতে পারতেন৷ পুলিশের চাকরী করলেও ওটুকু পড়ার যোগ্যতা আপনার আছে বলেই মনে হয়৷’
পুলিশ ইনস্পেক্টর একটু আমতা আমতা করে বললেন, ‘আসলে কলকাতা থেকে একটা খবর এসেছে৷ সেই জন্যই তল্লাসী চালাচ্ছি আমরা৷ অন্য রাজ্যেও বেশ কিছু জায়গাতে তল্লাসী চলছে৷’
কাঞ্জিলাল বললেন, ‘কোথায় কী হচ্ছে জানি না৷ আমার জানার দরকারও নেই৷ শুধু এটুকু বলি, এনারা সব ভদ্রলোক৷ তল্লাসী নিতে হয় নিন৷ আমার বাড়িতে তল্লাসী করার ওয়ারেন্ট আপনার কাছে আছে কিনা জানি না৷ তিরিশ বছর এ বাড়িতে আছি কিন্তু কোনো দিন পুলিশ ঢোকেনি এ বাড়িতে৷ আপনার সাথে এরপর আমার আদালতে দেখা হবে৷’
ভদ্রলোক কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে থমকে গেলেন অফিসার৷ তিনি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন প্রফেসর কাঞ্জিলালের চোখের দিকে৷ তারপর উপস্থিত পুলিশ কর্মীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘চলো সবাই গাড়িতে ওঠো৷’
সোমেনের যেন মনে হল গাড়িতে উঠে টুপি খুলে কপালের রগে একবার হাত বোললেন সেই অফিসার৷
পুলিশের গাড়ি বাড়ির চৌহুদ্দি থেকে বেড়িয়ে যেতেই প্রফেসর কাঞ্জিলাল সোমেনদের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, ‘ওরা ওরকমই৷ আসল অপরাধী না ধরে নিরিহ মানুষকে বিরক্ত করে৷ তবে এ ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলুন৷ শুনুন, আজ তো পূর্ণিমা৷ আজ রাতে একবার মার্বেল রকটা দেখে আসুন৷ চাঁদনী রাতে জায়গাটা অপূর্ব লাগে৷ আমার বাড়ির পিছন দিয়েও একটা পথ আছে সে জায়গাতে যাবার৷ সিউসরণ আবার আজ রাত্রে বাড়ি থাকবে না৷ নইলে ওকে আপনাদের সাথে পাঠাতাম৷ তবে সোজা পথ, চাঁদের আলো থাকবে৷ আপনাদের অসুবিধা হবে না৷’ এই বলে ভদ্রলোক সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন৷
সোমেন দরজাটা বন্ধ করে দিল৷ ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল তাদের৷ একটু ধাতস্থ হবার পর মাধব বলল, ‘লোকটার জন্য কপালের জোরে বেঁচে গেলাম৷ নইলে বামাল সমেত ধরা পড়তাম৷’
মাধব বলল, ‘ভাগ্য সবসময় সাথ নাও দিতে পারে৷ ব্যাগটা যদি অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলা যেত তবে রিস্কটা কমে যেত৷
কৈলাশ বলল, একটা কাজ করা যেতে পারে৷ কাঞ্জিলাল যে জায়গার কথা বলে গেল সে জায়গাতে আমি গেছি৷ জলের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো পাথরের খাঁজ আছে ওখানে, পাথরের দেওয়ালেও অনেক ফোঁকড় আছে৷ তার মধ্যে লুকিয়ে রাখা যেতে পারে ব্যাগটা৷ কেউ টের পাবে না৷’
সোমেন বলল, ‘ব্যাপারটা ভেবে দেখা যেতে পারে৷ তবে ও জায়গা সত্যি কতটা নিরাপদ দেখতে হবে৷’
মাধব বলল, ‘আমার আর সোমেনের তো জায়গাটা দেখা নেই৷ আগে দেখি?’
সোমেন বলল, ‘মাধব তুই একটা কাজ কর৷ ভদ্রলোককে কৃতজ্ঞতা জানবার জন্য একবার ওপরে যা৷ আর সেই ছুতোয় জেনে আসবি যে রাতে ওখানে কোন পুলিশ বা গাড়ি থাকে কিনা?’
মাধব সোমেনের কথা শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে ওপরে উঠল৷ সেই ঘরটাতেই আবার এসে বসেছিলেন কাঞ্জিলাল, তার হাতে একটা কাগজ পেন আর খাম৷ সম্ভবত কিছু লিখতে এখানে আবার বসেছেন তিনি৷ মাধবকে দেখে তিনি বললেন, ‘বসুন’৷ মাধব তাঁর মুখামুখি বসে বলল, ‘আপনি যে ভবে আমাদের পুলিশের হুজ্জতি থেকে বাঁচালেন সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এলাম৷ বেড়াতে এসে ঝামেলায় জড়ালে খুব মুশকিল৷ আচ্ছা, আপনিতো আমাদের রাতের বেলা ‘মার্বেল রক’ দেখতে যেতে বলছেন৷ ওখানে কোনা গার্ড থাকে না? তারা রাতে যেতে দেবে তো?’
কাঞ্জিলাল জবাব দিলেন, ‘যে দিক দিয়ে ট্যুরিস্টরা যায়, সেখানে থাকে৷ অ্যাক্সিডেন্টের ভয়ে রাতে ট্যুরিস্টদের যেতে দেওয়া হয় না৷ তবে আপনারা যে পথে যাবেন সে দিকে কেউ থাকে না৷ এই বলে তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন মাধবের দিকে৷ মাধবের মনে হল, হঠাৎই যেন কেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে লোকটার চোখ দুটো৷ কী অস্বস্তিকর সেই দৃষ্টি৷ মাধব যেন চেষ্টা করেও অন্যদিকে চোখ ফেরাতে পারছে না৷ কপালের রগ দুটো যেন জ্বলে যাচ্ছে মাধবের! এরপর অবশ্য সব স্বাভাবিক হয়ে গেল৷ ভদ্রলোক চোখ নামিয়ে কাগজে কী সব লিখে তা খামে ভরে ড্রয়ারে রেখে উঠে দাঁড়ালেন৷
৩
মাধব ঘরে ফিরে এসে বলল, ‘না, লোকটা বলল, আমরা যে পথে যাব সেদিকে কেউ থাকে না৷ তবে লোকটার তাকানোটা সত্যিই কেমন যেন অস্বস্তিকর! এবারও দেখলাম লোকটা কাগজে কী একটা লিখে সেটা আগের মতো খামে পুরে রাখল৷
কৈলাশ শুনে দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘হয়তো এবার তোর মনের খবর লিখছিল৷’
সোমেন আর মাধব দুজনেই এবার হেসে উঠল তার কথায়৷
মাধব এরপর বলল, ‘তাহলে ব্যাগটা নিয়ে কী করা যায় বল?’
কৈলাশ বলল, ‘এই তো বললাম, ওখানে রেখে আসা যাবে পাথরের খাঁজে৷’
মাধব বলল, ‘তাহলে জায়গাটা আগে একবার গিয়ে দেখে আসা যাক?’
সোমেন একটু সতর্ক হয়ে বলল, ‘কিন্তু একই জায়গাতে বার বার গেলে লোকের চোখে পড়ে যেতে পারি৷ হতে পারে ওখানেও পুলিশের চর ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ তিন জনকেই বামাল সমেত ধরে ফেলতে পারে৷ কাঞ্জিলাল তো তখন সামনে গিয়ে হাজির হবে না৷ সবাই গেলে লোকের চোখে পড়ার সম্ভবনা বেশি৷ কেউ হয়তো আমাদের মতোই আবার চোরের ওপর বাটপাড়ি করল৷ এক জনের এ বাড়িতেও থাকা দরকার৷ তিন জন এক সাথে ধরা পড়ার থেকে একজন বাইরে থাকলে সে অন্য দুজনকে বাঁচাবার জন্য কিছু চেষ্টা করতে পারবে৷ একটা কাজ করা যাক, কৈলাশ জায়গাটা চেনে, তাই কৈলাশকে তো যেতেই হবে৷ আর আমি নয় সঙ্গে যাই?’ মাধব সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, না, গেলে আমিই কৈলাশের সঙ্গে যাব৷’
মাধবের চোখের ভাষা পাঠ করতে অসুবিধা হল না কারো৷ কৈলাশ সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল, ‘মাধব, তুই কী আমাদের অবিশ্বাস করছিস?’
সোমেন, এ জন্যই তোকে বলেছিলাম আমরা দু-জন থাকলে সবদিক থেকে সুবিধা হত৷ অবিশ্বাসী লোক নিয়ে এ সব কাজ করা যায না৷’
মাধব সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল, ‘আমাকে তবে না নিলেই হত৷ এসব কারবারে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না৷ শেঠ সুরজমলও তো আমাদের বিশ্বাস করে আমাদের সামনেই কথাটা আলোচনা করেছিল!’
কৈলাশ তার কথা শুনে হিস হিস শব্দে করে বলল, ‘তার মানে তুই স্পষ্টই বলছিস যে আমাদের তুই বিশ্বাস করিস না৷’ কৈলাশের ডান হাতটা চলে গেল তার কোমরের কাছে৷ ওখানে জামার নীচে তার পিস্তলটা রাখা আছে৷
এটা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় নয়, সবারই ক্ষতি হয়ে যেতে পারে তাতে৷ কৈলাশ রগচটা ধরনের৷ সোমেনরা না পারলেও এর আগে মানুষ মেরেছে সে৷ ব্যাপারটা এখনই থামাতে হবে৷ কাজেই সোমেন তাদের দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে! তোদের দুজনের মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি? ঠিক আছে আমি বাড়ি থাকব৷ তোরা দু-জন যাবি৷’
আরও একটু ধমক-টমক দুজনকে দিয়ে সোমেন শেষ পর্যন্ত শান্ত করল তাদের৷ তারপর বলল, ‘তবে গোটা চার-পাঁচেক বাঁট আলাদা করে সরিয়ে রাখব৷ এই লাখ দশেকের মতো মাল৷ ওটুকু জিনিস নিজেদের কাছে রাখতে অসুবিধা হবে না৷ আসল ব্যাগটার যদি কিছু হয়ে যায় তবে কিছুটা শান্তনা থাকবে৷’
মাধব বলল, ‘এটা ভালো কথা৷ চার পাঁচটা টুকরো সড়িয়ে রাখা ভালো৷ সব একসাথে খোয়া যাবে না তবে৷’
কৈলাশ সম্মত হল তাদের কথায়৷
বিকালটা সে ঘরেই কেটে গেল তাদের৷ বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকার নামল৷ চাঁদও উঠল এক সময়৷ কৈলাশ আর মাধব বাইরে যাবার জন্য তৈরি হল৷ ব্যাগটা নিয়ে তার মধ্যে থেকে চারটে সোনার বাট বার করা হল৷ জিনিসগুলো দেশলাই বাক্সর মতো আকৃতির৷ ঘরে একটা অল্প পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে৷ তার আলোতেও ঝিলিক দিয়ে উঠল জিনিসগুলো৷ ওই চারটে বাট অন্য একটা ব্যাগে রেখে সে ব্যাগটাকে খাটের তলায় চালান করে আসল ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মাধব আর কৈলাশ৷ বাড়ির পিছনের রাস্তা ধরে তারা এগোল গন্তব্যের দিকে৷
সোমেন ঘরে একলা বসে রইল৷ বাইরে থেকে জলের শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে ভেসে আসছে৷ জায়গাটাতে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু মাধবের জন্য সেখানে যাওয়া হল না তার৷ এ কথা ভাবতে ভাবতে সোমেনের এক সময় মনে হল, ‘আচ্ছা, মাধবের কথাটাই কী ঠিক? এ লাইনে পরস্পরকে অবিশ্বাস করাটাই কী দস্তুর? এই তো সোমেন একা বসে আছে৷ তাহলে এমনও তো হতে পারে যে মাধব আর কৈলাশ দুজন যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে একটা সমঝোতা করল, তারপর সোমেন কে ফাঁকি দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে তারা দুজন হাওয়া হয়ে গেল?’ কথাটা মাথায় আমার সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল সোমেন৷ ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল সে৷ যে যত এই দুর্ভাবনাটাকে দূরে সরাবার চেষ্টা করতে লাগল ততই যেন ভাবনাটা চেপে ধরতে লাগল তাকে৷ কানে বাজতে লাগল মাধবের কথাটা— ‘এসব কারবারে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না…
সোমেনের এরপর মনে হতে লাগল, না, ঘরে বসে থাকা তার ঠিক হচ্ছে না৷ মাধব তো স্পষ্টতই বলছে সে কাউকে বিস্বাস করে না৷ কৈলাশের যা ব্যাপার সে টাকার লোভে সব করতে পারে৷ তার বাইরেটা আসলে হয়তো একটা মুখোশ৷ বিশ্বাস ভঙ্গের ব্যাপারে সেও কম যায় না৷ তারা যদি অন্যকে অবিশ্বাস করে তবে সোমেন তাদের অবিশ্বাস করবে না কেন?
আর তারপর সে ভাবল, একটা কাজ করলে তো হয়৷ লুকিয়ে তাদের অনুসরণ করে তাদের কার্য্যকলাপ দেখা যেতে পারে৷ দূর থেকে দেখা যেতে পারে তারা জিনিসটা কোথায় রাখল৷ তেমন বুঝলে সোমেন তা দেখার পর প্রয়োজন বোধে একাই সেটা হস্তগত করতে পারে৷— এ ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গেসঙ্গেই আর দেরি না করে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল সোমেন৷ বাড়িটার পেছন থেকে যে পথটা সোজা এগিয়েছে সেই নির্জন আধো অন্ধকার পথ বেয়ে হাঁটতে শুরু করল সে৷ জলের শব্দ ক্রমশ বাড়ছে৷ সেই শব্দই তাকে জানিয়ে দিল সে ঠিক পথে এগোচ্ছে৷
কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নদী খাতটাকে দেখতে পেল৷ অনেক নীচে খাতটা৷ দু পাশে জেগে আছে পাথুরে দেওয়াল৷ তার একদিকের মাথা ধরে পায়ে চলা জঙ্গলকীর্ণ পথ ধরে এগোচ্ছে সোমেন৷ চাঁদের আলোতে ঝলমল করছে নদী খাতের মধ্যে জেগে থাকা শ্বেতপাথরগুলো৷ মার্বেল রক! এত ধবধবে সাদা পাথর এর আগে কোনো দিন দেখেনি সোমেন৷ প্রবল জলস্রোত তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হবার সময় পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দ তুলছে৷ সেই শব্দই সোমেনরা তাদের ঘরে বসেও শুনতে পাচ্ছিল৷ কম সে কম দেড়শ থেকে দুশো ফুট নীচে সেই নদীখাত৷ চাঁদের আলোতে বিমোহিত হয়ে সোমেন বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল অনেক নীচে মর্মর শোভিত চার্লেমির অপরূপ সৌন্দর্য্যর দিকে৷ কিন্তু এরপরই হুশ ফিরল তার৷ সোমেন আবার এগোতে লাগল ঝোপঝাড় পূর্ণ সেই পথ দিয়ে৷ তার যাত্রা পথেও জেগে আছে বিরাট বিরাট নানা পাথর, নদীর দিকে নেমে যাওয়া পাথুরে দেওয়ালের নানা খাঁজ৷ আরও কিছুক্ষণ এগোবার পর কৈলাশদের দেখতে পেল সোমেন৷ তারই যাত্রাপথে আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে খাদের কিনারে একটা উঁচু পাথুরে দেওয়ালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা দুজন৷ হয় তো ওই পাথুরে দেওয়ালের কোনো খাঁজে, অথবা ঢাল বেয়ে নীচে নামার কোনো পথ থাকলে সেখানে ব্যাগটা লোকাবে তারা, মাধবের হাতে ব্যাগটা ধরা৷ তারা দুজন চারপাশে তাকাচ্ছে৷ সোমেন চট করে খাদের ধারে একটা পাথরের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল৷ তারা দুজন প্রথমে তাদের সামনে পাথুরে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে সম্ভবত কিছু আলোচনা করল৷ কৈলাশ ব্যাগটা মাধবের হাত থেকে নিল, একবার সে যেন নিজের কপালে হাত দিল তারপর আঙুল তুলে নীচে মাধবকে কী দেখাল৷ ভালো করে দেখার জন্য মাধব খাদের কিনারে এসে দাঁড়াল৷ আর তারপরই ঘটল ঘটনাটা৷ মুহূর্তের জন্য কোথা থেকে এক ফালি মেঘ এসে ঢেকে দিল চাঁদটাকে৷ অন্ধকার নেমে এল চারপাশে৷ একটা অস্পষ্ট আর্ত চিৎকার যেন শোনা গেল৷ তারপরই অনেক নীচে পাথরে ভারী কিছু আচড়ে পড়ার শব্দ! চাঁদ যখন মুখ তুলল তখন প্রবল জলস্রোতে মার্বেল রকে বাড়ি খেতে খেতে মাধবের দেহটা দূরে ভেসে যাচ্ছে৷ তাকে ধাক্কা মেরে নীচে ফেলে দিয়েছে কৈলাশ! মাধব ঠিকই বলেছিল, এ খেলায় কাউকে বিশ্বাস করা মানে নির্বুদ্ধিতা৷ তবে শেষ রক্ষা সে করতে পারল না৷ সোমেন ব্যাপারটা দেখে চমকে উঠল ঠিকই, কিন্তু প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটার পর তার মনে হল, হয় তো ব্যাপারটা ভালোই হল, তিনজনের বদলে দুজন মানে তো এক কোটি, এক কোটি! কিন্তু কৈলাশ আবার তাকেও মারবার চেষ্টা করবে না তো? সোমেন একবার হাত দিয়ে নিজের কোমরে রিভলবারের অবস্থান দেখে নিয়ে আড়াল থেকে লক্ষ করতে লাগল কৈলাশকে৷ কৈলাশ আবার চারপাশটা দেখল তারপর তার সামনের পাথরের দেওয়ালে একটা খাঁজের ভিতর ব্যাগটা লুকিয়ে রেখে ফেরার পথ ধরল৷ কৈলাশ, সোমেন যেদিকে আছে সেদিকেই আসছে, তবে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে খাদের কিনারে উঁকি দিয়ে নীচের দিকে তাকাচ্ছে৷ হয়ত সে দেখার চেষ্টা করছে মাধবের দেহটা নদীর বুকে কোনো পথরে আটকে আছে, নাকি দূরে ভেসে গেছে? কিন্তু সোমেনের আসল অবাক হওয়াটা তখনও বাকি ছিল৷ কৈলাশ তখন সোমেনের দিকে অনেকটা এগিয়ে এসেছে৷ শেষ বারের জন্য হয় তো সে খাদের কিনারে গেল নীচে দেখার জন্য৷ আর ঠিক সেই সময় তার কাছাকাছি পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি৷ তার হাতে একটা লাঠি৷ চিতাবাঘের মতো ক্ষিপ্রতায় সে সেটা দিয়ে আঘাত করল কৈলাশের মাথায়৷ কৈলাস একটা আর্তনাদও করতে পারল না৷ শুধু তার দেহটা একই রকম শব্দ তুলে ছিটকে পড়ল নীচে৷ মাধবের মতোই তার দেহটা পাথরের গায় ধাক্কা খেতে খেতে নদী প্রবাহের দিকে এগিয়ে চলল৷ এ লোকটা কে?’
নতুন আততায়ী একবার চারপাশে তাকাল৷ তারপর যেন নিশ্চিন্ত হয়ে পিছু হটে সেই পাথরের দেওয়ালের দিকে এগোলে৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই দেওয়ালের খাঁজ থেকে ব্যাগটা বার করে ফিরে আসতে লাগল সোমেন যেদিকে আছে সেদিকে৷ না, লোকটাকে এভাবে ব্যাগটা নিয়ে পালাতে দেওয়া যাবে না৷ সে কাছাকাছি এলেই সোমেন গুলি চালাবে৷ সোমেন রিভলবার বার করল৷ লোকটা হাঁটতে হাঁটতে এক সময় সোমেনের কাছাকাছি চলে এল৷ গুলি চালাবার জন্য প্রস্তুত হল সোমেন৷ কিন্তু এরপরই সে একটা অসুবিধা অনুভব করল সে৷ লোকটা খাদের একদম ধারে ঘেঁসে হাটছে৷ গুলি চালালে সে ব্যাগ শুদ্ধ ছিটকে পড়তে পারে নীচে৷ সে ক্ষেত্রে ব্যাগটা ভেসে যাবে নদীর জলে৷ নদীতে প্রচণ্ড স্রোত৷ তাছাড়া গুলির শব্দও নিশ্চই পাথরের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হবে৷ অনেক লোকের কানে যেতে পারে সেটা৷ অন্য দিক থেকে গার্ডরা শব্দ অনুসন্ধানে দৌড়ে আসতে পারে! তাহলে কী করা যায়? এ কথা ভাবতে ভাবতেই লোকটা একদম সোমেনের কয়েক হাতের মধ্যে চলে এল৷ চাঁদর মুড়ি দেওয়া থাকলেও বাতাসে চাদরটা হয়তো বাতাসে একটু সরে গেছিল৷ চাঁদের আলোতে এক ঝলকের জন্য সোমেন দেখতে পেল লোকটার মুখ৷ হতভম্ব হয়ে গেল সে৷ আরে এ যে প্রফেসর কাঞ্জিলাল! তাহলে কী সত্যিই টেলিপ্যাথির মাধ্যমে কৈলাশ বা তাদের কারো মনের কথা জেনে গেছিল? লোকটা কী বুঝতে পেরেছিল তারা সোনা নিয়ে এসেছে? টেলিপ্যাথি মাধ্যমেই কি সে কৈলাশকে পরিচালিত করল মাধবকে ধাক্কা দেবার জন্য? মাধবকে ধাক্কা দেবার আগে নিজের কপালে একবার হাত দিয়েছিল কৈলাশ৷ ঠিক যেমন গাড়িতে ওঠার সময় পুলিশ অফিসার নিজের কপালে হাত দিয়েছিল৷ ব্যাগ সুদ্ধ সোনা আত্মসাত করার জন্য তার ওপরও কী মানসিক প্রভাব খাটিয়ে ছিল প্রফেসর কাঞ্জিলাল৷ তাকে সে ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল? কিন্তু বিজ্ঞানের যুগে এ সব কী সম্ভব? তাহেল কী প্যারাসাইকোলজি সত্যিই একটা বিজ্ঞান? আর এরপর একটা সত্য অনুভব করল সোমেন৷ সোনাগুলো আত্মসাত করার জন্য কাঞ্জিলালের পথের কাটা একমাত্র সোমেনই৷ লোকটা নিশ্চই তাকেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করবে৷ তার আগেই কাঞ্জিলালকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন৷ তাতে প্রাণটাও বাঁচবে সোমেনের আর সোনাগুলোরও আর কোনো দাবীদার থাকবে না৷ তবে সোমেন কাজটা কাঞ্জিলালের বাড়িতেই করবে এখানে নয়৷ বাড়িটাতে ফেরার পথে সোমেন নিরাপদ দূরত্ব থেকে অনুসরণ করল লোকটাকে৷ আর তাঁকে অনুসরণ করতে করতে সোমেন খালি ভাবতে লাগল, ‘এও কী সম্ভব? লোকটা কী সত্যি পাঠ করতে পেরেছিল কৈলাশ বা তাদের কারো মনের কথা? সে জন্যই কী তার চোখের দিকে তাকালে অস্বস্তি হচ্ছিল? কপালের রগ দপদপ করছিল?’
এক সময় বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল তারা দুজনেই৷ পিছনের একটা সিঁড়ি বেয়ে কাঞ্জিলাল দোতালায় উঠে যাবার পর সোমেনও সন্তর্পণে বাড়িতে প্রবেশ করল৷
সোমেন প্রথমে ঢুকল তাদের ঘরটাতে৷ সোনার চারটে বাটও তাকে নিতে হবে৷ ছোটো ব্যাগটা নেবার জন্য সে খাটের তলায় ঢুকল৷ ব্যাগটা নিতে গিয়ে হঠাৎ খাটের নীচে পাটাতনের গায়ে একটা জিনিস আধা-অন্ধকারের মধেও চোখে পড়ল তার৷ সেটা মাইক্রোফোনের মতো দেখতে৷ কাঞ্জিলাল কী গোপন মাইক্রোফোনে এ ঘরের লোকদের কথাবার্তা শোনেন? এখন অবশ্য কিছু ভাবার সময় নেই৷ ব্যাগটা নিয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে সন্তর্পণে রিভলবার হাতে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল৷
৪
সারা বাড়ি নিঝুম৷ দোতলার একটা ঘরেই শুধু আলো জ্বলছে৷ সেই ঘরটাই, যে ঘরে কাঞ্জিলালের সাথে এদিন দুপুরে সাক্ষাত হয়েছিল তিন জনের৷ দরজার পাল্লাটা একটু ফাঁক করা৷ ঘরের ভিতর থেকে আলোর রেখা আসছে৷ সোমেন সাবধানে উঁকি দিল ঘরের ভিতর৷ হ্যাঁ, লোকটা ঘরের ভিতরই আছে৷ পোশাক পালটে ফেলেছেন তিনি৷ তাঁর হাতে একটা বেশ বড় সুটকেস৷ সেটা নিয়ে দরজার দিকে আসতে লাগলেন তিনি৷ ঠিক সেই সময় দরজা খুলে ঘরে ঢুকল সোমেন৷ তাকে দেখে একটু যেন আশ্চর্য হয়ে প্রফেসর কাঞ্জিলাল বললেন, ‘আপনি এখন? কী ব্যাপার?’
সোমেন বলল, ‘হ্যাঁ, আমিই৷ আপনার সাথে শেষ সাক্ষাত করতে এলাম৷’
আর এরপরই প্রফেসর কাঞ্জিলালের নজর পড়ল সোমেনের হাতে ধরা রিভলবারের ওপর৷ তিনি মুখে কিছু না বলে চশমটা খুলে তাকালেন সোমেনের দিকে৷ কী অদ্ভুত সেই দৃষ্টি! হিপ্নটিজিম নাকি? সে দৃষ্টি যেন গ্রাস করে নিছে সোমেনের সমস্ত সত্ত্বাকে৷ তার মনের গোপনতম কুঠুরীতে যেন তীক্ষ্ণ টর্চের আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করছে সেখানে কী লোকানো আছে! সোমেনের ভাবনা গুলোকে যেন ও দুটো চোখ ফালা ফালা করে চিরছে৷ তার কপালের রগ দুটো দপদপ করছে৷ রিভলবার ধরা হাতটা কেমন যেন অবশ্য হয়ে আসছে৷ সোমেন যেন ধীরে ধীরে লোকটার নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে৷ চোখ ফেরাতে পারছে না সোমেন৷ ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে কাঞ্জিলালের চোখ দুটো৷ সোমেন একটা শেষ চেষ্টা করল৷ মনের সব শক্তি একত্রিত করে রিভলবারটা উঠিয়ে প্রফেসর কাঞ্জিলালের বুক লক্ষ করে চালিয়ে দিল গুলি৷ পরপর দুটো গুলি৷ প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল ঘর৷ ধোঁয়াতে আর বারুদের গন্ধে ডেকে গেল সব কিছু৷ কাঞ্জিলালের চোখে দৃষ্টি হঠাৎই যেন নিস্প্রভ হতে হতে নিভে গেল৷ দড়াম করে একটা শব্দ হল৷ ধোঁয়ার রেশ যখন কাটল তখন সোমেনের সামনে মাটিতে পড়ে আছে কাঞ্জিলালের রক্তাক্ত নিস্পন্দ দেহ৷
সোমেনের নিজেরও ধাতস্ত হতে বেশ কিছুটা সময় লাগল৷ পরপর তিনটে মৃত্যু একঘণ্টার মধ্যে প্রত্যক্ষ করল সে৷ দুটো খুন হতে দেখল, একটা খুন সে নিজে করল! কাঞ্জিলালের হাত থেকে চাবিটা ছিটকে পড়েছিল মেঝেতে৷ সেটা কুড়িয়ে নিয়ে সে সুটকেসটা খুলতেই জামকাপড়ের নীচে থেকে বেড়িয়ে এল সোমেনেদের সেই ব্যাগটা৷ সম্ভবত কাঞ্জিলাল বাড়ি ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন৷ সোমেন এরপর সে ব্যাগটা টেবিলে রেখে কাঞ্জিলালের চেয়ারে বসল৷ মনটা শান্ত করার জন্য কিছুটা সময়ের প্রয়োজন তার৷ সিউসরণ বাড়িতে নেই, কাঞ্জিলাল সহ তার সঙ্গীরা মৃত৷ আপাতত কেউ তাকে বিরক্ত করতে আসবে না৷ একবার ঘড়ি দেখল সোমেন৷ সাড়ে আটটা বাজে৷ এখানে আসার সময় তারা খবর নিয়ে এসেছিল সাড়ে ন’টায় এখান থেকে শেষ বাস জববলপুর স্টেশনে যায়৷ স্টেশনে পৌঁছে রাতের কোনো ট্রেন ধরবে সোমেন৷ পরদিন শিউসরণ যখন বাড়িতে ফিরে প্রফেসর কাঞ্জিলালের লাশ দেখবে সোমেন তখন অনেক দূরে কোথাও পৌঁছে গেছে৷ এ বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব মিনিট কুড়ির৷ শেষ মূহূর্তে সোমেন সেখানে পৌঁছে বাসে উঠবে৷ আগে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে লোকের চোখে পড়ে কাজ নেই৷ এ বাড়ি ছেড়ে ঠিক নটায় বেরোলেই যথেষ্ট৷ আধ ঘণ্টা এ ঘরে বসে বিশ্রাম নেওয়া যাবে৷
কাঞ্জিলালের সেই গদি আঁটা চেয়ারটাতে বেশ আয়েশ করে বসল সোমেন৷ কিছু দূরে পড়ে আছে কাঞ্জিলালের মৃতদেহ৷ তার সেই উজ্জ্বল চোখ দুটো কেমন যেন নিঃস্প্রভ হয়ে মরা মাছের চোখের মতো চেয়ে আছে সিলিং-এর দিকে৷ প্রথম সেই চোখ দুটো কোনো দিন আর কারো মনের খবর পাঠ করতে চাইবে না৷ সোমেনের এটা প্রথম খুন, দেহটা কাছেই পড়ে থাকলেও তার তেমন কোনো উত্তেজনা অনুভব হচ্ছে না৷ এই সোমেন প্রথম বুঝতে পারল তার মধ্যেও একজন ‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারার’ এতদিন লুকিয়ে ছিল৷ বেশ একটু আত্মতৃপ্তি অনুভব করল সে৷ শুধু কয়েকটা প্রশ্ন মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে লাগল তার৷ ওই মৃত লোকটা কী ভাবে জানতে পারল তাদের ব্যাপারটা? লোকটা কী সত্যিই থট রিডিং জানত? লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে তার অমন অদ্ভুত হচ্ছিল কেন? আর এরপরই মনে পড়ল তার সেই খামটার কথা৷ সেটা দেখলেই তো সব সম্ভাবনার নিরসন হয়৷ ব্যাপারটা মাথায় আসার সাথে সাথে চাবি দিয়ে সোমেন টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে ফেলল৷
দুটো একই রকমের খাম রাখা আছে সেখানে৷ সোমেন খাম দুটো বাড় করে টেবিলে রাখল প্রথমে৷ মুখ বন্ধদটো খাম৷ লাল রঙের দেখতে৷ সে খামটার মুখে সোমেনের সই করা ছিল সেই খামটা খুলল সোমেন৷ একটু কাঁপা হাতে ভিতরের কাগজটার ভাজ খুলল সে৷ খুনটা নিয়ে না হল্যে এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উত্তেজনা বোধ করছে সে৷ কিন্তু কাগজের লেখাটা পড়ার পরই সোমেন হো হো শব্দে নিজের মনেই হেসে উঠল৷ কাগজে প্রথমে একটা পরিচিত ছড়া লেখা— ‘হলদে সবুজ ওরাং ওটাং, ইট পাটকেল চিৎপটাং৷’ তারপর লেখা— ‘আমার এত দিনের প্যারামাইকোলজি র্চ্চা তবে মিথ্যা৷ লোকটার মনের কোনো কথাইতো পড়ত পারলাম না আমি৷’
কিন্তু লোকটা তবে সোমেনদের ব্যাপারটা জানল কী ভাবে? তাহলে খাটের নীচে দেখা ওই জিনিসটা মাইক্রোফোনই৷ ওর মাধ্যমেই নিশ্চই তাদের কথা শুনেছিল লোকটা৷ তারপর কৈলাশদের পিছু নিয়ে সুযোগের সদব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল৷ আর লোকটার ওই চোখদুটো? সেই উজ্জ্বল চোখ? আসলে সেটা নিশ্চই সোমেনদের মানসিক দুর্বলতা৷ নানা কথা শুনিয়ে সোমেনদের ওপর মানসিক প্রভাব বিস্তার করেছিল লোকটা৷ উদ্ভট ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদের মাথায়৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য শেষ রক্ষা করতে পারল না লোকটা৷ সোমেনের কাছে হেরে গেল প্যারাসাইকোলজিস্ট প্রফেসর কাঞ্জিলাল৷ লোকটা জববর ধোঁকা দেবার চেষ্টা করেছিল! অস্বীকার করে লাভ নেই সোমেনও বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল ব্যাপারটাতে৷ কাঞ্জিলালের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতায় একটু ভয়ও পেয়েছিল৷ এখন পুরো ব্যাপারটা ভেবে হাসতে লাগল সে৷
সোমেন একটা সিগারেট ধরাল৷ তারপর টেবিলের ওপর পা তুলে সোনা ভর্তি ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে ভাবল, ‘সব সোনা এখন আমার৷ ব্যাগটা নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে গিয়ে বাকি জীবনটা আনন্দে, আরাম আয়েশে কাটিয়ে দেব৷’ সিগারেট টানতে টানতে সুখস্বপ্নে মশগুল হয়ে রইল সে৷ ঘড়ির কাঁটা টিক টিক শব্দে এগিয়ে চলল৷
কোথায় যেন গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং ঢং শব্দে রাত ন’টার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল৷ চিন্তা জাল ছিন্ন হল সোমেনের৷ এবার তাকে বেরোতে হবে৷ অনেক দূরে চলে যাবে সে৷ সবার নাগালের বাইরে৷ টেবিল থেকে পা নামিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে৷ দরজার দিকে এগোতে যাচ্ছিল সোমেন, ঠিক সেই সময় দরজা খুলো হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল সকালের সেই পুলিশ অফিসার সহ আরও বেশ কিছু পুলিশকর্মী৷ সোমেন ভালো করে কিছু বুঝে ফেলার আগেই তার হাত হ্যান্ডক্যাপ পড়িয়ে দিল পুলিশ৷ একজন তার কোমর থেকে রিভলবারটা বার করে নিল৷ আর একজন ছিনিয়ে নিল ব্যাগটা৷ ব্যাগ খুলতেই বেরিয়ে পড়ল সোনার বাটগুলো৷ আর কিছু করার নেই৷ পুলিশ কর্মীরা এবার ঘুরে ঘুরে ঘরটার আনাচে কানাচে দেখতে লাগল৷ একজন লোক টেবিলের ওপর থেকে প্রথমে কাঞ্জিলালের লেখা সেই কাগজের টুকরোটা তুলে নিয়ে ভ্রূ কুচকালো৷ তারপর দ্বিতীয় খামটা তুলে নিয়ে তার মুখ ছিড়ে তার ভিতরের কাগজটা খুলল কিন্তু সেই কাগজে চোখ বুলিয়েই সে বিস্মিত ভাবে বলে উঠল, ‘আরে লোকটা অন্তর্যামী ছিল নাকি?’
কথাটা শুনেই অফিসার সহ পুলিশকর্মীরা তাকাল তার দিকে৷ লোকটা সম্ভবত বাঙালি৷ সে বলল, ‘প্রফেসার কাগজটা কী লিখে রেখেছে শুনুন৷ উঁনি লিখেছেন— ‘পেরেছি! পেরেছি! আমার প্যারাসাইকোলজি, টেলিপ্যাথি র্চ্চা মিথ্যা নয়৷ প্রথম লোকটার ক্ষেত্রে দীর্ঘ দিনের অনভ্যাসের ফলে ব্যার্থ হয়েছিলাম৷ কিন্তু পরপর দুজনের মনের ভাব আমি পাঠ করতে পেরেছি পুলিশ অফিসার যাবার আগে মনে মনে বলে গেল, ঠিক রাত নটায় ওয়ারেন্ট নিয়ে এ বাড়িতে হানা দেবে সে৷ আর আমার সামনে সে লোকটা বসে আছে আর নাম প্রাঞ্জল নয়, মাধব৷ ওর ভাবনা পাঠ করে আমি জানতে পারছি এক ব্যাগ সোনা নিয়ে পালিয়ে এসে ভুয়ো পরিচয় দিয়ে এখানে উঠেছে তারা৷ অন্য দুজনের নাম কৈলাশ আর সোমেন…
সোমেন হতবাক হয়ে গেল৷ মাধব তো ওই খামটার কথাও তাকে বলেছিল৷ প্রথম খামটা খুলে লেখাটা খুলে দেখার পর দ্বিতীয় খামটা খুলে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেনি সোমেন৷ হাতে সময় ছিল তার, খামটা যদি সে খুলত তবে সে পুলিশের নাগাল এড়াতে পারত৷
সোমেন তাকাল কিছুটা তফাতে পড়ে থাকা কাঞ্জিলালের মৃতদেহর দিকে৷ হঠাৎ তার মনে হল কাঞ্জিলালের ঠোঁটের কোণে আবছা একটা হাসি ফুটে উঠেছে৷ সে হাসি ব্যাঙ্গ করছে সোমেনকে৷ তার দৃষ্টি যেন এখন সোমেনের প্রতি নিবদ্ধ৷ আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে সেই চোখদুটো৷ তারা পাঠ করছে সোমেনের মনের খবর৷ সোমেনের কপালের পাশে শিরাগুলো দপদপ করতে শুরু করেছে৷ সোমেন পুলিশ অফিসারের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘প্লিজ, ওর চোখ দুটো ঢেকে দিন৷ ওই দৃষ্টি আমি আর সহ্য করতে পারছি না!’