লালীর জন্য – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

লালীর জন্য

‘এই ঝোপে লালীর মড়াটা আটকে ছিল।’

দয়াময় এমন করে বলায় আমার খুব খারাপ লাগল। মড়া না বলে শুধু লালী বললেই পারতেন! যারা মরে যায়, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে না পারলেও ঘেন্না থাকা উচিত কি? ধরা যাক, লোকটা বা মেয়েটা কিংবা কেউ হাড়জ্বালানী বদমাস ছিল—কিন্তু মরার পর তো আর কিছু করারই রইল না।

আর মৃত্যু, আজও এক রহস্য। মরে গিয়ে কী ঘটে? কেউ ফিরে এসে তো বলার উপায় নেই। অন্তত মৃত্যুর এই রহস্যময়তার খাতিরেও লালী একটা মূল্য দাবি করতে পারে। বিশেষ করে নিজের বাবারই কাছে। ওর বাবা দয়াময় অবশ্য বরাবর নিষ্ঠুর মানুষ বলে প্রসিদ্ধ। কথায় কথায় চাষীদের বেদম ঠ্যাঙান। লালীকেও সারাজীবন ঠেঙিয়ে গেছেন। লালী বলত—এটা বাবার একটা ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স থেকে হয়েছে। সত্যি করে কেউ তো এ পৃথিবীতে দয়াময় থাকতে পারে না।

আমি ঝোপটা খুঁটিয়ে দেখছি লক্ষ করে দয়াময় ফের বললেন—সেই বন্যায় সব উপড়ে ভেসে গিয়েছিল, শুধু একটা বাদে। চিনতে পারছ, এটা একটা শ্যাওড়া ঝোপ? খুব শক্ত শেকড়-বাকড়।

ভাগ্যিস শক্ত এবং উপড়ে যায়নি, তাহলে লালী এই নদী বেয়ে সোজা গঙ্গায় পড়ত। তবে, গঙ্গায় পড়লে লালীর ভালই হত—সব পাপ ঘুচে মোক্ষ পেত তার আত্মা। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার। কেন কে জানে, তার পরমুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। বললুম—তারপর কী হল?

দয়াময় একটু বাঁকা হেসে বললেন—তারপর কী হয়?

—মানে, ওকে কী অবস্থায় পেয়েছিলেন?

দয়াময় ঝোপটা দেখতে দেখতে বললেন—শকুন বসতে পারেনি, জল ছিল। তবে দুটো শেয়াল ওর নাড়িভুঁড়ি খাচ্ছিল। আর একটা দাঁড়কাক স্তনে ঠোঁট ঠুকরে লাং বের করছিল। আরও শুনবে?

—জ্যাঠামশাই কি আমার ওপর রাগ করেছেন?

দয়াময় নিষ্ঠুর হেসে উঠলেন—কেন? তোমাদের আজকালকার ছেলে ছোকরাদের বোঝাই দায়—এত সেন্টিমেন্টাল। এস, তোমাদের জমিটা দেখিয়ে দিই।

দয়াময়ের কাঁধে এবার বন্দুকটা উঠল। পা বাড়ালেন। কাঁধে কার্তুজের ঝোলাটা নড়ে উঠল। আমার কিন্তু পা ডুবে গেছে শক্ত পলির তলায়, শেকড় গজাচ্ছে, এবং সেই সব সাদা বিন্দু বিন্দু শেকড়ের আঁকুর ভ্রূকুটির মতন আমার শরীর থেকে পৃথিবীর গভীরতা লক্ষ করতে চায়। খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করছিলুম এটা।

দয়াময় ঘুরে বললেন—কী হল?

—কিছু না। বেচারী লালীর কথা মনে পড়ছে!

দয়াময় ফের হাসলেন—তুমি বরাবর ব্রডমাইণ্ডেড আর মডার্ন। জানি। কিন্তু আমি প্রিমিটিভ ধরনের মানুষ। মেয়ের প্রেমিকদের….

বাধা দিয়ে বললুম—ছিঃ! কী বলছেন?

—মাঝে মাঝে আমি খুব সরল হয়ে যাই, অমিত! একে সেই প্রিমিটিভ সরলতা বলতে পারো। দেখ, ও যখন বেঁচে ছিল—তোমার বাবার কাছে কথাটা তুলেছিলুম। অরবিন্দ বলেছিল, তা কী করে হয়? এখন অমিত পড়াশোনা করছে। তা ছাড়া, বিয়ের বয়সও তো হয়নি। হুম! তোমার বাবা আরও বলেছিলেন, অমিতের অনেক অ্যামবিসন আছে!

—জ্যাঠামশাই, প্লীজ! ওসব ভুলে যান।

—ভুলেছিলুম তো। তুমি আবার মনে করিয়ে দিলে। চলো, এগোনো যাক।

—আজ থাক বরং। জমি তো উঠে পালাচ্ছে না। কাল যাব বরং।

দয়াময় আমার দিকে কেমন দৃষ্টে তাকিয়ে বললেন—ও, আচ্ছা! তাহলে তুমি বসে-বসে অশ্রুপাত করো। আমি বরং দেখি দুএকটা তিতির পাই নাকি।

বলেই উনি বড় বড় পা ফেলে চলে গেলেন। বিশাল ওই মানুষ, পায়ে গামবুট, কাঁধে বন্দুক ও কার্তুজের ঝোলা, মাথায় টুপি। বাঁয়ে ঘুরে চরে নামলেন। কিছুক্ষণ নদীর তলায় হারিয়ে রইলেন। তারপর ওপারে বাঁধে বিরাট আকাশের গায়ে তাঁকে আবার দেখতে পেলুম। অমন একলা ওঁকে কখনও এর আগে মনে হয়নি। এখন একটু ভয় হল। চারদিকে ওঁর শত্রু। এভাবে একটা বন্দুক নিয়ে কি আত্মরক্ষা করতে পারবেন? এলাকায় তিনজন জোতদার ইতিমধ্যে খুন হয়েছে। উনিও যে-কোনও সময় খুন হতে পারেন। তখন লালীর মা বলবেন, অমিতই ষড়যন্ত্র করে ওঁকে মাঠে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিস বলবে, তাই তো! হঠাৎ এই ছোকরা আচমকা শহর থেকে বাবার সম্পত্তি দেখার ছলে গ্রামে এল এবং..

বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। তারপর বাঁ চোখের কোণ দিয়ে যেন লালীকেই দেখতে পেলুম। —কী অমিত, কেমন আছ?

—তুমি ভাল আছ তো লালী? মৃত্যুর পর জায়গাটা কেমন বল তো? প্রেমিক পেয়েছ কি এখানকার মতো? কথায়-কথায় তাদের সঙ্গে কি শুয়েপড়া এখনও সহজ? লালী, আমি কিন্তু সেদিক থেকে এখনও ব্যর্থ।

—তুমি যে ভীতু! মেয়েদের দিকে চোখ তুলে কথা বলতেই পারো না। অথচ, তোমার সারা দেহে তীব্র কামনা পোকার মতন কিলবিল করে। অমিত তোমাকে তাই পোশাক খুলতে বলেছিলুম, মনে পড়ছে তো? ওই ওখানটায় জলের মধ্যে ভাসতে ভাসতে তুমি আবিষ্কার করেছিলে আমি উলঙ্গ, আর বলেছিলে—এ কী লালী! তোমার শাড়ি কোথায়? আমি বলেছিলুম—কেড়ে নিয়েছে। তুমি চেঁচিয়ে উঠেছিলে—কে? কে? তখনই বৃষ্টি আর বাতাস বেড়ে গেল। আমার জবাব তুমি শুনতে পেলে না!

—কী বলেছিলে লালী?

—বলেছিলুম, যে কাড়বার সেই কেড়েছে। এতদিনে আমার সম্পূর্ণতা। এবার তাই ভেসে গেলুম। বিদায়, অমিত! বিদায়!

—আর বলেছিলে, হাসতে হাসতে বলেছিলে, তুমিও প্যাণ্টটা খুলে ফেল। পারিনি। আমার সাঁতার দিতে অসুবিধা হচ্ছিল। তবু জলের তলায় সভ্যতাকে বাঁচাতে চাইলুম!

—অথচ……..

—অথচ কি লালী?

—অথচ পোশাক খুলে ফেললেই কত সহজেই মানুষ সম্পূর্ণতা পায়।

—সে কী লালী, সম্পূর্ণতাটা কী?

—তার নাম স্বাধীনতা।….

স্বাধীনতা! আমার চোয়াল আবার শক্ত হয়ে উঠল। লালী খুব ছেলেবেলা থেকেই তাহলে আমাকে এই স্বাধীনতার দিকে ডেকেছিল! তখন বুঝতুম না। পরেও কোনদিন বুঝিনি! নাটাকাঁটা কুঁচফল শ্যাওড়া-ঝোপের গুহায় ছায়ায় নির্জনে শুয়ে পড়ার মানে আরেক জন্মের দিকে লক্ষ্মীন্দরের মতো ভেসে যাওয়া—শিয়রে বেহুলা। জানতুম না। পদ্ম-শালুক-ফোটা ঝিলের জলে সেই স্বাধীনতার ডাক ছিল। চৈত্রের নির্জন মাঠে সেই স্বাধীনতার হাওয়া ছিল। নদীর চড়ায় জ্যোৎস্নায় গা এলিয়ে পড়ে থাকত সেই সোনালী রূপোলী স্বাধীনতা। কী বোকা ছিলাম এতদিন!

আমি ভালবাসতুম ব্রিজে শব্দকারী রেলগাড়ি, গলায় নীল রুমাল জড়ানো, দাড়িওলা ফায়ারম্যান, পাহাড়ের চূড়ার ওদিকে ব্লাস্ট ফার্নেসের ছটা, সবুজ ল্যাণ্ডমাস্টার গাড়ি, রাতের আকাশে এরোপ্লেন আর গালিভারস ট্রাভেল এক খণ্ড। ভালবাসতুম পুরনো কালের সাহিত্য, কিংবা পিকাসো আর দালির ছবি। রবিঠাকুরের কবিতা হেনরি মুরের ভাস্কর্য। ক্লাসিকে-রোমাণ্টিকে মাখামাখি এক বিরাট সভ্যতাকে জানতুম শ্রেয় ও প্রেয়। সভ্যতার কয়েক হাজার বছর আমার মগজে ঢুকে পড়েছিল।

আর লালী ভালবাসত কুঁচ ফল, বিষাক্ত ধুঁদুল, লালপোকা নীলপোকা নির্জন বালিয়াড়ির পাখি, জ্যোৎস্না রাতে পরীর নাচ মাঠের বিশালতা।

দুইয়ে কোন মিল ছিল না। আমি শহর থেকে নিয়ে যেতুম জাঁ পল সাত্রের অস্তিত্বমূলক গল্প। লালী কুড়িয়ে আনত মাঠের নিঃসঙ্গচাষা ইবাজ সেখের রূপকথা। লালী গাইত প্রাচীন লোকসঙ্গীত, আমি আওড়াতুম আধুনিক কবিতা। কোনও মিল ছিল না, কোনও মিল!

অথচ লালীকে দয়াময় লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। ক’বছর দিব্যি আধুনিক মেয়ে সেজে সে মফঃস্বল শহরের কলেজে বাসে যাতায়াত করত।

একদা লালী নদীর ধারে জামবনে আমাকে বলেছিল—তোর সঙ্গে একটা ভারি দরকারি কথা আছে, অমিত।

বলেছিলুম—কী কথা রে? এক্ষুনি বল না।

হঠাৎ চাপা গলায় ও বলেছিল—এখন বলা যাবে না। বলব’খন।

এই ছিল লালীর স্বভাব। কৌতূহলকে ফুটিয়ে দিয়েই নিঃশব্দে হেসে চলে যেত। তখন তাকে মনে হত সবে ফুল ফুটবে এমন টানটান শাখা-প্রশাখার উত্তেজনা দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। এবং তার ওই না-বলা কথাটা আমাকে তার-পর কতদিন উত্যক্ত করেছিল বলার নয়। ভাবতুম—কী কথা বলবে লালী? কোনো গুরুতর শরীর-বিষয়ক, নাকি তার আর সব উদ্ভট কথামালার অন্তর্গত? সে কি বলবে তার হাঁটুর নিচে আঁকুর গজাচ্ছে উদ্ভিদের? তার শরীরে কোথাও ফুল ফোটবার ষড়যন্ত্র চলেছে সেই গূঢ় খবর জানাবে?

মাঝে মাঝে ওকে দেখতুম কত সহজে মিশে যাচ্ছে উদ্ভিদের রাজ্যে। জড়িয়ে পড়ছে দুর্বোধ্য প্রাকৃতিক সব খেলাধুলায়। কেন যে চলতে চলতে রাস্তা ছেড়ে নেমে গেল মাঠে এবং দৌড়ুতে শুরু করল দিগন্তের দিকে, বুঝতেই পারতুম না।

ওর কাছে ছিল গভীর অথৈ কোন জলজগতের খবর, যেখানে মানুষেরা মৃত্যুর পর ঝিনুক হয়ে যায়। ও শোনাত, পাহাড়ের ওপর কোথায় আছে ডাকিনীর গুহা, যেখানে ঘণ্টা বাজলেই পৃথিবীতে রাত্রি আসে।

লালী একদিন বলেছিল, গ্রামের এই নদীর চড়ায় দেবদূত নেমেছিল। কেমন তার চেহারা? তাও সে বর্ণনা করেছিল। গলার রেশমি রুমাল, নীল চোখ, হলুদ দুই ডানা কাঁধে, লাল টুকটুকে ঠোঁট। আর সেই দেবদূত লালীকে কী একটা ভাল খবর দিয়েই কেটে পড়েছিল। এ খবরটা অনেক পরে বলেছিল লালী। রাঙা বউদির অর্থাৎ দয়াময়ের ভাইপো সুধাকান্ত—যে সেটেলমেণ্টের বড় অফিসার, তার বউয়ের ছেলে হবে।

এই সুধাকান্ত সারাক্ষণ আমাকে লালীর ব্যাপারে সন্দেহ করত। সে সেই বন্যার পর শহরে চলে গেছে। আর সে গ্রামে আসবে না। কারণ, লালীকে পাহারা দেবার দরকার ফুরিয়ে গেছে। লালীকে সভ্যতার দিকে টানতে তারই কারচুপি ছিল। দয়াময়কে ফুঁসলে বদলে ফেলেছিল। অথচ দয়াময়ের ইচ্ছে ছিল, লালীকে তিনি খাঁটি মেয়েজোতদার করে ছাড়বেন। অল্পস্বল্প লেখাপড়াই সেজন্য যথেষ্ট।

দেখতে দেখতে লালী বড় হল। কিন্তু তবু তার ওই বন্যতা গেল না। সভ্যতাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সে ঘুরে বেড়াত বিষাক্ত ধুঁদুল, লালপোকা, নীলপোকা, পাখি, প্রজাপতি, কুঁচফলের পৃথিবীতে। আমাদের এই পাড়াগাঁর পাশে কাঁচা রাস্তাটায় ইতিমধ্যে পিচ পড়েছিল। মাঠে বিশাল ফ্রেমে টাঙানো হয়েছিল বিদ্যুতের ভারী তার। ফ্রেমের গায়ে লাল ফলকে সাদা মড়ার মাথা ও দুটো আড়াআড়ি হাড় আঁকা ছিল। তাতে নাকি লেখা ছিলঃ সভ্যতা। অতএব সাবধান!

অবশ্য এ কথা লালীর। আমি পড়তুম : এগারো হাজার ভোল্ট সাবধান। ও পড়ে বলত—সভ্যতা। অতএব সাবধান।

একদিন লালী বলেছিল—কেন আমার পিছনে ঘুরঘুর করিস বল তো?

তখন সে নদীর ধারের বাঁধে যেতে যেতে হঠাৎ জঙ্গলে ঢুকে পড়েছিল। আমি তার পিছু ছাড়িনি। জারুল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে আমাকে ওই প্রশ্ন করেছিল। জবাবে চোখ বুজে বলে ফেলেছিলাম—আমি তোকে চাই, লালী।

লালী বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলেছিল—সে আবার কী রে?

—না লালী। বল কেমন করে তোকে পাব?

—আমাকে পেতে হলে তোকে দেউড় বাঁশের জঙ্গল পেরোতে হবে।

—তার মানে?

লালী বলেছিল—ওটা আমার শর্ত। ওই বাঁওড়ের মুখে কাঁটাভরা বাঁশের জঙ্গল আছে, ওটার পূর্বধারে তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই পশ্চিম থেকে ঢুকবি। পেরিয়ে গেলেই আমাকে পেয়ে যাবি।

—বেশ, তাই হবে।

অস্থির হয়ে বাঁওড়ের দিকে হেঁটে গিয়েছিলুম। কথামতো লালী পুবে চলে গেল। আমি গেলুম পশ্চিমে। তারপর সে এক অনাছিষ্টি কাণ্ড। হাঁটু না ভাঁজ করে বাঁশবনটায় ঢোকা যায় না। কোথাও বুকে হাঁটতেও হল। চার পাশে শুধু থরে থরে তীক্ষ্ণ কাঁটা। কেটে ছড়ে একাকার হল কপাল, চিবুক, হাতের তালু। জামাপ্যাণ্ট ছিঁড়ল। স্যাঁতসেঁতে মাটির কালো রসে সব বিচ্ছিরি হয়ে গেল। তারপর যত এগোই, তত শরীর শিউরে ওঠে। এ কোথায় চলে এসেছি? হাল্কা নীলচে অন্ধকার এক জগতে—যেখানে সরীসৃপদের রাজত্ব। পোকামাকড় ব্যাঙ খরগোশ জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আমাকে দেখছে। সাপের খোলস, ছত্রাক, শ্যাওলা আমার বুকের তলায় জমে উঠছে। মাকড়সার ঝুল আমার সারা মুখে জড়িয়ে গেছে। দেখতে দেখতে ক্রমশ বদলে যাচ্ছি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা—অতি ঠাণ্ডা সবুজ সাপ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে কোথায়। আমি বদলাচ্ছি। নিজেকে দেখতে পাচ্ছি এক হলদে ধূসর নীল লালে বিচিত্র এক গিরগিটি, সারা গায়ে শিহরণের কাঁটা শক্ত আর খসখসে। ভাঙা ডিমের খোলস মাড়িয়ে আমি কোথায় চলেছি, কোন আদিমতম পৃথিবীর দিকে? ক্রমশ আমার পোশাক অসম্ভব ভারি হয়ে এল। ছায়া হতে থাকল ঘনতর। তারপর অন্ধকারে বুকে হেঁটে যেতে যেতে, রক্ত ঝরার তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা পেতে পেতে, চিৎকার করে উঠেছিলুম—লালী! লালী! মনে হল, কোথাও লালীর খিলখিল হাসি শোনা গেল। তারপর সে আমার নাম ধরে ডাকতে লাগল। শব্দটা অনুমান করে এগোলুম। তবু অন্ধকার শেষ হল না। কতক্ষণ কেটে গেল। সময়ের অস্তিত্ব বলতে কিছু আর রইল না। সেই গভীর প্রাকৃতিক অন্ধকারে পথ হারিয়ে আমি ক্রমশ অবশ হয়ে পড়লুম।….

সেবার লালী খবর দিয়ে লোকজন এনে আমাকে খুঁজে বের করেছিল। উদ্ধার করার পর সবাই প্রশ্ন করেছিল—কেন ওখানে ঢুকতে গেলে তুমি? কোন যুক্তিপূর্ণ জবাব দিতে পারিনি। লালীর ব্যাপারে আমাদের প্রচলিত যুক্তির বালাই থাকতে পারে না। শুধু বলেছিলুম—এমনি।

এবং এই ছিল লালীর স্বভাব।

সেই ‘দরকারী কথার’ ব্যাপারটাই ধরা যাক না কেন! আমার কৈশোর থেকে যৌবন সে ওই না-বলা কথাটার জোরে বিভ্রান্ত করে রেখেছিল। তারপর তো কলেজে পড়তে গেলুম। মাঝে মাঝে ছুটিতে গ্রামে আসতুম। লালী যেমন ছিল তেমনি।

সময় হুহু করে চলে যাচ্ছিল। প্রতিশ্রুতি থাক বা না থাক, লালীকে আমার চাই-ই এই গূঢ় প্রতিজ্ঞায় তবু স্থির থেকে গেলুম। তারপর এক পুজোর ছুটিতে গ্রামে আসার পরই হঠাৎ নদীর বাঁধ ভেঙে প্রচণ্ড বন্যা শুরু হল।

বৃষ্টি পড়ছিল ক’দিন থেকে। নদীর জল ব্রিজের কাছে বিপদ-সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল। তারপর এক শেষ-রাতে গ্রামে জল ঢুকতে থাকল। সে এক ভয়ঙ্কর দিন এল গ্রামের। ঘরবাড়ি ধসে পড়ল। পালিত পশু-পাখিরা ভেসে গেল। কিছু মানুষও বেপাত্তা হয়ে গেল। আমাদের মাটির বাড়িটা ধসে গেলে পরিবারের সবাই দয়াময়ের একতলার ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিল। বন্যা এলে দয়াময় তাঁর নিষ্ঠুরতাকে কদিনের জন্যে ছুটি দিয়েছিলেন।

তখন বিকেল। রিলিফের নৌকো আসতে শুরু করেছে। দয়াময়ের এক-তলা চার পাঁচটা ইটের ঘরের ছাদ থেকে আশ্রিতরা নৌকোয় চলে যাছে। আমি লালীকেই খুঁজছি। কোথায় গেল সে?

দয়াময় ক’বার জিজ্ঞেস করলেন—লালীকে দেখেছো অমিত?

—না তো!

—আশ্চর্য! সকাল থেকে তার পাত্তা নেই। শুনলুম বাঁধের দিকে গিয়েছিল—খুব খোঁজা হল, পাওয়া গেল না।

—তাহলে আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে নৌকোয় চলে গেছে।

দয়াময় মাথা নাড়লেন—নাঃ!

লালী বাঁধের দিকে যাচ্ছিল? আমার মধ্যে একটা তীব্র উত্তেজনা জাগল। এক ফাঁকে নিচে নামলুম। কেউ আমাকে কোন প্রশ্নও করল না—কোথায় যাচ্ছি। প্রশ্ন করার এটা সময় নয়।

উঠোনের জল এক-বুক। তীব্র স্রোত ঘুরপাক খাচ্ছে। বেরিয়ে যেতেই রাস্তায় জল বেড়ে গেল। সাঁতার কাটার অভ্যাস ছিল ছেলেবেলা থেকে। নদীর বাঁধের দিকে এগিয়ে গেলুম। চিতসাঁতার দিচ্ছিলুম। স্রোতের সপক্ষে ভেসে যেতে যেতে যখন একটা নিচু জায়গায় পৌঁছলুম, টের পেলুম, বাঁধের এই অংশটাই যা টিকে আছে। জায়গাটা আন্দাজ কুড়ি ফুট-বাই-ছ ফুট এবং লম্বাটে, তার গায়ে অনেক জড়াজড়ি গাছ। তার নিচে ঝোপগুলো ডুবে গেছে। দ্রুত সন্ধ্যা আসছিল। আমি উথাল-পাথাল জলের শব্দের ওপর তীব্র-তীব্র কিছু শব্দ ছুঁড়ে দিলুম—লালী! লালী!

পরক্ষণেই খুব কাছে সাড়া পাওয়া গেল—আছি।

আশ্চর্য! লালী আমার খুব কাছেই একটা হিজল গাছের ছড়ানো ডালে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। ভিজে শাড়িটা গায়ে জড়ানো। শেষ আলোয় ওকে দেখে মনে হল এক প্রাগৈতিহাসিক কোন সত্তা—হয়তো প্রাণী নয়, অন্যকিছু—মানুষের ভাষায় বর্ণনা দেওয়া যায় না।

—লালী! ওখানে কী করছ?

লালী হাত তুলে ডাকল।—চলে এস অমিত।

শশব্যস্তে গাছে ডঠে যেই তার দিকে এগিয়েছি, ও লাফ দিয়ে জলে পড়ল। মুহূর্তের ঝোঁকে আমিও ঝাঁপ দিলুম। ও দ্রুত এগোচ্ছিল। ওকে অনুসরণ করলুম। আর সেই সময় আবার বৃষ্টি নামল। আরও ধূসর হয়ে গেল সব কিছু। তবু মরিয়া হয়ে ওকে অনুসরণ করতে থাকলুম। ডাকলুম—লালী! এই লালী।

লালী বার বার সাড়া দিয়ে গেল।

স্রোতে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ হাতে কী একটা শক্ত ঠেকল। অমনি সেটা ধরলুম। মনে হল একটা প্রকাণ্ড লোহার রেলিং। সেটার ওপর পা রেখে উঠে বসলুম। তারপর শুনলুম লালীর কণ্ঠস্বর।—অমিত!

—লালী!

লালীকে রেলিঙের অন্যপ্রান্ত দিয়ে উঠত দেখলুম। প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে সন্ধ্যার আবছায়ায় ওকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। অবশেষে কাছে এসে বলল—সাঁকোটা উপড়ে গেছে দেখছ? এখানে এসে আটকেছে!

আমরা পাশাপাশি বসে আছি, হঠাৎ লালী বলে উঠল—এই অমিত, আজ তোমাকে সেই পুরনো কথাটা বলব।

আমি ওকে দু হাতে জড়িয়ে ধরেই প্রচণ্ড অবাক হয়ে বললুম—একি লালী! তোমার কাপড়চোপড় কোথায় গেল?

—সাঁতার দেওয়া যায় না। তাই ফেলে দিয়েছি। তুমিও সব ফেলে দাও।

সেই রাতে পৃথিবী আমাদের দুজনকে শোবার মতো একটুও জায়গা দেয়নি। তা পেলে আমরা দুটি প্রাচীন সরীসৃপের মতো অন্ধ ভালবাসায় ঘনীভূত হতে পারতুম।

আমরা সেই রেলিঙে অতিকষ্টে বসে থাকলুম—অনেক অনেকক্ষণ। কথা খুঁজলুম। এবং এক অদ্ভুত বন্য গন্ধে আমাদের শরীরের ভিতরে স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কিছু ফুল ফুটল। নাকি আমাদের দুই সভ্যতাবর্জিত নগ্ন শরীর থেকে অজস্র আঁকুর গজাল শেকড়বাকড়ের ষড়যন্ত্রে? তাই তখন দরকার ছিল একটুকরো মাটি। অথচ কোথাও তখন মাটি নেই।

এক সময় বললুম—লালী, তোমার সেই কথাটা?

—হ্যাঁ, কথা।

বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর খুব আস্তে বলল—কথাটা হয়তো ফুরিয়ে গেছে। নেই আর।

—লালী, হেঁয়ালি করো না!

হঠাৎ সে হেসে উঠল। কথাটা ফুরিয়েছে। তবু কথা আরো থাকে, অমিত। সে কথা শুনতে হলে আরো দূরে যেতে হবে। চলে এস!

সে তক্ষুণি অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে ঝাঁপ দিল জলে। চেঁচিয়ে উঠলুম—লালী!

লালীর ডাক শোনা গেল।—চলে এস!

অসম্ভব। এই দুর্যোগে আর ঝাঁপ দেওয়ার সাধ্য আমার নেই। পারলুম না। কাকুতি মিনতি করে ওকে ডাকতে থাকলুম। ও শুধু দূর থেকে দূরে যেতে যেতে বলল—চলে এস!

আমি রাগ উত্তেজনা দুঃখে অস্থির হয়ে বসে থাকলুম। ওই ডাকে সাড়া দিয়ে এগোবার সাহস আর শক্তিও আমার ছিল না।….

এখন বুঝতে পারি, ওই ছিল লালীর মুখে স্বাধীনতার ডাক। যে স্বাধীনতায় অতিক্রান্ত হয় দিনরাত্রি, সূর্য ওঠে, চাঁদ জ্যোৎস্না দেয়, এই ব্রহ্মাণ্ড চলে যেতে থাকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের ভেগা নক্ষত্রের দিকে, বুদ্বুদের মতো প্রসারিত হয় স্পেস, সময় হয়ে ওঠে গতিবান—আর যে স্বাধীনতায় মাটি ফুঁড়ে উদ্ভিদ আসে, ফুল ফোটে, প্রাণীরা জন্ম নেয়, লালী সেই খাঁটি স্বাধীনতাকে জেনেছিল। তার দিকে চলে যাচ্ছিল আমৃত্যু। ওই যাওয়াই তার জীবন।

হায়, সেই স্বাধীনতার ডাক কেউ শোনে, কেউ জানে—অনেকে শোনে না, অনেকেই জানে না! জন্মের পরই ইতিহাস চোখে পরিয়ে দেয় সভ্যতার ঠুলি।

লালী ছিল আমারই স্বাধীনতার টান। আমি ভাসতে পারিনি। সভ্যতায় আছি। পোশাকে কার্পেটে ফুলদানিতে, পিকাসো রবিঠাকুরে।

—এই ঝোপে লালীর মড়াটা আটকে ছিল।

যেন দয়াময় আবার খুব পাশ থেকে কথা বলে উঠলেন। আবার আমি ঝোপটা দেখতে থাকলুম। দেখলুম, কালো বিষ-পিঁপড়ে, লালপোকা, মাকড়সার জাল, ছত্রাক, সাপের খোলস, শ্যাওলা, ভাঙা ডিম, গিরগিটি, সবুজ সাপের ছায়াধূসর স্যাঁতসেঁতে উর্বর পৃথিবীতে আলুথাল চুলে লালী শুয়ে আছে। ভাঁড়ুলে গাছের নিটোল গুঁড়ির মতো খয়েরি দুই উরু, ‘শঙ্খের মতন করুণ যোনি’, তার ধূসর দুই স্তনের বোঁটায় হাজার-লক্ষ বছরের মানুষের শৈশব জটিল হরফে লেখা। ফিসফিস করে ডাকলুম—লালী!

আর বাঁধের দিকে পরপর দু’বার শব্দ হল। চমকে উঠে দেখলুম, দয়াময় উড়ন্ত পাখির ঝাঁক লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছেন। ঝাঁকটা ভয় পেয়ে আমার মাথার ওপর এসে পড়তেই আমিও ভয়ে মাথা নাড়ালুম। তারপর আড়চোখে দেখি দয়াময় এদিকে বন্দুক তুলছেন। পাখিগুলো দূরে চলে গেল। কাঠ হয়ে বসে আছি। তারপর দয়াময়ের জুতোর শব্দ হল।—এখনও বসে আছ, দেখছি!

—না। ফিরব। আপনি এরই মধ্যে ফিরলেন যে?

—ফিরলুম। তোমাকে একথা কথা বলতে বাকি ছিল।

—বলুন।

—নদীর ধারে সবজিচাষ করত একটা লোক। ওই ওখানটায়। তোমার মনে পড়ে?

—হ্যাঁ। গণেশ রাজবংশী। সে নাকি জ্যোৎস্নায় চরে পরী নামতে দেখেছিল। তার ছেলেকে মনে পড়ে?

—খুব। কী যেন নাম ছিল—

—সীতু।

—হ্যাঁ, সীতু। পাঠশালায় আমাদের সঙ্গে পড়েছিল।

দয়মায় ঘোঁত ঘোঁত করে হাসলেন।—সে রাতে লালী কোথায় যাচ্ছিল জানো? সীতুর কাছে।

আমার সারা শরীর শিউরে উঠল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম ওঁর মুখের দিকে।

—সীতুরা থাকত ওখানেই। আর লালী তাদের খবর নিতে যাচ্ছিল। তাছাড়া আর কী বলব?

—কেন?

—বুঝতে পারছ না কেন? দয়াময় জ্বলে উঠলেন। কয়েক মুহূর্ত চাপা শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ হল। তারপর বললেন—খুব ছেলেবেলা থেকে এটা চলছিল—একটুও তলিয়ে ভাবি নি। ওই শুওরের বাচ্চাটা লালীকে নষ্ট করেছিল। লালীকে সে……

অনেক কষ্ট পাচ্ছেন দয়াময়, তাই কথা আটকে গেল। চোখমুখ লাল হয়ে গেল। হাঁফাতে হাঁফাতে আবার বললেন—পরে গণেশ বলেছিল আমাকে। লালী বন্যার রাতে ওদের কুঁড়েয় যায়। তখন ছোঁড়াটা ছিল না। রিলিফের নৌকো ডাকতে গিয়েছিল গ্রামের দিকে। ওর বাবা গাছের ডালে বসেছিল। অন্ধকারেও ওর চোখে কিছু এড়ায়নি। ও লালীকে টের পেয়েছিল। খুব বকাবকিও করেছিল। কেন এই দুর্যোগে এভাবে এসেছে? তারপর ভদ্রলোকের মেয়ে হয়ে এ কি সর্বনেশে কীর্তি। তারপর—ঘোড়ার মতো মুখ তুলে হাসলেন দয়াময়।

—তারপর?

—তারপর লালী আবার ভেসে যায়। বুড়ো আর ওকে দেখতে পায়নি।

—তাহলে পথে এই ঝোপের মধ্যে…

কথা কেড়ে দয়াময় বললেন—কী ঘটেছিল আমি জানি না। হয়তো কাপড়ে আটকে গিয়েছিল।

—না। ও সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিল তখন।

দয়াময় আমার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকালেন।

—আমার সঙ্গে সন্ধ্যায় ওর দেখা হয়। তারপর ও সাঁতার কেটে ওদিকে চলে গিয়েছিল।

—তুমি জানো, সীতু ছোঁড়াটাকে কী শাস্তি দিয়েছি?

—খুন করেছেন?

—এই ঝোপের তলায় মাটির অনেক নিচে তাকে লালীর জন্যে অপেক্ষা করতে পাঠিয়েছি।

—আর গণেশবুড়ো?

—তাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। মাঝে মাঝে তার কাছে যাই, লালীর কথা শুনতে। লালীর আরেকটা জীবন ছিল। ও জানত, আমি জানতুম না।

—আমি একবার যাব বুড়োর কাছে।

—যেও। তবে কষ্ট পাবে। আমি বাবা। হয়তো কষ্ট পাই। হয়তো কষ্ট পেতেই যাই। তুমি কি কষ্ট পেতে চাইবে লালীর জন্য? তোমাকে তো ও ভালই বাসে নি!

বলে দয়াময় কেমন একটু হাসলেন। তারপর কিছু না বলে হনহন করে মাঠের দিকে এগোতে থাকলেন।

তা হলে সীতুর জন্যই লালী…..আমার গলায় কী আটকে গেল। তাই নিয়ে গণেশ রাজবংশীর কুঁড়েঘরটার দিকে চললুম। আমি লালীর অন্য জীবনের কথা শুনব, যা আমার আজও শোনা হয়নি। সবুজ তেজী উদ্ভিদের ভেতরে এখন বুড়ো চাষা হাঁটু দুমড়ে বসে আছে। আমাকে দেখলে বেরিয়ে এসে ভিজে ধুলোয় ধূসর শরীর ছায়ায় এলিয়ে রেখে ফ্যাকাসে চোখে পৃথিবীর একটা পুরানো গল্প শুরু করবে। সেই গল্পের কোন শেষ নেই। কারণ সেই গল্প লালী নামে এক মেয়ের—যে স্বাধীনতা জেনেছিল।…….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *